Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প197 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বাঁধনহারা – পরিচ্ছেদ ০৬

    [চ]
    করাচি সেনানিবাস,
    (শ্রীঘর)
    ১৭ ফেব্রুয়ারি
    বাঁদর মনো!

    শুয়োর পাজি-ছুঁচো-উল্লু-গাধা-ড্যাম-ব্লাডিফুল-বেল্লিক-বেলেল্লা-উজবুক-বেয়াদব-বেতমিজ!– ওঃ আর যে মনে পড়ছে না ছাই, নইলে এ চিঠিতে অন্য কিছুই না লিখে শুধু হাজার খানেক পৃষ্ঠা ধরে তোকে আষ্টে-পিষ্টে গাল দিয়ে তবে কখনও ক্ষান্ত হতাম! একটা অভিধানও পাওয়ার জো নেই এই শালার জিন্দানখানায়, নইলে দিনকতক ধরে এমনিতর চোখা চোখা গাল পসন্দ করে তোকে বিঁধতাম যে, যার জ্বলনের চোটে তুই বিছুটি-আলকুসি-লাগানো ছাগলের মতন ছুটে বেড়াতিস – আর তবে না আমার প্রাণের জ্বালা হাতের চুলকুনি কতকটা মিটত! আচ্ছা, তোদের ভাই-বোন সবারই ধাত কি একই রকমের? তোদের ধর্মই কি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া? তোরা কী সুখ পাস এমন বে-দিলের মতন বেদনা-ঘায়ে ভোঁতা ছুরি রগড়ে? বল, ওরে হিংস্র জানোয়ারের দল, বল এতে তোদের কোন্ জিঘাংসা-বৃত্তি চরিতার্থ হয়! কী বলব, ভাগ্যিস তুই আমার হাতের নাগালের মধ্যে নেই, নইলে কামড়ে তোর বুকের কাঁচা মাংস তুলে ছাড়তাম! হায়, আমার জান যে আজ কীরকম তড়পে তড়পে উঠছে তোদের এই মুরগি-পোষা ভালোবাসার জুলুমে, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে না পেরে শুধু এই চিঠির কাগজটাকে কামড়িয়ে – নিজের হাতের গোশত নিজে চিবিয়ে আমার অতৃপ্ত রোষের ক্ষোভ মিটাচ্ছি! এখন আমার মনে হচ্চে, হনুমানের সাগর-লঙ্ঘনের মতন মস্ত এক লাফে এই দু হাজার মাইল ডিঙিয়ে তোর ঘাড়ের ওপর হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোকে একদম ‘কীচক-বধ’ করে ফেলি। তোর ওই বাঁকুড়া কলেজটাকে গন্ধমাদন পর্বতের মতন চড়চড় করে উপড়ে ফেলে সটান গন্ধেশ্বরীর গর্ভে নিয়ে গিয়ে ফেলাই! তার পর ভাবিসাহেবার ঘরটাসুদ্ধ সারা সালারটাকে অযুত বিসুবিয়াসের অগ্নিস্রাবে একদম নেস্ত-নাবুদ করে ফেলি! ভারি সব পণ্ডিত মনস্তত্ত্ববিদ কিনা, তাই এইসব ডেঁপোমি করে চিঠি লেখা! আমি নিজেকেই বা আর কী বলব, তোদর একটু পথ দেখাতেই তোরা ‘খাইবার-পাস’-এর মধ্যের গোরা সৈন্যের মতন সেই পথ দিয়ে অবিশ্রান্ত গোলাগুলি বর্ষণ করে আমাকে ঘায়েল করে ফেললি! যত দোষ এই আমি-শালার! তোর আগেকার চিঠিটা পেয়ে খুশি হয়ে যে উত্তর লিখেছিলাম, তা আলসেমি করে আর ডাকে দিইনি, তারপর তোর পরের বিশ্রী চিঠিটা পেয়েই তক্ষুণি সে-চিঠিটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেচি! মনে করেছিলাম, তুই ভালো, – আরে ‘তওবা’! সব শিয়ালের একই ডাক! পরের চিঠিটার পুরো উত্তর যে এখন দেবই না, তা বোধ হয় আর লিখে জানাবার দরকার নেই! যদি কোনোদিন আমি শান্ত হয়ে তোর অপরাধ ক্ষমা করতে পারি, তবেই উত্তর দেব – নইলে নয়। ভাবিসাহেবার চিঠিও তোরই মতো ‘রাবিশ’-যতসব মনগড়া কথায় ভরা। হবে না? হাজার হোক, তিনি তো তোরই বোন! আর কাজেই তুইও যে তাঁর সহোদর, তা মর্দের মতই প্রমাণ করলি! … খোদা তোদের মঙ্গল করুন!

    তোদের খবর যদি ইচ্ছা করিস, দিতে পারিস। চিঠিপত্র বন্ধ করলে বা খবর না পেলে যে খুব বেশি চিন্তিত হব তা ভুলেও মনে করিসনে যেন। সেদিন আর নেই রে মনু, সেদিন আর নেই! এখন সারা দুনিয়া গোল্লায় গেলেও আমি দিব্যি শান্তভাবে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিতে থাকব। জাহান্নামে যাক তোর এই দুনিয়া! আমার তাতে কী? দুনিয়ার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কী যে, আমি তার জন্যে ঝুরে মরব? মনে রাখিস, – দুনিয়া যদি হয় বুনো ওল, তবে আমি বাঘা তেঁতুল; দুনিয়া যদি হয় সাপ, তবে আমি নেউল: দুনিয়া যদি হয় রাধা-শ্যাম তবে আমি শ্রী কাঁধে-বাড়ি বলরাম!…আর কত বলব? কতই বা যা তা বকব! এক কথায়, আমি এখন থেকে সংসারের মহা শত্রু! সে যদি যায় পুবে, আমি যাব পশ্চিমে! এই তিন সত্যি করে দুনিয়ার সঙ্গে দুশমনি পাতালাম, দেখি কে হারে – কে জেতে … দূর ছাই! রাজ্যের ঘুমও আসচে যেন একেবারে আফিমের নেশার মতন হয়ে, – একেবারে মরণঘুম এলেও তো বাঁচি! আর, ঘুমকেই বা দোষ দেব কী! হাবিলদারজি আজ যে রকম দু ঘণ্টা ধরে আমায় মাটি খুঁড়িয়েচে! এমন ‘কেঠো’ হাতেও ফোসকা পড়িয়ে তবে ছেড়েচে! – হাঁ, এই হাবিলদার কিন্তু এক ব্যাটাছেলে বটে! একেই তো বলতে হয় সৈ-নি-ক পু-রু-ষ! আমায় পুরো দুটি ঘণ্টা গাধার চেয়েও বেহেজ্ খাটিয়েচে, একবার কপালের ঘাম মুছতেও দেয়নি – এমনি জাঁক! অত কষ্টের মধ্যেও আমার তাই একটা তীব্র তীক্ষ্ম আনন্দ শিরায় শিরায় গরম হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল, এবং তা এই ভেবে যে, আহা আর কেউ তো এমন করে দুঃখ দিয়ে আমার সব কিছু ভুলিয়ে দেয় না! এমনি কঠোরতা – না, এর চেয়েও সাংঘাতিক পরুষতা – আমি সব সময় চাইছি, কিন্তু পাই খুব কম! তাই আমার শাস্তির দরুণ ওই দু ঘণ্টা খাটুনি হয়ে যাওয়ার পর আমি হাবিলদার সাহেবের পাটাতন করা বুকে জোর দুটো থাপ্পড় কষিয়ে বাহবা দিয়েছিলাম! তীক্ষ্ণ উৎসাহের চোটে থাপ্পড় দুটো এতই রুক্ষ আর বে-আন্দাজ ভারি হয়ে পড়েছিল যে, তাঁর চোখে সত্য সত্যই “ভুগজুগুনি’ জ্বলে উঠেছিল! তাঁর চোখের তারা আমড়ার আঁটির মতন বেরিয়ে পড়লেও লজ্জার খাতিরে তিনি ‘কিছুই হয়নি’ বলে কাপাস-হাসি হাসতে চেষ্টা করেছিলেন। পরে কিন্তু তিনি সানন্দে স্বীকার করেছেন যে, আমি বাস্তবিকই তাঁকে একটু বেশিরকমই বেসামাল করে ফেলেছিলাম এবং তিনি এখন বিশ্বাস করেন যে, এরকম কারে পড়লে দিনেও তারা দেখা যেতে পারে! তবু এই হাবিলদারজিকে বাহাদুর পুরুষ বলতে হবে; কারণ অন্যান্য নায়ক হাবিলদারদের মতন সে অপরাধীকে না ঘাঁটিয়ে বসে থাকতে দিয়ে সৌজন্য প্রকাশ করে না – কর্তব্যে অবহেলা করে না। তাই আমাদের সৈনিক-সংঘ এঁর নাম রেখেছে, পাষণ্ড দুশমন সিং। এ বেচারা লেখাপড়া জানে কম, কিন্তু ‘নাচো কুঁদো ভুলো মৎ’ অর্থাৎ কাজের বেলায় ঠিক – একদম ঘড়ির কাঁটার মতো! তাই আমাদের শিক্ষিত হামবাগের দল এখনও সাধারণ সৈনিক এবং ইনি শিগগিরই ভারপ্রাপ্ত সেনানী হতে যাচ্ছেন।… পলটনে এসে গাফেলিই তো এক মহা অন্যায়, তার ওপর ব্যাটাচ্ছেলের আবার দুর্বলতা দেখো দেখি – পাছে বাংলার ননীর পুতুলদের নধর গায়ে একটু আঁচ লেগে তা গলে যায়, তাই তাঁদের কাজ থেকে রেহাই দিয়ে উচ্চ সেনানীদের দিনকানা করা হয়। যেই কোনো লেফটেন্যান্ট কাজ দেখতে আসেন, অমনি তারা এমনই নিবিষ্ট মনে, এত জোরে কাজ করতে থাকেন যে, তা দেখে স্বয়ং ব্রহ্মারও ‘সাবাস জোয়ান’ বলবার কথা! কিন্তু সে যখন দেখে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যা কাজ হওয়া উচিত ছিল, তার এক-চতুর্থাংশও হয়নি, তখন বেচারার বিস্ময়ের আর অবধি থাকে না! গভীর গবেষণা করেও তার গোবরগাদা মগজে এর কারণটা আর সেঁদোয় না – আর কাজেই তাকে বলতে হয় ‘বাঙালি জাদু জানতা হ্যায়!’ অবশ্য সবাই নয়, কিন্তু এইরকম করে অনেকেই বাঙালি ছেলেগুলোর কাঁচা মাথা চিবিয়ে খাচ্চে। কাজেই আমার সঙ্গে এই ধরনের সব সৈনিকের প্রায়ই মুখোমুখি এবং সময়ে হাতাহাতিও হয়ে যায়, আর শাস্তি ভোগটা করতে হয় আমাকে সবসে জিয়াদা!রাজার জন্য কাজ নাই-ই করলি, কিন্তু এও তো একটা শিক্ষা! যে-সামরিক শিক্ষা লাভের সৌভাগ্য বাঙালি এই প্রথম লাভ করেচে, তাকে এই রকম নষ্ট হতে দেওয়া কি বিবেকসম্মত? আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সামরিক শিক্ষাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। দেশের লোকের এত আশা, আমাদের প্রতি তাঁদের এত স্নেহ-আদরের সম্মান আমাদের প্রাণ দিয়েও রাখতে হবে। প্রাণ তো দিতেই এসেছি, তাই বলে লক্ষ্যচ্যুত হলে চলবে কেন? এ-ভীরুতা যে সৈনিকের দুরপনেয় কলঙ্ক।… পুরুষ-কা বাচ্চা পৌরুষকে বিসর্জন দেব কেন? সৈনিকের আবার দয়া-মায়া কীসের? সিপাই-এর দিল হবে শক্ত পাথর, বুক হবে পাহাড়ের মতন অটল, আর বাহু হবে অশনির মতন কঠোর! – গর্দানে একটা ‘রদ্দা’ বসালেই যেন বুঝতে পারে, হাঁ পৃথিবীও ঘোরে, আর স্বর্গ মর্ত্য পাতাল বলেও তিনটে ভুবন আছে! মরদের যদি মর্দানিই না রইল, তবে তো সে নিমোরাদে। মানুষের এরকম ‘মাদিয়ানা’ চাল দেখে মর্দমী আজকাল বাস্তবিকই লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না।

    তার পর, আমার জন্যে বিশেষ কোনো চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই এখন সম্প্রতি মাসখানেকের জন্যে। কারণ, গত পরশু এক শুভলগ্নে আমি আমার কোম্পানির সেনানী এক কাপ্তেন সাহেবকে একই ঘুষিতে ‘চাঁদা মামা’ দেখিয়ে এখন বন্দীখানায় বাস করচি! বড়ো দুঃখেই তাঁর সঙ্গে এরকম খোট্টাই রসিকতা করতে হয়েছিল, কেননা তিনি কিছুদিন থেকে নাকি আমার প্যারেড ও কাজে অসাধারণ চটক, নৈপুণ্য এবং কর্তব্যপরায়ণতা দেখে আসছিলেন, তাই সেদিন যখন মেসোপটেমিয়া যাওয়ার জন্যে আমাদের ‘বিবাহের খাকি-চেলি পরিধানপূর্বক’ নববধূর মতো আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আড়-চোখে-চোখে আমাদর পতিদেবতাস্বরূপ প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষের শুভাগমন প্রতীক্ষা করছি আর ঘেমে তেতে লাল হচ্চি – অবশ্য লজ্জায় নয়, খর চাঁদি-ফাটা রোদ্দুরের তাপে, – তখন হঠাৎ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আমাদের কোম্পানির সুবাদার সাহেবকে বললেন যে, আমার মেসোপটেমিয়া যাওয়া হবে না, নতুন রংরুটদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে করাচিতেই থাকতে হবে এবং আমাকে ওই খেসরতের ক্ষতিপূরণস্বরূপ লান্সনায়কের পদে উন্নীত করা হবে। কথা শুনে আমার অঙ্গ জুড়িয়ে গেল আর কী! তাই তাঁর এ অন্যায় আবদারে প্রতিবাদ করায় তিনি বেদম খাপ্পা হয়ে চোখ রাঙিয়ে উঠলেন, – ‘মেরা হুকুম হ্যায়!’ তোর হুকুমের নিকুচি করেনি! জানিস তো পুরুষের রাগ আনাগোনা করে, – যেই দাঁত খিঁচিয়ে উঠেচে, অমনি চোস্ত গোছের পরিপক্ব একটি ঘুঁষি সাহেবের বাম চোয়ালে, – তিনিও অবিলম্বে পপাত ধরণিতলে এবং সঙ্গে সঙ্গে ‘পতন ও মূর্ছার’ হাতে-কলমে অভিনয়! তারপর, আমায় ঠেলে ঢোকানো হল ‘কোয়ার্টার গার্ডে’ বা সামরিক হাজতে; তারপর বিচারে ২৮ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড ও সামরিক গারদখানায় বাস! কুছ পরোয়া নেই।আমি এই সশ্রম কারাদণ্ডকে ভয় করলে আর জান দিতে আসতাম না। দুঃখকষ্টই তো আমার অপার্থিব চিরদিনের চাওয়া-পাওয়া ধন। ও যে আমার অলংকার! তাই হাসিমুখেই তাকে বরণ করে নিয়েছি! আমাদের সৈন্যাধ্যক্ষ আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি সাহেবকে ওরকম আপ্যায়িত করেছিলাম কেন? তাতে আমি শুধু এইটুকু বলেছিলাম, – সাহেব ! সৈনিক হয়ে এসেচি মারামারি করবার জন্যই, প্রেম করবার জন্যে নয়!’ তাছাড়া, দেখ না ভাই, একে আমার মনের ঠিক নেই এবং মনের সে তিক্ত ভাবটাকে কোনোরূপে চাপা দিতে চাইছিলাম দু-দিন বাদে আগুন দেখতে পাব এই আনন্দে, – আর ঠিক সেই সময় কিনা তিনি এসে আমায় ‘কেতার্থ’ করে দিলেন!

    অতএব এখন কী করে আমার দিন কাটচে, আন্দাজেই মালুম করে নিতে পারবি। কিন্তু সে রকম ভাবতে পারাটাও তোমাদের অসামরিক লোকের পক্ষে এক রকম অসম্ভব ব্যাপার ; কারণ, সৈনিকের খাটুনি ধস্তাধস্তি কুস্তাকুস্তিও দেখনি এবং তাদের মিলিটারি শাস্তি বা গারদখানার ধারণাও তোমাদের বুদ্ধির অতীত, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। এখন খোদার নাম নিয়ে ভোরে উঠেই আমার গারদের ভিতর বসে হাত-পায়ের শিকলগুলো ঝংকার দিই। আহ্, সে কী মধুর বোল! আমার কানে তা যে কোনো তিলোত্তমা-তুল্যা ষোড়শী কুমারীর বলয় নূপুর ও রেশমি চুড়ির মধু শিঞ্জনের চেয়েও মিষ্টি হয়ে বাজে! তারপর শ্রীমান গুপিচন্দ্রের শিঙের (বিউগল্) আওয়াজ ‘কখন শুনি কখন শুনি’ করে যুগল কর্ণ উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। রাই বিনোদিনীর মতোই অহম পু্ং-বন্দিনী তখন হাঁশ-পাঁশ করে ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের খাকি বসনও ভীতি-সংকোচে আন্দোলিত হতে থাকে এবং আয়ান ঘোষ-রূপ এই লান্সনায়েক নারাণ ঘোষের গোয়াল বা গারদঘরে বসে শুনি, – ‘ওই বুঝি বাঁশি বাজে!’ অবিশ্যি, তা বন-মাঝে নয়, সন্ত্রস্ত মন-মাঝে! – হায়, সে কোন্ শ্যাওড়াতলায় হেলমেট-চূড়াশিরে রাইফেল-বংশী হাতে আমার সান্ত্রি-কালাচাঁদ ত্রিভঙ্গ ঠামে দাঁড়িয়ে আছেন! আমার এই শ্যামকান্তের ত্রিভঙ্গ নাম সার্থক, কেনা বুটপট্টি পরার পর তাকে ঠিক তিন জায়গায়ই ভঙ্গ বলে মনে হয়। প্রথম, পট্টি-লেপটানো পায়ের উপরে হাঁটুতে ‘দ’-এর মতো একটা ভঙ্গ; দ্বিতীয়, তাঁর কোমর-বন্ধের বাঁধনের ঠেলায় এবং কতকটা স্বভাবতই ভঙ্গ; তৃতীয়, তাঁর স্বর ভঙ্গ! আরও আছে, – তাঁর পৃষ্ঠদেশ অষ্টাবক্র মুনির মতন বাঁকা বলে আমরা তাঁর নাম দিয়েচি, ‘ফ্লাগব্রোকেন’ অর্থাৎ কিনা ধ্বজ-ভঙ্গ! কিন্তু ওই অষ্টাবক্রিয় ভঙ্গটাও হিসেবের মধ্যে ধরলে উনি চতুর্ভঙ্গ হয়ে যান বলে ওটা এখন ধরতার মধ্যে ধরিনে। … হ্যাঁ, তার পর আমায় কী করতে হয় শোন। শ্রীদামরূপ ধড়া-ধারী তাঁর এক সখা এসে আমায় কালার গোষ্ঠে নিয়ে যান ; আমিও মহিষ-গমনে আনত নেত্রে তাঁর অনুগমন করি। পথের মাঝে আমার লাজবিজড়িত শৃঙ্খল-পরা চরণে পঞ্চমেবোলা বাণী বেজে ওঠে, – ‘রিনিক ঝিনিকি রিনি ঝিনি রিনিঝিনি ঝিন্নিরে!’ তার পর এই মুখর ‘মঞ্জু মঞ্জু মঞ্জীরে!’ পথের যুবকবৃন্দকে চকিত করে গোষ্ঠে গিয়ে ঘণ্টা দুই গোষ্ঠবিহার! অর্থাৎ শ্যামের হুকুম মতো সামনের একটা ছোট্ট তাল-তমালহীন পাহাড় বারকতক দৌড়ে (ডবল মার্চ করে) প্রদক্ষিণ করে আসা – সেই দৌড়ানোর মাঝে মাঝে ‘ডবল মার্ক টাইম’ করা বা শিব ছাড়া যে সৈনিকেও তাণ্ডব নৃত্য করতে পারে, তা দেখিয়ে দেওয়া, – মধ্যে পরিখা-খাল ডিঙিয়ে মর্কট-প্রীতি প্রদর্শন করা ইত্যাদি! এসব লীলা রে লীলা, একেবারে রাসলীলা! এই দুই ঘণ্টা অমানুষিক কসরতের পরেও যখন পৈতৃক প্রাণটা হাতে করে ঘরে ফিরি, তখন স্বতই মনে হয় – নাঃ, ‘শরীরের নাম মহাশয়’ হওয়াটা কিছুই বিচিত্র নয়! এ মহাশয়কে যা সওয়াবে তাই সয়। তারপর বেলা এগারো-বারোটায় যে আ-কাঁড়া রেঙ্গুনি চালে সফেন ভাতের মণ্ড আর আ-ছোলা আলুর ঘেঁট খেতে পাই, তা দেখে আমরা বলদের চেয়ে উচ্চ শ্রেণির জীব বলে তো মনে হয় না। ডাল যা দু-একদিন হয়, তাতে নাকে-কানে সরষের তেল দিয়ে ডুব মারলেও কলাই-এর সন্ধান পাওয়া যাবে না! সকালে একবার ভেলি গুড় দিয়ে তৈরি এক হাতা যা চা পাই, তা না বলে দিলে বহু গবেষণাতেও কেউ চিনতে পারবে না যে, এ আবার কোন্ চিজ! এ যেন রোগীকে জবরদস্তি করে পথ্য গেলানোর মতো, ‘খাবি তো খই খা, না খাবি তো খই খা!’ যা হোক, অতক্ষণ খাবি খাওয়ার পর ওই জাব খাওয়াই তখন পরম উপাদেয়, অমৃত বলে বোধ হয়। তার পর একটু বাদেই পাথর কুড়ানো, ভাঙানো, আবার সন্ধ্যেয় ওই রকম প্যারেড বা গোষ্ঠবিহার এবং আরও কত বিশ্রী-সুশ্রী কাজ। সেসব শুনলে তোমার চক্ষু কাঁকড়ার মতন কোটরের বাইরে ঠেলে বেরিয়ে পড়বে।… তবু কিন্তু বুক ফুলিয়ে বলচি বেড়ে আরামেই আছি। আমি এই পিঁজরা-পোলে আটক থেকেও কী করে হরদম গান গাই, তা এখানকার সান্ত্রিসংঘ বুঝে উঠতে পারে না। এই দ্যাখ না, তোকে চিঠি লিখতে বসেছি – আর সঙ্গে সঙ্গে গানও ধরে দিয়েছি, –

    আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারও,
    আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝংকারও!

    এই রকমে আমার দিনগুলো এখন যাচ্চে, ‘আদম-গাড়ি’র (রিকশ) মতন একঘেয়ে হচং হচং করে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে।

    শুনচি, কয়েদ হওয়ার দরুণ আমায় নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে দেওয়া হবে না। যদি তা হয়, তাহলে আর এক কাণ্ড করে বসে থাকব। তা এখন বলছিনে। এ ব্যাটারা তো বুঝবে না যে, আমি কী জন্যে পলটনে এসেছি। তাই সকলেই শুধু ভুল বোঝে। অধিকাংশ সৈনিক যখন পদোন্নতির জন্য লালায়িত, তখন আমাকে প্রমোশন দিতে গেলেও আমি নিই না দেখে ওরা আমাকে ‘কাঠখোট্টা’, ‘গোঁয়ার’, ‘হোড়’ প্রভৃতি দুষ্পাচ্য গালাগালি দেয়। কিন্তু আমি জানি, দুঃখকে পাওয়ার জন্যেই আমি এমন করে বাইরে বেরিয়েচি। আমি রাজা ও দেশের জন্যে আসিনি। অত বড়ো দেবতা বা স্বার্থত্যাগী মহাত্মা হয়ে উঠতে পারিনি এখনও; আত্মজয়ই করতে পারলাম না আজও, তা আবার দেবতা! তাই আজও আমি রক্তমাংসের গড়া গোঁয়ার গর্দভ মানুষই রয়ে গেলাম।… পরে বরং দেবতা হওয়ার অভিনয় ও কসরত করে দেখা যাবে, যদি এই দুঃখ-কষ্ট-বেদনার আরাম আর আনন্দকে এড়িয়ে চলতে না হয়। কেননা, শুনেছি, দেবতাদের দুঃখ-কষ্ট বেদনা-ব্যথা বলে কোনো জিনিস জানা নেই, যদি তাই হয়, তবে ও আনন্দ-বিহীন নির্বিকার দেবত্বকে দূর থেকেই হাজার হাজার সালাম! যদি দুঃখই না পাওয়া গেল জীবনে, তবে সে জীবন যে বেনিমক, বিস্বাদ! এই বেদনার আনন্দই আমাকে পাগল করলে, ঘরের বাহির করলে, বন্ধন-মুক্ত রিক্ত করে ছাড়লে, আর আজও সে ছুটেছে আমার পিছু পিছু উল্কার মতো উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে! দুঃখও আমায় ছাড়বে না, আমিও তাকে ছাড়ব না। সে যে আমার বন্ধু – প্রাণপ্রিয়তম সখা, – আমার ঝড়-বাদলের মাঝখানে নিবিড় করে পাওয়া সাথি! এ পাওয়ার আনন্দের যে তীব্র নির্মমতাভরা মাধুর্য, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার সব শক্তি ওই পথে পাওয়া বন্ধু দুঃখই হরণ করেছে। তাই বাউল গানের অলস সুরে সামনের উদাসীন পথে আমার ক্রন্দন-আনন্দ একটা একটানা বেদনা সৃজন করে চলেছে, দিগন্তের সীমা ছাড়িয়ে অনন্তের পানে প্রসারিত হয়ে গেচে সে-পথ। বুকের ভিতর ক্রন্দন জাগে তার সেই চিরন্তন প্রশ্ন নিয়ে, ‘এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে?’ মূক পথের সীমাহীন আধ-আবছায়া আঁখির আগে ক্লান্ত চাওয়ার মৌন ভাষায় কইতে থাকে, ‘ তা কে জানে, তা কে জানে!’ এই অশেষের শেষ পেতে ততই প্রাণ আকুলি-বিকুলি করে ওঠে। তাতেও কত আনন্দ! এই যে নিরুদ্দেশ যাত্রা আর পথহীন পথচলার গূঢ় আনন্দ, তা থেকে আমার অতৃপ্ত আত্মতৃপ্তিকে বঞ্চিত করব কেন? তোরা অনুভূতিহীন আনন্দবিহীন পাথরের ঢেলা, – হয়তো একে ‘সোনার পাথর বাটি’ বা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’-এর মতোই একটা অর্থহীন অনর্থ মনে করে প্রশ্ন করবি, ‘যার সীমা নেই, শেষ নেই সে অজানার পিছনে ছোটার আবার আনন্দ কী?’ ওই তো মজা! এই অসীমের সীমা খোঁজায়, নিরুদ্দেশের চেষ্টায় যে দীর্ঘ অতৃপ্তির আশা-আনন্দ, সেই তো আমার উগ্র আকাঙ্ক্ষার রোখ চড়িয়ে দিচ্চে। শেষ হলে যে এ পথ চলারও শেষ, আর আমার আনন্দেরও শেষ, তাই আমি পথ চলি আর বলি, – যেন এ পথের আর শেষ না হয়। পাওয়ার আনন্দের শান্তির চাইতে, তাই আমি না-পাওয়ার আনন্দের অশান্তিকেই কামনা করে আসচি। যার জন্যে আমার অগস্ত্য-যাত্রা, আমার সেই পথ-চাওয়া ধনকে কি এই পথের পারেই পাব? সেও কি তবে আমার আশায় এই সীমার শেষে তার অনন্ত যৌবনের ডালি সাজিয়ে জন্ম জন্ম প্রতীক্ষা করে কাটাচ্চে? শুধু আমিই তাকে পেতে চাই? সে কী পথ চলে না আমার আশায়? না, না, সেও পেতে চায়, সেও পথ চলে; নইলে কে আমায় আকর্ষণ করবে এমন চুম্বকের মতো? কীসের এমন উন্মাদনাস্পন্দন আমার রক্তে-রক্তে টগবগ করে ফুটচে? – তার বাঁশি আমি শুনেচি, তাই আমার এ অভিসার যাত্রা ; আমার বাঁশি সে শুনেচে, তাই তারও ওই একই দিক-হারা পথে অভিসার-যাত্রা! আমি ভাবচি আমার এ-যাত্রার শেষ ওই পথহীন পথের অ-দেখা পথিকের কুটিরদ্বারে, – পথের যে-মোহনায় গিয়ে পথহারা পথিক ওই চেনা বাঁশির পরিচিত বেহাগ-সুর স্পষ্ট শুনতে পায়। সে বেহাগ-রাগে মিলনের হাসি আর বিদায়ের কান্না আলো-ছায়ার মতো লুটিয়ে পড়ে চারিপাশের পথে। কারণ, ক্লান্ত পথিক এই চৌমাথায় এসে মনে করে, বুঝি তার চলার শেষ হল; কিন্তু সেই পথেরই বাঁক বেয়ে বেহাগের আবাহন তাকে অন্য আর এক পথে ডেকে নেয়। তার পর সকালের পথ তাকে বিভাসের সুরে, দুপুরের পথ সারঙ-রাগে আর সাঁঝের পথ পুরবির মায়াতানে পথের পর পথ ঘুরিয়ে নিয়ে যায়! হায়, একী গোলকধাঁধা? কোথায় সে পথের বধুঁ যার বাঁশি নিরন্তর বিশ্বমানবের মনের বনে এমন ঘর-ছাড়া ডাক ডাকচে? যার অশরীরী ছোঁয়া শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সারাক্ষণই বাইরে-ভিতরে অনুভব করচি, যে শুধু দুষ্টুমি করে পথই চলাচ্চে, ধরা দিয়ে ধরা দিচ্চে না? পেয়েও তবে এই না-পাওয়ার অতৃপ্তি কেন? এর সন্ধান কে দেবে? যে যায়, সে তো আর ফেরে না। এ অগস্ত্য-যাত্রার মানে কী?…

    দুঃখ বলেছে সে আমাকে ওই পথের শেষ দেখাবে। সে নাকি আমার ওই বঁধুয়ার সখা। কোন্ পিয়াল বনের শ্যামলিমার আড়ালে লুকিয়ে থেকে সে চোর-চপল তার বাঁশি বাজাচ্ছে, তাই সে দেখিয়ে দেবে! তার সাথে গেলে সে এই লুকোচুরি ধরিয়ে দেবে। তাই দুঃখকে বরণ করেছি, তাকেই আমার পথের সাথি করেছি। সুখে যে-ক্লান্তি আছে, এ দুঃখে তা নেই; এর বেদনা একটা বিপুল অগ্নি-শিখা বুকের মাঝে জ্বালিয়েই রেখেছে – সে-শিখা ঝড়ে নেবে না, বাদল-বর্ষায় ঠান্ডা হয় না। এই আগুন-শিখার নামই অশান্তি। আমার জীবন-প্রদীপ ততক্ষণই জ্বলচে আর জ্বলবে, যতক্ষণ এই অশান্তির ‘রওগন’ বা স্নেহপদার্থ এই প্রদীপকে জ্বালিয়ে রেখেচে আর রাখবে। আগুন, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা – এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্চে, যা হবে দুর্ভেদ্য – মৃত্যুঞ্জয় – অবিনাশী! – আমার এ-পথ শ্বাশত সত্যের পথ, – বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়া পথ। আমি আমার আমিত্বকে এপথ থেকে মুখ ফিরাতে দেব না। পথ-বিচ্যুতি ঘটাতে সুখ তো প্রলোভন দেখাবেই ; কেননা তার দুশমন ‘দুঃখ’ যে আমার সাথি। কিন্তু আর ফিরছিনে। এই যে দুঃখের বুক আঁকড়ে ধরেচি, এ আর ছাড়চিনে! আমি আজ আমার এই বিশ বছর বয়সের অভিজ্ঞতা এবং দশ-বিশে দুশো বছরেরও বেশি আঘাত-বেদনা নিয়ে সত্য করেই বুঝেছি যে, দুঃখী যখন আনন্দকে পেতে সুখের পেছনে মরীচিকা-ভ্রান্ত মৃগের মতন অনুসরণ করে, তখন সে তার দুঃখের দৌলতে যে আনন্দটুকু পেয়েছিল তা তো হারায়ই, উলটো সে আরও অনেকখানি পেছনে অসোয়াস্তির গর্তে গিয়ে পড়ে। তার পর তাকে সেই আগে-চলা দুঃখের পথ ধরেই চলতে হয়। মৃগ তৃষ্ণিকার মতো সুখ শুধু দূর-তৃষিত মানবাত্মার ভ্রান্তি জন্মায়, কিন্তু সুখ কোথাও নেই – সুখ বলে কোনো চিজের অস্তিত্বও নেই ; ওটা শুধু মানুষের কল্পনা, অতৃপ্তিকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্যে কান্নারত ছেলেকে চাঁদ ধরে দেওয়ার মতো ফুসলিয়ে রাখা। আত্মা একটু সজাগ হলেই এ প্রবঞ্চনা সহজেই ধরতে পারে।…

    ওহ্, মাথাটা বড্ড দপদপ করচে রে। গা-টাও শির শির করচে। কী লিখতে গিয়ে কী যে ছাই-পাঁশ এক ঝুড়ি বাজে বকলাম, তা ভেবে উঠতে পারছিনে। চিঠিটা আর একবার যে পড়ে দেখতে পারব তারও কোনো আশা নেই, এমনই শরীর-মনে অবসাদ আসচে। তার ওপর আবার আর এক জুলুম, করাচিতে এখন খুব বসন্ত আরম্ভ হয়েচে, খোদা এখন দুনিয়ার কিছু খরচ কমাতে ইচ্ছে করেন বোধ হয়। বসন্ত-রোগাক্রান্ত রোগীর চেয়ে যাদের বসন্ত হয়নি, তাদের জুলুমেই আমরা সুদ্ধ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাদের লাইনের ওপারেই ‘সোলজার বাজার’ বলে একটা জায়গা আছে সেখানেই বসন্তভীতু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মিলে এমন বীভৎস কণ্ঠে হরি-সংকীর্তন করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সামনের সাগর-শয়ান নারায়ণকে মুগ্ধ করে প্রসাদ লাভ করবার চেষ্টা করচে যে নারায়ণের যদি এতটুকুও সংগীত-জ্ঞান থাকে, তাহলে এতক্ষণ তিনি শ্বশুরবাড়ি ক্ষীরোদ সাগরের আয়েশ, লক্ষ্মীর পরিচর্যা ইত্যাদি সব কিছু ছেড়ে সোজা আমেরিকা-মুখো হয়ে ছুট দিয়েছেন। লক্ষ্মী সম্বন্ধে কিছু বলতে পারিনে, কেননা তাঁর সতিন ব্যতীত তাঁর সংগীত-জ্ঞান সম্বন্ধে আমার সঠিক কোনো খবর জানা নেই। নারায়ণ দেখেন যে, দায়ে দৈবে না পড়লে এইসব মনু-সন্তানগণ তাঁর প্রতি অতিভক্তি দেখিয়ে চোরের লক্ষণ প্রকাশ করে না, বা তাঁর সুখ-নিদ্রার ব্যঘাত জন্মায় না, তাই তিনি অনেক সময় সমস্যায় পড়ে যান যে, তাঁর শ্বশুরালয় –সমুদ্রের গভীরতা বেশি, না এই ভক্তগুলি ভক্তির গভীরতা বেশি! আর, তাঁর এইরকম সমস্যা সমাধান করতে করতে ততক্ষণে অসহায় মানবকুলের অবস্থা ‘গুড়োয় মুড়ি দু-আঙুল’ গোছ হয়ে পড়ে এবং তাই তারা খঞ্জনি বাজিয়ে খোল পিটিয়ে ছাগ-মোষ বলি দিয়ে জোর চেঁচামেচি আরম্ভ করে দেয়!

    যাক, নারায়ণ তো এখন এইরকম কোনো প্রকারের লটপটিয়ে এক দিকে ছুট দিয়েচেন, কিন্তু এদিকে ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো আর এক আপদের আমার নাকের ডগায় অভিনয় হচ্চে। আমাদের খাকি-গেরুয়াধারী অতি ভক্ত সৈনিকবৃন্দ ‘হরির কৃপায়-দাড়ি গজায়, শীতকালে খায় শাঁখালু’ শীর্ষক ভক্তিরসাপ্লুত কীর্তনগানের সাথে সাথে ‘কাছা খুলে বা্হু তুলে’ যেরকম প্রলয় নৃত্য শুরু করে দিয়েচে, তাতে নিঃসন্দেহে মহাদেবও তাঁর ভূত-প্রেত-বলদাদিসহ কৈলাস-হিমালয় ছেড়ে এতক্ষণে তিব্বত পেরিয়ে পড়েছেন। খোলের প্রচণ্ড চাঁটির মাঝে মাঝে ‘গিজাং তাল ভটাভট’ গোছের একটা সমস্বর তীক্ষ্ণ ঋষভ চিৎকারের চোটে ‘ওই – নিলে রে’ বলে তাঁর ভূত-প্রেত-ডাকিনী-যোগিনীপর্ব যেমন অস্বাভাবিক ছুট ছুটচে, হরগৌরীপৃষ্ঠে ঊর্ধ্ব-লাঙ্গুল বৃষভ সিংহও পিট-টান দিয়েচে তেমনই উল্কা বেগে, – এ আমি আমার মনের চোখে বায়োস্কোপের মতো সাফ দেখতে পাচ্চি! আজ আমি নেই বলে ওদের দলে কেউ আর ‘ন্যাংটা নিতাই’ সাজতে পারেনি। আমার হাত-পা নিসপিস করে উঠচে – মনে হচ্চে এই হাজতখানার লোহার শিকলগুলো ভেঙে ওদের মাঝে গিয়ে খুব এক চোট দড়াম দড়াম করে উলঙ্গ নাচ নেচে দিয়ে আসি। …

    থাক – বাপ্‌স্! এসব প্রলয়কাণ্ড এতক্ষণে একটু শান্ত হল!…

    আজ বুঝি অমাবস্যার রাত্তির। নিবিড়-কালো যামিনী। আকাশের ছায়াপথ দেখে মনে হচ্চে, ও-ছায়াপথ যেন এই কালো যামিনীর সিঁথিপাটিপরা সিঁথি। অস্তোন্মুখ সন্ধে-তারা সেই সিঁথির মুখে সতীর জালে সিন্দূর বিন্দুর মতো রক্তরাগে জ্বলচে। তার এলিয়ে-দেওয়া কালো চুলের মাঝে মাঝে তারায় ফুল গোঁজা রয়েচে। আকাশ-বেয়ে পড়া ওই গভীর কালো এলোকেশের কুঞ্চিত রাশ ধরণির বুকে-মুখে লুটিয়ে পড়েচে। এক একটা তারা খসে পড়চে আর মনে হচ্চে অসংবৃত এই কালো রূপসির মাথা থেকে অসাবধানে এক আধটি করে কুসুম খসে পড়চে।… কোন্ কান্তের আশায় রজনি রোজ তার এ কালো রূপ নিয়ে অভিসারে বেরোয়? কেন সে অনন্তকাল ধরে এমন যামিনী জেগে আসছে? কোন্ আলো-করা-রূপের রাজকুমারের আসার আশায় তার প্রতি রজনি এমন করে ভোরের পাণ্ডুর ক্লান্ত হাসিতে মিলিয়ে যায়? প্রভাতের ভৈরবী-সুর-সিক্ত শীতল বায়ু – হা হা স্বরে যেন তারই না-পাওয়ার নিরাশা-ক্লান্তি আর পাওয়ার আশার আনন্দ ব্যক্ত করে। যামিনীর যেমন এ-প্রতীক্ষার অন্ত নেই, আমারও তেমনি এ পথ-চলার আর শেষ নেই!…

    আমার এত ইচ্ছে করচে এই যামিনী অভিসারের আশা-নিরাশা নিয়ে একটা সুন্দর কবিতা লিখতে, কিন্তু – আ রে তওবা, আমার কবিতা লেখা যা আসে, তা কতকটা এই রকম, –

    নেবুর ফুল আর করমচা,
    লাও এক কাপ গরম চা!

    এইবার ‘ক্ষেমা’ দিই, হাতে খাড় ধরে গেল। তোরও নিশ্চয় মুখে ব্যথা ধরবে পড়তে। এইবার ‘শ্রান্ত বায়ে ক্লান্ত কায়ে ঘুমে নয়ন আসে ছেয়ে।’

    যদি কষ্ট দিয়ে থাকি ক্ষমা করিস।

    স্বেচ্ছাচারী
    নূরুল হুদা

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    ব্যথার দান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    গানের মালা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    যুগবাণী – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 22, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মহুয়ার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    May 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }