Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বরফ গলা নদী – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প156 Mins Read0

    ২.৬ আমেনার শাড়ি

    আমেনার শাড়ি

    আমেনার শাড়িটাও অজস্র ছেড়া আর তালিতে ভরা। সেও মা। তারও ছেলেমেয়ে আছে। স্বামী আছে। তবু সালেহা বিবির সঙ্গে কোথায় যেন একটা ব্যতিক্রম রয়েছে ওর। চৌকির এক কোণে বসে নীরবে আমেনাকে দেখছিলো আর ভাবছিলো মাহমুদ।

    ঘরটা ঝাঁট দিয়ে, টুকিটাকি জিনিসপত্রগুলো গোছাচ্ছিলো আমেনা। মুখ তুলে বললো, প্রেস বিক্রি করে দেবে দাও। বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন? আমি করবো না বললেই কি আর রেহাই পাওয়া যাবে।

    কথাগুলো শাহাদাতকে উদ্দেশ্যে করে।

    মাহমুদের মুখোমুখি একবার টুলের ওপর বসে ছিলো সে। নড়েচড়ে একবার মাহমুদ আরেকবার আমেনার দিকে তাকিয়ে সে বললো, তাই বলে তোমার বুঝি কোন মতামত থাকবে না?

    আমেনার মতামত ছাড়া শাহাদাত কিছু করে না তা নয়। এ ক্ষেত্রে আমেনার মতামত চাওয়ার মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছে লুকিয়ে রয়েছে, সেটা জানতো মাহমুদ। আমেনার বড় তিন ভাই বেশ রোজগার করছে ইদানীং। ধানমণ্ডিতে বাড়ি করেছে ওরা। গাড়িও কিনেছে একখানা। ছেলেমেয়ে নিয়ে ওরা বেশ সুখে আছে। আমেনা ইচ্ছে করলে এ দুঃসময়ে হাত পাততে পারে ওদের কাছে। রক্তের ভাই, সহজে না করবে না। প্রেসটাকেও তাহলে বিক্রির হাত থেকে বাচানো যাবে। কিন্তু, প্রস্তাবটা সরাসরি মুখ ফুটে বলতে ভয় পায় শাহাদাত। আমেনার স্বভাবটা ওর অজানা নয়। আমেনা কিছুক্ষণ পরে বললো, আমার মতামত আবার নতুন করে কি দিবো। চালাতে না পারলে বিক্রি করে দাও।

    শাহাদাত বললো, তারপর চলবে কেমন করে?

    আমেনা গম্ভীর হয়ে বললো, আর পাঁচজন যেমন করে চলে। বলে বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো আমেনা।

    এতক্ষণে মাহমুদ একটি কথাও বলে নি। সে ভেবেছিলো, মায়ের সঙ্গে আমেনার ব্যতিক্রম যেখানে–সেখানে ওর সঙ্গে রয়েছে একটা আশ্চর্য মিল। না তা নয়। আমেনাকে ওর নিজের চেয়ে বড় মনে হলো আজ।

    শাহাদাত মৃদু গলায় বললো, দেখলে তো, কী যে স্বভাব পেয়েছে ও বুঝি না। দূরের কেউ তো নয়, আপন মায়ের পেটের ভাই, দরকার পড়েছে তাই হাত পাতবে। ভিক্ষে তো চাইছি না, ধার চাইছি। এতে অসম্মানের কি হলো?

    মাহমুদ চুপ করে রইলো।

    ওকে নীরব থাকতে দেখে শাহাদত আবার বললো, আরে ভাই, ওদের হচ্ছে হারামীর টাকা। কন্ট্রাকটারী করে, রাস্তায় রাস্তায় রোজগার করছে। দিতে একটু গায়ে লাগবে না।

    মাহমুদ আস্তে করে বললো, ওই হারামী টাকাগুলো এনে তোমার অনেক শ্রমে গড়া প্রেসটাকে কলুষিত করো না শাহাদাত। তারচেয়ে বিক্রি করে দাও ওটা।

    ওর কাছ থেকে কোন রকম সমর্থন না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়লো শাহাদাত। সবার ইচ্ছে প্রেসটা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু বিক্রির কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মন থেকে সত্যিকার কোন সাড়া পায় না সে। বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে। কত কষ্টে গড়া ওই প্রেস। বার কয়েক উসখুস করে ধরা গলায় হঠাৎ শাহাদাত বললো, তোমরা কি আমার কথা একবার ভাবো না? ওই প্রেসটার পেছনে সর্বস্ব দিয়েছি আমি, ওটাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে কি করে বাঁচবো, বলো।

    মাহমুদ নীরব।

    পর পর কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিলো শাহাদাত। তারপর অনেকক্ষণ অভিমানেভরা কণ্ঠে বললো, ঠিক আছে, তাই হবে বলে চুপ করে গেলো সে।

    এ সময়ে আবার এ ঘরে এলো আমেনা। মরিয়মের বিয়ে প্রসঙ্গে মাহমুদকে দুচারটে প্রশ্ন করলো সে। কোথায় বিয়ে হয়েছে, ছেলে দেখতে শুনতে কেমন, কি করে। পানদানটা সামনে রেখে একটা পান বানিয়ে খেলো আমেনা। তারপর আবার চলে গেলো। অনেকক্ষণ পর মাহমুদ বললো,  প্রেসটা বিক্রি করে দেবার পর কি করবে? চাকরি-বাকরি–!

    কথাটা শেষ করতে পারলো না। শাহাদাত বাধা দিয়ে বললো, কি যে বলো তুমি? আমি চাকরি করবো? আমেনা তাহলে গলায় দড়ি দেবে। বলে হেসে উঠলো সে। হাসতে গিয়ে চিবুকে অনেকগুলো ভাঁজ পড়লো তার।

    মাহমুদ কিছু বলবে ভাবছিলো।

    আমেনা আবার এলো সেখানে–কী হলো অমন হাসছে যে। বলতে গিয়ে খুকখুক করে বার কয়েক কাশলো সে। আবার কাশলো।

    শাহাদাত শঙ্কিত চোখে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, তোমার কাশটা দেখছি আরো বাড়লো।

    আমেনা পরক্ষণে বললো, না কিছু না।

    শাহাদাত বললো, কিছু না নয়, তুমি ভীষণ ঠাণ্ডা লাগাও আজকাল। এ কথার কোন জবাব দিলো না আমেনা। খানিকক্ষণ কেশে নিয়ে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসলো সে।

    ওদের এই দাম্পত্য আলাপের মাঝখানে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো মাহমুদ। কাল বিকেলে এতক্ষণে বর এসে গেছে মরিয়মের। আজ সে শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে খোকনও আছে। হাসিনা ফিরেছে স্কুল থেকে।

    বাসায় এখন বাবা, মা, দুলু আর সে হয়তো বসে বসে বিয়ের গল্প করছে। কাল স্বামীসহ আবার ফিরে আসবে মরিয়ম। হাসিনার ঘরে ওদের থাকার বন্দোবস্ত করা হবে। হাসিনা থাকবে মায়ের সঙ্গে। আর বাবার জন্যে মাহমুদের ঘরে একটা নতুন বিছানা পাতা হবে। মা হয়তো এতক্ষণে সে বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন বাসায় সবার সঙ্গে। মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো।

    শাহাদাত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ওকি উঠলে কেন?

    মাহমুদ আস্তে করে বললো, না, এবার যাই।

    যাবে আর কি বসো না।

    না, আর বসবো না।

    কোথায় যাবে? টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা হাই তুললো শাহাদাত।

    মাহমুদ বললো, প্রেসে, দেখি কোন কাজ আছে কি না। শরীরটা আজ বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাবো।

    আমেনা পেছন থেকে শুধালো, মরিয়ম ফিরছে কখন?

    মাহমুদ সংক্ষেপে বললো, কাল।

    আমেনা বললো, আবার এসো তুমি, খাওয়ার দাওয়াত রইলো।

    মাহমুদ আস্তে বললো, আসবো। তারপর শাহাদাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো সে।

     

    দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো মরিয়ম। বিয়ের পর তিনটে মাস কেটে গেছে। দিনগুলো যেন বাদাম তোলা নৌকোর মতো দেখতে না দেখতে চলে গেলো। প্রথম প্রথম মনসুর তো ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলো। সারাদিন ঘরে থাকতো। সারাক্ষণ মরিয়মের পাশে। মরিয়ম রাগ করে বলতো ব্যবসাটা কি ডোবাবে নাকি?

    মনসুর বলতো, তোমার জন্যে ডোবে যদি ডুবুক। ক্ষতি নেই। রোজ বিকেলে সাজপোশাক পরে, চকোলেট রঙের গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছে ওরা। যেখানে যেতে চেয়েছে মরিয়ম, সেখানে নিয়ে গেছে মনসুর।

    মাঝে বারকয়েক বাবার বাড়িতেও এসেছিলো মরিয়ম। দিন দুতিনেক করে থেকে গেছে।

    আরো থাকতো। মনসুরের পীড়াপীড়িতে থাকতে পারে নি।

    নিজের স্বচ্ছল জীবনের পাশে বাবা মা-ভাইবোনের দীনতা মনে আঘাত দিয়েছে মরিয়মকে। যখন যা পেরেছে, টাকা-পয়সা দিয়ে ওদের সাহায্য করছে সে। মনসুর কথা দিয়েছে, একটা ভালো বাড়ি দেখে সেখানে নিয়ে আসবে ওদের। ভাড়াটাও নিজেই দেবে, আর হাসিনা ও খোকনের পড়ার খরচটা চালাবে মনসুর। শুনে প্রসন্ন হয়েছে মরিয়ম। মাবাবারও খুশির অন্ত নেই। যখন হাত পেতেছেন কিছু না কিছু পেয়েছেন মনসুরের কাছে। জীবনটা বেশ চলছিলো।

    কিন্তু দুমাস না যেতে, অকস্মাৎ একদিন প্রথম জোয়ারের উচ্ছাসে ভাটা এলো। খাওয়ার টেবিলে সেদিন বড় উন্মনা মনে হচ্ছিল মনসুরকে। শোবার ঘরে এসে প্রথম বললো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ম্যারি, উত্তর দেবে?

    শঙ্কিত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে মরিয়ম জবাব দিলো, কি কথা, বলো।

    জাহেদ নামে কোন ছেলেকে তুমি চিনতে? ওর দৃষ্টি মরিয়মের চোখের উপর।

    বুকটা বহুদিন পর কেঁপে উঠেছে মরিয়মের। ইতস্তত করে বললো, চিনতাম।

    মনসুরের মুখখানা কাল হয়ে এলো। ক্ষণকাল পরে সে আবার বললো, তার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিলো তোমার?

    মুখখানা মাটির দিকে নামিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো মরিয়ম। তারপর মুখ তুলে সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে বললো সে, ওকে আমি ভালবাসতাম বলতে গিয়ে একটা ঢোক গিললো মরিয়ম |

    ভালবাসতে! যেন আর্তনাদ করে উঠল মনসুর।

    মরিয়ম আস্তে করে বললো, হ্যাঁ। মাথার উপরের পাখাটা আরো জোরে ঘুরিয়ে দিয়ে মনসুর কাঁপা গলায় বললো, তারপর?

    মরিয়মের দেহটা পাথরের মত নিশ্চল ঠাণ্ডা। অকম্পিত গলায় সে জবাব দিলো, তখন আমি স্কুলে পড়ি। বাবা হঠাৎ পড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন আমার। জাহেদকে আমি ভালবাসতাম। আমাদের পাড়াতেই সে থাকতো। কলেজে পড়তো। সেও ভালবাসতো আমায়। মরিয়ম থামলো, থেমে বার কয়েক ঘন ঘন শ্বাস নিলো সে। তারপর আবার বললো, বাবা যখন কিছুতেই বিয়ের আয়োজন বন্ধ করলেন না তখন একদিন রাতে ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলাম আমি।

    পালিয়ে গেলে! দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করে উঠলো মনসুর।

    মরিয়ম অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে চিটাগাং চলে গেলাম আমরা। জাহেদ তার মায়ের কিছু অলঙ্কার আর নগদ টাকা সঙ্গে নিয়েছিল। কথা হয়েছিল চাটগাঁ গিয়ে একটা বাসা ভাড়া নেবো আমরা। জাহেদ একটা চাকরি জোগাড় করবে। মরিয়ম থামলো।

    টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা জগ থেকে এক গ্রাস পানি খেয়ে এসে আবার বললো মনসুর–তারপর?

    পাখার বাতাসে কালো চুলগুলো বারবার উড়ে উড়ে পড়ছিলো মরিয়মের ফর্সা মুখের ওপর। আস্তে করে সে আবার বললো, ওখানে গিয়ে বাসা পাওয়া গেলো না, একটা সস্তা হোটেলে একখানা রুম ভাড়া করেছিলাম আমরা।

    একসঙ্গে ছিলে? ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হলো না মনসুরের। মরিয়ম হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে জবাব দিলো, হ্যাঁ।

    তারপর?পাখার নিচে ঘামতে শুরু করেছে মনসুর।

    তারপর সেখানে দু-মাস ছিলাম আমরা–মরিয়ম মৃদু গলায় বললো, টাকা পয়সা সব ফুরিয়ে গিয়েছিলো, ভীষণ কষ্টে দিন কাটছিলো আমাদের। তারপর একদিন–বলতে গিয়ে ইতস্তত করলো মরিয়ম, তারপর একদিন আমাকে সেখানে একা ফেলে রেখে কোথায় যেন চলে গেলো জাহেদ, আর ফিরলো না। বলতে গিয়ে এতক্ষণে চোখজোড়া পানিতে টলমল করে উঠলো তার।

    মরিয়মের কথা শেষ হয়ে গেলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো ওরা। পাখাটা ঘুরছে মাথার উপর। ঘরের মধ্যে শুধু তার বনবন শব্দ। কারো দিকে কেউ তাকালো না ওরা। কি এক নির্বিকার নীরবতায় দুজনে ডুবে গেলো। পরস্পরের কাছাকাছি অস্তিত্বটা ধীরে ধীরে যেন দূরে সরে গেলো। মরিয়মের মনে হলো, অনেকক্ষণ পরে, বহুদূর থেকে যেন মনসুর জিজ্ঞেস করছে তাকে, জাহেদকে সত্যি ভালবাসতে তুমি?

    মরিয়ম মাথা নোয়ালো–হ্যাঁ।

    এখনো ভালবাস? দ্বিতীয় প্রশ্ন।

    মরিয়ম মাথা নাড়লো–না।

    মনসুরের মনে হলো মিথ্যে কথা বলছে মেয়েটা।

    সে রাতে আর কোন কথা হলো না।

    মরিয়ম লক্ষ্য করেছে, সারারাত ঘুমোতে পারে নি লোকটা।

    পরদিন সকালে, মাঝে মাঝে তাল ভঙ্গ হয়ে গেলেও আগের মত ব্যবহার করলো মনসুর। বাইরে বেরুবার সময় রোজকার মত দুহাতে ওকে আলিঙ্গন করে মৃদু গলায় বললো, কাজটা সেরে আসি, কেমন? মরিয়ম ওর মুখের কাছে মুখ এনে মিষ্টি হেসে বললো, এসো।

    কিন্তু দুপুরে আবার যখন ফিরে এলো মনসুর, তার মুখখানা তখন আবার ভার হয়ে গেছে। সারা মুখে চিন্তার ছায়া। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো সে। খাওয়ার পরে, বিছানায় বিশ্রাম নেবার সময় বার কয়েক এপাশ ওপাশ করে হঠাৎ সে উঠে বসে বললো, তুমি আমাকে ভালবাস মরিয়ম? গলাটা অদ্ভুত শোনালো ওর।

    মরিয়ম পাশে বসেছিলো। চমকে তাকালো ওর দিকে। মৃদু হেসে জবাব দিলো, কেন, তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে?

    মনসুর মৃদু গলায় বললো, না। ক্ষণকাল চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো, তুমি জাহেদকেও ভালবাসতে, তাই না? তার কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা।

    মরিয়ম দৃষ্টিটা ওর ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ।

    অন্যদিন এ সময়ে বেরুতো না মনসুর, সেদিন বেরিয়ে গেলো। যাবার সময় মরিয়ম জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো?

    মনসুর ইতস্তত করে দু-হাতে কাছে টেনে নিলো ওকে। তারপর বললো, কাজ আছে।

    বিকেলে সে ফিরলো না, ফিরলো সে অনেক রাত করে। কাপড় চোপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।

    মরিয়ম জিজ্ঞেস করলো, খাবে না?

    সে বললো, মাথা ধরেছে, কিছু ভালো লাগছে না আমার।

    কপালটা টিপে দেবো?

    না।

    সারারাত যন্ত্রণায় ছটফট করেছে মনসুর।

     

    পরদিন চায়ের টেবিলে হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, সত্যি করে বলতো ম্যারি, তুমি কাকে বেশি ভালবেসেছ? জাহেদকে না আমাকে?

    চায়ের কাপটা মুখের কাছে এনে নামিয়ে রাখলো মরিয়ম। এক ঝলক চা ঢলকে পড়ে গেলো পিরিচের ওপর, মৃদু স্বরে সে জবাব দিলো, জানি না।

    ভ্রুজোড়া অদ্ভুতভাবে বাকালো মনসুর। তারপর আস্তে করে বললো, তোমার কি মনে হয়, মানুষ দুবার প্রেমে পড়তে পারে?

    বিব্রত মরিয়ম বললো, পারে।

    বাজে কথা। চায়ের কাপটা সামনে ঠেলে দিয়ে উঠে পড়লো মনসুর। লম্বা সোফাটার উপর শুয়ে পড়ে দুহাতে কপালটা চেপে ধরলো সে। আবার মাথা ধরেছে।

    সেদিন বিকেলে লিলি এলো বাসায়।

    ভাই আর ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে দিয়েছে সে। শঙ্করটোলা লেনে একটা ঘর নিয়ে থাকবে বলে সে কথা মরিয়মকে জানাতে এসেছিলো লিলি। ওর স্নান মুখ দেখে অবাক হলো সে। বললো, তোমার কি অসুখ করেছিলো ম্যারি?

    কই না তো। মরিয়ম ঘাড় নাড়লো।

    লিলি বললো, তুমি ভীষণ শুকিয়ে গেছ।

    মরিয়ম হাসতে চেষ্টা করলো, তাই নাকি?

    লিলি বললো, হ্যাঁ।

    সেদিন অনেকক্ষণ দুজনে গল্প করেছিলো ওরা। বাইরে ছোট লনটিতে দুটো বেতের চেয়ার বের করে মুখোমুখি বসেছিলো।

    লিলি বললো, হাসিনা এসেছিলো?

    মরিয়ম বললো, মাঝখানে দিন চারেক সে থেকে গেছে এখানে, তারপর আর আসে নি।

    বাবা এসেছিলেন একদিন। খোকন আসে মাঝে মাঝে।

    তোমার দাদা?

    না। বলতে গিয়ে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার। মাহমুদ যে আসবে না সেটা জানতো মরিয়ম।

    ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। আকাশে তারারা জ্বলে উঠেছিলো একে একে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে সবুজ লনের উপর দিয়ে। অন্ধকারে ওরা দুজনে বসে। মরিয়ম ভেবেছিলো লিলিকে কিছু বলবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর সংবরণ করে রাখতে পারলো না সে। দিন কয়েক ধরে যা ঘটেছে সব খুলে বললো লিলিকে।

    শুনে লিলি মন্তব্য করলো, তুমি এতো বোকা তাতো জানতাম না ম্যারি।

    মরিয়ম শুধালো কেন।

    লিলি বললো, সব কিছু ওভাবে খুলে বলতে গেলে কেন ওকে?

    মরিয়ম বললো, মিথ্যে তো বলি নি।

    লিলি হাসলো, অত সত্যবাদী হতে নেই ম্যারি। এ সমাজে বাঁচতে হলে মিথ্যের মুখোশ পরে চলতে হয়।

    মরিয়ম অবাক হয়ে বললো, কেন?

    কেন তা টের পাবে ধীরে। জবাব দিলো লিলি।

    ক্ষণকাল চুপ থেকে মরিয়ম বললো, মানুষ কি দুবার প্রেমে পড়তে পারে না? একজনকে হারিয়ে সেকি আরেকজনকে ভালবাসতে পারে না?

    পারে। দুবার কেন দশবারও পারে। লিলি বললো, কিন্তু সেটা কেউ স্বীকার করে না। যেমন আমার কথাই বল না। তুমি তো জান, দুটি ছেলেকে ভালোবাসছিলাম আমি। একজন ছিলো খুব ভালো অভিনেতা, আরেকজন ছিলো গায়ক। সেসব অতীতের কথা, তাই বলে ভবিষ্যতে আমি কাউকে ভালবাসবো না, তাতো নয়। হয়তো ভালবাসবো, কিন্তু ওদের কারো কথা আমি বলবো না তাকে ৷

    অন্ধকারে শব্দ করে হেসে দিলো মরিয়ম |

    লিলি বললো, তুমি হাসছে ম্যারি। বড় সরল মেয়ে তুমি। এ সমাজের কিছুই জান না।

    অনেক রাত হয়ে গেছে বলে উঠে পড়লো লিলি। একদিন তার নতুন ঘরটায় গিয়ে দেখে আসতে অনুরোধ করলো। মরিয়ম খেয়ে যাওয়ার জন্যে ধরেছিলো। লিলি জানালো, অন্য আরেকদিন এসে খাবে সে, আজ নয়।

     

    কয়েকদিন পরে, সেটা হয় রোববার ছিলো। বারান্দায় বসেছিলো ওরা।

    মরিয়ম একটা বই পড়ছিলো আর মনসুর সেদিন ডাকে-আসা কয়েকখানা চিঠি দেখছিলো বসে বসে। চিঠিগুলো পড়া শেষ হলে সে বললো, আচ্ছা মরিয়ম–। মরিয়ম চোখ তুলে তাকালো।

    জাহেদের ব্যাপারে তুমি আমাকে আগে বল নি কেন?

    তুমি জিজ্ঞেস করো নি বলে। আবার বই-এর মধ্যে মুখ নামালো মরিয়ম।

    আবার মনসুরের গলা– লুকোও নি তো?

    মরিয়ম চমকে উঠলো। বইটা বন্ধ করে রেখে সোজা ওর চোখের ওপর দৃষ্টি ফেললো সে। তারপর মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি হয়েছে বলতো?

    না, কিছু না। চিঠিগুলো হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো মনসুর। একটা তীব্র দৃষ্টি হেনে গেলো যাবার সময়। দুহাতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেললো মরিয়ম।

    বিয়ের তিনটি মাসের শেষ মাসটি এমনি করে কেটেছে তার। ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে মরিয়ম ভাবছিলো দিনগুলো কেমন করে এত তাড়াতাড়ি কেটে গেলো।

    আয়ার ডাকে চমক ভাঙলো তার। আপনার ভাই এসেছে গো, দেখুন। মরিয়ম তাকিয়ে দেখলো, দোরগোড়ায় খোকন দাঁড়িয়ে।

    ছুটে এসে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো সে। চিবুক ধরে আদর করলো তাকে–কিরে খোকন, স্কুলে যাসনি আজ?

    খোকন বললো, না। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।

    মরিয়ম বললো, মা কেমন আছেরে?

    প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে মরিয়মের হাতে দিলো খোকন। বললো, মা দিয়েছে এটা।

    মরিয়ম খুলে দেখলো হাসিনার হাতের লেখা। দশটা টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে মা।

    বড় দরকার।

    চিঠিটা পড়ে ব্লাউজের মধ্যে রেখে দিলো সে।

    দুপুরে খেয়ে যাবে তুমি, এখন বসো। তোমার দুলাভাই আসুন, তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেবো।

    বসে বসে খোকন অনেকক্ষণ এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলো মরিয়মকে। দুলু কি তার কথা বলে? হাসিনা কেমন আছে? আর ভাইয়া? বাবার শরীর ভালতো? তসলিম কি এখনো হাসিনাকে ছবি তোলা শেখায়? কাল রাতে কি রান্না হয়েছিলো ওদের? সকালে কি নাস্তা করেছে সে?

    খোকনকে কাছে পেয়ে বড় ভালো লাগছিলো মরিয়মের।

    দুপুরে মনসুর ফিরে এলে বললো, দশটা টাকা দিতে পারে?

    মনসুর ক্র কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কেন বলতো?

    মরিয়ম কোন জবাব দেবার আগেই খোকনের দিকে চোখ পড়লো তার। ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে সে আবার বললো, তোমার বাপের বাড়ি থেকে টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে বুঝি?

    ওর কথা বলার ধরন দেখে ক্ষুণ্ণ হলো মরিয়ম। ইতস্তত করে বললো, ধার চেয়েছেন, মাস এলে শোধ করে দেবেন।

    ওসব ন্যাকামো করো কেন বলতো, মনসুরের কণ্ঠে উন্মা। এ তিন মাসে কম টাকা নেয় নি ওরা, এক পয়সা শোধ দিয়েছে? বলতে বলতে পকেট থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে একখানা দশ টাকার নোট বের করলো সে। তারপর নোটখানা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার বললো, দশ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে বললেই তো হয়–নাও। তার কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। নোটখানা হাত থেকে উড়ে মাটিতে পড়ে গেলো। মরিয়ম পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর উপুড় হয়ে ওটা তুলে নিলো হাতে।

    খোকনকে বিদায় দেবার সময, কাছে টেনে আদর করলো মরিয়ম। তারপর কানে কানে বলে দিলো মাকে কিছু বলো না কেমন? আবার এলে টফি দেবো তোমায়।

    খোকন মাথা নেড়ে সায় দিলো।

    এতক্ষণ কিছু বলার জন্যে উসখুস করছিলো মনসুর ও চলে যেতে বললো তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, উত্তর দেবে? ঈষৎ লাল চোখজোড়া মেলে তাকালো সে।

    ছড়ানো চুলগুলো খোঁপায় বন্ধ করতে করতে মরিয়ম বললো, বলো।

    মনসুর চিন্তা করছিলো বলবে কিনা। অবশেষে বললো, তুমি কি আমায় সত্যি ভালবেসেছিলে না আমার টাকার প্রতিই আকর্ষণ ছিলো তোমার?

    চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো মরিয়ম। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। আমরা গরীব বলে আজ এত বড় কথা বলতে পারলে তুমি। এত অবিশ্বাস যদি মনে ছিলো তবে বিয়ে করলে কেন?

    তখন কি আমি জানতাম যে তোমার ওই দেহটা তুমি আরেকজন পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছিলে? তিক্ত গলায় ফেটে পড়লো মনসুর–সে লোকটা সারা দেহে চুমো দিয়েছে তোমার, রাক্ষসের মত ভোগ করেছে, আর তুমি দু-হাতে তাকে আলিঙ্গন করেছো, গভীর তৃপ্তিতে তার বুকে মুখ গুঁজেছ, ভাবতে ঘিন্না লাগে, বমি আসে আমার, একটুকাল দম নিয়ে সে আবার বললো, আমি তোমাকে কুমারী বলে জানতাম আর আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে তুমি ঠকিয়েছ।

    উহ আর না; আর বলো না, দোহাই তোমার এবার থামো। আর সহ্য হচ্ছে না আমার। সারা দেহটা কান্নায় দুলছিলো মরিয়মের। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে দুহাতে মুখখানা ঢেকে রাখলে সে। খোপাবদ্ধ চুলগুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়লো কালো হয়ে। মনুসর তখনো হাঁপাচ্ছে।

     

    আজ দুপুরে আমেনারা চলে যাবে। অনেক করে বলে গেছে শাহাদাত–কাল সময় করে একবার এসো, এইতো শেষ দিন তোমাদের শহরে। এসো কিন্তু।

    প্রেসটা বিক্রি করে দিয়েছে ওরা। ভৈরবে একটা ষ্টেশনারী দোকান কিনেছে। প্রেসের মালিক অবশেষে স্টেশনারী দোকানের মালিক হতে চললো।

    কাউন্টারে বসে-বসে জিনিসপত্র বিক্রি করবে শাহাদাত। তবু কারো চাকরি সে করবে না। আমেনা চায় না তার স্বামী কারো গোলামী করুক।

    শুনে মাহমুদ বলেছিলো, দোকান দিয়েছো ভালো কথা। কিন্তু ভৈরবে কেন? ঢাকায় কিনতে পারলে না?

    পেলে নিশ্চয় কিনতাম। জবাবে বলেছে শাহাদাত–ওখানে সস্তায় পাওয়া গেলো তাই।

    কথাটা যে সত্য নয় সেটা বুঝতে বিলম্ব হয় নি মাহমুদের, ভৈরবে দোকান কেনার পেছনেও রয়েছে আমেনার অদৃশ্য ইংগিত। সে চায় না তাদের এই ক্ষয়ে ক্ষয়ে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা সকলে দেখুক, উপভোগ করুক, বিশেষ করে তার ভাইয়েরা আর তাদের পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরা। ওদের চোখের কাছ থেকে নিজের দীনতাটুকু আড়াল করে রাখতে চায় আমেনা। ভৈরবে পরিচিত কেউ নেই। সেখানকার সকলে নতুন পরিচয়ে জানবে তাকে, জানবে দোকানীর বউ বলে। এককালে সে প্রেস মালিকের বউ ছিলো আর তার ভাইয়েরা এখনো ঢাকার রাস্তায় মোটর হাকিয়ে বেড়ায়–এ খোঁজ কাউকে দেবে না আমেনা।

    মাহমুদ এসে দেখলো জিনিসপত্রগুলো সব ইতিমধ্যে বেঁধে-ছেঁদে নিয়েছে ওরা। একটা পুরানো ট্রাঙ্ক, দুটো সুটকেস, একটা চামড়ার, আরেকটা টিনের। তিনটে বস্তার মধ্যে টুকিটাকি মাল। কাঠের আসবাবপত্রগুলো পাড়ার একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে শাহাদাত। ওগুলো সঙ্গে নেয়া যাবে না। পথে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। ভৈরব গিয়ে, মিস্ত্রি দিয়ে নতুন করে আবার বানিয়ে নিতে হবে সব।

    শাহাদাত বসে বসে একটা বস্তার মুখ সেলাই করছিলো।

    আমেনা আঙ্গিনায় ছেলেমেয়েদের গোসল করাচ্ছে।

    মাহমুদ বললো, আমার আসতে দেরি হয়ে গেলো, তোমরা তৈরি হয়ে আছো দেখছি।

    শাহাদাত মুখ তুলে মৃদু হাসলো। হেসে বললো, বসো। একটু পরে ঠেলাগাড়িওয়ালা আসবে। ট্রেনেরও বোধ হয় সময় হয়ে এলো।

    মাহমুদ বসলো।

    গত সাত বছর ধরে এখানে আছে ওরা, এই বাসাতে।

    আজ ছেড়ে চলে যাবে।

    তারপর এ পথে হয়তো আর আসবে না মাহমুদ। এলে ওদের বাসাটার দিকে চোখ পড়লে নিশ্চয় ভীষণ খারাপ লাগবে ওর।

    মিছামিছি তুমি দোকান দিচ্ছ শাহাদাত। মাহমুদ এক সময়ে বললো, একদিন সেটাও বিক্রি করে দিতে হবে।

    কেন, কেন? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো শাহাদাত।

    মাহমুদ বললো, সেখানেও সবাইকে ধারে জিনিসপত্র দিতে শুরু করবে তুমি। তারপর যখন কেউ আর ধার শোধ করতে চাইবে না, তখন দেখবে দোকান শূন্য। মাল নাই।

    উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো শাহাদাত।

    আমেনা এলো ভেতরে।

    মাহমুদ বললো, ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন তুমি এনেছো আমেনা, আর এই বিশ্রী স্বভাবটা বদলাতে পারলে না।

    কি, কোন স্বভাবের কথা বলছো? আমেনার দুচোখে কৌতুক।

    মাহমুদ বললো, লোককে ও বিশ্বাস করে। বড় বেশি ধার দেয়।

    আমেনা কোন উত্তর দেবার আগে শব্দ করে হেসে উঠলো শাহাদাত। বস্তার মুখটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কার কাছে অভিযোগ করছে মাহমুদ। এ স্বভাবটা আমার ওর কাছে পাওয়া।

    আমেনা ততক্ষণে আবার বাইরে বেরিয়ে গেছে।

    মাহমুদ ধীরে ধীরে বললো, স্বভাবটা যারই হোক, নিশ্চয় এটা খুব ভালো স্বভাব নয়। দুনিয়াটা হলো কতগুলো স্বার্থপরের আড্ডাখানা। অন্যকে দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে পার তুমি কিন্তু প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে একটা কানাকড়িও পাবে না।

    ম্লান হাসলো শাহাদাত। তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, তোমার উক্তির সত্যতা নিয়ে আমি তর্ক করতে চাইনে মাহমুদ। দুনিয়াটা কতকগুলো স্বার্থপরের আড্ডাখানা একথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে আমি রাজী নই। আজ এই বিদায়ের মুহূর্তে আর পাঁচটা কাজ ফেলে তুমি যে এখানে এসেছে, এর পেছনে কোন স্বাৰ্থ আছে বলতে চাও? নেই, জানি। জানি বলেই তো এখনো বেঁচে আছি। নইলে–বলতে গিয়ে থেমে গেলো শাহাদাত। গলাটা ধরে এসেছে ওর। চোখের কোণে দুফোটা জল মুক্তোর মত চিকচিক করছে।

    বিব্রত মাহমুদ, বড় ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো।

    স্টেশনে এসে ট্রেন ছাড়বার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মাহমুদের হাত ধরে শাহাদাত বললো, চিঠিপত্র লিখো মাহমুদ, আর যদি পারো একবার গিয়ে বেড়িয়ে এসো।

    মাহমুদ কিছু বলতে পারলো না। মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু। জানালার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে আমেনা | পাশে তার ছেলেমেয়েরা। পান খেয়ে ঠোঁট জোড়া লাল করেছে সে। কালো ছোট্ট একটা টিপ। গাড়ির আঁচলখানা খোঁপা পর্যন্ত তোলা। আজ হঠাৎ সুন্দর করে সেজেছে আমেনা।

    সামনে এগিয়ে গিয়ে মাহমুদ বললো, আবার দেখা হবে আমেনা।

    আমেনা লাল ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে বললো, একবার বেড়াতে এসো কিন্তু, নেমন্তন্ন রইলো।

    মাহমুদ আস্তে করে বললো, আসবো।

    একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দিলো। ওদের মুখগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো চোখের আড়ালে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগল্প সমগ্র – জহির রায়হান
    Next Article তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    Related Articles

    জহির রায়হান

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }