Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বরফকল – ওয়াসি আহমেদ

    ওয়াসি আহমেদ এক পাতা গল্প352 Mins Read0

    ঘরে ঘরে দুর্গ গড়া, না শেফালির বিয়ে ভাঙা

    পৌষ গেল, তার পর দেখতে দেখতে মাঘও। এখন ফাল্গুন। বিয়ের দিন ঘনাচ্ছে, এদিকে চারদিকে গুজব দেশে গণ্ডগোল হবে। মেরাজ ফকির সবখানে লোকজনের মুখে একই কথা শুনছে। এত হৈ হৈ করে ভোট হলো, নৌকা জিতল সারাদেশে, কিন্তু শেখ মুজিবকে নাকি গদিতে বসতে দেবে না, পশ্চিম পাকিস্তানিরা চায় না সে বসুক। একটা ফয়সালা করার বুঝি চেষ্টা চলছে, কিন্তু লোকজনের ভাবসাবে মনে হয় তারা আগেভাগে সব জেনে বসে আছে। হাটে-বাজারে সব জায়গায় এক কথা, ফয়সালা হবে না। তা হলে? কী ধরনের গণ্ডগোল, তার মাথায় খেলে না। এদিকে বিয়ের তারিখ পড়েছে ফাল্গুনের শেষ শুক্কুরবার, সাতাশ তারিখ। মাঝে মোটে সপ্তা দু-এক। রুশনি বেগম তাকে ভরসা দেয়, ‘অত পেরেশানি কইরো না, মাইয়ার বিয়া বইলা কতা, অশান্তি কমুক, তারপরে আল্লায় যা করে।’ তার মানে সে ধরে বসে আছে বিয়ে পেছাবে। কারা পেছাবে? সে না মেয়ের বাপ, সে জানবে না বিয়ে পিছিয়ে যাবে! পেছাতে হলে তো দুই পক্ষকে বসতে হবে, তবে কি আবার ওরা আসবে, আর রুশনি বেগম পোলাও-কোর্মা রাঁধার মওকা পাবে বলে এলাকার মানুষজন যেমন আগেভাগে ধরে নিয়েছে ফয়সালা হবে না, সেও তেমনি ওদের কথায় তাল ঠুকে বলে দিচ্ছে অশান্তি কমুক, তার পর।

    শেফালি শুনেছে সবই, তার মন বলছে বিয়ে পেছানোর মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না। এর মূলে যে যুক্তিটাকে সে খাড়া করে—শাহ আলম তো তার জন্য দিওয়ানা, সে তো চাইবে যত তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যাক।

    দিওয়ানা হওয়ার ঘটনাটা যে কে প্রথম তার কানে দিল মনে করতে পারছে না। এ ছাড়া সে নাকি তাকে নিজে দেখে গেছে, যদিও শেফালি তা বিশ্বাস করে না। শুনেছে খবরটা গাঁয়ে চাউর করেছে নৃপেন শীল, শেফালি ডাকে নিপেনদা। মাস দুয়েক আগে, সেই ফটো তোলার ঘটনার পর এক বিকালে নৃপেনের সেলুনে একজন এসেছিল যে তার কাছে মেরাজ ফকির ও শেফালির বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। আরও নাকি অনেক কিছু জানতে চেয়েছে, নৃপেনকে চা-মিষ্টিও খাইয়েছে।

    সব কথা নৃপেন বলেনি। নৃপেন করিৎকর্মা লোক, তার বাবা এক সময় হাটবারে বাজারের এক মাথায় বয়রা গাছের গোড়ায় বড় আয়না টাঙিয়ে মানুষের চুল-দাড়ি কাটত। বাপ-ঠাকুর্দার পেশায় নৃপেনের আপত্তি নাই, আপত্তি ওই গাছতলায় জোড়া ইটের ওপর লোক বসিয়ে ক্ষুর-কাঁচি চালানোয়। সে তার খদ্দেরকে চেয়ারে বসায়, আয়না অবশ্য বাপের আমলের, জায়গায় জায়গায় পারা ওঠা, তবে মাথার ওপরে ছাউনিটা গদাপেটানো কেরাসিন টিনের হলেও বৃষ্টির পানিতে খদ্দেরের সাবানমাখা গাল ধুয়ে যাওয়ার ভয় নাই। তো তার কাছে সেদিন যে অচেনা লোকটা এলো, তাকে প্রথম দেখায় খদ্দের ভেবে চেয়ারে বসতে ইশারা করার পর বুঝতে পারেনি চুল, না দাড়ি? দাড়ি কামানোর প্রশ্নই ওঠে না, সাফসুতরা গাল-থুতনি, গোঁফও সুন্দর করে ছাঁটা, আর চুলও তেমন বড় না। লোকটা বুদ্ধিমান, নৃপেনের সমস্যা বুঝে বলেছিল, ‘আপনের তো এখন কাস্টমার নাই, এট্টু বসি।’ লোকটার বয়স নিয়ে নৃপেন গণ্ডগোলে পড়েছিল, কারো কাছে বলেছে পঁচিশ-ছাব্বিশ, কারো কাছে এক লাফে তিরিশ-পঁয়তিরিশ। তবে লোকটা যে মাথায় বুদ্ধি রাখে এ কথা বারবার জোর দিয়ে বলেছে। আসল কথা তোলার আগে কায়দা করে একথা-সেকথা বলেছে। বাজারে ধানের দর কত, তার নিজের আয়-রোজগার কেমন, বিয়ে করেছে কি না এসব জানতে চেয়ে খাতির জমিয়ে বলেছে, ‘কথা আছে, চলেন চা খাই।’

    শুধু চা না, নৃপেনকে বিশুর দোকানে গরম পরোটা আর রসগোল্লা খাইয়ে ধীরে ধীরে ক্ষুরের এক টানে নৃপেন যেমন থুতনির দাড়ি চাঁছে না, তেমনি মেরাজ ফকিরকে নৃপেন চেনে কি না, বাড়িটা কোন দিকে, মেরাজ ফকিরের মেয়ে শেফালিকে দেখেছে কি না, ওই বাড়িতে যাওয়া-আসা আছে কি না, শেষ কবে শেফালিকে দেখেছে এসব বৃত্তান্ত জানতে দম ধরে, রয়েসয়ে এগিয়েছে। শেষে ‘আপনেরে ত্যক্ত করলাম’ বলে যাওয়ার সময় দশ টাকার একটা নোট পকেটে গুঁজে দিয়েছিল। টাকাটা নাকি নৃপেন নিতে চায়নি, চুল কাটল না, দাড়ি কাটল না, পরোটা-মিষ্টি খেল, আবার পাক্কা দশ টাকার নোট! বিশুর দোকানে সে সময় যারা ছিল তারা সাক্ষী।

    নৃপেন অবশ্য এসব স্বীকার করেনি, সে লোকটার বয়সের উল্টাপাল্টা হিসাব দিয়েছে, তবে তার কাছে যে যা জানতে চেয়েছে বলেছে, আরও বলেছে সিগারেট খায়, কাঁচি সিগারেট, সঙ্গে পানও, জর্দা খায় কি না বলতে পারবে না। সেই সাথে তাকে যা বলেনি, মানে বলি বলি করেও লজ্জায় বলেনি, তবে নৃপেন যেহেতু চুল কাটতে মানুষের মুণ্ডুটাকেই থাবা দিয়ে ধরে না, মুণ্ডুর ভিতরে কী আছে সে খবরও রাখে, তাই সে লোকটার না বলা কথাটাও এর-ওর কানে দিতে ভোলেনি। কথাটা আর কিছু না–শেফালির মাথায় পাক খাওয়া সেই দিওয়ানা।

    নৃপেনকে নিয়ে সে সময় আরও কাণ্ড হয়েছে। লোকটাকে সে কি মেরাজ ফকিরের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল এমন বেকায়দা জেরায় সে মা কালীর কিরা কেটেছে। লোকটাকে তার কথামতো সে সেলুন থেকেই বিদায় দিয়েছে। তবে কাঁচুমাচু মুখ করে দুই-একজনের কাছে বলেছে জোর করে কেউ খাওয়াতে চাইলে না করে কী করে! কিন্তু সাক্ষী-সাবুদ থাকলেও দশ টাকা ঘুষের কথায় জিভ কেটেছে।

    এখন এসব কথা কে মনে করে! চারদিকে একই আলোচনা—দেশে গণ্ডগোল হবে। রুকিয়া এলে বা ওদের বাড়ি গেলে নিজেরা নিজেদের মতো গল্প-টল্প করতে চায়, কিন্তু কেন যেন আগের মতো হয় না। বিয়ের মাত্র কদিন বাকি, এ সময় শেফালি চাচ্ছে সবাই বিয়ে নিয়েই কথা বলুক, এমনকি অদেখা শাহ আলমকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করলেও তার আপত্তি নাই। কিন্তু সবার মাথায় এ সময় অন্য চিন্তা। কোথায়, কত দূরে ঢাকায় গণ্ডগোল হবে বা হতে পারে, আর এদিকে এই শ্যামপুরে মানুষের চোখে ঘুম নাই।

    সেদিন হিজল পর্যন্ত কী সব বলল। এইট পর্যন্ত পড়লেও হিজলের কথাবার্তা শিক্ষিত মানুষের মতো। এলাকায় নাকি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হবে, সে তা-ই নিয়ে মেতে আছে। ভোটের সময়ও সে অনেক দিন মেতে ছিল, নৌকা জিতবে জানা কথা, তারপরও নাওয়া-খাওয়া ফেলে সারাদিন বাজারে ভোটের কাজ করত। ভোটের আবার কী কাজ, শেফালির মাথায় আসত না। ঘরের বেড়ায় শবনমের ছবিগুলো ভাতের আঠা থেকে আলগা হয়ে ঝুলে পড়লেও তার এখন সেসবে খেয়াল নাই। মা এক সুযোগে ছবিগুলো বেড়া থেকে ছাড়িয়ে চুলায় দিয়েছে, হিজল কিছু বলেনি। হিজলের সঙ্গে তার দুই-তিনজন সাঙ্গোপাঙ্গ প্রায়ই বাড়িতে আসে, উঠানে-দাওয়ায় বসে ওরা কথা বলে। এদের মধ্যে একজন মোবারক ওদের চেয়ে কিছু বড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পড়ে, সে-ই মনে হয় নেতা। তার সঙ্গে আবার একটা ছোট চারকোনা পানের ডিব্বার মতো রেডিও থাকে, কথাবার্তার ফাঁকে তারা রেডিওর গান-টান না, খবর শোনে।

    অবস্থা কি হঠাৎ বদলে গেল, না আস্তে আস্তে যা হওয়ার তাই হয়েছে- শেফালি বুঝতে পারে না। সেদিন একলা পেয়ে হিজলের কাছে জানতে চেয়েছিল গণ্ডগোল যে হবে সেটা কী ধরনের। হিজল চোখ বন্ধ করে বড়দের মতো চিন্তা করে বলেছে, ‘আন্দোলন, খুব বড় আন্দোলন। আন্দোলন বুজো? ধরো, যুদ্দ।’ ব্যস্ত মানুষ হিজল, যুদ্ধ কার সাথে বলার দরকার মনে করেনি।

    হিজলের কথা যে এভাবে ফলবে শেফালি আন্দাজ করতে পারেনি। আগের দিন শোনা গিয়েছিল শেখ মুজিব ঢাকায় সভা করে বক্তৃতা করবেন, বক্তৃতায় যুদ্ধের কথা বলতে পারেন। ঘরে একা একা ভালো লাগছিল না, শেফালি দুপুরের পরে রুকিয়াদের বাড়ি গিয়েছিল। রেডিওতে বক্তৃতা শোনার ইচ্ছা তার ছিল না, গিয়ে দেখল বাড়িভরতি মানুষ, সবাই রেডিওতে বক্তৃতা শুনতে উঠানে গোল হয়ে বসেছে। রুকিয়ার মা আবার বাটাভরা পান সাজিয়ে দিয়েছে, হাতে হাতে বাটা ঘুরছে। আশপাশে এক রুকিয়াদের বাড়িতেই রেডিও। সবাই শুনতে পায় সে জন্য ওয়াড়ঢাকা বাক্সের মতো রেডিওটাকে রাখা হয়েছে মাঝখানে একটা ছোট তেপায়ার ওপর। শেফালি কী করে, সবাই উঠানে, রুকিয়াকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যাবে বলতে পারছে না। এ সময় রুকিয়া একটা পিঁড়ি এনে দিতে এক পাশে সরে না বসে কী করে!

    .

    সেই বক্তৃতাই শেফালির জন্য কাল হলো। হিজল যেমন বলেছিল, যুদ্ধ, তাই হলো। সব কথা না বুঝলেও ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার ঘোষণা শেফালির না বোঝার কথা না, আবার স্বাধীনতার কথাও বলা হয়েছে। মেরাজ ফকির সব শুনে বলল, ‘বুজলাম মাইনষ্যে যা বলাবলি করছিল ঠিকই করছিল, তাই বইল্যা বিয়া আটকাইব ক্যান? বিয়ার সাথে কী সম্পর্ক!’ কিন্তু এ তো তার নিজের কথা, ঘরে রুশনি বেগম পর্যন্ত তার কথায় সায় দেয় না। পরদিনই পাত্রপক্ষের লোক এলো কথা বলতে। আগের বারের মতো দলে-বলে না, এলো শুধু পাত্রের মামা। বিয়ে হচ্ছে না তারিখ মতো, পেছাতে হবে, সেটা কবে বলা যাচ্ছে না। আগে তো দেশের হাওয়া-বাতাস ঠান্ডা হোক, অশান্তি কমুক। মেরাজ ফকির মিনমিন করে বলতে চাইল সামনে যদি অশান্তি আরও বাড়ে, বিয়ের কাজ চুকে গেলে মন্দ কী।

    লাভ হলো না। পাত্রের মামা ঠান্ডা মাথার মানুষ, বলল সামনে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। দেশে তো এখন সরকার নাই, অসহযোগ চলছে, শেখসাবের সাথে ইয়াহিয়ার একটা রফা হলে রক্ষা। কিন্তু এত কিছুর পর রফা কী করে হবে! বিয়েটা আপাতত মুলতবি থাক। মাস দুই যাক, তার পর যা হওয়ার হবে। বলে মেরাজ ফকিরের মনে সাহস দিতে বলল বিয়েতে তো কেউ ভাংচি দিতে আসছে না।

    কোথায় ঢাকা, সেখানেই যা হওয়ার হচ্ছে, অথচ মনে হচ্ছে এই শ্যামপুরেও সেসবের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। দিন-রাত সেই আঁচেই হু হু কেটে যাছে। আর এত কথাও মানুষ বলতে পারে! বাজারে গেলে মেরাজ ফকির হাঁ হয়ে মানুষের কথা শোনে, আর একটা জিনিস খেয়াল না করে পারে না, সবাই যার যার কথা বলায়ই ব্যস্ত, শোনার মানুষ নাই। তার মতো দুই-একজনই যা মুখ বুজে শোনে। গাঁয়ে রেডিওর এত কদর আগে কোনো দিন নজরে পড়েনি। মানুষ খবর শোনে, দোকানে বসে চা খায় আর কথা বলতে গিয়ে গলা তুলে তর্ক করে। দিন দিন তর্কের ধরন বদলায়। শেষমেশ কথা একটাই, যুদ্ধ হবে। বাঙালি আর পাঞ্জাবির যুদ্ধ। মেরাজ আলীর খটকা লাগে, বন্দুক-কামানের সাথে লাঠিসোঁটার কেমন যুদ্ধ! কথাটা তার একার না, তার মতো আরও দুই-চারজন একই কথা বলে। কিন্তু কেউ শুনলে তো! তাদের কথায় কিছু যুক্তি আছে। বাঙালি পুলিশ, বাঙালি মিলিটারিরা আছে না? বাঙালি মিলিটারি আছে কথাটা মেরাজ আলী প্রথম শুনল। এই শ্যামপুরে কেন, আশপাশে কোনো গ্রামে কেউ মিলিটারিতে গেছে শোনেনি। তবে পুলিশে গেছে, শ্যামপুরে না, কাছেই রাধানগরে এক বাড়িতেই শুনেছে দুই ভাই পুলিশ।

    শেফালির দিন কাটে না। কেন যে মনে হঠাৎ হঠাৎ কুডাক দেয়—বিয়েটা আর হবে না। সেই সাথে আজব কথাও ভাবে, শেখ মুজিবের বক্তৃতাটাই বিয়েতে ভাংচি দিল। পরপরই সে তওবা কাটে, বিয়ে কি ভেঙে গেছে যে ভাংচির কথা ভাবছে? শাহ আলমের ফটো এখন আর বালিশের নিচে রাখে না, সত্যি সত্যি যেন গালে চোখা গোঁফের খোঁচা লেগে রাতে ঘুম ভেঙে যায়। ফটোটা সে সরিয়ে রেখেছে বিয়ের জন্য কেনা ফুল-ফুল টিনের বাক্সে। সে বাক্সে নতুন কেনা কয়েকটা শাড়ি ছাড়াও রয়েছে সাজগোজের নানা জিনিস। মাসখানেক আগেও সময় পেলে বাক্সটা সে খুলে দেখত। বাক্সের ডালা খুলতেই সুন্দর বিয়ে-বিয়ে গন্ধ লাগত নাকে। এখন যে খোলে না তা না, তবে সেই গন্ধটা পায় না।

    মাঝে মাঝে রুকিয়া আসে। গণ্ডগোলের জন্য তার পরীক্ষার ফল আটকে আছে। ফল বের হলে রুকিয়া কলেজে ভর্তি হবে, তখন গ্রাম ছেড়ে তাকে গিয়ে থাকতে হবে এক চাচার বাসায় কুমিল্লায়। কলেজটা মেয়েদের, চাচার বাসা থেকে দূরে না, চাইলে হেঁটেই যেতে পারবে। নিজের কথাই রুকিয়া বেশি বলে, আর যে কথাটা এত দিন চেপে রেখেছিল তা শুনে শেফালি তো থ। কুমিল্লা শহরেই থাকে তার বড় ফুপু, সেই ফুপুর ছেলে ইমদাদের সঙ্গে নাকি তার চিঠি চালাচালি চলছে বেশ কিছু দিন। ইমদাদকে শেফালি দুই-একবার দেখেছে, কিন্তু এমন খবরটা রুকিয়া তাকে এত দিনে দিল! রুকিয়া বলল, কলেজে ভর্তি হলে ইমদাদের সঙ্গে যখন খুশি দেখা করতে পারবে, এতে সে মহাখুশি। এখন মানে মানে পাস করলে হয়। পাস করবে এ নিয়ে তার সন্দেহ নাই, তবে বলা তো যায় না, সমাজবিজ্ঞানের প্রশ্নটা কঠিন হয়েছে, যদি ডাব্বা মারে তা হলে কপালে খারাবি আছে।

    এদিকে হিজলের ব্যস্ততা দেখে কে? সারা দিন কোথায় কোথায় থাকে, সন্ধ্যায় বা রাত করে যখন আসে, সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। তাদের নেতা সেই মোবারকও কোনো দিন আসে, সঙ্গে তার পানের ডিব্বা রেডিও। এক দিন শেফালি শুনল তারা বলাবলি করছে যে কোনো সময় ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এমনকি আজ-কালের মধ্যেও হতে পারে। শেফালি তার বাবার মতোই ভাবে যুদ্ধ হলে হবে ঢাকায়, এখানে এই শ্যামপুরে মেরাজ ফকিরের উঠানে বসে যুদ্ধ দেখা দূরের, একটা গুলি ফোটার আওয়াজও কি পাওয়া যাবে! শেফালির অবশ্য ধারণা নাই গুলির আওয়াজ কত দূর যেতে পারে, কামানের আওয়াজ তার ধারণা গুলির আগে ছুটবে। কোনোটাই দেখেনি, আওয়াজ শোনা দূরের। গুলি-বন্দুক নিয়ে এত কথা কানে আসছে, দেখা যাক, এবার শোনে কি না।

    মান্তুর মুখে কথা, না পটকা?

    মান্তুকে যত দেখছে, চম্পা অবাক হচ্ছে। মাত্র কয়েক বছরে সে যেন তার অতীতকে কবর দিয়ে বসে আছে। ছেলেকে এতিমখানায় গছাতে পেরেছে, এতেই তার সব শান্তি। সেই প্রথম দিনই নিজের সম্বন্ধে সে যা বলেছে, তাও চম্পা জানতে চেয়েছে বলে। এ ক-বছর কী করল, সেসব নিয়েও অল্প কথায় যা বলার বলেছে। তবে প্রথম দিনই বলেছিল সব বলতে পারবে না। চম্পার বস্তিতে এসে কয়েক দিনেই সে আশপাশের পড়শিদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলেছে। সারা দিন কাজে বাইরে থাকে, সন্ধ্যার পরে যখনি সময় পায় এর-ওর সাথে গল্প-গুজবে মেতে ওঠে। মর্জিনার মা-র রোজই একবার খবর নেয়, মর্জিনা প্রায় দিনই ফিরতে দেরি করে। আর চম্পার ঘরের কাজকর্ম বলতে গেলে মান্তু একলাই সামলায়। সামলানোর মতো তেমন কিছু নাই, নিজেদের রান্নাবাড়া ছাড়া কাজ বলতে কাপড়-চোপড় ধোয়া বা বড়জোর ফেরার পথে দোকান থেকে সদাই আনা। চম্পার ওভারটাইম থাকে প্রায়ই, দেরিতে ফিরে প্রায়ই দেখে মান্তু রান্না চড়িয়ে বসে আছে।

    ‘তরে কি আমার সুখের জইন্য আনলাম? সারা দিন ফ্যাক্টরিতে খাইটা ঘরের সব কাম করেছি, আমার জইন্য কিছু তো রাখবি!’

    ‘তুমার সংসার তুমার একলার না, আমারও। তুমিও খালি তুমার না, আমারও।’

    মুখ আগেও পালিশ ছিল, এখনো আছে। কিছু বললে পাল্টা জবাব দিতে ছাড়ে না। ফ্যাক্টরির কাজ নাকি তার ভালোই লাগে, সুপারভাইজার লোকটাও ভালো। ভালো ভালো শুনে চম্পা সেদিন বলেছিল, ‘কত যে আচানক কতা কস, তিন মাসও যায় নাই, তর কাছে ফ্যাক্টরি ভালা, সুপারভাইজারও ভালা। অত ভালা ভালা করিস না, বিপদে পড়বি, বুজছস। গার্মেন্ট জাগাটা খারাপ। সারা মাস নাকে-মুখে খাটাইয়া কয়টা টেকা দ্যায়, আর মালিকরা যে কী শান-শওকতে থাকে চিন্তাও করতে পারবি না। বছর বছর তাগো ফ্যাক্টরি বাড়ে, একটা ফ্যাক্টরি করতে কত খরচ জানোস? আর বছরে কম অইলেও ছয়-সাতটা গার্মেন্টে আগুন লাগে, কয় বছর আগে একটা ভাইঙ্গা হাজার হাজার মানুষ মরল, মালিকরা কিছু দিছে! সরকারও ওগো লগে, বড়লোকে বড়লোকে দোস্তি।’

    কথাটায় আমলই দিল না মান্তু, বলল, ‘ভালা তাইলে কারা কও তো। বেশি না, দুইন্যায় দুইটা ভালা মাইনষ্যের নাম কও।

    ‘আছে, দুইটা ক্যান আরও বেশিরে আমিই চিনি।’

    ‘তুমি ঠিক কইতাছো?’

    ‘তর ক্যান মনো অইল দুইন্যায় দুইজনও ভালা মানুষ নাই?’

    ‘দুইজন বেশি কইছি, একজন দেখাও, থুক্কু, তুমি বাদে।’

    ‘আমি ভালা? আর কেউরে তর ভালা মনে অয় না?’

    ‘আমার মনো অইলে কি আর না অইলেই কি! কিন্তুক কতা যা কইলাম হাছা। আর আসল কতা—ভালা-খারাপে আমার কাম কী! আর বিপদের কথা কইলা না, আমারে বিপদ দিব এমন কেউ আছে দুইন্যায়! তুমারে তো কইছি সব কওয়া যাইব না, বিপদের তুমি কী দেখছো!’

    চম্পা ভড়কে গেল। এভাবে তো বলেনি আগে। সে চুপ করে থাকল। মান্তু হঠাৎ গা ঝেড়ে হেসে উঠে বলল, ‘আমাগো সুপারভাইজারের কতা কইছিলাম না, লোকটা ভাদাইম্যা। নামটা সুন্দর আশিকুর রহমান। নায়ক-নায়ক চেহারা। পয়লা নাকি নিজেই প্যাকিংয়ে কাম করত। এতগুলান মাইয়া লইয়া কারবার, কিন্তুক ক্যামনে কী করতে অয় জানে না।’ কথা শেষ না করে সে হাসতেই থাকে।

    চম্পা অপেক্ষা করে, তার মন বলে মান্তুর মুখ দিয়ে আবার আচানক কিছু বেরোবে। পরের কথাগুলো মান্তু এমনভাবে বলে চম্পা তার বলার কায়দায় তাজ্জব হয়ে যায়। মান্তু বলে প্যাকিং সুপারভাইজার আশিকুর রহমানের বাছবিচার নাই, অল্পবয়সি মেয়েদের দিকে যেমন নজর, তেমনি বেশি বয়সিদের দিকেও। তার পর তেমনি হাসতে হাসতে বলে, ‘বিয়াতি আর আবিয়াতির ফারাক বুজে না এমন বেক্কল। আরে আহম্মক, আবিয়াতিরা নখরামি করব তুই বুজোস না! ধরবি, ধর বিয়াতি, কাচ্চা-বাচ্চার মা-রে, ওরা ধরা খাইলেও ধরা দিব না, তরই লাভ। তর কী দরকার শিউলিরে পটানোর, কাটিংয়ের শ্যামলের লগে শিউলির লাইন কে না জানে, আর তুই গেলি শিউলিরে কাইত করতে! ধরা পইড়া মাইর খাওনের জোগাড়, কপাল ভালা সেকুরিটিরা সময়মতো আইসা বাচাইয়া দিছে।’

    সে রাতে পাশাপাশি শুয়ে মান্তুকে বারবার এপাশ-ওপাশ করছে টের পেয়ে চম্পা ঘুমের ঘোরে বলল, ‘কী অইল তর, ঘুম লাগে না?’

    মান্তু তার পিঠে হাত রেখে আস্তে আস্তে ঠেলে বলল, ‘কইছিলাম না সব কতা তুমারে কইতে পারুম না?’

    মাঝরাইতে কওয়ার কাম নাই, ঘুমা, কাইল কইস।’

    ‘না।’

    ‘কী না?’

    ‘আমার কওয়া লাগব। আইজ যহন তুমারে সুপারভাইজারের কতা কইতাছিলাম, তহন বুজি নাই তুমারে কওয়া ঠিক অয় নাই, তুমি তো বদলাও নাই গো চম্পাবু। এত কষ্ট করছো, তার বাদেও বদলাও নাই, কেমনে পারলা? আমি পারি নাই।’

    ঠেলাঠেলিতে ঘুম পুরোই ভেঙে গিয়েছিল। কী বলতে চায় মান্তু ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছিল কী আর বলবে—স্বামীর ঘর করতে পারল না, ভাইদের ঘরেও ঠাঁই মিলল না, এসবই হয়তো বলবে, আগে দু-এক কথায় বলেছিল, এখন ইচ্ছা করছে মন খুলে বলতে, বলুক।

    প্রথম কথায়ই চম্পাকে চমকে দিল মান্ত্র, বলল, ‘গেরাম ছাড়ার পরে তুমারে যা যা কইছি, সব হাছা না। আমি টানবাজার আছিলাম তিন বছর।’

    চম্পাকে চমকটা হজম করার সুযোগ না দিয়েই সে বলতে লাগল ভাইদের সংসারে টিকতে না পেরে গ্রাম ছেড়েছিল রাগের মাথায়। এক চেনা মহিলার সঙ্গে ঢাকায় এসে কাজে লেগেছিল একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে, ঝাড়ুদারনি মানে মেথরানি হিসাবে। শহরে টিকতে হবে যখন, দাঁত কিড়মিড়িয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, প্রথম দিকে ঘিন ঘিন করত। ভাবত কয়টা দিন যাক, তার পর দেখা যাবে। মাস ছয়েক গেল, একদিন ক্লিনিকের এক আয়া বলল, ‘কামাই করতে ঢাকা আইছো, সুইপারি করতাছো ক্যান? বয়স কম, শরীলে ভরা যৈবন, কামাই বাড়াইতে চাইলে আমারে কইও।’ কথাটা মাথায় ঘুরছিল, ঠিকই তো কামাই করতেই শহরে এসেছে, বেশি কামাই-রোজগারের পথ থাকলে মেথরানিগিরি করবে কোন দুঃখে! দুই দিন পরে সেই আয়া রাখঢাক ছাড়া বলল নারায়ণগঞ্জ টানবাজারে তার মতো মেয়ের অনেক কদর। টানবাজারের কাহিনি ভেঙে জানাল সে তো বিক্রি হতে যাচ্ছে না, সর্দারনির সাথে ফয়সালা করলে কোনো ঝামেলা হবে না, সর্দারনির বখরা দিয়ে স্বাধীন ব্যবসা করতে পারবে। মান্তু বেশি ভাবাভাবিতে যায়নি, মাত্র একদিন সময় নিয়েছিল, তার পর সেই আয়াই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বয়স্ক এক বোরকা পরা মহিলাকে দিয়েছিল তাকে নিয়ে যেতে, আর শর্ত অবশ্য একটা দিয়েছিল মাসে মাসে সর্দারনির মাসোয়ারার সঙ্গে বাড়তি কিছু দিতে হবে যা যাওয়ার পর সর্দারনিই ঠিক করে দেবে।

    চম্পা কাঠ-কাঠ হয়ে শুনছিল। মান্তু বলে যাচ্ছিল যেন ছোটবেলায় ঝড়ে আম কুড়ানোর গল্প শোনাচ্ছে। পাক্কা তিন বছর ছিল। ক্লিনিকের আয়া যত সহজ করে বলেছিল, আসল ঘটনা মোটেও সে রকম ছিল না। মারামারি, হাঙ্গামা, পুলিশ, খদ্দেরদের ঠকবাজি, মস্তানি, সর্দারনির চশমখুরি কী না ছিল! তবে এত কিছুর পরও কামাই-রোজগার ভালো ছিল। ঘরে টাকা রাখত না, ব্যাংকে জমাত। তিন বছরে পঞ্চাশ হাজারের মতো জমেছিল। তখন মাঝে মাঝে ভাবত গ্রামে গিয়ে ভাইদের সংসারে বোঝা না হয়ে চম্পা যে রকম মুরগির খামার করেছিল সে রকম একটা খামার করবে। কিন্তু টাকা কোথায় পেল এ নিয়ে কথা উঠবে; এর জবাব মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু তখনি ঘটনা ঘটল।

    এক নিয়মিত খদ্দের, যে তাকে বউ করে নিয়ে যাবে এমন কথা নেশার ঘোরে প্রায়ই বলত, এক সন্ধ্যায় এসে শুরু করল মহাহুজ্জত। নেশায় ভোম হয়েছিল, ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিল না, তারপরও মুখখারাপ করে চিৎকার করে বলছিল বাসন্তী–মান্তুর ওখানকার নাম—নাকি আগের রাতে তার মানিব্যাগ থেকে পাঁচশ ডলার হাতিয়েছে। পুরনো খদ্দের, সর্দারনি ছুটে এসে হাতে-পায়ে ধরে বলেছিল সে ব্যাপারটা দেখছে, কিন্তু লোকটার তখন মাথা খারাপ অবস্থা, সে সর্দারনিকে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে মান্তুকে লাথি মেরে ফেলে বুকে হাঁটুচাপা দিয়ে বসেছিল। হাঁসফাঁস করে নিজেকে ছাড়িয়ে মান্তু দেখছিল লোকটাকে, মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বমি করবে বলে গা ঝাঁকাচ্ছে। তার ডলার সরানো দূরের, হাত পেতে তার কাছ থেকে সে কোনো দিন টাকা-পয়সা নেয়নি। আর নেশার চোটে লোকটা তো কত কথাই বলত। হঠাৎ শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে সে হামাগুড়ি দিয়ে তাকে ধরবে বলে কেবল হাত বাড়িয়েছে, মান্তু এক ঝটকায় টেবিলে রাখা লোকটারই মদের বোতল তুলে মাথা বরাবর বসিয়ে দিয়েছিল।

    মেঝেতে কপাল ঠুকে লোকটা উপুড় হয়ে পড়েছিল। বোতলটা ভাঙেনি, হাত থেকেও ছুটে যায়নি, কেবল ভোঁতা একটা আওয়াজ উঠেছিল যা বেশ্যাপাড়ার সন্ধ্যা রাতের ক্যাচমেচে দরজার বাইরে যাওয়ার কথা নয়। কয়েক মিনিট কেটে গিয়েছিল, মান্তু অপেক্ষায় ছিল, লোকটা ওঠামাত্র বোতলটা আরও জোরে ঠিক মাথার পেছনে যেখানে শুনেছে ঘিলু থাকে ওখানে বসাবে। আরও কয়েক মিনিট কেটে গিয়েছিল। লোকটা ওঠেনি। এক সময় বোতল রেখে মান্তু দেখতে পাচ্ছিল লোকটার কান বেয়ে গাঢ় রক্তের একটা রেখা মেঝেতে লেজ মুচড়ে চওড়া হচ্ছে। দরজাবন্ধ ঘরে চুপচাপ বসে রক্তের রেখাটার দিকে তাকিয়ে সে আন্দাজ করতে পারছিল না ভোর পর্যন্ত রেখাটা কত দূর যেতে পারে, দরজার নিচ দিয়ে বাইরে যাওয়া ঠেকানো দরকার। বিছানার চাদর-বালিশ জড়ো করে একটা ব্যবস্থা করেছিল। ভোর হওয়ার আগেই এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছিল।

    চম্পা ভয়ে অন্ধকারে চোখ খুলতে পারছিল না। এ কে তার পাশে? মান্তু বলে যাচ্ছিল। বাইরে এসে সামনে যে বাস পেয়েছিল উঠে বসেছিল। অনেকক্ষণ পরে মিরপুর গোল চক্করে বাস থামতে নেমেই খানিকটা দূরে এক গলিতে ঢুকে প্রথম যে বাসাটা পেয়েছিল ঢুকে পড়েছিল। কাজ খুঁজতে এসেছে শুনে বাসার বুড়ি মহিলা বলেছিল, তাদের দরকার নাই, তবে মহিলার মেয়ে থাকে ধানমন্ডিতে, মেয়ের বুয়া দরকার। রান্নাবান্নার লোক আছে, বাচ্চা আছে দুজন, তাদের দেখাশোনা করতে পারবে কি না? মান্তু মাথা নেড়ে জানিয়েছিল রাজি।

    এ পর্যন্ত বলে মান্তু চুপ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে চৌকি থেকে নেমে পানি খেয়ে আবার শুয়েছিল। আর ঘুমিয়েও পড়েছিল। চম্পার অস্থির অস্থির লাগছিল, মনে হচ্ছিল শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উঠে বাইরে খোলা বাতাসে যেতে বা পানি খেতেও সাহস হচ্ছিল না।

    পরদিন, যেন আগের রাতে তেমন কিছুই হয়নি এমনভাবে মান্ত্র বলল, ‘তুমারে না কইয়া কেমনে থাকি!’

    ‘তরে তো পুলিশে …’

    তুমি ধরাইয়া দিও না। আর পুলিশে কারে খুঁজব, বাসন্তী তো মইরা গেছে।’

    চম্পা জবাব দিল না। বোতল মাথায় ঠুকে খুন করার চেয়ে মান্তু বছরের পর বছর বেশ্যাপাড়ায় পার করেছে, তাও নিজের ইচ্ছায়, কথাটা ভেবে সে কিছুতেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছিল না। এও ভাবছিল, নিজে সেধে ঘরে এনে তুলেছে, এখন ওকে তাড়ায় কী করে! আবার এমনও ভাবছিল, হঠাৎ মান্তু খিলখিলিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘কেমন ডর দেখাইলাম, সব মিছা।’

    লাল-চোখ বেজি

    এর নাম যুদ্ধ শেফালি ভাবেনি। ঢাকায় মানুষ মেরে সাফ করে ফেলেছে, এসব পুরনো খবর। নতুন খবর বলতে মিলিটারিরা সবখানে আস্তানা গাড়ছে। তাদের গ্রামটা বেশ ভেতরে, রাস্তাঘাটের সুবিধা নাই, না হলে এদিকেও নাকি আসত। হিন্দুদের যেখানে পাচ্ছে মারছে শুনে গ্রামের কয়েক ঘর হিন্দু আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। পুব দিকে পাঁচ-ছয় মাইল পরে বর্ডার, ওপারে আগরতলা। আখাউড়া দিয়ে গেলে একটু বেশি পথ।

    জ্ঞাতিরা পালাচ্ছে দেখেও বটু পাল যায়নি। সে বলে, ওখানে কাউকে চেনে না, যাবে কার কাছে? প্রায়ই সন্ধ্যায় শেফালিদের বাড়ি এসে বসে থাকে, কোনো দিন বীণাকেও সঙ্গে আনে। বসে বসে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলে, কী করবে? শুনেছে আগরতলায় এপারের ম্যালা মানুষ, লঙ্গরখানা খুলেছে, এক বেলা খাবার দেয়। আবার এও খবর রাখে, ওখানে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হয়েছে। তার জ্যাঠার পরিবার গেল, যাওয়ার সময় সাধাসাধি করেছে, না গিয়ে ভুল করেছে কি না ঝুঝতে পারছে না। এখন যদি যায়, ওদের কোথায় খুঁজবে। আগরতলা শুনেছে বড় জায়গা। মেয়ে-বউ ও ছোট ছেলেকে নিয়ে যেতে হলে এখন একলাই যেতে হবে। হাঁটাপথও একেবারে কম না। মেরাজ ফকির তাকে সাহস দেয়, বলে মিলিটারি নবীনগর পর্যন্ত এসে ক্যাম্প করেছে, আর এদিকে আসবে বলে মনে হয় না। আবার এও বলে, তার জান থাকতে বটু পালের পরিবারের কিছু হতে দেবে না। শুনে শেফালি অবাক হয়, তার বাপ কীসের ভরসায় এত বড় কথা বলে!

    এদিকে যে হিজল সেই ভোটের সময় থেকে নাওয়া-খাওয়া ফেলে বাইরে বাইরে ঘুরত, সে বাড়িতে বসে আছে। যারা তার সঙ্গে থাকত, তাদের কেউ কেউ মুক্তির ট্রেনিং নিতে চলে গেছে। হিজল কোথা থেকে একটা রেডিও জোগাড় করেছে, রাতে সেটা কম আওয়াজে চালায়। স্বাধীন বাংলা রেডিও শোনে, কোনো

    ৯৮। উপন্যাস

    দিন মেরাজ ফকিরসহ ঘরের সবাইকে শোনায়। তার মতিগতি বোঝা কঠিন। বয়স কম, মুক্তির ট্রেনিংয়ে তাকে নেবে না এ জন্যই হয়তো মন খারাপ করে সারা দিন বাড়িতে কাটায়। রুশনি বেগম ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। স্বামীকে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলে—যদি হিজল চলে যায় তাদের কী অবস্থা হবে! হিজলকেও বলে সে কথা। হিজল জবাব দেয় না।

    বর্ষা শুরু হয়ে গেছে অন্যান্য বছরের চেয়ে আগে। প্রায় দিনই আকাশ কালো, নয়তো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, পথে-ঘাটে কাদা, উঠানে পর্যন্ত নামার উপায় নাই। ছোট ঘর, মাত্র দুইটা কামরা, কতক্ষণ ঘরবন্দি থাকা যায়! শেফালির দম আটকে আসতে চায়। দাওয়াটা যদি বড় হতো মাঝে মাঝে গিয়ে বসা যেত, বৃষ্টির ছাঁটে চিলতে দাওয়ার অবস্থাও উঠানের মতো, ভেজা মাটিতে পা আটকে যায়। এ সময় একদিন বিকাল থেকে জোর বৃষ্টি, সঙ্গে শোঁ শোঁ বাতাস, সন্ধ্যার পরেও বৃষ্টি-বাতাসের কমতি নাই। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিল সবাই। মাঝরাতে হঠাৎ মড়মড় আওয়াজ। উঠানের এক কোণের কাঁঠাল গাছটা বিকট আওয়াজ তুলে পড়ল তো পড়ল গোয়ালের একচালায়। আওয়াজ শুনে রুশনি বেগম বেরিয়ে কাত হওয়া গোয়াল থেকে গরু দুটোকে বের করতে হিজলকে ডেকে সাড়া না পেয়ে মেরাজ ফকিরকে ঘুম থেকে তুলল। ঘুমচোখে বেরিয়ে সেও হিজলকে ডাকল। গরু দুইটাকে বের করে কোথায় রাখে, অন্তত রাতের জন্য একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। কিন্তু হিজল কোথায়? ডাকাডাকিতে শেফালিও বেরিয়ে এলো। উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনজনই ভিজছিল, কাত হওয়া গোয়ালের দিকে চোখ, কিন্তু সবার মাথায় তখন হিজল। আসমানে বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছিল, তাতে ভাঙা গোয়ালে গরু দুইটার ভয় পাওয়া চোখও ঝলকে উঠছিল।

    তুফানের মধ্যে কেন যে হিজল বাড়ি ছেড়ে গেল এ দুঃখে রুশনি বেগম গলা ছেড়ে মাতম করে উঠল, ‘জানতাম ও থাকব না, যাইবই, তুফানের রাইতে ক্যান গেলি রে বাপ!’

    চারজনের মধ্যে একজন চলে যেতে বাড়িটা ঝিমিয়ে পড়েছে। হিজল নিশ্চয় একা যায়নি, কিন্তু কার সাথে গেল জানা গেল না। দিন পাঁচেক পরে খোঁজ মিলল আরমান নামে তার থেকে বছর চারেকে বড় একটা ছেলেকেও তার বাড়ির লোকজন পাচ্ছে না। আরমানের সঙ্গে হিজলের ওঠা-বসা ছিল না, তবে সেই তুফানের দিন সকালে দুজনকে কারা যেন দেখেছে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে এক সাথে হাঁটতে। ছেলে চলে গেছে, এ সময় কোথায় যেতে পারে সবার জানা, হা-হুতাশ করে বেশি বেশি লোকজনকে জানান দেওয়া বিপদের বলে মেরাজ ফকির মুখ বন্ধ করে আছে, কিন্তু রুশনি বেগমকে থামানো মুশকিল। সে কাঁদে, কচি ছাওয়ালটা যুদ্ধের কী বোঝে, বেঘোরে মরে পড়ে থাকবে, লাশটাও দেখতে পাবে না। মেরাজ ফকির বোঝায় মনের কষ্ট যেন মনেই রাখে, কান্নাকাটি করে লাভ কী! কাজ হয় না।

    এসবের মধ্যে প্রতিদিনই নানা খবর আসে। কোথাও মিলিটারিরা আগুন দিয়ে পুরো একটা গ্রাম জ্বালিয়েছে, কোথাও খাল বা নদীর পাড়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে সাত-আটজনকে মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। ফোলা-ফাঁপা লাশ ভাটির টানে দূরে কোথাও গিয়ে ভিড়েছে। তবে যত খবরই আসুক, সেসব কাছাকাছির না, দূরের—ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জের আশপাশের। ওই দিকে মিলিটারির চলাফেরায় সুবিধা, আর কিছু দূরেই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট। সেই আশুগঞ্জ থেকে হঠাৎ এক দিন এসে হাজির মেরাজ ফকিরের এক বোনের পরিবার। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে বোন, বোনের জামাই কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ নৌকায় করে এসে জানাল তাদের পাশের গাঁয়ে মিলিটারি আসার খবর পেয়ে কোনো মতে জান নিয়ে পালাতে পেরেছে, এতক্ষণে তাদের বাড়িঘর পুড়ে ছাই হওয়ার কথা।

    গ্রামে অনেক বাড়িতেই দূর-দূরান্ত, এমনকি কুমিল্লা-চিটাগাং থেকেও আত্মীয়- স্বজন এসে ঠাঁই নিয়েছে। কাউকে কাউকে দেখে বোঝা যায় টাকা-পয়সাওয়ালা মানুষ, গাঁয়ে কোনো দিন থেকেছে এমনও মনে হয় না। এ রকম একজন হায়দার আকন্দ। মাঝবয়সি মানুষ, থাকেন কুমিল্লা শহরে। পরিবার নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে এসে উঠেছেন মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে। কাঁচা রাস্তায় গাড়ি চালাতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। মামাতো ভাই মোত্তালেব মিয়ার অবস্থা ভালো, বাড়িতে দুইটা বড় বড় ঘর, একটা ঘর ওদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ছেলে-মেয়েরা আগে গ্রাম দেখলেও থাকতে আসেনি, এবার এসে নাকি ওরা আনন্দে আছে। আর হায়দার আকন্দের বিশ্বাস শ্যামপুরের মতো গ্রাম এ সময় আশপাশের অনেক জায়গা থেকে নিরাপদ। তবে তার একটা সমস্যা হয়েছিল গাড়ি নিয়ে, গাড়িটা রাখেন কোথায়, খোলা জায়গায় রাখতে ভয়, বলা তো যায় না, গাড়ির কারণে না উটকো বিপদে পড়েন। শেষে এক রাতে মোত্তালেব মিয়ার খড়ের পালায় গর্ত করে গাড়ি ঢুকিয়ে গর্তটা বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে গাড়ি দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু পড়শিরা কে না জানে তার মরিচ-লাল গাড়িটা কোথায়।

    গ্রামে বাইরের মানুষ আসায় যেমন পরিবর্তন হয়েছে, অন্য পরিবর্তনও ঘটেছে। শান্তি কমিটি বলে একটা জিনিস হয়েছে, এতে যারা আছে তাদের কাজ এলাকায় শান্তি নষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা করা। দুই দিনেই বোঝা গেল তারা আসলে মিলিটারির দালাল। গ্রামে মুক্তি আছে কি না, থাকলে খবর দেওয়াই তাদের পয়লা কাজ। তাদের সাহায্য করতে খাকি পোশাকে পুলিশের মতো দেখতে রাইফেল হাতে কিছু বেকার ছেলে-ছোকরা ঘুরে বেড়ায়। নাম দিয়েছে রাজাকার। গ্রাম থেকে কয়েকজন যে আগরতলা চলে গেছে আর এদের মধ্যে হিজলও আছে এ খবর তাদের জানা। তবু একদিন দুইজন এসে জানতে চাইল ঘটনা সত্যি কি না। মেরাজ ফকির কেঁদেকেটে বলল সে জানে না হিজল কোথায়, কারো কুবুদ্ধিতে যদি ওপারে গিয়েও থাকে, যে কোনো দিন পালিয়ে চলে আসবে, নিশ্চয়ই পালানোর পথ খুঁজছে। শিং মাছের গালা খেয়ে যে ছেলে কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তোলে, সে করবে যুদ্ধ, পয়লা সুযোগেই ভেগে চলে আসবে।

    বাড়িতে মানুষ আসায় একটা লাভ হয়েছে, খাওয়ার মুখ বাড়লেও বিপদের সময় আপন মানুষ কাছে পাওয়ায় মেরাজ ফকির মনে জোর পাচ্ছে। তার বোনের বাচ্চারা ছোট ছোট, ছয় থেকে দশ বছরের মধ্যে বয়স। সবাই স্কুলে যেত, এখানে বই-খাতা, পড়াশোনা নাই। ওরা সারক্ষণ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি করে কাটিয়ে দেয়। রাতে শোয়ার ব্যবস্থা নিয়ে কিছু সমস্যা হলেও না মেনে উপায় কী! শেফালির ঘরে শেফালির মা ও তার ফুপুসহ ফুপুর তিন ছেলে-মেয়ে, শোয়ার পর পা ফেলার জায়গা থাকে না। অন্য ঘরে মেরাজ ফকির ও বোনজামাই। মেরাজ ফকিরের তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট এই ফুপুকে মাত্র দুই-তিনবার দেখেছে শেফালি। এবার এই মহিলাকে তার খুব মনে ধরল। কথাবার্তা বলে আস্তে-ধীরে, আশুগঞ্জে তাদের ধানের কল আছে, খেত-জমিও মন্দ না। শেফালিকে খুব করে বলল, গণ্ডগোল থামলে তাকে কিছু দিন তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখবে। অল্প দূরে মেঘনা নদী, নৌকায় করে তাকেসহ ভৈরব যাবে, মস্ত বাজার।

    বাড়িতে মানুষের মেলায় হিজলের কথা আর সেভাবে মাথায় থাকে না। হিজল আরমানের সঙ্গেই গিয়েছে। আরমান তার বাড়িতে কাকে দিয়ে যেন খবর পাঠিয়েছে সে ও হিজল ভালো আছে। দুজন মেলাঘর মুক্তি ক্যাম্পে আছে। চুপিচুপি খবরটা এ বাড়িতে আসতে রুশনি বেগম নফল নামাজ পড়ে ছেলের জন্য লম্বা দোয়া করল। মেরাজ ফকিরকে বলল দুই রাকাত নামাজ পড়তে। শেফালি নামাজ না পড়লেও ভাইয়ের জন্য রাতে শুয়ে শুয়ে যত দোয়া-দরুদ জানে পড়ল। আশ্চর্য সে রাতেই সে স্বপ্নে দেখল হিজল ফিরে এসেছে। তাগড়া-লম্বা জোয়ান, প্রথমে চিনতে পারেনি, পরে দেখল হিজলই। উঠানের মাঝখানে একটা বড় গর্ত খুঁড়ে বলল, ‘বুজি, মিলিটারিরা এদিকে আসলে এই গাতায় লুকাইয়া থাকবি।’ ঘুম ভেঙে যেতে স্বপ্নটার মাথামুণ্ডু না বুঝে সে চৌকি থেকে নেমে সাবধানে এর পা ওর মাথা বাঁচিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। ভোর হচ্ছে কেবল, দূরে কোনো মসজিদে মুয়াজ্জিনের ভাঙা গলা পাতলা হাওয়ায় বেঁকেচুরে উঠছে-নামছে। পরিষ্কার উঠান, একটা খড়কুটো পর্যন্ত নাই, এখানে হিজল এসেছিল কী করতে? আর গর্ত যে খুঁড়ছিল, হাতে কোদাল-টোদাল তো দেখেনি, খালি হাতে উবু হয়ে বেদম মাটি তুলছিল। মনে একটা কুডাক টের পেল শেফালি, হিজলের কি কিছু হয়ে গেছে, গর্তটা তার নিজের জন্য না তো!

    উঠানে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে মনে পড়ল এই কিছু দিন আগেও কানের গোড়ায় একটা দোয়েলের পাগলাটে গানে বা ডাকে ভোরের ঘুম মাটি হতো। উঠানের কোনায় খাট্টা আমগাছটা ছিল তার পছন্দের জায়গা। পাখিটার ডাক শোনে না ইদানীং, গুলতি দিয়ে কেউ মেরে ফেলেনি তো! বা অসুখ-বিসুখে মরে গেছে কি না কে জানে। পাখিরা নাকি মরার সময় হলে নিজেরা টের পায়, যেখানে-সেখানে মরে পড়ে থাকে না, জঙ্গলে তাদের জন্য জায়গা আছে। বটু কাকার কাছে শোনা ছোটবেলায়। বটু কাকা পাখিদের নিয়ে অনেক খোঁজ-খবর রাখত। বলত শীতের সময় নাকি হলদে পাখির গায়ের রঙ ফ্যাকাসে মেরে যায়, কিন্তু শীত এলেই শালিকের ঠোঁটে, পায়ে হলুদ রঙটা তেজি-টাটকা হয়ে কমলা রঙ ধরে। কত কথা বলত বটু কাকা, আজগুবি কথাই বেশি। বাচ্চাদের সঙ্গেই তার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত। একে ছিপ বানিয়ে দিচ্ছে, ওকে ঘুড়ি। শেফালিকে একবার মেলা থেকে একটা ছোট সোনা-ঝলমল হরিণ এনে দিয়ে বলেছিল, ‘এইটা সেই সোনার হরিণ যার জইন্য এত।’ শেফালি জানতে চেয়েছিল কার হরিণ, কীসের হরিণ?’আরে ফকিরের বেটি এইটাও জানস না, সীতা পাগল অইছিল যে হরিণের জইন্য’ বলে সে রামায়ণের কাহিনি শোনাতে লেগে গেলে রুশনি বেগম তেড়েমেড়ে এসে বলেছিল, ‘আর কাম পাইলা না, আমার মাইয়ারে তুমাগো রাম-সীতার কিস্সা কও!’ হরিণটা হাতে নিয়ে মা তারিফ করেছিল। অনেক দিন রেখেছিল শেফালি, রঙ মরে গিয়েছিল, তাও ফেলেনি। হিজল একদিন নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলেছিল।

    কয়েক দিন বৃষ্টির পর চনমনে রোদ উঠেছে। ঘরে কেউ জাগেনি। রোদের কারণেই হবে, রাতের স্বপ্নটা মাথায় ঝাপসা হতে শুরু করেছিল। শেফালির ইচ্ছা করছিল পায়ে পায়ে রুকিয়াদের বাড়ি যায়, রুকিয়ার ভোরে ওঠার অভ্যাস। গেলে হয়তো দেখবে গালে হাত দিয়ে বসে রুকিয়া তার ফুপাতো ভাইয়ের কথা চিন্তা করছে। কী যেন নাম! আজকাল কী হয়েছে নাম ভুলে যায়, তার বাবার রোগ তাকে পেল নাকি! তার বাবা মাঝে মাঝে কাছের আত্মীয়-স্বজনের নামও মনে করতে পারে না, বলে নাম ভুলে যাওয়া খালি বয়সের লক্ষণ না, মরার লক্ষণ। বাবার কথা! এই তো মনে করতে পারছে, রুকিয়ার ফুপাতো ভাইয়ের নাম ইমদাদ।

    হঠাৎ দূর থেকে শোরগোলের আওয়াজ শুনে শেফালি কান পাতল। দমকা একটা ধাক্কার মতো উঠে মিলিয়ে যেতে যেতে আবার উঠল। অনেক দিন আগে তিন-চার মাইল দূরে মেলাদিয়া বাজারে আগুন লাগার পর এ রকম আওয়াজ পেয়েছিল। সময়টা ছিল সন্ধ্যা, হাটবার ছিল হয়তো, অনেক মানুষের একজোট চেঁচামেচি দূরে দূরে থাকলেও হাওয়ার টানে এত পথ পাড়ি দিয়ে মৌমাছির গুনগুনের মতো কানে বাজছিল। কিন্তু এত ভোরে এই আওয়াজ আসছে কোথা থেকে?

    এ সময় কাছেপিঠে কাদের ডাকাডাকি, ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ির দাপাদাপিতে তার মনে হলো আওয়াজটা সে একাই পাচ্ছে না। ততক্ষণে ঘর থেকে বড়রা বেরোতে শুরু করেছে। বাইরে থেকে কে একজন হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে গেল কাছেই সোনাপুরে মিলিটারি ঢুকেছে, এদিকে আসছে। দেখতে না দেখতে আশপাশের বাড়িঘর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এলো। সবার এক কথা পালাতে হবে, বাড়িতে থাকা চলবে না। ছুটে ছুটে বটু পাল তার বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে হাউমাউ জুড়ে দিল, সে কী করবে? অন্যদের কী হবে জানে না, তবে তাকে বা তার পরিবারের কাউকে জ্যান্ত রাখবে না। মেরাজ ফকির কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। ঘরে এত মানুষ, যুবতী মেয়ে, বোনের বাচ্চা-কাচ্চা, এদিকে আবার বটু পালের পরিবার। পালাবে যে, যাবে কোথায়? এত বড় বহর নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলা আর বিপদ ডেকে আনা এক কথা। এ অবস্থায়ও সে বটু পালকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তাদের যা হয়, তারও তাই হবে। তারা যাবে না কোথাও, বাড়িতে থাকবে, আল্লা-আল্লা করবে, পাকিস্তানের একটা নিশান যদি থাকত! এ সময় তার মাথায় অন্য দুশ্চিন্তা ঢুকল, শেফালি আর বীণাকে তো সরানো দরকার, বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড় থাকলে হতো, কী করা!

    পড়শিরা ছুটছে, কারো হাতে জিনিসপত্র, কারো হাত খালি। হঠাৎ পাশের বাড়ির রহমত এসে মেরাজ ফকিরকে কানে কানে কিছু বলতে সে চোখে অন্ধকার দেখল। তাই তো, তার ছেলে মুক্তি, এটা জানার পর তাদের কারো রেহাই মিলবে! এ ছাড়া এ গ্রামে মুক্তি লুকিয়ে আছে এ খবরেই নাকি মিলিটারিকে পথ দেখিয়ে আনছে রাজাকাররা। বোনজামাই আর বটু পালের সঙ্গে চটপট কথা বলে সে মত বদলাল। তারা রাস্তার দিকে না গিয়ে বাড়ির পশ্চিমে গাছপালার আড়ালে কিছু পথ হেঁটে গিয়ে নামবে ধানখেতে, আউশ ধান এখনো সব উঠতে বাকি, বৃষ্টির পানি আছে, বুক-গলা ডুবিয়ে যত দূর যাওয়া যায়। ওদিকে রাস্তাঘাট নাই, যদি ঘণ্টাখানেক কোনোমতে চলা যায়, সাহাদের বড় বড় মানকচুর খেত পড়বে, ওখানে লুকিয়ে থাকতে সুবিধা।

    এত দূর চিন্তা করার পর মেরাজ ফকির আর সময় পায়নি। গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, রোদে পুড়ে পাকা বাঁশের গিঁট ফাটার মতো পর পর কয়েকটা আওয়াজ কানে আসামাত্র সে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে উঠানে জড়ো করেছিল। তার পর কী করতে হবে, কোন দিকে যেতে হবে বলে আর দাঁড়ায়নি। আগে আগে হেঁটে পুরো বহরকে নিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা জংলা পার হয়ে ধান ক্ষেতে নেমে পড়েছিল। এক এক করে সবার নাম ধরে ধরে ডেকেওছিল।

    শেফালির পষ্ট মনে আছে তার নাম ধরে বাবা তো ডাকছিলই, মা-ও ডেকে ডেকে বাবার পিছু পিছু পা চালিয়ে খেতে নেমে গিয়েছিল। খেতে পানি ছিল, হাঁটুপানি বা কিছু বেশি, দলবেঁধে নামতে গিয়ে ঝুপুস আওয়াজে ভয় পেয়ে কিছু সময় সবাই গুটিসুটি মেরে বসেছিল, আর ধানগাছগুলো আধপাকা বা পাকা ধানের ভারে ঘাড় বাঁকিয়ে থাকায় মাথা নিচু করেও সবার পক্ষে নিজেদের আড়াল করা যাচ্ছিল না। একটু পরে যে যার মতো পানিতে যতটা সম্ভব কাঁধ-পিঠ ডুবিয়ে এগোতে শুরু করেছিল। শেফালি দেখছিল অন্যরা তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। সে কিছুতেই সুবিধা করতে পারছে না। এমন সময় তার নজর পড়েছিল কিছুটা দূরে পানির ওপরে ডুবুডুবু খেতের আইলের ওপর। আইলটা কিছু দূর গিয়ে অন্যদিকে বেঁকে গেছে। তার তখন মনে হয়েছিল, যেদিকেই যাক, সে আইল ধরেই যাবে— কাদা-পানিতে নড়তে পারছে না। পানিতে ধানগাছের গায়ে গায়ে নানা জাতের লতা-পাতা, ধঞ্চে গাছের ঠাসাঠাসি দঙ্গল।

    পানি ছেড়ে কিভাবে উঠেছিল আর আইল ধরে ছুটতে গিয়ে সে যে দল থেকে আলাদা হয়ে কোন পথে যাচ্ছিল মাথায় খেলছিল না। কতক্ষণ ছুটেছিল মনে নেই, এক সময় দেখতে পাচ্ছিল সে পুরোপুরি ডাঙায়, সামনে খোলা ময়দানের মতো, ময়দানের ওপাশে কী তার জানা ছিল না। ভাবাভাবির সময় নাই, সে ময়দানের মাঝ বরাবর দৌড়ে একটা ছাড়াবাড়ি পর্যন্ত গিয়ে থেমেছিল। পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। তার বাবা যে কোন বুদ্ধিতে সবাইকে নিয়ে খেতে নামল! আইল ধরে সে যেমন এসেছে, বাকিরাও চলে আসতে পারত।

    চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটা চিনতে পারল, এ তো পশ্চিম পাড়ার শেষ মাথা। এত দূর চলে এসেছে ভেবে সে অবাক হলো। সামনের ছাড়াবাড়িতে কারো সাড়াশব্দ নাই, বাঁশঝাড় আর নানা গাছপালায় চারপাশ ঢাকা পড়ে আছে। তার বাবা যে কেন এ পথে এলো না! এমনও মনে হলো এখানে লুকিয়ে থাকলে কেউ খুঁজে পাবে না। সে কী করবে, ছাড়াবাড়িতে ঢুকে বসে থাকবে কি না ভাবতে ভাবতে কিছুটা এগিয়ে দেখতে পেল বাড়ি থেকে সামান্য তফাতে গ্রামের একমাত্র কালীমন্দির। বাজ পড়ে মন্দিরের চূড়ার এক অংশ ভেঙে পড়ায় এখন নাম মাথাভাঙা কালীমন্দির। মন্দিরের নোনাধরা দেওয়াল ঘেঁষে নয়নতারা গাছে ফুল আর ফুল। খানিকটা দূরে লাল শাপলা-ফোটা ছোট পুকুর। এদিকে আসা পড়ে না বলে পুকুর বা শাপলার খবর জানা ছিল না। পুকুরের পাড়ে বেঁকাত্যাড়া ডাল ছড়ানো কঙ্কালের মতো কয়েকটা বরুণ গাছ, কঙ্কালের হাড় থেকে ঝুলছে হাঁসের ডিমের আকারের মেটে রঙের ফল বা গোটা। দূরে দাঁড়িয়েও গন্ধ পাচ্ছিল। গন্ধটা বাজে, শাপলা-ফোটা পুকুরপাড়ে বরুণ গাছ কেন? ভাবতে গিয়ে গোড়ালির খানিকটা ওপরে জ্বলুনি টের পেয়ে পা ঝাড়ল, একটা তেলতেলে চিনাজোঁক ছিটকে পড়তে বারকয়েক পা ঝেড়ে সামনে এগোল।

    বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা পায়ের চাপে খড়মড় করে কানে বাজছিল। গায়ে লেপ্টে বসা ভেজা কাপড়ে শীত শীত করছিল। এমন সময় কীসের আওয়াজে চমকে ঘাড় ঘোরাতে চোখে পড়েছিল প্রায় বিড়ালের আকারের একটা বেজি বাঁশঝাড়ের গোড়া থেকে বেরিয়ে সামনের দুই পা তুলে পলকহীন লাল চোখে তাকে দেখছে। বেজিটার তাকানোয় যে কী ছিল, শেফালি না পারছিল সামনে পা বাড়াতে, না পারছিল মাটি থেকে একটা কিছু তুলে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে। পা তার আটকে গিয়েছিল।

    বেজিটা যে বেজি ছিল না তাকে তখন কে বলবে! না হলে সেই যে সে তাকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, সে সুযোগেই পেছন থেকে হাত এসে পড়েছিল মুখে, পরপরই শরীর ঘের দেওয়া কঠিন বেড়ি। রাজাকার তৈমুরের হয়ে বেজিটাই তাকে আটকে রেখেছিল।

    জাফর সাদেকের শুরু

    সাপ্তাহিক দ্য এক্সপ্রেস তার লেখা ছাপবে এ নিয়ে জাফর সাদেক সংশয়ে ছিলেন। লেখা দেওয়ার সময় সম্পাদক তেমন আগ্রহ দেখাননি। ভদ্রলোকের নাম আগে শুনেছেন। দেশে এসে আরও যা শুনলেন তাতে চমকে ওঠারই কথা। বিলেতে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন, সেখানে বার্গম্যানের সেভেন্থ সিল দেখে নাকি সিনেমা বানানোর নেশায় পড়েন। তবে নেশাকে মুলতবি রেখে ইংল্যান্ডের তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ও পার্টির পত্রিকা ডেইলি ওয়াকারে রিপোর্টার হিসাবেও কিছু দিন কাজ করেন। তখন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। পরে আলজেরিয়া ও প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেন। সে সময় ফ্রান্সে কয়েক মাস জেলও খাটেন। ষাটের শেষ দিকে দেশে ফিরে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে আবার জেলে যান। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা রেডিওতে ইংরেজি অনুষ্ঠান পরিচালনাসহ রোজ সন্ধ্যায় ইংরেজি খবরও পড়তেন আহমেদ চৌধুরী নামে।

    সেই আহমেদ চৌধুরী ওরফে আলমগীর কবির তাকে প্রথম দেখায়ই পাত্তা দেবেন, জাফর সাদেক আশা করেননি। আর বড় কথা, তিনি তো লেখালেখির লোক না। কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটে নিউজ লেটার বের করতে গিয়ে লেখাজোখা যা করেছেন, সেসবে চিন্তা বা কল্পনাশক্তি কোনোটারই তেমন দরকার পড়ত না। গৎবাঁধা লেখা। যে কারণে ছাপানোর জন্য যে লেখাটা নিয়ে নয়াপল্টনে এক্সপ্রেসের দুই কামরার অফিসে গিয়েছিলেন, সেটার ব্যাপারে নিজে যথেষ্ট কুণ্ঠিত ছিলেন। ফুলস্কেপ কাগজে টাইপ করা কুড়ি-বাইশ পাতার বড়সড় তাড়াটা দেখে সম্পাদক আলমগীর কবির ভ্রু কুঁচকেছিলেন।

    দিন তিনেক পরে বাসায় ফোন, তাকে পত্রিকা থেকে তলব করা হচ্ছে। ফোনটা করেছিলেন খোদ সম্পাদক।

    সামনাসামনি বসতে আলমগীর কবির তার সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। শুনে বললেন রেপ ভিকটিমদের নিয়ে বোঝা যাচ্ছে তার অনেক হোমওয়ার্ক রয়েছে, যে লেখাটা লিখেছেন সেটাই প্রমাণ, এ ধরনের লেখা কেউ লেখেনি। ড্রয়ার থেকে লেখার তাড়াটা বের করে বললেন, ‘আপনার ল্যাংগুয়েজ ইজ রিয়েলি কমেন্ডবল, বাট রাদার লাউড। এটা হয়, যখন আপনি কোনো কিছু নিয়ে বেশি চার্জড হয়ে পড়েন। প্রয়োজনের কথা তো জোরে বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বেশি জোরে বললে আবার মানুষ শুনতে চায় না। ইংরেজিতে এই জোরে বলাটা খাটে না। এ জন্য ফ্যাক্ট-ফিগার খুব জরুরি। আপনার ল্যাংগুয়েজ একটু টোন ডাউন করে দেব। দেশে যদি এ সময় একটা ভালো জার্নাল থাকত, ছাপানোর ব্যবস্থা করে দিতাম। আমার ছোট কাগজে তো এত স্পেস দিতে পারব না। এক কাজ করা যায়, কয়েক ইনস্টলমেন্টে যতটুকু আনা যায়। তবে কিছু এডিটিং লাগবে। হেডিংটাও বদলে দেব, আপত্তি আছে? খবরের কাগজে আমরা প্রায় সবার লেখায়ই কাঁচি চালাই, চালাতে হয়।’

    জাফর সাদেক বুঝতে পারছেন না কী বলবেন। তিনি তো দিন-রাত মাথায় ঘুরপাক খাওয়া সেই ওয়ান লাইনারকে ভেবেই শিরোনাম দিয়েছিলেন : It was war, you rape.

    আলমগীর কবির বললেন, ‘উইকলি হলেও আমাদের পত্রিকাকে মেনস্ট্রিম নিউজপেপারই বলব। আপনার হেডিংটাও লাউড। মনে হচ্ছে আপনার এ নিয়ে লেখার আরও অনেক মেটেরিয়েল আছে। আছে না?’

    জাফর সাদেক কাঁধ ঝাঁকালেন। জিজ্ঞাসু চোখে আলমগীর কবির বললেন, ‘আর কী করার ইচ্ছা?’

    জাফর সাদেক আবার কাঁধ ঝাঁকালেন, তবে দ্বিতীয়বার ঝাঁকানোর মানে পরিষ্কার করতে বললেন, ‘জেনেভা কনভেনশনে ওয়ার প্রিজনারদের নিরাপত্তার প্রভিশন রয়েছে, যা ওয়ার ক্রিমিনালদেরও নিরাপত্তা দিচ্ছে। এই যে এতগুলো ওয়ার ক্রিমিনালকে ছেড়ে দেওয়া হলো, এ নিয়ে কিছু করা উচিত না—ক্যাম্পেইন ধরনের কিছু?’

    আলমগীর কবিরকে চুপ থাকতে দেখে বললেন, ‘আমি কিছু পড়াশোনা করেছি এ নিয়ে, বুঝতে পারছি না পড়াশোনা কতটা কাজে দেবে, যদি না সরকারের কোনো গরজ থাকে। দেশে এ লাইনে অ্যাটর্নিও নেই যে আলাপ করব। তবু চেষ্টা করব।’

    আলমগীর কবির বললেন, ‘বিদেশি রাইটস গ্রুপের কিছু লোকজন রয়েছে ঢাকায়। এ ছাড়া দেশে যারা রেপ ভিকটিমদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন বা এখনো করে যাচ্ছেন, তাদের সাথে কথা বলেছেন, জানাশোনা আছে?’

    ‘ঠিক জানাশোনা নেই, তবে খোঁজ-খবর পেয়েছি কারা এসবে রয়েছেন।’

    ‘তাদের সঙ্গে কথা বললে আপনার সুবিধা হবে।’

    ‘চেষ্টা করছি।’

    কিছু সময় চুপ থেকে জাফর সাদেক বললেন তার এক সময় ফটোগ্রাফির ঝোঁক ছিল, এখন যে নেই তা না। তার ইচ্ছা সারাদেশ ঘুরে ঘুরে এখনো যেসব চিহ্ন রয়ে গেছে সেসবের ছবি তোলা, ডকু ফিল্ম করা—সম্ভব হলে রেপ ভিকটিমদের নিয়ে।

    ‘ফিল্ম করার শখ আছে?’

    ‘ফিল্ম না, ডকু। শখ, নাহ্, তবে রেকর্ড হিসাবে আমার দরকার।’

    আমার দরকার কথাটা জোরের ওপর বলে ফেলায় শুধরে বললেন, ‘রেকর্ড তো থাকা প্রয়োজন। আপনি তো পত্রিকায় দেখলাম ফিচার ফিল্ম বানাচ্ছেন।’

    ‘হ্যাঁ। সবে শুরু করেছি।’

    ‘নামটা মনে করতে পারছি না। স্যরি।’

    ‘না, ঠিক আছে। নাম ধীরে বহে মেঘনা, এখন পর্যন্ত।’

    ‘বদলাতে পারেন?’

    ‘আমি চাচ্ছি না।

    ‘তবে?’

    আলমগীর কবির হাসলেন, ‘আছে অনেক ব্যাপার। তো ডকুমেন্টারি বানাবেন, ক্যামেরা কী?’

    ‘আমি স্টিল ফটোগ্রাফিই অল্পস্বল্প যা করেছি। ডকুমেন্টারির জন্য এইট এমএম কোডাক চলবে না?’

    ‘খুব চলবে। ওটা নামেই এইট, আসলে সিক্সটিন এমএম-এর রেজাল্ট পাবেন। লেগে যান, উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট। আই হোপ ইউ ডোন্ট মিস আউট অন দ্য ক্রিয়েটিভ এলিমেন্টস, ইটস দ্য সেম ইন বোথ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড ফিচার ফিল্ম—বর্ডারলাইন ইজ রাদার স্লিম।’

    ‘প্রয়োজনে আপনার সাহায্য নেব।’

    প্রথম কিস্তি লেখার শিরোনাম ছিল—রেপ এ্যজ ওয়ার উইপেন। ম্যাড়মেড়ে শিরোনাম, জাফর সাদেকের মোটেও ভালো লাগেনি। দ্বিতীয় কিস্তিতে—জেনেভা কনভেনশন প্রটেক্টস ওয়ার ক্রিমিন্যালস। হ্যাঁ, এটা ঠিক আছে, লাল হরফে রক্তাভ বিক্ষোভ। নিজেরই লেখা, পড়তে গিয়ে গা শিরশির করছিল। খেয়াল করছিলেন, কিছু কিছু জায়গায় আলমগীর কবির যেমন বলেছিলেন টোন ডাউন করবেন, তাই করা হয়েছে। আর লেখার নিচে তার পরিচিতি দেওয়া হয়েছে ফ্রি ল্যান্সার অ্যান্ড রাইটস এক্টিভিস্ট। রাইটস এক্টিভিস্ট? এ তো মহাবাড়াবাড়ি, এক্টিভিস্ট হওয়ার কী যোগ্যতা আছে তার!

    নওশিন সে কথাই তুললেন, ‘তুই রাইটস এক্টিভিস্ট এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে!’

    জাফর সাদেক প্রতিবাদ করে বললেন, এটা পত্রিকার কারসাজি, তিনি নিজের কোনো পরিচিতিই দেননি লেখায়।

    নওশিন বললেন, ‘এত ভালো লিখিস, আর কী দুর্দান্ত সব আর্গুমেন্ট, আমরা দেশে বসেও এত কিছু জানতাম না। সত্যি করে বলবি তোর মাথায় এসব কে ঢুকিয়েছে? এনিওয়ে, জীবনে প্রথম তোকে কনগ্রাচুলেট করছি। হার্টিয়েস্ট কনগ্রাচুলেশনস মাই ব্রাদার।’

    এক্টিভিস্ট কেন লেখা হলো এ নিয়ে আলমগীর কবির যুক্তি দিলেন, ‘শুধু বক্তৃতাবাজি করলেই এক্টিভিস্ট? আপনি যেভাবে জেনেভা কনভেনশন, ইন্টারন্যাশন্যাল হিউম্যানিটারিয়ান ল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন তাতে এটাই হওয়া উচিত আপনার পরিচয়। আরও তো লিখবেন এ নিয়ে। আপনার লেখার ফিডব্যাক ভালো পাচ্ছি। অ্যানমেরিকে চেনেন, টেরেডেস হোমসের সঙ্গে ছিল, ও আপনার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। ফোন নম্বর চেয়েছিল, আপনার অনুমতি না নিয়েই দিয়েছি। ওর এক্সপোজার ভালো, কাজও অনেক করছে, মনে হয় কথা বললে আপনার সুবিধা হবে। চাইলে এক সঙ্গে কাজ করতে পারবেন।’

    .

    ‘চাইলে এক সঙ্গে কাজ করতে পারবেন’ আলমগীর কবিরের এ কথাই যার মুখে শুনলেন তিনি চল্লিশোর্ধ্ব বেঁটেখাটো মহিলা, নাম অ্যানমেরি ফনসেকা। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে সাদার কারণে অ্যাংলো স্যাক্সন ভাবাই স্বাভাবিক, কিন্তু আসলে নরওয়েজিয়ান। আলমগীর কবির ভুল বলেছিলেন, টেরেডেস হোমস না, মহিলা এসেছিলেন মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির স্বেচ্ছাসেবী হয়ে। এখন যুক্ত হয়েছেন তারই দেশের এক সেবা সংস্থার সঙ্গে। থাকছেন গ্রিন রোডে ওয়াইডব্লিউসিএ-র গেস্ট হাউসে। কাছেই একটা একতলা বাসা পেয়েছেন, শিগগিরই সেখানে উঠে যাবেন। সেখানে হবে তার নতুন অফিস, মানে তার প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। জানালেন প্রতিষ্ঠানটা বড় না, তার দেশের নোরাড-সহ কয়েকটা সংস্থার ডোনেশনে চলে। মাত্র সাতটা দেশে অফিস রয়েছে, বেশিরভাগই আফ্রিকায়, আর এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ছাড়া নেপালে। বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে তার সঙ্গে রয়েছে তিনজন ছেলে-মেয়ে, সবাই ভীষণ ডেডিকেটেড। এদের মধ্যে একজন আবার কলেজ টিচার, তার ভাষায় প্রফেসর। এতদিন ওদের বসার জায়গা দিতে পারেননি, এবার ওদের সুবিধা হবে, নতুন বাসায় দুটো কামরা অফিসের জন্য ছেড়ে দেওয়া যাবে। এতটুকু বলে মজার তথ্য দেওয়ার মতো করে বললেন, প্রত্যেক দেশে তাদের শাখা-প্রতিষ্ঠানের নাম সে দেশের কোনো জনপ্রিয় মোটিফ বা ফুল-পাখির নামে। বাংলাদেশে নাম ঠিক করতে মুশকিলে পড়েছিলেন, এত এত ইন্টরেস্টিং সব মোটিফ, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেন। শেষে জাতীয় ফুলের নামে নাম দিয়েছেন শাপলা। ‘সুন্দর না?’ বলে উৎসুক চোখে তাকালেন। জাফর সাদেক ঘাড় নাড়লেন। মনে হলো অ্যানমেরি এ ভঙ্গিটা পছন্দ করলেন না। নিজের মনোভাব গোপন না করে বলেই ফেললেন, ‘ইউ ডোন্ট সিম ইমপ্রেসড। ইটস সিম্পল বাট বিউটিফুল।’ জাফর সাদেককে তখন মুখ ফুটে বলতে হলো নামটা অবশ্যই সুন্দর।

    নিজের সম্বন্ধে ফিরিস্তি দিয়ে অ্যানমেরি ভুরু কুঁচকে জাফর সাদেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত দিন বাদে এসব নিয়ে লেখা ধরেছেন, ব্যাপার কী? কোথায় ছিলেন?’

    জবাবে দেশে ছিলেন না, মাসখানেক হলো এসেছেন শুনে মহিলার কোঁচকানো ভুরুতে আরও গিঁট পড়ল। বললেন, ‘তো এখন কী? আপনার যদি ওয়ার ক্রিমিন্যাল ও রেপ ভিকটিমদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা, আরও আগেই হইচই শুরু করা উচিত ছিল। এ দেশে তো শুধু মায়াকান্না ছাড়া কিছু দেখি না। মেয়েরা সুইসাইড করছে, অনেকে পরিবারে আশ্রয় না পেয়ে ব্রোথেলে পর্যন্ত চলে গেছে। আর আপনাদের সরকার মুখেই বলছে ক্রিমিনালদের দেশে ফেরত আনবে।’

    কথাগুলো রূঢ় হয়ে গেছে বুঝতে পেরে ভুরুর গিঁট মুছে বললেন, ‘আপনার লেখা পড়েছি, মনে হচ্ছে না শুধু রাগ থেকেই এসব লিখেছেন, অনেক লিগ্যাল আর্গুমেন্ট রয়েছে, জেনেভা কনভেনশনের কয়েকটা আর্টিকেল নিয়ে যুক্তি-টুক্তি ও তুলে ধরেছেন। বাট ইউ আর রাদার লেট মিস্টার জাফর সাদেক। আপনাকে কি ফার্স্টনেমে ডাকতে পারি? জাফর সাউন্ডস নাইস।’

    ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতে অ্যানমেরি বললেন, ‘আমাকে অ্যান বা অ্যানমেরি যা খুশি ডাকতে পারেন। নরওয়েজিয়ানে অবশ্য উচ্চারণ অন্যরকম। আমার সাথের ছেলে-মেয়েদের যতই বলি নাম ধরে ডাকো, এতে কাজে সুবিধা, ওরা ম্যাডাম ছাড়া কিছু বলবে না, আমি কি মাস্টারনি? যাক, কী করতে চান?’

    জাফর সাদেক ভাবলেন নতুন করে কী বলেন! আলমগীর কবিরকে যা বলেছিলেন তাই বললেন।

    অ্যানমেরি চুপ করে শুনে সেই পুরনো কথাই বললেন, ‘এতদিন পরে এলেন! চাকরি-ব্যবসা এসবে যাবেন না বলছেন। খাবেন কী?’

    ‘আমি যত দিন পারি এ নিয়ে থাকতে চাই।’

    ‘আমাদের সঙ্গে থাকবেন? যদি চান আমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন।’

    চোখাচোখি হতে জাফর সাদেক দেখলেন অ্যানমেরিকে কথাবার্তায় যতটা কাঠখোট্টা মনে হয়েছিল, চোখের দৃষ্টিতে তার আভাস নেই। পরিষ্কার, স্বচ্ছ চাউনি। কিছুটা তীক্ষ্ণ, এই যা।

    ‘লেখালেখি ছাড়াও অনেক কাজ আছে—সবই এই মেয়েদের নিয়ে। আপনাদের সরকার নাম দিয়েছে ওয়ার হিরোইন, বাংলাটা আমার আসে না। এটা ইউরোপ-আমেরিকায় হলে অসুবিধা হতো না, কিন্তু আপনাদের মতো কনজারভেটিভ প্যাট্রিয়ার্কাল সোসাইটিতে ওয়ার হিরো থাকতে পারে, বাট নেভার ওয়ার হিরোইন। রেপের যে বাংলা— ডর্ষিতা, এর কোনো রিলিফ নেই ওয়ার হিরোইন বলায়। বুঝতে পারছেন কী বলতে চাচ্ছি? আমি তো ঘুরে ঘুরে কম দেখিনি। ফাহমিদা এ নিয়ে অনেক কাজ করেছে। ওহ্, ফাহমিদা ওই যার কথা বললাম কলেজে পড়াত, প্রফেসর। ও বেশ কিছু কেস স্টাডি করেছে। ও থাকলে আলাপ করিয়ে দিতে পারতাম। বলেন রাজি, ওয়ান্ট টু বি ওয়ান অব আস?’

    বলতে পারতেন, অবশ্যই। তার বদলে অনেকটা জোরের ওপর মাথা নাড়লেন। অ্যানমেরি হাত বাড়াতে হাতটা নিতে নিতে দ্বিতীয়বার মাথা না নেড়ে চোখে চোখে তাকালেন। অ্যানমেরি বললেন, ‘ওয়েলকাম।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন
    Next Article প্রাচীন চীনা দর্শন : লাওসি ও কনফুসিয়াস – হেলাল উদ্দিন আহমেদ
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.