Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প197 Mins Read0

    বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০১

    বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ১

    উৎসর্গ

    সুর-সুন্দর শ্রীনলিনীকান্ত সরকার
    করকমলেষু
    বন্ধু আমার! পরমাত্মীয়! দুঃখ-সুখের সাথি!
    তোমার মাঝারে প্রভাত লভিল আমার তিমির রাতি।
    চাওয়ার অধিক পেয়েছি – বন্ধু আত্মীয় প্রিয়জন,
    বন্ধু পেয়েছি – পাইনি মানুষ, পাইনি দরাজ মন।
    চারিদিক হতে বর্ষেছে শিরে অবিশ্বাসের গ্লানি,
    হারায়েছি পথ – আঁধারে আসিয়া ধরিয়াছ তুমি পাণি।
    চোখের জলের হয়েছ দোসর, নিয়েছ হাসির ভাগ,
    আমার ধরায় রচেছে স্বর্গ তব রাঙা অনুরাগ।
    হাসির গঙ্গা বয়েছে তোমার অশ্রু-তুষার গলি,
    ফুলে ও ফসলে শ্যামল করেছে ব্যথার পাহাড়তলি!
    আপনারে ছাড়া হাসায়েছ সবে হে কবি, হে সুন্দর;
    হাসির ফেনায় শুনিয়াছি তব অশ্রুর মরমর!
    তোমার হাসির কাশ-কুসুমের পার্শ্বে বহে যে ধারা,
    অশ্রুর অঞ্জলি দিনু, লহো এ ‘বাঁধন-হারা’।
    নজরুল
    কলিকাতা
    ২৪ শ্রাবণ ১৩৩৪।

    [ক]
    করাচি সেনানিবাস,
    ২০এ জানুয়ারি (সন্ধ্যা)
    ভাই রবু!
    আমি নাকি মনের কথা খুলে বলিনে বলে তুমি খুব অভিমান করেছ? আর তাই এতদিন চিঠি-পত্তর লেখনি? মনে থাকে যেন, আমি এই সুদূর সিন্ধুদেশে আরব-সিন্ধুর তীরে পড়ে থাকলেও আমার কোনো কথা জানতে বাকি থাকে না! সমঝে চোলো, তারহীন বার্তাবহ আমার হাতে!
    আমি মনে করেছিলাম, – সংসারী লোক, কাজের ঠেলায় বেচারির চিঠি-পত্তর দেবার অবসর জোটেনি এবং কাজেই আর উচ্চ-বাচ্য করবার আবশ্যক মনে করিনি ; কিন্তু এর মধ্যে তলে-তলে যে এই কাণ্ড বেধে বসে আছে, তা এ বান্দার ফেরেশ্‌তাকেও খবর ছিল না! – শ্রাদ্ধ এত দূর গড়াবে জানলে আমি যে উঠোন পর্যন্ত নিকিয়ে রাখতাম!
    আমি পল্টনের ‘গোঁয়ার গোবিন্দ’ লোক কিনা, তাই অত-শত আর বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন দেখছি তুমিও ডুবে ডুবে জল খেতে আরম্ভ করেছ! আমার আজ কেবলই গাইতে ইচ্ছে করছে সেই গানটা, যেটা তুমি কেবলই ভাবি-সাহেবাকে (ওরফে ভবদীয় অর্ধাঙ্গিনীকে) শুনিয়ে শুনিয়ে গাইতে –

    মান করে থাকা আজ কি সাজে?
    মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
    চলো চলো কুঞ্জ মাঝে।

    হাঁ, – ভাবিসাহেবাও আমায় আজ এই পনেরো দিন ধরে একেবারেই চিঠি দেননি। স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী কিনা!
    তোমার একখানা ছোট্ট চিঠি সেই এক মাস পূর্বে – হাঁ, তা প্রায় একমাস হবে বই কি! – পেয়ে তার পরের দিনই ‘প্যারেডে’ যাওয়ার আগে এলোমেলো ভাবের কী কতকগুলো ছাই-ভস্ম যে লিখে পাঠিয়েছিলাম, তা আমার এখন মনে নেই। সেদিন মেজাজটা বড়ো খাট্টা ছিল, কারণ সবেমাত্র ‘ডিউটি’ হতে ‘রিলিভ’ হয়ে মুক্তি পেয়ে এসেছিলাম কিনা! তারপরেই আবার কয়েকজন পলাতক সৈনিককে ধরে আনতে ‘ডেরাগাজি খাঁ’ বলে একটা জায়গায় যেতে হয়েছিল। এসব হ-য-ব-র-ল-র মাঝে কি আর চিঠি লেখা হয় ভাই? তুমিও বা আর কীসে কম? এই একটা ছোট্ট ছুতো ধরে মৌনব্রত অবলম্বন করলে! এ মন্দ নয় দেখছি।
    তুমি যে মনুকে লিখে জানিয়েছ যে, আমি ‘মিলিটারি লাইনে’ এসে গোরাদেরই মতো কাঠখোট্টা হয়ে গেছি তাও আজ আমার জানতে বাকি নেই। আগেই বলেছি, তারহীন বার্তাবহ হে, ওসব তারহীন বার্তাবহের সন্দেশ!
    যখন আমায় কাঠখোট্টা বলেই সাব্যস্ত করেছ, তখন আমার হৃদয় যে নিতান্তই সজনে কাঠের ঠ্যাঙার মতো শক্ত বা ভাঙা বাঁশের চোঙার মতো খনখনে নয়, তা রীতিমতোভাবে প্রমাণ করতে হবে। বিলক্ষণ দূর না হলে আমি অবিশ্যি এতক্ষণ ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে আস্তিন গুটিয়ে দাঁড়াতাম; কিন্তু এত দূর থেকে তোমায় পাকড়াও করে একটা ‘ধোবি আছাড়’ দিবার যখন কোনোই সম্ভাবনা নেই, তখন মসিযুদ্ধই সমীচীন। অতএব আমি দশ হাত বুক ফুলিয়ে অসিমুক্ত মসিলিপ্ত হস্তে সদর্পে তোমায় যুদ্ধে আহ্বান করছি – ‘যুদ্ধং দেহি!’
    তোমার কথামতো আমি কাঠখোট্টা হয়ে যেতে পারি, কিন্তু এটা তো জান ভায়া যে, খোট্টাকাঠের উপরও চোট পড়লে সেটা এমন আর্তনাদপূর্ণ খং শব্দ করে ওঠে, যেন ঠিক বুকের শুকনো হাড়ে কেউ একটা হাতুড়ির ঘা কশিয়ে দিলে আর কী। তোমার মতো ‘নবনীতকোমল মাংসপিণ্ডসমষ্টি’র পক্ষে সেটার অনুভব একেবারে অসম্ভব না হলেও অনেকটা অসম্ভব বই কি!
    তা ছাড়া যেটা জানবার জন্যে তোমার এত জেদ, এত অভিমান, তার তো অনেক কথাই জান। তার উপরেও আমার অন্তরের গভীরতর প্রদেশের অন্তরতম কথাটি জানতে চাও, পাকে-প্রকারে সেইটেই তুমি কেবলই জানাচ্ছ। – আচ্ছা ভাই রবু, আমি এখানে একটা কথা বলি, রেগো না যেন!
    তোমার অভিমানের খাতির বেশি, না, আমার বুকের পাঁজর দিয়ে-ঘেরা হৃদয়ের গভীরতম তলে নিহিত এক পবিত্র স্মৃতিকণার বাহিরে প্রকাশ করে ফেলার অবমাননার ভয় বেশি, তা আমি এখনও ঠিক করে বুঝে উঠতে পারিনি। তুমিই আমায় জানিয়ে দাও ভাই, কী করা উচিত!
    আচ্ছা ভাই, যে শুক্তি আর কিচ্ছু চায় না, কেবল ছোট্ট একটি মুক্তা হৃদয়ের গোপন কোণে লুকিয়ে থুয়ে অতল সমুদ্রের তলে নিজকে তলিয়ে দিতে চায়, তাকে তুলে এনে তার বক্ষ চিরে সেই গোপন মুক্তাটা দেখবার এ কী মূঢ় অন্ধ আকাঙ্ক্ষা তোমাদের! এ কী নির্দয় কৌতূহল তোমাদের!
    যাক, শিগ্‌গির উত্তর দিয়ো। ভাবিসাহেবাকে চিঠি দিতে হুকুম কোরো, নতুবা ভাবিসাহেবাকে লিখব তোমায় চিঠি দিতে হুকুম করবার জন্যে।
    খুকির কথা ফুটেছে কি? তাকে দেখবার বড়ো সাধ হয়। … সোফিয়ার বিয়ে সম্বন্ধে এখনও এমন উদাসীন থাকা কি উচিত? তুমি যেমন ভোলানাথ, মা-ও তথৈবচ! আমার এমন রাগ হয়!
    আমার জন্যে চিন্তা কোরো নো। আমি দিব্যি কিষ্কিন্ধ্যার লবাবের মতো আরামে আছি। আজকাল খুব বেশি প্যারেড করতে হচ্ছে। দু-দিন পরেই আহুতি দিতে হবে কিনা! আমি পুনা থেকে বেয়নেট যুদ্ধ পাশ করে এসেছি। এখন যদি তোমায় আমার এই শক্ত শক্ত মাংসপেশীগুলো দেখাতে পারতাম!
    দেখেছ, সামরিক বিভাগের কী সুন্দর চটক কাজ? এখানে কথায় কথায় প্রত্যেক কাজে হাবিলদারজিরা হাঁক পাড়ছেন, ‘বিজলি কা মাফিক চটক হও। – শাবাশ জোয়ান!’
    এখন আসি। ‘রোল-কলের’ অর্থাৎ কিনা হাজিরা দেবার সময় হল। হাজিরা দিয়ে এসে বেল্ট, ব্যাণ্ডোলিয়র, বুট, পট্টি (এসব হচ্চে আমাদের রণসাজের নাম) দস্তুরমতো সাফ-সুতরো করে রাখতে হবে। কাল প্রাতে দশ মাইল ‘রুট মার্চ’ বা পায়ে হণ্টন।
    – ইতি
    তোমার ‘কাটখোট্টা লড়ুয়ে’ দোস্ত
    নূরুল হুদা

     

    করাচি সেনানিবাস
    ২১এ জানুয়ারি (প্রভাত)

    মনু!
    আজ করাচিটা এত সুন্দর বোধ হচ্ছে সে আর কী বলব! কী হয়েছে জানিস?
    কাল সমস্ত রাত্তির ধরে ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে খুব একটা দাপাদাপির পর এখানকার উলঙ্গ প্রকৃতিটা অরুণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দিব্যি শান্ত স্থির বেশে – যেন লক্ষ্মী মেয়েটির মতো ভিজে চুলগুলি পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে রোদ্দুরের দিকে পিঠ করে বসে আছে! এই মেয়েই যে একটু আগে ভৈরবী মূর্তিতে সৃষ্টি ওলট-পালট করবার জোগাড় করেছিল, তা তার এখনকার এ-সরল শান্ত মুখশ্রী দেখে কিছুতেই বোঝা যায় না। এখন সে দিব্যি তার আশমানি রং-এর ঢলঢলে চোখ দুটি গোলাবি-নীল আকাশের পানে তুলে দিয়ে গম্ভীর উদাস চাউনিতে চেয়ে আছে। আর আর্দ্র ঋজু চুলগুলি বেয়ে এখনও দু-এক ফোঁটা করে জল পড়ছে, আর নবোদিত অরুণের রক্তরাগের ছোঁওয়ায় সেগুলি সুন্দরীর গালে অশ্রুবিন্দুর মতো ঝিলমিল করে উঠছে! কিন্তু যতই সুন্দর দেখাক, তার এই গম্ভীর সারল্য আর নিশ্চেষ্ট ঔদাস্য আমার কাছে এতই খাপছাড়া খাপছাড়া ঠেকছে যে, আমি আর কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারচি নে। বুঝতেই পারচ ব্যাপারটা ; – মেঘে মেঘে জটলা, তার ওপর হাড়-ফাটানো কনকনে বাতাস ; করাচি-বুড়ি সমস্ত রাত্তির এই সমুদ্দুরের ধারে গাছপালাশূন্য ফাঁকা প্রান্তরটায় দাঁড়িয়ে থুরু থুরু করে কেঁপেছে, আর এখনকার এই শান্ত-শিষ্ট মেয়েটিই তার মাথার ওপর বৃষ্টির পর বৃষ্টি ঢেলেছে। বজ্রের হুংকার তুলে বেচারিকে আরও শঙ্কিত করে তুলেছে; বিজুরির তড়িদালোকে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে আর সঙ্গিনী উন্মাদিনী ঝঞ্ঝার সঙ্গে হো-হো করে হেসেছে। তারপর সকালে উঠেই এই দিব্যি শান্ত-শিষ্ট মূর্তি, যেন কিচ্ছু জানেন না আর কী! বল তো ভাই, এতে কার না হাসি পায়? আর এ একটা বেজায় বেখাপ্পা রকমের অসামঞ্জস্য কিনা? আমার ঠিক এই প্রকৃতির দু-একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে। খুব একটা ‘জাঁদরেলি’ গোছের দাপাদাপি দৌরাত্মির চোটে পাড়া মাথায় করে তুলেছেন, হঠাৎ তাঁর মনে ‘দার্শনিকের অন্যমনস্কতা’ চলে এল আর অমনি এক লাফে তিনি তাঁর বয়সের আরও বিশ-পঁচিশটা বৎসর ডিঙিয়ে একজন প্রকাণ্ড প্রৌঢ়া গৃহিণীর মতো জলদগম্ভীর হয়ে বসলেন এবং কাজেই আমার মতো ‘ঠোঁটকাটা ছ্যাবলা’র পক্ষে তা নিতান্তই সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সেরকম ধিঙ্গি মেয়েদের বিপক্ষে আমি আর অধিক বাক্যব্যয় করতে সাহস করি নে; কারণ – এই বুঝলে কিনা – এখনও আমার ‘শুভদৃষ্টি’ হয়নি। ভবিতব্য বলা যায় না ভাই! কবি গেয়েছেন, – (মৎকর্তৃক সংস্কৃত) –

    প্রেমের পিঠ পাতা ভুবনে,
    কখন কে চড়ে বসে কে জানে!

    অতএব এই স্থানেই আমার সুন্দরী-গুণ-কীর্তনে ‘ফুলস্টপ্’, – পূর্ণচ্ছেদ!
    আমার এই কাণ্ডজ্ঞানহীন গো-মুখ্যুর মতো যা-তা প্রলাপ শুনে তোর চক্ষু হয়তো এতক্ষণ চড়ক গাছ হয়ে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে বিরক্ত হচ্ছিস দস্তুরমতো! নয়? – হবারই কথা! আমার স্বভাবই এই। আমি এত বেশি আবোল-তাবোল বকি যে, লোকের তাতে শুধু বিরক্ত হওয়া কেন, কথঞ্চিৎ শিষ্ট প্রয়োগেরই কথা!
    যাক এখন ও-সব বাজে কথা। কী বলছিলাম? আজ প্রাতের আকাশটার শান্ত সজল চাউনি আমায় বড্ডো ব্যাকুল করে তুলেছে। তার উপর আমাদের দয়ালু নকিব (বিউগ্‌লার) শ্রীমান গুপিচন্দর এইমাত্র ‘নো প্যারেড’ (আজ আর প্যারেড নেই) বাজিয়ে গেল। সুতরাং হঠাৎ-পাওয়া একটা আনন্দের আতিশয্যে সব ব্যাকুলতা ছাপিয়ে প্রাণটা আজকার আকাশেরই মতো উদার হয়ে যাবার কথা! তাই গুপিকে আমরা প্রাণ খুলে আশীর্বাদ দিলাম সব, একেবারে চার হাত-পা তুলে। সে আর্শীর্বাদটা শুনবি? ‘আশীর্বাদং শিরচ্ছেদং বংশনাশং অষ্টাঙ্গে ধবল কুষ্ঠং পুড়ে মরং।’ এ উৎকট আশীর্বাদের জুলুমে বেচারা গুপি তার ‘শিঙে’ (বিউগ্‌ল) ফেলে ভোঁ দৌড় দিয়েছে। বেড়ে আমোদে থাকা গেছে কিন্তু ভাই।
    এমনই একটা আনন্দ পাওয়ার আনন্দ পাওয়া যেত, যখন বৃষ্টি হওয়ার জন্য হঠাৎ আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যেত। স্কুল-প্রাঙ্গণে ছেলেদের উচ্চ হো-হো রোল, রাস্তায় জলের সঙ্গে মাতামাতি করতে করতে বোর্ডিং-এর দিকে সাংঘাতিক রকমের দৌড়, সেখানে গিয়ে বোর্ডিং সুপারিন্টেন্ডেন্টের মুখের ওপর এমন ‘বাদল দিনে’ ভুনিখিচুড়ি ও কোর্মার সারবত্তা এবং উপকারিতা সম্বন্ধে কোমর বেঁধে অকাট্য যুক্তিতর্ক প্রদর্শন, অনর্থক অনাবিল অট্টহাসি, – আহা, সে কী আনন্দের দিনই না চলে গেছে! জগতের কোনো কিছুরই বিনিময়ে আমাদের সে মধুর হারানো দিনগুলি আর ফিরে আসবে না। ছাত্র-জীবনের মতো মধুর জীবন আর নেই এ কথাটা বিশেষ করে বোঝা যায় তখন, যখন ছাত্র-জীবন অতীত হয়ে যায়, আর তার মধুর ব্যথাভরা স্মৃতিটা একদিন হঠাৎ অশান্ত জীবনযাপনের মাঝে জগ-জগ (য) করে ওঠে।
    আজ ভোর হতেই আমার পাশের ঘরে (কোয়ার্টারে) যেন গানের ফোয়ারা খুলে গেছে, মেঘমল্লার রাগিণীর যার যত গান জমা আছে স্টকে, কেউ আজ গাইতে কসুর করছেন না। কেউ ওস্তাদি কায়দায় ধরছেন, – ‘আজ বাদরি বরিখেরে ঝমঝম!’ কেউ কালোয়াতি চালে গাচ্চেন, – ‘বঁধু এমন বাদরে তুমি কোথা!’ – এ উলটো দেশে মাঘ মাসে বর্ষা, আর এটা যে নিশ্চয়ই মাঘ মাস, ভরা ভাদর নয়, – তা জেনেও একজন আবার কবাটি খেলার ‘চুঁ’ ধরার সুরে গেয়ে যাচ্ছেন, – ‘এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।’ সকলের শেষে গম্ভীর মধুরকণ্ঠ হাবিলদার পাণ্ডেমশাই গান ধরলেন, – ‘হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে, সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে।’ গানটা সহসা আমার কোন্ সুপ্ত ঘায়ে যেন বেদনার মতো গিয়ে বাজল! হাবিলদার সাহেবের কোনো সজল-কাজল-আঁখি প্রেয়সী আছে কিনা, এবং আজকার এই ‘শ্যামল ঘন নীল গগন’ দেখেই তাঁর সেইরূপ এক জোড়া আঁখি মনে পড়ে গেছে কিনা, তা আমি ঠিক বলতে পারি নে, তবে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যেন আমারই হৃদয়ের লুকানো সুপ্ত কথাগুলি ওই গানের ভাষা দিয়ে এই বাদল রাগিণীর সুরের বেদনায় গলে পড়ছিল। আমি অবাক হয়ে শুনতে লাগলাম,

    হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে
    সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে॥
    অধর করুণা-মাখা,
    মিনতি বেদনা-আঁকা,
    নীরবে চাহিয়া-থাকা
    বিদায় ক্ষণে,
    হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে॥

    ঝর ঝর ঝরে জল বিজুলি হানে,
    পবন মাতিছে বনে পাগল গানে।
    আমার পরানপুটে
    কোনখানে ব্যথা ফুটে,
    কার কথা বেজে উঠে
    হৃদয় কোণে,
    হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে॥

    গান হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে দু-চারজন সমঝদার টেবিল, বই, খাটিয়া যে যা পেয়েছেন সামনে, তাই তালে-বেতালে অবিশ্রান্ত পিটিয়ে চলেছেন। এক একজন যেন মূর্তিমান ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি!’ আবার দু-একজন বেশি রকমের রসজ্ঞ ভাবে বিভোর হয়ে গোপাল রায়ের অনুকরণে – ‘দাদা গাই দেখ্‌সে, গোরু তার কী দেখব; দ্যাখ ঠাকুদ্দার বিয়ে, ধুচনি মাথবায় দিয়ে; – বাবারে, প্যাট গ্যালরে, শা … তোর কী হল রে’ ইত্যাদি সুমধুর বুলি অবিরাম আওড়িয়ে চলেছেন। যত না বুলি চলছে, মাথা-হাত-পা-মুখ নড়ছে তার চেয়ে অস্বাভাবিক রকমের বেশি! গানটা ক্রমে ‘আঙ্কোর প্লিজ’ – ‘ফিন জুড়ো’ প্রভৃতির খাতিরে দু-তিনবার গীত হল। তারপর যেই এসে সমের মাথায় ঘা পড়েছে, অমনি চিত্র-বিচিত্র কণ্ঠের সীমা ছাড়িয়ে একটা বিকট ধ্বনি উঠল, ‘দাও গোরুর গা ধুইয়ে! – তোমার ছেলের বাপ মরে যাক ভাই! তুই মরলে আর বাঁচবি নে বাবা!’ সঙ্গে সঙ্গে বুটপট্টি-পরা পায়ে বীভৎস তাণ্ডব নৃত্য! – এদের এ উৎকট সমঝ-বুদ্ধিতে গানটার অনেক মাধুর্য নষ্ট হয়ে গেলেও মনে হচ্ছে এও যেন আমাদের আর একটা ছাত্রজীবন। একটা অখন্ড বিরাট আমোদ এখানে সর্বদাই নেচে বেড়াচ্ছে। যারা কাল মরবে তাদের মুখে এত প্রাণ-ভরা হাসি বড্ড অকরুণ!
    আমার কানে এখনও বাজছে –

    – পড়িল মনে
    অধর করুণা-মাখা,
    মিনতি-বেদনা-আঁকা,
    নীরবে চাহিয়া-থাকা
    বিদায় ক্ষণে।

    আর তাই আমার এ পরানপুটে কোন্খানে ব্যথা ফুটচে, আর হৃদয়কোণে কার কথা বেজে বেজে উঠচে।
    আমি আমার নির্জন কক্ষটিতে বসে কেবলই ভাবচি যে, কার এ ‘বিপুল বাণী এমন ব্যাকুল সুরে’ বাজচে, যাতে আমার মতো শত শত হতভাগার প্রাণের কথা, হৃদয়ের ব্যথা এমন মর্মন্তুদ হয়ে চোখের সামনে মূর্তি ধরে ভেসে ওঠে? ওগো, কে সে কবিশ্রেষ্ঠ, যাঁর দুটি কালির আঁচড়ে এমন করে বিশ্বের বুকের সুষুপ্ত ব্যথা চেতনা পেয়ে ওঠে? বিস্মৃতির অন্ধকার হতে টেনে এনে প্রাণ-প্রিয়তমের নিদারুণ করুণ স্মৃতিটি হৃদয়ের পরতে-পরতে আগুনের আখরে লিখে থুয়ে যায়? আধ-ভোলা আধ-মনে-রাখা সেই পুরানো অনুরাগের শরমজড়িত রক্তরাগটুকু চির-নবীন করে দিয়ে যায়। কে গো সে কে? – তার এ বিপুল বাণী বিশ্ব ছাপিয়ে যাক, সুরের সুরধুনী তাঁর জগতময় বয়ে যাক! তাঁর চরণারবিন্দে, কোটি কোটি নমস্কার!
    ‘বিদায় ক্ষণের’ নীরবে চেয়ে থাকার স্মৃতিটা আমার সারা হৃৎপিণ্ডটায় এমন একটা নাড়া দিলে যে, বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে আমারও আঁখি সজল হয়ে উঠেচে। ভাই মনু, আমায় আজ পুরানো দিনের সেই নিষ্ঠুর স্মৃতি বড্ড ব্যথিয়ে তুলেছে! বোধ হয় আবার ঝর ঝর করেই জল ঝরবে। এ আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা ধরবার কোথাও ঠাঁই নেই।
    খুব ঘোর করে পাহাড়ের আড়াল থেকে এক দল কালো মেঘ আবার আকাশ ছেয়ে ফেললে! আর কাগজটা দেখতে পাচ্ছি নে, সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

    (বিকেলবেলা)
    হাঁ, এইবার চিঠিটা শেষ করে ফেলি। সকালে খানিকক্ষণ গান করে বিকেলবেলা এখন মনটা বেশ হালকা মতো লাগচে।
    চিঠিটা একটু লম্বা চওড়া হয়ে গেল। কী করি, আমার লিখতে বসলে কেবলই ইচ্ছা হয় যে, হৃদয়ের সমস্ত কথা, যা হয়তো বলতে সংকোচ আসবে, অকপটে লিখে যাই। কিন্তু সবটা পারি কই? আমার সবই আবছায়ার মতো। জীবনটাই আমার অস্পষ্টতায় ঘেরা।
    রবিয়লকে চিঠি লিখেছি কাল সন্ধ্যায়। বেশ দু-একটা খোঁচা দিয়েছি! রবিয়ল অসংকোচে আমার উপর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের যেরকম দাবি করে, আমি কিছুতেই তেমনটি পারি না। কী জানি কেন, তার ওপর স্বতই আমার ভক্তিমিশ্রিত কেমন একটা সংকোচের ভাব আসে। তবুও সে ব্যথা পাবে বলে আমি নিতান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই তার সঙ্গে চিঠি-পত্তর ব্যবহার করি। কথাটা কী জান? সে একটু যেন মুরব্বি ধরনের, কেমন রাশভারি লোক, তাতে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে পড়েছে। এরূপ লোকের সঙ্গে আমাদের মতো ছাল-পাতলা লোকের মোটেই মিশ খায় না। কিন্তু ও আর আমি যখন বাঁকুড়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়তাম, তখন তো এমন ছিল না!
    লোকটার কিন্তু একটা গুণ, লোকটা বেজায় সোজা! এই রবিয়ল না থাকলে বোধ হয় আমার জীবন-স্রোত কোনো অচেনা অন্য দিকে প্রবাহিত হত। রবু আমায় একাধারে প্রাণপ্রিয়তম বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ ভ্রাতার মতোই দেখে। রবিয়লের – রবিয়লের-চেয়েও সুন্দর স্নেহ আমি কখনও ভুলব না।
    সংসারে আমার কেউ না থাকলেও রবিয়লদের বাড়ির কথা মনে হলে মনে হয় যেন আমার ভাই-বোন-মা সব আছে!
    রবিয়লের স্নেহময়ী জ্যোর্তিময়ী জননীর কথা মনে হলে আমার মাতৃবিচ্ছেদ-ক্ষতটা নতুন করে জেগে ওঠে। – আমি কিন্তু বড্ড অকৃতজ্ঞ! না? বড্ড অকৃতজ্ঞ! না? এখন আসি ভাই, – বড্ড মন খারাপ কচ্চে। ইতি –
    হতভাগা
    নূরুল হুদা

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    সন্ধ্যা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.