Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঘের মন্তর

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প11 Mins Read0

    বাঘের মন্তর

    বাইরে বেশ শীত সেদিন। রায়বাহাদুরের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে বেশ গল্প জমেছিল। আমরা অনেকে ছিলাম। ঘন ঘন গরম চা ও ফুলুরি-মুড়ি আসাতে আসর একেবারে সরগরম হয়ে উঠেছিল।

    রায়বাহাদুর অনুকূল মিত্র একজন মস্ত বড়ো শিকারি। আমরা কে তাঁর কথা না শুনেছি? তাঁর ঘরে ঢুকে চারিদিকে চেয়ে শুধু দেখবে— মরা বাঘ ও ভালুকের চামড়া, বাঘের মুখ, ভালুকের মুখ বাঁধানো; ঘরগুলো দেখে মনে হয়— ট্যাক্সিডারমিস্টের কারখানায় বুঝি এসে পড়লাম।

    কিন্তু সেদিন আর-একজন লম্বা মতো প্রৌঢ় ব্যক্তিকে রায়বাহাদুরের অতিকাছে বসে থাকতে দেখে ও শিকার সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। রায়বাহাদুরের সামনে শিকারের কথা বলে এমন লোক তো আজও দেখিনি! যে অনুকূল মিত্র জীবনে ত্রিশটি রয়েল বেঙ্গল, পনেরোটি লেপার্ড মেরেছেন, ভালুক ও বুনো শুয়োরের তো লেখাজোখা নেই। এ ছাড়া আছে গণ্ডার, আছে বাইসন, আছে অজগর-পাইথন, আছে শজারু, আছে কাক বক হাঁস, এ-হেন রায়বাহাদুরের পাশে বসে শিকারের কথা বলা! নাঃ, লোকটা কে হে? বড়ো কৌতূহল হল জানবার।

    উপেনবাবু, আমাদের উপেন মাইতি আপন মনে চা খেয়েই চলেছেন, তাঁকে দেখে বললাম— ও উপেনবাবু, ওই লোকটি কে?

    উপেনবাবু যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে বলে উঠলেন— অ্যাঁ? কই, কে?

    —ঘাবড়াবেন না। ওই আধ-বুড়ো লোকটি কে?

    —উনি?

    —হুঁ, বলুন না।

    —বিজ্ঞ-শিকারি নিধিরাম ভট্টাচার্য।

    —নামটা যেন নৈয়ায়িক পণ্ডিতের মতো শোনালো। আপনি অনায়াসে বলতে পারতেন— নৈয়ায়িক নিধিরাম সার্বভৌম।

    —তা, শিকারের ব্যাপারে উনি নিতান্ত কেউকেটা নন! ওঁর ‘শিকার-যোগ’ বই পড়েননি? তিনটে এডিশন হয়ে গেল। আসুন আলাপ করিয়ে দিই।

    আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। নিধিরাম ভট্টাচার্য যে কোনোকালে চাল-কলা বাঁধা পুরুত ছিলেন না, তা তাঁর কথাবার্তার ধরনে আগেই বুঝেছিলাম; এখন সেটা আরও ভালো করে জানা গেল। নানা স্থানের বাঘ-ভাল্লুকের শিকার কীভাবে হয় সে গল্প করলেন। রাত্রে কীভাবে গাছের উপর বসে কাটিয়েছেন, কোন জঙ্গলে একবার বাঘের মুখে পড়েছিলেন, ইত্যাদি নানা গল্প। লোকটি ভালো গল্প বলতে পারেন। এমন সুন্দর, নিখুঁতভাবে গল্প বলছিলেন যে, আমরা ঘটনাবলি যেন চোখের ওপর ঘটতে দেখছি। আরও দেখলাম, নিধিরাম বেশ প্রকৃতি-রসিক ব্যক্তি। জ্যোৎস্না রাত্রি ও বর্ষামুখর শ্রাবণ রাত্রিগুলির এমন সুন্দর বর্ণনা দিচ্ছিলেন মুখে মুখে! আমি বললাম— একটা কিছু আশ্চর্য ঘটনা বলুন।

    নিধিরাম ভটচাজ বললেন— সবই আশ্চর্য। বনের সব ব্যাপারই আশ্চর্য।

    —তবুও।

    —তবুও কী? ভূত দেখিনি কখনো চোখে।

    —বিশ্বাস করেন?

    —না।

    বা-রে, এ-আবার অতি অদ্ভুত লোক। বাঙালি হয়ে ভূতে বিশ্বাস করে না, এমন লোক তো দেখিনি! পরে কথার ভাবে বুঝলাম তিনি তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাসী। বললাম— আপনাদের তন্ত্রশাস্ত্রে ভূত মানে না?

    —তন্ত্রশাস্ত্র আমি পড়িনি। মন্তর-তন্তরের কথা বলছি।

    —ও! কীরকম মন্তর-তন্তরের?

    —সব বাজে, ভুয়ো।

    —ও-ও বাজে?

    —একদম।

    —আমি একেবারে অতটা যেতে রাজি নই। মন্তরের শক্তি নিশ্চয় আছে।

    —ওই করে করে দেশটা উচ্ছন্নে গেল। আপনারা ইংরেজি লেখাপড়া শিখেও এইসব মানেন?

    এইবার নিধিরাম ভটচাজের ওপর আমার শ্রদ্ধা হল। আশ্চর্য মানুষ তো? আধুনিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন প্রৌঢ় ব্যক্তি। আমি বললাম— সুন্দরবনে আপনি গিয়েছেন?

    —অনেকবার। এই মন্তর-তন্তর সম্বন্ধে সেখানকার একটি ঘটনা বলি।

    আমি বেশ এগিয়ে গিয়ে বসলাম তাঁর কাছে। দিনটা এইসব গল্প শুনবার উপযুক্ত বটে। উনি বলতে লাগলেন —

    সেবার কাকডাঙার ট্যাঁকে আমাদের বজরা লেগেছিল। আমাদের যিনি শিকারের গুরু, খুলনার উকিল সীতাকান্ত রায়ের ভাইপো শ্যামাচরণ রায় ছিলেন আমাদের সঙ্গে। কথাটা উলটো বলা হল। আসলে তাঁর সঙ্গেই আমরা গিয়েছিলাম; নইলে আমাদের অবস্থার লোক আর বজরা কোথায় পাবে বলুন!

    যেখানে বজরা বাঁধা হল সেখানটা একটা খালের মুখ। গভীর বনের মধ্যে দিয়ে এসে এখানে নদীতে পড়েছে কাকডাঙার খাল। খালের দৃশ্য বড়ো সুন্দর। দু-ধারে হেঁতাল ঝোপ, বনের মধ্যে গরান আর গোলপাতার গাছ। জলের ধারে টাইগার ফার্নের জঙ্গল। এই টাইগার ফার্নের জঙ্গলের মধ্যেই সাধারণত বড়ো বাঘ আত্মগোপন করে থাকে। শ্যামাচরণ রায় ফর্সিতে তামাক খেয়ে নিয়ে আমাদের বললেন— কাকডাঙার খালে ডিঙি ওঠাও।

    ডিঙি বেয়ে আমরা চললাম খালের মধ্যে দিয়ে। সুন্দরবনে যাঁরা কখনো যাননি, তাঁরা বুঝতে পারবেন না এইরকম খাল বেয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় কী চমৎকার রূপ চোখে পড়ে সুন্দরবনের। কখনো হেঁতাল ঝোপ, কখনো বন্য লেবুর জঙ্গল, গোল গাছের সারি, কোথাও বাতাবি লেবুর মতো প্রচুর ফল হয়ে আছে; কোথাও-বা হলুদ ফুল ফুটে বাতাসকে মিষ্টি করেছে।

    অনেকে বলেন সুন্দরবন বড়ো একঘেয়ে। তাঁরা গভীর জ্যোৎস্না রাত্রে এ-বনের চেহারা কখনো দেখেননি, অন্ধকারে দেখেননি, সূর্য উঠবার আগে রাঙা আলোয় মোড়া নিস্তব্ধ বনানীর রূপ, শোনেননি এর বিচিত্র বিহঙ্গ-কাকলি। আমার গুরু শ্যামাচরণ রায় এত ভালোবাসতেন এই বন যে, বাড়িতে বলেছিলেন তিনি মারা গেলে তাঁর দেহটি যেন সুন্দরবনে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর আত্মা এতে শান্তি পাবে।

    আমি বললাম— তিনি বেঁচে আছেন?

    —না। বহুদিন দেহ রেখেছেন।

    —দেহ কি সমাধিস্থ করা হয়েছিল বনের মধ্যে?

    —না। হিন্দুর দেহ সমাধিস্থ করা নিয়ে গোলমাল হয় সমাজে। তাই হয়নি।

    —বড়ো দুঃখের কথা। তারপর বলুন—

    —শুনুন তারপর, কিন্তু একটা কথা। সবটা শেষ হয়ে না গেলে কোনো প্রতিবাদ করতে পারবেন না।

    —বেশ, বলুন—

    নিধিরামবাবু ভালোভাবে তামাক টেনে দম নিয়ে অনেকখানি ধোঁয়া ছেড়ে তারপর আবার বলতে লাগলেন —

    অনেক দূর চলে গেলাম খাল বেয়ে। সত্যি কথা বলতে কী, শিকার করার নেশার চেয়েও এই ঘন বনভূমির দৃশ্য আমাকে পেয়ে বসেছিল। যখন প্রায় মাইল খানেকের বেশি চলে গিয়েছি নদী থেকে, তখন খালের ধারের বনঝোপের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল— বাবু, ও বাবুরা—

    আমরা চমকে উঠলাম। ডিঙির হিন্দু মাঝি বলে উঠল— রাম রাম!

    শ্যামাচরণ রায় গলা উঁচু করে ডাঙার দিকে চেয়ে বললেন— আঃ, চুপ করো সবাই। কে ওখানে?

    ক্ষীণ স্বরে কে বললে— বাবু আমি—

    —কে তুমি? কোথায় তুমি, সামনে বেরিয়ে এসো—

    —এই যে বাবু আমি, হেঁতাল ঝোপের পাশেই বসে।

    সত্যি এতক্ষণ লোকটাকে দেখতে না পাওয়ার দরুন ওর স্বর অশরীরীর কণ্ঠনিঃসৃত বলে ভ্রম হচ্ছিল বটে, এবার লোকটাকে সবাই দেখতে পেলে। ওই তো বসে আছে হেঁতাল ঝোপের ডাইনে। ওকে আগেও দেখা গিয়েছিল, এবার বুঝলাম। কিন্তু আলো-ছায়ার জলের মধ্যে দিয়ে ওকে গাছের কাটা গুঁড়ির মতো দেখাচ্ছিল। আমরা দস্তুরমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওকে এখানে একা বসে থাকতে দেখে। সুন্দরবনের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা বুঝবেন এরকম বনের মধ্যে একা বসে থাকতে বাতুলেও ভয় পায়।

    শ্যামাচরণ রায় বললেন— ও, বেশ। তা ওখানে কী করছ?

    —বাবু হেঁতালের ফল খাচ্ছিলাম। বড্ড খিদে পেয়েছে। গরিব লোক!

    —কথাটার ঠিক জবাব হল না। খিদে পাওয়া তো শরীরের ধর্ম, সেটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়; এ-জঙ্গলে ঢুকলে পাকা কুল ছাড়া যে আর কিছু খাবার পাওয়া যায় না, তাও ঠিক। কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে?

    —বাবু, আমি ফকির মানুষ। ভয়-ডর করলি আমাদের চলে? আমারে একটু নৌকায় তুলে নেবেন বাবু? কাল-রনঘাটের ট্যাঁকে আমাকে নাবিয়ে দিলে হেঁটে পিরের দরগায় গিয়ে রাত কাটিয়ে কাল সক্কালে বাড়ি যাব। নেবেন বাবু?

    —তোমার বাড়ি সেখানে?

    —কাল-রনঘাটের কাছে মানিক সেনের পাড়ায়।

    শ্যামাচরণবাবু কিছু বলবার আগে আমাদের ডিঙির মাঝি দু-জন আপত্তি জানিয়ে বললে— নেবেন না বাবু! ডিঙির নিয়ম জানেন তো, সুন্দরবনে চলতি ডিঙিতে পথের লোক তুললে সে বড্ড অপয়া। বাবু যাচ্ছেন যখন একটা শুভ কাজে—

    শ্যামাচরণবাবু রেগে বললেন— তোমাদের কী বুদ্ধি!

    —কেন বাবু?

    —আমার শিকার হোক আর না-হোক, ওকে এখানে ফেলে যাবো বাঘের মুখে? নিয়ে চলো ওকে।

    আর এর পরে কী কথা চলবে? ডিঙি থামিয়ে তাকে উঠিয়ে নেওয়া হল। আমাদের মনে হল লোকটা সত্যিই একজন ফকির। সাজপোশাক দেখে অন্তত তাই আমার মনে হয়েছিল। হিন্দু কী মুসলমান, বাইরের সাজ দেখে বোঝা শক্ত। আমরা চুপ করে আছি। শ্যামাচরণ রায় বললেন— কী সাধনা?

    —বাঘ আনবার মন্তর জানি কিনা, তার সাধনা।

    আমি বললাম— সেটা আবার কী?

    —আছে বাবু। আমার গুরু আমায় শিখিয়েছেন।

    শ্যামাচরণবাবু বললেন— হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকো?

    —না বাবু। মন্তরে বাঘ আসবে।

    —আমরা শিকার করতে চলেছি। তুমি বাঘ এনে দিতে পারলে দশ টাকা বকশিশ পাবে।

    —বাবু! আপনার দয়া!

    —ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে না।

    —ও-কথাই বলবেন না বাবু!

    লোকটাকে আমরা ততক্ষণে সবাই ঘিরে বসেছি। শ্যামাচরণ বললেন— সুন্দরবনে এক-একজন লোক আছে, যারা শিকারির সামনে বাঘ হাজির করে পয়সা রোজগার করে। তারা তো হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকে, জানি। তুমি সে দলের নও?

    —আপনাকে আগেই বলেছি বাবু। মন্তর আসল জিনিস। বাঘ টেনে আনে।

    এইসময় আমরা নিধিরাম ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসা করলাম— হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকার ব্যাপারখানা বুঝলাম না তো? নিধিরামবাবু আমাদের বুঝিয়ে দিলেন— এক শ্রেণির লোকের পেশা হচ্ছে এই যে তারা ঝোপের মধ্যে বসে হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে বাঘের আওয়াজ নকল করে ডাকে; তাতে নর-বাঘ সেখানে ছুটে আসে এবং শিকারির বন্দুকের পাল্লায় ধরা দেয়। পাঁচ টাকা ছিল ওদের ফি যুদ্ধের আগে। এখন কত জানি না।

    আমরা বললাম— এমনভাবে বাঘ আসতে আপনি দেখেছেন?

    —অনেক দেখেছি। তবে সবসময় সফল হয় না ওদের চেষ্টা। বাঘ হয়তো সে জঙ্গলে নেই, কিংবা কাছে নেই। নয়তো মানুষের সাড়া পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। সে অবস্থায় কী হবে? তার পর শুনুন। আমি ঘুন শিকারি, মন্তরে বাঘ এনে দেয় এমন কথা কখনো শুনিনি। শিকার কত এগিয়ে গেল তাহলে ভাবুন তো? শিকারের শখ যাঁদের আছে, তাঁরা জানেন একটা জ্যান্ত বাঘের পেছনে কী খাটুনিটাই হয় মশাই তাকে শিকার করতে! হয় জঙ্গল ঠ্যাঙাও, নয়তো মাচান বেঁধে রাত জাগো। সোজা কষ্ট মশায়? আর সে-জায়গায় যদি মন্তরে বাঘ আসে, তবে শিকার কত সোজা হয়ে গেল বলুন। পাঁচের জায়গায় দশ টাকা দিতে কেন তারা আপত্তি করবে?

    —ঠিক কথা। বলুন আপনি।

    —তারপর ঘণ্টা-দুই কেটে গেল, কাকডাঙার খালের মাজায় এসে আমরা নোঙর করলাম।

    —মাজায় মানে কী?

    —খালের অর্ধেকটা পার হয়ে এসে। সন্ধে হয়ে এল। আমরা সাহস করলাম না এখন ডাঙায় নামতে। রাত্রের খাবার সঙ্গে করে আনা হয়েছিল, তাই খেয়ে সবাই ডিঙিতে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিলাম। সমস্ত রাত উত্তেজনায় শ্যামাচরণবাবুর ঘুম নেই চোখে। তিনি শুধু বসে বসে ফকিরসাহেবের আজগুবি মন্তরের কথা শুনছিলেন— সে কতবার সাধনা করেছে বনের মধ্যে এই বাঘ আনার জন্য। গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে বসে এই মন্তরের সাধনা করাই তার কাজ। আরও কত কী যে বাজে গল্প! সারাদিন খেটেখুটে রাতে যে একটু ঘুমুব, তার উপায় নেই। কিন্তু শ্যামাচরণ রায় স্বয়ং ফকিরসাহেবের মুরুব্বি। তাঁর কথার উপর কথা বলবে কে? আমরা চুপচাপ শুয়ে ঘুমুবার চেষ্টা করলাম। শেষরাতের দিকে খানিকটা কৃতকার্য যে হইনি, তাও নয়।

    আমি বললাম— একটা কথা। আপনারা কাকডাঙা খালের মাঝামাঝি এলেন কেন? বজরা ছেড়ে আসা হেতু কী?

    —হেতু খুব স্পষ্ট। বজরায় বসে তা শিকার চলবে না! বজরা আছে নদীতে, তার একদিকে জঙ্গল, অন্যদিকে কূলকিনারা দেখা যায় কী না-যায়। ছোটো খালের মধ্যে না-গেলে দু-দিকের জঙ্গল তো তুমি দেখতে পাচ্ছ না। তুমি তো জঙ্গলে চড়ুইভাতি করতে আসনি?

    নিধিরাম ভটচাজ একটু তর্কপ্রিয় লোক। কেউ তাঁর কথার প্রতিবাদ পাছে করে, এই আশঙ্কায় সর্বদাই কোমর বেঁধে তর্কের জন্য তৈরি হয়ে থাকেন এবং গল্প শুরু করবার সময়ে কেন যে বলেছিলেন আমার কথার কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না, গল্প শেষ না-হওয়া পর্যন্ত; এখন তা বুঝলাম। আমরা তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সান্ত্বনা দিতে বললাম— আপনাকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছি জানবার আগ্রহে, আপনার গল্পের খুঁত ধরবার জন্য নয়। বলে যান আপনি।

    নিধিরাম ভটাচাজ বললেন— খুব ভালো কথা। শোনো তারপরে। আমার এ-গল্প শেষ হয়ে এসেছে। যা কিছু প্রতিবাদ করবার গল্পের শেষে করতে তো তোমাদের বলছি।

    ডিঙি নোঙর করে সারারাত্রি সেখানে থাকবার সময়ে সে-রাত্রেই বুঝতে পারা গেল, কী ভয়ানক জায়গায় আমরা এসেছি। জ্যোৎস্না রাত্রির আলো-ছায়া বার বার কেঁপে-কেঁপে উঠে ভেঙে-ভেঙে যেতে লাগল বাঘের গর্জনে। কাকডাঙার খাল সম্বন্ধে শ্যামাচরণ রায় বিবেচনায় ভুল করেননি। ভোরে উঠে শ্যামাচরণবাবুকে বললাম— চমৎকার জায়গায় এসেছেন!

    শ্যামাচরণ রায় বললেন— কাঁচা শিকারির কথা হয়ে গেল।

    —আজ্ঞে কেন?

    —বনের বাঘ আর শিকারির বাঘ এক নয়। ওরকম বাঘ ডাকে সুন্দরবনের বহু জায়গায়। কিন্তু চোখে দেখতেও পাবে না কোনোদিন একটি। তাই তো ফকিরসাহেবকে ধরেছি। এখন ফকিরসাহেবের দয়া—

    —আর আপনার হাতযশ—

    সকালের রোদ বেশ উঠলে আমরা সবাই ডিঙি থেকে নেমে বনের মধ্যে ঢুকলাম। আধ-মাইলটাক দূরে একটা ফাঁকা জায়গা আছে বনের মধ্যে, তাকে বলে হাতল বাদিয়ার ডাঙা। সেখানে আমরা রান্না করে খাব দুপুরে।

    আমরা জিনিসপত্র নিয়েই নামলাম, নয়তো কে আবার এ বনের মধ্যে দিয়ে ডিঙিতে ফিরবে রান্নার জিনিস নিতে। মাঝি দু-জনকেও সঙ্গে নিলাম, এ-নির্জন জঙ্গলে তারা দু-টি প্রাণী ডিঙিতে বসে থাকতে রাজি নয়।

    দু-দিকে ঘন গরান আর হেঁতালের জঙ্গল, টাইগার ফার্নের ঘন সমাবেশ, পা বাঁচিয়ে চলতে হয় শুলোর ভয়ে। শুলো হল গাছের বায়ব্য শিকড়, কাদা থেকে মাথা তুলে তীক্ষ্ন সড়কির মতো খাড়া হয়ে থাকে, ঝরা পাতার তলায় পা দিলেই রক্তপাত! দু-ধারে বন, মাঝখান দিয়ে জুড়ি পায়ে চলার পথটা।

    ফকিরসাহেব সকলের আগে, তার পেছনে গুরুজি শ্যামাচরণ রায়, তাঁর পিছনে দু-জন লোক, তারপর আমি, সর্বশেষে মাঝি দু-জন।

    হঠাৎ এক জায়গায় কী একটা শব্দ হল, শ্যামাচরণবাবু ও লোক দু-জন চমকে দাঁড়িয়ে গেল। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে এগিয়ে গেলাম।

    বললাম— কী হল? থামলেন যে?

    সেইসময় নজর পড়ল, দলের পুরোভাগে ফকিরসাহেব ছিলেন, তিনি নেই। বলতে যাচ্ছি— ফকিরসাহেব বুঝি—

    শ্যামাচরণবাবু বললেন— উঃ সর্বনাশ! এমন কাণ্ড কখনো— উঃ!

    তাঁর পেছনের লোক দু-টি তখনও আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে। একজন বললে— উঃ! বাবুর ডান পাশের ঝোপ থেকেই তো—

    শ্যামাচরণবাবু আড়ষ্ট গলায় বললেন— আহা, গরিব লোক! আমি মন্তর আওড়াতে বলেছিলাম ওকে মনে-মনে—

    ব্যাপার তখনি শুনলাম। ডানদিকের টাইগার ফার্নের বন থেকে ভীষণ এক রয়্যাল টাইগার লাফিয়ে পড়ে ফকিরসাহেবকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।

    চেয়ে-দেখে মনে হল বাঁ-দিকের হেঁতাল ঝোপের মাথা যেন তখনও নড়ছে।

    আমি রুদ্ধ নিশ্বাসে বললাম— তারপর? পাওয়া গেল ফকির সাহেবকে?

    —তা কখনো যায়! ওই শেষ। একটা হিংলাজের দানার মালা কেবল একটি হেঁতালের ডালে বেঁধে ঝুলছিল। আমরা অনেক খুঁজেছিলাম। শ্যামাচরণ রায় বড়ো শিকারি, বঘের ধরন-ধারণ তাক-বাক অনেক কিছু জানেন। কিছুই করতে পারলেন না। নামও জানিনে ফকিরসাহেবের, যে কাউকে কোথাও খবর দেব।

    আমার গুরুজি শ্যামাচরণ রায় বলতেন, লোকটি সত্যিই গুণী ছিল। মন্তরের জোরে বাঘ আকর্ষণ সে ঠিকই করেছিল, আমার অসতর্কতায় মারা পড়ল ও। বাঘকে আকর্ষণ করতেই শিখেছিল, বাঘের হাত থেকে বাঁচার মন্তর তো শেখেনি!

    অপরাহ্নের দিকে আমরা খোঁজাখুঁজি শেষ করে কাকডাঙার খাল বেয়ে বজরা ধরলাম নদীতে। মন সবারই এত খারাপ হয়ে গেল যে, সেবারে আমাদের শিকারে আর কোনো উৎসাহই রইল না। শ্যামাচরণবাবুকে একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম— গুরুজি, ফকিরসাহেবকে দলের আগে-আগে যেতে কে বলেছিল? আপনি তো জানেন নিরস্ত্র অবস্থায় আগে আগে ওভাবে যেতে নেই? শ্যামাচরণ রায় বলেছিলেন— বিশ্বাস করিনি যে! বোগাস বলে ভেবেছিলাম তোমাদের মতো।

    জ্যৈষ্ঠ ১৩৬২, ছোটোদের শ্রেষ্ঠ গল্প

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবউ চণ্ডীর মাঠ
    Next Article বিরজা হোম ও তার বাধা

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    অন্ধের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }