Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বনবিবির বনে – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প89 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বনবিবির বনে – ৬

    ৬

    কিছুক্ষণের মধ্যে ঝুরঝুরে বালি পেরিয়ে ঘাসি বনে ঢুকে পড়লাম আমরা।

    নোঙর করা বোটটাকে দেখা যাচ্ছে না আর। তবে অনেক দূর অবধি ওদের কথা শোনা যাচ্ছিল। কত আস্তে কথা বলছিল ওরা, কিন্তু কতদূর অবধি তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। বাসনে-বাসনে ধাক্কা লেগে টুং-টাং আওয়াজ হল, তাও শোনা গেল ‘কতদূর থেকে।

    ছেলেটির নাম সবীর। সে বলল, আমি তুমারে রাস্তা দেখায়ে ঠিক নে যাব। সামনের দিকে চোখ থাকবে আমার, তুমি পাশে আর পিছনে চোখ রেখো।

    তারপর আবার বলল, খুব সাবধান খোকাবাবু!

    ঐ ভয়াবহ পরিবেশে আমার পথপ্রদর্শক পরমবন্ধু হওয়া সত্ত্বেও সবীরের উপর রাগ হল আমার ভীষণ, আমাকে খোকাবাবু বলল বলে।

    কিছুদূর গিয়ে একটা ট্যাকের মতো জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। ঘাসি জায়গাটা। মধ্যে ফাঁকা মাঠ, তাতে ঘাস। তিনদিকে সাদাবানী আর সুন্দরী গাছ আর এক পাশটায় খোলা সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। হলুদ গায়ে কালো বুটি দেওয়া একদল চিতল হরিণ চরে বেড়াচ্ছিল ঘাসিবনে। আমাদের সাড়া পেয়ে টাঁউ টাউ টাউ করে ডাকতে ডাকতে ওরা যেন উড়ে গেল সেই ঘাসে ভরা মাঠের উপর দিয়ে।

    সবীর বলল, একটা মারলে না কেনে গো, মাংস খাওয়া যেভ পেট ভরে।

    আমি ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।

    আজই সকালে ওদের সঙ্গীকে ওদেরই সামনে বাঘে মুখে করে নিয়ে গেল। এই মুহূর্তেও মাটিতে নেমে আমরা দুজনে সর্বক্ষণ প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে রয়েছি। ঠিক সেই সময় গাছ থেকে একটা সরু ডাল ভেঙে কান চুলকোতে চুলকোতে কী করে যে হরিণের মাংস খাওয়ার কথা বলল ও, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি।

    আসলে আমরা অন্য গ্রহের লোক। এই সবীর, শাজাহান, মীরজাফরের মতো বেপরোয়া গরিবদের আমরা চিনি না, কখনও হয়তো তেমন করে চেনার চেষ্টাও করিনি। খাদ্য-খাদক ওদের জীবনে এতখানি স্থান জুড়ে আছে যে, তা ছাড়িয়ে অন্য অনেক বড় কিছুই সে জীবনে প্রবেশাধিকার পায় না।

    সবীর ফিসফিস করে বলল, দাঁড়াও, গাছে উঠে চারদিকে দেখি।

    আমি সাবধানে গাছেব গুঁড়ির আড়ালে পেছন দিকটা কভার করে দাড়ালাম, বন্দুক রেডি-পজিশানে ধরে। সবীর তরতর করে গাছে উঠল।

    হঠাৎ, দূর ব্যাটা! বলল সবীর। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমার সামনেই গাছ থেকে থপ্ করে কী একটা পড়ল। চমকে দেখি একটা সাপ। উলটো হয়ে পড়ল বলে সাপটার পেটের দিকের সাদাটে- সবুজে রঙটা চোখে পড়ল। পরক্ষণেই সোজা হয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে সাপটা প্রচণ্ড বেগে ঘাসবনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    হরিণগুলো দূরে গিয়ে বার বার ডাকতে লাগল। পুরুষগুলো টাউ, টাউ, আর মেয়ে হরিণগুলো টিউ টিউ টিউ করে ডাকছিল।

    সবীর গাছ থেকে নেমে ফিসফিস করে বলল, নাঃ কোনো হদিশই লাই। তারপর বলল, চলো।

    আমি বললাম, আন্দাজে ঘুরে লাভ কী? তার চেয়ে বাঘের পায়ের দাগ দেখে দেখে গেলে ভাল হত না?

    সবীর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল, বাঘের পায়ের দাগ? দেখতে চাও? বলেই, ও বাঁদিকে মাথা নিচু করে কিছু দূরে হেঁটে গেল। তারপর আমাকে বলল, লাও, আশ্ মিইট্যে দেকো।

    দেখি, বালির উপর বাঘেদের প্রসেশানের দাগ। কত বাঘ যে এসেছে, গেছে—তার ইয়ত্তা নেই।

    সবীর আঙুল তুলে বলল, ইখানে দেকো।

    মুখ তুলে দেখি, সেই রাজপথের দুপাশের বড়-বড় গাছের গুঁড়ি বাঘের নখের দাগে ফালা ফালা। বাঘেরা পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামনের পায়ের থাবার নখ ধার করেছে ঘষে ঘষে— নখের মাংস, ময়লা পরিষ্কার করেছে।

    ঐখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার মনে হল যে, মিছিমিছি সময় নষ্ট করছি আমি। এবং হয়তো প্রচণ্ড বিপদের মধ্যেও আছি। সময় খুব কম। ঋজুদাকে খোঁজা আনার কাজ।

    আমি ওকে বললাম সে কথা। —বললাম, এতই যখন তুমি জানো সবীর, ঠিক রাস্তা দেখিয়ে নে চলো তো।

    ও বিড়বিড় করে বলল, সেই চেষ্টাই তো কইরতেছি। কতা কউনি। এক্কেরে চুইপটি মেইরে থাকো।

    কিছু দূর গিয়েই একটা বাঘের টাটকা পায়ের চিহ্ন দেখলাম। খুব বড় বাঘ। মনে হল পুরুষ বাঘ।

    সবীর মনোযোগ দিয়ে চিহ্নটা দেখল। তারপর পায়ে পায়ে এগোতে লাগল চিহ্ন দেখে।

    আমি বললাম, আমি এবার তোমার সামনে যাই?

    সবীর বলল, একদম না। এখানের বাঘে দণ্ডি কাটে।

    মনে পড়ল আমার কথাটা। ঠিক। ঋজুদা আগে বলেছিল যে, এখানের বাঘ শিকারীকে এইভাবে ঠকায়। নিজে গোল হয়ে ঘোরে। শিকারী তার পায়ের চিহ্ন দেখে দেখে যায়, এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে বৃত্তটাকে ছোট করে আনে বাঘ, তারপর নিজের সঙ্গে শিকারীর দূরত্ব কমে এলে এক লাফে পাশ থেকে ঘাড়ে পড়ে।

    সবীর সাবধানে এগোচ্ছিল। আমিও সাবধানেই, এর পেছন-পেছন।

    বাঘের পায়ের দাগ ক্রমাগতই এঁকে-বেঁকে যাচ্ছে দেখলাম।

    ভয় পেয়ে, সবীরকে দাড় করিয়ে বললাম যে, কোথায় ঢুকে পড়ছ দাগ দেখে? আমরা তো আর বাঘ মারতে আসিনি, ঋজুবাবু আর মীরজাফরকে খুঁজতে এসেছি। তুমি নিজেও মরবে, মারবে আমাকেও।

    ও কথা বলতে মানা করল। হাত দিয়ে ইশারা করে।

    ঠিক এমনি সময় আমাদের বোট থেকে খুব জোরে ভোঁ বেজে উঠল এবং একসঙ্গে অনেকে মিলে আমার ও সবীরের নাম ধরে ডাকতে লাগল বোট ও নৌকো থেকে।

    তোমরা কেউ কখনও স্টীমার ও লঞ্চের ভোঁ শুনেছ কি না জানি না। যদি শুনে থাকো, তবে নিশ্চয়ই জানো যে, সেই আওয়াজে কোনো আরোহণ-অবরোহণ নেই। জলের উপর নির্জন জায়গায় তাই ঐ আওয়াজকে কোনো অতিপ্রাকৃত আওয়াজ বলে মনে হয়। একটানা বেজে আওয়াজটা ঝপ করে থেমে যায় একসময়।

    সবীর থমকে দাঁড়াল। চোখে চোখে আমাদের কথা হল। তারপর সবীর বলল, খুব সাবধান। এখন বাঘের পথে পেছন ফিরনু আমরা। পেছনে ও পাশে বড় খর নজর রাইখতে হবে। জানোয়ার বড় ভীষণ। খুউব সাবধান!

    আমি ভাবছিলাম যে, বোট থেকে বুঝি অনেকদূর চলে এসেছি। কিন্তু বোটের ভোঁ বাজতে এবং আমাদের জোরে ডাকাডাকি করাতে বুঝলাম যে খুব দূরে আসিনি আমরা! জঙ্গলে জলের ওপর শহরের লোকের পক্ষে দূরত্ব ঠাহর করা বড়ই মুশকিল।

    জোরে জোরে পা চালিয়ে চলেছিলাম আমরা বোটের দিকে। বার বার দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে মুখ করে চারপাশ ভাল করে দেখ- ছিলাম। যখন আমরা বালির তটের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম তখন সারেঙের উঁচু কেবিনে বসা নীলমণি আমাদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল—এসেছে, এসেছে—বলে।

    ঘাস পেরিয়ে বালিতে নামতেই যে দৃশ্য দেখলাম, তা আর কখনোই দেখতে চাই না এ জীবনে।

    মীরজাফর বালিতে শুয়ে আছে। আস্ত মীরজাফর নয়। আধখানা মীরজাফর। ওর ডান হাত এবং বাঁ পাটা নেই। বালিতে একটা রক্ত- পিশুর মতো পড়ে আছে ও।

    ঋজুদা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের দিকে, মানে আমাদের দিকে মুখ করে। ঋজুদার সারা গা-মাথায় রক্ত। মীর- জাফরকে বয়ে এনেছে ঋজুদা একা-একা কতদূর কে জানে? শাজাহান বুড়ো মীরজাফরের উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে সে যে কী করুণ কান্না কাঁদছে—কী বলব।

    আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণ পরিবেশে বৃদ্ধ বাবার বুকের করুণ আর্তি মুঠো মুঠো করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র থেকে আসা শোঁ-শোঁ হাওয়া।

    শাজাহান মুখ তুলল—দেখি সাদা দাড়ি তার ছেলের রক্তে লাল হয়ে গেছে।

    আমরা কাছে যেতেই ঋজুদা আমাকে খুব সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল, ইডিয়ট।

    রক্তাক্ত মৃতদেহের অংশবিশেষ সামনে নিয়ে তখন আমাদের, মানে জীবন্ত মানুষের নির্বিঘ্নে ফিরে আসা নিয়ে আনন্দ করার পরিবেশ একেবারেই ছিল না।

    শাজাহানকে ঋজুদা জিগ্যেস করল যে, যদি শাজাহান চায় তাহলে বোটে করে মীরজাফরকে ও শাজাহানকে পাঠিয়ে দেবে ওদের গাঁয়ে—ঋজুদা ও আমি থেকে যাব ওদের নৌকো দুটোতে যতক্ষণ না বোট ফিরে আসে। কারণ বাঘের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে ঋজুদাকে কাল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই।

    শাজাহান বলল, কী করতি নে যাব? ওর মাজান তার সাধের পুতের এই মুরতি দেইখ্যে ত’ ভিরমি যাবে। তার চেয়ি ইখানেই আমার বাজানকে কবর দে যাই। একটা বড় সুন্দর গাছ দেখো তুমরা সক্কলে। তার নীচে শুইয়ে দে যাই। যখনই আইসব আবার, যতদিন বাঁচি, গাছটারে দেইখ্যে যাব একবার কইরে—বাতি দে যাব পেরতিবার তার কবরে।

    কাল সকাল অবধি মীরজাফরের মৃতদেহ অমনভাবে ফেলে রাখা যাবে না। পচন ধরবে। তাই ঋজুদা বোট এবং নৌকোর সক্কলকে নেমে আসতে বলল মাটি খোঁড়ার মতো কোদাল, শাবল এবং অন্য যা কিছু আছে সব নিয়ে।

    আমাকে বলল, বন্দুক রেখে আমার ডাবল-ব্যারেল রাইফেলটা নিয়ে আয়। আরেকটা টর্চও।

    তারপর আমি আর ঋজুদা যে বড় কেওড়া গাছের তলায় কবর খোঁড়া হবে বলে ঠিক হল, তার দুপাশে অন্য দুটো বড় গাছে হেলান দিয়ে রাইফেল হাতে করে দাড়ালাম। আমি ঋজুদার থি – সিক্সটি-সিক্স রাইফেলটা নিয়েছি। নেওয়ার আগে রুমাল দিয়ে যতখানি পারি রক্ত মুছে নিয়েছিলাম। তবুও চট্‌ চট্‌ করছিল।

    বোট থেকে পরেশ একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে এনেছে। সেটা ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে খপাখপ মাটি খুঁড়ছে।

    ঋজুদা পরেশকে বলল, অনেকখানি খুঁড়তে হবে রে। নইলে আজ নয় কাল বাঘে খুড়ে বের করে নেবে।

    নিচু গলায় বলল, যাতে শাজাহান শুনতে না পায়।

    কবর খোড়া হয়ে গেল এক ঘণ্টার মধ্যে। সকলে মিলে হাত লাগাতেই তা হল। নীলমণি সারেঙ পর্যন্ত হাত লাগিয়েছিল। শুধু শাজাহানই বসে বসে দেখছিল। ওর শরীরে মনে বল ছিল না।

    তারপর ওরা কোরান থেকে কী সব আবৃত্তি করল। ঋজুদা বোট থেকে তার একটা নতুন ভাগলপুরি চান্দ্র বের করে আনতে বলল গদাধরকে। সেই চাদরে ওডিকোলন ঢেলে তাতে মীরজাফরকে শোওয়ানো হল। মীরজাফরের মুখটা তেমনিই সুন্দর আছে। মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। মাথার চুল পড়েছে এসে মুখের এক পাশে। যেন ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। ঘুমের মধ্যে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে যেন।

    সকলে মিলে হাত লাগিয়ে মীরজাফরকে কবরে নামিয়ে দিল ওরা। তারপর মাটি চাপা দিল। প্রথমে সকলে হাতে করে মাটি দিল। পরে কোদাল দিয়ে।

    কবর দেওয়া শেষ হলে একটা হ্যারিকেনে তেল ভরে সেইটে কবরের উপরে রেখে দিতে বলল ঋজুদা।

    তারপর আস্তে আস্তে ফিরে এসে বোটে ও নৌকোয় উঠলাম আমরা এক এক করে। ফিরে আসার সময় আমি আর ঋজুদা জঙ্গলের দিকে মুখ করে পিছু হেঁটে এলাম। যখন ফিরছি, তখন ট্যাকের ঘাসিবনে চিতল হরিণের ঝাঁক টাউ-টাউ, টিউ করে ডেকে ফিরছিল। জোয়ার তখন ভরা। নদীনালা টইটম্বুর। একফালি চাঁদ উঠেছে। পাণ্ডুর।

    ঋজুদা চান করতে গেল। সারাদিন কিছুই খায়নি বলতে গেলে। গদাধর সকলের জন্যেই রাতে খিচুড়ির বন্দোবস্ত করে রেখেছিল, তাড়াতাড়ি খিচুড়ি চাপিয়ে দিল ও।

    সবীরকে আমি শুধোলাম, গাছের উপর থেকে যে সাপটা নীচে ফেললে তখন, সেটা কী সাপ?

    কে জানে কী জাত? বজ্জাত সাপ হবি। ফোঁস করে ফণা তুলছিল। সাপের গো আমাকে চেনে না। আমার বাবা ছেল সাপুড়ে, কত সাপের বিষদাত ভেইঙেছে সে। এমনভাবে লেজ ধইরে হ্যাচকা টেনে ছুঁইড়ে দিলাম যে, পড়তে পথ পায় না।

    আমি আঁৎকে উঠে বললাম, বিষ ছিল?

    ছেলনি? বিষধর না হলি কি ফণা ধইরতে পারে?

    আমি বললাম, তুমি তো আচ্ছা লোক। আমার প্রায় ঘাড়ে ফেললে এই বিষধর সাপকে?

    সবীর ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করল। তারপর জিভ কেটে বলল, এঃ! বড্ড অন্যায় হইয়ে গেছে তো, তুমাকে কাটতি পারত যি, সি কথা খেয়াল ছেলনি।

    ঋজুদা চান করে উঠে তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে শুয়ে পড়লো। আমাকে বলল, শুয়ে পড়। কাল প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উঠে পড়ব। তারপর নেমে যাব। কাল মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আজ ভাল করে ঘুমো।

    শোওয়ার আগে, ঋজুদা সক্কলকে সাবধানে থাকতে বলল। বোটে ও নৌকোয় হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখতে বলল সারা রাত।

    কেবিনে আমি আর ঋজুদা পাশাপাশি। দুই বার্থে। নৌকো দুটো বোটের সঙ্গে বাঁধা। ওরা সকলেও তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ল। ঋজুদা বলল, তোকে আমি আর কখনও শিকারে আনব না। তোকে নামতে মানা করা সত্ত্বেও তুই নামলি কেন নীচে?

    আমি বললাম, কাল বলব। আজ তুমি ক্লান্ত; ঘুমোও।

    তারপরই, না জিগ্যেস করে পারলাম না বলে, আমি শুধোলাম, কী হল? গুলির শব্দ শুনলাম যে।

    ঋজুদা মন খারাপের গলায় বলল, কী যে হল, বুঝলাম না। হয় মিস্ করেছি, নয়ত গুলি বাঘের গায়ে লেগেছে, কিন্তু ভাইটাল জায়গায় নয়।

    তারপর একটু থেমে বলল, আমি গিয়ে পৌঁছতেই দেখি, মীর- জাফরের ডান হাতটা কামড়ে কেটে নিয়ে ওর পাশে শুয়ে শুয়ে খাচ্ছে বাঘটা। প্রকাণ্ড বাঘ। আমাকে দেখেই তো তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে মীরজাফরের শরীরটাকে তলায় নিয়ে বসে পড়ল মাথা নিচু করে। আমাকে দেখতে লাগল। ও আমার উপর লাফাতে যাবে আমি ঠিক সেই সময় গুলি করলাম। ও লাফানোর পর হয়তো গুলিটা হয়ে থাকবে। খুব সম্ভব চামড়া বা মাংস ঘষে বেরিয়ে গেছে গুলিটা। আমি সামনে সটান শুয়ে পড়তেই আমার মাথার উপর দিয়ে গিয়ে পড়ল হ্যাতালের ঝোপে, তারপর ঝোপ ঝাড় ভাঙতে ভাঙতে লাফাতে লাফাতে গভীর বনে চলে গিয়ে একবার গর্জন করল।

    তোরা শুনেছিলি সে গর্জন?

    আমি বললাম, হ্যাঁ। সক্কলেই।

    ঋজুদা আবার বলল, তখন আমার বাঘের পেছনে যাওয়ার সময় ছিল না। কী করে মীরজাফরকে এনে তার বাবার হাতে দিই সেই চিন্তাই তখন একমাত্র চিন্তা। লোডেড রাইফেল হাতে করে ওকে কাঁধে তুলে এক-পা এক-পা করে সাবধানে এগোই, তারপর একটু গিয়েই নামিয়ে রেখে দম নিই, চারপাশে ভাল করে দেখি, আবার এগোই। এইতেই এত সময় লেগে গেল।

    আমি বললাম, ফোর-ফিফটি ফোর হাণ্ডে ড রাইফেলটা নিয়ে গেলে না কেন? ঐ রাইফেলের গুলি গায়ে লাগলে বাছাধনের নড়তে হত না। ঋজুদা বলল, নিলে হয়তো ভালই করতাম। কিন্তু ভাবলাম, কত মাইল জঙ্গলে কাদায় চলতে হবে তা তো অজানা। অত ভারী রাইফেল বইতে অসুবিধা হবে। তাছাড়া গুলি লাগলে তবে ত!

    আমি আবার জিগ্যেস করতে গেলাম, তাহলে…

    ঋজুদা বলল, এখন আর কথা না। ঘুমিয়ে পড়।

    প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতে স্টোভে চা করে আর তার সঙ্গে কুচো নিমকি দিয়ে গদাধর আমাদের তুলে দিল। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। ঋজুদা-ফোর-ফিফটি ফোর-হাণ্ডে ড রাইফেলটা নিল, আমাকে দিল থ্রি সিক্সটি-সিক্স ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটা।

    বোট থেকে নেমে ম্যাগাজিনে চারটি গুলি ভরে বোল্টটা টেনে চেম্বারে একটা দিয়ে সেফটি ক্যাচটা ঠেলে দিলাম।

    কাল যেখানে গুলি করেছিল ঋজুদা বাঘটাকে, খুব সাবধানে সেখান অবধি গিয়ে পৌঁছতেই সাড়ে-সাতটা বেজে গেল।

    রোদ উঠে গেছে। ঘাসে পাতায় জমিতে যেখানে যেখানে শিশির পড়ে ভিজে রয়েছে সেই শিশিরে রোদ পড়ে ঝলমল করতে লাগল। নানারকম রঙিন পোকা, কাঁকড়া সব এদিকে ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। একটা মাছরাঙা পাখি রাতের আবাস ছেড়ে খালের দিকে উড়ে গেল অদ্ভুত স্বরে ডাকতে ডাকতে। এই সকালে কোনো অঘটন ঘটবে বোধহয়। পাখিটার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যা কখনও আগে লক্ষ্য করিনি।

    আমরা বাঘের রক্তের হদিস পেলাম। পাতায় পাতায় রক্ত লেগে শুকিয়ে আছে।

    ঋজুদা আগে আগে, আমি ঋজুদার হাত দশেক পিছনে। ঋজুদা রক্ত দেখে দেখে এগোচ্ছে, আমি চারপাশ ও পিছনে তাকাতে তাকাতে।

    ঘণ্টাখানেক এগোনোর পর, আশ্চর্য! দেখি, বাঘটা সমুদ্রের মোহনার বালিতে নেমে গেছে। যেখানে নেমেছে, সেখানে বালিতে একটা খুব বড় কুমিরের গা ও পায়ের দাগ দেখলাম।

    ঋজুদা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, কী রে? আহত বাঘ কি শেষে কুমিরের পেটে গেল?

    ঠিক সেই সময় প্রকাণ্ড কুমিরটা জল ছেড়ে আমাদের দিকে মুখ করে ডাঙায় জাগল। কুমির মারার পারমিট ছিল না আমাদের। তাছাড়া ঐ সময় আহত বাঘটা ছাড়া অন্য কোনো-কিছুতে আমাদের আগ্রহও ছিল না।

    ঋজুদা বলল, তাড়াতাড়ি সরে আয়। প্রকাণ্ড কুমির। সাহস দেখেছিস? ডাঙায় উঠে মানুষ নেওয়ার মতলব।

    আমরা তাড়াতাড়ি জঙ্গলের দিকে সরে এসে আবার রক্তের দাগ দেখতে লাগলাম। মিনিট পনেরো এদিক-ওদিক ঘুরে আবার পাওয়া গেল দাগ। বাঘটার বোধহয় পিপাসা পেয়েছিল। নোনা জলই খেয়েছিল। এখানকার বাঘ তো নোনা জলই খায়। কেন এদিকে এসেছিল কে জানে? ঋজুদাকে নজর করার জন্যেও এসে থাকতে পারে।

    পায়ের দাগে বোঝা গেল, সে মুখ ফিরিয়ে আবার জঙ্গলেই ঢুকেছে। সাদাবানী, গেঁয়ো, গরান, হ্যাঁতাল কম এখানে। হ্যাঁতাল যেন জলের কাছেই বেশি হয়। গোলপাতাও। এদিকে বড় বড় কেওড়া গাছ, সুন্দরী, কাঠপুতলি লতা, ঝাকাসুন্দির ঝাড়, ওড়া।

    আস্তে আস্তে রক্তের দাগ ট্যাকের দিকে এগোতে লাগল। কাল আমি আর সবীর যেখানে গিয়েছিলাম। তখনও ট্যাকটা প্রায় দু ফার্লং মতো দূরে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleলবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article কিশোর গল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }