Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বরফ গলা নদী – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প156 Mins Read0

    ২.৭ খবরটা পেয়েছিলো মাহমুদ

    খবরটা পেয়েছিলো মাহমুদ

    একটা কনট্রাক্টরের সঙ্গে কাজে লেগে গেছে রফিক।

    সকাল থেকে সন্ধ্যা মজুরদের সঙ্গে বসে বসে ওদের কাজ তদারক করা। কতদূর কাজ হলো দেখা। হিসেব নেয়া। আর কেউ কাজ না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তাকে ধমকিয়ে কাজ আদায় করা।

    খোদাবক্স বলেছিলো, ওর ইচ্ছে ছিলো—লেখাপড়া-জানা মানুষ, লেখাপড়ার চাকরি করবে। তা বেকার বসে থাকার চেয়ে এটাও মন্দ কিসের, কি বলেন মাহমুদ সাহেব?

    মাহমুদ সায় দিয়ে বললো, হ্যাঁ, অফিসের কেরানীগিরি করার চেয়ে এ চাকরি ঢের ভালো।

    তারপর থেকে বেশ ক-দিন আর রফিকের দেখা পাওয়া যায় নি। সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে ও। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে এখন। আজ বিশ্রামাগারে আসার পথে ওর কথা ভাবছিলো মাহমুদ। হয়তো ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। দেখা হলে বিয়ের কতদূর কি করলো জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু বিশ্রামাগার পর্যন্ত আসতে হলো না। পথেই দেখা হয়ে গেলো, গায়ে আধ ময়লা একটা জামা, পরনে এর চেয়েও ময়লা একটা পায়জামা ! পায়ে টায়ারের স্যান্ডেল। কাজ শেষে ফিরছে সে।

    দেখা হতে একগাল হেসে বললো, মনে মনে তোমার কথাই ভাবছিলাম মাহমুদ।

    আমার কথা তুমি ইদানীং বড় বেশি ভাবছো। মাহমুদ জবাব দিলো পরক্ষণে।

    পথ চলতে চলতে রফিক আবার বললো, তুমি ইচ্ছে করলে আমার একটা ভালো চাকরি নিয়ে দিতে পারতে মাহমুদ। যাকগে, চাকরি একটা জুটিয়েছি। মন্দ না, ভালোই।

    টেলিগ্রামের তারে বসে একটা কাক কা-কা শব্দে ডাকছে একটানা। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাহমুদ বললো, তুমি চাকরি চেয়েছিলে, একটা পেয়েছো আবার কি?

    রফিক বললো, এবার ওকে বিয়ে করে ঘর বাঁধবো আমি। তোমরা দেখো, আমি খুব সুখী হবো। বলতে গিয়ে মুখখানা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, তুমি বিয়ে করছে না কেন মাহমুদ?

    চলার পথে হোঁচট খেলো মাহমুদ, হঠাৎ আমার সম্পর্কটি ভাবতে শুরু করছো কেন? নিজের কথা ভাবো।

    রফিক চুপসে গেলো।

    খানিকক্ষণ নীরবে পথ হাঁটলো ওরা।

    নীরবতা ভেঙ্গে রফিক সহসা বললো, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিলো আমার।

    বলো। এবার তুমি আমায় হতাশ করবে না, কথা দাও।

    অমন কথা আমি দেই নে। মাহমুদের গলা বিরক্তিতে ভরা।

    রফিক বললো, তাহলে আর কি লাভ।

    মাহমুদ বললো, না বলাই ভালো।

    কিন্তু না বলে থাকতে পারলো না রফিক। না বলার অনেক চেষ্টা করলেও অবশেষে বলতে হলো—শোনো মাহমুদ, মেয়েদের স্কুলের লিলি মাস্টারনির সঙ্গে শুনেছি তোমার নাকি বেশ আলাপ আছে।

    কার কাছ থেকে শুনেছো? ওর কথাটা শেষ হবার আগেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো মাহমুদ।

    রফিক ইতস্তত করে বললো, কেন সবাই জানে। খোদাবক্স বলেছিলো সেদিন বিকেলে মেয়েটা নাকি স্কুল থেকে বেরিয়ে ওখানে খোঁজ করছিলো তোমায়।

    বাজে কথা, একেবারে মিথ্যে কথা। মাহমুদ উত্তেজিত গলায় বললো, খোদাবক্স বানিয়ে বলেছে তোমাদের।

    তা না হয় বলেছে। কপালের ঘাম মুছে নিয়ে রফিক আবার বললো, কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে যে তোমার আলাপ আছে, তা কি সত্যি নয়?

    মাহমুদ বললো, হ্যাঁ, সত্যি, কিন্তু তোমার সেটা নিয়ে এতো মাথা ঘামানো কেন?

    আছে বন্ধু, আছে, নইলে কি আর মিছিমিছি মাথা ঘামাচ্ছি? রফিক হেসে দিয়ে বললো। ভাই এবার আমার কথাটা রাখ, ভালই হবে তোমার। আজ ক’দিন ধরে ওর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। আগে দাইগুলোর হাতে হাতে চিঠি পাঠাতাম। এই দাইগুলো, বুঝলে, এক নম্বরের বজ্জাত। একটা চিঠির জন্যে দুটো করে টাকা নিতো। সেও ভালো ছিলো, এখন নেয়াই বন্ধ করে দিয়েছে, বলে ‘ডর লাগতী, নোকরি চলি যায়গী।‘

    মাহমুদ বাধা দিয়ে বললো, ওসব শুনে কি হবে আমার। আমার কিছু করার থাকলে তাই বলো।

    তাইতো বলছি মাহমুদ। তুমি বন্ধু, বন্ধুর দুঃখ বুঝবে। সলজ্জ সঙ্কোচের সঙ্গে বললো, তোমার সেই লিলি মাস্টারনির হাতে যদি আমাদের চিঠিগুলো—কথাটা শেষ করতে পারলো না রফিক। মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো সে। কে যেন আলকাতরা লেপে দিয়েছে ওর চোখেমুখে। একটু পরে মৃদু গলায় সে বললো, ওইসব ইয়ার্কি আমার ভালো লাগে না, বুঝলে?

    রফিক কাতর গলায় বললো, তোমার কি আমার জন্যে অতটুকু অনুভূতি নেই মাহমুদ?

    মাহমুদ জবাব দিলো, না।

    রফিক বললো, এই বুঝি তোমার বন্ধুত্ব?

    মাহমুদ বললো, হ্যাঁ। ততক্ষণে ওরা বিশ্রামাগারের চৌকাঠে এসে পা রেখেছে।

     

    আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামবার আগে, শঙ্করটোলা লেনে লিলির নতুন বাসাটা খুঁজে বের করলো মরিয়ম। ওকে বাসায় পাওয়া যাবে কিনা ভাবছিলো সে। এসে দেখলো সবে বাইরে থেকে ফিরেছে লিলি। মুখ-হাত ধুয়ে, স্টোভে আগুন জ্বালাচ্ছে। ওকে দেখে, কেতলিতে আরেক কাপ আন্দাজ পানি ঢেলে স্টোভের ওপর চড়িয়ে দিলো লিলি।

    বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে।

    লিলি বললো, ঠিক সময়ে এসে পৌঁছে গেলে তুমি, নইলে ভিজতে হতো। মরিয়ম বললো, আরো আগে এসে পৌঁছতাম, তোমার ঠিকানাটা খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে গেছে।

    তাকের উপর থেকে চায়ের কৌটোটা নামিয়ে নিয়ে লিলি বললো, এই একটু আগে তোমার কথা ভাবছিলাম আমি। ভাবছিলাম কাল সকালে তোমার ওখানে যাবো। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে লিলি আবার বললো, আজ দুপুরে দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো রাস্তায়।

    তাই নাকি? অন্যমনস্ক গলায় বললো মরিয়ম।

    লিলি বললো, হ্যাঁ। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জ্বলন্ত স্টোভটার দিকে তাকিয়ে রইলো মরিয়ম। কেটলির ঢাকনাটা তুলে এক মুঠো চায়ের পাতা ঢেলে দিয়ে লিলি আবার বললো, তোমার কি খবর?

    সহসা কোন জবাব দিলো না মরিয়ম ৷

    লিলি উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে একখানা হাত রাখলো ওর কাঁধের ওপর–ও কি এখনো আগের মত ব্যবহার করছে?

    তবু কিছু বললো না মরিয়ম। ডাগর চোখজোড়া ধীরেধীরে জলে ভরে এলো তার। কান্না চেপে মৃদু গলায় বললো, আগের মত হলে ভালোই ছিলো লিলি। আজকাল সে কি আর মানুষ আছে, অমানুষ হয়ে গেছে। বলতে গিয়ে চোখ উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার।

    ওকি, কাঁদছো কেন? হাত ধরে বিছানায় এনে ওকে বসালো লিলি। কেঁদে কি হবে।

    জানি কেঁদে কিছু হবে না। মরিয়ম ধীরে ধীরে বললো, জীবনটা আমার এমন হলো কেন লিলি? এমনটি হোক, তাতো আমি চাই নি কোনদিন।

    নিজহাতে তুমি নিজের সুখ নষ্ট করেছো ম্যারি। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো লিলি।

    মরিয়ম নীরবে মাটির দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, গত দুদিন সে বাসায় আসে নি। ওর কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি আর হতাশা ৷

    লিলি ওর মুখের দিকে চেয়ে শুধালো, একেবারেই আসে নি?

    মরিয়ম সংক্ষেপে বললো না। স্টোভের ওপর থেকে কেটলি নামিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দিলো লিলি। তারপর তাকের ওপর থেকে দুটো চায়ের পেয়ালা আর চিনির কৌটোটা মেঝেতে নাবিয়ে রাখলো সে।

    মরিয়ম বললো, আমি চা খাবো না লিলি।

    লিলি অবাক হয়ে শুধালো, কেন?

    খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো মরিয়ম। তারপর মান গলায় বললো, আজ দু-দিন সে বাসায় আসে নি। তুমি কি ভাবছো এ দু-দিন কিছু মুখে দিতে পেরেছি আমি? বলতে গিয়ে কান্নায় গলাটা ভেঙ্গে এলো তার।

    লিলি কী বলে ওকে সান্তুনা দেবে ভেবে পেলো না। পাশে এসে বসে বিব্রত গলায় বললো, ওর জন্যে নিজেকে এমন করে কষ্ট দিচ্ছো কেন ম্যারি?

    মরিয়ম কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে লিলির কোলে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদলো। জড়ানো স্বরে বললো, আমি কি পাপ করেছিলাম বলতে পারো লিলি? বলতে পারো আমার কপালটা এমন হলো কেন?

    কেটলিটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। ওর কারো চা খাওয়া হলো না।

     

    বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরেই, দোরগোড়ায় মনসুরের পায়ের শব্দে চমকে উঠলো মরিয়ম। আনন্দ ও আতঙ্ক দুটোই এসে এক সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো তাকে।

    ওকে দেখে মনসুর বিস্ময়ের ভান করলো, তুমি এখনো আছো? অদ্ভুত ভাবে ভ্রুজোড়া বাঁকালো সে।

    না থাকলেই কি তুমি খুশি হতে? গলাটা কাঁপছিলো মরিয়মের। ঘরের মাঝখানে টিপয়টার চারপাশে সাজানো সোফার উপর বসে অকম্পিত স্বরে মনসুর জবাব দিলো, এ সহজ কথাটা কি আর বোঝ না তুমি?

    ওর প্রতিটি কথা তীরের ফলার মত এসে বিঁধলো তার বুকে। ওর মুখের উপর থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মরিয়ম। যে মুখে অত বড় কথা উচ্চারণ করেছে মনসুর, সে মুখের দিকে একটিবারও আর ফিরে তাকাবে না সে।

    তবু তাকাতে হলো।

    তবু ওর পাশে এসে দাঁড়ালো মরিয়ম। হাঁটু গেড়ে বসে আশ্চর্য কোমল গলায় শুধালো আমি চলে গেলে সত্যি খুশি হবে তুমি? মনসুর উঠে দাঁড়িয়ে অন্য সোফায় গিয়ে বসলো। তারপর জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বিকৃত কণ্ঠে বললো, সত্যি তোমার লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই?

    অকস্মাৎ কোন জবাব দিতে পারলো না মরিয়ম। সারা মুখ আরো স্নান হয়ে এলো তার। নীরবে, মেঝেতে বিছানা কাপেটের ওপর হিজিবিজি কাটতে কাটতে অবশেষে আস্তে করে বললো, তাহলে তাই হবে, তুমি যা চাও তাই করবো আমি। ওর কথাগুলো মনসুর শুনতে পেলো কিনা বোঝা গেলো না।

     

    কদিন ধরে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মাঝে মাঝে একটু থামে, হয়তো ঘণ্টাখানেকের জন্যে, তারপর আবার আকাশ কালো করে নেমে আসে ঝপ ঝপ শব্দে।

    একটানা বৃষ্টি হলে ফাটলগুলো চুঁইয়ে ঘরে টপটপ পানি পড়ে। এ ঘরে সে ঘরে হেঁটে সালেহা বিবি দেখছিলেন কোথায় পানি পড়ছে। সেখানে একটি করে মাটির পাত্র বসিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। হাসিনা বললো, বাড়িওয়ালাকে ডেকে ঘরটা মেরামত করে দিতে বলো না কেন?

    সালেহা বিবি বললেন, তোর দুলাভাই বলেছে এ মাসের মধ্যে একটা বাড়ি দেখে নিয়ে যাবে আমাদের। তাই তোর বাবা আর মেরামতের জন্যে গা লাগান নি।

    হাসিনা বললো, কবে যে এ বাড়ি থেকে যাবো, একটু ছাতেও উঠতে পারি নে।

    সালেহা বিবি পানি পড়ার জায়গাগুলো লক্ষ্য করতে করতে বললো, মাহমুদটার জন্যে, নইলে এতদিনে তোর দুলাভাই এখান থেকে নিয়ে যেতো আমাদের।

    হাসিন ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ভাইয়াটা যে কী?

    কথাটা কানে গেলে নিশ্চয় একটা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতো মাহমুদ। এমনিতে কম হৈ চৈ করে নি সে। মাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, দেখো মা, তোমার জামাইকে বড় বেশি কৃপা দেখাতে নিষেধ করো। আমরা গরিব হতে পারি, কৃপার পাত্র নই। এ পাড়ার আরো পাঁচশো পরিবার এমনি ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে থাকে। তোমার জামাই পারবে তাদের সবার জন্য নতুন বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিতে? আমাদের ওপর অত বদান্যতা কেন? মেয়ে বিয়ে দিয়েছ বলে?

    দেখ মাহমুদ, সব কাজে তোর এই বেয়াড়াপনা ভালো লাগে না আমার, বুঝলি? তীব্র গলায় ওকে আক্রমণ করেছে মা–এক পয়সার মুরোদ নেই, মুখে শুধু বড় বড় কথা।

    আরো অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি করেছে ওরা। কিন্তু এ-ধরনের তর্কের সহজে মীমাংসা হয় না। হয়ও নি।

    মাহমুদের ঘরে পানি পড়ছিলো। ওর বইপত্রগুলো আর বিছানাটা এক পাশে টেনে রেখে যেখানে যেখানে পানি পড়ছিলো সেখানে একটা করে মাটির পাত্র বসিয়ে দিলেন সালেহা বিবি। একরাশ সুরকির গুঁড়ো ঝরে পড়লো ওঁর সামনে। সালেহা বিবি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কোথেকে পড়লো। তারপর চিন্তিত মুখে চলে গেলেন সেখান থেকে।

    সারা সকাল বৃষ্টি হলো। সারা দুপুর।

    বিকেলের দিকে মেঘ সরে গিয়ে আকাশে সূর্য উঁকি দিলো। সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তে।

    তসলিম এসেছিলো। তাকে নিয়ে পা টিপে টিপে ছাতে ওঠে হাসিনা। আকাশের ছবি নেবে।

    তসলিমা বললো, তোমার ক্যামেরা কেনার কী হলো?

    হাসিনা বললো, দুলাভাই বলছিলেন বাজারে এখন ভালো ক্যামেরা নেই, এলে কিনে দেবেন উনি।

    কিনে দেবেন না ছাই ছাতে এসে তসলিম বললো, বাজারে কত ক্যামেরা, আমাকে টাকা দিয়ে দাও না, আমি কিনে দেবো।

    হাসিনা বললো, আচ্ছা।

    তসলিম গিয়ে ছাতের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলো। হাসিনা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠলো, ওখানে দাঁড়াবেন না, ভেঙ্গে পড়বে। এ পাশটায় আসুন।

    কার্নিশের পাশে এসে বসলো ওরা। ক্যামেরাটা খুলে, কি আকাশের ছবি নিতে হয় ওকে দেখালো তসলিম। আরো কাছে সরে ওর কাধের ওপর একখানা হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে দেখছিলো হাসিনা। লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখতে পেলো আকাশটা আবার মেঘে ছেয়ে আসছে। বাতাসে বিক্ষিপ্তভাবে ছুটছে তারা।

    ক্যামেরা বন্ধ করে তসলিম বললো, বৃষ্টি আসতে পারে আবার, নিচে চলো।

    কাঁধে রাখা হাতটায় একটা জোরে চাপ দিয়ে হাসিনা বললো, উঁহু, এখন আসবে না।

    তসলিম বললো, বাজি ধরো, ঠিক আসবে।

    আসুক, আমি এখন উঠবো না।

    কেন?

    আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে।

    তসলিম মুখ ফিরিয়ে তাকালো ওর দিকে। হাসিনা ফিক করে হাসলো একটু। তারপর আঁচল দিয়ে ঠোঁটজোড়া ঢেকে সে বসে রইলো চুপ-চাপ। বৃষ্টি এলো না। সন্ধ্যা নেমে এলো।

    রাতের অন্ধকার বাইরের পৃথিবী থেকে আড়াল করে নিয়ে গেলো ওদের। তসলিম বললো, রাত হয়ে গেছে, নিচে চলো।

    উঁহু। কাঁধের ওপর থেকে হাতটা নামিয়ে নিলো হাসিনা। অন্ধকারে একজোড়া কটাকটা চোখের দিকে নীরবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ দু-হাতে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো তসলিম। হাসিনা কোন বাধা দিলো না, শুধু অস্ফুটস্বরে কি যেন বললো, শোনা গেল না।

    হাসিনা-আ। নিচে থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো। একবার। দুবার তিনবার।

    অপূর্ব শিহরনের দুজনে কঁপিছিলো ওরা। বাহুবন্ধন শিথিল হয়ে এলো ধীরে ধীরে। ছুটে ছাদ থেকে নেমে এলো হাসিনা।

    মা, মাগো, ওমা, দৌড়ে এসে সালেহা বিবিকে জড়িয়ে ধরলো সে, মা, আমায় ডেকেছো মা?

    ওকি অমন করছিস কেন?

    জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো হাসিনা। চোখেমুখে আবির ছড়ানো। মাকে ছেড়ে দিয়ে—দুলু বসেছিলো মেঝেতে—তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলো হাসিনা–দুলু, দুলু-উ-উ। তোমার পুতুলগুলো কোথায়? চলো, দুজনে খেলবো আমরা।

    কী খেলবে তুমি, পুতুল, পুতুল?

    না, তোমার পুতুলের সঙ্গে আমার পুতুলের বিয়ে দেবো আজ।

    দুলু খুশি হলো, আপা আজ তার সঙ্গে পুতুল খেলবে।

    কিন্তু খানিকক্ষণ পুতুল নিয়ে বসে আপার আর মন বসলো না। ছুটে সে রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে এলো– মা, আজ কি পাক করছো মা?

    সালেহা বিবি তরকারিতে লবণ ছিঁটিয়ে দিয়ে বললো, নতুন কিছু না, রোজ যা রান্না হয়, তাই।

    মা আমি রাঁধবো, তুমি ঘরে যাও।

    তরকারির কড়াই থেকে চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন সালেহা বিবি। রান্না ঘরের ধার যে ঘেঁষে না তার আজ হঠাৎ পাক করার শখ হলো কেন? থাক, তোমাকে রাধতে হবে না, লেখাপড়া করো গিয়ে যাও।

    মা, আমি তোমার পাশে বসবো মা। মায়ের পাশে এসে বসে পড়লো হাসিনা। খানিকক্ষণ পর আবার উসখুস করে উঠে গেলো সেখান থেকে। নিজের ঘরে এসে টেবিলের ওপর থেকে আয়নাটা তুলে নিয়ে বসলো সে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে নিজেকে দেখলো হাসিনা। হেসে দেখলো। মুখখানা গম্ভীর করে দেখলো। কপট রাগ করে, ঠোঁটজোড়া বাঁকিয়ে কারো সঙ্গে যেন কথা বললো সে।

    হ্যারিকেনের আলোয় বসে বই-এর ওপর চোখ বুলাচ্ছিলো মাহমুদ। ভাইয়া কি করছো? ওর সামনে এসে ঝুঁকে পড়ে কি পড়ছে দেখলো হাসিনা, ভাইয়া, তুমি একটা বিয়ে করো ভাইয়া, আমাদের বুঝি ভাবী দেখতে ইচ্ছে করে না?

    কী ব্যাপার, আমার বউ দেখার জন্যে হঠাৎ তোমার মন কেঁদে উঠলো কেন? বইয়ের পাতার ওপর চোখ রেখে জবাব দিলো মাহমুদ–যাও, নিজের বিয়ের কথা চিন্তা করো গিয়ে।

    হাসিনার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ‘ধ্যাৎ, আমি বিয়ে করবো না’ বলে সেখান থেকে পালিয়ে এলো হাসিনা। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পা জোড়া উপরের দিকে তুলে দোলনার মত দোলাল সে। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে চোখ বুজলো। মিটিমিটি হাসলো। চোখের পাতায় একটি মুখ ভাসছে বারবার আর একটি ছবি। বালিশটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরলো হাসিনা।

    সারারাত একটানা বৃষ্টি হলো।

    সকালেও।

    অপরাহ্নে তখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিলো বাইরে।

    হাসমত আলী অফিসে গেছেন, মাহমুদ তার প্রেসে। বৃষ্টির জন্যে, হাসিনা আর খোকন কেউ স্কুলে যায় নি আজ। সালেহা বিবি ভরে যাওয়া মাটির পাত্রগুলো থেকে পানি ফেলে দিয়ে আবার বসিয়ে দিচ্ছিলেন পুরোনো জায়গায়।

    টপটপ পানি পড়ছে ফাটলগুলো থেকে চুইয়ে। মাঝে মাঝে সুরকির গুড়ো, ইটের কণা।

    দুয়ারে কড়া নাড়ার মৃদু শব্দ হতে, দরজা খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো হাসিনা–মা, মাগো, কে এসেছে দেখে যাও, মা।

    একটা চামড়ার সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো মরিয়ম ৷ জড়িয়ে ধরে তাকে ভিতরে নিয়ে এলো হাসিনা। দুলু ছুটে এসে আঁচল ধরে দাঁড়ালো তার।

    মা ডেকে শুধালো–কে এসেছেরে হাসি?

    হাসিনা জবাব দিলো, আপা এসেছে। সুটকেসটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিলো হাসিনা।

    মরিয়ম দুলুকে কোলে তুলে আদর করলো।

    দাদার ঘরে উঁকি মেরে মাহমুদ আছে কিনা দেখলো মরিয়ম।

    হাসিনা বললো, সেই ভোরে বেরিয়ে গেছে।

    মায়ের খাটের ওপর এসে বসলো মরিয়ম। চারপাশে তাকিয়ে বললো, ইস, ভীষণ পানি পড়ছে তো?

    কিরে, তুই একা এলি, জামাই আসেনি? কুয়োতলা থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বললেন সালেহা বিবি। জামাই এলো না কেন?

    মরিয়ম ম্লান হয়ে বললো, কাজের ভীষণ চাপ।

    খোকন বললো, আমার জন্যে টফি আনিস নি আপা!

    এনেছি। আশেপাশে তাকিয়ে সুটকেসটা খোঁজ করলো মরিয়ম। হাসিনা বললো, ওটা ও-ঘরে রেখে এসেছি, নিয়ে আসি।

    সুটকেস নিয়ে এলে, খুলে দুটো টিন বের করলো মরিয়ম। বিস্কিট আর টফি। বিস্কিটের টিনটা মায়ের হাতে দিয়ে সে বললো, এটা রেখে দাও মা। নাস্তার সময় দিও।

    মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মেয়ের পাশে এসে বসলেন তিনি।

    টফির টিনটা খুলে খোকন আর দুলুকে কয়েকটা টফি দিলো মরিয়ম। হাসিনাকেও দিলো। সালেহা বিবির হাতে একমুঠো টফি গুঁজে দিতে তিনি হেসে বললেন, আমায় কেন?

    মরিয়ম বললো, খাও মা।

    হাসিনা বললো, মাকে মিছিমিছি দিচ্ছিস আপা। মা কি খাবে? এই রাক্ষস দুটোর পেটে যাবে সব। বলে তর্জনী দিয়ে দুলু আর খোকনকে দেখালো হাসিনা।

    খোকন জিভ বের করে ভেংচি কাটলো।

    ওকে অনুসরণ করে দুলুও জিভ বের করলো হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে। হাসিনা দাঁতমুখ খিঁচে বললো, আবার বের কর না, একেবারে কেটে দেবো।

    একটা টফি কাগজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখে দিলেন সালেহা বিবি। বারকয়েক চুষে বললো, বেশ মিষ্টিতো। তুই খাচ্ছিস না কেন, একটা খা-না।

    মরিয়ম সুটকেসের ডালাটা বন্ধ করলো ধীরে ধীরে। মায়ের অনুরোধ কানে গেলো না ওর।

    মুঠোয় ধরে রাখা টফিগুলো আঁচলে বেঁধে রাখলেন সালেহা বিবি। হাসমত আলীকে আজ খাওয়াবেন একটা আর মাহমুদকে।

    এতক্ষণে ইতিউতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভালো করে নজরে পড়ে নি সালেহা বিবির। এবার মেয়ের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, হ্যাঁরে মরিয়ম, তুই অমন শুকিয়ে গেছিস কেন, অসুখ করেছিলো নাকি?

    এই ভয়টাই এতক্ষণ করছিলো মরিযম। মায়ের চোখে কিছু এড়াবে না তা জানতো সে। গত এক মাসে শরীরটা অনেক খারাপ হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারে মরিয়ম। দিনে রাতে অবিচ্ছিন্ন চিন্তার স্রোতে ডুবে থাকলে, আঘাতে আর যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হলে শরীর ভালো থাকার কথা নয়।

    ওকে চুপ থাকতে দেখে মা আবার বললো, কি হয়েছিলো?

    হাসিনা বললো, তাইতো তোকে বড্ড রোগা লাগছে আপা।

    মরিয়ম পরক্ষণে একটা মিথ্যা কথা বললো, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছিলো।

    ওর মুখখানা কোলে নিয়ে মা বললো, বেশ মেয়েতো, অসুখ করেছিলো আমাদের একটু খবর দিতে পারলি না? আমরা কি পর হয়ে গেছি তোর?

    হাসিনা বললো, খবর পাঠালে আমি দেখতে যেতাম।

    চোখ ফেটে কান্না আসছিলো মরিয়মের। একটু কাঁদতে পারলে বোধ হয় শান্তি পেত সে। কিন্তু কেঁদে সকলকে বিব্রত করতে চায় না মরিয়ম। মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে সে বললো, কাপড়টা বদলিয়ে নিই মা।

    সাঁঝরাতে আকাশ ফর্সা হয়ে তারা দেখা দিলো। একটা মেঘও আকাশে নেই এখন।

    সালেহা বিবি বললো, তারা উঠলে কি হবে, এ-সময়ে আকাশকে একটুকুও বিশ্বাস নেই, দেখবে আবার ঝুপঝুপ করে নেবে আসবে একটু পরে।

    হাসমত আলী বললো, বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দুএকদিনের মধ্যে মিস্ত্রী পাঠাবে।

    দু-একদিনের কথা বলেছে তো, দেখবে দশ দিন লাগবে। স্বামীর কথার ওপর মন্তব্য করলেন সালেহা বিবি। বলে মরিয়মের দিকে তাকালেন তিনি। সবার চোখ এ মুহূর্তে তার ওপর গিয়ে পড়েছে। কারণ মনসুর বলেছিলো–একটা ভালো বাসা দেখে ওদের নিয়ে যাবে। স্নানমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো মরিয়ম। বাবা কিংবা মায়ের দিকে তাকাতে ভয় হলো ওর। যদি তারা সে ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করে। তাহলে এখন কোন জবাব দিতে পারবে না সে। মনসুর যে অনেক বদলে গেছে সে খবর তো কারো জানা নেই।

    একটু পরে সেখান থেকে উঠে হাসিনার কামরায় চলে গেলো মরিয়ম। হ্যাঁরে হাসি, তসলিম এসেছিলো না, চলে গেছে?

    কি একটা কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো হাসিনা। ও আসতে কাগজটা লুকিয়ে ফেলে সে বললো, হ্যাঁ, চলে গেছে।

    ওটা কিরে?

    না কিছু না। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বই নিয়ে বসলো হাসিনা। ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করো নি? উনি এসেছেন তো।

    তাই নাকি! আঁচলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আবার বেরিয়ে এলো মরিয়ম।

    বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে, নিঃশব্দে সিগারেট টানছিলো মাহমুদ। ভাইয়া কেমন আছো? মরিয়ম এসে বসলো মেঝের উপর।

    মরিয়ম যে। পা-জোড়া নাবিয়ে নিলো মাহমুদ–বাবার বাড়ি সফর করতে এসেছে বুঝি।

    মরিয়ম মৃদু গলায় বললো, তুমি তো একটা দিনও গেলে না।

    বার কয়েক ঘনঘন সিগারেটে টান দিলো মাহমুদ। তারপর ছাই ফেলে বললো, তুমি জানতে আমি যাবো না, তবু মিছে অভিমান করছো। ভাবছো আমি বড় নির্দয়। সত্যি আমি তাই। কারো জন্যে আমার কোন অনুভূতি নেই। বাবা, মা, ভাই বোন এই যে, কতগুলো শব্দের সৃষ্টি করেছে তোমরা, একটা অর্থহীন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এর কোন মূল্য আছে? অন্তত আমার কাছে নেই। সিগারেটে একটা জোরটান দিয়ে ধোয়া ছাড়লো মাহমুদ। তারপর আবার বললো, আমি তো দুটি সম্পর্ক ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব দেখি না। ওই বড় লোকের বাচ্চাগুলো যারা মুরগির মত টাকার ওপর বসে বসে তা দিচ্ছে আর আমরা গরিবের বাচ্চারা যাদের ওরা ছোটলোক বলে। এই দুটো সত্য ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না আমার। তুমি হয়তো মনে বড় আঘাত পাচ্ছে, কিন্তু কি আর বলবো বলো, ওরা হলো আমাদের মা, বাপ আর আমরা ওদের ছা-পোষা, জীব। থাকগে কেমন আছো বলো–সিগারেটের গোড়াটা ছুড়ে ফেলে দিলো মাহমুদ।

    মরিয়ম আঙুল দিয়ে মেঝেতে দাগ কাটতে কাটতে বললো, ভালো।

    ভালো যে থাকবে তা জানতাম। ছাদের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলে মাহমুদ–তোমার মত কপাল কজন পেয়ে থাকে। বাড়ি-গাড়ি, অর্থ সবই পেয়েছে তুমি। আর আমাদের অবস্থাটা একবার দেখো, সারাদিন খেটে এসে এমন খাদের মধ্যে শুয়ে আছি। টপটপ করে ঘরের মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। এটা নিশ্চয়ই আরামদায়ক নয়, কী বলো? মরিয়মকে কোন কথা না বলতে দেখে মাহমুদ আবার বললো, মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো, পুরুষ হয়ে না জন্মে যদি তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে হয়ে জন্মাতাম তাহলে বেশ হতো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মাহমুদ। মরিয়ম তবু কোন কথা বলছে না দেখে আবার বললো, হ্যাঁ, তোমার সেই বান্ধবীটির কি খবর বলতো?

    মরিয়ম মুখ তুলে তাকালো, কার কথা বলছো?

    মাহমুদ বললো, সেই যে–কি নাম যেন–যাক-গে বাদ দাও তার কথা, ওসব জেনে আমার কোন কাজ নেই। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বিড়ি আছে কিনা খুঁজে দেখলো সে।

    সালেহা বিবি এসে খাবার জন্য ডেকে গেলেন সকলকে। ও-ঘর থেকে হাসিনার গলা শোনা গেলো–আপা খাবি চল।

    মরিয়ম উঠে পড়লো, ভাইয়া খাবে না?

    যাও আসছি–মাহমুদ উঠে বসলো।

    রান্না ঘরটা ভিজে থাকায় শোবার ঘরে খাটের পাশে একটা মাদুর বিছিয়ে খাওয়ার আয়োজন করেছেন সালেহা বিবি। অনেকদিন পরে একসঙ্গে খেতে বসলো ওরা। দুলুকে নিয়ে হাসমত আলী বসলেন সবার ডান দিকটায়। তার পাশে বসলো মাহমুদ। তারপর হাসিনা আর মরিয়ম। একেবারে বা পাশটায় খোকন। সালেহা বিবি বসলেন সবার দিকে মুখ করে মাঝখানটায়। নিজে খাবেন এবং সকলকে পরিবেশন করবেন তিনি। অনেকদিন পর এক সঙ্গে খেতে বসে আনন্দের আভা জেড়ে উঠলো সবার চোখে-মুখে। সালেহা বিবি সবচেয়ে খুশি। ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে বসিয়ে খাওয়ানোর তৃপ্তি ও আনন্দ যে কি পরিমাণ সেটা শুধু মা-ই জানেন। তাদের খাওয়ার মাঝখানে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। বাইরে তাকিয়ে, হাতটা ধুয়ে নিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন সালেহা বিবি।

    হাসিনা বললো, কোথায় যাচ্ছ মা।

    সালেহা বিবি বললেন, আবার বৃষ্টি এলো, মাটির ভাণ্ডগুলো জায়গা মত আছে কিনা দেখে আসি, নইলে সব ভিজে যাবে।

    মরিয়ম বললো, খেয়ে নাও মা, এই তো বৃষ্টি এলো, অত তাড়াতাড়ি ভিজবে না।

    মাহমুদ বললো, ভিজলে ভিজুক, তোমাকে আবার খাওয়ার মাঝখানে উঠতে বললো কে?

    আবার বসে পড়লেন সালেহা বিবি। কিন্তু বসেও স্বস্তি পেলেন না তিনি, বারবার উপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। কোথায় পানি পড়ছে কে জানে। এক মুখ ভাত চিবোতে মাহমুদ বললো, বাবার সেই পুরোনো ছাতাটা আছে তো ঘরে?

    সালেহা বিবি জবাব দিলেন, আছে, কেন?

    আমার প্রেসে যেতে হবে।

    এই বৃষ্টির মধ্যে?

    হ্যাঁ। আজ রাতে অনেকগুলো প্রুফ দেখতে হবে আমায়, সব জমা হয়ে আছে।

    সকলে একবার করে তাকালো মাহমুদের দিকে। তারপর নীরবে খেতে লাগলো।

    অনেকদিন পর নিজের সেই পুরোনো বিছানায় শুয়ে আজ কেমন নতুন নতুন ঠেকছিলো মরিয়মের। হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে চুপচাপ উদাম বৃষ্টির রিমঝিম গান শুনছিলো আর ভাবছিলো মনসুরের কথা। লিলি বলে, সে ভুল করেছে। হয়তো তাই। সব কিছু ওকে খুলে না বললেও হতো। তাহলে মনসুর নিশ্চয় এমন ব্যবহার করতো না তার সাথে। যেমন চলছিলো সব কিছু তেমনি চলতো। হাসি আর আনন্দের অফুরন্ত স্রোতে ভাসতো ওরা দুজনে। কিন্তু সত্যকে ঢেকে রাখার কি অর্থ হতে পারে। মরিয়ম জাহেদকে ভালোবেসেছিলো। হ্যাঁ, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলো। মনসুরকেও সে তেমনি ভালবেসেছে। নিজের সকল সত্তা আর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আপনার করে নিতে চেয়েছে। দুটোই সত্য। মরিয়ম বুঝতে পারে না এ সত্যের সহজ স্বীকৃতিতে ভুল কোথায়। সেকি মিথ্যের মুখোশ পরলে মনসুর সন্তুষ্ট হতো? দুবার কি মানুষ প্রেমে পড়তে পারে না? মনসুর কেন এমন হয়ে গেলো? হাসিভরা জীবনের মাঝখানে অশ্রু কেন এলো? ভাবতে গিয়ে দুচোখ সজল হয়ে এলো মরিয়মের।

    ফাটল বেয়ে টপটপ পানি ঝরে পড়ছে নিচে। সেদিকে চেয়ে চেয়ে এক সময় সে মনে মনে ঠিক করলো ফিরে গিয়ে মনসুরকে তার এই যন্ত্রণার কথা খুলে বলবে মরিয়ম। করজোড়ে তার কাছে পুরোনো দিনগুলো আবার ভিক্ষে চাইবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। জানালা গলিয়ে আসা বাতাসে চুলগুলো উড়ছে ওর। এতক্ষণে মরিয়ম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

    মেঝেতে বিছানো মাদুরটার ওপর বালিশটা বুকের নিচে দিয়ে উপুড় হয়ে পা-জোড়া ছড়িয়ে দিয়েছে হাসিনা দরজার দিকে। সামনে একটা সাদা কাগজ আর কলম। হ্যারিকেনের আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে অদূরে চৌকির ওপরে শোয়া মরিয়মের দিকে তাকিয়ে ধীরেধীরে ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা চিঠি বের করলো হাসিনা। তসলিমের চিঠি। বিকেল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তিন-চারবার চিঠিখানা আগাগোড়া পড়েছে। তবু উত্তর দেবার আগে আরেকবার পড়ে নিলো সে। তারপর অতি যত্নসহকারে গোটা গোটা করে লিখলো হাসিনা—প্রিয় লিখেই কেটে দিলো। কী সম্বোধন করা যেতে পারে? সে লিখেছে ‘হাসি’ সম্বোধন করে। বারকয়েক কাটা ছেড়ার পর হাসিনা লিখলো—

    তসলিম,
    তুমি আমাকে অনেক অনেক ভালবাস, আমাকে ছাড়া বাঁচবে না লিখেছ। আমারও তাই মনে হয়। সেদিন বিকেল থেকে কিছু ভাল লাগছে না আমার। তোমাকে সব সময় দেখতে ইচ্ছে করে। আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ। আর তোমার মত সুন্দর করে গুছিয়ে আমি লিখতে পারি না। বাবা মা কেউ-এ ব্যাপারটা জানে না। সত্যি তোমার জন্য মনটা আমার সব সময় খারাপ হয়ে থাকে। তুমি আমাকে ভালবাস, কিন্তু আমি দেখতে ভীষণ বিশ্রী। তুমি কত সুন্দর!

    এখানে এসে চোখজোড়া ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো হাসিনার। অসমাপ্ত চিঠিটা খাতার মধ্যে লুকিয়ে সেটা বালিশের তলায় রেখে দিলো সে। হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে ঘুমের সমুদ্রে তলিয়ে গেলো হাসিনা। ঠোঁটের কোণে শুধু ছড়িয়ে রইলো এক টুকরো প্রশান্ত হাসি।

    এ-ঘরে বাতি নিভে গেলেও ও-ঘরে আলো জ্বলছিলো। হাসমত আলী আর সালেহা বিবি তখনও জেগে। টিমটিমে হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে গেলেন সালেহা বিবি। নতুন কোথাও পানি পড়ছে কিনা। দরজাটা বন্ধ না খোলা দেখে গেলেন। হাসিনার গায়ের কাপড়টা উঠে গিয়েছিলো, উপুড় হয়ে সেটা নামিয়ে দিলেন তিনি। তারপর নিজের কামরায় ফিরে এসে হ্যারিকেনটা রাখলেন মেঝের উপর। ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে শোবার আয়োজন করতে করতে শুধোলেন হাসমত আলী।

    হ্যাঁ। কুয়োতলার দিকটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাটের ওপর এসে বসলেন সালেহা বিবি।

    বাইরে বৃষ্টি ঝরছে রিমঝিম। একটানা বর্ষণ। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস দেয়ালের গায়ে লেগে করুণ বিলাপে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, পৃথিবীর চোখে অশ্রু ঝরছে, বিষন্ন ব্যথার চাপে?

    বাতিটা নিভিয়ে দাও। শুয়ে পড়লেন হাসমত আলী।

    হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিতে অন্ধকার গ্রাস করে নিলো ঘরটা। কোথায় একটা টিকটিকি ডেকে উঠলো টিকটিক শব্দে। দু-হাতে নিজের জায়গাটা হাতড়ে নিয়ে কাত হলেন সালেহা বিবি। মাঝখানে দুলু আর খোকন।

    দুপাশে-ওঁরা দু-জন, হাসমত আলী আর সালেহা বিবি।

    খানিকক্ষণ পর সালেহা বিবি ডাকলেন, শুনছো?

    উঁ। সারা দিলেন হাসমত আলী।

    ঘুমুচ্ছো নাকি?

    না।

    কাল মরিয়মকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবো?

    কোনটা?

    মনসুর যে বলেছিলো একটা নতুন বাসায় নিয়ে যাবে আমাদের।

    মাহমুদের সঙ্গে আলোচনা করো।

    বাইরে বৃষ্টির উদাম নৃত্য চলছে। ভেতরে টপটপ বৃষ্টি পড়ছে ফাটলগুলো বেয়ে। মাঝে মাঝে ভেজা সুরকির গুড়ো।

    শুনছো? আবার সালেহা বিবির গলা।

    কী?

    এ বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না। আমার ভীষণ ভয় করে।

    হাসমত আলীর কাছ থেকে এবার কোন উত্তর পেলেন না সালেহা বিবি। মৃদু নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে তার। একটু পরে তিনিও তন্দ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।

    এখন সকলে গভীর ঘুমে অচেতন।

    তখনো বৃষ্টি থামে নি। ইলশেগুঁড়ির মত ঝরছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগল্প সমগ্র – জহির রায়হান
    Next Article তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    Related Articles

    জহির রায়হান

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }