Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বরফকল – ওয়াসি আহমেদ

    ওয়াসি আহমেদ এক পাতা গল্প352 Mins Read0

    আঁধার কালো

    মান্তুর কী কথা—চম্পা চলে আসার সময় আজগর তাকে ‘আটকাইলে পারত’! যেন মান্তুর পথ যেভাবে আজগর আগলেছিল, সেভাবে দুই হাত দুই দিকে মেলে দিলেই চম্পা আটকা পড়ত।

    সেই কবে ঠা ঠা দুপুরে নাকে-মুখে আসমানপোড়া গন্ধ নিয়ে বেরিয়ে আসার পর চম্পা একবারও ফেলে আসা সংসার নিয়ে আফসোসের কারণ দেখেনি। তবে মানুষের মন এক আজব যন্ত্র, চাইলে ইচ্ছামতো চালানো যায়, আবার সময় সময় নিজে নিজে চলে—পেছন দিকেই তার নজর। পেছনের সংসারের নানা ছবি চম্পা না চাইতেই মাথায় ঘুরঘুর করেছে, তবে আশকারা পায়নি বলে টিকতে পারেনি। চলে আসার সময় যেমন একবারও পেছনে চোখ ফেরায়নি, তেমনি পরে কখনো ভাবেনি কেউ তার চলে যাওয়া চোখ তুলে দেখেছিল কি না। সেই পা চালিয়ে হাঁটার রেশ আজও রয়ে গেছে।

    চম্পার মোটেও ইচ্ছা নাই রেশ কাটানোর। তবে কিছু ঘটনা নানা ছুতানাতায় এমনভাবে হাজির হয় যেন তার এত বছরের চালচলনে কাঁটা ফোটানোই তাদের কাজ। জবার ইশকুলে ভর্তি করার সময় বাবার নাম দিতে হবে এ কথা তার মাথায় ছিল না। আগারগাঁও বস্তির ইশকুলে নাম লাগেনি। আম্মা জবাকে সরকারি প্রাইমারিতে ভর্তি করে দিলেন দস্তুরমতো বাবার নাম দিয়ে। আজগরের নাম মোহাম্মদ আজগর না হয়ে আজগর হুসেন, আজগর মিয়া কত কিছুই তো হতে পারত। আশ্চর্য, আম্মা ঠিকই লিখেছেন। চম্পার মনে আছে মুরগির খামারের জন্য ধার নিতে সমিতির খাতাপত্রে মোহাম্মদ আজগর লেখা ছিল। আম্মা বলেছিলেন, ‘জবার বাপের নাম দিলাম মোহাম্মদ আজগর, অসুবিধা নাই তো?’ আম্মা একেক সময় কী বলেন, চম্পার আবার সুবিধা-অসুবিধা! ইশকুলের খাতায় যখন বাবার নাম থাকা নিয়ম, নাম তো দিতে হবে। আম্মাকে যখন বলেছে নাম ঠিক আছে, আম্মা অবাক হননি, বলেছেন নাম এ রকমই হয়। তবে পরে জবা যখন তাকে দেখিয়েছে খাতার পাতাভরা মোহাম্মদ আজগর, সঙ্গে জবার আর তার নাম, চম্পা কী বলবে ভেবে পায়নি। নাম লিখতে ভালো লেগেছিল বলে বারবার লিখেছে?

    বাবা, আবার বাবার নাম—এমন কঠিন প্যাচে চম্পা জীবনে পড়েনি, আর জবার কথা যখন ভেবেছে, মনে হয়েছে জবার জন্য এটা মোটেও প্যাচ না। এই নামের লোকটা তো তার বাবা-ই। কিন্তু চম্পার কাছে ব্যাপারটা প্যাচই। আজগর বলে কেউ ছিল সে মনে করতে চায় না, আবার জবার বাবা আজগর এ কথা তো ভুললে চলবে না, কিছুতেই না। জবার জন্য এর মতো খাঁটি কী আছে!

    সেই বাবার এত দিনে খায়েশ হয়েছে মেয়েকে দেখার, জ্যৈষ্ঠ মাসে মেয়ের তেরো-য় পড়ার পাক্কা হিসাবও মাথায়। চম্পার নিজের হিসাবে গড়বড় হয়; বৈশাখ না জ্যৈষ্ঠ ঠিক মনে করতে পারে না। মেয়ে না হয় বোঝা গেল খাতায় লিখে-লিখে বাপের নাম মুখস্থ করেছে, বাপও কি জপে-জপে জ্যৈষ্ঠ মাসের ঘটনাটাই শুধু মনে রেখেছে, আর কিছু না?

    আজগর আর কিছু মনে রেখেছে কি না এ নিয়ে চম্পার মাথাব্যথা নাই। সে নিজেও কি মনে রেখেছে? কথাটা ঠিক হলো না। মনে আছে, মন থেকে চাইলেও মোছা যায় না, তবে মনে করা অন্য জিনিস। এ কাজ চম্পা করে না।

    .

    ফ্যাক্টরিতে এসে চম্পা দেখল ঝামেলা। দূর থেকে গেটে ভিড়ভাট্টা দেখে খটকা লেগেছিল। হাজিরার সময় কিছুটা ভিড়ের মতো হয়, কিন্তু এ তো রীতিমতো হল্লাগোল্লা। কাছে যেতে শুনল অস্থায়ী শ্রমিক ছাঁটাইয়ের নোটিশ টাঙিয়েছে মালিকপক্ষ। গেটেই নোটিশের কাগজ সাঁটা। হঠাৎ নোটিশ দেখে শ্রমিকরা ঝামেলা পাকাতে পারে এ জন্য হাজিরার আগেই গেট বন্ধ রাখা হয়েছে। ঝামেলার কথা চিন্তা করে পুলিশকেও খবর দিয়ে আনা হয়েছে। পুলিশ অবশ্য বেশি না, ছয়-সাতজনের একটা দল ভিড় থেকে কিছুটা তফাতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। গেট বন্ধ হলেও শুধু যারা স্থায়ী তারাই ভিতরে ঢুকতে পারবে। কিন্তু ইউনিয়নের লিডাররা খবর পেয়ে গেট ঘিরে রেখেছে, কাউকে ঢুকতে দেবে না। মান্তুর কথা মনে পড়ল চম্পার, নোটিশের কোপ মান্ত্রর ঘাড়ে পড়বে—ও তো অস্থায়ী। কিন্তু মান্তু কোথায়? চম্পা বেরোনোর সময় বলল সে আসছে, তার জন্য অপেক্ষা না করে চম্পা যেন চলে যায়।

    অবস্থা দেখে চম্পা আন্দাজ করল ইউনিয়নের নেতারা চাচ্ছে ভিতর থেকে মালিকপক্ষের কেউ এসে তাদের সঙ্গে কথা বলুক। চম্পার মনে হয় না এত সকাল-সকাল মালিকদের কেউ ফ্যাক্টরিতে থাকবে। সে এদিকে-ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে মান্তুকে খুঁজল, না পেয়ে পিছু হটে খানিকটা দূরে রাস্তার দুই পাশে জটলা পাকানো মেয়েদের একটা দলে ভিড়বে বলে পা বাড়িয়েছে এমন সময় মান্তু হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল, ‘আমরার বুজি চাকরি নাই? ফাইজলামি? পারমেন্ট হই আর না হই, কামে লাগানোর সুমায় তো কয় নাই বিনা কারণে ছাটাই করতে পারব। ছাটাইয়ের কারণ দেখান লাগব না? মাগনা?’

    চম্পা দেখল মান্তু একা না, ওর সাথে কয়েকজন মেয়ে, আবার ছেলেও রয়েছে দশ-পনেরোজন। চম্পাকে ফেলে মান্তু দলেবলে গেটমুখো এগোতে লাগল। চম্পা খানিকটা দূরে চেনা-জানা মেয়েদের একটা জটলায় গিয়ে দাঁড়াল।

    এ ফ্যাক্টরিতে এমন ঘটনা চম্পা আগে দেখেনি। হয়তো তার আসার আগে হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ কী এমন হয়ে গেল অস্থায়ীদের বাদ দেওয়ার দরকার পড়ল! গত মাসেও তো কাজের চাপে স্থায়ী-অস্থায়ী সবাইকে দিয়ে ওভারটাইম করানো হয়েছে; এখন অবশ্য কাজ কম, তবে গার্মেন্টের যে কায়দা–এক মাস হালকা গেল তো পরের মাসে নাকে-মুখে করেও অর্ডারের কাজ তোলা মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্য কারণেও আজকের ঘটনা তার হিসাবে মিলছে না। চার বছরের ওপর সে এই গার্মেন্টে, বেতন-ওভারটাইমের টাকা-পয়সা নিয়ে তেমন ক্যাচাল দেখেনি, মালিকদের নিয়ে আকথা-কুকথাও কানে আসেনি। আশপাশের দুই-চারটা ফ্যাক্টরিতে মাঝেমধ্যে অশান্তি হয়, আর আশুলিয়ায়, সাভারে বড়-বড় গার্মেন্টে তো আকসার লেগেই থাকে। মজুরি, ঈদের বোনাস নিয়ে জ্বালাও-পোড়াও, খুন-জখম কিছুই বাদ যায় না।

    গেটের ভিড় থেকে উঁচু গলার কথাবার্তা, তর্কাতর্কির আওয়াজ উড়ে আসছে। মালিকদের কেউ কি রয়েছে ওখানে? মান্তুর দলটাকে দেখা যাচ্ছে না, এতক্ষণে নিশ্চয় ওদের সঙ্গে আরও অনেকে ভিড়েছে। চম্পা এ সময় একটা জিনিস খেয়াল করল, তার মতো স্থায়ী যারা তারা দূরে-দূরে জটলা পাকিয়ে গল্পেসল্পে মেতে আছে, মান্তুরাই শুধু গেটে বা গেটের কাছাকাছি ভিড় বাড়াচ্ছে। দেখে ভালো না লাগলেও কী করা!

    বেলা বাড়ছে। কোনো সুরাহা না হলে এভাবে কতক্ষণ! পুলিশ নিয়ে মালিকরা যেভাবে আগে থেকে তৈরি, চম্পার মনে হয় না গেট আগলে ইউনিয়নওয়ালাদের তর্কাতর্কি বা অস্থায়ীদের মানি না, মানব না-য় কিছু হবে। দরকার পড়বে না ভেবে মাত্র কয়েকজন পুলিশ আনা হয়েছে, ঘটনা খারাপের দিকে গেলে গাড়িভরতি করে আনতে কতক্ষণ! এমন অবস্থায় অন্যরকম ঘটনাও ঘটে। আশুলিয়ায় মাস কয়েক আগে বকেয়া বেতন নিয়ে আন্দোলনের সময় মালিকরা পুলিশ ডাকেনি, পোষা মস্তান দিয়ে কাজ সেরেছিল। দুইজন পুরুষ শ্রমিক মারা পড়েছিল, জখম হয়েছিল কতজন কে জানে! জখমিদের মধ্যে মেয়েরাও ছিল। এখানকার অবস্থা তেমন বাড়াবাড়ির দিকে যাবে মনে হয় না। তারপরও কী হয় বলা যায় না।

    কী করবে! অনেকক্ষণ তো দেখল। বারোটার মতো বাজে। রোদে টেকা যাচ্ছে না, চম্পা মন ঠিক করে ফেলল ফিরে যাবে। কিন্তু এ সময় ঘরে গিয়ে কী করবে! ভাবতে ভাবতে আশপাশে তাকিয়ে দেখল মেয়েদের জটলাগুলো পাতলা হয়ে যাচ্ছে, অনেকে এর মধ্যে চলে গেছে। নাসিমাকে দেখল যাবে বলে কয়েক পা বাড়িয়ে তার দিকে নজর পড়তে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে বলল, ‘আর কী কামে খাড়ায়া থাকবা, লও যাই। আমার আইজ আসাই ভুল হইছে, মাইয়াটার জ্বর দেইখা বারাইছি।’ চম্পা কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগল।

    রোদ কী রে বাবা! মান্তুর জন্য খারাপ লাগছে, ও নিশ্চয় শেষ না দেখে সরবে না। মান্তু যদি মন দিয়ে কাজ করত, এ কয় মাসে স্থায়ী হলেও হতে পারত।

    ওর তেমন গরজ আছে বলে মনে হয় না, তবে যেভাবে তেড়েমেড়ে দলেবলে গেটের দিকে গেল, যে কারো মনে হবে অস্থায়ী হলেও চাকরিটা তার খুব দরকার। জমানো টাকা এখনো কত আছে কে জানে! শাহজাদা ফুসলিয়ে টাকাগুলো হাওয়া করে ফেললে চাকরি ছাড়া তার গতি থাকবে না। বলেছে তো টাকার কথা শাহজাদাকে বলেনি।

    মান্তুর কথা চম্পা ভাবছে ঠিকই, এদিকে কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ না হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। রোদে পা চালিয়ে পথ মনে হচ্ছে শেষ হবে না, বস্তির মুখের চাপা গলি পর্যন্ত রাস্তাটা এত দূরে, কোথাও একটু ছায়া পেলে দাঁড়ালে মন্দ হতো না। নিজে থেকে না দাঁড়িয়ে যদি কেউ এসে পথ আগলে ছায়া খুঁজে দাঁড়াতে বলত!

    ঘরে ঢুকে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে চম্পা ভাবল রোদে হেঁটে চাঁদি গরম হয়ে গেছে, না হলে এমন আজগুবি চিন্তা মাথায় ঢোকার ফন্দিফিকির করে! আর করলেই সে লাই দিতে যাবে কোন আক্কেলে! আজগরকে গত দিন যা বলেছে তাতে মনে হয় না সে আর পথেঘাটে ডাকার সাহস পাবে। জবা ইশকুলে যায় কি না জানতে চেয়েছিল, জেনেছে। ইশকুলের খাতাপত্রে বাবার নাম দেওয়া হয়েছে এ খবর অবশ্য জানে না। আর জবা খাতার পাতা ভরে লিখে বাবার নাম মুখস্থ করেছে এ তো জানার প্রশ্নই ওঠে না। অপেক্ষা করবে নাকি চম্পা পথেঘাটে, যদি আবার দেখা পায়, খবরটা দেবে?

    মাথাটা সত্যি গরম, পানি ছিটানোর পরও আবোল-তাবোল চিন্তা ঘুরছে।

    .

    দুপুর পার করে মান্তু এলো। চম্পা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দরজা খুলে দিতে মা চম্পাকে দরজায় রেখেই পাশ ঘেঁষে দ্রুত ভিতরে ঢুকল। চম্পা পেছন ফিরতেই সে দরজা বন্ধ করতে ইশারা করল। ওর হাবভাবে কিছুটা ভড়কে গিয়ে চম্পা দরজা আটকে বলল, ‘ঘটনা কী? অত পেরেশানি ক্যান, কাম একটা ছুটছে, আরেকটা ধরবি।’ কিন্তু মান্তুর দিকে তাকিয়ে মনে হলো ব্যাপার অন্য কিছু। এ মান্তুকে সে আগে দেখেনি, চোখে-মুখে ভয়, আর পা চালিয়ে বা হতে পারে দৌড়ে এসেছে বলে এত হাঁফাচ্ছে, কথা বলার অবস্থায় সে নাই। বুকে হাত চেপে মেঝেতে বসে জোরে জোরে শ্বাস টানার ফাঁকে মান্তু যা বলল তা হাঁ হয়ে শোনা ছাড়া চম্পা করার কিছু পেল না। মান্তু বলল, ফ্যাক্টরি থেকে চলে আসছে—বস্তির গলির মুখে প্রায় পৌঁছে গেছে—এমন সময় একজনের সঙ্গে দেখা যে তাকে টানবাজারে থাকতে চিনত। পাড়ার এক দালাল, ওখানেই কোথাও থাকত। লোকটা মান্তুকে তার তখনকার নাম বাসন্তী বলে ডেকেছে। ডাক শুনে কিছু না ভেবেই সে লোকটার দিকে তাকিয়েছে। প্রথমে চিনতে পারেনি, তবে বাসন্তী বলে যে তাকে ডাকল আর সেও সাড়া দিল ভাবামাত্র লোকটাকে চিনতে পেরে আর দাঁড়ায়নি, এক ছুটে গলিতে ঢুকে গেছে। ‘আমার অহন কী অইব, হে তো দেখছে বস্তিতে ঢুকতেছি। হে সব খবরাখবর জানে, খুনের ঘটনা তো জানেই। এই হারামি তো পুলিশরে খবর দিব, নিজে যুদি না-ও দেয়, সর্দারনিরে তো ফোনে কওয়া সারা’ কথা শেষ করেই মান্তু তার জিনিসপত্র দলা পাকিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগল।

    চম্পা কিছু বলার না পেয়ে বলল, ‘ব্যাগ গুছাইতেছস ক্যান?’

    মান্তু মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকল। দুই হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে চাপা কান্নার হেঁচকি সামলাতে কিছু সময় নিয়ে বলল, ‘আমারে ধরতে এইখানে পুলিশ আইব। আমার নাম তো জানে না, বাসন্তী বইলা বিছরাইব, এই নামে বস্তিতে কাউরে পাইব না। তুমি ডরাইও না। বাসন্তী নামে কাউরে তুমি চিনো না।’

    তুই কই যাইবি?’

    ‘কই যাই কও, যাওনের জাগা আছে আমার! আমারে কয়টা টেকা দেও।’

    ‘মাথা ঠান্ডা কর, চিন্তা কর কী করবি।’

    ‘সময় নাই গো বু।’

    ‘সত্যই চইলা যাইবি?’

    ‘অহনই, পিছে দিয়া পথ আছে না, ওই পথে বাইরামু।’

    একবার জানতে চাওয়ার পর চম্পা সাহস পেল না জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাবে। মান্তু নিজে থেকে বলল কালাচান্দপুরে ফিলিপ আর অন্তির কাছে যাবে।

    হাজার দুয়েকের মতো টাকা ছিল। মান্তু পাঁচশ-র বেশি নেবে না, বলল তার কাছে কিছু আছে, শেষে চম্পার জোরাজুরিতে আরও একটা পাঁচশ-র নোট নিল।

    মান্তু বেরিয়ে যেতে চম্পা অনেকক্ষণ পাথর হয়ে বসে থাকল। সত্যি সত্যি যদি পুলিশের কাছে খবর চলে যায়, পালিয়ে মান্তু কত দিন! এদিকে তার ছেলে এতিমখানায়, ধরা পড়ে ফাঁসি হলে ছেলেটা খবরও হয়তো পাবে না। মান্তু নিশ্চয় নিজের অপকর্ম লুকাতে ছেলেকে দেখতে চাইবে না। আবদুর রহমান মান্তুর ছেলের নাম মনে হতে বুকে একটা মোচড়ের মতো টের পেল চম্পা। কী একেকটা জীবন মা-রা বাচ্চাদের দিয়ে যায়!

    বাইরে দিনের আলো মরে যাচ্ছে। মাগরিবের আজান হচ্ছে দূরের মসজিদে। ঢেউয়ের মতো কাঁপা-কাঁপা আওয়াজের সাথে ছোপ ছোপ অন্ধকার ঢিলাঢালা হাওয়ায়। পরপরই আসমান দাপিয়ে দূর থেকে কাছ থেকে একের পর এক ঢেউ এক জোট হতে থাকলে চম্পা দেখে ছোপগুলো গায়ে গায়ে চাপাচাপি হয়ে তার চোখমুখ ঢেকে দিচ্ছে।

    অশ্রুদানির শেষ কাহন

    কানে ফোন ঠেকাতে দুর্বল গলায় রেখাবু শোনার পর কয়েক সেকেন্ড সাড়াশব্দ না পেয়ে মনে হলো কান বদলাই, ডান কানে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ শুনতে পাই না। বাঁ কানে ফোন চেপে বারকয়েক শেফালি শেফালি করতে আবার রেখাবু। সপ্তাখানেক আগের ঘটনা। শেফালি বলল, ডাক্তার দেখাতে সেদিনই কলকারচর থেকে ফরিদপুর এসেছে, আগেরবার ডাক্তারের দেওয়া ওষুধে বেশ কিছু দিন ভালো ছিল। আবার ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় খামারি মতি মিয়া তাকে নিয়ে এসেছে। সে আসতে চায়নি, জোর করে নাকি নিয়ে এসেছে। মতি মিয়া তা হলে সেই মোষের খামারি যার পরিবারের সাথে সে থাকে। এতটুকু শুনে আমি দেরি করিনি, বললাম মতি মিয়াকে ফোন দিতে, পরে তার সাথে কথা বলব। পুরুষ গলায় আসসালামু আলাইকুম শুনে যেন কত দিনের পরিচয়, বললাম, ‘মতি মিয়া নাকি?’ জবাবে ‘জি আম্মা’ শুনে আমার ভড়কে যাওয়ার দশা। জানা নাই শোনা নাই, কে আমাকে আম্মা ডাকছে? বলল শেফালিকে সে খালা ডাকে, অনেক দিন তাদের সাথে আছে। আগে কয়েকবার সে-ই আমাকে ফোন করেছিল। বললাম, তুমি করেই বললাম। আমি একটা ফোন নম্বর এসএমএস করে দিচ্ছি। শেফালিকে যেন ওই নম্বরে আজই কথা বলিয়ে দেয়। তার পর শেফালির শরীরের অবস্থা যা বলল তাতে কেন যেন মনে হলো অবস্থা বেশ খারাপ, পেটে একটা ব্যথা অনেক দিন ধরেই ছিল। টোটকা ওষুধে কিছু দিন চাপা থেকে আবার দেখা দিত। কয়েক মাস আগে ফরিদপুর এনে ডাক্তার দেখিয়েছে। পরীক্ষা করে ডাক্তার নাকি বলেছেন ওষুধের ওপরে থাকতে হবে। পুরোপুরি ভালো হওয়ার অসুখ না। অসুখটা খারাপ। খারাপ মানে কতটা খারাপ, অসুখের কি নাম জানতে না চেয়ে হুট করে বলে ফেললাম শেফালিকে কি ঢাকায় আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে? মতি মিয়া একটু সময় নিয়ে বলল, ‘খালা কি রাজি অইব? নেন, খালার লগে কতা কন।’

    শেফালিকে বললাম ঢাকায় চলে আসার কথা। এও বললাম মতি মিয়া তাকে ফরিদপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিলে কাউকে পাঠিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারি। কথা পুরো না শুনেই শেফালি না না করে উঠল। বললাম ঢাকায় এলে ভালো চিকিৎসা হবে, আর চম্পাকে এত দিন পর দেখবে—শুধু কি চম্পা, চম্পার এত সুন্দর মেয়ে, তার নাতনি জবাকে দেখতে মন চায় না? আমাকে দেখতেও কি ইচ্ছা করে না? মরে যে যাব যে কোনো দিন। শেফালির মুখে তারপরও না না। বললাম মতি মিয়াকে চম্পার মোবাইল নম্বর পাঠাচ্ছি। আজই যেন ফোন করে, আর ঢাকায় আসার জন্য যেন তৈরি থাকে। কথা শেষ করে মতি মিয়ার মোবাইলে চম্পার নম্বর টেক্সট করলাম।

    সেদিনই বিকালে চম্পার ফোন, উত্তেজনায় কথা বলতে পারছে না। শেফালির সঙ্গে তার কথা হয়েছে। কথাবার্তা সে-ই নাকি বেশি বলেছে। শেফালি কয়েকবার জানতে চেয়েছে সে কেমন আছে, আমি কেমন আছি। জবাবে সে অনেক কিছু বলেছে—তার নিজের কথা, জবার কথা, আমার কথাও। অসুখের বিষয়ে জানতে চাইলে তেমন কিছু বলেনি, বড় ডাক্তার তাকে দেখেছেন এই পর্যন্তই। এত বছর বাদে গলা শুনে তার নাকি বিশ্বাস হতে চায়নি সত্যিই মায়ের সাথে কথা বলছে। গলাটা একদম অন্যরকম, অবশ্য আগে কেমন ছিল তার মনে নাই।

    এ তো গেল গত সপ্তার ঘটনা, আর গতকাল যে আরেকটা তাক লাগানো ঘটনা ঘটবে বলে তৈরি হয়েছিল, কী করে ভাবব! জাফর সাদেক। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর পর লোকটা আমার কথা মনে রাখবে, ফোন-টোন ছাড়া সোজা এসে ঘরে বসবে, এ তো অকল্পনীয় ব্যাপার।

    চিনতে পারিনি। চেনার কথা নয়। এত বছর পর হাজার চেনা মানুষকেও চেনা যায়? কে না কে এসেছে ভেবে বসার ঘরে ঢুকেছি, সে নিজের নাম ঘোষণা করল। চেহারা মনে থাকলেও কাজ হতো না। কোনো মিলই নাই, তবে নামটা তো মার্কামারা। দেখলাম কুঁজো একটা লোক, গাল-থুতনি ঢাকা সাদা দাড়ি, হাতে আবার লাঠিও। সঙ্গে আরেকজন, নাম বলতে চমকালাম, সেও বুড়ো — মানে বুড়ি, তবে মোটাসোটা বলেই সম্ভবত মুখের চামড়ায় তেমন ভাঁজ-টাজ পড়েনি— ফাহমিদা।

    থতমত খেয়ে চোখাচোখি করে কতক্ষণ! শুরুটা জাফর সাদেকই করল। বলল, ছিয়াত্তরে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, এসেছে দিন চারেক হলো। পঁচাত্তরের পর দেশের অবস্থা বদলে যেতে চলে যাওয়া ছাড়া নাকি উপায় ছিল না। ইংল্যান্ডেই আছে, সঙ্গে ফাহমিদাও। দেশে এসেই ভাবছে আমার কাছে আসবে। বাসা খুঁজতে অসুবিধা হচ্ছিল। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আর দোকানপাটে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে, তবে আমার নাম বলতে লোকজন সাহায্য করেছে। কে একজন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। নিজের কাহিনি অল্প কথায় শেষ করে বলল, আমি নাকি খুব একটা বদলাইনি। চেহারা অনেকটা আগের মতো, তবে বেশি বুড়িয়ে গেছি—এতটা ভাবেনি। ফাহমিদা তার ব্যাগ থেকে মাঝারি সাইজের কফি জার বের করে বলল, ডিক্যাফ, আমার জন্য এনেছে। বলতে চাইলাম আমাকে না দেখে ওরা জানল কী করে এখনো মরিনি! চায়ের কথা বলতে যাব, দুজনই না না করে উঠল। বললাম, কফি, তাতেও না। এবার তবে কী বলি? ভাবিনি বলব, তারপরও মুখ থেকে যা বেরোল তাতে নিজেই চমকালাম, ‘এবার কী প্ল্যান, নতুন কারো ইন্টারভিউ?’ আমার চোখ জাফর সাদেকের চোখে, দেখলাম সেও তাকিয়ে আমার চোখে— কুঁজো ঘাড়ে ঝোঁকানো মাথা সত্ত্বেও চোখ দুটো আমাকে গেঁথে গেঁথে দেখছে।

    খোঁচাটা বেশি হয়ে গেছে দেখে কথা ঘোরালাম। বললাম তার সেই ইন্টারভিউ আজও মানুষের প্রিয়, সরকারি টিভিতে পর্যন্ত দেখায়, তবে পুরোটা না, শেষের কিছু অংশ বাদ দিয়ে। সেই বীরাঙ্গনার কথা কি তার মনে আছে? ইন্টারভিউ একেই বলে, মেয়েটা রাতারাতি দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। জাফর সাদেক চোখ সরিয়ে মুখোমুখি জানালার দিকে মাথা তুলে তাকাল। পরপরই চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘শেফালিকে পাওয়া যাবে?’

    চমকে গেলেও আমি কথার পিঠে বললাম, ‘আবার ইন্টারভিউ?’

    কথা তো না, চাবুক। সেটা কতটা জোরে তার কুঁজো ঘাড়ে পড়েছে বুঝতে চুপ করে অপেক্ষা করলাম। জাফর সাদেক থেমে থেমে বলল আমি তাকে পুনর্বাসনকেন্দ্রে ঢুকতে দিইনি। এ নিয়ে তার রাগ ছিল আমার ওপর। শেফালিকে নিয়ে যখন ভিডিওটা বানায়, সে জানত পুনর্বাসনকেন্দ্র ছেড়ে শেফালি সবে বাইরে এসেছে। ও যেখানে কাজ করত সেখানকার খোঁজ ফাহমিদা এনে দিয়েছিল। তবে ইন্টারভিউয়ের সময় শেফালিকে কিছু বলে-কয়ে দেয়নি, নিজে থেকেই সে কথা বলেছে, আর শেষ কথাগুলো যে এমনভাবে বলবে তার কল্পনায়ও ছিল না। এডিটিং প্যানেলে বসে বারবার কথাগুলো শুনেছে আর ভেবেছে এ তো তারও কথা। ভিডিও হলো, শেফালির ছবি কাগজে ছাপা হলো, শেফালিকে নিয়ে তার বই বেরোল, কিন্তু শেফালিকে খুঁজে কোথাও পেল না। সে ও ফাহমিদা বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেছে, লাভ হয়নি।

    ইচ্ছা হয়েছিল বলি, আমাকে এসব শোনানোর কী মানে! তখনই জাফর সাদেক বলে উঠল সে নাকি দেশের কাগজে পড়েছে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর শেফালির খবর কেউ জানে না।

    সে তা হলে কিছুটা হলেও খবর রাখে। তাতে কি তার জানার কথা নয় তার পাল্লায় পড়েই শেফালি হারিয়ে গেছে। শেফালির দেখা পেলে কী করবে? বলা যায় না দুর্গত বীরাঙ্গনার শেষ পরিণতি দেখাতে আরেকটা ভিডিও বানালে বানাতেও পারে। নাকি টাকা-পয়সা দেবে?

    কিন্তু আমার কাছে কী চায়, ডিক্যাফের বদলে কী সাহায্য? শেফালি আমার সম্পত্তি না যে ওকে সিন্দুকে ভরে রেখেছি, কেউ দেখতে চাইলে বের করব! জাফর সাদেক যদি বিশ্বাস করে তার কারণে শেফালি হারিয়ে গেছে, সে-ই খুঁজুক, সঙ্গে তো আরেকজন রয়েছে যে নাকি তাকে শেফালির খোঁজ দিয়েছিল। ভাবছিলাম আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলাম। জাফর সাদেকের সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি। একটা সময় ছিল যখন ভাবতাম দেখা পেলে তাকে জিজ্ঞাসা করব কেন শেফালির সর্বনাশটা করতে গিয়েছিল। সর্বনাশ ওর আগেই হয়ে গিয়েছিল, তবু নিজের চেষ্টায় দাঁড়াবে বলে যখন বাইরে বেরিয়েছে তখনি খপ্ করে ধরে সর্বনাশের ওপর সর্বনাশ। না হলে ও হয়তো কষ্টেসৃষ্টে টিকে যেত, ওর বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল, সাহস ছিল যা ওর মতো যারা তাদের অনেকেরই ছিল না। এত দিনে কব্জায় পেয়ে কি মুখ বুজে থাকব, জাফর সাদেককে কিছুই বলব না!

    বলেছিলাম। কী করে কয়েকটা বছর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে পালিয়ে থেকেছে। এত বিখ্যাত ও, ধরা না পড়ে উপায় ছিল না। ধরা পড়ত, বাজে মেয়েলোক বলে মারধরও খেত। সাক্ষাৎকারের ভিডিওটা কে না দেখেছে! ভালোবেসে মানুষ ওটাকে বুকে করে রেখেছে—বীরাঙ্গনার এমন তেজি-মায়াবী চোখমুখ, আর শেষ কথাগুলো যে মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছে কে অস্বীকার করবে, তার ওপর নামটাও মনভরানো। মানুষ কী করে ভোলে! এ অবস্থায় মানুষের এত ভালোবাসা নিয়ে সে কী করবে! পালিয়েছে, দুর্গম জায়গা খুঁজে কেটে পড়েছে। তবে তার মেয়ে মায়ের খ্যাতির বিড়ম্বনা বয়ে চলেছে আজও। আগে তার মা পালাত তাকে নিয়ে, এক সময় সে পালাতে শুরু করল তার মেয়েকে নিয়ে। আজও পালিয়েই থাকে।

    জাফর সাদেক একটা কথাও বলেনি, চুপ করে শুনে গেছে। ফাহমিদা একবার কী বলতে মুখ খুলতে সে হাত তুলে থামিয়ে দিয়েছে। একটানা বলতে গিয়ে আমি হাঁফিয়ে উঠছিলাম, গলায় কথা আটকে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম শুধু কথা না, কথার সাথে আরও কত কী গলায় ফুটছে। মূল প্রশ্নটা অবশ্য করা হয়নি— সর্বনাশটা কেন করেছিল?

    এত দিন পর এ প্রশ্ন করার মানে হয় না। করলে সে হয়তো তার পুরনো কথাই শোনাত—ওয়ার ক্রাইমের মতো এত বড় ঘটনা লুকিয়ে রাখাও ক্রাইম। মনে নাই ঠিক, মূল কথা তার এ রকমই ছিল। এ ছাড়া সাফাই তো গাইতেই পারত—সে তার কাজটাকে তখন বড় করে দেখেছে, শেফালির পরিণামের কথা ভাবেনি। এখন সে দুঃখিত, অনুতপ্ত-টপ্ত কি? রিপেনটেন্ট?

    আমার বিরক্ত লাগছিল। শেফালি কোথায়, আর তাকে নিয়ে কী সব ভাবছি! শরীরের কী অবস্থা, কত দিন বাঁচবে কে জানে! ঢাকায় আসার ব্যাপারে যত আপত্তিই করুক, আসতে তাকে হবেই। মতি মিয়া পারলে ভালো, নয় লোক দেখব ওকে নিয়ে আসতে। ফরিদপুর পর্যন্ত এনে দিলে কোনো সমস্যাই হবে না। না হলেও অসুবিধা নাই, মোটামুটি ঠিকানা তো জানা গেছে—কলকারচর বের করতে পারলে খামারি মতি মিয়ার বাড়ি বের করতে কতক্ষণ! অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। জাফর সাদেক হঠাৎ বলে উঠল, অসময়ে এসে আমাকে বিরক্ত করছে। ঠিক আমার মনের কথা। সে বুঝতে পারছিল কথাবার্তা বাড়াতে চাইলে প্রসঙ্গ একটাই থাকবে, তাতে তিক্ততা বাড়বে।

    কিছু সময় চুপ করে থেকে জাফর সাদেক ও ফাহমিদা দুজনই এক সঙ্গে উঠে পড়েছিল। লাঠিতে ভর দিয়ে জাফর সাদেক নিজেকে দাঁড় করানোর সময় ফাহমিদা এগিয়ে গিয়ে তার হাত টেনে ধরল। উঠে দাঁড়িয়ে জাফর সাদেক ঘরের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে কী যেন খুঁজল, না পেয়ে মনমরা গলায় বলল যদি একবার দেখা করতে পারত। শুনে আমি না শোনার ভান করলাম যা তাদের দুজনের দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয়।

    দরজা খোলাই ছিল, ওরা ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছিল দরজার দিকে। জাফর সাদেকের এক হাত লাঠিতে, অন্য হাত ফাহমিদার কাঁধে, আমার হঠাৎ কী হলো, বললাম, ‘কলকারচর, মতি মিয়ার বাড়ি।’ যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া, মুরোদ থাকে তো যাক। পা থামিয়ে, লাঠি থামিয়ে দুজন দাঁড়িয়ে পড়তে আমি এক পা এগোলাম। ওরা ঘুরে আমার মুখে তাকাল। কী করি, বললাম, ফরিদপুর শহর থেকে ট্রলারে যেতে হয়, কলকারচর, ওখানে আছে এক দয়ালু মোষের খামারি, নাম মতি মিয়া, শেফালি ওখানে লুকিয়ে আছে কত বছর-তিরিশ বছর তো হবেই।

    .

    শেফালিকে নিয়ে আমার বলার এখানেই শেষ। শুরু করেছিলাম এই বলে— শেফালির কথা আমি ছাড়া কে ভালো জানে! শুরুটা যেখানে করেছিলাম সেখান থেকে এত দূর আসব ভাবিনি। গতকাল আচমকা জাফর সাদেকের দেখা পেয়ে দীর্ঘদিনের রাগ-ঝাল কিছুটা হলেও ঝাড়তে পেরে মনে হচ্ছে শেফালিকে নিয়ে আর বলার কিছু নাই, অশ্রুদানি হয়ে আমিই-বা আর কত! জাফর সাদেক একটুও উচ্চবাচ্য না করে কান ভরে কথা শুনেছে, কুঁজো ঘাড়ে কথার ভারে সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়েছে কি না সে-ই বলতে পারবে। তবে আমি কী করে অস্বীকার করি মুক্ত-মুক্ত লাগছে! এবার শেফালিকে ঢাকায় আনার পালা। চিকিৎসায় শেফালি সাড়া দেবে কি না কে জানে। তবে এ সুযোগে সে চম্পাকে দেখবে, জবাকে দেখবে। মরার আগে এ সুখ আমার জন্য কম না। আর আমিও ওকে দেখব, কম না। সে কাহিনি শেফালির একার কাহিনি হবে না।

    কেন্দ্রের নানা ঘটনা আজকাল যখন-তখন মাথায় ঘোরে। বয়সই এর কারণ, স্মৃতি হাতড়ানো ছাড়া এক সময় মানুষের করার কিছু থাকে না। আমাকে অবশ্য হাতড়াতে হয় না, ভিড় করে তারা নিজেরাই হাজির হয়, কে কাকে ঠেলে সরিয়ে সামনে আসবে এ নিয়েও যেন প্রতিযোগিতা চলে। জাহাঙ্গীর গেটের ঘটনাটা হঠাৎ হঠাৎ মাথায় দপদপ করে। বাংকারের মেয়েদের নাম ভুলে গেছি, চেহারাও মনে নাই, তবে টেনে তোলার আগে তাদের শীতল, পাথুরে চাউনি আজও আমাকে ভোগায়। অনেক মেয়ের নাম-চেহারা মনে নাই, কারো কারো আছে—মমতা, রুবিনা, মালতী, পিয়াসা, আনোয়ারা, রিজিয়া। মমতা মাঝে মাঝে ফোন করে নেত্রকোনা থেকে। ওর ঘটনা তো বলেছি, বাচ্চা হওয়ার আগে পাগল-পাগল অবস্থায় থাকত, পেটে কিল-ঘুষি মারত, কিন্তু বাচ্চার কান্না শোনার পর তার কী পরিবর্তন! খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন ওর স্বামী ওকে নিতে এসেছিল। আমার জানা মতে ও-ই একমাত্র যে ফিরে গিয়ে তার সংসারে থিতু হতে পেরেছিল। বাকিরা কে কোথায় কী অবস্থায় জানি না। পিয়াসার কথা বেশ মনে পড়ে। ভাই ও বোনজামাইকে বাঁচাতে নিজেকে এক অর্থে মিলিটারির হাতে সঁপে দিয়েছিল। কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখল যারা তার কারণে বেঁচে আছে, তারাই তাকে এড়িয়ে চলে।

    ঘটনা তো একটা-দুটো না, বড় ঘটনার আনাচেকানাচে ছোটখাটো কত কিছু ভিড় করে! আবার বিস্মৃতি থেকেও কেউ কেউ উঠে আসে। বছর দু-এক আগের ঘটনা। ওষুধ কিনতে ফার্মেসির কাউন্টারে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ মনে হলো কে যেন পাশ থেকে শাড়ি টেনে ধরে আছে। প্রথমে গরজ করিনি, পরে বিরক্ত হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি রোরকা পরা এক মহিলা। আপা বলে জিজ্ঞেস করল কেমন আছি। বোরকায় পিটপিটে চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখার উপায় নাই। গলা নামিয়ে কী একটা নাম বলল, চিনতে পারলাম না। তার পর তেমনি নিচু গলায় কী বলল, আশপাশে লোকজনের কথাবার্তায় পুরোটা শুনতে পারিনি, তবে ইস্কাটন ও কেন্দ্র শব্দ দুটো শুনে যা বোঝার বুঝে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত ধরে কথা বলব বলে কাছে ঘেঁষেছি, সে হাত ছাড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো আরও দুজন বোরকাধারীর দিকে ছুটে গেল। মনে আছে যতক্ষণ ওখানে ছিলাম, সে তাকিয়েছিল আমার দিকে। মুখ যদি খোলাও থাকত, এত দিন পরে চিনতে পারা কঠিন হতো।

    কোথায় জানি পড়েছিলাম দুঃখ-কষ্টের দিন পেরিয়ে এলে স্মৃতিতে ডুব দেওয়ায় এক ধরনের সুখ রয়েছে। হতে পারে, সব কষ্ট তো এক রকম হয় না। তবে আজকাল কাউকে কাউকে দেখি এই মেয়েদের নিয়ে লিখতে গিয়ে রীতিমতো ইচ্ছাপূরণের কাহিনি ফাঁদেন, কেউ কেউ তো খোশগল্পেও মেতে ওঠেন। ভেবে পাই না, মনোরঞ্জক কল্পকাহিনিতে কার লাভ! জাফর সাদেকের ওপর আমার যত রাগই থাকুক, একটা কথা বলেছিল একদম খাঁটি। সেই প্রথম দিকে যখন কেন্দ্রে ভিড়বে বলে আমার পিছু নিয়েছিল, তখন কী কথায় একদিন বলেছিল একাত্তরের নেরেটিভে মেয়েদের নির্যাতনের ঘটনাটা চাপা পড়ে থাকার কারণ এটা একটা ন্যাশনাল ট্যাবু।

    আজকাল চম্পার কথা বেশি ভাবি। আশ্চর্য হলেও সত্যি জবাকে নিয়ে যে জীবনটা কাটিয়েছে বা এখনো কাটাচ্ছে তা আগে আমাকে তেমন ভাবায়নি। ওকে বরাবর একটা কথাই বলতাম—ওর জীবন আর ওর মায়ের জীবন এক না, ও কেন মাকে নকল করতে যায়? চম্পা কখনোই তেমনভাবে আমার মনোযোগ কাড়েনি বলে বা হতে পারে তাকে সাহস জোগাতে কথাটা বলতাম, আর এখন যখন ভাবি পরিষ্কার বুঝতে পারি কথাটা অসত্য। আমারই ব্যর্থতা, না বোঝার ফল। জবা কয়েক দিন আগে চম্পাকে নিয়ে প্রশ্ন করে আমাকে বিপাকে ফেলেছে।

    একটা বিষয় ইদানীং মাথায় খুব ঘোরে। বেশি তো না, সব মিলিয়ে সাড়ে চার বছরের মতো পুনর্বাসনকেন্দ্রে জড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু এই অল্প সময় আমার পেছনের ও পরের অনেক কটা বছরকে যেন পর্দা টেনে আড়াল করে রেখেছে। মাঝে মাঝে হিসাব করতেও বসি, সত্যি সাড়ে চার! অনেকে বলেন ছোটবেলার স্মৃতি তরতাজা হয়ে টিকে থাকে, অনেক তুচ্ছ ঘটনাও বাদ পড়ে না। আমার প্রায় আশি বছরের জীবনে এই সাড়ে চার বছর কৈশোর, যৌবন এমনকি প্রৌঢ়ত্বেরও অনেক কিছু ধুলিধূসর বিস্মৃতিতে ঠেলে দিয়েছে। পেছনের ও পরের অনেক ঘটনা মনে করতে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। আজ মনে হয় সেই সাড়ে চারের প্রতিটা বছর, মাস, দিন, ঘণ্টা ক্যালেন্ডার বা ঘড়ির কাঁটা মেপে আসেনি, এসেছে হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে—শক্ত আঠায় সময়কে কখনো কষে আটকে, কখনো টেনে লম্বা করে চাদরের মতো আমাকে ঢেকে রেখেছে। আমি চাইলেও বেরোতে পারি না, চাইও না।

    বিভ্রম, না টানাপড়েন

    চার দিন হয়ে গেছে, মান্তুর খবর নাই। চম্পা কয়েকবার ওর মোবাইলে চেষ্টা করেছে, মোবাইল বন্ধ। অন্তি নামে ফিনিশিংয়ের গারো মেয়েটাকে খুঁজে মান্তুর খবর করবে কি না ভেবেছে, কিন্তু কেন জানি মনে হয়েছে মান্তু ওখানে যায়নি। গেলে অন্তিই ওকে খুঁজে বের করত। আর কোথায় যেতে পারে চম্পার ধারণা নাই। বাড়িতে যেতে পারে? মনে হয় না। এমন কি হতে পারে যে লোকটা ওকে চিনেছে সে বস্তির আশপাশেই ছিল, মান্তু চোরা পথে বের হলেও তার নজর এড়াতে পারেনি, ধরা পড়েছে—লোকটার হাতেই না, পুলিশের হাতেও? ভাবতে গেলে কুচিন্তাগুলোই মাথায় চক্কর কাটে।

    এর মধ্যে আবার আজগর। চম্পা ভেবেছিল সাফ সাফ বলে দেওয়ার পর সে আর সামনে পড়বে না। সামনে ঠিক পড়েনি, গত পরশু কাজ থেকে ফেরার সময় বস্তির মুখে চম্পা তাকে দেখেছে এক চা-দোকানের বেঞ্চে বসে থাকতে। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেও এক নজর তাকিয়ে চম্পার ধরতে অসুবিধা হয়নি। মনে হয় না আজগর তাকে দেখেছে। চম্পা জানে ঝামেলা পাকানোর মতো অবস্থা আজগরের নাই, সেই সাথে তার মন বলে ঝামেলা পাকিয়ে তাকে মুসিবতে ফেলতেও আজগর চাইবে না। তবে শুধু জবাকে দেখবে বলে সে এত উতলা হয়ে আছে, এ-ই বা কী করে বিশ্বাস করে! না কি বলতে পারছে না, মনে মনে অন্য মতলব? মান্তু থাকলে বলত চম্পাকে দেখতেই তার আসা, এজন্যই পথেঘাটে ঘোরাঘুরি!

    আগে যে দুইবার দেখা হয়েছে, চম্পার তেমন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু শেষবার দেখার পর বসার ধরনটা তার মাথায় রয়ে গেছে। দেখা হলে কী বলত, পুরনো কথাই—একবার জবাকে দেখতে চায়? কিন্তু চম্পা যা বলার কড়া গলায় বলে দিয়েছে। বোকাসোকা তো না যে কথা বুঝবে না। তার ওপর শরীরের যে অবস্থা, খামোখা ঘোরাঘুরিতে শরীর আরও খারাপ হবে এও না বোঝার কথা না। ক্যানসারের কথা যে সেদিন বলল, সেটা হতে পারে চম্পার মন গলাতে। না-ও যদি হয়ে থাকে, শরীর যে তার খারাপ দেখেই বোঝা গেছে, আর এ অবস্থায়ই পথেঘাটে ঘুরছে। সত্যিই যদি ক্যানসার হয়ে থাকে তা হলে এই ঘোরাঘুরিতেই আজগর শেষ হয়ে যাবে?

    কী সব ভাবছে! এক চিন্তা থেকে হুট করে অন্য চিন্তা যে মাথায় ঢুকে পড়ে এ কীসের লক্ষণ? আজগরকে নিয়ে ভাবাভাবি তার কাজ না। আজগরের ওপর তার কোনো নালিশ নাই। তার ঘটনা জানাজানির পর সে কী করে আজগরের বাড়িতে থাকত! আজগর তাকে কিছু বলেনি, বললেই কী হতো? তার ও আজগরের ঘটনা ওই সময়ই শেষ হয়ে গিয়েছে; কিন্তু মাঝখানে যে আরেকজন—জবা, যে বাপের নাম খাতায় লিখে লিখে মুখস্থ করেছে! চম্পা তো ভাবতে পারে না বাবা কাকে বলে, কোনো দিন ভাববার ফুরসতও পায়নি। জবার বাবা বলে একজন রয়েছে, না দেখলেও জবা জানে আছে একজন। সেই একজন যদি মেয়েকে দেখতে এতই উচাটন—তাও দূর থেকে মাত্র এক নজর, তাতে দেখার সাধ মিটবে?

    প্রশ্নটা মাথায় আসামাত্র চম্পা যেন খানিকটা বেকায়দায় পড়ল। জবা যখন পড়া মুখস্থ করার মতো নামটা জপে জপে শিখেছে, এবার না হয় দেখুক বাবা বলে কুঁজো, কাঁপা-হাত, কাঠি-কাঠি লোকটাকে! খাতায় নাম লিখে অজানা-অচেনা একটা মুখ কল্পনা করার চেয়ে সত্যিকারের লোকটাকেই দেখুক—দূর থেকে না, কাছে থেকেই দেখুক। আজগরের এখন যে চেহারা বা শরীরের হাল, একবার দেখলেই জবার মাথায় পাকাপাকি বসে যাবে, সারা জীবন মনে থাকবে। স্মৃতি হিসাবে বাবার মুখটা মাথায় থাকা মন্দ না। চম্পা অন্য কথাও ভাবে, বাবা বলে এমন একটা ভাঙাচোরা মুখ, কুতকুতে এক জোড়া চোখ জবার মাথায় বসিয়ে দিয়ে তার কী ফায়দা! জবা তো কোনো দিন জানতে চায়নি বাবা লোকটা দেখতে কেমন। না কি লোকটা যে সত্যি সত্যি জবার বাবা, জবাকে তা দেখানো, দেখিয়ে বিশ্বাস করানোও একটা কাজ!

    ওলটপালট চিন্তায় মাথাটা ভারী। সুযোগ পেলেই তাকে বেদিশা করতে ফিকিরবাজির শেষ নাই।

    আজগরের বসার ধরনটা মাথায় রয়ে গেলেও চম্পা জানে তার করার কিছু নাই। তবে লোকটা যদি কাল বা পরশু তার সামনে পড়ে, আর মুখ তুলে কিছু বলতে চায়, সে না হয় তাকে দয়া করবে, শুনবে কী চায়। জবার কথাই বলবে, আর কী বলতে পারে, চম্পার তা হলে এখনই ঠিক করে ফেলা দরকার সে কী বলবে। কিন্তু আজগর যদি অন্য কিছুও বলে? যদি বলে বসে সে কেমন আছে?

    চম্পা জানে এত সাহস তার হবে না, কিছুতেই না।

    .

    সাহস আজগরের হবে না, চম্পার এ ধারণা যত পাকাপোক্তই হোক, বাস্তবে যে সে নিজে একটা ভজকট বাধিয়ে বসবে কী করে জানবে! দিন তিনেক আগে ঘরে ফিরছে, বিকালের আলোয় আকাশ সাফসুতরা, গলিতে ঢুকতে হালকা হল্লাগোল্লা শুনে তার নজরে পড়ল জনাচারেক লোক জটলা পাকিয়ে কাকে যেন জোর গলায় কী সব বলছে। যাকে বলছে তাকে দেখা যাচ্ছে না। চম্পা জায়গাটা পার হতে যাবে এমন সময় কী খেয়ালে এক নজর চোখ ফেলতেই পা দুটো আটকে গেল। জটলার মাঝখানে একটা লোক মাটিতে উবু হয়ে বসা, আর মাথা নিচু করে থাকার পরও সে যে আজগর, চম্পার ধরতে এক পলকই যথেষ্ট। সে পা বাড়িয়ে জটলার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শুনল লোকটা কয়েক দিন ধরে বস্তিতে ঘোরাফেরা করছে, কী মতলব কে জানে, সন্দেহ হওয়ায় লোকজন জেরা করছিল, পরিষ্কার কিছু বলছে না। ‘উনারে ছাড়েন, বিমারি মানুষ’ বলে চম্পা জটলার কাছাকাছি হতে, আর তখনি আজগর মুখ তুলে তাকাতে সে যেন বলার আরও কিছু পেল। ‘উঠেন’ বলে আরও সামনে পা বাড়াতে আজগর মাটিতে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। জটলায় লোক বাড়ছিল, কে কী ভাবছে চম্পার মাথায় ছিল না; পরে মনে হয়েছে পা দুটো যে তাকে টেনে নিয়ে গেল, আর মুখ থেকেও যা বেরোল সেসব তার না। কে হতে পারে যে তাকে হাঁটিয়েছে, মুখে কথা ফুটিয়েছে!

    ঘরমুখো হাঁটা শুরু করতে আজগরকে আর কিছু বলতে হয়নি, সে তার পিছু পিছু হেঁটে ঘরের দরজায় গিয়ে থেমেছে। চম্পা তালা খুলে ভিতরে ঢুকতে সেও ঢুকবে কি না এ দোটানায় খানিকটা সময় নিয়েছিল। যেন অপেক্ষা করছিল চম্পা ডাকলে ভিতরে যাবে। মুখে চম্পা কিছু বলেনি, ভিতর থেকে দরজার পাট দুটো মেলে ধরতে, সেটাকেই চম্পার কথা ভেবে সে ধীরে ধীরে পা বাড়িয়েছিল। বাইরে তখনো দিন শেষের নরম আলো, ঘরে বাতি জ্বালিয়ে চম্পা একটা মোড়া ঠেলে দিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলেছিল। ঘরে ঢুকে প্রথমে সে এ কাজটাই করে। সেদিন তা করলেও নিজের মুখে না ঠেকিয়ে গ্লাস বাড়িয়েছিল আজগরের দিকে। গ্লাসটা আজগর তার কাঁপা-কাঁপা ডান হাতে নিয়ে অন্য হাতে ঠেকনা দিয়ে পানিটুকু খেয়েছিল।

    মারমুখী জটলা থেকে বাঁচিয়ে ঘরে এনে বসিয়ে পানি খাওয়ানোর পর কী করার থাকে! চম্পা ভেবে উঠতে পারছিল না এর পর কী। আজগর সেদিনের মতো পকেট থেকে লাল রঙের চারকোনা ছোট কৌটাটা বের করে পাশেই চৌকির ওপরে রেখে আস্তে বলেছিল, ‘তুমার জিনিস। আর তো কিছু নাই।’ বলেই তার হয়তো খেয়াল হয়েছিল মোড়া এগিয়ে দিলেও চম্পা চায় না সে এভাবে বসে থাকুক। উঠে পড়তে যাবে, চম্পা ধমকে উঠেছিল, ‘কই যান, ভাত দিতাছি।’ বলেই মুশকিলে পড়েছিল, চাল না ফুটিয়ে ভাত দেয় কী করে!

    জবাবের অপেক্ষা না করে সে চুলা ধরিয়ে চাল ধুতে বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে অল্প জায়গায় যতটা সম্ভব সরে বসে আজগরের দিকে পিঠ দিয়ে রান্নায় মন দিয়েছিল। ভাত চড়ানোর পর করার কিছু থাকে না, তবু তার মনে হয়েছিল মনোযোগটা ভাতের হাঁড়িতে দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। সে জানতে চায় না আজগরের কী অসুখ, বস্তিতে যে ঘোরাঘুরি করে, থাকে কোথায়? এসবের চেয়ে কী দিয়ে ভাত দেয়, এ চিন্তাই তার মাথায় ঘুরছিল। আগের রাতে শিং মাছ দিয়ে কাঁচকলা রান্না করেছিল, সকালে খাওয়ার পর একটুখানি যা ছিল গরম করে রেখে গিয়েছিল, ভালো আছে কি না কে জানে! তার চেয়ে একটা ডিম ভেজে দেওয়াই ভালো। হাঁসের ডিম।

    কত সময় নিয়ে যে ভাত রেঁধেছিল, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচামরিচ, লবণ মাখিয়ে ডিম ভেজেছিল চম্পা বলতে পারবে না। মান্তু যাওয়ার পর নিজের জন্য রাঁধতে একদম ইচ্ছা করে না, গতকালই কেবল কী মনে করে ফেরার সময় কাঁচকলা আর কয়েকটা আধমরা শিং মাছ এনেছিল।

    ভাত বেড়ে বসা থেকে পিঠ ঘুরিয়ে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে আজগর কাঁপা হাতের সাথে অন্য হাত মিলিয়ে থালাটা নিয়ে যেন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। চম্পা উঠে গিয়ে কলতলায় মুখ-হাত ধুতে যত বেশি সময় পার করা যায় করেছিল। ফিরে এসে দেখেছিল চেটেপুটে থালা শেষ করে আজগর চোখ ঘুরিয়ে তার ঘর দেখছে।

    চম্পার তখন চিন্তা—এবার কী? জবাকে দেখার আবদার, না আর কিছু? সে ঠিক করে রেখেছে, জবার কাছে জানতে চাইবে সে তার বাবাকে দেখতে চায় কি না। ব্যাপারটা জবার ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। আজগর যদি জবার কথা তোলে, সে এ কথাই শোনাবে। জবার কারণেই যদি তার ঘোরাফেরা, বস্তির মানুষের হাতে হেনস্তা হওয়া, তা হলে তো আর কিছু বাকি থাকে না। না কি আরও কিছু আছে, লোকজন যে বলেছে মতলব, সে রকম কিছু? কিংবা চম্পার মনে যে ধুকপুক—যদি বলে বসে সে কেমন আছে?

    চম্পার ধারণা ঠিক। সাহস হয়নি আজগরের। চম্পাকে ফিরতে দেখে সে উঠে পড়েছিল। ‘যাই’ বলে আস্তে পা ফেলে উঁচু চৌকাঠ পাড়ি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আসমানে সবে ঘোলা চাঁদ উঠেছে, আর ঘরে ঘরে বাতির কারণে গলির চাপা পথটাকে পরিষ্কার দেখাচ্ছিল।

    দিকচিহ্নহীন

    স্পিডবোট বলতে আরও ছোটখাটো জিনিস ভেবেছিলাম। দেশে এক সময় যা দেখেছি তাতে সে রকমই ধারণা হয়েছিল। এটা দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা, আবার পানি থেকে উচ্চতায় প্রায় ছোটখাটো লঞ্চের মতো। স্টিলের বডি হলেও দেখে ঠিক ভরসা জাগে না। মাথায় গামছাবাঁধা মাঝবয়সি যে লোকটা চালাচ্ছে সে কাজ করে ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডে, বোর্ডের অফিসাররা এতে করে কাছাকাছি বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাজ তদরকিতে যান। সাড়ে তিন-চার ঘণ্টা পদ্মায় ঢেউ ভাঙার তাকদ এর আছে কি না এ নিয়ে সন্দেহের কথা মুখ ফস্কে বলে ফেলতে লোকটা খুব একটা পাত্তা দেয়নি, বলেছে অসুবিধা হবে না। তবে এও বলেছে এ সময় পদ্মা তো নদী না, সাগরই বলা উচিত, ঝড়-বাদলায় পড়লে নদী আর সাগরে তফাত কী!

    অনেক চেষ্টার ফল এই বোট। প্রথমেই শুনেছিলাম ট্রলার ছাড়া যাওয়ার উপায় নাই, লঞ্চের খোঁজ-খবর করে জানা গেল শুকনার মৌসুমে রিজার্ভ লঞ্চ পাওয়া যায়—এক তলা ছোট লঞ্চ। সুবিধার লঞ্চ পাওয়া যায়নি। একটা যা-ও পাওয়া গিয়েছিল, সেটার কিছু মেরামতি বাকি। মালিক ভরসা দিয়েছিল এক-দুই দিনে কাজ সেরে ফেলবে। কিন্তু লঞ্চ দেখে আমার বা ফাহমিদার মন ওঠেনি। শেষে ফাহমিদার এক আত্মীয় ওয়াটার বোর্ডে যোগাযোগ করে বোটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বোটে ক্যানভাসের ছাউনি থাকায় ভরসা, তবে এতে রোদ অনেকটা আড়াল করা গেলেও বৃষ্টি ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না।

    মিনিট পাঁচেকে ঘাট পেছনে ফেলে বোট পুরোপুরি নদীতে পড়তে ফাহমিদাকে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখে কিছু বললাম না। সাঁতার যে জানি না ফাহমিদাকে বলিনি, অঘটন ঘটলে সাঁতার জানলেও বড় একটা কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। নদীর বুকে এই সকাল-সকাল প্রচুর রোদ, সঙ্গে এলোমেলো হাওয়া। রাতে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল। ভোরের আলো ফুটতেই টালবাহানাহীন ঝকঝকে আকাশ। রোদ-বৃষ্টি নিয়ে ভাবছি না, সকাল থেকে টের পাচ্ছি শরীর বাগড়া দিচ্ছে। সুগার বেড়েছে বলে রাতে চার ইউনিট বেশি ইনসুলিন নিয়েছি। ফাহমিদাকে বলিনি। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরেছি এক টুকরা টোস্ট আর কফি দিয়ে। ফাহমিদা হটপটে খাবারদাবার নিয়েছে, বড় ফ্লাস্কে কফি। বোটে ওঠার সময় একটা অঘটন প্রায় ঘটেই গিয়েছিল। কাদাপানিতে লাঠি ভর দিয়ে পা ফেলতেই মাথাটা চক্কর দিল, ব্যালেন্স হারিয়ে হুমড়ি খাওয়ার মুখে বোটের মাঝি পাশ থেকে জাপটে ধরায় রক্ষা। না হলে বড় ধরনের কিছু হয়ে যেতে পারত। বোটে ওঠার পর লোকটা—নাম জেনেছি আমজাদ শেখ, সেই সাথে এও সে সারেং, মাঝি না—বলেছে বেগমসাবেরে ধইরা বসেন। ফাহমিদার মুখ তখন থেকেই গোমড়া—কেন আগেভাগে কাদাপানিতে লাঠি ঠুকে নামতে গেলাম? ফাহমিদা সাবধান করেছিল গোড়াতে, সেজন্যই আমজাদ শেখ আমার পাশে পাশে ছিল আর সময়মতো পাকড়াতেও পেরেছে। ফাহমিদা গোমড়া মুখে দুটো লাইফ জ্যাকেট পাটাতনের হুক থেকে খুলে হাতের চাপে কী পরীক্ষা করছে, ভাবলাম জিজ্ঞেস করি সাঁতার জানে কি না। আমি যে জানি না, তিরিশ বছর এক সাথে থেকেও ফাহমিদাকে তা জানাইনি বা জানানোর দরকার পড়েনি ভেবে বেশ অবাক লাগল। স্বামী-স্ত্রী হলেও কি সাঁতার জানা বা না-জানার ব্যাপার অজানা থাকত? কী সব ভাবছি!

    আজকের এই যাত্রাকে কী বলি? এই প্রায়-লজঝরে বোটে ফাহমিদাকে নিয়ে বর্ষার ভরা পদ্মায় নামব, আগে কখনো ভাবিনি। এমনকি সপ্তাখানেক আগেও না। ঠিকানাটা মুখে মুখে শুনলেও মাথায় এমনভাবে গেঁথে বসেছিল, মনে হয়েছে ব্যাপারটা যে যেভাবে দেখুক, যাওয়া দরকার। কেন? এ প্রশ্নের সুরাহা হয়নি, আজ সকালেও যখন ভাবছিলাম কেন যাচ্ছি, জবাব মেলেনি। এখন যখন বোটের নড়বড়ে বেঞ্চে সাবধানে পিঠ ঠেকিয়ে একই কথা ভাবছি, বুঝতে পারছি না আমি কি একটা সোজাসাপটা জবাব খুঁজছি? এও মনে হচ্ছে, কলকারচর কি সত্যি সত্যি কারো ঠিকানা—হারিয়ে যাবে বলে যেখানে ঠাঁই নিয়ে শেফালি বেগম নিজেকে নিরুদ্দিষ্ট ভাবছে, সেখানে কী দেখতে যাচ্ছি? সে তো আমাকে চিনবে না, আমিও চিনব আশা করি না। অসংখ্যবার দেখা ভিডিওতে শেফালির আলো ঝলসানো মুখ, তীব্র চাউনি, ডান ভুরুতে ঝুঁকে পড়া জড়ুল এত বছর মাথায় বয়ে বেড়ালেও শেফালি নিজে কি অতীতের স্মৃতিবাহী কোনো চিহ্ন আজও বয়ে চলেছে?

    কী বলতে পারি শেফালিকে?

    জীবনে অনেক কিছু করার প্রবল স্পৃহা নিয়েও মনে হয় না একটা কোনো কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পেরেছি; আজ এটা ধরেছি, লেগেও থেকেছি, দুই দিন পর অন্যটা নিয়ে মেতে উঠেছি। শেফালিকে নিয়ে ভিডিওটা একমাত্র ব্যতিক্রম। একাত্তরের বাংলাদেশ নিয়ে আজও কেউ কিছু লিখতে গেলে শেফালির সাক্ষাৎকার কোনো না কোনোভাবে ঢুকে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশে মানুষের আবেগ, পপুলিজম আর ইচ্ছাপূরণের এত রমরমার অপর পিঠে শেফালির একটামাত্র বাক্য। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে বিশ্বাস হতে চায়নি সত্যি শুনছি—এ কে কথা বলছে? ঘুমন্ত, ঠান্ডা অগ্নিগিরির আচমকা লাভা বিস্ফোরণে মাথাটা তখন টালমাটাল। দেশে ফিরে কাজের কাজ কিছু না পেয়ে হতোদ্যম হওয়ার মুখে শেফালির সেই ওয়ান লাইনার এ জীবনে আমার সেরা সঞ্চয়। অতটা সে সময় ভাবিনি, তবে দিন যত গড়িয়েছে, বছরের পর বছর পার হয়েছে, দেখতে পাচ্ছি একটা স্ফুলিঙ্গ তেজ হারিয়েও ধিকিধিকি নিথর ঝুলে আছে সামনে—আয়নায়, মুখ দেখতে গেলে কপালে আঁচ লাগে।

    গত কয়েক বছর ধরে একটা প্রশ্ন মাথায় প্রায়ই ঘোরে, অস্বস্তিতেও ফেলে। আমার তো কোনো কারণ ছিল না বাহাত্তরে দেশে ফিরে যুদ্ধাপরাধী সৈন্যদের ট্রাইব্যুনাল নিয়ে উঠেপড়ে লাগার, ক্যাম্পেইন করার। বিলেতে করার কিছু ছিল না বলে দেশে ফেরার যুক্তিটা টেকে, কিন্তু আমি ফিরেছিলাম একটা দিকদিশাহীন জ্বালাপোড়া ও বিক্ষোভ নিয়ে। জানতাম না ঠিক কী করতে চাই। পেছনে ঘটনা একটাই—সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের খবর যা ডেইলি মেইল চারকোনা বর্ডার দিয়ে ছেপেছিল। মাত্র কয়েক লাইনের খবর ও খবরের বিদঘুটে, পাগলাটে শিরোনাম আমার তখনকার উড়নচণ্ডী জীবনকে চাবকে চাবকে দিশেহারা করে দেবে, কী করে ভাবব! আমার হঠাৎ পরিবর্তনে অনেকের মনে খটকা জেগেছিল, বিশেষ করে পরিবারে বা ঢাকার চেনা-জানা মহলে, যাদের কাছে আমি তখন এক অর্থে আউট ল। মানুষের কথা কী বলব, আমি নিজেকে যত দেখছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। অ্যানমেরির শাপলায় কাজ করার সুবাদে নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। লেখাজোখা দিয়ে যা করেছিলাম তাকে সে সময় যে যেমনই ভাবুক, পরে আমার মনে হয়েছে খেটেখুটে যা করেছিলাম তা বেশ জোরালো ক্যাম্পেইনই ছিল। সঙ্গী-সাথি না থাকলেও কিছু কিছু সাড়া তো পেয়েছিলাম, যদিও রাগ-রোষ ঝাড়া ছাড়া কাজের কাজ কিছু হয়নি। তবে রেকর্ড হিসাবে দেখলে সেসবের মূল্য ছিল, আর আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আজও আছে, আগামীতেও থাকবে। দেশে, এমনকি বিদেশেও অনেকে আমার কাজ ফলো করেছে, নিজেদের রিসার্চের দেদার মাল-মসলা আমার লেখাপত্র থেকে নিয়েছে। এবার অস্বস্তির কথায় আসি। সোজাসাপটা বললে ব্যাপারটা কি এ রকম—ওয়ার ট্রাইব্যুনাল নিয়ে রাগ-ঝাল ঝাড়া ছাড়া কিছু করতে না পেরে শেফালি বেগমের ভিডিও ইন্টারভিউতে আত্মরক্ষার পথ খুঁজেছিলাম?

    অভিযোগটা কেউ তোলেনি, আমিই সময় সময় খুঁড়ে তুলি। ফাহমিদাকে বললে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে এটা আমার গোটা কাজের অংশ ছিল, বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না, শুধু একটা ভিডিও বানানোর জন্য আমি চার বছর অপেক্ষা করে বসেছিলাম না। ফাহমিদা এমন কথা বলতেই পারে, ও সে সময় আমার কাজপাগল জীবনকে ভালোবেসে কাছে ভিড়েছিল, তাতে আমার ভেতরের প্রলোভনকে দেখতে পায়নি। হ্যাঁ, হতাশ হয়ে কিছু করতে না পেরে আমি চেয়েছিলাম একটা কিছু করি; সেটা শেফালি বেগমকে নিয়ে ভিডিও। প্রলোভন বটে। তবে এ কথা সত্য, আমার প্রলোভনের খেসারত দিতে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি।

    হঠাৎ হাওয়া বাড়ছে দেখে ফাহমিদা আর অপেক্ষা না করে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে দিল। প্রথমে আমাকে পরিয়ে নিজে পরল। তবে মুখ দেখে মনে হলো না তেমন আশ্বস্ত হতে পারছে। নদীকে এখন মোটেও নদী মনে হচ্ছে না, যেন জলবেষ্টিত প্রকাণ্ড আকাশ, ছোট-মাঝারি ঢেউয়ের মাথায় রোদ বাড়ি খাচ্ছে, একটা কালো লম্বা-গলা পাখি—পানকৌড়ি কি–বোটের কিনার ঘেঁষে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কোন দিকে যে ভেসে উঠল! এটা কি কোনো মোহনা, এত পানি কেন চারদিকে? দূরে, কত দূরে কে জানে, কালচে-সবুজের ছেঁড়া-ছেঁড়া ঝিলমিল। কোথায় যাচ্ছি? দিকচিহ্নহীন কলরোলে কে পথ দেখায়! এত পানি ঠেলে, রোদ-হাওয়া ভেঙে ডাঙার খোঁজ শেফালি কী করে পেয়েছিল—যত ভাবছি মনে হচ্ছে শেফালি পেয়েছে বলে আমি পাব তার কী নিশ্চয়তা! আমি শেফালি নই, শেফালির মুখ ছিটকানো কথা শেফালির, একে আজীবন সঞ্চয় মানলেও এর কৃতিত্ব আমার নয়, কিছুতেই নয়।

    বোটটা বেশ দুলছে, রোদও চড়াও হচ্ছে, ছাউনির ফাঁক-ফোকর দিয়ে বর্শা বাগিয়ে নাচছে পাটাতনে, কখনো লাফিয়ে বিঁধছে চোখে। জানি না এ যাত্রায় শেফালির খোঁজ পাব কি না, যদি পাই, আমি বরং শেফালির কথা শুনতেই অপেক্ষা করব, যদি সে কিছু বলে—আমাকে দয়া করে।

    —

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন
    Next Article প্রাচীন চীনা দর্শন : লাওসি ও কনফুসিয়াস – হেলাল উদ্দিন আহমেদ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.