Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাই দ্য রিভার পিদরা আই সেট ডাউন এন্ড উইপ্ট – পাওলো কোয়েলহো

    পাওলো কোয়েলহো এক পাতা গল্প167 Mins Read0

    ১. পিদরা নদীর তীরে

    বাই দ্য রিভার পিদরা আই সেট ডাউন এন্ড উইপ্ট / পাওলো কোয়েলহো / অনুবাদ : রাফিক হারিরি

    উৎসর্গ

    মুনতাসির মামুন ইমরান।

    তাকে আমি বলি আমাদের সময়ের ইবনে বতুতা। যিনি দুটো পা কে সাইকেলের দুই চাকার সাথে বেধে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবী। ব্রাজিল থেকে মেস্কিকো, ইজিপ্ট থেকে জাপান, নিউজিলেন্ড থেকে অষ্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা থেকে থাইলেন্ড এবং পরিবেশ সচেতনতার জন্য আমেরিকার উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত প্রায় ৫৫০০ কিলোমিটার ঘুড়েছেন সাইকেলে চেপে।

    জিতে রাহো ইয়ার
    প্রিয় বন্ধু বরেষু।

    .

    লেখকের কথা

    স্পেনের এক ধর্মপ্রচারকের একবার একটা দ্বীপ পার হওয়ার সময় তিনজন আযটেক পুরোহিতের সাথে দেখা হলো।

    “আপনারা কীভাবে প্রার্থনা করেন? ধর্মপ্রচারক জিজ্ঞেস করলেন।

    ‘আমাদের শুধু মাত্র একটাই প্রার্থনা। তিনজন আযটেক পুরোহিতের একজন বললেন। আমরা বলি, ঈশ্বর আপনারা তিনজন, আমরাও তিনজন। আমাদের প্রতি করুণা করুন।

    ‘খুব সুন্দর প্রার্থনা। ধর্মপ্রচারক বললেন। কিন্তু শুধু মাত্র এই দিয়েই আপনারা ঈশ্বরের মনোযোগ আর্কষণ করতে পারবেন না। আমি আপনাদেরকে এর চেয়ে ভালো কিছু শেখাতে পারি।

    পাদরি তাদেরকে একটা কেথলিক প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়ে নিজের ধর্মপ্রচারের কাজে বের হয়ে পড়লেন।

    বেশ কয়েক বছর পর সে যখন আবার স্পেনের পথে ফিরে আসছিল তখন। সেই দ্বীপে তার জাহাজ আবার থামল।

    জাহাজের ডেক থেকে পুরোহিত নদীর তীরে সেই তিনজন পাদরিকে দেখতে পেলেন। তিনজন পাদরি তখন পুরোহিতকে দেখে নদীর তীর থেকেই হাত নাড়তে লাগল।

    তারপরই পাদরি তিনজন নদীর পানির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই পুরোহিতের জাহাজের দিকে চলে আসল।

    ‘পুরোহিত পুরোহিত। জাহাজের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে একজন পাদরি বলল। আমাদেরকে আবার কীভাবে ঈশ্বরের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায় সেটা শিখিয়ে দিন। এটা কীভাবে কাজ করে আমরা তা ভুলে গেছি।’

    ‘কোন অসুবিধা নেই। পুরোহিত তিনজন পাদরির পানির উপর দিয়ে হেঁটে আসার অলৌকিক ক্ষমতা দেখে বলল। সাথে সাথে সে ঈশ্বরের কাছে এই বলে ক্ষমা চেয়ে নিল যে সে জানত না যে ঈশ্বর সব ভাষায়ই কথা বলতে পারেন।

    এ ঘটনাটাই বর্ণনা করছে এই বইটা আসলে কি নিয়ে।

    আমরা যে খুব অবাক করা একটা পৃথিবীতে আছি সেটা কম সময় অনুভব করে থাকি। আমাদের চারপাশে শুধুই অলৌকিক কত কত বিষয়। ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নানা লক্ষণসমূহ আমাদেরকে পথ দেখিয়ে চলছে, ফেরেশতারা আমাদের কাছ থেকে সেই বিষয়ে শোনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে, অথচ আমারা খুব কমই সেদিকে নজর দিচ্ছি। কারণ ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু পথ শিখিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে এর বাইরে গেলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না। অথচ আমরা এটা মোটেও বোঝার চেষ্টা করছি না যে ঈশ্বরকে তুমি যেখানেই চাও সেখানেই খুঁজে পাবে।

    ধর্মীয় ঐতিহ্যগত আচার-আচরণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা আমাদেরকে এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের প্রার্থনার নানা অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করার সুযোগ করে দেয়।

    কিন্তু আমাদেরকে এটা ভুললেও চলবে না যে এসব অতিন্দ্রিয় আচার আচরণ অভিজ্ঞতার মূলে রয়েছে প্রেম আর ভালোবাসার অভিজ্ঞতা। আর ভালোবাসার কাছে কোনো নিয়ম খাটে না।

    কেউ কেউ তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করে নিজেদের আচরণগত উন্নয়নের জন্য, আবার কেউ কেউ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকদের কাছ থেকে উপদেশ নিয়ে শুধুমাত্র বই পড়ে যায়, অথচ এসব কিছুই হলো এক ধরনের মূখামি।

    এ হৃদয়ই সিদ্ধান্ত নেয় সে কি করবে। আর হৃদয় যা সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই হলো সত্যিকারের বিষয়।

    আমাদের সকলেরই এই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে যে; কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলি একটা ভালোবাসার জন্য শুধু শুধুই আমি খুব কষ্ট করলাম।

    ‘আমরা ভালোবাসার জন্য কষ্ট করছি কারণ যত না গ্রহণ করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদেরকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

    ‘আমরা কষ্ট করছি কারণ ভালোবাসাকে আমরা চিনতেই পারলাম না।

    ‘আমরা কষ্ট করছি কারণ আমাদের নিজেদের নিয়মই আমরা প্রয়োগ করতে পারলাম না।

    অথচ আমাদের এই কষ্টের ভালো কোন যৌক্তিক কারণ নেই। যদিও প্রতিটি ভালোবাসার বীজে আমাদের বেড়ে ওঠা নির্ভর করে। আমরা যত ভালোবাসব তত অতিন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক এক অনুভূতির কাছাকাছি চলে আসব।

    যারা সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসতে পেরেছে, প্রেম দিয়ে তাদের আত্মাকে সাজাতে পেরেছে তারাই নিজের যুগের সকল বাধা আর ভ্রান্ত ধারণাকে অতিক্রম করেছে।

    তারা এখন গাইতে পারে, বুক খুলে হাসতে পারে, চিৎকার করে প্রার্থনা করতে পারে। তারা অত্যন্ত সুখি, কারণ যারা ভালোবাসতে পেরেছে তারা পৃথিবীকে জয় করেছে, তাদের হারানোর কোনো ভয় নেই।

    সত্যিকারের ভালোবাসা হলো পরিপূর্ণ ভাবেই নিজেকে সপে দেওয়া।

    এই বইটা হলো ভালোবাসার সেই আত্মসমর্পণের গুরুত্ববহ একটা বই।

    পাইলার আর তার বন্ধু দুজনেই কাল্পনিক হলেও ভালোবাসার সন্ধানে আমরা যেসব সংঘাতের মুখোমুখি হই তারই প্রতিনিধিত্ব করছে এই দুজন। খুব শিগগির কিংবা একটু বিলম্ব হলেও আমরা সব ভয়কে জয় করে ফেলব। কারণ আমাদের প্রতিদিনের ভালোবাসার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই আমরা সেই অতিন্দ্রিয় পথে ঘুরে বেড়াতে সক্ষম হবো।

    থমাস মাটন একবার বলেছিলেন ভালোবাসার জন্য আধ্যাত্মিক জীবন খুব দরকার। ভালোবাসা শুধু আরেকজনের উপকার করা, ভালো কাজ করা; কিংবা অন্য কাউকে রক্ষা করাই নয় বরং ভালোবাসা হলো একে অপরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে আরেকজনের ভেতর খোদার যে ঝিলিক আছে সেটাকে আবিষ্কার করা।

    পিদরা নদীর তীরে পাইলারের আর্তনাদ আমাদেরকে সেই একই অনুভবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক এই কামনা।

    —পাওলে কোয়েলহো

    .

    তার সমস্ত সন্তানদের দিয়ে জ্ঞানকে যাচাই করা হবে।
    লিউক ৭:৩৫

    .

    .

    বাই দ্য রিভার পিদরা আই সেট ডাউন এন্ড উইপ্ট

    পিদরা নদীর তীরে বসে আমি কাঁদছি।

    একটা উপকথা আছে যে এই নদীর পানিতে যাই কিছু পড়ে-পাতা, পতঙ্গ, পাখির পালক সব কিছুই পাথরে পরিণত হয়ে নদীর বিছানা হয়ে যায়।

    আহ আমি যদি হৃদয়টাকে ছিঁড়ে খুড়ে বের করে এই নদীর স্রোতে সজোরে ছুঁড়ে মারতে পারতাম তাহলে আমার দুঃখ বেদনাগুলো কিছুটা হলে লাঘব হতো, আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব কিছু ভুলে থাকতে পারতাম। পিদরা নদীর তীড়ে বসে আমি কাঁদছি।

    শীতের বাতাস আমার গালের পানিগুলোকে ঠাণ্ডায় জমিয়ে দিচ্ছিল। এই নদীটা কোথাও না কোথাও আরেকটার সাথে তারপর আরেকটার সাথে মিলিত হয়েছে, যা আমার হৃদয় আর দীর্ঘশ্বাস থেকে অনেক দূরে। তারপর এসব কিছুই সমুদ্রের সাথে মিশে গেছে।

    আমার চোখের জল যত দূরেই যাক না কেন আমার ভালোবাসা হয়ত কখনোই জানতে পারবে না যে একদিন আমার স্বপ্নের পুরুষটার জন্য আমি অঝোরে কেঁদেছিলাম।

    চোখের জল যতই ঝরুক না কেন আমি হয়ত এই পিদরা নদীর দুই কুল, আশপাশের গির্জা, আর যেই পথগুলো দিয়ে আমরা হেঁটেছিলাম সেগুলো হয়ত ভুলে যাব।

    আমি ভুলে যাব আমার স্বপ্নের মাঠ, পাহাড়-পর্বত সব কিছু। সেই স্বপ্ন যেটা হয়ত আর কখনোই বাস্তব হবে না।

    সেই যাদুকরি মুহূর্তের কথা আমার খুব মনে পড়ে। সেই মুহূর্তে কীভাবে একজনের হ্যাঁ কিংবা না শব্দটা আরেকজনের জীবনকে চিরতরে বদলে দিতে পারে।

    মনে হয় যেন কতকাল আগে এই সব ঘটেছিল। অথচ এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে গত সপ্তাহেই আমার ভালোবাসাটাকে আমি আবারো দেখেছিলাম তারপর আমার স্বপ্নের পুরুষটাকে হারিয়ে ফেললাম।

    পিদরা নদীর তীড়ে বসে আমি এই গল্পটা লিখছি।

    আমার হাতের আঙুল, পায়ের নখ, পা সব কিছুই জমে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমি থামতে চাচ্ছি।

    ‘বেঁচে থাকার জন্য খুঁজে বেড়াও। সে বলেছিল।

    আসলে ভালোবাসা কিন্তু আমাদেরকে প্রয়োজনের আগেই বেশ অভিজ্ঞ করে তুলে। আমি জানি না সেই মুহূর্তগুলোকে আমি কেন আবার ডেকে নিয়ে আসতে পারছি না।

    এ জন্যই আমি লিখছি-আমার দুঃখগুলোকে আরো দীর্ঘায়িত করার জন্য, আমার একাকিত্বগুলোকে মনে রাখতে হবে।

    আমি নিজেকেই যখন গল্প বলে শেষ করব তখন এই পিদরা নদীর তীড়ে বসে নিজের ভাগ্য বাছাই করব।

    আমাকে যেই মহিলাটা আশ্রয় দিয়েছিল তিনি এমনটাই আমাকে করতে বলেছেন।

    একজন দরবেশ বলেছিলেন, ‘আগুনের শিখা থেকে যা লেখা হয় এই নদীর পানি সেই জ্বলনকে নিভিয়ে দেয়।

    সমস্ত ভালোবাসার গল্প একই।

    *

    আমরা দুজনেই ছোট ছিলাম।

    তারপর একদিন অন্য সব তরুণেরা যেভাবে ছোট ছোট শহরগুলো ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায় আমার ভালোবাসার পুরুষটাও চলে গেল। সে বলেছিল এই পৃথিবীর বিষয়ে সে জ্ঞান অর্জন করতে চায়। তার স্বপ্নগুলো সুরিয়া শহরের মাঠে প্রান্তে ঘুমিয়ে আছে।

    তার কোন খবর ছাড়াই অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেল। সে প্রায় সময়ই আমাকে চিঠি লিখত কিন্তু আমাদের শৈশবের সেই রাস্তাগুলো কিংবা অরণ্যের ছায়ায় সে আর ফিরে আসল না।

    আমি স্কুল শেষ করে জারাগোযায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম সে সত্যি কথাই বলেছিল।

    সুরিয়া খুবই ছোট শহর। এ শহরের একজন বিখ্যাত কবি বলেছিল রাস্তাগুলো শুধু ঘুড়ে বেড়ানোর জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

    আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেখানে আমার একজন ছেলে বন্ধু জুটে গেল।

    শিক্ষা বৃত্তির জন্য আমি পড়াশোনা শুরু করলাম। (তখন আমি পড়াশোনার খরচ বহনের জন্য দোকানে কাজ করতাম।)

    কিন্তু শিক্ষা বৃত্তির প্রতিযোগিতায় আমি ছিটকে পড়লাম। তখনই আমার ছেলে বন্ধুটাকে আমি ছাড়িয়ে দিলাম।

    তখন আমার কাছে আবারো আমার শৈশবের সেই বন্ধুর কাছ থেকে চিঠি আসা শুরু করল। পৃথিবীর নানা জায়গার ঠিকানা থেকে চিঠিগুলো আসত। সেটা দেখলে আমার খুব ঈর্ষা হতো। তার চিঠি পড়লে আমার মনে হতো সেসব কিছুই জানে। দুটো ডানা বিছিয়ে সে শুধু ঘুড়েই বেড়াচ্ছে।

    তার কিছু চিঠি শুধু মাত্র ফ্রান্সের একটি জায়গা থেকেই এসেছিল।

    একটা চিঠিতে সে লিখেছে সে একটা তীর্থদলের সাথে ভিড়ে যাচ্ছে, প্রার্থনার জন্য সে তার পুরো জীবনটাকে বিলিয়ে দিবে। আমি তাকে ফিরে আসতে বলেছিলাম। বলেছিলাম একটু ধৈর্য ধরতে। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার স্বাধীনতাকে আরো বেশি করে উপভোগ করতে।

    কিন্তু তাকে লেখা আমার চিঠিগুলো পড়ে আমি আবার সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতাম। কারণ তাকে স্বাধীনতার বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার আমি কে? তার তুলনায় আমিতো একেবারে অজ্ঞ মূর্খ।

    একদিন আমি শুনলাম সে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা শুনে আমি খুব অবাক হলাম। ভাবলাম এখন সে অন্য মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিশ্চয় বেশ যুবক হয়ে উঠেছে।

    তারপরই সে লিখল সে মাদ্রিদে একটা সভায় বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে। আমি যেন সেখানে যাই।

    তাই জারাগোজা থেকে আমি মাদ্রিদের দিকে চার ঘণ্টার যাত্রা শুরু করলাম। আমি তাকে আরেকটাবারের জন্য দেখতে চাইলাম। তার গলার স্বর শুনতে চাইলাম। একটা কফিশপে বসে তার সাথে আলাপ করতে করতে পুরোনো দিনগুলো স্মরণ করতে খুব ইচ্ছে হলো। যখন আমরা ভাবতাম জানার জন্য পৃথিবীটা আসলে অনেক দূরে আর খুব বড়।

    *

    শনিবার, ডিসেম্বর ৪, ১৯৯৩

    যে জায়গাটায় সভা হয়েছিল সেটা আমার কল্পনার চেয়েও খুব সাধারণ ছিল। আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি লোক সেখানে জড়ো হয়েছিল। কীভাবে সব কিছু ঘটেছিল?

    ‘সে নিশ্চই অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছে।

    আমি ভাবলাম।

    তার চিঠিগুলোতে সে এই বিষয়ে আমাকে কিছুই জানায় নি। আমার খুব ইচ্ছে করছিল সভার লোকগুলোকে একজন একজন করে জিজ্ঞেস করি কেন তারা এখানে এসেছে। কিন্তু আমার অত সাহস ছিল না।

    সে যখন সভাকক্ষে ঢুকল তখন তাকে দেখে আমি আরো বেশি অবাক হলাম। ছেলেবেলা তাকে আমি যেভাবে দেখেছিলাম তার চেয়ে খুব বেশি একটা পরিবর্তন আমি তার মধ্যে দেখলাম না। যদিও এর মধ্যে বারোটা বছর কেটে গেছে। মানুষ মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়।

    তার চোখ দুটো চক মক করছিল। খুব সুন্দর লাগছিল তাকে।

    ‘আমরা যা হারিয়েছিলাম সে আমাদেরকে আবার সেগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছে।

    আমার পাশেই একজন মহিলা বসতে বসতে বলল।

    খুবই অবাক করা কথা।

    “সে কি ফিরিয়ে দিচ্ছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    “আমাদের কাছ থেকে যা চুরি হয়ে গিয়েছিল। ধর্ম।

    “না না, সে আমাদেরকে কিছুই ফিরিয়ে দেয় নি। আমার ডান পাশে অল্প বয়স্ক একটা মেয়ে বসতে বসতে বলল।

    ‘আমাদের সাথে সব সময় যেটা ছিল তার কিছুই তারা ফিরিয়ে দিতে পারেনি।

    ‘তাহলে তুমি কেন এখানে এসেছ?’ প্রথম বয়স্ক মহিলাটা বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয় তরুনীকে জিজ্ঞেস করল।

    ‘আমি তার কথা শুনতে চাই। আমি দেখতে চাই কীভাবে তারা চিন্তা করে। তারা আমাদেরকে একবার পুড়িয়ে ছারখার করেছে। আমার ধারণা তারা আবারো সেটা করবে। অল্প বয়স্ক মেয়েটা বলল।

    ‘তার একটাই কণ্ঠস্বর। তিনি যা পারেন তাই করেন। বয়স্ক মহিলাটা বলল।

    অল্পবয়স্ক মেয়েটা ঠোঁট বাকিয়ে বিদ্রুপের মতো করে হেসে ঘুরে বসল। সে এখানেই আলোচনার ইতি টানতে চায়।

    ‘একজন রোমান ধর্মযাজকের জন্য সে যথেষ্ট উদ্দীপনার ব্যবস্থা করেছে।

    বয়স্ক মহিলাটা কথাগুলো বলে সমর্থণের আশায় আমার দিকে ঘুড়ে তাকাল।

    আমি অবশ্য তাদের কথা বার্তার কিছুই বুঝতে পারলাম না।

    আমি চুপ করে থাকলাম।

    ডানপাশে বসা তরুণীটি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল। যেন আমি তার দলেরই একজন।

    কিন্তু আমি তো চুপ করে ছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণে।

    আমি ভাবছিলাম, সেমিনারিয়ান? এটাতো হতে পারে না! সেতো আমাকে কিছু হলেও বলত।

    আমার সেই বন্ধুটি যখন কথা বলা শুরু করল, তখন আমি তার বক্তৃতায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।

    আমি নিশ্চিত ছিলাম সভাস্থলে সে আমাকে ঠিক দেখতে পেয়েছে।

    সে কি ভাবছিল তখন আমি সেটা অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম।

    তার কাছে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?

    ঊনত্রিশ বছরের একজন রমণীর সাথে সতেরো বছরের একজন তরুণীর কি পার্থক্য রয়েছে?

    আমি লক্ষ্য করলাম তার গলার স্বর একটুও পরিবর্তিত হয় নি। তবে তার কথাগুলো পাল্টে গেছে।

    *

    ‘তোমাদেরকে ঝুঁকি নিতেই হবে।

    সে বলল।

    “আমরা যদি জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটার আশা করি তাহলে জীবনের অলৌকিকতায় আমাদেরকে বিশ্বাস করতেই হবে।

    প্রতিদিনই খোদা আমাদেরকে সূর্যের আলো দিচ্ছেন; কিন্তু এর মধ্যেও তিনি আমাদেরকে এমন একটা মুহূর্ত দান করেন যখন আমরা আমাদের অসুখী মুহূর্তগুলোকে পাল্টে দিতে পারি।

    যদিও আমরা প্রতিদিন ভান করি যে সেই মুহূর্তটাকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না, কিংবা মুহূর্তটা হয়ত বা নেই।

    অথবা আজকের দিনটা যেন গতকালের মতই আর, আগামীকালটাও আজকের মতই হবে।

    কিন্তু মানুষ যদি সত্যিকার অর্থেই তার প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় মনোযোগ দিত তাহলে সে ঐ যাদুকরী মুহূর্তটাকে আবিষ্কার করতে পারত।

    সেই অলৌকিক মুহূর্তটা হয়ত চলে আসবে হঠাৎ করেই যখন আমরা প্রতিদিনের স্বাভাবিক মামুলি কাজটা করছি যেমন আমাদের ঘরের মূল দরজার তালাটা খোলার জন্য তাতে চাবি ঢোকালাম, কিংবা এই রকম আরো হাজারো সাধারণ কাজের ভেতর হয়ত সেই মুহূর্তটা লুকিয়ে থাকতে পারে।

    তবে বিশ্বাস করতে হবে যাদুকরি সেই মুহূর্তটার অস্তিত্ব আছে।

    সেটা এমন এক মুহূর্ত যখন সমস্ত নক্ষত্রদের ক্ষমতা আমাদের অংশ হয়ে যায় আর আমরা ঠিক তখনই অলৌকিক কিছু করার ক্ষমতা অর্জন করি।

    আনন্দ একটা আশীর্বাদ তবে প্রায় সময়ই এটা একধরনের বিজয়।

    আমাদের যাদুকরি মুহূর্ত সব কিছু পরিবর্তন করতে, আমাদের স্বপ্নকে খুঁজে বেড়াতে সহায়তা করে।

    হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমরা কখনো কখনো দুঃখিত হয়ে পড়ি, আমাদের জটিল সব সময় আসে, আমরা প্রচুর হতাশার ভেতর দিয়ে যাই; কিন্তু এই সব কিছুই পরিবর্তনশীল, এইগুলো কোন স্থায়ী চিহ্ন রেখে যায় না।

    একদিন হয়ত আমরা গর্ব আর বিশ্বাসের সাথেই অতীত ভ্রমনের দিকে ঘার ঘুরিয়ে তাকাব।

    দয়া আর কোমলতা হলো এমন এক ব্যাক্তি যে কিনা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। হতে পারে এ ব্যাক্তিটি কখনো হতাশ হয় না কিংবা অন্য লোকেরা স্বপ্নের খোঁজে যেভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয় সেই রকম দুঃখ সে অনুভব করে না। কিন্তু অন্যান্য মানুষের সাথে সাথে এই লোকটা যখন পেছন ফিরে তাকায় তখন সে শুনতে পায় তার হৃদয় বলছে, খোদা তোমার অতীতের দিনগুলোতে যে অলৌকিক মুহূর্তগুলো তোমাকে দিয়েছিল তুমি সেগুলো দিয়ে কি করেছ? খোদা তোমাকে যে বুদ্ধি আর প্রতিভা দিয়েছিল সেটাকে কীভাবে ব্যবহার করেছ? তুমি নিজেই নিজেকে একটা গুহার ভেতর কবর দিয়েছ, কারণ তুমি ভয় পাচ্ছিলে যে তোমার সেই প্রতিভাগুলো হয়ত তুমি হারিয়ে ফেলবে। ফলে এই হলো তোমার পাওনা, তুমি তোমার জীবনকে নিজেই ধ্বংস করেছ।’

    দয়া কোমল আর ভীতু লোকেরা এটাই অনুভব করবে। কারণ শেষ পর্যন্ত যখন তারা জীবনের অলৌকিক মুহূর্তগুলোকে বিশ্বাস করা শুরু করবে ততক্ষণে তাদের জীবনের যাদুকরি মুহূর্তগুলো তাদের ছেড়ে চলে গেছে।

    *

    আমার বন্ধুর বক্তৃতা শেষ হলে সভার সদস্যরা তার দিকে ছুটে গেল।

    আমি অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম এতকাল পরে তার সাথে দেখা হলে তার প্রথম অনুভূতিটা কী হবে?

    একজন শিশুর মতই আমি অস্থির আর চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। কারণ তার নতুন বন্ধুদের কাউকেই আমি চিনি না।

    আমার একটু ঈর্ষাও হচ্ছিল, কারণ সে আমাকে রেখে অন্যদের প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দিচ্ছিল।

    অবশেষে সে যখন আমার কাছে আসল তখন আমি দেখলাম লজ্জায় সে লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই একটু আগে গুরুগম্ভীর বক্তা থেকে সে অতীতের সেই ছোট্ট বালকটাতে পাল্টে গেল। যে বালকটা আমার সাথে সান সাটুরির আশ্রমে লুকিয়ে থাকত, তার সারা পৃথিবী ঘুড়ে বেড়ানোর স্বপ্নের কথা আমাকে বলত (সেই সময় বাবা মা আমাদেরকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশে খবর দিয়েছিল। তারা ভয় পেয়েছিল যে আমরা দুজন হয়ত নদীতে ডুবে গেছি)।

    ‘পিলার’। সে বলল।

    আমি তাকে চুমু খেলাম।

    আমি অনেক কিছুই বলতে পারতাম। তার বক্তৃতার উপস্থাপনার বিষয়ে মন্ত ব্য করতে পারতাম।

    আমি তাকে বলতে পারতাম যে অসংখ্য লোকের মাঝে বসে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমাদের শৈশব নিয়ে খুব মজার হাস্যকর কিছু তাকে বলতে পারতাম। কিংবা বলতে পারতাম তাকে এমন একটা জায়গায় দেখে আমি গর্বিত।

    আমি তাকে ব্যাখ্যা করতে পারতাম যে আমাকে জারাগোজার সবশেষ বাসটা ধরার জন্য এই মুহূর্তেই ফিরে যেতে হবে।

    আমি করতে পারতাম এই কথাটার তাৎপর্য কী?

    আমাদের জীবনে অনেক নিশ্চিত মুহূর্ত আছে যেখানে অনেক কিছুই নিশ্চিত ভাবে ঘটতে পারত কিন্তু ঘটে না।

    অলৌকিক মুহূর্তগুলো ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় আর হঠাৎ করেই ভাগ্য আমাদের সব কিছু পাল্টে দেয়।

    আমার সাথেও এমনটাই ঘটেছিল।

    ‘আমরা কি আবারো এক সাথে কফি খেতে পারি?’ আমি বললাম।

    সে আমার দিকে ঘুরে ভাগ্যের হাতটা বাড়িয়ে দিল।

    সত্যিকার অর্থেই তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার। আগামীকাল বিলবোতে আমার একটা বক্তৃতা আছে। আমার গাড়ি আছে। চলো আমার সাথে। সে বলল।

    ‘আমাকে জারাগোজায় ফিরে যেতে হবে। এটা যে আমার শেষ সুযোগ সেটা উপলব্ধি না করেই আমি উত্তরে বললাম।

    তাকে দেখে হয়ত আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম, আমি আবারো একজন শিশুতে পাল্টে গিয়েছিলাম।

    অথবা সম্ভবত আমরা সেই আগের মতো ছিলাম না যে দুজন একত্রে আমাদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো লিখেছিল।

    আমি বললাম, তবে বিলবোতে তোমার সাথে ছুটির সময়টা উপভোগ করা যেতে পারে। তোমার সাথে আমি সেখানে যেতে পারি। তারপর আবার জারাগোজে চলে যাব।

    .

    এরপরই আমার ঠোঁটে সে কীভাবে সেমিনারিয়ান হলো সেই প্রশ্নটা ফুটে উঠতে চাইল।

    সে হয়ত আমার ভাবটুকু বুঝতে পেরেছিল। তাই জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?

    “হ্যাঁ। তোমার বক্তৃতা শুরু হওয়ার আগে একজন মহিলা আমার পাশে বসে বলল যে তুমি তাদেরকে এমন একটা জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছ যেটা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। সে এটা দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছিল?

    ও সেটা তেমন কিছু না।

    কিন্তু এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমার জীবনের বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না। এখানে অসংখ্য লোক দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি।

    সে একটু হাসল। তারপর লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ঘুরে তাকাল।

    দাঁড়াও। আমি তার হাত টেনে ধরলাম। “তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। নি।

    ‘আমার মনে হয় না এটা তোমার শুনতে ভালো লাগবে পিলার। সে বলল।

    ‘আমি তারপরেও জানতে চাই।

    সে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আমাকে ঘরের এক কর্ণারে নিয়ে গেল।

    ‘সমস্ত বড় ধর্মগুলোই সেটা ইহুদিবাদ বলো খ্রিষ্টানিটি বলো কিংবা ইসলাম বলো পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষরাই সব কিছুর মূল নেতৃত্বে থাকে। পুরুষরাই নিয়ম নীতি তৈরি করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষরাই হয় ধর্মীয় পাদ্রী। ‘সেই মহিলাটা কি এটাই বোঝাতে চেয়েছিল?

    একটু ইতস্তত করে সে উত্তর দিল, “হ্যাঁ এ বিষয়ে আমার একটু ভিন্ন দৃষ্টি আছে। আমি স্রষ্টার নারীতান্ত্রিক অংশটাতে বিশ্বাস করতে চাই।

    আমি হাফ ছারলাম। কারণ মহিলাটা ভুল করছিল। সে সেমিনারিয়ান হয় নি। কারণ সেমিনারিয়ানদের এ রকম ভিন্ন দৃষ্টি থাকে না।

    ‘তুমি খুব সুন্দরভাবেই বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করেছ। আমি বললাম।

    *

    যে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করেছিল সে আমার জন্য দরজার পাশে অপেক্ষা করছে।

    ‘আমি জানি তুমি আর আমি একই ধারার লোক। আমার নাম ব্রিডা। মেয়েটা বলল।

    ‘আমি জানি না তুমি কি নিয়ে কথা বলছ?’

    অবশ্যই তুমি জান। মেয়েটা হাসল।

    আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা আমার হাত ধরে সেই দালানের বাইরে নিয়ে আসল।

    রাতটা খুব শীতল ছিল। পরদিন সকালে বিলাবো ছাড়ার আগ পর্যন্ত আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে আমি কি করতে যাচ্ছি।

    ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    ‘দেব দেবীর মূর্তিগুলোর কাছে।

    কিন্তু… দেখো এই মুহূর্তে আমি রাতটা কাটানোর জন্য ভালো দেখে একটা হোটেল খুজছি।

    ‘পরে আমি তোমাকে সেরকম একটা হোটেলের সন্ধান দেব।

    আমি চাচ্ছিলাম কোনো একটা গরম কফি হাউজে গিয়ে মেয়েটার সাথে বসে আমার ছেলে বন্ধুটার বিষয়ে আরো কিছু খোঁজ খবর নিই। কিন্তু মেয়েটা আমার সাথে সেরকম কোনো তর্কেই গেল না। সে আমাকে নিয়ে যখন পাছিও ডি কেসেলিনা পার হচ্ছিল তখন আমি মাদ্রিদ শহরটাকে একবার ঘার ঘুড়িয়ে ভালো করে দেখলাম। অনেক বছর হয় আমি এখানে আসি না।

    রাস্তার মাঝ পথে মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেল।

    তারপর আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, “তিনি সেখানে আছেন। আমাদের দেবী।

    রাস্তার অপর পাশে গাছগুলোর নগ্ন শাখার উপর চাঁদ উদারভাবে আলো দিচ্ছিল।

    ‘এটা কি সুন্দর নয়!’ আমি বললাম।

    কিন্তু মনে হলো মেয়েটা আমার কোনো কথাই শুনতে পেল না। সে তার হাত দুটো আকাশের চাঁদের দিকে ফিরিয়ে বিস্তৃত করে দাঁড়িয়ে থাকল।

    ‘আমার ভেতরে আমি কি খুঁজে পেলাম। আমি ভাবলাম। আমি এখানে এসেছিলাম একটা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু এখন এই পাগল মেয়েটার সাথে আমি পাছিও ডি কেসেলিনায় সময় কাটাচ্ছি। আর আগামীকাল আমি বিলবাওতে চলে যাব।’

    ব্রিডা তার হাত দুটো বিস্তৃত করে চোখ বন্ধ করে বলছিল, ‘হে পৃথিবীর দেবীদের আয়না আমাদের ক্ষমতাটুকু আমাদের জানতে দাও। পুরুষজাতি যেন আমাদেরকে বুঝতে পারে। স্বর্গের ভেতরে ভ্রমণের মাধ্যমে তুমি আমাদেরকে বীজ আর ফলের চক্রের বিষয়টা বুঝিয়ে দাও।’

    মেয়েটা আরো কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তার হাত দুটো বিস্তৃত করে রাখল। বেশ কিছু পথচারি তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাসছিল। কিন্তু মেয়েটা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না।

    মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে একমাত্র আমিই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম।

    ‘এটা করা আমার জন্য খুব দরকার ছিল। যাতে দেবী আমাদেরকে রক্ষা করতে পারেন। মেয়েটা তার দীর্ঘক্ষণ চাঁদের ধ্যান থেকে বের হয়ে এসেবলল। “তুমি কি নিয়ে কথা বলছ?

    ‘সেই বিষয় নিয়েই কথা বলছি যেটা নিয়ে তোমার বন্ধু একটু আগে বক্তৃতা দিয়েছিল।

    আমি একটু লজ্জা পেলাম। কারণ আমার বন্ধুর বক্তৃতার প্রতি আমি তেমন মনোযোগ দেয় নি।

    আমরা যখন হাঁটা শুরু করলাম তখন ব্রিডা আবার বলল, আমরা এখন খোদর মাতৃত্বের অংশটাকে জানি। আমরা নারীরা এটা বুঝতে পারছি। ফলে আমাদের মহান মাকে এখন আমরা ভালোবাসি। আমারা এখন মহান মাতার রহস্যকে বুঝতে পারি।’

    আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে আমি আরো ঘনিষ্ঠভাবে দেখলাম। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর। মাথার চুলগুলো কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। ‘যখন পুরুষেরা শিকারের জন্য বাইরে চলে যেত তখন আমরা গুহার ভেতর আমাদের মহান মাতার গর্ভে বসে আমাদের সন্তানদেরকে যত্ন নিতাম, তাদেরকে রক্ষা করতাম। তখনই মহান মাতা আমাদেরকে সব কিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন।

    ‘পুরুষেরা নানা রকম চালচলন দিয়ে বেঁচে থাকত। আর সেই সুযোগে আমরা দেখে নিয়েছিলাম কীভাবে বীজগুলো গাছে পরিণত হচ্ছে। আমরা এগুলো পুরুষদেরকে বলেছিলাম। আমরাই প্রথম রুটিটা তৈরি করেছিলাম। তারপর আমাদের লোকগুলোকে সেটা খেতে দিয়েছি। প্রথম পান পাত্রটি আমরা তৈরি করেছি যাতে করে পানি খেতে পারি। এভাবেই আমরা সৃষ্টি চক্রের বিষয়টা জানতে পেরেছিলাম।

    হঠাৎ করে মেয়েটা তার কথার মাঝে থামল। ঐ তো তিনি সেখানে।

    আমি তাকালাম। রাস্তার ট্রাফিকের চারপাশের ঠিক মধ্যখানে একজন নারী মূর্তির ঝর্ণাধারা। তিনি একটা গাড়িতে বসে আছেন। আর একটা সিংহ সেটাকে টানছে। এ ঝর্ণাধারাটাকে আমি কয়েক ডজন পোস্টকার্ডে দেখেছিলাম।

    তরুণীটা আমার কোনো কথাই শুনছিল না। সে ইতোমধ্যে রাস্তার মাঝে চলে গিয়েছে। প্রচণ্ড গাড়ির ভিড়ের ভেতর দিয়েই সে নিজের রাস্তা তৈরি করে এগুচ্ছিল। গাড়ির ভিড়ের মাঝখান থেকেই সে হাতের ইশারা করে আমাকে ডাকল।

    ‘চলে আসো। আমরা ঐপারে যাই।

    মেয়েটাকে আমি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে ভালো একটা হোটেলের নাম জানতেই হবে।

    আমরা দুজন একই সময়ে ঝর্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার বুকটা তখনো কাঁপছিল।

    কিন্তু মেয়েটার চোখে মুখে কোনো ভয় নেই। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি।

    ‘পানি! পানি হলো তার একমাত্র উদ্দেশ্য, তার লিখিত ঘোষণা।

    “আচ্ছা তুমি কি আমাকে দয়া করে কম দামি একটা হোটেলের নাম বলতে পারবে?

    মেয়েটা তার হাত পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে বলল, তোমারও এমনটা করা উচিত। পানিকে অনুভব করো।

    ‘না! আমি তোমার অভিজ্ঞতাকে নষ্ট করে দিতে চাই না। আমি এখন একটা হোটেলের সন্ধানে যাচ্ছি। আমি বললাম।

    ‘একটু দাঁড়াও। মেয়েটা বলল।

    ব্রিডা তার ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করল।

    আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাঁশির সুরে যাদুকরি একটা আকর্ষণ আছে যা আমাকে মুগ্ধ করে তুলছে। গাড়ির হৈ চৈ-এর মধ্যেও আমার মনটা কেমন শান্ত হয়ে আসছিল।

    আমি ঝর্ণার পাশে বসলাম। পানির শব্দের সাথে সাথে ব্রিডার বাঁশির সুরও শুনছিলাম।

    কোনো না কোনো ভাবে আমি উপলব্ধি করছিলাম যে, চাঁদটা আমার নারীত্বেরই প্রতিচ্ছবি। আমি কীভাবে সেটা উপলব্ধি করছি তার কিছুই বুঝতে পারলাম না।

    আমি জানি না মেয়েটা কতক্ষণ বাঁশিটা বাজিয়েছিল। সে বাঁশিটা থামিয়ে ঝর্ণার দিকে তাকাল।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? তুমি কেন আমাকে তোমার সাথে আসতে বলেছ?

    ব্রিডা আমার দিকে মুখটা ফিরিয়ে বলল, তুমি আমাকে যেমনটা দেখতে চাও আমি সেরকমই। আমি এ পৃথিবীর ধর্মেরই একটা অংশ।

    ‘তুমি আমার কাছে কী চাও?

    ‘আমি তোমার চোখ দুটো পড়তে পারছি। আমি তোমার হৃদয়ের কথাগুলো পড়তে পারছি। তুমি প্রেমে পড়তে যাচ্ছ। খুব কষ্ট পাবে তুমি।

    আমি?

    ‘তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কি বলছি। আমি দেখেছি সে কীভাবে তোমার দিকে তাকিয়েছিল। সে তোমাকে ভালোবাসে।

    মেয়েটা সত্যিই পাগল।

    ‘এই জন্যই আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি। কেননা ঐ লোকটা যাকে তুমি ভালোবাস সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সে বেশ কিছু হাল্কা কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু সে আমাদের মহান মাতাকে চিনতে পেরেছে। তাকে তার পথ থেকে হারিয়ে যেতে দিও না। তাকে সাহায্য করো।

    ‘তুমি জানো না কি নিয়ে কথা বলছ তুমি! তুমি স্বপ্ন দেখছ। কথাগুলো বলে আমি ঘুড়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির ভিড়ের দিকে হাঁটা দিলাম। চেষ্টা করলাম মেয়েটা যা বলেছে তার সবকিছুই ভুলে যেতে।

    *

    রবিবার, ডিসেম্বর ৫, ১৯৯৩

    এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য আমরা থামলাম।

    “হ্যাঁ জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।’

    কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি বললাম।

    “জীবন আমাকে শিখিয়েছে যে আমরাও অনেক কিছু শিখতে পারি, আমরা পাল্টে যেতে পারি। এমনকি এটা যদি অসম্ভবও হয় তাহলেও।’ কথার উত্তরে আমার ছেলে বন্ধুটি বলল।

    বোঝা যাচ্ছিল সে কথার বিষয়টা থামিয়ে দিতে চাচ্ছে। গত দুই ঘণ্টা গাড়ি চালাতে চালাতে আমরা অনেক কঠিন বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তারপর রাস্তার পাশের এই কফি হাউজটা পেলাম।

    শুরুতে আমাদের বাল্যকালের নানা রকম অভিযানের কথা আমি তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু সে আমার কথায় মৃদু সম্মতি দিল। এমনকি আমার মনে হচ্ছিল সে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে না।

    মাঝে মাঝে সে আমাকে এমন কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করছিল যেটা এই কিছু আগেই আমি তাকে বলেছি।

    কোথাও একটা কিছু ভুল হয়েছে।

    সময় আর দূরত্ব কি আমার বন্ধুকে আমার কাছ থেকে চিরতরে দূরে ঠেলে দিয়েছে? আমি নিজেকেই বললাম, “সে আমাকে যাদুকরি মুহূর্তগুলোর কথা বলেছে। সে এখন কেন তার পুরাতন বন্ধুর বাজে স্মৃতির দিকে ফিরে যাবে? সে এখন ভিন্ন এক জগতে বাস করে। সুরিয়া শহর এখন কেবলই তার কাছে স্মৃতি।

    তার সাথে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। আমি নিজের কাছে নিজেই ভুল স্বীকার করলাম।

    তাই সে যখন কথা বলার বিষয় পাল্টাতে চাইল তখন আমি আর দ্বিতীয়বার তাকে একই কথার দিকে টেনে আনতে চেষ্টা করলাম না।

    .

    বিলবাওর দিকে যাত্রা পথে শেষের দুই ঘণ্টা আমার কাছে কেবল যাতনাই মনে হলো।

    সে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম।

    আমাদের মাঝে যে তিক্ত অনুভূতিটুকু ফুটে উঠেছিল সেটা আমরা দুজনেই লুকোচ্ছিলাম না।

    ভাড়া করা গাড়িটার কোন রেডিও ছিল না। ফলে চুপ করে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।

    আমরা যখন বড় রাস্তা পার হয়ে আসলাম তখন আমি বললাম, ঠিক আছে চালককে জিজ্ঞেস করো বাসের স্টপেজটা কোথায়? জারাগোজার উদ্দেশ্যে এখান থেকেই কোথাও প্রতিদিন বাস ছেড়ে যায়।

    রাস্তায় লোকজন খুব কম ছিল।

    একজন ভদ্রলোক আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। তারপর একজোড়া কম বয়সি যুবক যুবতী। কিন্তু আমার বন্ধু কাউকেই জিজ্ঞেস করার জন্য থামাল না।

    ‘তুমি কি জানো বাস স্টেশনটা কোথায়? কিছু সময় পার হওয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    ‘কোথায় কি?’ সে বলল।

    বুঝতে পারলাম সে এখনো আমার কথায় মন দিচ্ছে না।

    হঠাৎ করেই আমি বুঝলাম কেন তার এ নিরবতা। সে এ ধরনের মেয়ে মানুষের সাথে তো স্বাভাবিক হতে পারে না যে এখনো তার শৈশব নিয়ে পড়ে আছে, কিংবা যে অনিশ্চিতকে ভয় পায়, যেই মেয়েটা খুব স্বাভাবিক একটা জীবন আর নিরাপদ চাকরিই শুধু প্রত্যাশা করে। আমাকে ধিক্কার, যে কেবলই তার ক্ষয়ে যাওয়া ধূলিপূর্ণ শৈশব নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করেছে।

    আমরা যখন শহরের মাঝামাঝি চলে আসলাম তখন আমি বললাম, তুমি আমাকে এখানে ছেড়ে দিতে পারো। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম তারপরেও আমার কথার মাঝে এক ধরনের শিশু সুলভ বিরক্তি আর অভিমান ফুটে উঠছিল।

    সে গাড়ি থামাল না।

    ‘জারাগোজার দিকে যে বাস যাচ্ছে আমাকে সেটা ধরতে হবে। আমি আবারো জোড় দিয়ে বললাম।

    ‘আমি এখানে আগে কখনোই আসি নি।’ সে বলল। আমার হোটেলটা কোথায় আছে সে বিষয়ে কোনো ধারণা এখন আমার নেই। আমি জানি না কোথায় সম্মেলনটা হয়েছিল এবং বাস স্টেশন কোথায়।

    ‘ভয় পেয়ো না আমি সব কিছু ঠিকভাবে চিনে নেব।’

    সে গাড়ির গতি কমাল তবে গাড়ি থামাল না। চালিয়ে যেতে লাগল।

    ‘আমি আসলে…’ সে কথা বলা শুরু করল।

    কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু তার ভাবনাটা শেষ করল না।

    আমি ঠিক কল্পনা করতে পারছিলাম যে সে কি ভাবছে। সে হয়ত আমাকে ধন্যবাদ দিবে, আমাদের মাঝের অস্বস্থি দূর করার জন্য আরো কিছু বলবে।

    ‘আমি আসলে ভীষণ ভাবে চাই যে তুমি আমার সাথেই থাক। আমার সাথেই আবার সম্মেলনে যোগ দাও। অবশেষে সে দম নিয়ে বলল।

    আমি খুব অবাক হলাম। এই কথাটা বলার জন্য সে এতক্ষণ সময় নিয়েছে, গাড়ি ভ্রমণে বাজে ভাবে চুপ করেছিল?

    ‘তুমি আমার সাথে থাকলে খুশি হতাম। সে আবারো একই কথা বলল।

    আমি বুঝতে পারলাম এখানে কোন ভনিতা নেই, সে যা বলছে সেটা সত্যিই বলছে।

    আমি একটা প্রশান্তির শ্বাস ফেললাম। আমার বন্ধু যদি ফিরে না আসত তাহলে এ ধরনের কোনো সম্মেলনে আমি কিছুতেই অংশগ্রহণ করতাম না। আমার বন্ধু আমাকে তার আনন্দ বেদনা,অভিযান, ভয় আর বিজয়ের অনুভূতিগুলোর অংশিদার হওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করছে।

    ‘তোমার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। আমি বললাম। কিন্তু কোনো হোটেলে থাকার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট টাকা নেই। তাছাড়া আমাকে পড়াশোনায় আবার ফিরে যেতে হবে।

    ‘আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তুমি আমার ঘরে থাকতে পারবে। দুটো বিছানার ব্যবস্থা আমি করে ফেলব।

    আমি লক্ষ্য করলাম বাইরে বেশ ঠাণ্ডা বাতাস থাকার পরেও সে ঘামছে।

    একটা সংশয়ে আমার বুকটা ধক করে উঠল।

    হঠাৎ করেই সে গাড়িটা থামিয়ে সোজা আমার চোখের দিকে তাকাল।

    সে যখন কারো চোখের দিকে সরাসরি তাকায় তখন কেউ মিথ্যা বলতে পারে না, কেউ নিজের মনের ভেতর কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারে না। আর তখন যে কোন নারী যার ন্যূনতম ভালোবাসার অনুভূতি আছে সে এই প্রেমিক পুরুষটির ভালোবাসার কথাটা পড়ে ফেলতে পারবে।

    আমি মুহূর্তেই ঝর্ণার পাশে সেই উদ্ভট মেয়েটার কথাগুলো ভাবলাম।

    বিষয়টা অসম্ভব মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে সেটা সত্যি হতে যাচ্ছে।

    এতগুলো বছর পার হওয়ার পরও আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সে সব কিছুই মনে রেখেছে।

    আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন সব জায়গায় আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে যেতাম। তার প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল। যদিও একটা শিশু ভালোবাসার কিই বা বোঝে।

    কিন্তু সেটা অনেক কাল আগে ছিল। সেটা ছিল অন্যরকম এক জীবন। এমন এক জীবন যার নিষ্পাপ মুহূর্তগুলো আমার হৃদয়ের কাছে কেবল সত্য সুন্দরের দরজাগুলো খুলে দিয়েছিল।

    আর এখন আমরা দায়িত্ববোধ সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন মানুষ।

    শিশুসুলভ বিষয়গুলো যেভাবেই হোক আমাকে এড়িয়ে যেতে হবে।

    আমিও তার চোখের দিকে তাকালাম।

    তার চোখের ভেতর আমি যা দেখলাম সেটা দেখতে আমি চাচ্ছিলাম না। কিংবা আমি হয়ত সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

    ‘এটাই আমার শেষ সম্মেলন ছিল। এখন আমার ছুটি। সেই পাহাড়গুলোতে আমাকে যেতে হবে। সেখানে আমি তোমাকে একটা বিশেষ কিছু দেখাব।’ এই মেধাবী ছেলেটা যে কিনা মানুষকে যাদুকরি সব মুহূর্তের কথা শুনিয়ে বেড়াচ্ছে আমি দেখলাম সে এখন একেবারে আনাড়ি শিশুর মতোই আচরণ করছে।

    সে খুব দ্রুত হাঁটছিল। মনে হচ্ছিল যা সে প্রস্তাব করেছে সেই বিষয়ে তার নিজেরই সংশয় আছে।

    তাকে এই অবস্থায় দেখে আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।

    গাড়ির দরজা খুলে আমি নেমে পড়লাম। কাছাকাছি একটা রাস্তার দিকে চোখ রাখলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে চেষ্টা করছিলাম আমার ভেতরে যে ভাবনাগুলো ছিল সেগুলো ঢেকে রাখতে। ভান করার চেষ্টা করলাম যে আমার বন্ধু যা বলছে আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না।

    সে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

    ‘আমি সত্যিই চাই তুমি আজকের রাতের সম্মেলনে উপস্থিত থাকো। সে কথা বলা শুরু করল। অবশ্য যদি না থাকতে পারো তাহলে কি আর করার।

    আমি একই সাথে খুব বোকার মত ভাবছিলাম আবার কিছুটা শান্তিও পেলাম।

    হ্যাঁ আমি আরো একটা দিন এখানে থাকতে পারি। এক সাথে রাতের খাবার খেয়ে কিছুটা পানিয় খেতে পারি- ছোটবেলায় আমরা যার কিছুই করি নি। আমাদের মধ্যে এখনো যে শীতলতাটুকু আছে সেটা হয়ত এই সুযোগে গলে যাবে।

    একটা দিন তেমন কিছু পরিবর্তন আনবে না। আমার যে গল্পটা আছে সেটা হয়ত আমার বন্ধুকে বলার সুযোগ আমি পাব।

    ‘আলাদা বিছানা। আমি হাসতে হাসতে মজা করে বললাম। আর রাতের খাবারের বিল তুমি দিবে। আমি এখনো ছাত্রি।

    .

    হোটেলের নির্ধারিত কক্ষে আমাদের ব্যাগগুলো রেখে যেখানে সম্মেলন হবে সে জায়গাটায় আমরা চলে আসলাম। যেহেতু আমরা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসলাম তাই একটা কাফেতে বসে কিছু সময় অপেক্ষা করলাম।

    ‘আমি তোমাকে একটা জিনিস দিতে চাই। ছোট্ট একটা থলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল।

    আমি থলেটা খুলে সেখানে খুব পুরাতন একটা মেডেল পেলাম, যার এক পাশে আমাদের মহান মাতার ছবি আর অন্য পাশে যিশুর আতংকিত হৃদয়ের ছবি।

    ‘এটা তোমার ছিল। সে বলল।

    আমার অন্তরে আবারো একটা সর্তক ঘণ্টা বাজতে শুরু করল।

    ‘একদিন আজকের মতই শরতের সুন্দর একটা মুহূর্ত ছিল। আমাদের বয়স তখন ছিল দশ। আমি তোমার সাথে বিশাল ওক গাছের কাছে বসেছিলাম। সে বলল।

    ‘আমি তোমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম। এমন কিছু একটা যেটা বলার জন্য এক সপ্তাহ ধরে অভ্যেস করে রপ্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। আমি যখন তোমাকে কথাটা বলা শুরু করলাম তখন তুমি হঠাৎ করেই বলা শুরু করলে যে তোমার মেডেলটা তুমি হারিয়ে ফেলেছ। তুমি আমাকে বললে আমি যেন সেটা খুঁজে দেই।

    আর ঠিক তখনই হে ঈশ্বর আমার সব কিছু মনে পড়ে গেল।

    ‘আমি ঠিক তোমার মেডেলটা খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি যখন মেডেলটা নিয়ে সেই ওক গাছটার কাছে আসলাম তখন এক সপ্তাহ ধরে যে কথাটা বলার জন্য অভ্যেস করেছিলাম সেই কথাটা তোমাকে বলতে উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম ঠিক বিশ বছর আগে আমি যে কথাটা বলা শুরু করেছিলাম সেই কথাটা যখন আমি তোমাকে বলতে পারব তখনই আমি তোমাকে এই মেডেলটা ফেরত দেব। আমি দীর্ঘদিন এটাকে ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এটা সব সময় আমার সাথেই ছিল। এটা ছাড়া আমি একটা মুহূর্তও থাকতে পারিনি। সে বলল।

    সে কফি নামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর দীর্ঘক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।

    আমার দিকে ঘুড়ে তাকিয়ে সে বলল, এটা খুব সাধারণ একটা কথা। আমি তোমাকে ভালোবাসি।

    *

    কখনো কখনো অনিয়ন্ত্রিত দুঃখি মুহূর্তগুলো আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলে।’ সে বলল।

    ‘আমরা বুঝতে পারি দিনের যাদুময় মুহূর্তগুলো পার হয়ে গেছে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারি নি। জীবন তার অলৌকিকতা আর শিল্পকে ভুলতে শুরু করেছে।

    আমাদের ভেতরে কোনো এক কালের যে শিশুটা বাস করে তার কথা শুনতে হবে। সেই শিশুটা অলৌকিক মুহূর্তগুলোকে খুব ভালো বুঝতে পারে। আমরা হয়ত সেই শিশুর কান্নাকে জোর করে থামিয়ে দিতে পারব কিন্তু তার কথাকে থামাতে পারব না।

    আমাদের ভেতরে সেই শিশুটা এখনো আছে।

    আমরা যদি আবার নতুন করে জন্ম না নেই- যদি সেই শিশু সুলভ নিষ্পাপ দৃষ্টি ভংগি আর কৌতূহলি চোখ দিয়ে জীবনকে দেখতে না শিখি তাহলে বেঁচে থাকার বিষয়টা আমরা বুঝতে পারব না।

    আত্মহত্যা করার জন্য অনেক উপায় আছে। ঈশ্বরের নিয়ম ভংগ করে যারা নিজেদেরকে নিজেদের আত্মাকে ধ্বংস করে তাদের পাপকর্মের পরিমাণ কম হলেও তারা দোষী।

    আমাদের হৃদয়ের ভেতর যে শিশুটা আছে সে কি বলে আমাদেরকে সেদিকে মানোযোগ দিতে হবে।

    আমাদের ভেতরের সেই শিশুটাকে কিছুতেই আতংকিত করা চলবে না।

    কারণ সে বড় একা, নিঃষঙ্গ।

    আমাদের জীবনের লাগামটা সেই শিশু যেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

    সেই শিশুটা জানে যে জীবনের প্রতিটি দিন একটার চেয়ে অন্যটা আলাদা। প্রতিটিই স্বতন্ত্র।

    তাকে ভালোবাসার বিষয়টা বুঝতে দিতে হবে। এই শিশুটাকে সুখী করতে হবে।

    প্রয়োজনে যে কাজটা আমরা করতে অভ্যস্ত নই যে কাজটা করলে লোকে আমাদেরকে বোকা বলবে সেই কাজটাও করার ভান করতে হবে।

    মনে রাখবেন ঈশ্বরের চোখে মানুষের জ্ঞান এক ধরনের পাগলামি আর বোকামি ছাড়া কিছুই না।

    কিন্তু আমাদের ভেতরে যেই শিশুটা আছে আমরা যদি তাকে শুনি তাহলে আমাদের চোখগুলি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

    আমরা যদি সেই শিশুর সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ না করি তাহলে জীবনের সাথেও আমাদের সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হবে না।

    *

    আমার চারপাশের রঙগুলো খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। আমি ধীরে ধীরে খুব উত্তেজিত হয়ে কথা বলা শুরু করলাম।

    টেবিলের উপর পানির গ্লাসটা বেশ শব্দ করে রাখলাম।

    সম্মেলনের পরে রাতের খাবারের জন্য আমরা দশজনের একটা দল একত্রে বসেছিলাম। সবাই এক সাথে কথা বলছে। বিশেষ এই রাতের কারণে আমি খুব হাসছিলাম। অনেকগুলো বছরের মধ্যে এই রাতটাই প্রথম একটা রাত যেটাকে আমি কখনো কল্পনাও করি নি।

    কি আনন্দ!

    মাদ্রিদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছিলাম তখন পর্যন্ত আমার কার্যকলাপ আর অনুভূতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল আমার। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই সব কিছু পাল্টে গেছে।

    এখানে এমন এক শহরে আমি বসে আছি যেখানে ইতোপূর্বে আমার পায়ের চিহ্ন পড়ে নি।

    যে টেবিলটাতে আমি বসে আছি সেখানে আমি মাত্র একটা লোককে চিনি। আর টেবিলের চারপাশ ঘিরে আমন্ত্রিত লোকজন আমার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা বছরের পর বছর ধরে আমাকে চেনে।

    তাদের সাথে কথা বলে, পানীয় পান করে আড্ডা দিয়ে আমি খুব আনন্দ পেলাম।

    আমি সেখানে আছি কারণ হঠাৎ করেই জীবন আমার কাছে তার সত্যিকার জীবনের চেহারাটা নিয়ে হাজির হয়েছিল।

    আমার কোন অপরাধবোধ, কোন ভয় কিংবা কোন রকম বিব্রতবোধ করছিলাম না।

    আমি যতই আমার বন্ধুর কথা শুনছি আর তার ঘনিষ্ঠ হচ্ছি আমার ততই মনে হচ্ছিল না আমার বন্ধুই সঠিক। সে ঠিক কথাটাই বলছে।

    .

    আমার নিজের লেখা নিজের নোটবুকটার সাথে দিনের পর দিন আমি কাটিয়েছি। আতি মানবিক চেষ্টা দিয়ে নিজের দাসত্বকে কীভাবে ক্রয় করা যায় তার চেষ্টা করেছি। আমি ভাবলাম।

    এই রকম একটা কাজ আমার কেন দরকার? একজন মানুষ হিসেবে একজন নারী হিসেবে এই চাকরিটা আমাকে কি দিতে পারে?

    .

    কিচ্ছু না! একটা ডেস্কের পাশে বসে অন্যলোকদের বিষয় সম্পর্কিত কাজ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজের পুরো জীবনটা নষ্ট করার জন্য আমার জন্ম হয় নি।

    .

    না না আমি এভাবে নিজের জীবনকে নিয়ে ভাবতে পারি না। এ সপ্তাহেই আমাকে ফিরে যেতে হবে। যে যাই বলুক না কেন তুমি যদি কাজ না করো তোমাকে না খেয়ে থাকতে হবে। এসব কিছু হলো কেবলই স্বপ্ন। এটার শেষ আছে।

    কিন্তু কতক্ষণ আমার এই স্বপ্ন দীর্ঘ হবে?

    .

    এই প্রথমবার আমার বন্ধুর সাথে পরের সপ্তাহটা পাহাড়ি উপত্যকায় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ এর পরই এক সপ্তাহের লম্বা একটা ছুটি শুরু হবে।

    ‘তুমি কে?’ আমাদের টেবিলেই বসা একজন মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করল।

    ‘আমি ওর ছেলেবেলার বন্ধু। আমি উত্তর দিলাম।

    ‘এখন যে ধরনের কাজ করছে সে যখন ছোট ছিল তখনো কি এই সব করত?

    ‘কি ধরনের কাজ?

    টেবিলে আলোচনাটা একটু মন্থর হয়ে এল।

    “তুমিতো জানো : এই সব অলৌকিকতা,যাদু।

    ‘আমার বন্ধু সব সময় ভালো কথাই বলত।’ এই মহিলাটা আসলে কি। বলতে চাইছিল আমি সেটা ধরতে পারিনি।

    আমার বন্ধুসহ আশপাশের সকলেই হেসে উঠল। আমি বুঝতেই পারলাম না কি ঘটতে যাচ্ছে। তবে হয়ত মদ খেয়েছি বলেই আমার তেমন কোন অস্বস্তি হচ্ছিল না। আমি বেশ শান্তই ছিলাম।

    চারপাশ একবার তাকিয়ে পরের মুহূর্ত কি হবে সেটা ভুলে গিয়ে আমি কিছু একটা বললমা। আমি আসছে ছুটির মুহূর্তগুলো নিয়েই আসলে ভাবছিলাম।

    খুব হাসিখুশি ভাব নিয়ে নতুন নতুন সব লোকদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সব কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছিল।

    আমার কাছে মনে হচ্ছিল অন্তত এই একটা রাত আমি সত্যিকার পৃথিবীর সাথেই আছি। আমি যখন জারাগোযায় ফিরে যাব তখন বলে বেড়ানোর মত অনেক গল্প আমার কাছে থাকবে।

    আজকে যদি আমার বন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে পরের ছুটির দিনগুলো তার সাথে কাটাই তাহলে সারাটা জীবন পার করে দেওয়ার জন্য বছরের পর বছরের মধুর স্মৃতি আমার কাছে জমা হয়ে থাকবে।

    সুরিয়াদের নিয়ে আমার যে মন্তব্য ছিল সেটা শুনে আমার বন্ধুর চুপ থাকাটাই উপযুক্ত কাজ ছিল। আমি ভাবলাম।

    ‘আরেকটু মদ দেই তোমাকে। সাদা চলের একজন লোক আমার গ্লাসটায় মদ ঢেলে দিয়ে বলল।

    আমি মদ খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম এখানে আমার বন্ধুর কাছে যদি আমি না আসতাম তাহলে আমার সন্তান বা নাতিপুতিদের বলার মতো কিছুই থাকত না আমার কাছে।

    ‘ফ্রান্সদের দিকে আমাদের যাত্রাপথ নিয়েই আমি ভাবছি। খুব নিচু স্বরে আমার বন্ধু আমাকে কথাটা বলল। সেটা শুধু আমিই শুনতে পেলাম।

    মদ আমার মুখের জড়তা দূর করে দিয়েছে।

    কিন্তু তোমাকে একটা জিনিস বুঝতেই হবে।

    কি সেটা?

    সভা শুরু হওয়ার আগে তুমি কি বলেছিলে? সেই কফি হাউজে?

    ‘মেডেল?’

    ‘না’। আমি সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম। আমার কোনো দ্বিধাই হচ্ছিল না। কি বলেছিলে তুমি?

    “ঠিক আছে তাহলে এটা নিয়ে পরে কথা বলব। সে খুব দ্রুত কথার বিষয় পাল্টাতে চেষ্টা করল।

    সে বলেছিল যে সে আমাকে ভালোবাসে। এটা নিয়ে কথা বলার মতো সময় এখন আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমি জানতাম এটা যে একটা মিথ্যা কথা আমার বন্ধুকে সেটা আমি বোঝাতে পারব।

    তুমি যদি তোমার ভ্রমণের সংগি হিসেবে আমাকে নিতে চাও তাহলে অবশ্যই আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। আমি বললাম।

    ‘এই বিষয় নিয়ে ঠিক এখানে আমি কোন কথা বলতে চাই না। খুব সুন্দর একটা সময় কাটছে এখন।

    ‘তোমার যখন বয়স একদম কম ছিল তখন তুমি সুরিয়া চলে এসেছ। আমি কথা চালিয়ে যেতে থাকলাম। আমি হলাম তোমার অতীতের সাথে একমাত্র যোগসূত্র। তোমার মূলকে আমিই চিনিয়েছি। এইগুলোই সত্য। সেখানে কোনো ভালোবাসা জড়িত থাকতে পারে না।

    আমার কথাগুলো সে শুনল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না।

    কেউ একজন তাকে অন্য একটা বিষয়ে তার মতামতের কথা জিজ্ঞেস করল। ফলে আমাদের কথায় বাধা পড়ল।

    আমি কি ভাবছিল অন্তত সেটা তাকে খুলে বলতে হবে। আমি ভাবলাম। যে ভালোবাসার কথা সে বলছে সেই ভালোবাসা কেবল ভূত পরীদের গল্পে পাওয়া যায়।

    বাস্তব জীবনে ভালোবাসাকে সত্যিকার অর্থেই সম্ভব হতে হবে। এটা যদি সঠিক পথে নাও আসে তবুও। যখন আশা থাকে তখনই ভালোবাসা বিজয়ী হয়। তখনই তুমি মনের মানুষের উপর জয়ী হতে পারবে।

    এর বাইরে সব কিছু হলো গালগল্প।

    টেবিলের অন্য পাশ থেকে আমার বন্ধু আমি কি ভাবছিলাম সেটা অনুমান করতে পেরে তার গ্লাসটা উঁচু করে আমার দিকে তুলে বলল, “ভালোবাসার জন্য।’

    আমি বলতে পারি আমার বন্ধু কিছুটা মাতাল হয়েছে। তাই সুযোগটাকে আমি কাজে লাগাতে চাইলাম।

    আমি বললাম, এটা ঐ যথেষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে যারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে ভালোবাসাটা আসলে বাল্যকালের নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।

    ‘জ্ঞানীরা এই জন্যই জ্ঞানী যে তারা ভালোবাসে। আর বোকারা এই জন্যই বোকা যে তারা মনে করে ভালোবাসাকে তারা বুঝতে পেরেছে। উত্তরে সে বলল।

    টেবিলের চারপাশে যারা ছিল তারা কথাগুলো শুনল। মুহূর্তের মধ্যেই ভালোবাসা নিয়ে একটা জমপেশ তর্ক জমে উঠল।

    তর্কের উত্তেজনা এতই উঁচুতে উঠল যে সেটাকে শান্ত করার জন্য আরো বেশি করে মদ খেতে হলে সবাইকে।

    শেষ পর্যন্ত একজন বলল যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হোটেলের মালিক হোটেল বন্ধ করতে চায়।

    ‘আমাদের আরো পাঁচদিন ছুটি আছে। টেবিলের অন্যপাশ থেকে আরেকজন চিৎকার করে বলল। আসলে হোটেলের মালিক এটা বন্ধ করতে চাইছে কারণ তুমি বিষয়টা নিয়ে খুব গুরুত্বের সাথে ভাবছ।

    আমি ছাড়া সকলেই হেসে উঠল।

    ‘এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা কোথায় আলোচনা করতে পারি? আরেকজন টালমাটাল হয়ে বলল।

    ‘সেটা কোনো চার্চে হতে পারে।

    এই কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম।

    আমার বন্ধুটা উঠে দাঁড়াল। ভাবলাম সে হয়ত কোন একটা কিছু করে বসবে। কারণ আমরা সবাই শিশু সুলভ পাগলামি শুরু করেছিলাম।

    কিন্তু সে তেমন কিছু না করেই আমার হাতটা ধরল। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, “আমাদেরকে যেতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

    *

    বিলবোতে বৃষ্টি হচ্ছে।

    প্রেমিক হৃদয়ের জানা দরকার কীভাবে নিজেকে হারিয়ে আবার খুঁজে পেতে হয়। আমার বন্ধু এই দুটো কাজই খুব ভালোভাবে করতে পারে। সে এখন খুব সুখি। আমরা যখন হোটেলে ফিরছিলাম সে গুনগুন করে গান করছে। গানের কথাগুলো আসলে সত্যিই ছিল।

    যে লোকটা ভালোবাসাকে আবিষ্কার করেছিল সে আসলেই উন্মাদ ছিল।

    মদের প্রভাব আমি তখনো বোধ করছিলাম। তবে চেষ্টা করছিলাম আরো পরিষ্কারভাবে চিন্তাভাবনা করতে।

    তার সাথে ভ্রমণ শুরু করার আগে আমাকে সব কিছু নিয়ন্ত্রিতভাবে চিন্তা করতে হবে।

    আমি অবশ্য খুব আবেগপ্রবণ না হওয়ায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা আমার জন্য সহজই ছিল। আমি ভাবলাম। প্রেমিকার হৃদয় যে দখল করতে পারে সে পুরো পৃথিবী দখলে নিতে পারে।

    আমার অন্তরকে নিয়ন্ত্রণের কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি যদি পরের এক সপ্তাহের জন্য নিজেকে সমর্পণ করি তাহলে এই যে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছে এর অনুভূতিটা হবে আমার জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।

    ভালোবাসা যদি সত্যিই সহজ হয় তাহলে আমার বন্ধুর কাছে আমি খুব বিত হয়ে পড়ব। তার গানের কথাগুলো হবে আমাদের জীবনের গল্প। এ অবকাশের পর জারাগোজা যদি আমার জন্য অপেক্ষা না করে তাহলে আমি মদ খেয়ে আরো মাতাল হবো, আমার বন্ধুকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে চুমু খাব। তার যত্ন নেব, একজন প্রেমিক পুরুষ যা বলে আমি সেটা তার কাছ থেকে শুনব।

    কিন্তু না আমি আসলে এটা করতে পারব না। আমি এটা করতে চাই না।

    আমার বন্ধুটি এখনো জানে না যে আমি তাকে হ্যাঁ বলতেই যাচ্ছি।

    আমি কেন এই ঝুঁকিটা নিতে যাচ্ছি?

    কারণ আমি মদ্যপ অবস্থায় আছি। যে দিনগুলো আমি পার করে এসেছি সেগুলো নিয়ে আমি এখন ক্লান্ত।

    .

    না আমাকে জারাগোজায় ফিরে যেতে হবে। যেখানে আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছি। আমার শিক্ষা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি যেইরকম একটা স্বামী খুঁজছি সেইরকম একজন মানুষ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেরকম একজন স্বামী খুঁজে বের করা খুব কঠিণ কিছু না।

    আমার জন্য সেখানে অত্যন্ত সহজ একটা জীবন অপেক্ষা করছে। সেখানে সন্তান থাকবে, নাতি থাকবে, বছরে একটা ছুটি থাকবে। সে কি নিয়ে ভয় পাচ্ছে সেটা আমি জানি না, তবে আমার নিজেরটা আমি ঠিক জানি। নতুন করে আর কোন ভয় আমি নিতে চাই না। আমার নিজেরটাই যথেষ্ট।

    .

    আমি নিশ্চিত ছিলাম তার মতো একটা মানুষের প্রেমে আমি জীবনেও পড়ব না। আমি তাকে খুব ভালো করেই জানতাম, তার সমস্ত দুর্বলতা, ভীতি। অন্যরা তাকে যেভাবে প্রশংসা করছিল সেভাবে তাকে আমার প্রশংসা করা সম্ভব না।

    কিন্তু ভালোবাসা হলো একটা বাধের মতো। তুমি যদি তার মধ্যে ছোট্ট একটা ফুটো করে পানি ঢুকতে দাও তাহলে কিছু সময়ের মধ্যেই সেটা বড় ফাটল হয়ে তার ভেতর দিয়ে পানির স্রোত ঢুকতে থাকবে। কেউ সেই স্রোত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পুরো বাধের গঠনটা ভেঙে পড়বে।

    .

    না, না, আমি কিছুতেই ভালোবাসার মধ্যে সেরকম একটা ফাটল ধরাতে চাই না। সেটা যত ছোটই হোক না কেন।

    .

    ‘এই একটু দাঁড়াও।

    হঠাৎ করেই আমার বন্ধু তার গানটা থামিয়ে দিয়ে বলল। আমাদের আশপাশে কয়েকটা পায়ের দ্রুত শব্দ শোনা গেল।

    ‘চলো দ্রুত এখান থেকে চলে যাই। সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল।

    ‘দাঁড়ান। একজন লোক বলল। আপনার সাথে আমার কথা বলা দরকার।

    কিন্তু সে আরো দ্রুত সরতে লাগল।

    ‘এখানে আমাদের করার কিছুই নেই। চলো হোটেলে ফিরে যাই। সে বলল।

    আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। টের পেলাম মাতলামির বিষয়টা অনেক আগেই কেটে গেছে। আমার মনে পড়ল বিলবাও হলো একটা সন্ত্রাসী প্রধান এলাকা। এখানে সন্ত্রাসী আক্রমণ খুব সাধারণ বিষয়। লোকজনের পায়ের শব্দ খুব কাছাকাছি চলে আসল।

    ‘চলো এখান থেকে ভাগি। সে আরো দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বলল।

    কিন্তু এর মধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। একজন লোক মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীর ঢেকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।

    ‘দয়া করে দাঁড়ান। ঈশ্বরের ভালোবাসার কসম।

    আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। চারপাশটা ভাল করে তাকাচ্ছিলাম যে কোনো ভাবে বের হওয়ার কোন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। ভাবছিলাম অলৌকিক ভাবেই যদি এই মুহূর্তে পুলিশের গাড়ি এসে উপস্থিত হতো তাহলে খুব ভালো হতো।

    দয়া করে একটু দাঁড়ান। লোকটা আবারো বলল। আমি শুনেছিলাম আপনি এই শহরেই আছেন। আপনার সাহায্য আমার খুব দরকার। এটা আমার ছেলে। লোকটা মাটিতে বসে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।

    ‘দয়া করুন, দয়া করুন।

    আমার বন্ধু লম্বা করে দম নিল। আমি লক্ষ্য করলাম সে তার মাথাটা নিচ করে চোখ দুটো বন্ধ করল। নিরবতার কয়েকটা মুহূর্ত বৃষ্টির শব্দে ভেঙে গেল। লোকটা তখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল।

    ‘হোটেলে চলে যাও পিলার। অবশেষে সে বলল। একটু ঘুমাও। আমি সকালে চলে আসব।

    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো
    Next Article ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    Related Articles

    পাওলো কোয়েলহো

    দ্য এ্যালকেমিস্ট – পাওলো কোয়েলহো

    September 10, 2025
    পাওলো কোয়েলহো

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 10, 2025
    পাওলো কোয়েলহো

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 10, 2025
    পাওলো কোয়েলহো

    ইলেভেন মিনিটস – পাওলো কোয়েলহো

    September 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }