Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঙালি মুসলমানের মন – আহমদ ছফা

    লেখক এক পাতা গল্প150 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র

    বাংলা সাহিত্যে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কোনো জুড়ি নেই। এই উপন্যাসের একটি চরিত্রে মানিকবাবু যে সুগভীর ইতিহাসবোধ, জীবন অভীপ্সা এবং মনীষার পরিচয় দিয়েছেন, বোধকরি চরিত্রসৃজনকুশলতায় তারো কোনো জুড়ি নেই। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা উঠলেই কুবের, মালা, কপিলা, রাসু, গনেশ ইত্যাকার মানুষদের মুখগুলো আপনা-আপনিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মানিক বাবু তেমন শিল্পী (বিশেষ করে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে) যা স্পর্শ করেছেন, জীবন্ত করে তুলেছেন। ক্ষিপ্র টানে একেকটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র প্রমত্তা পদ্মা থেকে শুরু করে, প্রাকৃতিক তাণ্ডব, ঝড়, বন্যা, সমুদ্রের ভয়ংকর বিস্তার, এমনকি সে আকুরঠাকুরের গ্রামের শ্যামাদাসের বাড়ির গম্ভীর পাঁঠাটি পর্যন্ত আশ্চর্য রকম জীবন্ত। যে নৈসর্গিক পটভূমিকায় জীবন সংগ্রামে কাতর মানুষগুলোকে তিনি স্থাপন করেছেন সেই নিসর্গ যেমন ভীষণে সুন্দরে জীবন্ত, তেমনি জীবন্ত বিচিত্র আবেগের মানুষগুলো। কেউ বাড়তি নয়, কোনো ঘটনা বাহুল্য নয়, কোনো দৃশ্যপট অতিরিক্ত নয়। তাই উপন্যাসটির কথা উঠলেই সবকিছু মনে পড়ে যায় এবং সব মিলিয়েই উপন্যাসটি। যার যতটুকু প্রাপ্য ঠিক ততটুকু আয়তনের মধ্যেই লাগসইভাবে বসে গেছে। কুবের-মালা-কপিলা-রাসু এসব চরিত্রের ক্রমিক উন্মোচনের মধ্যে যে হৃদয় ভাবনার উৎসার হয়েছে, গভীর চিন্তাটি পর্যন্ত পরিবেশের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সে উপস্থাপনার বাস্তবতা এবং শিল্প সৌকর্য নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব।

    উপস্থিত মুহূর্তে আমরা তার ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রটির প্রতি একটু অভিনিবেশ সহকারে তাকাবার চেষ্টা করছি। বেবাক বাংলা সাহিত্যে এমন আশ্চর্য চরিত্র আর কোনো শিল্পী সৃষ্টি করেছেন কিনা সন্দেহ। শুধু অন্তদৃষ্টি, শুধু জীবনবোধ কিংবা লেখকসুলভ নির্লিপ্ততা, লেখার রাজনৈতিক সামাজিক দর্শন অথবা মানবচরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই এরকম একটা চরিত্র সৃষ্টি করা যায় না। আরো অধিক কিছুর প্রয়োজন।

    সমস্ত উপন্যাসে যদিও ‘হোসেন মিয়া’র উপস্থিতি অধিক নয়, তবু ‘হোসেন মিয়া’ই উপন্যাসটির প্রাণ। কিন্তু তাই বলে ‘হোসেন’ উপন্যাসটির নায়ক নয়। নায়কের যে আবেগ থাকে, দুর্বলতা থাকে, ‘হোসেনে’র চরিত্রে তার ছিটেফোঁটাও নেই। ইলিয়াড মহাকাব্যে দেবরাজ জিউসের নির্দেশে যেমন সবকিছু একের পর এক ঘটে যাচ্ছে- বিজয়ী-বিজিত, হত এবং হন্তা শুধু নিমিত্তমাত্র, সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই মহাইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন দেবতার চূড়ান্ত ইচ্ছারই বিজয় সূচিত হয়েছে; ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে পাদপ্রদীপের একটু পেছনে দণ্ডায়মান মিঠেমিঠে বুলি এবং গুছিগুছি দাড়িবিশিষ্ট এই শান্ত একেবারে অনুত্তেজিত মানুষটিও সেরকম শক্তির অধিকারী। তার প্রকাণ্ড ইচ্ছাশক্তির প্রবল বাধ্যবাধকতা পদ্মার তীরবর্তী জেলে সমাজে অত্যন্ত সক্রিয়, তারা কেউ সে নিগড় ছিন্ন করতে পারে না। এই মহাস্বাপ্লিকের স্বপ্ন সফল করার জন্য আনন্দবেদনা স্পন্দিত প্রেম ভালোবাসা কল্লোলিত অন্তর নিয়েই স্বেচ্ছায় ‘হোসেন মিয়া’র কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়। অথবা তাদের বেঁচে থাকবার গভীর আকাঙ্ক্ষাই তাদেরকে বাধ্য করে হোসেন মিয়ার কাছে যেতে। পদ্মা পারের এই এক টুকরো পৃথিবী, যেখানে জেলে সমাজের বসবাস, মায়ামমতা, ঝগড়াবিবাদ এবং প্রাণধারণের সমূহ আর্তি গভীর করুণ সুরে বেজে ওঠে, তা যখন কোনো কারণে দৃষ্টির সীমানা থেকে অবলুপ্ত হয়ে যায়, বিশাল পৃথিবীর অন্য কোনো স্থান, অন্য কোনো জনপদ তাদের দৃষ্টিতে নিবাসভূমি হিসেবে ভেসে ওঠে না; জঙ্গলাকীর্ণ, বাঘ সিংহে ভরা, লোনাজলবেষ্টিত ঊষর অনুর্বর ময়নাদ্বীপের ছবিই চোখে চোখে দৃশ্যমান হয়। সেখানে যাবার দুঃস্বপ্ন তাদের পেয়ে বসে এবং শেষ পর্যন্ত যেতেও হয়। হোসেন মিয়া এই ময়নাদ্বীপের রাজা এবং আবিষ্কারক দুই-ই।

    ‘হোসেন মিয়া’র পরিচয় এভাবে দিয়েছেন লেখক তার বাড়ি ছিল নোয়াখালী অঞ্চলে। বেশ কয়েক বছর আগে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর গ্রামে সে আসে এবং সে সময়ে জহুর মাঝির বাড়িতে আশ্রিত হিসেবেই ছিল ও অন্যান্য মাঝিদের সঙ্গে মাঝিগিরি করেই জীবিকা নির্বাহ করত। এ কয় বছরে সে বেজায় রকম ধনী হয়ে উঠেছে। এখন দাড়িতে মেহেদির রং লাগায়, ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি শরীরে চড়ায়, মাত্র অল্প কিছুদিন আগেই দুনম্বরের স্ত্রীকে বিয়ে করে এনেছে। ধনী হওয়া সত্ত্বেও সে জেলে পাড়ার লোকদের সঙ্গে আগের মতোই মেলামেশা করে। ধনসম্পদ হাতে এলে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠার উন্মত্ত মোহ মানুষকে পেয়ে বসে, ‘হোসেন মিয়া’র মধ্যে তার কণামাত্রও নেই। বড়লোকের সঙ্গে সে ব্যবসা করে, সমাজ করে না। আরেকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন লেখক, হোসেন মিয়া একজন স্বভাব কবি। ঘটনাচক্রে যদি হোসেনের জীবনধারা বদলে না যেত তাহলে অনায়াস কবিত্ব শক্তির বলে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন একজন সাধুপুরুষ হিসেবে পরিচিত হতে পারত। ‘লালন শাহ’, হাসান রাজার মতো তারও অনেকগুলো রচনা পল্লিগ্রামের গীতি সংগ্রহে স্থান করে নিত। আশপাশের দশগ্রামের মানুষ জাগতিক কল্যাণাকাতক্ষায় তার কবরে ভক্তিভরে মোমের প্রদীপ জ্বালাতো। কিন্তু ঘটনাচক্রে ‘হোসেন’কে অন্য জীবন বেছে নিতে হয়েছে, তাই বলে তার কবিত্ব শক্তির উৎস একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়নি। এখনো সে ইচ্ছে করলে মুখে মুখে চমৎকার গান রচনা করতে পারে। তার আত্মপ্রত্যয়ের জুড়ি নেই। তাই ‘হোসেন’ যখন বলে, খুশি হলে সে সব করতে পারে, একটুও অস্বাভাবিক শোনায় না। অপরিসীম আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন, নানাগুণে গুণান্বিত ‘হোসেন মিয়া’র আত্মসংযমেরও তুলনা নেই। কেউ তার ক্ষতি করলে শাস্তি সে দেয়, কিন্তু কখনো কোনো ব্যাপারে তাকে রাগ করতে দেখা যায়নি।

    ‘হোসেন মিয়া’ পাকা মাঝিও বটে। এত নির্ভাবনায় সে গভীর সমুদ্রে নৌকায় হাল ধরে বসে থাকতে পারে, পদ্মাপারের বংশ পরম্পরা মাঝিরাও ‘হোসেনে’র হেকমত দেখে চমকে যায়। সে ম্যাপ দেখে দ্বীপের অবস্থান নির্ণয় করতে জানে, রাতের তারার গতিপথ দেখে সময় কত বলতে পারে, দিক নির্ণয়ের কাজে চুম্বক ব্যবহার করতে জানে নির্ভুলভাবে। চাটগায়ে সায়েব কোম্পানির জাহাজে চাকরি করার সময় যন্ত্রপাতি চালনার বিদ্যা এত গভীর অনুরাগ নিয়ে শিক্ষা করেছে যে, ইচ্ছা করলে ‘হোসেন’ একখানি জাহাজ নিয়ে সমস্ত পৃথিবী একাকীই ঘুরে আসতে পারে।

    ‘হোসেন মিয়া’র বাড়ি নোয়াখালী। মাঝখানে অনেক বছর জাহাজে সে চাকরি করেছে এবং বর্তমানে পদ্মাপারের কেতুপুর গ্রামের হিন্দু-মুসলমান মাঝিদের সঙ্গেই তার সমাজ।

    সংকীর্ণ পৃথিবীর এই অধিবাসীরা অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী এবং ক্ষমতাসম্পন্ন ‘হোসেন মিয়া’র সাথে ঠিক মিশতে পারে না। কিন্তু তাদেরকে তার কাছে যেতেই হয়। ‘হোসেন’ যদিও বলুক-না কেন সে হৃদয়ের মধ্যিখান থেকে তাদের পেয়ার করে, তথাপি মজ্জাগত আদিম অসহায়তার ভীতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারে না। যন্ত্রের মতো নিখুঁত, দেবতার মতো পারঙ্গম এবং জীন-পরীর মতো রহস্যময় ‘হোসেন মিয়া’র কথায় সায় দিলে, তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে যে একদিন অমঙ্গল এসে তাড়া করবে তারা বুঝতে পারে। কিন্তু তাদের নিয়তিই এমন যে তারা যেন ‘হোসেনে’র কথায় সায় দিতে এবং তার নির্দেশ পালন করার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে।

    বহিরঙ্গের দিক দিয়ে দেখলে ‘হোসেন নোয়াখালী জেলার মুন্সী মোল্লা জাতীয় মুসলমান। সে মুন্সী মোল্লার মতো কথা বলে, পোশাক পরে, দাড়ি রাখে, আবার দাড়িতে নুরে মেহেদির রংও লাগায়। এ হলো বাইরের ব্যাপার। ভেতরের মানুষটি ঠিক একবারে অন্যরকম। হোসেনের মধ্যে ধর্মীয় কোনো সংস্কারের সামান্য আঁচারও নেই। এ নিয়ে সে কোনো কথাই বলে না। সে শুধু বোঝে তার জন্য কোটা সুবিধার । জগৎ এবং জীবনকে সে যে দৃষ্টিতে দেখে তার সঙ্গে অন্য দশজন প্রাচ্য দেশীয় মানুষের কোনো মিল নেই।

    আজিজ সাহেব প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি ময়নাদ্বীপে মসজিদ স্থাপন করে এবং হিন্দুদের জমি দেয়া বন্ধ করে তাহলে বসবাসকারী সংগ্রহের কিছুই অসুবিধা হবে না। হোসেন সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। গ্রহণ না করার পেছনে কারণ হলো, মুসলমানদের জন্য যদি মসজিদ বানিয়ে দেয়, তা হলে হিন্দুদের জন্যও মন্দির বানিয়ে দিতে হবে। আর হিন্দুদের যদি সে না নিয়ে যায়, তাহলে এগার মাইল দীর্ঘ এই দ্বীপ সে কিভাবে মানুষ দিয়ে পূরণ করবে তাই হোসেনের যুক্তি হলো, মন্দির মসজিদ সব ফ্যাসাদে গিয়ে কাজ নেই। ওসব ছাড়াই চলবে ময়নাদ্বীপ। ময়নাদ্বীপ আবাদ করে বসবাস স্থাপন করার সঙ্গে মন্দির মসজিদের কোনো ব্যবহারিক সম্পর্ক নেই। তাই পরম নিশ্চিন্তে সেগুলো বাদ দিতে পারে । ময়নাদ্বীপে সে যে নতুন মানব সমাজ সৃষ্টি করতে চায় তারা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হবে, হবে নতুন বিশ্বাসে বলীয়ান, নতুন মূল্য চেতনায় সমৃদ্ধ হবে তাদের অন্তর্লোক। অতিকষ্টে যে সকল ভাঙাচোরা মানুষকে ‘হেসেন’ সংগ্রহ করে, পাত্রী ঠিক করে তাদের বিয়ে দেয়, তাদের প্রতিও ‘হোসেনে’র কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু এই নরনারীর মিলনে যে মানুষ মানুষী আসবে এবং ময়নাদ্বীপে বসবাস করবে তাদের প্রতিই রয়েছে তার প্রকৃত আগ্রহ। যেন ‘হোসেন’ নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন মানব সভ্যতার সৃষ্টি করতে যাচ্ছে একাকী। এই রকম একটি প্রকাণ্ড ঘটনা যার প্রয়াসের মধ্য থেকে সম্ভাবিত হয়, তাকে বিধাতা পুরুষের মতো পারঙ্গম,দুৰ্জ্জেয় এবং ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠতে হয়। স্বয়ং বিধাতাপুরুষও নাকি একজন কবি। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তার কবিতা। মানিক বাবুর ‘হোসেন মিয়া’ও একজন ক্ষুদে বিধাতাপুরুষ। সীমিত পরিসরের মধ্যে তার অসাধ্য কোনো কিছুই নেই এবং ময়নাদ্বীপ তার একটি কবিতা। একজন ভাবমুগ্ধ কবি যেমন সমস্ত প্রযত্ন প্রয়াস বিলিয়ে দিয়ে কবিতাটিকে সার্থক করে তুলতে চান, ‘হোসেন মিয়া’ও স্বপ্নের শেষ বিন্দুটি দিয়ে ময়নাদ্বীপকে, লোক কোলাহলে মুখরিত একটি কাব্যিক ভূখণ্ড হিসেবে নির্মাণ করতে চায়।

    যৌনাচারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও ‘হোসেনের মতামত রীতিমতো কৌতূহলের সঞ্চার করে। বৃদ্ধ বসিরের স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের সম্পর্ক নিয়ে ময়নাদ্বীপের ক্ষুদ্র জনসমাজটির জনমত চঞ্চল হয়ে উঠলে লোক দেখানোর জন্য ‘হোসেন’ এনায়েতকে তিনদিন অভুক্ত বেঁধে রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাতে বসিরের স্ত্রীকে যখন এনায়েতকে স্বহস্তে ভাত খাইয়ে দিতে দেখা যায় সে খবর গোপন রাখার জন্য ‘হোসেন’ অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করে। ‘হোসেনের ঐ একই যুক্তি, বৃদ্ধ বসিরের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। অথচ তার স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের সম্পর্ক নিয়ে দ্বীপবাসীদের মধ্যে কথা উঠলে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও করে। কিন্তু রাতে নিজেই উদ্যোগী হয়ে এনায়েতের সঙ্গে বসিরের স্ত্রীর মিলনের বন্দোবস্ত করে দেয়। তার ফলে একটি নতুন মানুষ জন্ম নিতে পারে। ‘হোসেন মিয়া’র চোখে একেকটি নতুন মানুষ হীরা মাণিক্যের চাইতেও মূল্যবান।

    .

    ২.

    ‘হোসেন মিয়া’র চরিত্র বিশ্লেষণ করলে কতিপয় অসাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। যদিও সে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলে, মুন্সি মোল্লাদের মতো জামা কাপড় পরে, তথাকথিত সমাজের প্রতিষ্ঠাবানদের এড়িয়ে চলে তথাপি ‘হোসেন মিয়া বিশ্বাস, হৃদয়বৃত্তিতে এবং কল্পনায় একেবারে খাঁটি আধুনিক মানুষ। যন্ত্রবিজ্ঞানে তার বিলক্ষণ দক্ষতা আছে। বিশ্বপ্রকৃতিও যে নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ, সে নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে পারলে প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ থাকে না। প্রকৃতি সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞানই ‘হোসেন মিয়াকে অকুল সমুদ্রের বুকে এমন অনুত্তেজিত, সাহসী এবং প্রত্যয়সম্পন্ন করেছে। আসলে জ্ঞানই যে শক্তি তা তার টুকরোটাকরা বাক্যালাপের মধ্যে বিরল হীরার দ্যুতির মতো ঝরে পড়েছে। যে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদে এবং প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞানের সাহায্যে একসময়ে ইউরোপীয় ভৌগোলিক অভিযাত্রীর দল আমেরিকা থেকে মেরু প্রদেশ অবধি অভিসার যাত্রা করেছিল, ‘হোসেন মিয়া’ সে কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুকেরই বঙ্গীয় সংস্করণ । অতি চেনা পোশাকে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই দেখা দিয়েছে বলে ঠিক সেরকম মনে হয় না । মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ‘হোসেন মিয়া পুরনো চেতনার স্থলে নতুন মূল্য চেতনাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ধর্ম ‘হোসেন মিয়া’র দৃষ্টিতে একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং পুরনো পৃথিবীর স্মারক চিহ্ন। তাই তার নতুন উপনিবেশে নিজের কিংবা অপরের কোনো ধর্মকেই শেকড় প্রসার করতে না দিতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ নিয়ে সে বিশেষ বাক্যালাপ করে না। কারণ সমতল ভূমির লোকেরা তার এই চূড়ান্ত মতামত সমূহকে কখনো যথার্থ বলে মেনে নেবে না। একটা হৈ চৈ পড়ে যাবে। তাতে করে তার স্বপ্নের অপমৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে । এত বুদ্ধিমান, এত দক্ষ ‘হোসেন মিয়া’ও জানে ডাঙার মানুষগুলোর আচার সংস্কারের বেড়াজালে আটকা পড়লে ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা অল্প। তাই ‘হোসেন মিয়া অজস্র অর্থের মালিক হয়েও কখনো সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের পথে পা বাড়ায়নি। ইচ্ছা করলে সে সামাজিক সুনাম সুখ্যাতি কিনে নিতে পারত। কিন্তু তা করতে গিয়ে হোসেনকে আটকা পড়ে থাকতে হতো এবং অচরিতার্থ থেকে যেত কবি ‘হোসেনে’র একটি নির্জন দ্বীপে একটি নতুন উপনিবেশ, একটি নতুন সভ্যতার একক স্রষ্টা হওয়ার স্বপ্ন।

    সামাজিক এবং নরনারীর সম্পর্ক-বিষয়ক যে মতামত ‘হোসেন’ পোষণ করে তাতে বেঁচে থাকার বাস্তব দাবির প্রতিই পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। ভুল করেও তার মুখ দিয়ে একবার, বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না,কল্পনা দিয়ে ধরা যায় না এমন কোনো ভৌতিক বিষয় উচ্চারিত হয়নি। কি সমাজ সম্বন্ধের ক্ষেত্রে, কি নরনারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে, হোসেন মিয়ার যে মতামত তা পূর্ণ মাত্রায় প্রসারিত করলে সেগুলো যে চেহারা পাবে তা দাঁড়াবে অনেকটা ইউরোপীয় প্রয়োগবাদী দার্শনিকদের মতামতের অনুরূপ।

    .

    ৩.

    আসলে ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রটিকে লেখক মানিকবাবু মানুষের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অনেকগুলো পর্যায়েরই ঘনীভূত রূপ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। যন্ত্রবিজ্ঞানে মানুষের দীক্ষা, ভৌগোলিক আবিষ্কারের অভিযাত্রা এবং সামাজিক মানব সম্বন্ধের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োজনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত সন্তর্পণে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ‘হোসেন মিয়ার’ চরিত্রে চরিয়ে দিয়েছেন। এই তিনটি জিনিসই ইউরোপে ‘এনলাইটেন্টমেন্ট’ আন্দোলনের ফল। কোনো বাঙালির মধ্যে এই তিনটি বিষয় সচরাচর সমান পরিমাণে মিলমিশ খায় না। প্রায় তিন শতাধিক বছরের অর্জিত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ভিন্ন একটি ভৌগোলিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রাণবান করে তোলা প্রায় অসম্ভব। জীবনে যা অসম্ভব, মানিকবাবু শিল্পে তা সম্ভব করে তুলেছেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে ‘হোসেন মিয়াকে বলতে হয় নব্য মেঘনাদ’। একটি মাত্র চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানব জাতির অগ্রসর অংশের চিন্তা চেতনা, জীবন অভীপ্সা। দৃশ্যমান করে তোলার জন্য ভূগোল-ইতিহাসের কি পরিমাণ জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল তা অবাক বিস্ময়ে কল্পনা করার বিষয়। যুগযুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার প্রতিভূ হিসেবে ‘হোসেন’কে উপস্থাপন করেছেন বলেই সমস্ত উপন্যাসে ‘হোসেনের মনোবৃত্তিসমূহের কোনো বিকাশ নেই, রূপান্তর নেই- আগাগোড়া একরকম। রক্ত মাংসের মানুষ হলেও কোনো মানবিক অনুভূতি তার মধ্যে নেই।

    আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সমালোচকেরা ‘হোসেন মিয়া’র চরিত্রের যে একটা ঐতিহাসিক দূর বিস্তৃতি রয়েছে বলতে গেলে তার মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থই হয়েছেন। কাউকে এ ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত করতে দেখা যায়নি। যতটা চেনা পোশাকে দেখা দিক না কেন ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রের কোনো বাস্তবতা নেই। এ সম্পূর্ণভাবেই লেখকের মায়া সৃষ্টি। এই ‘হোসেন’কে জামা কাপড় পাল্টে ভিন্ন পরিবেশে অনায়াসে সায়েন্স ফিকশনের নায়ক করে দেয়া খুবই সহজ। পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে জীবন্ত নরনারী এবং সজীব প্রাণবান প্রাকৃতিক দৃশ্যের অন্তরালে অবাস্তবতাটুকু ঢাকা পড়েছে। সর্বোপরি মানিক বাবুর অসাধারণ শিল্প প্রতিভা ‘হোসেন মিয়াকে একান্ত বাস্তবানুগভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

    ১৯৭৩

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleযদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা
    Next Article সূর্য তুমি সাথী – আহমদ ছফা

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }