Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প547 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯. পারুল সেবার এসেছিল বাপের বাড়ি

    অনেক দিন পরেই পারুল সেবার এসেছিল বাপের বাড়ি। এ পক্ষের আগ্রহের অভাবেই শুধু নয়, নিজেরও আসাটা তার কদাচিৎ হয়, কারণ শ্বশুরবাড়িতে থাকে না সে, থাকে বরের বাড়ি। বরের বদলীর চাকরি এবং বৌয়ের বদলে রাঁধুনী-চাকরের হাতে খেতে সে নারাজ, তাই বৌকে বাসায় নিয়ে গেছে মা বাপের সঙ্গে মতান্তর করে। ছেলে তার বৌকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রাখতে চাইলে কোন মা-বাপাই বা প্ৰসন্নচিত্তে সে যাওয়াকে সমর্থন করতেন তখন? বৌ যদি নাচতে নাচতে বরের সঙ্গে বাসায় যায়, এবং সেখানে পূর্ণ কর্ত্রীত্বের স্বাদ পায়, আর কি কখনো সে বৌ শাশুড়ী পিসশাশুড়ীর ছত্ৰতলে বৌগিরি করতে রাজী হবে? কদাচ না।

    তাহলে আর কি? বাসায় যাওয়া মানেই বৌয়ের পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাওয়া। কি জন্যে তবে ছেলেকে মানুষ-মুনুষ করে বড় করে তুলে তার বিয়ে দেওয়া, যদি ছেলের বৌয়ের হাতের সেবা-যত্নটুকু না পেলেন? কিন্তু পারুলের বর বৌয়ের সেই কর্তব্যের দিকটা দেখেনি, নিজের দিকটাই দেখেছে।

    আর পারুল? পারুলের একটা কর্তব্যৰোধ নেই? অন্ততঃ চক্ষুলজ্জা?

    বকুলের সেই প্রশ্নের উত্তরে পারুল হেসে উঠে বলেছিল, হ্যাঁ, সেটা অবিশ্যি দেখাতো ভালো। আমি যদি শাশুড়ীর পা চেপে ধরে বলতে পারতাম, ওই বেহায়া নির্লজ স্বাৰ্থপরটা যা বলে বলুক, আমি আপনার চরণ ছাড়ব না, তাহলে নিশ্চয়ই ধন্যি-ধন্যি পড়ে যেতো। কিন্তু সেই ধন্যি-ধন্যিটার মধ্যে আছে কী বল? ছদ্মবেশ ধারণ করে ধন্যি-ধনি কুড়োনোয় আমার দারুণ ঘেন্না। তাছাড়া-পারুল আরো একটু হেসেছিল, লোকটাকে দগ্ধে মারতে একটু মায়াও হলো। আমায় চোখছাড়া করতে হলে ও তো অহরহ অগ্নিদাহে জ্বলতো।

    বকুলও হাসে।

    কুমারী মেয়ে বলে কিছু রেখেঢেকে বলে না। আহা শুধু তারই নিন্দে করা হচ্ছে। নিজের দিকে যেন কিছুই নেই। অমলবাবু বাক্স-বিছানা বেঁধে নিয়ে ভাগলবা হলে, তুই নিজে বুঝি বিশ্বভুবন অন্ধকার দেখতিস না?

    তা তাও হয়তো দেখতাম। যতই হোক বেঘোরে বেপোটে একটা পৃষ্ঠবল তো!

    শুধুই পৃষ্ঠবল? আর কিছু নয়?

    আরও কিছু? তাও আছে হয়তো কিছু। চক্ষুলজার মায়াটা কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলে অন্ততঃ রান্নাঘর ভাড়ার-ঘরটার ওপর তো নিরঙ্কুশ কর্ত্রীত্ব থাকে। সে স্বাধীনতাটুকুই কি কম?

    যাঃ, তুই বড় নিন্দেকুটে। অমলবাবু তোকে সর্বস্ব দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে বসে আছেন।

    সেই তো জ্বালা। পারুল কেমন একটা বিষণ্ন হাসি হেসেছিল, সর্বস্ব লাভের ভারটা তো কম নয়। সেটা না পারা যায় ফেলতে, না পারা যায় গিলতে।

    ফেলতে পারা যায় না সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু গিলতে বাধা কি শুনি?

    আরে বাবা ও প্রশ্ন তো আমিই আমাকে করছি অহরহ, কিন্তু উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছি কই? ভারটাই ক্রমশঃ গুরুভার হয়ে উঠছে।…কিন্তু সে যাক, আমার অমলবাবুর চিন্তা রাখ, তোর নির্মলবাবুৰ খবর কি বল?

    আঃ অসভ্যতা করিস না।

    অসভ্যতা কী রে? এতোদিনে কতদূর কী এগোলো সেটা শুনি!

    তুই থামবি?

    পারুল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, হতভাগাটা বুঝি এখনো সেই মা-জেঠির আঁচলাচাপা খোকা হয়ে বসে আছে? কোনো চেষ্টা করেনি?

    গম্ভীর বকুলও হয়েছিল তখন, চেষ্টা করবার তো কোনো প্রশ্নই নেই সেজদি!

    ওঃ, প্রশ্নই নেই? সেই গণ-গোত্র, কুল-শীল, বামুন-কায়েত, রাঢ়ী-বারেন্দ্র? তাহলে মরতে তুই এখনো কিসের প্রত্যাশায় বসে আছিস?

    প্ৰত্যাশা? প্ৰত্যাশা আবার কিরে সেজদি? বসে থাকা কথাটাও অর্থহীন। আছি বলেই আছি।

    কিন্তু ভাবছি অভিভাবককুল তবে এখনো তোকে বাড়িছাড়া করবার জন্যে উঠেপড়ে লাগছে না কেন?

    তা আমি কি জানি?

    .

    বলেছিল বকুল, তা আমি কি জানি?

    কিন্তু সত্যিই কি জানতো না বকুল সে কথা? বকুলের বাবা তাঁর চিরদুর্বল অসহায় চিত্তের সমস্ত আকুলতা নিয়ে ওই মেয়েটাতেই নির্ভর করছেন না কি? বড় হয়ে ওঠা ছেলেরা তো বাপের কাছে জ্ঞাতির সামিল, অন্ততঃ বকুলের বাবার চিন্তা ওর উর্ধ্বে আর পৌঁছুতে পারে না। বিবাহিত ছেলেদের তিনি রীতিমত প্ৰতিপক্ষই ভাবেন। বিবাহিতা মেয়েদের কথা তো বাদ। আপন বলতে অতএব ওই মেয়ে। কুমারী মেয়েটা।

    যদিও মেয়ের চালচলন তাঁর দুচক্ষের বিষ, তবু সময়মত এসে ওষুধের গ্লাসটা তো ও-ই সামনে এনে ধরে। ওই তো দেখে বাবার বিছানাটা ফর্সা আছে কিনা, বাবার ফতুয়াটার বোতাম আছে কিনা, বাবা ভালমন্দ একটু খাচ্ছে কিনা।

    ওই ভরসাস্থলটুকুও যদি পরের ঘরে চলে যায়, বিপত্নীক অসহায় মানুষটার গতি কি হবে? হতে পারে জাত মান লোকলজ্জা, সবই খুব বড় জিনিস, কিন্তু স্বার্থের চাইতে বড় আর কী আছে? আর সবচেয়ে বড় স্বাৰ্থ প্রাণরক্ষা।

    বকুল বোঝে বাবার এই দুর্বলতা।

    কিন্তু এ কথা কি বলবার কথা?

    নাঃ, এ কথা সেজদির কাছেও বলা যায় না। তাই বলে, আমি কি জানি। কিন্তু বাবার এই দুর্বলতাটুকুর কাছে কি কৃতজ্ঞ নয় বকুল?

    পারুল বলে, তাহলে আপাততঃ তোমার খাতার পাতা জুড়ে ব্যর্থ প্রেমের কবিতা লেখাই চলছে জোর কদমে?

    বকুল হেসে উঠে বলে, আমি আবার প্রেমের কবিতা লিখতে গেলাম কখন? সে তো তোর ব্যাপার! যার জন্যে অমলবাবু-

    দোহাই বকুল, ফি কথায় আর তোর অমলবাবুকে মনে পড়িয়ে দিতে আসিসনে, দু-চারটি দিন ভুলে থাকতে দে বাবা।

    ছিছি সেজদি, এই কি হিন্দুনারীর মনোভাব?

    ওই তো মুশকিল। পারুল হেসে ওঠে, কিছুতেই নিজেকে হিন্দু নারীর খোলসে ঢুকিয়ে ফেলতে পারছি না, অথচ খোলসটা বয়েও মরছি। হয়তো মরণকাল অবধিই বয়ে মরবো।

    পারুলের মুখটা অদ্ভুত একটা রহস্যের আলোছায়ায় যেন দুর্বোধ্য লাগছে, মনে হচ্ছে ইচ্ছে করলেই পারুল ওই খোলসটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। বেরোচ্ছে না, শুধু যেন নিজের উপর একটা নির্মম কৌতুকের খেলা খেলে মজা দেখছে।

    অনামিকা ওই মুখটা দেখতে পাচ্ছেন, সেদিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকা বকুলের মুখটাও। বকুল ফর্সা নয়, পারুলের রং চাপা ফুলের মত। পারুলের বর সেই রঙের উপযুক্ত শাড়িও কিনে দেয়। সেদিন পারুল একখানা মিহি চাঁদের আলো শাড়ি পরেছে, তার পাড়াটা কালো চুড়ি। সেই পাড়টা মাত্র খোঁপার ধারটুকু বেষ্টন করে কাঁধের পাশ থেকে বুকের উপর লতিয়ে পড়েছে। পারুলকে বড় সুন্দর দেখতে লাগছে।

    চাঁদের আলো শাড়িতে লালপাড় আরো সুন্দর লাগে। কিন্তু লালপাড় শাড়ি পারুলের নাপছন্দ। কোনো উপলক্ষে এয়োস্ত্রী মেয়ে বলে কেউ লালপাড় শাড়ি দিলে পারুল অপর কাউকে বিলিয়ে দেয়। কারণটা অবশ্য বকুল ছাড়া সকলেরই অজ্ঞাত। কিন্তু বকুল ছাড়া আর কাকে বলতে যাবে পারুল, লালপাড় শাড়িতে বড় যেন পতিব্ৰতা-পতিব্ৰতা গন্ধ। পরলে মনে হয় মিথ্যে বিজ্ঞাপন গায়ে সেঁটে বেড়াচ্ছি।

    ছেলেবেলায় পারুলের এমনি অনেক সব উদ্ভট ধারণা ছিল। আর ছিল একটা বেপরোয়া সাহস।

    তাই পারুল তার বাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, বকুলের তো বিয়ের বয়স হয়েছে, আমাদের হিসাবে সে বয়েস পেরিয়েই গেছে, বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

    পারুল-বকুলের বাবা থতমত খেয়ে বলে ফেলেছিলেন, তা দেব না বলেছি নাকি? পাত্র না পেলে? আমার তো এই অশক্ত অবস্থা, বড় বড় ভাইরা নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যন্ত–

    খুব একটা অশক্ত ছিলেন না ভদ্রলোক, তবু স্ত্রীবিয়োগের পর থেকেই তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে অশক্ত করে তুলেছিলেন। কে জানে কোন মনস্তত্ত্বে।

    হয়তো অপরের করুণা কুড়োতে।

    হয়তো বা সংসারে নিজের মূল্য বজায় রাখতে। কেউ কিছু বলেনি, তবু বুঝি তখন থেকে নিজেকে তাঁর সংসারে অবান্তর বলে মনে হতো, তাই যখন তখন মর-মর হতেন।

    সে যাক, নিজেকে অশক্ত বলে বলে অবশেষে তাই-ই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কথা বললেই কাসতে শুরু করতেন।

    পারুল বলতো, ওটা নার্ভাসনেস, মিথ্যে কাসি কেসে শেষ অবধি—

    কিন্তু পারুল তো অমন অনেক উদ্ভট কথা বলে। সেদিনও বাপের মুখের ওপর বলে উঠেছিল, আপনারা স্রেফ চোখ থাকতে অন্ধ। পাত্র তো আপনার চোখের সামনেই রয়েছে।

    চোখের সামনেই পাত্র!

    পারুলের বাবা আকাশ থেকে পড়েছিলেন, কার কথা বলছিস তুই?

    কার কথা আবার বলবো বাবা? কেন-নির্মলের কথা মনে পড়লো না আপনার?

    নির্মল! মানে অনুপমবাবুর ছেলে সুনির্মল?

    অশক্ত মানুষটা সহসা শক্ত আর সোজা হয়ে উঠে বলেছিলেন, ওঃ, ওই হারামজাদি বুঝি উকিল খাড়া করেছে তোকে? নির্মলের বাড়ি যাওয়া বার করছি আমি ওর!

    আর এখন যায়ও না। তাছাড়া আপনি তো জানেন। পরের শেখানো কথা কখনও কইনা আমি। আমি নিজেই বলছি-

    নিজেই বলছো।

    বাবা বিবাহিত মেয়ে এবং কৃতী জামাইয়ের মর্যাদা বিস্মরণ হয়ে খোঁকিয়ে ওঠেন, তা বলবে বৈকি! বাসায় গিয়েছ, আপটুডেট হয়েছ! বলি ওদের সঙ্গে আমাদের কাজ হয়?

    এই খেঁকিয়ে ওঠাটা যদি পারুলের নিজের সম্পর্কে হতো, অবশ্যই পারুল আর দ্বিতীয় কথা বলতো না, কিন্তু পারুল এসেছিল বকুল সম্পর্কে একটা বিহিত করতে। তাই পারুল বলেছিল, হয় না কথাটার কোনো মানে নেই। হওয়ালেই হয়।

    হওয়ালেই হয়?

    তাছাড়া কি? নিয়ম-কানুনগুলো তো ভগবানের সৃষ্টি নয় যে তার নড়াচড় নেই! মানুষের গড়া নিয়ম মানুষেই ভাঙে।

    বাঃ, বাঃ! বাপ আরো খোঁকিয়ে উঠেছিলেন, বাক্যি তো একবারে মা বসিয়ে দিয়েছে। তা বলি আমি ভাঙতে চাইলেই ভাঙবে? ওরা রাজী হবে?

    যদি হয়?

    হবে! বলেছে তোকে?

    আমি বলছি যদি হয়, আপনি অরাজী হবেন না তো?

    বাপ আবার অশক্ত হয়ে শুয়ে পড়ে বলেছিলেন, আমার আবার অরাজী। রোগা মড়া, একপাশে পড়ে আছি, মরে গেলে একদিন ছেলেরা টেনে ফেলে দেবে। মেয়ে যদি লভ করে কারুর সঙ্গে বেরিয়েও যায়, কিছু করতে পারবো আমি?

    পারুল নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিল ওই বুকে হাত দিয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে নিঃশ্বাস ফেলা লোকটার দিকে। তারপর চলে এসেছিল।

    চলে এসে ভেবেছিল, হালটা কি তবে আমিই ধরবো?

    কিন্তু হাল ধরলেই কি নৌকো চলে? যদি বালির চড়ায় আটকে থাকা নৌকো হয়? তবু শেষ চেষ্টা করে যাব।

    নাঃ, তবু বকুলের জীবন-তরণীকে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে পারেনি। পারুল, শুধু সেবার চলে যাবার সময় বলে গিয়েছিল, তোর কাছে আমি অপরাধী বকুল, শুধু শুধু তোকে ছোট করলাম।…আশ্চর্য ভাবতেই পারিনি একটা মাটির পুতুলকে তুই-

    রোষে ক্ষোভে চুপ করে গিয়েছিল পারুল।

    .

    কিন্তু বকুলের সেই কথাটার শেষটুকু শোনা হল না। সেই মৃদু হাসির উপর রূঢ় রুক্ষ কর্কশ একটা ধাক্কা এসে আছড়ে পড়লো।

    ঘড়ির অ্যালাম!

    নিয়মের বাড়িতে শেষ রাত্রি থেকে কৰ্মচক্ৰ চালু করার জন্যে ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ভারী লক্ষ্মী আর হুঁশিয়ার বৌ নমিতা। ওই অ্যালার্মের শব্দে উঠে পড়েই ও সেই চাকাটা ঘোরাতে শুরু করবে। শীতের দেশ, চাকরবাকররা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে চায় না, অথচ ভোর থেকেই বাড়ির সকলের বেড-টি চাই, গরম জল চাই।

    এ কাজ নমিতাকে কেউ চাপিয়ে দেয়নি, নমিতা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। আত্মপীড়নও এক ধরনের চিত্তবিলাস। এ বিলাস থাকে কারো কারো। কেউ না চাইলেও তারা ত্যাগস্বীকার করে, স্বাৰ্থত্যাগ করে, অপ্রয়োজনে পরিশ্রম করে অহেতুক সেবা করে।

    নইলে অনামিকা দেবীর বন্ধ দরজায় করাঘাত করে বেড-টি বাড়িয়ে ধরবার দরকার ছিল না তার, অনামিকা দেবীর দায়িত্ব তার নয়।

    অ্যালার্মের শব্দে চকিত হয়ে টেবিলে রাখা হাতঘড়িটা দেখেছিলেন অনামিকা দেবী, অবাক হয়ে ভাবছিলেন, আমি কি তবে ঘুমোইনি?

    চায়ের পেয়ালা দেখে আরো অবাক হয়ে ভাবলেন, এ মেয়েটাও কি ঘুমোয়নি?

    বললেন সেকথা।

    নমিতা একটু উদার হাসি হাসলো, ঘুমিয়েছিলাম, উঠেছি। এই সময়ই উঠি আমি। ঘড়িতে অ্যালাম দিয়ে রাখি।

    কেন বল তো? এই অন্ধকার ভোর থেকে এতো কী কাজ তোমার?

    সহজ সাধারণ একটা প্রশ্ন করেন অনামিকা দেবী। নমিতা কিন্তু উত্তরটা দেয় অসহজ। গলা নামিয়ে বলে, থাক, ও-কথা। কে কোথা থেকে শুনতে পাবেন।

    অনামিকা গম্ভীর হয়ে যান।

    বলেন, যাক, আজ আমারও তোমার ওই অ্যালার্মের জন্যে সুবিধে হলো। ছটার সময় তো বেরোবার কথা।

    কয়েক মাইল মোটর গাড়িতে গেলে তবে রেলস্টেশন, আর সকাল সাতটার গাড়ি ধরতে হবে।

    নমিতা কিন্তু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সে কী, আজই চলে যাবেন কি? আরো তো দুদিন ফাংশান আছে না?

    অনামিকা ওর অবোধ প্রশ্নে হাসেন।

    বলেন, কথা তাই ছিল বটে। কিন্তু এর পরও ফাংশান হবে বলে ধারণা তোমার?

    নমিতা মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলে, হবে। কাল আপনি শুয়ে পড়ার পর অনেক রাত্রে সম্মেলনের কারা এসেছিলেন এ বাড়িতে, জানিয়ে গেলেন। আপনি উঠলে যেন বলা হয় অধিবেশন হবে। রীতিমত পুলিস পাহারা বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে।

    পুলিস পাহারা!

    রীতিমত পুলিস পাহারা দিয়ে সাহিত্য সম্মেলন!

    অনামিকা দেবী কি হেসে উঠবেন? না কেঁদে ফেলবেন?

    অবশ্য দুটোর একটাও করলেন না তিনি, শুধু বললেন, না, আমি আজকেই চলে যাবে। সকালের গাড়িতে হয়ে না উঠলে দুপুরের গাড়িতে। হয়ে ওঠা মানে, ওদের তো বলতে হবে।

    হাঁ, চলেই এলেন অনামিকা দেবী। অনেক অনুরোধ উপরোধ এড়িয়ে। পুলিস পাহারা বসিয়ে সাহিত্য সম্মেলনে রুচি হয়নি তার।

    অনুষ্ঠান সমিতির সভাপতি কাতর মিনতি জানিয়েছিলেন, অনিলবাবু যে হাসপাতাল থেকেও অনুরোধ জানিয়েছেন তা বললেন, কিন্তু কিছুতেই যেন পলাতক মেজাজকে ফিরিয়ে অজানতে পাবলেন না। অনামিকা দেবী।

    অবশেষে বললেন, শরীরটাও তেমন-মানে কালকের ঘটনায় কী রকম যেন–

    শরীর বলার পর তবে অনুরোধ প্রত্যাহার করলেন তাঁরা। শরীর হচ্ছে সর্ব দেবতার সার দেবতা, ওর নৈবেদ্য পড়বেই। মন? মেজাজ? ইচ্ছে? অনিচ্ছে? সুবিধে? অসুবিধে? ওদের খণ্ড খণ্ড করে ফেলার মতো সুদৰ্শন চক্ৰ আছে অনুষ্ঠানকারীদের হাতে! শুধু শরীরের কাছে তাঁরা অস্ত্ৰহীন; অতএব অপর পক্ষের ব্ৰহ্মাস্ত্রই ওই শরীর। শুধু নাম করেই ছাড়পত্র পেলেন।

    কিন্তু ওদের, মানে সম্মেলন আহ্বানকারীদের এবার শনি রাহু যোগ।

    সেটা টের পাওয়া গেল কলকাতায় এসে খবরের কাগজ মারফৎ।

    কাগজটা পড়তে পড়তেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল শম্পা শাড়ির কোঁচা লটপটাতে লটপটাতে।

    ও পিসি, পিসি গো, তোমাদের উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনের এই পরিণতি? পুলিসী শাসন ব্যর্থ! স্থানীয় যুবকদের সহিত পুলিসের সংঘর্ষে দুইজন নিহত ও বাইশজন আহত। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি গুরুতর আহত হইয়া হাসপাতালে।…হি হি হি, কী কাণ্ড! কই কাল তুমি তো বললে না কিছু?

    অনামিকা দেবী সেই মাত্র কোনো এক সম্পাদকের তাগাদায় উত্যক্ত হয়ে মনের সমন্ত শক্তি প্রয়োগ করে কলম নিয়ে বসেছিলেন, ওই হি হিতে প্ৰমাদ গুনলেন। সহজে যাবে না ও এখন, জোর তলবে জেরা করে জেনে নেবে কী ঘটনা ঘটেছে আসলে।

    কাণ্ডতে ভারী কৌতূহল শম্পার।

    যেখানে এবং যে বিষয়েই হোক, কোনো একটা কাণ্ড ঘটলেই শাম্প উল্লসিত। আর সেই উল্লাসের ভাগ দিতে আসে মাই-ডিয়ার পিসিকে। অনামিকা দেবী গম্ভীর হতে চাইলেও, সে গাভীর্য ও নস্যাৎ করে ছাড়ে!

    পিসি, শুনেছো কাণ্ড, শিবনাথ কলেজের প্রিন্সিপাল ছাত্ৰগণ কর্তৃক ঘেরাও। বেচারী প্রিন্সিপাল করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে তবে–, হিহি করেই বাকিটা বোঝায়।

    পিসি, জানো কী কাণ্ড। এই সেদিন অতো ঘটা করে বিয়ে করলো ললিতা, এক্ষুনি সেপারেশান, দুজনেই অনমনীয়!.পিসি, যত সব বানানো মানুষ নিয়ে রাতদিন মিথ্যে কাণ্ডকারখানা ঘটাচ্ছে, সত্যি মানুষের দিকে দৃষ্টিই নেই তোমার। পাড়ায় কি কাণ্ড ঘটেছে জানো? অনিন্দবাবুর গাড়ি থেকে সতীশবাবুর প্যাণ্টে কাদা ছিটকেছিল বলে দুজনের তুমুল একখানা হাতাহাতি হয়ে গেছে, এখন দুজনেই কেস ঠুকতে গেলেন।

    এই সব হচ্ছে শম্পার উল্লাসের উচ্ছাস!

    অনামিকা দেবী হতাশ-হতাশ গলায় বলেন, এতো খবর তোর কাছেই কি করে আসে বল তো?

    শম্পা দুই হাত উল্টে বলে, চোখ-কান খোলা থাকলেই আসে।

    ওই সব বাজে ব্যাপারে চোখ-কান একটু কম খোলা রাখ শম্পা, জগতে আরো অনেক ভালো জিনিস আছে।

    ভালো!

    শম্পা এমন কথা শুনলে আকাশ থেকে পড়ে। বলে, ভালো শব্দটার অর্থ কি পিসি? কোন স্বর্গীয় অভিধানে আছে ওটা?…যেগুলোকে তুমি বাজে বলছে, ওইগুলোই হচ্ছে আসল কাজের। এই কাণ্ডগুলোই হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজ, সংস্কৃতি এগুলোর গতিপ্রকৃতি তুমি দেখবে কোথা থেকে, যদি কাণ্ডগুলোকে আমল দেবে না? ডালপালা তো শো মাত্র, কাণ্ডই আসল বস্তু। ওই কাণ্ড!

    স্বভাবগত ভঙ্গিমায় ঝরঝর করে অনেক কথা বলে শম্পা। সব সময় বলে।

    আজও বলে উঠলো, কাল যে বললে, তোমার ভাষণ হয়ে গেছে বলে তুমি আর অকারণে দুদিন বসে থাকলে না! এদিকে এই কাণ্ড? তুমি থাকতেও তো—

    অনামিকা দেবী নিরুপায় ভঙ্গীতে কলমটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলেন, তা কি করবো বলো? তোমার কাছে কাণ্ড আওড়াতে বসলে, আমার আর কিছু কাজ হতো? জেরার চোটে এক কাণ্ডকে সাত কাণ্ড করে তুলতে! কিন্তু সে যাক, কী লিখেছে কাগজে? সত্যিই দুজন নিহত?

    তাই তো লিখেছে-, শম্পা আবার হেসে ওঠে, অবিশ্যি খবরের কাগজের খবর। দুয়ের পিঠে দুই বাইশ হতে পারে। হয় পুলিসী নির্দেশে একটা দুই চেপে ফেলা হয়েছে, নয় ছাপাখানার ভূত একটা দুই চেপে ফেলেছে। হয়তো বাইশজন নিহত, বাইশজন আহত।

    অনামিকা দেবী ওর ওই উথলে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে ঈষং কঠিন গলায় বলেন, সেই সন্দেহ মনে নিয়ে তুমি হেসে গড়াচ্ছে? নিহত শব্দটার মানে জানো না বুঝি?

    এই সেরেছে—, শম্পা তার তিনকোণা চশমার কোণকে আরো তীক্ষ্ণ করে তুলে চোখ উচিয়ে বলে, পিসি রেগে আগুন! মানে কেন জানবো না বাছা, এ যুগে ও শব্দটার মানে তো খুব প্রাঞ্জল হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে একখানা থান ইট তুলে টিপ করে ছুঁড়তে পারলেই তো হয়ে গেল মানে জানা!..সেদিন যেই তুমি বেরোলে…তক্ষুনিই প্রায় ঘটে গেল তো একখানি ঘটনা। পাড়ার ছেলেরা রাস্তার মাঝখানে যেমন ইট সাজিয়ে ক্রিকেট খেলে তেমনি খেলছে, হঠাৎ কোথা থেকে এক মস্তান এসে এই তম্বি তো সেই তম্বি! রাস্তাটা পাবলিকের হাঁটবার জায়গা, ইটের দেওয়াল তোলবার জায়গা নয়, উঠিয়ে নিয়ে যাও ইত্যাদি ইত্যাদি।

    ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে হাতে হাতে প্রতিফল। নেহাৎ বরাতজোর ছিল, তাই কারো ভাবলীলা সাঙ্গ হয়নি, কপাল কাটার ওপর দিয়েই গেছে। তবে যেতে পারতো তো?

    অনামিকা দেবী হতাশ গলায় বললেন, শম্পা, আমাকে এখন খুব তাড়াতাড়ি একটা লেখা শেষ করতে হবে।

    বাবাঃ বাবাঃ, সব সময় তোমার তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করতে হবে! ভাবলাম। এই দুদিনের ঘটনাগুলো বলি তোমাকে। যাকগে, মরুকগে, এই রইল তোমার উত্তরবঙ্গ। পঞ্চম পৃষ্ঠার সপ্তম কলমে দেখুন! আমি বিদেয় হচ্ছি। দুটো কথা কইবারও লোক নেই বাড়িতে। সাধে বেরিয়ে যাই-

    অনামিকা দেবী তো ওকে যেতে দিতে পারতেন। অনামিকা দেবী তো সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে লিখতে বসেছিলেন, তবু কেন ওর অভিমানে বিচলিত হলেন?

    কে জানে কী এই হৃদয়-রহস্য!

    ওর প্রায় সব কিছুই অনামিকা দেবীর কাছে দৃষ্টিকটু লাগে, তবু ওর জন্যে হৃদয়ে অনেকখানি জায়গা।

    তাগাদার লেখা লিখতে সত্যিই কষ্ট হয় আজকাল, সত্যিই জোর করেই বসতে হয়। সে লেখা লিখতে, তবু গা এলিয়ে দিলেন তিনি এখন। বলে উঠলেন, যেমন অসভ্য চুলবাঁধা, তেমনি অসভ্য কথাবার্তা!

    শম্পা টকটিকিয়ে চলে যাচ্ছিল, এ কথায় ঘাড় ফেরালো। সতেজে বলে উঠলো, কেন, খোঁপার মধ্যে কি অসভ্যতা আছে শুনি?

    সবটাই আছে! অনামিকা দেবী তার একটা হাত চেপে ধরে চেয়ারের কাছে টেনে এনে বলেন, কী আছে খোঁপার মধ্যে আমের টুকরি ও গোবরের ঝুড়ি?

    ওর মধ্যে থাকার জনযে বাজারে অনেক মালমশলা বিকোচ্ছে পিসি, কিন্তু কথা হচ্ছে খোঁপার গড়নটা তোমার ভাল লাগছে না?

    লাগছে বললে হয়তো তুই খুশি হাতিস, কিন্তু খুশি করতে পারছি না! ভেবে পাচ্ছিনা তুই এই কিছুদিন আগেও ঘাড়ের বোঝা হালকা করে ফেলি বলে চুল কাটতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলি, নেহাৎ তোর মোর দিব্যি-দিলেশায় কাটিসনি, সেই তুই হঠাৎ স্বেচ্ছায় মাথার ওপর এতো বড় বোঝা চাপালি কি করে!

    চাপালাম কি করে? হি হি হি, কেন পিসি, তুমিই তো যখন আমাকে ছেলেবেলোয় গল্প বলতে, বলেছিলে-যে সুয়োরানী পানের বাটা বইতে মূৰ্ছা গিয়েছিল, সেই সুয়োরানীই ফ্যাশানের ধুয়োয় গলায় সোঁনাবাঁধানো শিল বুলিয়েছিল!

    মনে আছে সে গল্প? অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেন, গল্পগুলো কেন তৈরী হতো। আর বলা হতো, বল দিকি?

    আহা রে! তা যেন জানি না! লোকশিক্ষার্থে, আবার কি? বিশেষ করে মহিলাকুলকে শিক্ষা দিতেই তো যত গল্পের অবতারণা!

    সবই যদি জানিস, এটাও তাহলে জানা উচিত, শিক্ষা জিনিসটা নেবার জন্যেই। ফ্যাশানের শিকার হয়ে মেয়েজাতটা কতো হাস্যাস্পদই হয় ভাব।

    শম্পা অভিমান ভুলে পিসির পাশে আর একখানা চেয়ারে বসে পড়ে বলে, এই খোঁপাটার ব্যাপারে তুমি সেটি বলতে পারবে না মহাশয়া, এ স্রেফ অজন্তা স্টাইল।

    হতে পারে। কিন্তু অজন্তার সেই স্টাইলিস্ট মেয়েরা কি ওই খোঁপার সঙ্গে হাইহিল জুতো পরতো? হাতে ঘড়ি বঁধতো? ছুটোছুটি করে বাস ট্রাম ধরে অফিস কলেজ যেতো? নিজে হাতে ড্রাইভ করে মাইলের পর মাইল রাস্তা পাড়ি দিতো?

    কে জানে!

    শম্পা চেয়ারটার পিঠে ঠেস দিয়ে দোলে।

    কে জানে নয়। দিতো না। সাজের সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য থাকা দরকার, বুঝলি?

    বুঝলাম না-, শম্পা বলে হেসে হেসে, সাজ বজায় রেখেও যদি কাজ করা যায়?

    মানায় না।

    ওটা তোমাদের বদ্ধ দৃষ্টিতে। দৃষ্টি মুক্ত করো মহিলা, দেখবে সামঞ্জস্য কথাটাই অর্থহীন! আশ্চৰ্য, লেখিকা হয়েও কেন যে তুমি এতো সেকেলে! অথচ লোকে তোমার নামের আগে প্ৰগতিশীল লেখিকা বলে বিশেষণ বসায়।

    তাতে তাহলে তোর আপত্তি?

    রীতিমত।

    তবে যা, যারা বিশেষণ বসায়, তাদের বলে দিগে, যেন ওই প্ৰগতিটার আগে একটা অ বসিয়ে দেয়। কিন্তু এই দুদিনের কী খবর বলছিলি?

    থাকগে সে কিছু না।

    বলে শম্পা টেবিলে টোকা দিয়ে সুর তোলে। অথচ মুখের ভাবে ফুটিয়ে রাখে সেটা অনেক কিছু।

    অনামিকা দেবী ওর এ ভঙ্গী জানেন।

    মনে মনে হেসে বলেন, কিছু না? তবে থাক। আমি ভাবছিলাম বুঝি—

    আহা, আমি একেবারে কিছু না বলিনি। বলছি এমন কিছু না। যাকগে, বলেই ফেলি! পরশু ছোঁড়া এক কীর্তি করেছে।

    শম্পা একটু দম নেয়, তারপর ঝরঝরে গলায় বলে, বিয়ে বিয়ে করে আমায় তো পাগল করে মারছিলই, আবার পরশু সোজা এসে বাবার কাছে হাজির। বলে কিনা-আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। বোঝ ব্যাপার!

    শম্পা সহজ হাসি হেসে-হেসেই বলে কথাগুলো, কিন্তু অনামিকা দেবীর হঠাৎ মনে হয় শম্পা যেন ব্যঙ্গহাসি হাসছে। যেন বলতে চাইছে, দেখো দেখো, আমাদের যুগকে দেখো! ছিলো এমন সাহস তোমাদের যুগের প্রেমিকদের? হুঁ! সে সাহসের পরাকাষ্ঠা তো দেবদাস, শেখর, রমেশ মাটির ঘোড়া, স্রেফ মাটির ঘোড়া। ছোটার ভঙ্গীটি নিয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

    মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বহে গেল।

    অন্য অনেক দিনের মতো আজও একবার ভাবলেন অনামিকা দেবী, আমি কি এ যুগকে হিংসে করছি? আমার ওই না-পছন্দটা কি সেই হিংসেরই রূপান্তর?

    কী হল পিসি, আমন চুপ মেরে গেলে যে?

    অনামিকা দেবী কলমটা আবার হাতে তুলে নিলেন এবং যে কথাটা মুহূর্ত আগেও ভাবেননি, হঠাৎ সেই কথাটাই বলে বসলেন, ছেলেটা তো দেখছি ভারী হ্যাংলা!

    কেন বললেন?

    ঠিক এই মুহূর্তে কি সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনাটাই ভাবছিলেন না অনামিকা দেবী?

    ভাবছিলেন না কি, বকুল, তোমার নির্মলের যদি এ সাহস থাকতো?

    কিন্তু শম্পা ওই মনের মধ্যেকার কথাটা জানে না। তাই বলে ওঠে, আমিও ঠিক সেই কথাটাই বলেছি হতভাগাকে। কিন্তু ও যা নাছোড়বান্দা, মনে হচ্ছে বিয়ে না করে ছাড়বে না।

    তোর বাবা কি বললো?

    বাবা? বাবা আবার নতুন কি বলবেন? বাবা মাত্রেই যা বলে থাকে তাই বললেন–বললেন, পাত্র হিসেবে তুমি কী, তোমার চালচুলো কিছু আছে কিনা সে-সব না জানিয়েই হঠাৎ আমার মেয়েকে বিয়ে করবার ইচ্ছে প্ৰকাশ করলেই আমি আহ্লাদে অধীর হয়ে কন্যা সম্প্রদান করতে বসবো, এই কি ধারণা তোমার? তাতে ও–

    তাতে ও কী? ভাবী শ্বশুরকে পিটিয়ে দিয়ে গেল?

    শম্পা হেসে উঠে বলে, অতটা অবিশ্যি নয়, তবে শাসিয়ে গেছে। বলেছে–দেখি কেমন না দেন!

    চমৎকার! কোথা থেকে এসব মাল জোটাস তাই ভেবে অবাক হই!

    ব্যাপারটা কী হচ্ছে জান পিসি-—, শম্পা পা দোলাতে দোলাতে বলে অবস্থাটা মরীয়া। আমি আবার কিছুদিন থেকে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আর একটা ছেলের সঙ্গে চালাচ্ছি কিনা। অবিশ্যি সেটা একেবারেই ফলস। স্রেফ ওর জেলাসি বাড়াবার জন্য—

    ওকে কথা শেষ করতে দিলেন না অনামিকা দেবী, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, আচ্ছা! তোমার ফাজলামি পরে শুনবো, এখন আমায় এটা শেষ করতে দাও।

    শম্পা ঝপ করে উঠে দাঁড়ায়, ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় বলে, আমি চলেই যাচ্ছিলাম, তুমিই ডেকে বসালে!

    তরতর করে নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে।

    অনামিকা দেবীও সেই দিকে তাকিয়ে থাকেন। বন্ধ কলমটাই হাতে ধরা থাকে, সর্বশক্তি প্রয়োগের ইচ্ছেটাকে যেন খুঁজে পান না।

    খুব আস্তে, খুব গভীরে ভাবতে চেষ্টা করেন, এ যুগের কোন কর্নারে আমি আমার ক্যামেরাটা বসাবো? কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি নেবো?…এই বাড়িরই কোনোখানে কোনোখানে যেন এখনো ভাশুর দেখে ঘোমটা দেওয়া হয়, ভাঁড়ারের কোণে ইত্য ঘটপাতা হয়, হয়তো বা বিশেষ বিশেষ দিনে লক্ষ্মীর পাঁচালিও পড়া হয়। অথচ এই বাড়িতেই শম্পা–

    এর কোনটা সত্য?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article প্রথম প্রতিশ্রুতি – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }