Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বরফ গলা নদী – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প156 Mins Read0

    ২.৪ সকালে মাথা ধরেছিলো মরিয়মের

    সকালে মাথা ধরেছিলো মরিয়মের

    সেই যে সকালে মাথা ধরেছিলো মরিয়মের তারপর দুটাে দিন বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারলো না সে। সারা গা কঁপিয়ে জ্বর এলো। সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা।

    এখনো গায়ে জ্বর আছে অল্প-অল্প। ডাক্তারের কাছ থেকে মিকচার এনে খাইয়েছেন হাসমত আলী। মাথার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিয়েছেন সালেহা বিবি, হাসিনা গা-হাত পা টিপে দিয়েছে ওর।

    শরীরটা ভয়ানক দুর্বল বোধ হলেও এখন অনেকটা সুস্থ মরিয়ম।

    জানালা গলিয়ে এক ঝলক রোদ এসে পড়েছে। ঘরের কোণে, যেখানে একটা মাকড়সা জাল বুনছে আপন মনে। সুরকি-ঝরা লাল দেয়ালটা জুড়ে সাদা পাতলা আলোর জাল। চোখের পাতাজোড়া বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলো মরিয়ম। সালেহা বিবি কখন এ ঘরে এসেছেন। টের পায় নি সে। কপালে একখানা হাত রেখে দেহের উত্তাপ নিলেন তিনি। তারপর মৃদুস্বরে বললেন এক বাটি বার্লি বানিয়ে দিই, কেমন?

    মায়ের হাতের ওপর ওর ডান হাতখানা রেখে অস্পষ্ট স্বরে মরিয়ম বললো, খেতে ইচ্ছে করে না মা।

    না খেলে যে শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। সালেহা বিবির কণ্ঠে কোমলতায় ভরা, বানিয়ে আনবো।

    আনো মা! ক্ষীণ গলায় জবাব দিলো মরিয়ম।

    একটু পরে ওর গায়ের কাপড়টা ভালোভাবে টেনে দিয়ে চলে গেলেন মা। তার পায়ের লঘু শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো দূরে।

    কোথায় একটা কাক ডাকছে কা কা করে। এই মাত্র একটি চিল ডেকে গেলো। গলিতে বুঝি কোন ছেলে টিন পিটিয়ে খেলা করছে। কারা কথা বলছে ও বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনছিলো মরিয়ম।

    আপা! দোরগোড়ায় হাসিনার গলা, একটা লোক আসছে তোর কাছে, দেখা করতে চায়।

    জ্বরের মধ্যেও চমকে উঠলো মরিয়ম।

    হাসিনা কাছে এসে বললো, ভেতরে নিয়ে আসবো?

    হাতের ইশারায় ওকে আরো কাছে ডেকে মরিয়ম শুধালো, নাম জিজ্ঞেস করেছিস লোকটার।

    হাসিনা মাথা নাড়লো, না তারপর নাম জিজ্ঞেস করার জন্য বোধ হয়। আবার ফিরে যাচ্ছিলো হাসিনা।

    মরিয়ম ক্ষীণ গলায় ডাকলো, হাসিনা এই শোন!

    হাসিনা ফিরে দাঁড়ালো।

    মরিয়ম বললো, মায়ের ঘর থেকে চেয়ারটা এনে এখানে রাখ। টেবিলের উপরে বইগুলো বড্ড আগোছালো হয়ে আছে। হ্যাঁরে হাসিনা, বাবা আছেন ঘরে?

    হাসিনা ঘাড় নাড়ালো, না।

    ভাইয়া?

    না।

    ইশারায় লোকটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলে কাঁথাটা সারা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলো মরিয়ম।

    প্ৰথমে মায়ের ঘর থেকে চেয়ারটা এ ঘরে রেখে গেলো হাসিনা। তারপর লোকটাকে নিয়ে এলো।

    মরিয়ম যা আশঙ্কা করেছিল– মনসুর।

    এ কী? ঘরে ঢুকে ওর চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লো মনসুর। আপনার অসুখ করেছে নাকি? ওর কণ্ঠস্বরের এই ব্যগ্রতায় বিব্রত বোধ করলো মরিয়ম। দৃষ্টিটা ওর পায়ের পাতার কাছে নামিয়ে এনে আস্তে করে বললো, বসুন।

    মনসুর বসলো।

    হাসিনা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলো। মাকে একটা নতুন লোক আসার খবর দেবার জন্য বোধ হয় চলে গেলো সে।

    মরিয়ম তাকালো ওর দিকে।

    একজোড়া গভীর সহানুভূতি ভরা চােখ চেয়ে দেখছে তাকে।

    মরিয়ম বললো, তারপর কেমন আছেন?

    ওর প্রশ্ন, খুশির আবির ছড়িয়ে দিলো মনসুরের চোখেমুখে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বাঁ হাতের তালুটা ঘষতে ঘষতে সে জবাব দিলো, আমি ভালো আছি। আপনার অসুখ হয়েছে জানতে পেলে আরো আগে দেখতে আসতাম। দু-দিন ও-বাসায় আপনি গেলেন না, ভাবলাম কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে। মনসুর থামলো। শান্ত, স্নিগ্ধ ও গভীর দৃষ্টি নিয়ে সে তাকালো মরিয়মের দিকে।

    মরিয়ম ইতস্তত করে বললো, এখন জ্বর প্রায় ছেড়ে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবো।

    মনসুর বললো, দু-দিনের জুরে আপনি ভীষণ শুকিয়ে গেছেন।

    রোগপাণ্ডুর মুখখানা ঈষৎ আরক্ত হলো মরিয়মের। ইচ্ছে হচ্ছিলো, গায়ের কাঁথাটা দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলতে তার। হাসিনা এসে এই বিপর্যন্ত অবস্থা থেকে মুক্তি দিলো তাকে।

    মরিয়ম বললো, ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার? আমার ছোট বোন হাসিনা।

    মনসুর ফিরে তাকালো ওর দিকে। মৃদু হাসলো, তারপর বললো, উনিই তো ভেতরে এনেছেন আমায়।

    হাসিনা চুপচাপ হাতের নখ খুঁটতে লাগলো। মরিয়ম দেখলো, মা দূর থেকে উঁকি মেরে একবার মনসুরকে দেখে চলে গেলেন। হাসিনাও গেলো তাঁর পিছু পিছু। শায়িত অবস্থায়, ওর দিকে তাকিয়েও মরিয়ম বুঝতে পারছিলো, একজোড়া সহানুভূতিভরা শান্ত চােখ গভীর দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাকে। অকারণে আরেক বার আরক্ত হলো মরিয়ম। কিছু না বলে নীরব থাকাটাও অস্বস্তিকর মনে হলো। অথচ কি যে আলোচনা করা যেতে পারে কিছু খুঁজে পেলো না। ‘হ্যাঁ, সেলিনা কেমন আছে?’ একটা কিছু আলোচনার বিষয়বস্তু পেয়ে আসন্ন বিপদমুক্ত হলো মরিয়ম।

    মনসুর বললো, ভালো।

    তারপর আবার নীরবতা।

    এবার উঠি তাহলে। নীরবতা গুঁড়িয়ে বললো মনসুর, একটা কাজ আছে যাই এখন। আবার আসবো।

    না না, যাবেন আর কি, আরেকটু বসুন, ক্ষীণ গলায় বললো মরিয়ম। দরজা লক্ষ্য করে তাকালো সে–যদি হাসিনাকে দেখা যায়। মনসুরকে চা-নাস্তা করানো উচিত এবং মা নিশ্চয়ই তার যোগাড়যন্ত্র করছে।

    মরিয়মের অনুমান মিথ্যে নয়। একটু পরে, কিছুদিন আগে কেনা চায়ের কাপে চা আর একটা পিরিচে দুটাে পান্তুয়া আর দুটাে সন্দেশ সাজিয়ে নিয়ে এলো হাসিনা। টেবিলের উপর ওগুলো নামিয়ে রাখলে সে।

    মরিয়ম বললো, এক গ্রাস পানি দিয়ে যাও হাসি।

    মনসুর একবার টেবিলের দিকে, আরেকবার মরিয়মের দিকে তাকিয়ে নীরব রইলো।

    মরিয়ম ওর দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে বললো, আমরা গরীব। বিশেষ কিছু খাওয়াতে পারবো না আপনাকে,–এক কাপ চা খান। বলতে গিয়ে আবার আরক্ত হলো মরিয়ম। কিন্তু মনসুর গম্ভীর হয়ে গেছে, মুখখানা কালো হয়ে আসছে তার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে এসেছে।

    চা-নাস্তা খেয়ে আবার আসবো বলে চলে গেলো মনসুর।

    ও চলে গেলে অনেকক্ষণ কেন যেন ভালো লাগলো মরিয়মের। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর যে ক্লান্তি বোধ করছিলো তা আর এখন নেই। বাইরে কোন পরিবর্তন হয় নি। গায়ে জ্বর এখনো আছে, মাথাটা ধরে আছে এখনো। তবু একটা আনন্দের আভা জেগে উঠেছে তার দুগালে। বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। গায়ের উপর থেকে কথাটা সরিয়ে দিয়ে, চোখ বুজে মনসুরের কথা ভাবতে লাগলো মরিয়ম।

    কে এসে ছিলোরে মরিয়ম? মায়ের কণ্ঠস্বর। হাতে এক গ্রাস বার্লি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

    মরিয়ম বললো, সেলিনার বড় বোনের দেবর। বার্লির গ্লাসটার জন্য হাত বাড়িয়ে জবাব দিলো মরিয়ম। সে ভেবেছিলো, মা কিছু বলবেন, কিন্তু সালেহা বিবি আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মরিয়ম বুঝতে পারলো সালেহা বিবি লোকটার আগমনে সুখী হতে পারেন নি। কে জানে, হয়তো জাহেদের কথা মনে পড়ে গেছে তাঁর। কিন্তু সব পুরুষ কি এক রকম? বার্লির গ্লাস হাতে ভাবলো মরিয়ম। মনসুরকে জাহেদের মত বলে ভাবতে কোথায় যেন একটা যন্ত্রণা অনুভব করলো সে।

    লোকটা করে কী? এতক্ষণে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন সালেহা বিবি।

    বার্লিটা খেয়ে নিয়ে মরিয়ম জবাব দিলো, ব্যবসা করে।

    কিসের ব্যবসা?

    জানি না।

    মা চলে গেলে অনেকক্ষণ মরিয়ম ভাবলো, মনসুরকে বলে দিলেই হতো সে যেন আর না আসে।

    বিকেলে আবার এলো মনসুর।

    এক বোতল হরলিক্স আর এক ঠোঙ্গা আঙ্গুর-বেদানা হাতে। সসঙ্কোচে ওগুলো টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলে সে। মরিয়মের দিকে সরাসরি তাকাতে সাহস পেলো না।

    মরিয়ম অস্ফুটস্বরে বললো, ওখানে কী?

    মনসুর সলজ্জ গলায় বললো, একটা হরলিক্স আর কিছু ফ্রুটস।

    কেন এনেছেন শুধুশুধু। আর বেশি বলতে পারলো না মরিয়ম। মনে-মনে ওর প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছিলো তার। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলো না। একজোড়া সহানুভূতিপূর্ণ লজ্জাবনত চােখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলো সে। সকালে এনে-রাখা চেয়ারখানা দেখিয়ে বললো, বসুন।

    বাসায় বাবা আর মাহমুদ দু-জন আছেন এখন। তাদের কথা ভেবে শঙ্কিত হলো মরিয়ম। তারা নিশ্চয় মনসুরের এই আসা-যাওয়া শুভ চোখে দেখবে না। জাহেদকে এত সহজে ভুলতে পারে না। ওরা। মরিয়মও ভুলে নি।

    এখন কেমন আছেন? গলার স্বরে উৎকণ্ঠা। কনুই-এর উপর ভর দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করলো মরিয়ম। ক্ষীণ গলায় বললো, ভালো।

    মনসুরকে এখন বিদায় দিতে পারলে বাঁচে সে। রোগাক্লিষ্ট দেহে কোন রকমে অপঘাত সহ্য করতে পারবে না। বাবা মনে-মনে রাগ করলেও মুখে কিছু বলবে না। কিন্তু মাহমুদ হয়তো প্রকাশ্যে অপমান করে বসবে। আর তা খুব সুখপ্রদ হবে না মরিয়মের কাছে।

    কেমন আছিস মা? বাবা এখন আসবেন তা জানতো মরিয়ম। মুহূর্তে সারা গাল রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তার। হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে যেন শ্বাসরোধ করে দাঁড়ালো।

    মনসুরকে দেখে বিব্রত বোধ করলেন হাসমত আলী।

    মরিয়ম অস্ফুটস্বরে বললো, বাবা।

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ওদের দুজনকে চমকে দিয়ে হাসমত আলীর পা ধরে সালাম করলো মনসুর। ডানহাতখানা সামনে বাড়িয়ে ইতস্তত করে হাসমত আলী বললেন, থাক।

    নিজের নাম আর পরিচয় শেষে শূন্য চেয়ারটা হাসমত আলীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মনসুর বললো, বসুন। যেন ঐ বাড়ির কর্তা। হাসমত আলী মেহমান হিসেবে এসেছেন।

    মনসুরের ব্যবহারে দুজনে ওরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেলো।

    হাসমত আলী বললো, না, না, আমি বসব না, আপনি বসুন।

    মনসুর বসলো না–দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর অত্যন্ত সহজভাবে হাসমত আলীর সঙ্গে মরিয়মের চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করলো সে। একটা ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। কিছু টনিক খাওয়ালে শারীরিক দুর্বলতা আর থাকবে না, তাও বললো মনসুর। বিব্রত বোধ করলেও অপ্ৰসন্ন যে হন নি হাসমত আলী, সেটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মরিয়ম। একটু আগের সকল শঙ্কা দূর হয়ে গিয়ে হাল্কা বােধ করলো সে।

    পরদিন আবার এলো মনসুর।

    পরদিন।

    তার পরদিনও।

    তারপর থেকে নিয়মিত ওদের বাসায় আসতে লাগলো মনসুর। বাবা, হাসিনা, সালেহা বিবি, খোকন, সকলকে কি এক অদ্ভুত যাদুবলে আপনার করে নিল সে। মরিয়ম নিজেও বুঝতে পারলো না, কেমন করে এটা সম্ভব হলো। স্রোতের মুখে তৃণখণ্ডের মত সমস্ত পরিবারকে দুর্বার বেগে তার কাছে টেনে নিয়ে এলো মনসুর। হাসমত আলীকে বাবা বলে সম্বোধন করলো সে, সালেহা বিবিকে মা। খোকনকে একটা ফুটবল কিনে দিলো, দুলুকে একটা প্লাস্টিকের পুতুল। হাসিনার জন্য ওর পছন্দ মত একটা শাড়ি কিনে আনলো–আর মরিয়মের জন্য নানা রকম টনিক, ফ্রুটস আর হরলিক্স।

    দারিদ্র্য-বিধ্বস্ত পরিবারে খোদার ফেরেস্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো মনসুর। কোনদিন ও না এলে মা চিন্তিত হয়ে শুধায়, কিরে, মনসুরটা তো আজ এলো না। অসুখ-টসুখ করে নি তো ওর?

    বাবা বলেন, আসবে, বোধহয় কোন কাজে-টাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আহা বড় ভালো ছেলে। জীবনে কত মানুষ দেখলাম, এমন নম্র আর ভদ্র ছেলে আমি দেখি নি।

    খোকন ফুটবলটা দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে, মনসুর ভাই আজ আসবে না আপা?

    হাসিনা বলে, সত্যি, উনি না এলে কিছু ভালো লাগে না।

    কোনো মন্তব্য করে না, শুধু একজন। সে মাহমুদ। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নির্বিকার নির্লিপ্ততায় বাইরে বেরিয়ে যায় সে। সারাদিন আর ফেরে না। ফেরে রাত বারোটায়। কোনদিন খায়, কোনদিন না-খেয়ে শুয়ে থাকে। বাসায় কাউকে মুখ দেখাতে যেন লজ্জা বোধ করে সে। তাই সকলের ঘুম ভেঙ্গে ওঠার আগে বেরিয়ে যায়–আবার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবে বাসায় ফেরে।

    মনসুর দু-একদিন জিজ্ঞেস করছিলো ওর কথা।

    সালেহা বিবি হতাশ গলায় বলেছেন, ওর কথা আর বলো কেন বাবা? বাসায় খোঁজ খবর কি রাখে ও? সারাটা দিন কি চিন্তায় যে ঘুরে বেড়ায়, খোদা জানে।

    হাসিনা বলে, ভাইয়া দিন দিন বাউণ্ডুলে হয়ে যাচ্ছে।

    হাসিনা! মরিয়ম শাসানো-দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে।

    হাসিনা বলে, বাউণ্ডুলে নয় তো কি? ভাইবোনগুলোর একটু খোঁজখবর নেয় কোনোদিন?

    মরিয়ম বলে, ও কথা বলতে নেই হাসিনা।

    হাসিনা চুপ করে যায়।

    মরিয়ম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বিছানা ছেড়ে এ ঘরে ও ঘরে চলাফেরা করে সে। বাইরে বেরুতে চেয়েছিলো। কিন্তু মনসুরের কড়া নিষেধ। জ্বর ছাড়লে কি হবে, আবার আসতে পারে। শরীরটা সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে বাইরে বেরুনো চলবে না।

    মরিয়ম বলে, এখন তো কোন অসুখ নেই। সত্যি ভালো হয়ে গেছি।

    মনসুর বলে, আরো ক’টা দিন যাক।

    মরিয়ম বলে, সেলিনার নিশ্চয় পড়ার খুব ক্ষতি হচ্ছে?

    মনসুর বলে, ঘাবড়াবার কিছু নেই, আপনার চাকুরি যাবে না। ওদের বলে দিয়েছি আমি, আপনার অসুখ।

    মরিয়ম বলে, সত্যি আপনার কাছে অনেক ঋণী হয়ে রইলাম।

    একটু ইতস্তত করে মনসুর বলে, ভালো হয়ে নিন, এক দিন না হয় এ ঋণ শোধ করার সুযোগ দেয়া যাবে আপনাকে।

    বুকটা ধড়াস করে ওঠে মরিয়মের। চােখ তুলে ওর দিকে আর তাকাতে পারে না সে। বুকের কাছে কোথায় যেন একটু ভয়, একটু আনন্দ মিশে গিয়ে এক অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করে।

    একদিন হাসিনা আর খোকনকে নিয়ে বেড়াতে বেরুলো মনসুর। মাকেও যেতে বলেছিলো। মা বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, তোমরা যাও।

    মনসুরের কিনে দেওয়া শাড়িখানা পরে, গলায় সেই পাথরের মালাটা জড়িয়ে বেরিয়ে যাবার সময় মরিয়মকে লক্ষ্য করে বলে গেছে হাসিনা, তুই বিছানায় শুয়ে থাক আপা, আমরা চললাম বেড়াতে। কি, খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি? মুচকি হেসে খোকনের হাত ধরে মনসুরের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে সে। ফিরে এসে উল্লাসে ফেটে পড়েছে হাসিনা।

    মনসুর মোটরে করে পুরো রমনাটা ঘুরিয়েছে ওদের। রেসকোর্স, সারপেন্টাই লেক, আজিমপুর, মতিঝিল, কত জায়গায় গেছে। কি সুন্দর মনসুর ভাইয়ের মোটরটা। মাঝে মাঝে খুব জোড়ে চালাচ্ছিল আর এমন ভয় হচ্ছিলো আমার আপা!

    হাসিনা বললো, খোকন বারবার পিগ পিগ করে হর্ণ দিছিলো, এত ভালো লাগছিলো আমার, বলতে গিয়ে সারা চােখ-মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিলো তার, কসবা রেস্টুরেন্টে কোনদিন গেছিস আপা? বাইরে কি গরম, আর ওখানে ঢুকলে ঠাণ্ডায় গা কাঁপে। মনসুর ভাই ওখানে নিয়ে গিয়ে পরটা-কাবাব খাওয়ালেন। তারপর গলির মাথায় আমাদের নামিয়ে বললেন, তোমার আপা ভালো হলে সবাইকে নিয়ে আরেক দিন বেড়াতে বেরুবো। কি মজা, তাই না আপা? মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে লুটিপুটি খেলো হাসিনা।

    শুধু তখন নয়, পড়তে বসে, খাওয়ার সময়, শোবার আগখান দিয়েও কোথায় কোথায় গিয়েছিলো আর কি কি দেখেছে–সে সব কথা সকলকে শুধালো হাসিনা। বারবার মনসুরের প্রশংসা করলো। ওর মত এত ভালো লোক এ জীবনে সে দেখে নি। আর মনসুর ভাই দেখতে খুব সুন্দর—তাই না। আপা?

    চমকে হাসিনার দিকে তাকালো মরিয়ম। কটাকটা চোখজোড়া স্বপ্নময়। আনন্দে চিকচিক করছে যেন।

    তোমার কি হয়েছে হাসিনা? মনে মনে বললো মরিয়ম। জাহেদের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়লো তার আর নিজের প্রথম যৌবনের কথা। খানিকক্ষণ সে শুধু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলো তাকে। এক প্ৰগলভতা কেন হাসিনার?

    নিজেকে প্রশ্ন করলো মরিয়ম। হাসিনার প্রতিটি গতিবিধি, কথাবার্তা, আশঙ্কাজনক বলে মনে হলো তার।

    রাতে ভালো ঘুম হলো না মরিয়মের।

    পরদিন সকালে অন্য দিনের মত বেরিয়ে গেলো না মাহমুদ। বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো। কুয়োতলায় বসে অনেকক্ষণ ধরে দাঁত মাজলো, মুখ হাত ধুলো। তারপর মায়ের ঘরে চা-নাস্তা করতে বসে খবরটা জানালো সে। নতুন একটা চাকরি হয়েছে তার। প্রেসে প্রুফ-রিডারের চাকরি। মাসে নব্বই টাকা করে দেবে।

    মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে গোল হয়ে বসে চা খেতে বসেছিলো সবাই। মুখ তুলে একবার করে তাকালো ওর দিকে।

    সালেহা বিবি প্রথম কথা বললেন, রাত জেগে কাজ করতে হবে নাতো?

    মাহমুদ বললো, রাত দিন ঠিক নেই, যখন দরকার হবে তখনি করতে হবে কাজ।

    সালেহা বিবি বললেন, এ আবার কেমনতর চাকরি।

    আর কেউ কোন মন্তব্য করলো না।

    এক মুখ মুড়ি চিবোতে চিবোতে হাসিনা বললো, মনসুর ভাইকে বললে উনি আরো একটা ভালো চাকরি যোগাড় করে দিতেন তোমায়।

    মনসুর ভাইটা আবার কে? যেন কিছু জানে না। এমনিভাবে সবার দিকে তাকালো মাহমুদ।

    মরিয়ম যে মেয়েটাকে পড়ায় তার বড় বোনের দেবর। সালেহা বিবি জবাব দিলেন ক্ষণকাল পরে–তোমার সঙ্গে কি আলাপ হয় নি তার হবেই বা কেমন করে তুমি কি আর বাসায় থাকো?

    এ ফাঁকে সেখান থেকে সরে পড়লো মরিয়ম।

    হাসিনা ডাকলো–চা না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেন আপা?

    মরিয়ম বললো, আসছি। কিন্তু সে আর এলো না।

    মুখেপোরা মুড়িগুলো গিলে নিয়ে মাহমুদ বললে, বাসায় না থাকলে কি হবে, কোথায় কি হচ্ছে সে খোঁজ আমি রাখি মা। টাকার জন্যে যে তোমরা আত্ম বিক্রি করছে তা আমি জানি।

    সকলে চুপ

    মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও ছেলের কথার জবাবে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না হাসমত আলী।

    হাসিনা অবাক হয়ে তাকালো মাহমুদের দিকে। এ কথার কোন অর্থ বোধগম্য হয় নি তার।

    সালেহা বিবি ইতস্তত করে বললেন, যা মুখে আসে তা পট করে বলে বসিস না, বুঝলি? একটু চিন্তা করিস।

    মাহমুদ পরক্ষণে জবাব দিলো, চিন্তা করার কথা আর কেন বলছি মা। লোকটার যদি টাকা পয়সা না থাকতো, সে যদি তোমার ছেলেমেয়েদের জন্যে এটা সেটা কিনে না দিতো তাহলে কি আর তাকে অমন মাথায় তুলে নাচতে তোমরা? মায়ের কাছ থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ। নিজের ঘরে চলে যাবার আগ মুহূর্তে বলে গেলো–চা-টা আমার ঘরে দিয়ে যাস তো হাসিনা।

    ও চলে গেলে হাসিনা মুখ বিকৃতি করে বললো, ভাইয়াটা যে কি মিছিমিছি অন্য লোককে গালাগাল দেবে, নিজে যেন কত বড় হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত একটা শাড়ি কিনে দিতে পারলো না আমায়, মুখে শুধু বড় বড় কথা।

    ওই কথা বলে বলেই তো গেলো, যোগ করলেন সালেহা বিবি।

    খোকন বললো, মনসুর ভাই কখন আসবেন?

    সে কখন আসবে তাতে তোমার কি? হাসমত আলী খেঁকিয়ে উঠলেন, ওদের বাজে কথা ছেড়ে বই নিয়ে পড়তে বসো। উষ্মা বিরক্তি বিতৃষ্ণা।

    সালেহা বিবি বললেন, ও কী করেছে যে ওকে অমন ধমকাচ্ছো তুমি?

    হাসমত আলী বললেন, আজকাল পড়ালেখা কিছু করে ও? সারাদিন তো ঐ ফুটবলটা নিয়ে আছে।

    ছেলেমানুষ একটু খেলাধুলো করবে নাতো কি? সালেহা বিবি জবাব দিলেন–তুমি শুধু-শুধু ওকে অমন করে ধমকিও না। চায়ের বাটি আর মুড়ির থালাগুলো হাতে নিয়ে পাকঘরে চলে গেলেন তিনি।

    বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলো মাহমুদ। চায়ের কাপটা পাশে নাবিয়ে রাখতে বইটা বন্ধ করে বললো, হাঁরে হাসি, ধর আমি যদি একটা বড় চাকরি করতাম, মাসে মাসে যদি শ-পাঁচেক টাকা আয় হতো আমার, আর তোদেরকে যতি রোজ বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতাম, এটা-সেটা কিনে দিতাম–থাওলে তোরা আমাকে খুব ভালোবাসতি তাই না?

    হাসিনা বুঝলো না। অবাক হয়ে মাহমুদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। তারপর ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, তুমি পাঁচশো টাকা আয় করতে পারলে তো। বলে ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো সে।

    অপমানিত বৈাধ করলো মাহমুদ। সে পুরুষ। পাঁচশো টাকা আয় করার মতো সামৰ্থ কোনদিন তার হবে না। হবে না এ জন্য নয় যে–তার শক্তি নেই, ক্ষমতা নেই, যোগ্যতা নেই। হবে না এ জন্য যে–তার কোন বড়লোক হিতৈষী নেই, মন্ত্রী আত্মীয় নেই, অসৎ পথে অর্থ রোজগারের প্রবৃত্তি নেই। মরিয়ম। হঠাৎ চিৎকার করে ডাকলো সে–মরিয়ম। প্রথম তার কোন জবাব এলো না। দ্বিতীয় ডাকের একটু পরে মরিয়ম সশরীরে এসে হাজির–আমায় ডাকছে?

    হ্যাঁ, বসো, এক চুমুকে চায়ের কাপটা শূন্য করে একটা বিড়ি ধরালো মাহমুদ। তুমি কি করবে ঠিক করেছাে।

    মরিয়ম ইতস্তত করে বললো, এখনো কিছু ঠিক করি নি।

    মাহমুদ বললো, কেন, ওই বড়লোকটার গলায় ঝুলে পড়লেই তো পারো, মন্দ কি? তীর্যক কণ্ঠস্বর।

    মরিয়মের ইচ্ছে হচ্ছিলো মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায় চোখমুখে জ্বালা করে উঠলো তার। এ সময় হাসিনা না এলে হয়তো কেঁদে ফেলতো মরিয়ম।

    হাসিনা দরজার ওপাশ থেকে বললো, কে এসেছে দেখে যা আপা।

    ওর উচ্ছাস দেখে প্ৰথমে মরিয়মের মনে হয়েছিলো মনসুর। আর তাই মনে হতে ভীষণ বিব্রত বোধ করছিলো সে।

    হাসিনা বললো, লিলি আপা এসেছে।

    মরিয়ম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মাহমুদ বললো, তোমার সঙ্গে কথা কিন্তু শেষ হয় নি আমার। বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে আবার এসো।

    লিলি একা আসে নি, সঙ্গে তার একটা সতেরো-আঠারো বছরে ছেলে। হাতে একটা ক্যামেরা। লিলি পরিচয় করয়ে দিয়ে বললো, আমার মামাতো ভাই তসলিম, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। হাসিনা ফটাে তুলবে বলেছিলো তাই ওকে নিয়ে এসেছি।

    হাসিনা খুশিতে ডগমগ হলো।

    মরিয়ম বললো, তোমাকে আরো আগে আশা করেছিলাম লিলি। এতদিন আস নি। কেন?

    লিলি বললো, সারাদিন ছাত্রী পড়িয়ে বিকেলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।

    মরিয়ম বললো, আমার অসুখ করেছিলো, যদি মরে যেতাম!

    লিলি অবাক হলো–অসুখ হয়েছিলো? আমাকে একটু খবর দিলেই তো পারতে, আমি কিচ্ছু জানি না।

    মরিয়ম বললো, কার হাতে খবর পাঠাবো?

    লিলি বললো, তোমার দাদাকে তো প্রায়ই দেখি, আমাদের স্কুলের সামনে একটা রেস্তোরাঁয় বসে বসে আড্ডা দেন। তার হাতে খবর পাঠালে পেতাম।

    মাহমুদ সম্পর্কে লিলির মন্তব্যটা ভালো লাগলো না মরিয়মের।

    হাসিনা বললো, দেখলি তো আপা, ভাইয়া সারাদিন রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা মারে, তাইতো বাসায় বেশি খায় না।

    বাজে বকো না হাসিনা। মরিয়ম ধমকে উঠলো।

    মুহূর্ত কয়েক আবহাওয়াটা গুমোট হয়ে রইলো।

    অবশেষে পরিবেশটা হাল্কা করে দিয়ে লিলি বললো–চলো ফটাে তুলবে।

    হাসিনা হাততালি দিয়ে বললো, চল আপা, ভাইয়াকে ডাকবো?

    তারপর তসলিমের দিকে চেয়ে বললো, আমার একটা ভালো ফটাে তুলে দিতে হবে কিন্তু।

    আপনারা কি গ্রুপ ফটাে তুলবেন, না প্রত্যেকে আলাদা করে। তসলিম এতক্ষণে কথা বললো, আমার কাছে কিন্তু বেশি ফিল্ম নেই।

    ফিল্ম না থাকলে এসেছেন কেন? হাসিনা পরক্ষণে জবাব দিলো, না এলেই পারতেন।

    এই হাসিনা। ওর চুলের গোছা ধরে টান দিলো মরিয়ম।

    তসলিমের কচি মুখখানা লাল হয়ে গোলো।

    লিলি হেসে বললো, রাগ করো না হাসিনা–আরেক দিন ভর্তি ফিল্ম নিয়ে আসবে ও।

    মরিয়ম বললো, বড় বেশি ফাজিল হয়ে গেছে।

    ফটাে তোলার জন্যে মাহমুদকে ডাকতে গেলে ও বললো, আমার অত সখ নেই।

    মরিয়ম বললো, সবাই তুলছি আমরা।

    মাহমুদ জবাব দিলো, তোমরা তোলা গে।

    মা এসে বললো, কেন কি হয়েছে। ভাইবোন সবাই মিলে ওরা একটা ফটাে তুলতে চাইছে, তাতে তোর এত আপত্তি কেন শুনি? তুই এমন হলি কেন অ্যাঁ?

    উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো মাহমুদ। দোরগোড়ায় লিলিকে উঁকি মারতে দেখে থেমে গেলো সে। উঠে দাঁড়াতে মৃদু গলায় বললো, চলো তোমাদের যখন এত সখ হয়েছে।

    কিন্তু কোথায় বসে ফটাে তুলবে তা এক সমস্যা দাঁড়িয়ে গেলো। ছাদে বসে তুলবে বলে আগে ভেবেছিলো। ওরা। মাহমুদ বললো, পাগলামো আর কি। এক সঙ্গে সবাই ওখানে উঠলে ছাত্র ভেঙ্গে পড়বে।

    হাসিনা বললো, একজন করে উঠলে তো হয়।

    কিন্তু গ্রুপ ফটাে তুলতে হলে সকলকে একসঙ্গে বসতে হবে। অবশেষে ঠিক হলো কুয়োর পাশে পাক ঘরের সামনে যে অপরিসর আঙ্গিনাটা আছে সেখানে বসবে ওরা।

    ফটো তোলার ব্যাপারে হাসমত আলী কোন আপত্তি করলেন না। ছেলেমেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার সাহস তাঁর নেই। শুধু একবার মাথা চুলকে বললেন, আমায় কেন? বলতে বলতে কুয়োতলায় নেমে এলেন তিনি।

    সালেহা বিবি বেঁকে বসলেন। বললেন, তোমরা তোলো, আমি দেখি।

    মরিয়ম বললো, এসো না মা।

    লিলি বললো, আসুন খালা খাআম্মা।

    সালেহা বিবি বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, আজ বাদে কাল মরবো, ফটাে তুললে গুনাহ হয়। মনে তারও ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কার বারবার বাধা দিচ্ছিলো এসে।

    মাহমুদ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ। বিরক্ত হয়ে এবার বললো, ফটাে তোলার যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে এসো মা তোমাদের অত ধানাইপানাই আমার ভালো লাগে না, আমি চললাম। ও চলে যেতে উদ্যত হলো।

    ওর রাগ দেখে ফিক করে হেসে দিলো লিলি।

    দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে ওর দিকে তাকালো মাহমুদ। একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মেয়েটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না বোধ হয়। চোখ নামিয়ে নিলো। মা এতক্ষণে রাজী হলেন।

    পাকঘরের সিঁড়ির ওপর পাশাপাশি বসলো।

    মা-বাবা মাঝখানে। বাবার পাশে মাহমুদ। মায়ের পাশে মরিয়ম। সামনে বসলো হাসিনা, দুলু আর খোকন।

    তসলিম বললো, একটু অপেক্ষা করতে হবে। রোদ ঢাকা পড়ে গেছে। মেঘটা সরে যাক৷

    একফাঁকে খোকনের মনে পড়লো তার ফুটবলটার কথা। দৌড় দিয়ে খাটের তলা থেকে ওটা বের করে এনে কোলে নিয়ে বসলো সে। ওর ফুটবল নিয়ে বসতে দেখে, দুলুর মনে পড়লো ওর পুতুলটার কথা। ছুটে গিয়ে পুতুলটা নিয়ে এলো সে, ওর মুখে হাসি। খোকন একবার নিজের ফুটবল আর ওর পুতুলটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বঁকালো, আর আস্তে করে বললো, আমার দেখাদেখি।

    মেঘ সরে গেছে, সকলেই ক্যামেরাটার দিকে তাকালো এবার।

    গ্রুপ ফটো তোলা হয়ে গেছে। মাহমুদ চলে যাচ্ছিলো। হাসিনা পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ওর। ভাইয়া পালাচ্ছে কেন, আমি তুমি আর আপা একখানা তুলবো।

    মাহমুদ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, বাজে আবদার করো না।

    মরিয়ম ডাকলো–ভাইয়া।

    নাও, তুলতে হলে তাড়াতাড়ি তোল। মাহমুদ আবার এসে বসলো পাকঘরের সিড়ির ওপর। মরিয়ম আর হাসিনা ওর দু-পাশে।

    লিলি মৃদু মৃদু হাসছিলো আর দেখছিলো ওদের। ওর দিকে চোখ পড়তে মরিয়ম বললো, এসো না লিলি তুমিও এসো।

    হাসিনা ডাকলো, আসুন লিলি আপা, আসুন না। ওর গলায় অবদারের সুর।

    মাহমুদের দিকে তাকিয়ে, মুখখানা রক্তে লাল হয়ে গেলো লিলির। দ্রুত ঘাড় নাড়লো সে–না তুলব না।

    মাহমুদ এ প্রথম বললো ওর সঙ্গে–এত লজ্জা নিয়ে আপনি শহরে বেরোন কি করে? ফটো তুলতে আসুন।

    লিলি এবার সরাসরি তাকালো ওর দিকে। মুখখানা স্নান হয়ে গেছে তার। মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললো, আপনারা তুলুন।

    ফটো তোলা শেষ হলে তসলিমকে ধরে বসলো হাসিনা–আমাকে ছবি তোলা শেখাতে হবে।

    তসলিম সুবোধ বালকের মত মাথা নোয়ালো, আচ্ছা।

    হাসিনা বললো, আচ্ছা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার দেখা পাওয়া যাবে কোথায়? তসলিম সঠিক কোন উত্তর না দিতে পেরে ইতস্তত করছিলো।

    হাসিনা বললো, আপনি আমাদের বাসায় আসবেন, রোজ একবার করে আসতে হবে কিন্তু।

    তসলিম মৃদু হেসে সায় দিলো–আসবো।

    হাসিনা সহজে ছেড়ে দিলো না তাকে। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলো। কি করে ছবি ওঠে তা জিজ্ঞেস করলো। একটা ক্যামেরার দাম কতো জানতে চাইলো। আজকে তোলা ফটোগুলো কবে পর্যন্ত পাবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলো। তসলিম কবে থেকে শিখেছে, শিখতে তার কতদিন লেগেছে, হাসিনার কতদিন লাগতে পারে, এমনি নানা আলাপের শেষে বললো, আমাকে কিন্তু শিখাতে হবে নইলে… কথাটা শেষ না করলেও অপূর্ব ভঙ্গিতে ওকে শাসলো হাসিনা।

    এতদিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকলেও আজ লিলির সঙ্গে বাইরে বেরুলো মরিয়ম। দুটি কারণ ছিলো এর পিছনে। প্রথমত মাহমুদকে এ-মুহূর্তে এড়াতে চায় সে। দ্বিতীয়ত নিরালায় বসে মনসুর সম্পর্কে লিলির সঙ্গে আলাপ করবে। একটা সিদ্ধান্ত অবিলম্বে নিতে চায় মরিয়ম।

    বাসায় ফিরতে সাঁঝ হয়ে গেলো। দুপুরে লিলির ওখানে খেয়েছে সে। তারপর গল্প করতে করতে কখন বেলা পড়ে এসেছে সে খেয়াল ছিলো না।

    বাইরে থেকে হাসিনার উচ্ছসিত গলার স্বর শুনে বুঝতে পেরেছিলো, মনসুর এসেছে।

    মাহমুদ ঘরে আছে কিনা উঁকি মেরে দেখে, বারান্দায় বার কয়েক হোঁচট খেয়ে যখন ভেতরে এলো মরিয়ম, তখন সকাল বেলা ফটো তোলার ব্যাপারটা মনসুরকে শোনাচ্ছিলো হাসিনা। তসলিম তাকে ফটো তোলা শেখাবে বলেছে। সে খুব ভালো ছেলে-বড় ভালো–এসব কথাও তাকে বলছিলো সে।

    মনসুর অন্যমনস্কভাবে শুনছিলো সব। মরিয়মকে দেখে মুখখানা মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে স্নানতায় ফিরে এলো।

    কখন এসেছেন আপনি? ভেতরে এসে প্রশ্ন করলো মরিয়ম।

    অনেকক্ষণ। স্নানমুখে বললো মনসুর, আপনি বুঝি আবার বেরুতে শুরু করেছেন?

    মৃদু হেসে ওর পাশ কাটিয়ে এসে বিছানার ওপর বসলো মরিয়ম। ময়লা চাদরটার দিকে চোখ পড়তে, হাসিনার প্রতি একটা কটাক্ষ হানলো সে।

    হাসিনা আবার ফটো তোলার খবর শোনাতে লাগলো। তারপর বললো, আমাকে একটা ক্যামেরা কিনে দিতে হবে মনসুর ভাই।

    মনসুর হেসে দিয়ে বললো, কিনে দেবো।

    মরিয়ম উসখুস করছিলো। অকস্মাৎ হাসিনার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি একটু বাইরে যাও হাসি, মনসুর সাহেবের সঙ্গে আমার কিছু আলাপ আছে। গলার স্বরটা অদ্ভুত শোনালো মরিয়মের।

    মনসুর অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে।

    একবার মরিয়ম, আরেকবার মনসুরের দিকে তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো হাসিনা।

    একেবারে চলে গেলো না সে। বারান্দায় আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে রইলো।

    দুজনে নীরব।

    মরিয়ম ভাবছিলো কী করে কথাটা বলা যায় ওকে।

    মনসুর শঙ্কিত হলো, চরম মুহূর্তটি বুঝি আজ এলো ওর সামনে।

    আরো অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে, অদূরে টেবিলটার দিকে তাকিয়ে মরিয়ম বললো, আপনি রোজ রোজ এখানে কেন আসেন?

    যা আশঙ্কা করছিলো মনসুর।

    সারা দেহে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর এলো।

    ক্ষণকাল পরে সে বললো, সে কথা কি এ মুহূর্তে শুনতে চান আপনি? ওর চোখে চোখ পড়তে দ্রুত চোখজোড়া নাবিয়ে নিল মরিয়ম।

    হ্যাঁ। গলাটা কেঁপে উঠলো তার।

    আবার নীরবতা।

    নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো মনসুর। বার-কয়েক ঢোক গিলে অবশেষে বললো, আমি আপনাকে ভালবাসি।

    অপ্রত্যাশিত কিছু ছিলো না, তবু সারা দেহ দুলে উঠলো মরিয়মের। জীবনে আরেকটি ক্ষণ, মুহূর্ত মনে পড়ে গেলো। বুকটা দুরুদুরু কাপছে ভয়ে-আনন্দে। মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতে পারলো না মরিয়ম। মনে হলো, ওর দৃষ্টির সামনে থেকে যদি নিজেকে এখন কোথাও লুকিয়ে ফেলতে পারতো সে? বিছানার চাদরটাকে ডান হাতে আঁকড়ে ধরলো মরিয়ম। ওকে চুপ থাকতে দেখে অদ্ভুত গলায় মনসুর আবার বললো, আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। যদি অন্যায় কিছু বলে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দেবেন আমায়। আরেক বার ঢোক গিললো সে। কথাগুলো ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না আমি, আপনি বিশ্বাস করুন, জীবনে এই প্রথম একটি মেয়েকে ভালবেসেছি আমি। যেদিন আপনাকে প্রথম দেখি সেদিন।

    কথার খেই হারিয়ে ফেললো মনসুর।

    সমস্ত দেহটা কুঁচকে একটুখানি হয়ে এলো মরিয়মের। ভয় আর আনন্দ। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না সে। খানিকক্ষণ পরে মনসুর আবার বললো, আপনি হয়তো মনে মনে ঘৃণা করতে পারেন আমাকে, কিন্তু যেদিন আপনাকে প্রথম দেথি সেদিনই ঠিক করেছিলাম আপনাকে বিয়ে করবো।

    মরিয়ম চমকে তাকালো ওর দিকে।

    একজোড়া যন্ত্রণাকাতর চোখ।

    পরক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মরিয়ম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, বাবাকে বলবেন, দয়া করে এসব কথা বাবাকে বলবেন। আমি কিছু জানি না  বলে তার সামনে থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো মরিয়ম।

    আর এলো না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগল্প সমগ্র – জহির রায়হান
    Next Article তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    Related Articles

    জহির রায়হান

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }