Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন – অতুল সুর

    লেখক এক পাতা গল্প428 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    মধ্যযুগের অর্থনেতিক অবস্থা

    আর্থিক ঋদ্ধির জন্য বাঙলাকে ‘সোনার বাঙলা’ বলা হত। মধ্যযুগের বৈদেশিক পর্যটকরা বাঙলাদেশকে ভূস্বর্গ বলে অভিহিত করে গেছেন। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য থেকেও আমরা বাঙলার বিপুল ঐশ্বর্যের কথা জানতে পারি। বাঙলার আর্থিক সম্পদ প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর কৃষি ও শিল্পের উপর। নদীমাতৃক বঙ্গভূমি উৎপন্ন করত প্রচুর পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য। এই সকল কৃষিজাত পণ্য বাঙলার নিজস্ব চাহিতা মিটিয়েও বিক্রীত হত দেশদেশান্তরের হাটে। কৃষিকাজ পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল চাউল। অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে ছিল তুলা, ইক্ষু, তৈল বীজ, সুপারি, আদা, লঙ্কা, ও নানাবিধ ফল। পরে পাট ও নীলের চাষও প্রভূত পরিমাণে হত। উৎপন্ন পণ্যের পাঁচ শতাংশে রাজস্ব হিসাবে রাজকোষে জমা দিতে হত। শতকরা ৯০ জন লোক কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকত। কৃষিকে হীনকর্ম বলে কেউ করত না। এমনকি ব্রাহ্মণরাও কৃষিকর্ম করতে লজ্জাবোধ করত না। চন্ডীমঙ্গলে রচয়িতা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম লিখে গিয়েছেন যে, তাঁর সাতপুরুষ কৃষিকর্মে নিযুক্ত ছিলেন।

    শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল কার্পাস ও রেশমজাত বস্ত্র। সূক্ষ্ম বস্ত্র প্রস্তুতের জন্য বাঙলার প্রসিদ্ধি ছিল যুগ যুগ ধরে। দেশ-বিদেশে বাঙলার ‘মসলিনের’র চাহিদা ছিল। এই জাতীয় বস্ত্র এত সূক্ষ্ম হত যে একটি ছোট নস্য ধারের মধ্যে বিশ গজ কাপড় ভরতি করা যেত। বাঙলায় শর্করার প্রসিদ্ধিও সর্বত্র ছিল। এ ছাড়া বাঙলায় প্রস্তুত হত শঙ্খজাত নানারূপ পদার্থ, লৌহ, কাগজ, লাক্ষা, বারুদ ও বরফ। বীরভূমের নানা স্থানে ছিল লৌহপিন্ডের আকর। তা থেকে লৌহ ও ইস্পাত তৈরি হত। বীরভূমের যে সকল স্থানে লৌহ ও ইস্পাতের কারখানা ছিল, সেগুলি হচ্ছে দামরা, ময়সারা, দেওচা, ও মহম্মদনগর। এই সকল লোহা দিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ পর্যন্ত কলকাতা ও কাশিমবাজারে কামান তৈরি হত। বলা বাহুল্য, এই লোহা ও ইস্পাত প্রস্তুতের জন্য বীরভূমের কারিকরগণ নিজস্ব প্রণালী অবলম্বন করত। বরফ তৈরির জন্যও ও বাঙলার নিজস্ব প্রণালী ছিল। শীতকালে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে গরম জল ভরতি করে সমস্ত রাত্রি রাখা হত। প্রভাতে তা বরফে পরিণত হত।

    এ ছাড়া চিনি তৈরির জন্যও বাঙলার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যে চিনি তৈরি হত বা ধবধবে সাদা হত। এই চিনি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হত। (এই পদ্ধতি সম্বন্ধে যারা সম্যক অবগত হতে চান, তাঁরা বর্তমান লেখকের ‘ফোক্’ এলিমেন্টস ইন বেঙ্গলি লাইফ, পুস্তকে দেখুন)।

    বাঙলার লোকদের বিশেষরূপে পারদর্শিতা ছিল নৌকা নির্মাণে। বাঙলার নানাস্থানে নৌকা-নির্মাণের কেন্দ্র ছিল, বিশেষ করে ঢাকায় কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে বলেছেন যে কখনও কখনও নৌকাগুলি ৩০০ গজ লম্বা ও ২০০ হজ চওড়া হত। দ্বিজ বংশীদাস তাঁর মনসামঙ্গলে ১০০০ গজ লম্বা নৌকার কথাও বলেছেন, তবে সেটা অতিরঞ্জন বলেই মনে হয়। বাঙলার নিজস্ব তৈরি এরূপ বৃহদাকার নৌকা করেই মনসা ও চন্ডীমঙ্গল কাব্যদ্বয়ের নায়করা, যথা- চাঁদ সদাগর, ধনপতি, সদাগর ও শ্রীমন্ত সদাগর দূরদূরান্তরে বাণিজ্য করতে যেতেন। মনে রাখতে হবে যে, সে যুগের নাবিকদের দিগ্‌দর্শন যন্ত্র ছিল না। বংশীদাসের মনসামঙ্গল-কাব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, সে যুগের নাবিকরা মাত্র সূর্য ও নক্ষত্রসমূহের অবস্থান লক্ষ্য করেই সাতসমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিত। তাদের দক্ষতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। তবে তাদের অনেক ঝুঁকি নিতে হত, সেটা বলা বাহুল্য মাত্র। তারা প্রায়ই দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হত। বিশেষ করে আরবদস্যু দ্বারা আক্রমণের ফলেই তারা পশ্চিমের দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য বর্জন করে সিংহল, যবদ্বীপ, মালয়, প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু এই পটভূমিকাও ষোড়শ শতাব্দী থেকে পরিবর্তিত হয়ে পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদের আক্রমণের ফলে। বস্তুত ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে বাঙালী বণিকরা আর বাণিজ্য করতে বিদেশ যেতেন না। মোট কথা, বৈদেশিক বাণিজ্যক্ষেত্র থেকে তাঁরা ক্রমশ হটে গিয়েছিলেন। হটে যাবার প্রধান কারণ ছিল মগ ও পর্তুগীজ দস্যু দ্বারা বন্দুক ও কামানের ব্যবহার। বাঙালী বণিকদের তা ছিল না। সুতরাং বাঙালীরা আর এই সকল বৈদেশিক দস্যুদের সঙ্গে পেরে উঠলেন না। তাঁরা বিদেশ-যাত্রার ঝুঁকি পরিহার করে বাণিজ্যক্ষেত্রে মধ্যগের কাজ করা শুরু করে দিলেন। নবাগত বিদেশী বণিকদেরই তাঁরা মাল বেচতেন। এর ফলে দেশের মধ্যে গড়ে উঠল কতকগুলি নতুন অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকেন্দ্ৰ। সেসব কথা বিশদভাবে আমরা পরে বলব।

    দুই

    বস্তুত কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য—এই তিনটির ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল বাঙালীর সমৃদ্ধি। বিশেষ করে লক্ষ্যণীয় বণিকসমাজের ধনাঢ্যতা। তাদের ধনাঢ্যতার পরিচয় আমরা পাই মনসা ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যসমূহে। তাদের স্থান ছিল সমাজের শীর্ষদেশে। তাদের আবাস কেন্দ্র ছিল সপ্তগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। পরে আমরা দেখব যে এই বণিকসমাজই উত্তরকালে কলকাতা নগরীর পত্তন করেছিল। সপ্তগ্রাম ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে আরও অনেক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। তাদের অন্যতম হচ্ছে গৌড়, সোনারগাঁ, হুগলী ও চট্টগ্রাম। এ সকল বাণিজ্যিক কেন্দ্রের নাম আমরা সমসাময়িক বৈদেশিক পর্যটকদের লেখনী মারফত জানতে পারি। ষোড়শ শতাব্দীর পর্যটক বারথেমা, ‘বেঙ্গল’ নামে, এক নগরী ও বন্দরের উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর আর একজন পর্যটক যোয়াও দ্য ব্যারোস গৌড়কে প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখে গিয়েছেন যে গৌড় নগর নয় মাইল লম্বা ও বিশ লক্ষ লোক দ্বারা অধ্যুষিত ছিল। তিনি আরও বলেছেন যে, গৌড়ের পণ্যসমৃদ্ধির জন্য সেখানে এতে লোকের সমাগম হত যে ভিড় ঠেলে নগরের রাস্তা দিয়ে হাঁটা দুষ্কর ছিল। এ ছাড়া তিনি সোনারগাঁ, হুগলী, চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম প্রভৃতি বাণিজ্যকেন্দ্রেরও উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগের পর্যটক সীজার ফ্রেডরিক সপ্তগ্রামকেই সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধিশালী বন্দর বলে বর্ণনা করেছেন। এর বিশ বছর পরে র‍্যালফ্ ফীচ সপ্তগ্রাম এবং চট্টগ্রাম উভয়কেই বাংলাদেশের বড় বন্দর (Porte Grande) বলে অভিহিত করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর পর্যটক হ্যামিলটন হুগলী ও চট্টগ্রামকেই প্রধান বন্দর বলে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সপ্তগ্রামের কোনও উল্লেখ করেননি। অধিকন্তু তিনি তাণ্ডার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, তাণ্ডা সুতা ও সুতিবস্ত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।

    এককালে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঙলার যে অসাধারণ প্রতাপ ছিল, তা হারবার পর বাঙলা অভ্যন্তরীণ হাটে পরিণত হয়েছিল। কেবল নবাগত বিদেশীরাই যে বাঙলায় হাটে মাল কিনত, তা নয়। ভারতের নানাস্থান থেকে ব্যবসায়ীরা বাঙলার হাটে মাল কিনতে আসত। যার বাঙলার হাটে কেনাবেচা করতে আসত, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাশ্মীরী, মূলতানী, আফগান, পাঠান, শেখ, পগেয়া (যাদের নাম থেকে বড়বাজারের পগেয়াপটির নাম হয়েছে), ভুটিয়া ও সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীরা যে কারা, তা আমরা সঠিক জানি না। মনে হয় তারা হিমালয়ের সানুদেশ থেকে চন্দনকাঠ, মালার গুটি (beads) ও ভেষজ গাছগাছড়া বাঙলায় বেচতে আসত। তার বিনিময়ে তারা বাঙলা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যেত। হলওয়েলের এক বিবরণী থেকে আমরা জানতে পারি যে, দিল্লী ও আগরা থেকে পগেয়ারা বর্ধমানে এসে প্রচুর পরিমাণ বস্ত্র, সীসা, তামা, টিন ও লঙ্কা কিনে নিয়ে যেত। আর তার পরিবর্তে তারা বাঙলাদেশে বেচে যেত আফিম, ঘোড়া ও সোরা। অনুরূপভাবে কাশ্মীরের লোকরা বাঙলা থেকে কিনে নিয়ে যেত লবণ, চামড়া, নীল, তামাক, চিনি, মালদার, সাটিন কাপড় ও বহুমূল্য রত্নসমূহ। এগুলি তারা বেচত নেপাল ও তিব্বতের লোকদের কাছে।

    বাঙলার বাহিরের ব্যবসায়ীরা যেমন বাঙলায় আসত, বাঙলার ব্যবসায়ীরাও তেমনই বাঙলা বাহিরে যেত। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে জয়নারায়ণ কর্তৃক রচিত ‘হরিলীলা’ নামক এক বাংলা বই থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাঙলার একজন বণিক ব্যবসা উপলক্ষে হস্তিনাপুর, কর্ণাট, কলিঙ্গ, গুর্জর, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর, ভোজ, পঞ্চাল, কম্বোজ, মগধ, জয়ন্তী দ্রাবিড়, নেপাল, কাঞ্চী, অযোধ্যা, অবন্তী, মধুরা, কাম্পিল্য, মায়াপুরী, দ্বারাবতী, চীন মহাচীন ও কামরূপ প্রভৃতি দেশে গিয়েছিলেন।

    যারা বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত, তারা বেশ দু পয়সা রোজগার করে বড়লোক হত। বস্তুত তাদের ধনদৌলত প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছিল। তার পরিচয় আমরা পাই বাংলা সাহিত্যে ও বৈদেশিক পর্যটকদের বিবরণীতে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে একদল চৈনিক দূত বাঙলাদেশে এসেছিলেন। তাঁদের বিবরণী থেকে আমরা তৎকালীন বাঙলাদেশের ধনাঢ্যতার এক বিশেষ পরিচয় পাই। খুব জাঁকজমক করে তাদের এক বিশেষ চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আহার্যের ভোজে আপ্যায়িত করা হয়েছিল। ভোজান্তে তাঁদের প্রত্যেককে উপহার দেওয়া হয়েছিল এক একটি স্বর্ণনির্মিত বাটি, পিকদানী, সুরাপাত্র ও কপিবন্ধ। তাঁদের সহচরদের দেওয়া হয়েছিল রৌপ্যনির্মিত উক্ত সামগ্রী সমূহ এবং ওঁদের সঙ্গে যে সকল সৈন্যসামন্ত এসেছিল, তাদের দেওয়া হয়েছিল বহু রৌপ্যমুদ্রা। তাঁরা লিখে গেছেন যে বাঙলা কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ। আর্থিক সম্পদের এই তিন উৎস থেকে বাঙলা প্রচুর অর্থ অর্জন করত। লোকদের পোশাক-আশাক ও অলঙ্কার দেখে তাঁরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিলেন। গৌড় ও পূর্ব বাঙলার ধনীসমাজের ঐশ্বর্যের কথা ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’ ও ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’-এও উল্লেখিত হয়েছে। এই দুই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে গৌড় ও পূর্ব বাঙলার ধনী লোকরা সোনার থালা বাটিতে আহার করে। ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড় লুণ্ঠিত হয়েছিল, তখন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ লুন্ঠনকারীদের কাছ থেকে ১৩০০ সোনার থালা ও প্রচুর অর্থ ও অলঙ্কার উদ্ধার করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফিরিস্তা ও মন্তব্য করেছেন যে কোন বড়লোকের ঘরে কত সংখ্যক সোনার থালা-বাসন আছে সেটাই ছিল তার ধনাঢ্যতার মাপকাঠি। সমাজে তার মর্যাদা নির্ভর করত তার ওপর।

    তিন

    মধ্যযুগে বাঙলাদেশের লোকদের জীবন যাত্রা-প্রণালী যে সচ্ছল ছিল, তা সে যুগের জিনিসপত্রের দাম লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যাবে। চতুৰ্দশ শতাব্দীতে আফ্রিকা দেশ থেকেই ইবনে বতুতা নামে একজন পর্যটক বাঙলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তখনকার পণ্যমূল্যের যে তালিকা দিয়ে গিয়েছেন তা হচ্ছে (বর্তমানের নয়াপয়সায় দাম)—চাউল এক মণ ১২ পয়সা, ঘি এক মণ ১৪৫ পয়সা, চিনি এক মণ ১৪৫ পয়সা, তিল তৈল এক মণ ৭৩ পয়সা, সূক্ষ্ম কাপড় ১৫ গজ ২০০ পয়সা, দুগ্ধবতী গাভী একটি ৩০০ পয়সা, হৃষ্টপুষ্ট মুরগী ১২টি ২০ পয়সা ও ভেড়া একটি ২৫ পয়সা।

    ইবনে বতুতা একজন বাঙালী মুসলমানের কাছ থেকে শুনেছিলেন যে, তার সংসারের (নিজের, স্ত্রীর ও একজন ভৃত্যের) বাৎসরিক খাই-খরচ ছিল মাত্র সাত টাকা।

    ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতেও জিনিসপত্রের অনুরূপ সুলভতার কথা উল্লেখিত হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে বার্নিয়ারও বলেছেন যে বাঙলাদেশের চাউল, ঘি, তরিতরকারি ইত্যাদি দাম নামমাত্র। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দের এক মূল্যতালিকায় আমরা মুর্শিদাবাদে প্রচলিত যে দাম পাই, তা থেকে জানতে পারি যে, প্রতি টাকায় মুর্শিদাবাদে পাওয়া যেত সরু চাউল ১ মণ ১০ সের থেকে ১ মণ ৩৫ সের পর্যন্ত, দেশী চাউল ৪ মণ পঁচিশ সের থেকে ৭ মণ ২০ সের, গম ৩ মণ থেকে ৩ মণ ৩০ সের, তেল ২১ সের থেকে ২৪ সের, ঘি ১০ সের ৮ ছটাক থেকে ১১ সের ৪ ছটাক ও তুলা ২ মণ থেকে ২ মণ ৩০ সের। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাহেবদের খাদ্যসামগ্রির দাম ছিল একটা গোটা ভেড়া দু’টাকা, একটা বাচ্চা ভেড়া এক টাকা, ছয়টা ভাল মুরগী বা হাঁস এক টাকা, এক পাউন্ড মাখন আট আনা, ১২ পাউন্ড রুটি এক টাকা, ১২ বোতল ক্লারেট মদ ৬০ টাকা ইত্যাদি।

    চার

    কিন্তু এই প্রতুলতার মধ্যেও ছিল নিম্নকোটির লোকদের দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণ ছিল সরকারী কর্মচারীদের অত্যাচার ও জুলুম। কবিকঙ্কণ-চণ্ডীর রচয়িতা মুকুন্দরাম বলেছেন যে যদিও ছয়-সাত পুরুষ ধরে তাঁরা দামুন্যা গ্রামে বাস করে এসেছিলেন, তথাপি ডিহিদার মাহমুদের অত্যাচার তাঁরা ভিটাচ্যুত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনুরূপ দুর্দশার বর্ণনা ক্ষেমানন্দ কেতকাদাসও দিয়ে গিয়েছেন। একজন সমসাময়িক বৈদেশিক পর্যটক (মানরিক) লিখে গিয়েছেন যে, রাজত্ব দিতে না পারলে, যে কোনও হিন্দুর স্ত্রী ও ছেলেপুলেদের নীলাম করে বেচা হত। এ ছাড়া, সরকারী কর্মচারীরা যখন তখন কৃষক রমণীদের ধর্ষণ করত। এর কোনও প্রতিকার ছিল না। তার ওপর ছিল যুদ্ধ- বিগ্রহের সময় সৈন্যগণের অত্যাচার ও বাঙলার দক্ষিণ অংশের উপকূলভাগে মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের উপদ্রব। তারা যে মাত্র লুটপাট করত ও গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দিত তা নয়, মেয়েদের ধর্ষণ করত ও অসংখ্য নরনারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশের দাসদাসীর হাটে বেচে দিত। এ ছাড়া, দুঃসময়ে ও দুর্ভিক্ষের সময় তারা স্ত্রী ও পুত্র- কন্যা হাটে বেচে দিত।

    পাঁচ

    দাসদাসী-কেনাবেচা মধ্যযুগে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। সোনার থালা-বাসনের মতো দাসদাসীর সংখ্যাও ছিল সামাজিক মর্যাদার একটা মাপকাঠি। এসব দাসদাসীর ওপর গৃহপতিরই মালিকানা স্বত্ব থাকত। গৃহপতির অধীনে থেকে তারা গৃহপতির ভূমিধর্ষণ ও গৃহস্থালির কাজকর্ম করত। কখনও কখনও মালিকরা তাদের দাসীগণকে উপপত্নী হিসাবেও ব্যবহার করত। নবাব, সুলতান ও বাদশাহদের হারেমে এরকম হাজার হাজার দাসী থাকত। সাধারণত এ সকল দাসীদের হাট থেকে কেনা হত। অনেক সময় দামদস্তুর করে মুখের কথাতেই তাদের কেনা হত, তবে ক্ষেত্রবিশেষে দলিলপত্রও তৈরি করে নেওয়া হত। এরূপ দলিলপত্রকে গৌড়ীয়-শাতিকা-পত্র, বহীখাতা, অকরার পত্র ইত্যাদি বলা হত।

    দাসীদাসী রাখা ঋগ্বেদের আমল থেকেই ভারতের প্রচলিত ছিল। তবে মধ্যেযুগে এই প্রথা বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। হিন্দুসমাজে দাসদাসী কেনা ও রাখা যে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই নিবন্ধ ছিল, তা নয়। চাষাভূষার ঘরেও দাসদাসী থাকত। সাধারণত লোক দাসীদের সঙ্গে মেয়ের মতো আচরণ করত। অনেকে আবার নিজের ছেলের সঙ্গেও কোন দাসীর বিয়ে দিয়ে তাকে পুত্রবধূ করে নিত। তখন সে দাসত্ব থেকে মুক্ত হত। অনেকে আবার যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করবার জন্য দাসীদের ব্যবহার করত। এরূপ দাসীদের গর্ভজাত সন্তানদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্মৃতিতে ও নির্দেশ আছে।

    সমসাময়িক দলিলপত্র থেকে আমরা দাসদাসীর মূল সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারি। বিদ্যাপতির সময় ৪৪ বৎসর বয়স্ক এক কৈবর্ত পুরুষ দাসের দাম ছিল ৬ টাকা, গৌরবর্ণ ৩০ বৎসর বয়স্কা দাসীর দাম ছিল ৪ টাকা, ১৬ বৎসর বয়স্ক বালকের দাম ছিল ৩ টাকা এবং ৫ বৎসর বয়স্কা শ্যামাঙ্গী মেয়ের দাম ছিল মাত্র এক টাকা। পরবর্তী কালে দামের কিছু হেরফের দেখা যায়। চতুর্দশ শতাব্দী আফ্রিকাদেশের পর্যটক ইবন বতুতা বলেছেন যে, তিনি মাত্র ১৫ টাকায় এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণীকে কিনেছিলেন ও তাকে বাঙলাদেশ থেকে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। দাসদাসীর ব্যবসাটা বিশেষভাবে চলত দুর্ভিক্ষের সময়।

    ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে পর্তুগীজ দস্যুরা দক্ষিণ বাঙলা থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে চুরি করে নিয়ে গিয়ে তাদের বিদেশের হাটে বিক্রী করত। আবার মেয়ে চুরি করে এদেশের লোকরাও অপর অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে তাদের বিয়ের পাত্রী হিসাবে বিক্রী করত। এরূপ মেয়েদের ‘ভরার মেয়ে’ বলা হত। অনেক সময় অজানা মুসলমানী ‘ভরার মেয়ের সঙ্গে হিন্দুর ছেলের বিয়েও দেওয়া হত।

    ইংরেজরা যখন এদেশে আসে, তখন তারাও দাসদাসী কিনত ও খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বেচত।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – অতুল সুর
    Next Article প্রমীলা প্রসঙ্গ – অতুল সুর

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }