Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন – অতুল সুর

    লেখক এক পাতা গল্প428 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    মধ্যযুগের হিন্দুসমাজ ও জাতিবিন্যাস

    ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি যখন বাঙলা অধিকার করেন, বাঙলায় তখন দুই প্রধান সমাজ ছিল-বৌদ্ধ সমাজ ও হিন্দু সমাজ। মুসলমানদের মঠ-মন্দির মূর্তি ভাঙার তাণ্ডবলীলার উন্মাদনা দেখে দুই সমাজই বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। বৌদ্ধদের মধ্যে অনেকেই তিব্বত ও নেপালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। আর যারা বাঙলাদেশেই থেকে যাবার সঙ্কল্প করে, তারা প্রথমে গিয়ে আশ্রয় নেয় উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে রাজশাহী জেলাতে। কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তার অভাব দেখে তারা আসামের দিকে চলে যায়। কিন্তু সেখানেও তারা মুসলমানদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে দলে দলে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের অভিমুখে যাত্রা করে। কেননা, বহুপ্রাচীন কাল থেকেই কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের এক উপনিবেশ ছিল। চট্টগ্রাম সে সময় আরাকান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বৌদ্ধধর্মের বেশ এক প্রাণবন্ত কেন্দ্র ছিল। সে কারণেই বাঙলার পলায়মান বৌদ্ধারা-ঐতিহ্যমণ্ডিত চট্টগ্রামকেই তাদের নিরাপদস্থল গণ্য করে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা প্রাচীন বৌদ্ধ-ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব বিকাশ ঘটায়। চট্টগ্রামের বর্তমান বৌদ্ধরা তাঁদেরই বংশধর।

    দুই

    বৌদ্ধদের অদৃষ্ট ভাল ছিল বলে, তারা ধর্মদ্বেষী ইসলামিক অভিযানের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু হিন্দুদের অদৃষ্ট ছিল মন্দ। সেজন্য তাদের এদেশেই থেকে যেতে হয়েছিল। তাদেরই মুসলমান শাসকদের অত্যাচার নিপীড়ন, ও ধর্মান্তরকরণের বলি হতে হয়েছিল। নিম্নশ্রেণির হিন্দুরাই নিজেদের প্রাণরক্ষার জন্য স্বেচছায় মুসলমানদের ধর্মান্তকরণের বলি হয়েছিল। কেননা, ব্রাহ্মণশাসিত হিন্দুসমাজের মধ্যে তারা ছিল অত্যাচারিত ও নিপীড়িত শ্রেণি। আগের এক অধ্যায়েই বলেছি যে ব্রাহ্মণশাসিত হিন্দুসমাজের এই অবহেলিত ও নিপীড়িত নিম্নশ্রেণীর কাছে মুসলমান শাসকরা দুটি প্রস্তাব রেখেছিল—’হয় কোরান গ্রহণ কর, আর তা নয়তো মৃত্যুবরণ কর।’ যেখানে প্রাণের প্রশ্ন ছিল, সেখানে প্রাণভয়ে তারা অনেকেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, তা ছাড়া তারা দেখেছিল যে মুসলমান হলে তারা ব্রাহ্মণশাসিত হিন্দুসমাজের অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে চিরকালের মতো নিষ্কৃতি পাবে। এই পটভূমিকাতেই মধ্যযুগে হিন্দুসমাজের স্রোতোধারা প্রবাহিত হয়েছিল।

    তিন

    এই সকল কারণে হিন্দুসমাজের মধ্যে নূতন করে আবার একটা জাতিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। এটা ‘মীথ (myth) সৃষ্টি করা হয়েছিল, যার দ্বারা প্রমাণ করবার চেষ্টা হয়েছিল যে বাঙলার সকলজাতির মধ্যেই, হয় পিতৃকুলে, আর তা নয়তো মাতৃকুলে, উচ্চবর্ণের প্রবাহিত হচ্ছে। এ সম্পর্কে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, বাঙলায় কোন দিনই চতুর্বর্ণভিত্তিক জাতিপ্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং ব্রাহ্মণ ছাড়া, বাঙলার জাতিসমূহের এ সঙ্করত্বকেই ভিত্তি করে, বাঙলার মুসলমান রাজত্ব শুরু হবার অব্যবহিত পরেই রচিত হয়েছিল ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’। বৃহদ্ধর্মপুরাণ’- এ প্রথম বাঙলার জাতিসমূহকে বিভক্ত করা হয়েছিল তিন শ্রেণিতে — (১) উত্তম সঙ্কর (২) মধ্যম সঙ্কর, ও (৩) অত্যজ। কোন কোন জাতিকে কোন শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিল তার একটা তালিকা আমরা আগের এক অধ্যায়ে দিয়েছি। বাঙলার জাতিসমূহ যে সঙ্কর জাতি তা ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বাঙলার জাতিসমূহের নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ থেকেও তা প্রমাণিত হয়। তবে এই সংমিশ্রণ যে কার সঙ্গে কার ঘটেছিল, তার প্রকৃত হদিশ পাওয়া যায় না, কেননা বিভিন্ন পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রসমূহে এদের বিভিন্ন রকম উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। কোথাও বা কোন জাতি অনুলোম বিবাহের ফসল, আবার কোথাও বা তারা প্রতিলোম বিবাহের ফসল। এটা নীচের তালিকা থেকে পরিস্কার বোঝা যাবে—

    জাতি পিতা মাতা প্রমাণসূত্র(৩)
    ১. অন্বষ্ঠ ১. ব্রাহ্মণ
    ২. ক্ষত্রিয়
    বৈশ্য
    বৈশ্য
    ৫, ৭, ১, ১২
    ৪
    ২. আগুরি করণ রাজপুত্র ৮
    ৩. উগ্ৰ ১. ক্ষত্রিয়
    ২. ব্রাহ্মণ
    ৩. বৈশ্য
    শূদ্র
    শূদ্র
    শূদ্র
    ১, ৫, ১২, ৬
    ৯
    ৪
    ৪. কর্মকার ১. বিশ্বকর্মা
    ২. শূদ্র
    ৩. শূদ্র
    ঘৃতাচি
    বৈশ্য
    ক্ষত্রিয়
    ৩
    ২
    ২
    ৫. করণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য ৬
    ৬. চর্মকার ১. শূদ্র
    ২. বৈদেহক
    ৩. বৈদেহক
    ৪. অয়োগব
    ৫. তিবর
    ৬. তক্ষণ
    ক্ষত্রিয়
    ব্রাহ্মণ
    নিষাদ
    ব্ৰাহ্মণ
    চণ্ডাল
    বৈশ্য
    ৯
    ৯
    ৬
    ৮
    ৩
    ২
    ৭. তিলি গোপ বৈশ্য ২
    ৮. তেলি বৈশ্য ব্রাহ্মণ ২
    ৯. তামলি বৈশ্য ব্ৰাহ্মণ ২
    ১০. কংসবণিক ব্ৰাহ্মণ বৈশ্য ২
    ১১. চণ্ডাল শূদ্র ব্ৰাহ্মণ ৬
    ১২. নাপিত ১. ব্রাহ্মণ
    ২. ক্ষত্রিয়
    ৩. ব্রাহ্মণ
    ৪. ক্ষত্রিয়
    শূদ্র
    শূদ্র
    বৈশ্য
    নিষাদ
    ৭
    ২
    ৯
    ৮
    ১৩. বাগ্দী ক্ষত্রিয় বৈশ্য ৩
    ১৪. হাড়ি লেট চণ্ডাল ৩
    ১৫. সুবর্ণবণিক ১. অন্বষ্ঠ
    ২. বিশ্বকর্মা
    বৈশ্য
    ঘৃতাচি
    ২
    ৩
    ১৬. গন্ধবণিক ১. ব্রাহ্মণ
    ২. অন্বষ্ঠ
    বৈশ্য
    রাজপুত্র
    ২
    ৭
    ১৭. কায়স্থ ব্ৰাহ্মণ বৈশ্য ৯
    ১৮. কৈবর্ত ১. নিষাদ
    ২. শূদ্র
    ৩. ব্ৰাহ্মণ
    ৪. নিষাদ
    অয়োগব
    ক্ষত্রিয়
    শূদ্র
    মগধ
    ৫
    ২
    ৭
    ৯
    ১৯. গোপ ১. বৈশ্য
    ২. ক্ষত্রিয়
    ক্ষত্রিয়
    শূদ্র
    ২
    ৭
    ২০. ডোম লেট চণ্ডাল ৩
    ২১. তন্তবায় ১. শূদ্র
    ২. বিশ্বকর্মা
    ক্ষত্রিয়
    ঘৃতাচি
    ২
    ৩
    ২২. ধীবর ১. গোপ
    ২. বৈশ্য
    শূদ্র
    ক্ষত্রিয়
    ২
    ৪
    ২৩. নিষাদ ১. ব্রাহ্মণ
    ২. ব্ৰাহ্মণ
    ৩. ক্ষত্রিয়
    শূদ্র
    বৈশ্য
    শূদ্র
    কৌটিল্য
    ৬
    ৩
    ২৪. পোদ বৈশ্য শূদ্র ৩
    ২৫. মালাকার ১. বিশ্বকর্মা
    ২. ক্ষত্রিয়
    ঘৃতাচি
    ব্ৰাহ্মণ
    ৩
    ২
    ২৬. মাহিষ্য ক্ষত্রিয় বৈশ্য ৪, ১২
    ২৭. মোদক ক্ষত্রিয় শূদ্র ২
    ২৮. রজক ১. বৈদেহক
    ২. ধীবর
    ৩. করণ
    ব্রাহ্মণ
    তিবর
    বৈশ্য
    ৮
    ৩
    ২
    ২৯. বারুজীবী ১. ব্রাহ্মণ
    ২. গোপ
    শূদ্র
    তন্তুবায়
    ২
    ১৩
    ৩০. বৈশ্য ১. ব্রাহ্মণ
    ২. শূদ্র
    বৈশ্য
    বৈশ্য
    ৫
    ৬
    ৩১. শুঁড়ি ১. বৈশ্য ২. গোপ তিবর শূদ্র ৩ ২

    * ১. বৌধায়ন ধর্মসূত্র, ২. বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ৩. ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ৪. গৌতম ধর্মসূত্র, ৫. মনুসংহিতা, ৬. মহাভারত, ৭. পরাশর, ৮. সূত সংহিতা, ৯. উশানস সংহিতা, ১০. বিষ্ণু ধর্মসূত্র, ১১. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র, ১২. যাজ্ঞবল্ক্য, ১৩. জাতিমালা।

    তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে বাঙালী জাতি তিন নরগোষ্ঠীর (races যথা-অনু-অস্ত্রাল (Proto-Australoid), দ্রাবিড় ও আলপীয়র মিশ্রণে উদ্ভূত। বাঙালী সমাজের সব জাতির মধ্যে ওই একই রক্তধারা প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং সামাজিক সংস্থা-হিসাবে কোনও জাতিই রক্তের শ্রেষ্ঠতা বা রক্তের বিশুদ্ধতা দাবী করতে পারে না। যদিও বৈদ্য ও চণ্ডাল উভয়ের দেহেই ব্রাহ্মণরক্ত রয়েছে, তথাপি তাদের মধ্যে সামাজিক প্রভেদের আকাশ- পাতাল তফাৎটা যে ব্রাহ্মণদের উষ্মার জন্য, সেটা আমি অন্যত্র বলেছি। এরূপ পার্থক্য যে, ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের উদ্দেশ্যরঞ্জিত কাল্পনিক ধ্যান মাত্র, সে বিষয়ে কোন সংশয় নেই। এটা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাপার (Sociological Phenomenon) হতে পারে, কিন্তু আবয়বিক নৃতত্ত্বের (ethnological fact) দিক থেকে সত্য নয়। অনুরূপভাব পদবীসমূহও কোন জাতি নির্দেশ করে না। একই পদবী, ব্রাহ্মণ, সদ্‌গোপ, কায়স্থ, বৈদ্য, গোপ, মাহিষ্য ও অন্যান্য জাতির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ড. দেবদত্ত ভাণ্ডারকার বহুপূর্বেই দেখিয়েছিলেন যে গুজরাতের নাগর – ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে সকল পদবী প্রচলিত আছে, তা এখন বাঙলার কায়স্থদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।

    পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রসমূহে বর্ণিত জাতিসমূহের উৎপত্তি কাহিনী যে একেবারে কল্পনাপ্রসূত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, প্রথমত পরস্পর বিরোধী মতবাদ, ও দ্বিতীয়ত, উত্তর ভারতের বর্ণবাচক জাতি হিসাবে ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘বৈশ্য’ জাতি কোনদিনই বাঙলায় ছিল না। গুপ্তযুগের বহু লিপিতে ব্রাহ্মণ ব্যতীত বহু লোকের উল্লেখ আছে, কিন্তু এই সকল লিপিতে কেহ নিজেকে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বলে দাবী করেনি। তবে পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রসমূহের বর্ণনা থেকে পরিস্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, বাঙলার জাতিসমূহ যে মাত্র নানাজাতির রক্তের মিশ্রণের ফসল তা নয়, পুনমিশ্রণেরও ফল।

    পরবর্তীকালে বাঙলায় যে সমাজবিন্যাস রচিত হয়েছিল, তা হচ্ছে, ১. ব্রাহ্মণ, ২. বৈদ্য, ৩. কায়স্থ, ৪. নবশাখ, ৫. অন্যান্য জাতি। যেসব জাতির হাতে ব্রাহ্মণরা জলগ্রহণ করে তারাই নবশাখ। তাদের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে তিলি, তাঁতী, মালাকার, সদ্‌গোপ, নাপিত, বারুই, কামার কুম্ভকার ও মোদক। অন্যান্য জাতিসমূহ ছিল জল অনাচরণীয়। সুবর্ণবণিকদের জল-আচরণীয় জাতির তালিকা থেকে বাদ দেবার কারণ সম্বন্ধে বলা হয় যে, বল্লভানন্দ নামে প্রসিদ্ধ সুবর্ণবণিক রাজা বল্লালসেনকে অর্থসরবরাহ করতে অসম্মত হওয়ায় বল্লালসেন তাদের অবনমিত করেন। আর স্বর্ণকারদের সম্বন্ধে বলা হয় যে, তারা খরিদ্দারের সোনা চুরি করে বলেই তাদের অবনমিত করা হয়েছিল।

    চার

    পুরাণ গ্রন্থ ছাড়া, আর এক শ্রেণির গ্রন্থ থেকেও আমরা মধ্যযুগের জাতিসমূহের উদ্ভব ও বিস্তারের ইতিহাস পাই। এগুলি বাঙলার কুলজী গ্রন্থসমূহ। এগুলি রচিত হয়েছিল পঞ্চাদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীতে।

    মধ্যযুগের, বিশেষ করে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর, সামাজিক জীবনের ওপর এগুলি বিশেষ আলোকপাত করে। মূলত এগুলি বংশের পুরুষানুক্রমিক বিবরণ। এগুলি সংস্কৃতি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই রচিত। বাঙলার সব জাতিরই কুলপঞ্জী আছে; তবে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থগণের কুলপঞ্জীই সবচেয়ে বেশি। এগুলির অধিকাংশই ঘটকগণ কর্তৃক রচিত। কুলপঞ্জীগুলির বিষয়বস্তুসমূহকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলিতে আছে (১) জাতি ও তাদের শাখাসমূহের উদ্ভব ও বিস্তার, (২) কালক্রমে এই সকল জাতির যে-সকল শাখার সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে পরস্পরের আহার ও বৈবাহিক বিষয় সম্পর্কে যে সকল রীতি-নীতি ও প্রথা-পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল তার ইতিহাস, এবং (৩) বিভিন্ন পরিবারের বংশাবলী ও বংশের প্রধান প্রধান ব্যক্তির কীর্তিকথা, কুলক্রিয়া ইত্যাদি।

    প্রধান প্রধান কুলজীগ্রন্থের নাম নীচে দেওয়া হল—(২) ব্রাহ্মণ কূলজীগ্রন্থ: ধ্রুবনন্দ মিশ্রের ‘মহাবংশাবলী’ ও ‘সমীকরণকারিকা’, মহেশের ‘নির্দোষ কুলপঞ্জিকা, শিবচন্দ্র সিদ্ধান্তের ‘কুলশাস্ত্রকৌমুদী, বাচষ্পতি মিশ্রের ‘কুলরাস’ নুলো পঞ্চাননের ‘গোষ্ঠিকথা’, রামভদ্রের; ‘পাশ্চাত্যবৈদিক, কূলদীপিকা’, এডুমিশ্রের ‘কারিকা,’ হরি মিশ্রের ‘কারিকা’, দনুজারিমিশ্রের ‘কারিকা,’ ‘মেলপ্রকাশ’ মেলচন্দ্রিকা, ‘মেলরহস্য’ ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জী’ ইত্যাদি। (২) বৈদ্যকুল-পঞ্জিকাসমূহ : ভরত মল্লিকের ‘চন্দ্রপ্রভা’ ‘রত্নপ্রভা’, রামকান্তের ‘কবিকণ্ঠহার’ ইত্যাদি। (৩) কায়স্থকুলপঞ্জিকা: মালাধার ঘটকের ‘দক্ষিণরাঢ়ীয় কারিকা, দ্বিজ বাচস্পতির বঙ্গজকুলজী’ ও কাশীরাম দাসের ‘বারেন্দ্র-কায়েস্থ’-ঢাকুরি’ ইত্যাদি। এছাড়া, অবশ্য আর অনেক কুলপঞ্জীকার ছিলেন। যেমন দ্বিজ ঘটক চূড়ামণি ও রামনারায়ণ ঘটক। প্রথমজন রচনা করেছিলেন ‘উত্তর রাঢ়ীয় কুলপঞ্জী’। বলা বাহুল্য, কুলপঞ্জিকাসমূহের ঐতিহাসিকতা সন্দেহের অতীত নয়। তাদের অকৃত্রিমতা ও সংশয়পূর্ণ; কেননা, ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোক এগুলির পরিবর্তন করেছে এগুলির মধ্যে প্রক্ষিপ্ত অংশ প্রবেশ করিয়েছে। কিন্তু তাহলেও মধ্যযুগের সমাজে বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্যপ্রথা দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে কুলপঞ্জীসমূহই সহায়ক হয়েছিল।

    পাঁচ

    মধ্যযুগের সমাজে কৌলীন্যপ্রথা এনেছিল এক অসামান্য জটিলতা। এ প্রথা বিশেষ করে প্রচলিত ছিল বাঙলা ও মিথিলাতে। কিংবদন্তি অনুযায়ী বাঙলাদেশে কৌলীন্যপ্রথা সৃষ্টি করেছিলেন সেনবংশীয় রাজা বল্লালসেন, আর মিথিলাতে কর্ণাটবংশীয় শেষ রাজা হরিসিংহ। এ হচ্ছে কুলজীগ্রন্থসমূহের কথা। ইতিহাস কিন্তু এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। বস্তুত বল্লালসেন বা হরিসিংহ যে কৌলীন্যপ্রথা প্রবর্তন করেছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই। বল্লালসেন রচিত ‘অদ্ভুতসাগর’ ও ‘দানসাগর’-এ এর কোনও উল্লেখ নেই। বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেনের রাজসভাতেও অনেক বিশিষ্ট ও পরম পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, যথা— জয়দেব, ধোয়ী, শরণ, উমাপতি ধর প্রমুখ। তাঁরাও অনেক গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের কোন গ্রন্থেও এর কোন উল্লেখ নেই। অনেকে আবার মনে করেন যে, বল্লালসেন কৌলীন্যপ্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন মাত্র এবং এটা বাঙলাদেশে অনেক আগে থেকেই (অনেকের মতে আদিশূরের সময় থেকে) বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তার সপক্ষেও কোন বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। বরং এ সম্বন্ধে প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্র, তাম্রপট্ট ও শিলালিপিসমূহ সম্পূর্ণ নীরব। প্রাচীন সমাজে অনুলোম-বিবাহ ছাড়া প্রচলিত ছিল প্রতিলোম বিবাহ। এর প্রচলন বিশেষভাবে ঘটেছিল বৌদ্ধযুগে। তার মানে প্রাচীন সমাজে প্রচলিত ছিল অসবর্ণ বিবাহ, যার ফসল ছিল সঙ্কর জাতিসমূহ। কৌলীন্যপ্রথা সম্বন্ধে যে মতটা আজ সমীচীন বলে গৃহীত হয়েছে, সেটা হচ্ছে এই যে,পঞ্চদশ- ষোড়শ শতাব্দীতে বাঙালী কুলপঞ্জীকারগণই এটা প্রথমে ব্রাহ্মণসমাজে কায়েম করবার চেষ্টা করেছিলেন এবং এটাকে একটা রীতিমতো স্বীকৃতি দেবার জন্যই তাঁরা এর সঙ্গে বল্লালসেনের নাম জড়িত করেছিলেন। ব্রাহ্মণসমাজের অনুকরণে এটা পরবর্তীকালে কায়স্থ, বৈদ্য, সদ্‌গোপ প্রভৃতি সমাজে প্রবর্তিত হয়েছিল। বস্তুত বৈদ্যসমাজে কৌলীন্যপ্রথা যে সপ্তদশ শতাব্দীতে ও সদ্‌গোপসমাজে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত হয়েছিল, তার প্রমাণ আছে।

    কৌলীন্যের লক্ষণ সম্বন্ধে একটা বচন আছে। সেটা হচ্ছে- ‘আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনম্। নিষ্ঠাবৃত্তিস্তপো দানং নবধা কুললক্ষণম্। ‘ তার মানে আচরণ, শালীনতা, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠার তীর্থভ্রমণ, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, তপস্যা ও দান-কুলীনের এই নয়টি লক্ষণ। কিন্তু ব্রাহ্মণসমাজে যাদের একবার কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তাদের বংশপরম্পরায় কুলীন, বলে সম্মানিত করা হত—উপরিউক্ত নবধা গুণ অনুযায়ী নয়। যেমন, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণসমাজে কুলীন করা হয়েছিল মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়দের। অনুরূপভাবে বঙ্গজ কায়স্থসমাজে ঘোষ, বসু, গুহ ও মিত্র বংশকে কুলীনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, আর সদ্‌গোপসমাজে শূর (সুর), নিয়োগী ও বিশ্বাসদের

    কৌলীন্যপ্রথা যে কলুষিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সে সমাজে উপরি উক্ত নয়টি গুণের কোনোটারই অস্তিত্ব ছিল না। সমজাতীয় সমাজে বিভিন্ন বংশকে উচ্চ ও নীচ চিহ্নিত করে এই প্রথা যে সমাজকে দুর্বল করে দিয়েছিল, সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। বরং কুলপঞ্জীকারগণ নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখবার জন্য নানারূপ বিধিনিষেধ সৃষ্টি করে সমাজকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছিল এবং ফলে নানারকম কুপ্রথার সৃষ্টি হয়েছিল।

    ব্রাহ্মণসমাজে এই প্রথাটি ছিল কন্যাগত। তার মানে কুলীনের ছেলে কুলীন বা অকুলীনের মেয়েকে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু কুলীনের মেয়ের বিবাহ কুলীনের ছেলের সঙ্গেই দিতে হত। অকুলীনের সঙ্গে তার বিয়ে দিলে মেয়ের বাপের কৌলীন্য ভঙ্গ হত। সুতরাং কুলরক্ষার জন্য কুলীনব্রাহ্মণ পিতাকে যেন তেন প্রকারে কুলীন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়ে নিজের কুলরক্ষা করতে হত। তার কারণ অনূঢ়া কন্যা ঘরে রাখা বিপদের ব্যাপার ছিল। এক দিকে তো সমাজ তাকে একঘরে করত, আর অপর দিকে ছিল বিধর্মীর নারী-লোলুপতা। অনেক সময় বিধর্মীরা নারীকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে (এমনকি বিবাহমন্ডপ থেকেও) নিকা করতে কুণ্ঠা বোধ করত না।

    অনেক সময় কুলীন ব্রাহ্মণগণ অগণিত বিবাহ করতেন এবং স্ত্রীকে তার পিত্রালয়েই রেখে দিতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতচন্দ্র তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে লিখেছিলেন—’আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে। যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে ॥ যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই। বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই ॥ বিয়াকালে পন্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে। পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে ॥ বিবাহ করেছে সেটা কিছু ঘাটিষাটি। জাতির যেমন হৌক কুলে বড় আঁটি ॥ দু’চারি বৎসরে যদি আসে একবার। শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার ॥ সূতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারে তায়। তবে মিষ্ট মুখ নহে রুষ্ট হয়ে যায়।’ এরূপ প্রবাস- ভর্তৃক সমাজে কুলীন কন্যাগণ যে সবক্ষেত্রেই সতী-সাবিত্রীর জীবন- যাপন করতেন সে কথা হলফ করে বলা যায় না। এর ফলে বাঙলার কুলীনসমাজে যে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, নারীর বিধর্মী দ্বারা ধর্ষিতা হবারও সম্ভাবনা ছিল। বিধর্মী-দূষিতা হবার শঙ্কাতেই বাঙালী সমাজে বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা সতীদাহ প্রভৃতি প্রথা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

    ছয়

    কৌলীন্যপ্রথা বাঙালীকে ক্রমশ অবনতির পথেই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। যে সমাজে কৌলীন্যপ্রথা প্রচলিত ছিল ও মেয়ের বিবাহ কষ্টকর ও ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে সমাজে মেয়েকে অপসারণ করবার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি পিতামাতার মনে জেগেছিল। সেজন্য গঙ্গাসাগরের মেলায় গিয়ে মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা এদেশে একটা প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। ইংরেজ সরকার আইন প্রণয়ন করে এই প্রথা বন্ধ করে দেয়। অনেকে আবার মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে না দিয়ে, মন্দিরের দেবতার নিকট তাদের দান করতেন। মন্দিরের পুরোহিতরা এই সকল মেয়েদের নৃত্যগীতে পটীয়সী করে তুলতেন। এদের দেবদাসী বলা হত। এটাও আইন দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

    যদিও স্বামীর সহিত সহমৃতা হবার দু-একটা দৃষ্টান্ত প্রাচীন সাহিত্যে আছে, তবুও স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় মরতে হবে, এমন কোনও সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা প্রাচীন ভারতের জনসমাজে প্রচলিত ছিল না। বরং মনুসংহিতায় বিধবা নারীদের আমরণ কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের নির্দেশ‍ই আছে। পরবর্তী স্মৃতিকারগণও সহমরণের বিরোধী ছিলেন। কেননা, মহানিবার্ণতন্ত্রে বলা হয়েছে যে, এই প্রথা নারী বা আদ্য শক্তির অবমাননা সূচক। সহমরণ ব্যাপকভাবে প্রবর্তিত হয়েছিল মধ্যযুগের বাঙলাদেশে। মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে আমরা এর বহু উল্লেখ পাই। হিন্দুর মেয়েরা তো অনেকে স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হতেনই, এমনকি ধর্মান্তরিত নিম্নশ্রেণির মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রথা কোথাও কোথাও অনুসৃত হত। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে কৌলীন্য-কলুষিত সমাজে এটা প্ৰায় বাধ্যতামূলক প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। সবক্ষেত্রেই যে স্ত্রী স্বেচ্ছায় সহমৃতা হতেন, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীকে অহিফেন সেবন করিয়ে তার প্রভাবে বা বলপূর্বক তাঁকে চিতায় চাপিয়ে পুড়িয়ে মারা হত। নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতার স্ত্রী সহমৃতা হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় এরূপ ব্যথিত হয়েছিলেন যে, নিষ্ঠাবান সমাজের বিরুদ্ধে একাকী খড়্গহস্ত হয়ে এই প্রথা লোপ করতে বদ্ধপরিকর হন। তাঁরই চেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর তারিখে আইন প্রণয়ন দ্বারা এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন।

    সাত

    ময়ুরভট্টের ‘ধর্মপুরাণ’, মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গল’, ‘চন্ডীমঙ্গল’ বিজয়গুপ্ত-রচিত ‘মনসামঙ্গল’, বৈষ্ণব পদাবলীসমূহ, দয়ারামের ‘সারদামঙ্গল’, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’, দেবীবরের ‘মেলবন্ধন,’ বিভিন্ন কুলজীগ্রন্থসমূহ, মন্দিরগাত্রের অলঙ্করণসমূহ ও বৈদেশিক পর্যটকগণের ভ্রমণকাহিনী সমূহ থেকে আমরা মধ্যযুগের, বিশেষ করে ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী হিন্দুর সমাজজীবনের একটা সঠিক চিত্র পাই।

    সুফলার বছরে কৃষকের ঘর ধান, চাল, গম, মুগ, তিল, ছোলা, কার্পাস ও সরিষায় পরিপূর্ণ থাকত। তেলিরা কেউ ঘানি ও কেউ ঘণায় তেল প্ৰস্তুত করত; কামারেরা কোদালি, কুড়ালি, ফাল, টাঙ্গি ও শেল তৈরি করত; তাম্বুলীরা গুবাক ও পানে বীড়া বেঁধে বেচত; কুম্ভকারেরা হাঁড়ি, খুরি, মৃদঙ্গ, দগড় ও শরা প্রস্তুত করত; বারুইরা নগরের আশেপাশে বরজ তৈরি করে পানের চাষ করত; নাপিত ক্ষুর, ভাঁড় ও দর্পণ নিয়ে নগরের ঘুরে বেড়াত। মোদকদের চিনির কারখানা ছিল; তার নানা প্রকার লাড্‌ডু ও মিষ্টান্ন তৈরি করত। গন্ধবণিকরা বাজারে ধূপধূনা বেচত। শঙ্খবেণে শাঁখার কাজ করত। কাঁসারি নানারকম কাঁসার বাসন-কোসান তৈরি করত। সুবর্ণবণিক সোনারূপার কারবার করত। স্বর্ণকারের হাটে স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির দোকানে ছিল। গোপেরা দুধ ও দহি বেচত। তাঁতিরা কাপড় বুনতো। মোট কথা, প্রতি জাতিই তাদের নিজ নিজ কৌলিক কর্মে ব্যস্ত থাকত।

    বৃহদ্ধর্মপুরাণে ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বিবৃত তিনশ বছর আগের যে-সকল জাতির উল্লেখ আছে, সে-সকল জাতির পরের তিনশ বছরেও বিদ্যমান ছিল। তবে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল ও বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল থেকে আমরা জানতে পারি যে, মধ্যযুগের সমাজে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য— এই তিন জাতির প্রাধান্যই ক্রমশ বর্ধিত হয়েছিল। মুকুন্দরাম তাঁর জন্মস্থান দামুন্যার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, ওই স্থানে গুণবান লোকেরা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য—এই তিন জাতিভুক্ত ছিলেন। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল-কাব্য থেকেও আমরা জানতে পারি যে, একশ বছর আগেও এই তিন জাতিই সমাজে প্রভাবশালী ছিলেন। তবে মুকুন্দরামের কাব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, এ যুগের ব্রাহ্মণরা সাধারণত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। এক শ্রেণি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ যাঁরা শাস্ত্র অধ্যয়ন ও চর্চা করতেন এবং টোল স্থাপন করে ছাত্রদের শাস্ত্র পড়াতেন। আর এক শ্রেণি ছিল ‘অশিক্ষিত’ ব্রাহ্মণ যারা গ্রামে যজন-যাজন ও পূজা-অর্চনাদি করে জীবিকা অর্জন করত। মনে হয়, এটা ছিল দাক্ষিণাত্যের বৈদিক গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ এবং সেই হেতু এদের প্রতি কটাক্ষ করে মুকুন্দরাম তাদের ‘অশিক্ষিত’ বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া, আর এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ ছিল—যাদের মুকুন্দরাম ‘বর্ণবিপ্র’ বলে অভিহিত করেছেন। এরা জ্যোতিষের চর্চা করত ও পাপগ্রহসমূহের প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য শান্তিস্বস্ত্যয়ন ইত্যাদি করত। এছাড়া, অগ্রদানী ব্রাহ্মণদেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের কাজ ছিল শ্রাদ্ধে দান গ্রহণ করা।

    বর্তমান কালের ন্যায় মধ্যযুগেও বৈদ্যরা সেন, গুপ্ত, দাশ, দত্ত, কর, কুণ্ড প্রভৃতি উপাধি ব্যবহার করতেন। বৈদ্যদের প্রধান পেশা ছিল চিকিৎসা। তবে তাঁরা অন্য কাজও করতেন এবং শাস্ত্রাদিরও অধ্যাপনা করতেন। বৈদ্যদের চিকিৎসা সম্বন্ধে একটা মজার কথার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। যখন রোগীর ব্যাধি কঠিন দেখতেন তখন কোনও না কোন অছিলায় তাঁরা সরে পড়তেন।

    কায়স্থদের মধ্যে যাঁদের উপাধি ছিল, ঘোষ, বসু, মিত্র ও গুহ তাঁরাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ কায়স্থ। এ ছাড়া, কায়স্থরা অন্য যে-সকল উপাধি ব্যবহার করতেন, সেগুলির অন্যতম ছিল পাল, পালিত, নন্দী, সিংহ, সেন, দেব, দত্ত, দাস, নাগ, কর, কুণ্ড, সোম, তন্ত্র, ভঞ্জ, বিষ্ণু, রাহা, বিন্দ ইত্যাদি। মুকুন্দরাম মাহেশের রথযাত্রার প্রবর্তক ‘ঘোষ’ উপাধিকারী কায়স্থবংশের উল্লেখ করেছেন। তা থেকে মনে হয় যে, মাহেশ সে সময় কায়স্থসমাজের এক প্রভাবশালী স্থান ছিল। কায়স্থদের মধ্যে শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ছিল। তাঁরা করণিকের কাজ ছাড়া কৃষিকর্মেও লিপ্ত থাকতেন। রূপরাম তাঁর ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন—’কায়স্থ কারকুন যত করে লেখাপড়া’।

    ব্রাহ্মণরা সকল জাতির হাত থেকে জল গ্রহণ করতেন না। মাত্র নয়টি জাতি জল-আচরণীয় বলে চিহ্নিত হয়েছিল। এদের নবশাখ বলা হত। এরা হচ্ছে তিলি, তাঁতি, মালাকার, সদ্‌গোপ, নাপিত বারুই, কামার, কুম্ভকার ও ময়রা। এখানে উল্লেখনীয় যে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে মেদিনীপুরের জেলা আদালত, কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালত ও বিলাতের প্রিভিকাউনসিল সদ্‌গোপদের ‘সদ্‌গোপ ব্রাহ্মণ’ বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। (Moore’s India Appeals দ্র.)।

    ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ও ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ অন্যান্য যে-সকল জাতির উল্লেখ আছে মধ্যযুগের বঙ্গীয় সমাজে তারাও বিদ্যমান ছিল। তারাই ছিল সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। ষোড়শ শতাব্দীতে ময়ূরভট্ট তাঁর ‘ধর্মপুরাণে’ বাঙলাদেশের জাতিসমূহের এক তালিকা দিয়েছেন। তালিকাটি নিচে উদ্ধৃত করা হল—’সদ্‌গোপ, কৈবর্ত আর গোয়ালা তাম্বুলি। উগ্ৰক্ষেত্ৰী কুম্ভকার একাদশ তিলি ॥ যোগী ও আশ্বিন তাঁতি মালী মালাকার। নাপিত রজক দুলে আর শঙ্খধর ॥ হাড়িমুচি ডোম কলু চণ্ডাল প্রভৃতি। মাজি ও বাগ্দী মেটে নাহি ভেদজাতি ॥ স্বর্ণকার সুবর্ণবণিক কর্মকার। সূত্রধর গন্ধবেণে ধীবর পোদ্দার ॥ ক্ষত্রিয় বারুই বৈদ্য পোদ পাকমারা পরিল তাম্রের বালা কায়স্থ কেওরা ॥’ (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ, পৃ. ৮২)। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত দ্বিজ হরিরামের ‘চণ্ডীকাব্য’ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও আমরা এই সকল জাতির উল্লেখ দেখতে পাই। এদের মধ্যে সুবর্ণবণিক ও গন্ধবণিক জাতি ছিল ধনবান গোষ্ঠী। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে, লিপ্ত থেকে বহু অর্থ উপার্জন করে সমাজে বেশ উচ্চস্থান অধিকার করত। মঙ্গলকাব্যসমূহে আমরা এদের বেশ প্রাধান্য লক্ষ্যকরি। ইতিপূর্বে আমরা বণিকসম্প্রদায়ের সমুদ্রপথে বাণিজ্য উপলক্ষে বিদেশ যাত্রার কথা উল্লেখ করেছি। মধ্যযুগে যদিও স্মৃতিকার রঘুনন্দন হিন্দুর সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করেছিলেন, তা সত্ত্বেও বণিক সম্প্রদায় তাঁদের সমুদ্রপথে বাণিজ্যযাত্রা পরিহার করেনি। সুতরাং মধ্যযুগের সমাজে আমরা আদর্শমূলক বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও বাস্তব ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ্য করি।

    গন্ধবণিক ও সুবর্ণবণিক সমাজেও আমরা শিক্ষার প্রসার দেখি। বস্তুত শিক্ষার প্রসার ব্রাহ্মণেতর অন্যান্য জাতির মধ্যেও ছিল। বণিক-সম্পদ্রায়ের ষষ্ঠীবর সেন ও গঙ্গাধর সেন বহু গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন। নাপিত মধুসূদনও নল-দময়ন্তী উপাখ্যানের ভিত্তির উপর একখানি কাব্য রচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাঝি-কায়েত, রামনারায়ণ গোপ, ভাগ্যবন্ত ধুপি প্রভৃতিও লেখক হিসাবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। এ ছাড়া, অনেকে নূতন ধর্মপ্রবর্তক হিসাবেও বরণ্যে হয়েছিলেন। যেমন সদ্‌গোপ-বংশীয় রামশরণ পাল কর্তাভজা পাল কর্তাভজা উপাসকদল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

    আট

    মধ্যযুগের সমাজে যবন-দোষের জন্য অনেক জাত হারাত। যারা যবনদের সংস্পর্শে আসত তাদেরই যবন-দোষ ঘটত। দেবীবরের ‘মেলবন্ধনে’ কয়েকটি মেলকে যবন-দোষ-দুষ্ট বলে বর্ণিত করা হয়েছে। তবে এজন্য তাদের জাত গিয়েছে একথা বলা হয়নি। আবার অদ্ভুতচার্যের ‘রামায়ণ’ পাঠে আমরা জানতে পারি যে, সমাজের একদল উদার মনোভাব সম্পন্ন লোক এই যবন দোষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝাণ্ডাও তুলেছিলেন। যবন-দোষ তখনই ঘটত যখন হিন্দু নারী মুসলমান, মগ ও পোর্তুগীজগণ কর্তৃক ধর্ষিতা হত, বা এদের সঙ্গে হিন্দু খাওয়া-দাওয়া করত। মনে হয়, সমাজের বিধানকর্তারা প্রথমে যবন-দোষ-দুষ্ট পরিবারগণের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন এবং সে সকল পরিবারকে জাতিচ্যুত করতেন। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল যে ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড় হয়ে যায়, তখন তাঁরা এ সম্বন্ধে শান্তিটাকে লঘু করে দিয়েছিলেন। অন্তত দেবীবরের ‘মেলবন্ধন’ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। হিন্দুসমাজের মধ্যে পিরালী, শেরখানী প্রভৃতির সৃষ্টি সেটাকে সমর্থন করে। তবে অনেক জায়গায় রক্ষণশীল সমাজ কঠোরই থেকে গিয়েছিল এবং যবন-দোষের জন্য কোনও কোনও পরিবারকে জাতিচ্যুত করতে দ্বিধা বোধ করত না। রঘুনন্দন (ষোড়শ শতাব্দী) দেখলেন এভাবে যদি হিন্দুসমাজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তা হলে হিন্দু একেবারে লোপ পেয়ে যাবে। তাঁর সামনে এটা ‘চ্যালেঞ্জ-রূপে দেখা দিল। আগে যেসব বিদেশী আক্রমণকারী এসেছিল, তারা হিন্দুই হয়ে গিয়েছিল। তাতে হিন্দুসমাজ প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু মুসলমানগণ কর্তৃক ধর্মান্তরিতকরণের ফলে হিন্দুসমাজ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল। কিভাবে এই ক্ষয় নিবারণ করা যেতে পারে, সেটাই ছিল রঘুনন্দনের চিন্তা। সেজন্য রঘুনন্দন বিধান দিলেন যে মাত্র একটা সংক্ষিপ্ত প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা এরূপ ধর্মান্তরিত লোকেরা আবার হিন্দু হতে পারে।

    নয়

    মধ্যযুগে শিক্ষাবিস্তারের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ছিল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ কর্তৃক পরিচালিত চতুষ্পাঠীসমূহ। চতুষ্পাঠীসমূহের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ শাস্ত্র, অনুশীলন, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জন্য নবদ্বীপের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। ‘চৈতন্য ভাগবত’ থেকে আমরা চৈতন্যের সমসাময়িক কালে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মহাতীর্থ হিসাবে নবদ্বীপের সুনাম বিশেষভাবে অবগত হই। নব্যন্যায় ও স্মৃতির অনুশীলনের জন্য নবদ্বীপ বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। নৈয়ামিক হিসাবে তখনকার দিনে নবদ্বীপের রঘুনাথ শিরোমণি, বাসুদেব সার্বভৌম প্রকৃতির নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।

    তবে নবদ্বীপই শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না। শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার জন্য রামকেলী, ত্রিবেণী, কুমারহট্ট (হালিসহর), ভট্টপল্লী (ভাটপাড়া), গোন্দলপাড়া (চন্দননগর), ভদ্রেশ্বর, জয়নগর-মজিলপুর, আন্দুল, বালী, বর্ধমান প্রভৃতিও প্রসিদ্ধ ছিল। দ্রাবিড়, উৎকল, মিথিলা ও বারাণসী থেকে দলে দলে ছাত্র বর্ধমানের চতুষ্পাঠীতে অধ্যয়ন করতে আসত। এই সকল চতুষ্পাঠীতে যে মাত্র নব্যন্যায় বা স্মৃতিশাস্ত্রেরই অনুশীলন হত তা নয়। জ্যোতিষ, ন্যায়, কোষ, নাটক, গণিত, ব্যাকরণ, ছন্দোসূত্র প্রভৃতি ও দণ্ডি, ভারবি, মাঘ, কালিদাস প্রভৃতির কাব্যসমূহ এবং মহাভারত, কামন্দকী-দীপিকা, হিতোপদেশ প্রভৃতি পড়ানো হত।

    সাধারণ গ্রামবাসীর শিক্ষালাভের জন্য ছিল পাঠশালা। পাঠশালা ও চতুষ্পাঠীর মধ্যে প্রভেদ ছিল এই যে চতুষ্পাঠীসমূহ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা (অনেক সময় বিদুষী ব্রাহ্মণ কন্যারা), যেমন—হটী, বিদ্যালঙ্কার (?–১৮১০) ও দ্রবময়ী (১৮০৭-) পরিচালনা করতেন। পাঠশালাসমূহে যে কোনও জাতির লোকেরা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতেন। পাঠশালা সমূহে সাধারণত প্রাথমিক লিখন-পড়ন, শুভঙ্করী, পত্র ও দলিলাদি লিখন প্রভৃতি সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হত। পাঠশালার শিক্ষককে গুরুমশাই বলা হত এবং তিনি শিক্ষাদানের জন্য খুব বদ্যান্যতার সঙ্গে বেতের ব্যবহার করতেন। পাঠশালায় ছেলেমেয়ে উভয়েই পড়ত। মেয়েরা যে লেখাপড়ায় দক্ষতা লাভ করত তার পরিচয় আমরা মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে উল্লিখিত লহনা, খুল্লনা ও লীলাবতী কর্তৃক পত্র-লিখন থেকেও জানতে পারি

    কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেয়েরা যে লেখাপড়া শিখে বিদুষী হতেন, তা আমরা সমসাময়িক কালের অন্যান্য রচনা থেকেও জানতে পারি I ভারতচন্ত্রের (১৭১১-১৭৬০) ‘অন্নদামঙ্গল’-এর নায়িকা বিদ্যা তো বিদ্যারই প্রতীক ছিলেন। রানী ভবানীও (১৭১৫-১৮০১?) বেশ সুশিক্ষিত মহিলা ছিলেন। নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০-১৭৮২) ও বর্ধমানের রাজবাড়ির মেয়েরাও লেখাপড়া জানতেন।

    অনেক মেয়ে সংস্কৃত শিক্ষার উচ্চ সোপানে উঠেছিলেন। তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন রাঢ়দেশের হটী বিদ্যালঙ্কার ও হটু বিদ্যাঙ্কার, বিক্রমপুরের আনন্দময়ী দেবী (১৭৫২-১৭৭২) ও কোটালিপাড়ার প্রিয়ম্বদা দেবী (১৬- ১৭ শতাব্দী) ও বৈজয়ন্তী দেবী (১৭ শতাব্দী)। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুপ্রসিদ্ধা ছিলেন হটী বিদ্যালঙ্কার। তিনি ছিলেন রাঢ়দেশের এক কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের বালবিধবা। সংস্কৃত-ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি ও নব্যন্যায়ে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করে বারাণসীতে এক চতুষ্পাঠী স্থাপন করেছিলেন। পণ্ডিতসমাজ তাঁকে বিদ্যালঙ্কার উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বেশ বৃদ্ধ বয়সে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান। হটু বিদ্যালঙ্কারের আসল নাম ছিল রূপমঞ্জরী। তিনিও রাঢ়দেশের মেয়ে ছিলেন, তবে তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তাঁর পিতা নারায়ণ দাস অল্পবয়সেই মেয়ের অসাধারণ মেধা দেখে, তার ১৬/১৭ বছর বয়স কালে তাঁকে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে অধ্যয়ন করে রূপমঞ্জরী ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। নানা জায়গা থেকে ছাত্ররা তাঁর কাছে ব্যাকরণ, চরকসংহিতা, নিদান ও আয়ুর্বেদের নানা বিভাগের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করতে আসত। অনেকে বড় বড় কবিরাজ তাঁর কাছে চিকিৎসা সম্বন্ধে পরামর্শ নিতে আসতেন। রূপমঞ্জরী শেষ পর্যন্ত অবিবাহিতাই ছিলেন এবং মস্তক মুণ্ডন করে মাথায় শিখা রেখে পুরুষের মতো বেশ ধারণ করতেন। ১০০ বৎসর বয়সে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

    প্রিয়ম্বদা দেবী সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতা শিবরাম সার্বভৌম বিত্তবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পশ্চিমদেশীয় পণ্ডিত রঘুনাথ মিশ্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে, মেয়ে- জামাইকে ভূমিদান করে তাঁদের গ্রামে স্থিত করেন। প্রতিভাশালিনী এই মহিলা সংস্কৃত ভাষায় যেমন অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন তেমনই কবিতা রচনা করতে পারতেন। বৈজয়ন্তী দেবী সপ্তদম শতাব্দীর মেয়ে ছিলেন। সুন্দরী ছিলেন না বলে স্বামী কৃষ্ণনাথ সার্বভৌম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সংস্কৃত শ্লোকে রচিত পত্রে তাঁর কবিত্বশক্তি দেখে স্বামী তাঁকে গ্রহণ করেন। আনন্দময়ী আঠারো শতকের মেয়ে। পয়গ্রামনিবাসী অযোধ্যারামের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্যে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। পিতা অন্যকর্মে ব্যস্ত থাকায়, তিনি মহারাজা রাজবল্লভের অনুরোধে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের প্রমাণ ও প্রতিকৃতি স্বহস্তে তৈরি করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। খুল্লতাত জয়নারায়ণকে ‘হরিলীলা’ কাব্য রচনাতেও তিনি সাহায্য করেছিলেন।

    তবে মেয়েদের দু-চারজন এরূপ উচ্চশিক্ষিতা হলেও সাধারণ মেয়েরা অল্পশিক্ষিতাই হত। তাদের বিদ্যার দৌড় পাঠশালায় লব্ধ শিক্ষা পর্যন্ত। এর প্রধান কারণ ছিল মেয়েদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন। বিবাহের পর অন্তঃপুরে প্রবেশ করে যাতে না তারা অজ্ঞানতার তিমিরের অবগুণ্ঠিতা হয়ে বন্দিনী বামার জীবন যাপন না করে, তার মুক্তির জন্য ১৯ শতকে উত্তরপাড়া হিতকারী সভার প্রয়াস বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। এ-সম্পর্কে তাঁদের প্রবর্তিত ‘অন্তঃপুরিকা পরীক্ষা’ ছিল এক অভিনব অবদান।

    দশ

    মেয়েদের বিবাহ সাধারণত আট বছর বয়সের আগেই হয়ে যেত। সেরূপ বিবাহকে গৌরীদান বলা হত। গৌরীদানই প্রশস্ত বিবাহ ছিল। অনূঢ়া মেয়ের বয়স দশ পেরিয়ে গেলে সমাজে তার পরিজনকে একঘরে হয়ে থাকতে হত। একঘরে হয়ে থাকা তখনকার দিনে খুব বড় রকমের সামাজিক শাস্তি ছিল। তাদের ধোপা, নাপিত ও পুরোহিত বন্ধ হয়ে যেত। তাদের সঙ্গে কেউ সামাজিক আদান-প্রদান করত না। কোন সামাজিক কাজেও তারা নিমন্ত্রিত হত না।

    বিবাহের আচার-ব্যবহার রীতিনীতি এখনকার মতোই ছিল। বিবাহ ও অন্যান্য মাঙ্গলিক কর্মের সময় মৃদঙ্গ, পটহ, ঢক্কা, মাদল, বংশী, মুরজ ও বীণা বাজানো হত। তবে এখন যেমন মেয়ের বাপকে কন্যাপণ দিতে হয়, তখনকার দিনের প্রথা ছিল ঠিক বিপরীত। বরের বাপই পণ দিত মেয়ের বাপকে। এখনও পর্যন্ত এ প্রথা সমাজের নিম্নকোটির লোকদের মধ্যে প্রচলিত আছে।

    মেয়েরা নানারকম ব্রত করত। শ্বশুরকুল, পিতৃকুল লক্ষ্মীবান হউক, ক্ষেতে ধান হউক, গোয়ালভরা গরু হউক, স্বামী ভালবাসুন, সতীন মরুক, ইত্যাদি প্রার্থনাই ব্রতসমূহের মাধ্যমে করা হত। স্বামী যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসুক এরূপ প্রার্থনাও করা হাত। কুমারী মেয়ের ব্রতের মাধ্যমে রামের মতো স্বামী, লক্ষ্মণের মতো দেবর, দশরথের মতো শ্বশুর ইত্যাদি প্রার্থনা করত।

    বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকার দরুণ সমাজে বালবিধবার সংখ্যই খুবই বেশি ছিল। বালবিধবাদের বেশভূষা, খাদ্যাখাদ্য প্রভৃতি রঘুনন্দনের কঠোর বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। যে কোনও বয়সেই সে বিধবা হোক না কেন, তাকে শুদ্ধাচারিণী হয়ে থানকাপড় পরতে হত ও অলঙ্কার পরিহার করতে হত। মাছ, মাংস ও অন্যান্য অনেক খাদ্য সামগ্রী বর্জন করতে হত ও একদশীর দিন উপবাসী থাকতে হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজা রাজবল্লব বিধবার পুনরায় বিবাহ দেওয়ার রীতির প্রচলন করবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরোধিতার জন্য তা করতে সক্ষম হননি।

    সধবা মেয়েদের অবগুণ্ঠনবতী হয়ে থাকতে হত। তাঁদের স্বামী, শ্বশুর ও ভাশুরস্থানীয়দের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। তাঁরা ভাশুর বা মামাশ্বশুরদের সংস্পর্শে আসতে পারতেন না। যদি দৈবাৎ কোনও ক্রমে ভাশুর বা মামাশ্বশুরের সঙ্গে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যেত, তা হলে ধান-সোনা উৎসর্গ করে শুদ্ধ হতে হত। এ প্রথা বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

    এগার

    শাস্ত্রকারদের কৃপায় মধ্যযুগের সমাজে খাদ্যাখাদ্য সম্বন্ধে অনেক কিছু বিধান প্রবেশ করেছিল। তবে মধ্যযুগের অনেক নূতন খাদ্যও বিদেশ থেকে এদেশে আনীত হয়েছিল। তাদের অন্যতম হচ্ছে আলু, তামাক, জামরুল, সফেদা, চীনাবাদাম, আতা, গোলমরিচ প্রভৃতি।

    মধ্যযুগের সমাজে বৈষ্ণবরা নিরামিষ ভোজন করতেন। কিন্তু শাক্তরা আমিষভোজী ছিলেন। নানারূপ খাদ্যসামগ্রী দিয়ে নানা ব্যঞ্জন বানানো হত। নারায়ণদেবের পদ্মাপুরাণে উল্লিখিত আছে যে, বেহুলার বিবাহ উপলক্ষে ঘৃতসংযোগে ১১ রকম নিরামিষ ব্যঞ্জন ও তৈলসংযোগে ১২ রকম মাছের ব্যঞ্জন, ও পাঁচ রকম (ছাগ, মেষ, মৃগ, কবুতার, ও কচ্ছপের) মাংসা রান্না করা হয়েছিল। এ ছাড়া ছয় রকম মিষ্টান্নের ও উল্লেখ আছে। তবে গরিব লোকদের খাদ্য ছিল ভাত, ডাল চচ্চরি, অম্বল ও মাছের ঝোল।

    বার

    অশনের পরেই আসে বসন-ভূষণের কথা। পুরুষরা মাত্র ধুতিই পরিধান করত। চাদর ও চটিজুতাও ব্যবহার করত এবং মাথায় পাগড়ি বাঁধত। মেয়েরা পরত শাড়ি। কখনও কখনও তাঁরা কাঁচুলিও ব্যবহার করত। তবে বিত্তশালী সমাজের পোশাক-আশাক অন্য রকমের ছিল। তারা প্রায়ই রেশমের কাপড় পরিধান করত ও পায়ে ভেলভেটের উপর রূপার জরির কাজ করা জুতা ও কানে কুণ্ডল, দেহের উপর অংশে আঙরাখা, মাথায় পাগড়ি ও কোমরের নিচে কোমরবন্ধ পরত। পুরুষরা দেহ চন্দনচর্চিত করত, আর মেয়েরা স্নানের সময় হলুদ ও চন্দনচূর্ণ দিয়ে দেহ মার্জিত করত ও মাথায় কেশপাশ আমলকির জলে ধৌত করত। অভ্রের চিরুনি দিয়ে তারা মাথা আঁচড়াত ও নানা রকমের খোঁপা বাঁধত। তা ছাড়া, তারা যে-সব অলঙ্কার পরত, তা আমরা আগেই বলেছি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – অতুল সুর
    Next Article প্রমীলা প্রসঙ্গ – অতুল সুর

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }