Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বরফ গলা নদী – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প156 Mins Read0

    ২.৩ রাতে পত্রিকা অফিসে

    রাতে পত্রিকা অফিসে

    রাতে পত্রিকা অফিসে এসে দারওয়ানের হাতে একখানা চিঠি পেলো মাহমুদ।

    দারওয়ান বললো, ‘এক মেমসােব দে গিয়া।’

    চিঠিখানা খুলে পড়লো সে। মরিয়ম লিখেছে।

    ‘ভাইয়া,

    আজ দুদিন তুমি বাসায় এলে না। মারা ভীষণ অসুখ। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। মাকে এভাবে কেন কষ্ট দিচ্ছে তুমি?

    আশা করি আজ নিশ্চয় বাসায় ফিরবে।’

    নিচে নিজের নাম সই করেছে।

    চিঠিটা পড়ে টুকরো করে ছিড়ে ফেললো মাহমুদ। ‘মা ভীষণ অসুস্থ, ইয়ার্কির আর জায়গা পায়নি’ মনে মনে বললো মাহমুদ। এ শুধু ওকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবে একটা মিথ্যে কথার আশ্রয় না-নিয়ে সরাসরি বাসায় যাবার জন্যে লিখলেই তো পারতো মরিয়ম। মাহমুদ ভাবলো, রাতে বাসায় ফিরে মরিয়মকে এক প্রস্থ গালাগাল দিতে হবে।

    সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলে, সামনে একফালি সরু বারান্দা। ডান হাতে ম্যানেজারের দপ্তর। বী হাতে নিউজ সেকসনের লম্বা ঘর। টেবিলের ওপর কাগজের স্তুপ। আলপিনের বাক্স। শূন্য চায়ের পেয়ালা। পেপার কাটার আর দোয়াত কলম। একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো মাহমুদ। প্রথম প্রথম এ ঘরটিতে এসে ঢুকতে আশ্চর্য রোমাঞ্চ অনুভব করতো সে। এখন কোন অনুভূতিই জাগে না। বরঞ্চ বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে মন। সাংবাদিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে আজ সে লজ্জা বোধ করে। সে তো সাংবাদিক নয়, মালিকের হাতের একটি যন্ত্রবিশেষ। কর্তার ইচ্ছেমতো সংবাদ তৈরি করতে হয় তাকে। তাঁরই ইচ্ছেমত বিকৃত খবর পরিবেশন করতে হয়। মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মন। তখন সে ভাবে, যদি তার টাকা থাকতো তা হলে নিজে একখানা পত্রিকা বের করতো মাহমুদ। সুস্থ সাংবাদিকতা হতো যার আদর্শ। কিন্তু এসব উদ্ভট কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যহ প্রয়োজন মেটানোর যার সামথ্য নেই, সে স্বপ্ন দেখে দৈনিক পত্রিকা বের করবার। দুত্তোর আদর্শী-পিনের বাক্সটা একপাশে ঠেলে রেখে, কলামটা হাতে তুলে নিলো মাহমুদ।

     

    মাসখানেক পরে, একদিন সেলিনাকে পড়াতে আসার পথে দূর থেকে ওদের বাসার সামনে একটা চকলেট রঙের নতুন গাড়ি দেখতে পেলো মরিয়ম। ভাবলো, বোধ হয় নতুন কোন অতিথি এসেছে বাসায়।

    এ একমাসে বৈচিত্র্যের দিক থেকে না হলেও, ঘটনার দিক থেকে অনেক নতুন কিছু ঘটেছে তার জীবনে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে সে। যে চাকরিটা হবে আশা করেছিলো, তা হয়নি। আরো দু একটা নতুন টিউশনি পাবার আশ্বাস পেয়েছে মরিয়ম। মনসুরের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক বজায় রেখেছে সে। গত এক মাসের মেলামেশার মধ্য দিয়ে লোকটাকে কখনো খারাপ মনে হয় নি। অন্তত সে রকম কোন ধারণা জন্মাবার মত ব্যবহার করে নি মনসুর। যে ক’দিন এখানে এসেছে, যাবার পথে গলির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে মরিয়মকে। একদিন তো সে নিজেই আমন্ত্রণ করেছিলো তাকে, আসুন না আমাদের বাসায়, একটু বসে যাবেন।

    না, আজ থাক। আরেকদিন যাবো। উপেক্ষা নয়, বরং সলজ্জ সংকোচে আমন্ত্রণ এড়িয়ে গেছে মনসুর।

    মরিয়ম তাতে দুঃখ পেয়েছে তা নয়। সে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করায়, নিজের দৈন্য আর প্রতিপক্ষের স্বচ্ছলতার কথা ভেবে অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছে মরিয়ম। যদি সে আসতো। তাহলে তাকে কোথায় বসতে দিতো মরিয়ম। কী খাওয়াতো তাকে?

    যে কোনদিন মনসুর বাসায় যাওয়ার কথা তুলতে পারে এই আশঙ্কায় সুন্দর দেখে দুটাে চায়ের কাপ দুটাে পিরিচ কিনে রেখেছে সে বাসায়। এলে আর কিছু না হােক এক কাপ চা তো দিতে হবে। মরিয়ম আরো ভেবেছে, দুটাে চেয়ার আর একটা গোল টিপয় যদি কিনতে পারে তাহলে হয়তো ভদ্রভাবে সাজানো যাবে ঘরটাকে। বাইরে থেকে কেউ এলে তাকে বসানো যাবে।

    দূর থেকে মটরটাকে দেখছিলো মরিয়ম, পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাবার সময় আরেক বার চোখ বুলিয়ে নিলো সে।

    বৈঠকখানায় সবার সাথে এক সঙ্গে দেখা। বাইরে বেরুবার তোড়জোড় করছিলো ওরা। সেলিনা, তার আম্মা আর মনসুর। সেলিনার বাবাকে দেখা গেলো না সেখানে। একটা ছাই রঙের প্যান্ট পরেছে মনসুর। গায়ে একটা সিল্কের সাদা সার্ট। সেলিনার পরনে আকাশ রঙের শাড়ি, গায়ে বাদামি ব্লাউজ।

    ওকে দেখতে পেয়ে সেলিনা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো, এই যে আপা এসে গেছে, কি মজা, এবার সবাই একসঙ্গে বেড়াতে বেরুবো আমরা।

    মনসুর হাসলো। সেলিনার আম্মাও।

    অপ্ৰস্তৃত মরিয়ম তিনজনের দিকে তাকালো একবার করে। মনসুর হেসে বললো, আপনার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। সেলিনা আজ পড়বে না। চলুন বেরিয়ে আসবেন আমাদের সঙ্গে।

    সেলিনার আম্মা–আনিসা বেগমের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মরিয়ম জানতে চাইলো, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?

    সেলিনা আর আনিসা বেগম দুজনে এক সঙ্গে বলে উঠলো, নিউ মার্কেট। উপলক্ষটা তেমন কিছু নয় আসার পথে বাইরে যে গাড়িটা দেখে এসেছে মরিয়ম কিছুদিন হলো মনসুর কিনেছে ওটা। ওর নতুন গাড়িতে করে ওদের একটু ঘুরিয়ে আনতে চায় সে।

    এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও পারবে না মরিয়ম, তা জানতো সে। তাই রাজী হয়ে বললো, আমায় একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হয় আজ।

    মনসুর বললো, ঘাবড়াবেন না। ঠিক সময়ে বাসায় পৌঁছে দেবো আপনাকে ৷

    সেলিনা অহেতুক ফিক করে হাসলো একটু। আনিসা বেগম কেন যেন একটু গভীর হয়ে গেলেন।

    গাড়িতে মনসুর আর সেলিনা সামনের সিটে বসলো। মরিয়ম আর আনিসা বেগম পেছনে।

    হ্যাঁ, গত এক মাসে আরো একটি সত্য আবিষ্কার করেছে মরিয়ম। একদিন কথায় কথায় আনিসা বেগম হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেছিলেন তাকে মনসুরকে কেমন মনে হয় তোমার মরিয়ম?

    এ ধরনের প্রশ্ন আশা করেনি মরিয়ম, তাই মুহূর্ত কয়েক বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো। সহসা কোন জবাব দিতে পারে নি। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলেছে, কেন, বেশ ভালোই তোI

    আনিসা বেগমের মুখখানা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার উত্তর শুনে। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে চাপা স্বরে বলেছেন, সেলিনার সঙ্গে ওকে কেমন মানাবে বলতো?

    প্রশ্নের হেতুটা এতক্ষণে বুঝতে পেরে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছে মরিয়ম।

    কিন্তু এরকম কিছু মুহূর্ত আগেও ভাবে নি সে। পরন্তু অন্য একটি সম্ভাবনার কথা ভেবে শঙ্কিত হয়েছিলো। উত্তরটা দিতে আবার বিলম্ব হয়েছিলো মরিয়মের, মন্দ কি? বেশ ভালোই মানাবে ওদের।

    আমারো তাই মনে হয়, আনিসা বেগম বলেছিলেন, কিন্তু কথাটা কোথাও আলোচনা করো না তুমি, কেমন?

    মরিয়ম মাথা নত করে কথা দিয়েছিলো তাকে। না, এ কথা কাউকে জানাবে না সে।

    গাড়িটা তখন নবাবপুর রোড ধরে এগুচ্ছিলো। দুধারে সারি সারি বাতিগুলো একে-একে পেছনে রেখে আসছিলো ওরা। বাইরে দৃষ্টি গলিয়ে দেখছিলো মরিয়ম। আঁচলে টান পড়তে মুখ ফিরিয়ে তাকালো সে। আনিসা বেগম কিছু বলতে চান তাকে। কাছে সরে আসতে ফিসফিসিয়ে তিনি বললেন, পাশাপাশি ওদের কেমন লাগছে বলতো?

    শুনে হাসি পেলো মরিয়মের। অতি কষ্টে সামলে নিয়ে জবাব দিলো, বেশ ভালো।

    আনিসা বেগম গলাটা আরো খাটাে করে বললে, দুজনের গায়ের রঙ এক রকম, তাই না?

    মরিয়ম বললো, হ্যাঁ।

    স্বভাবের দিক থেকেও বেশ মিলবে, তাই না?

    হ্যাঁ।

    আনিসা বেগম মুখখানা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন বাইরের দিকে। রমনা এলাকাটা অনেকটা নির্জন। দুপাশে দোকানপাট, লোকজনের ভিড় নেই। কোলাহল নেই।

    জানালার পাশে ঘেঁষে বসতে এক ঝলক বাতাস এসে সারা মুখখানা শীতল করে দিয়ে গেলো মরিয়মের।

    নিউমার্কেট এসে অনেক কেনাকাটা করলো ওরা–সেলিনা আর আনিসা বেগম। দু-খানা শাড়ি কিনলো সেলিনা। একখানা ব্লাউজ পিস। এক টিন পাউডার, একটা টুথপেস্ট, কয়েকখানা সাবান কিনলো ওরা এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে।

    মনসুর একফাঁকে গলাটা নামিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কিছু কিনবেন না? মরিয়ম অন্যমনস্কভাবে একটা সেন্টের শিশি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো ঈষৎ অপ্ৰতিভ হয়ে বললো, না।

    কথাটা কানে গেলো আনিসা বেগমের। সেলিনাসহ একটা নকল পাথরের তৈরি মালার দর করছিলেন তিনি। ওর দিকে চােখ ফিরিয়ে বললেন, ওকি, তুমি তো কিছুই কিনলে না, একটা-কিছু কেনা উচিত তোমার।

    মরিয়ম নিষেধ করতে যাচ্ছিলো। এক জোড়া মালা কিনে একটা ওর দিকে এগিয়ে দিলেন আনিসা বেগম, লজ্জা করছে কেন, তুমিতো আমার মেয়ের মতো।

    এ কথার পর মালাটা ফিরিয়ে দিতে পারলো না মরিয়ম। আনিসা বেগম হয়তো মনে আঘাত পাবেন।

    মনসুর চুপচাপ কেনাকাটা দেখছিলো। ওদের। মাঝেমাঝে দু-একটা মন্তব্য করছিলো। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দু-শিশি সেন্ট কিনলো সে। একটা সেলিনার জন্যে আরেকটা মরিয়মের জন্যে। মরিয়মকে সরাসরি দিতে হয়তো সাহস হচ্ছিলো না। সেলিনার হাতে তুলে দিয়ে বললো, আমার তরফ থেকে এ দুটাে দিলাম তোমাদের। তারপর আনিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো, খালাম্মা, আপনাকে কি দেয়া যেতে পারে বলুন তো?

    আনিসা বেগম হেসে বরলেন, না বাবা, আমাকে দিতে হবে না, আমি বুড়োমানুষ।

    সেলিনা পরক্ষণে বললো, মাকে একটু চুল না-ওঠার তেল কিনে দিন, মাথার চুলগুলো উঠে যাচ্ছে ওঁর।

    মেয়ের প্রতি কুপিত দৃষ্টি হানলেন আনিসা বেগম।

    মরিয়মের মুখখানা অনেক আগেই কালো হয়ে গেছে।

    মার্কেট থেকে বেরুবার পথে মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। বোধ হয় কোন কাজে এসেছে সে, মরিয়ম ভাবলো। চােখে চােখ পড়তে মৃদু হাসলো সে। মাহমুদের কোন ভাবান্তর হলো না। বাকি সকলের দিকে একটি সন্ধানী দৃষ্টি হেনে, ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, এরা কারা?

    ওরা তখন সামনে এগিয়ে গেছে। মরিয়ম পেছনে পড়ে ছিলো। একবার ওদের দিকে আরেকবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললো, এসো না, ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই তোমার।

    আমি আলাপ করতে চাইনে মরিয়ম। ওরা কারা, তাই জানতে চেয়েছি। মাহমুদ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো।

    মরিয়ম অপ্রস্তুত গলায় বললো, একজন আমার ছাত্রী সেলিনা, আরেকজন তার মা।

    আর লোকটা কে?

    সেলিনার বড় বোনের দেওর।

    যাও, ওরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।

    মরিয়ম তাকিয়ে দেখলো গাড়িতে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই। গাড়িতে উঠতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো মনসুরের মুখখানা কেমন ভার-ভার।

     

    বালিশে উপুর হয়ে পড়ছিলো হাসিনা। ষান্মাসিক পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে ওর। রোজ পাঠ্য বই নিয়ে বসে প্রথমে একবার, লেখাপড়ার সূচনা যারা করেছিলো তাদের একপ্রস্থ গালাগাল আর অভিশাপ দিয়ে নেয় হাসিনা, তারপর পড়তে শুরু করে।

    বাসায় ফিরে এসে, শাড়িটা বদলে নিয়ে, ওর কাছে এসে মরিয়ম বললো, তোমার জন্যে আজ একটা জিনিস এনেছি হাসিনা।

    কী, কী আপা? বই ফেলে উঠে বসলো হাসিনা। মরিয়ম মৃদু হাসলো। তার আগে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমায়।

    কী প্ৰতিজ্ঞা? হাসিনা ব্যগ্র গলায় জিজ্ঞেস করলো।

    মরিয়ম বললো, ভালো করে লেখাপড়া করবে।

    অন্য সময় হলে এত বড় প্রতিজ্ঞায় রাজী হতো না হাসিনা। কিন্তু, কিছু-একটা পাবার লোভে বিনা দ্বিধায় রাজী হয়ে গেলো।

    বললো, ঠিক পড়বো দেখো, এই গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি তোমার। কী এনেছো আমার জন্যে, দেখাও না আপা। আর বিলম্ব সহ্য হচ্ছিলো না হাসিনার।

    টেবিলের ওপর থেকে পাথরের মালাটা এনে, হাসিনার হাতে গুঁজে দিলো মরিয়ম। চোখের সামনে মালাটা তুলে ধরে আনন্দে ফেটে পড়লো হাসিনা। আপাকে জড়িয়ে ধরে বললো, কী সুন্দর আপা, কী সুন্দর!

    মরিয়ম বললো, দাও আমি গলায় পড়িয়ে দেই।

    মালাটা গলায় পরিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর থেকে কোণা-ভাঙা আয়নাটা এনে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখলো হাসিনা। খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। আপার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললো, দাঁড়াও মাকে দেখিয়ে আসি, কি সুন্দর লাগছে তাই না? নাচতে নাচতে মাকে মালাটা দেখাতে চলে গেলো। সে।

    সেন্টের ছোট্ট শিশিটা টেবিলের ওপর রাখা ছিলো। হাসিনার চোখ পড়ে নি। ওর ওপর। তাহলে এতক্ষণে বাড়িটা মাথায় তুলতো। উঠে গিয়ে শিশিটা চৌকির তলায় রাখা ওর টিনের বাক্সটার মধ্যে যত্ন করে রেখে দিলো মরিয়ম। হাসিনাকে ওটা দেবে না সে।

    পথে আসতে আকাশে মেঘ দেখে এসেছিলো, মনে হয়েছিলো যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এতক্ষণে বুঝি নামলো। প্রথমে কয়েক ঝলক দমকা বাতাস জানালার কবাট, ঘরের দেয়ালে বাধা পেয়ে করুণ বিলাপের মত শব্দ করলো। তারপর ঝিরঝির এবং অবশেষে ঝমােঝম শব্দে বৃষ্টি নেমে এলো। উঠে গিয়ে জানালার কবাট জোড়া বন্ধ করে দিলো মরিয়ম। গলির আর সব বাড়িগুলোতেও জানালা বন্ধ করার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বউ-ঝিদের হাঁক-ডাক।

    আপা–আপা–ও ঘর থেকে হাসিনার ডাক শোনা গেলো।

    মরিয়ম জবাব দিলো, আসছি।

    সবেমাত্র রান্নাবান্না সেরে এসেছেন সালেহা বিবি। হাসমত আলী খোকনকে পড়াচ্ছেন বসে বসে। দুলুটা ওঁর পিঠের ওপর উপুড় হয়ে আছে গলা জড়িয়ে। মাকে মালাটা দেখাচ্ছিলো আর কি যেন বলছিলো হাসিনা। মরিয়ম অসতে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, এটা কত দিয়ে কিনেছিসরে আপা?

    মরিয়ম বললো, বিনে পয়সায়।

    মা, বাবা, হাসিনা তাকালো ওর দিকে।

    মরিয়ম আবার বললো, সেলিনার আম্মা আমাকে কিনে দিয়েছে এটা।

    ও। হাসিনা ভ্ৰ কুঁচকে বললো, তাহলে তুই কিনিস নি!

    সালেহা বিবি বললো, তোকে কিনে দিয়েছেন উনি, তুই আবার হাসিনাকে দিয়ে দিয়েছিস কেন?

    মালা হারাবার ভয়ে হাসিনার মুখখানা স্নান হয়ে গেলো।

    মরিয়ম বললো, কী আছে, ও পরুক না।

    শুনে আবার উজ্জ্বলতা ফিরে এলো হাসিনার চিবুকে।

    বৃষ্টি তখন আরো বেড়েছে। বাইরে শুধু একটানা ঝুপঝাপ শব্দ। কে যেন জোরে কড়া নাড়ছে সদর দরজায়। সালেহা বিবি বললেন, দেখতে হাসিনা, বোধ হয় মাহমুদ এলো।

    একটু পরে ছুটতে ছুটতে হাসিনা এসে হেসে লুটােপুটি খেলো–দেখে এসো মা, ভাইয়া একেবারে ভিজে চুপসে গেছে।

    সালেহা বিবি ধমকালেন, দাঁত বের করে হাসছিস কেন, এতে হাসার কী আছে?

    মরিয়মের মনে পড়লো মাহমুদের ঘরে আলো নেই। দ্রুত পায়ে নিজের ঘর থেকে হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে ওঘরে রাখলো সে। ভিজে কাপড়গুলো বদলে মাহমুদ তখন গামছায় পা মুছছিলো। কাগজের স্তুপের ওপাশে রাখা হ্যারিকেনটা নিয়ে ওতে আলো জেলে দিলো মরিয়ম।

    কেমন করে ভিজলি, একটু কোথাও দাঁড়াতে পারলি না? মা এসে দাঁড়িয়েছেন দোরগোড়ায়।

    মাহমুদ বললো, সখ করে নিশ্চয় ভিজি নি।

    সালেহা বিবি বললেন, বছরের প্রথমে বৃষ্টি, এ বড় খারাপ। একটু গায়ে পড়লেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। মাথার চুলগুলো মুছে নে ভালো করে।

    মরিয়ম উঠতে যাচ্ছিলো। মাহমুদ বললো, কোথায় চললে, তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার, বসো।

    মরিয়ম বসলো। ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে সালেহা বিবি চলে গেলেন একটু পরে।

    পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে ধারালো মাহমুদ। তারপর বিছানার মাঝখানে আস্তে করে বসলো, রোজ সন্ধ্যায় তুমি কোথায় যাও তা জানতে পারি কি আমি?

    মরিয়ম অপ্রস্তুত হয়ে বললো, কেন ছাত্রী পড়াতে।

    পড়ানোর কাজটা কি নিউমার্কেট সারা হয়? মাহমুদের গলায় শ্লেষ। মরিয়ম ক্ষণকাল নীরব থেকে বললো, ওরা নিউ মার্কেটে যাচ্ছিলো, সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। আমায়–।

    তুমি গেলে কেন–? ওর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে মাহমুদ রূঢ় গলায় জবাব দিলো, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক হলো মালিক আর মাস্টারনীর সম্পর্ক। ওদের মেয়েকে পড়াও আর বিনিময়ে টাকা পাও। নিউ মার্কেটে ওদের সঙ্গ দেবার জন্য নিশ্চয় কোন বাড়তি টাকা তোমাকে দেয়া হয় না?

    মাথা নত করে চুপচাপ বসে রইলো মরিয়ম।

    ওকে চুপ থাকতে দেখে হাতের বিড়িটা এক পাশে সজোড়ে ছুড়ে মেরে মাহমুদ আবার বললো, কতদিন বলেছি বড়লোকের বাচ্চাগুলোকে আমি দেখতে পারি না, আর তুমি সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরোও?

    ছেলের চিৎকার শুনে সালেহা বিবি ছুটে এসে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে, অমন চেঁচাচ্ছিস কেন তুই?

    হাসিনা এতক্ষণ দুয়ারের আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলো সব। সে ফিসফিসিয়ে বললো, আপা সেলিনাদের সঙ্গে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলো, তাই ভাইয়া বকছে তাকে।

    সালেহা বিবি মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিউ মার্কেটে গেছে তাতে হয়েছে কি, এমন কি অন্যায় করেছে যে তুই বকছিস ওকে।

    তুমি যা-বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না মা, কিছুটা সংযত হতে চেষ্টা করলো মাহমুদ। নিউ মার্কেট ও যাবে না কেন, একশো বার যাবে কিন্তু ওই বড়লোকদের বাচ্চাগুলোর সঙ্গে নয়।

    কেন ওরা কি মানুষ না নাকি? সালেহা বিবি ছেলের অহেতুক রাগের কোন কারণ খুঁজে না-পেয়ে নিজেই রেগে গেলেন ওরা যদি সঙ্গে করে নিয়ে যায় তাহলে—

    কই ওরা তো আমাকে নিয়ে যায় না? মায়ের মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে মাহমুদ জবাব দিলো। নিউ মার্কেট কেন সদরঘাট পর্যন্ত ওরা মোটরে করে নিয়ে যাবে না আমায়। তোমার মেয়েকে দেখবে বুড়িগঙ্গার ওপারেও নিয়ে যাবে। স্বরটা নামিয়ে নিয়ে মাহমুদ আবার বললো, কই দশ টাকা বেতন এ মাসে বাড়িয়ে দিবে বলে কথা দিয়েছিলো, বাড়িয়েছে? ওদের আমি চিনি নি ভাবছো? সব ব্যাটা বেঈমান।

    মরিয়ম তখনো মাথা নুইয়ে চুপচাপ বসেছিলো। হ্যারিকেনের আলোয় ভালো করে মুখ দেখা যাচ্ছিলো না ওর।

    সালেহা বিবি ধীর গলায় বললেন, সব বড়লোক এক রকম হয় না।

    যা জানো-না তা নিয়ে কথা বলো না। এত জোরে চিৎকার করে উঠলো মাহমুদ, যে ওরা সকলে চমকে তাকালো ওর দিকে। সব বড়লোক সমান না–কটা বড়লোক তুমি দেখেছো শুনি? কোনো বড়লোকের ছেলেকে দেখেছে। বি. এ. পাশ করে পঁচাত্তর টাকার চাকরির জন্যে মাথা খুঁড়ে মরতো? কই, একটা বড়লোক দেখাও তো আমায়, যার মেয়ে অন্যের বাড়িতে ছাত্রী পড়িয়ে যে টাকা পায় তা দিয়ে কলেজের বেতন শোধ করে? দুপুর রোদে এক মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে ক্লাশ করতে যায়? ওরা সমান না বললেই হলো। সব শালা বেঈমান, চামার। বিনে পয়সায় মানুষকে খাঁটিয়ে মারতে চায়। দিয়েছি। শালার চাকরি ছেড়ে। জাহান্নামে যাক–বলতে গিয়ে কাশি এলো তার। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ভয়ানকভাবে কাশতে লাগলো মাহমুদ।

    পাথরের মূর্তির মত ঠােয় দাঁড়িয়ে সালেহা বিবি।

    মরিয়ম নীরব।

    মাহমুদ তখনও কাশছে একটানা।

    ওর কাছে এগিয়ে এসে শঙ্কিত গলায় সালেহা বিবি বললো, ঠাণ্ডা লাগে নি তো? একটু সরষের তেল গরম করে এনে বুকে মালিশ করে দেবো?

    উঠে দাঁড়িয়ে বোধ হয় তেল গরম করে আনার জন্যে বেরিয়ে গেলো মরিয়ম।

    কাশি থামলে মাহমুদ বললো, আমাকে নিয়ে অত চিন্তা করতে হবে না তোমাদের মা, এত সহজে আমি মরবো না। বলে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মাহমুদ।

    সালেহা বিবি বললেন, শুয়ে পড়লি কেন? ওঠ। যাই আমি নামাজ পড়ে ভাত দেই তোদের।

    হাসমত আলী পুরোপুরি ওর আলোচনাটা না-শুনতে পেলেও মাঝে মাঝে টুকরো কথাগুলো কানে আসছিলো তার। বিশেষ করে যখন নিজের দৈন্যের কথা, সাখীহীনতার কথা বলছিলো মাহমুদ। শুনেছিলেন আর মনে মনে নিজেকে বারবার অপরাধী বলে মনে হচ্ছিলো তাঁর। ছেলেমেয়েদের লেখা-পড়া শেখানোর গুরুভার বহন করতে পারেন নি। তিনি। পারেন। নি তাদের সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে মানুষ করতে। তাদের শৈশব-যৌবনের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে চরিতাৰ্থ করতে। মনে মনে পীড়িত হচ্ছিলেন হাসমত আলী। স্ত্রীকে আসতে দেখে চাপা স্বরে শুধালেন, কি বলছিলো মাহমুদ।

    সালেহ বিবি নামাজের যোগাড়যন্ত্র করতে করতে জবাব দিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ও।

    অনেক কথা শুনলেও এ খবরটি ইতিপূর্বে কানে আসে নি তাঁর। স্ত্রীর মুখে শুনে, খানিকক্ষণ একটা অর্থহীন দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ভ্রু-জোড়া ঈষৎ কুঁচকে এলো তাঁর। চোখজোড়া সরু হয়ে এলো। কেউ যেন শুনতে না পায় এমনি করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হাসমত আলী।

    বাইরে তখনাে একটানা বৃষ্টি ঝুপঝুপ শব্দে।

    সালেহা বিবি সবে নামাজের নিয়ত বেঁধেছেন। হাসিনার উঁচু স্বরের ডাক শোনা গেলো ওঘর থেকে। আপা, জলদি আয়। পানি পড়ে বিছানাটা যে একেবারে ভিজে গেলো।

    পাকঘরে বোধ হয় মাহমুদের জন্যে তেল গরম করতে এসেছিলো মরিয়ম। কান খাড়া করে ওর ডাক শুনতে পেলে সে।

    একটু জোরে বৃষ্টি হলে ফাটল দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা পানি পড়তে থাকে ঘরে। প্রতি বর্ষায় তাই বাড়িওয়ালাকে বলে মিস্ত্রী আনিয়ে ফাটলগুলো মেরামত করতে হয়। তা না হলে বর্ষার মরশুমে ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে।

    মরিয়ম এসে দেখলো টপটপ করে পানি পড়ে বিছানাটা বেশ ভিজে গেছে। দু-বোনে দু-মাথায় ধরে চৌকিটা একপাশে নিয়ে এলো। যেখানে পানি পড়ছিলো সেখানে একটা পানির পাত্ৰ এনে বসিয়ে দিলো মরিয়ম। হাসিনা বললো, আজ রাতে থাকবে কেমন করে?

    মরিয়ম কোনো জবাব দিলো না। চৌকির এক কোণে বসে পড়ে সে ভাবতে লাগলো কবে তাদের এমন দিন আসবে যখন এ বাড়ি ছেড়ে একটা ভালো বাসায় উঠে যেতে পারবে তারা, যেখানে ছাদটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে-ভেঙে পড়বে না মাথার উপর আর বৃষ্টির পানি তাদের চােখের ঘুম কেড়ে নেবে না? কিন্তু তেমন কোন দিন অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পেলো না মরিয়ম। হাতজোড়া কোলের উপর গুটিয়ে রেখে অসহায়ভাবে বসে রইলো সে। মা যখন ভাত খেতে ডাকলেন সকলকে, বৃষ্টি তখন থেমে আসছে। খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হয়ে গেলো।

    বিছানায় শুয়ে বারবার এপাশ-ওপাশ করছিলেন হাসমত আলী।

    সালেহা বিবি শুধালেন, কী ব্যাপার, অমন করছে কেন?

    না, কিছু না। আবার পাশ ফিরে শুলেন হাসমত আলী।

    কিছুক্ষণ পরে তার গলার আওয়াজ শোনা গেলো। মাহমুদ হঠাৎ চাকরিটা ছেড়ে দিলো কেন?

    ওকে জিজ্ঞেস করলেই পারো। সালেহা বিবি উত্তর দিলেন, অত খামখেয়ালী হলে চলে? মাসে মাসে পঁচাত্তরটা টাকা কম ছিলো কিসে  কণ্ঠস্বরে তার আক্ষেপ ধ্বনিত হলো।

    হুঁ। আবার নড়েচড়ে শুলেন হাসমত আলী। তারপর মৃদু গলায় বললেন, ছেড়ে না দিলেই ভালো করতো।

    একটু পরে নীরব হয়ে গেলেন দুজন।

    সকালে ঘুম ভাঙতেই মরিয়মের মনে হলো, মাথাটা বড় বেশি ভার-ভার লাগছে ওর। গা-হাত-পা ব্যথা করছে। চোখের ভেতরটা জ্বলছে অল্প অল্প। হাত বাড়িয়ে হাসিনা আছে কিনা দেখলো মরিয়ম ৷ ও উঠে গেছে, এতক্ষণে পাশের বাড়ির বউটিকে হয়তো গলার মালাটা দেখাতে গেছে সে। মরিয়ম পাশ ফিরে শুলো। একটু পরে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে।

    ভালো করে আকাশটা ফর্সা হবার আগেই উঠে পড়েছিলো মাহমুদ, মুখ-হাত ধুয়ে চা নাস্তা খাবার আগে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লো সে। পরিচিত দুচার জনের বাসায় গিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজের চাকরি ছেড়ে দেয়ার খবরটা জানালো, কোথাও কোন কাজের সুযোগ থাকলে যেন তাকে জানানো হয়–সে অনুরোধটাও তাদের করতে ভুললো না সে। বেশি টাকার আশা করে না মাহমুদ, শ’খানেক টাকা পাওয়া যেতে পারে এ-রকমের একটা চাকরি পেলে আপাতত চলে যাবে তার।

    এখানে-সেখানে ঘুরে বিশ্রামাগারের চৌকাঠে যখন পা রাখলে সে, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে।

    কেরোসিন কাঠের কাউন্টারের ওপাশে বসে হাতজোড়া সামনে প্রসারিত করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে নঈমকে কি যেন বলছিলো খোদাবক্স। হ্যাঁ, নতুন আসছে মেয়েটা; এইতো হপ্তাকানেক হলো। একশ’ টাকার মাষ্টারনী–এই যে, মাহমুদ সাহেব যে, কাল কেমন ভিজলেন? কত করে বললাম, আরেকটু বসে যান, আকাশটা একটু ধরে আসুক। মাহমুদকে নীরব থাকতে দেখে খোদাবক্স তার পুরনো কথায় ফিরে গেলো। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। নতুন মাষ্টারনী হয়েছে মেয়েটা। দেখতে কেমন বলছো? একেবারে আগুনের শিখা। গায়ের রংটা? কাঁচা হলুদ দেখছো কোনদিন? ঠিক তার মত। অনেক মেয়ে তো দেখলাম, অমনটি দেখি নি। একটা ঢোক গিয়ে খোদাবক্স আবার বললো, শরীরটা ছিপছিপে, চুলগুলো কোঁকড়ানো আর চােখ দুটাে—।

    দেখি আজকের খবরের কাগজটা এদিকে দাওতো।

    মাহমুদের ডাকে কথার মাঝখানে হােঁচট খেলো খোদাবক্স। কাউন্টারের এককোণে রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলো সে। তারপর আবার বললো, বসো না, চা খাও। একটু পরেই তো আসবে, দেখাবো তোমায়।

    পত্রিকাটি খুলে চাকরির বিজ্ঞাপনের উপর চােখ বুলোতে লাগলো মাহমুদ। খোদাবক্সকে এখনো সে তার বেকারত্বের কথা শোনায় নি। তাহলে আর বাকিতে খেতে দেবে না। বলবে, এমনিতে এত টাকা জমা হয়ে আছে আপনার।

    হ্যাঁ, মাহমুদ সাহেব ইয়ে হয়েছে, দশটা টাকা কি এ মাস থেকে বাড়লো আপনার? খোদাবক্স প্রশ্ন করছে।

    পত্রিকা থেকে মুখ না-তুলে মাহমুদ জবাব দিলো, বাড়বে, এখনো বাড়ে নি। মিথ্যে কথা বলে আশু আক্রমণ থেকে মুক্তি পেলেও মনে শান্তি পাচ্ছিলো না সে।

    তা হলে এ মাসে কিছু টাকা শোধ করছেন আপনি? খোদাবক্সের গলা।

    তোমার কি হয়েছে বলতো। দিনে দিন একটা চামার হয়ে যাচ্ছো। সকালবেলা সবে এসেছি, অমনি টাকা-টাকা বলে চিৎকার শুরু করেছো? মাহমুদের গলা তিক্ততায় ভরা, টাকা শোধ করবো না বলে ভয় হচ্ছে নাকি তোমার? গরিব হতে পারি, নীচ নই, বুঝলে? যা খেয়েছি তা পাই-পাই করে শোধ করে দেবো। বেঈমান ভেবো না আমাদের, বেঈমান নাই। পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে রাস্তার পাশে পান-দোকানে ঝোলান দড়িটা থেকে আগুন ধরিয়ে এসে আবার বসলো মাহমুদ।

    আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন মাহমুদ সাহেব। আমি বলছিলাম। কি—।

    থাক, থাক, এবার চুপ করো। ওসব কথা শুনতে ভাল লাগে না আমার। বিড়িতে একটা জোর টান দিয়ে আবার পত্রিকার উপর ঝুঁকে পড়লো মাহমুদ।

    খদ্দেরদের রাগাতে মোটেই প্রস্তুত নয় খোদাবক্স। তাহলে ব্যবসার ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ছোটখাটো রেস্তোরাঁ যারা চালায় তাদের পক্ষে এটা একটা অভিশাপস্বরূপ।

    খানিকক্ষণ ইতস্তত করে গলাটা একবারে খাদে নামিয়ে খোদাবক্স বললো, আপনাদের সেই ইন্টারভিউটার কি হলো মাহমুদ সাহেব?

    বিড়ির ছাই ফেলতে ফেলতে মাহমুদ জবাব দিলো, কিছু হয় নি- হবে না যে জানতাম। তার গলার স্বরটা শান্ত।

    শুনে আশ্বস্ত হলো খোদাবক্স। একটা খদ্দেরের কাছ থেকে চা আর টোষ্টের দামটা নিয়ে ক্যাশ বাক্সে রাখলে সে। তারপর সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো খোদাবক্স। রাতে বৃষ্টি হবার পর আজকের সকালটা অন্য দিনের চেয়ে আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে। মেয়ে স্কুলের লাল দালানটার গায়ে চিকচিক করছে এক টুকরো রোদ। গেটের সামনে মেয়েদের বয়ে নিয়ে আসা ঘোড়ার গাড়িগুলো একটা দুটা করে জমা হচ্ছে এসে। এক সময়ে ক্ষুদ্র চোখজোড়া বড় হয়ে এলো খোদাবক্সের। ওই যে আসছে–আসছে। চাপা উত্তেজিত গলায় বললো সে। চোখজোড়া তখনো রাস্তার উপর নিবদ্ধ তার।

    ওর দৃষ্টি ধরে, মাহমুদ আর নঈম দু-জনে তাকালো সেদিকে।

    খোদাবক্স মিথ্যে বলে নি। গায়ের রংটা ওর কাঁচা হলুদের মত। চুলগুলো ঘন কালো আর কোঁকড়ানো। দেহটা ছিপছিপে। সরু কটি। চোখজোড়া ভালো করে দেখতে পেলো না মাহমুদ। খোদাবক্স মৃদু হেসে বললো, এর কথা বলছিলাম, নতুন মাস্টারনী।

    লাল দালানটার ভেতরে একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেলো মেয়েটা। মাহমুদের মনে হলো কোথায় যেন তাকে দেখেছে সে। কোনো বাসায়? কোনো অফিসে? কোনো রাস্তার মোড়ে?

    খোদাবক্স বললো, ওর নাম লিলি।

    মাহমুদের মনে হলো, নামটাও এর আগে কোথায় শুনেছে সে। কার মুখে যেন শুনেছিলো? দূর তোর জাহান্নামে যাক মেয়েটা। দুহাতে মুখখানা ঢেকে নীরবে ভাবতে লাগলো মাহমুদ, কোথায় গেলে সে আশু একটা চাকরি পেতে পারে।

     

    দুপুরের গানগনে রোদে চোখমুখ জ্বালা করছিলো ওর। আকাশে একটুও মেঘ নেই। রাস্তার পাশে একটি-দুটি পাতা ঝরা গাছ। ছায়াহীন পথ। মতিঝিলের চওড়া রাস্তাটা পেরিয়ে শান্তিনগরে প্রান্তিক প্রেসে যখন এসে পৌঁছলো মাহমুদ, তখন সূর্যের প্রখরতা এতটুকু কমে নি।

    টিনের ছাপরা দেওয়া ছোট্ট প্রেস।

    ছাপরার নিচে একখানা চৌকোণ টেবিলকে সামনে নিয়ে, চেয়ারে বসে শাহাদত তালপাতার পাখায় হাওয়া দিচ্ছিলো গায়ে। ওকে দেখে পাখাটা সামনে নাবিয়ে রেখে ত্ৰস্তপায়ে উঠে দাঁড়ালো সে। আরে, মাহমুদ যে, এসো এসো।

    মাহমুদ বললো, উতলা হয়ে না, বসো। কোণায় রাখা গোল টুলটা টেনে এনে বন্ধুর মুখোমুখি বসলো সে। তারপর একটা লম্বা হাই ছেড়ে জামার বুতামগুলো একে-একে সব খুলে নিলো। পাখাটা হাতে নিয়ে জোরে বাতাস করতে করতে শুধালো, তারপর কেমন আছে বলো।

    কেমন আছি জিজ্ঞেস করছো? অদ্ভুতভাবে হাসলো শাহাদাত, সুখে আছি, দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছি।

    মাহমুদ বিরক্তির সাথে বললো, হেঁয়ালি রাখো, আমেনা কেমন আছে?

    শাহাদাত সংক্ষেপে বললো, ভালো।

    ছেলেমেয়ে?

    ভালো।

    বাইরে গানগনে রোদের দিকে তাকিয়ে পাখাটা আরো জোরে নাড়তে লাগলো মাহমুদ। উপরের টিন তেতে গিয়ে গরমটা আরো বেশি করে লাগছে। এখানে।

    হঠাৎ শাহাদাত শুধালো, তোমার কি খবর?

    পাখা থামিয়ে মাহমুদ বললো, চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।

    ছেড়ে দিয়েছো? শাহাদাত অবাক হলো, এতদিনে পারলে ছাড়তে?

    মাহমুদ বললো, ধৈর্যের একটা সীমা আছে বুঝলে? বলে চাকরি ছাড়ার ইতিবৃত্তটা ওকে শুনালো মাহমুদ। সাংবাদিক হবার স্বপ্ন ছিলো, সে তো চুরমার হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার নামে গণিকাবৃত্তি করেছি এ-কবছর। মালিকের হুকুম তামিল করেছি বসে বসে। গেলকে ঘি বলতে  বলেছে, বলেছি। হাতিকে খরগোশ বানাতে বলেছে, বানিয়েছি। তবু বেটারা বেঈমামি করলো। জামার কলারটা তুলে ধরে জোরে বুকের মধ্যে বাতাস করতে লাগলো মাহমুদ।

    কিছুক্ষণ পর শাহাদাত আবার প্রশ্ন করলো, এখন কি করবে তুমি?

    সহসা কোন জবাব দিতে পারলো না মাহমুদ। কি ভেবে বললো, যে কোন একটা চাকরি পেলে করবো। তাইতো এসেছি তোমার কাছে। যদি কোথাও কোন প্রেসে কিছু-একটা জুটিয়ে দিতে পারো।

    শাহাদাত বিব্রত গলায় বললো, আমার অবস্থা খুলে না বললেও তুমি বুঝতে পারো। কম্পিটিশনের বাজারে ভালো ক্যাপিটাল না-থাকলে বিজনেসে টিকে থাকা যায় না। প্রেসটা বোধ হয় বিক্রি করে দিতে হবে। ক্ষণকাল থেমে আবার বললো, থাকগে, নিজের দুঃখের কথা বলে তোমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চাই নে। আমার সাধ্যিমত চেষ্টা করে দেখেবো, যদি কিছু জুটিয়ে দিতে পারি।

    শেষের কথাগুলো মাহমুদের কানে গেলো কিনা বোঝা গেলো না। সামনে ঝুঁকে পড়ে অবাক কণ্ঠে সে শুধালো, প্রেসটা কি বিক্রি করে দেবে তুমি? শাহাদাতের প্রেস বিক্রি করে দেবার খবরে যেন ভীষণ আঘাত পেয়েছে সে।

    শাহাদাত স্নান হেসে বললো, কিছু টাকা। যদি দিতে পারো তা হলে এ যাত্ৰা ঠেক দিয়ে রাখা যায়। টাইপগুলো সব পুরনো হয়ে গেছে। ওগুলো দিয়ে আর কাজ চালানো যাচ্ছে না। নতুন টাইপ না কিনলে লোকে এখানে ছাপতে আসবে কেন? তাছাড়া শহরে এখন অনেক অভিজাত ছাপাখানা হয়ে গেছে–তাদের পাশে আমার টিনের ছাপরাটা কি হাস্যকর নয়? কথা শেষে আবার হাসলো শাহাদাত।

    মাহমুদ এতক্ষণে গম্ভীর হয়ে গেছে। মাস কয়েক আগে বউয়ের অলংকার বিক্রি করে টাইপ কেনার টাকা সংগ্রহ করেছিলো শাহাদাতা। সে-খবর মাহমুদের অজানা নয়। সে-টাকা তবে কি করেছে সে? জুয়োর আড্ডায় সব উড়িয়েছো বুঝি?

    শাহাদাত চমকে বললো, কী?

    আমেনার অলংকার বেচার টাকাগুলো?

    শুনে বিমর্ষ হলো শাহাদাতা। ইতস্তত করে বললো, পাগল হয়েছো? জুয়োর আড্ডায় উড়াবো, পাগল হয়েছো?

    থাক, আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত চাই নি, পাখাটা টেবিলের উপর নাবিয়ে রেখে মাহমুদ বললো, আমেনা আছে কি ভিতরে?

    প্রসঙ্গটা আপনা থেকে ঘুরিয়ে নেয়ায় খুশি হলো শাহাদাতা। বললো না, ও ওর এক খালার বাড়ি গেছে, এইতো কমলাপুর। বসো, এক্ষুণি এসে যাবে।

    মাহমুদ বললো, না, আমি আর বসবো না। বেলা অনেক হয়ে গেছে, এবার উঠি।

    শাহাদাত বললো, কোথায় যাবে?

    বাসায়।

    আরেকটু বসো না, এক কাপ চা খেয়ে যাও।

    না, এখন চা খাবো না।

    আবার সেই গানগনে রোদের সমুদ্রে নেমে এলো মাহমুদ। পেছন থেকে শাহাদাতের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আবার এসো কিন্তু।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগল্প সমগ্র – জহির রায়হান
    Next Article তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    Related Articles

    জহির রায়হান

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }