Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাঙালি মুসলমানের মন – আহমদ ছফা

    লেখক এক পাতা গল্প150 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা

    রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক জীবন-সাধনার প্রতি তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি ফেললে ক্রমশ মনে এ বিশ্বাস সঞ্চারিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দূরের মানুষ। তাকে ধরি ধরি ছুঁই ছুঁই মনে করলেও তিনি সম্পূর্ণভাবে ধরাছোঁয়ার অতীতই থেকে যান এবং একই কারণে দুর্বোধ্য না হলেও রবীন্দ্রনাথকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হলে সাধনা, নিষ্ঠা, শ্রম এবং সর্বোপরি সময়ের প্রয়োজন অপরিহার্য।

    রবীন্দ্র সাহিত্যের পাঠকমাত্রই অবগত আছেন, রবীন্দ্রনাথ তার রচনায় কড়া আলো কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সমধর্মী সূক্ষ্ম, মিহি, সর্বব্যাপ্ত ও সর্বভুক এক ধরনের চেতনায় পুষ্ট রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক অবদান। তিনি যে যুগের চৌহদ্দীতে লালিত পালিত সংবর্ধিত তার আগের কিংবা পরের যুগের বাংলা সাহিত্যে জীবনের শ্রেয়োবোধর সঙ্গে সৌন্দর্যচেতনার এমন সুনিবিড় মিলন কোথাও ঘটেনি। এ অসম্ভব একমাত্র রবীন্দ্রনাথের সাধনাতেই সম্ভব হয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রধান গুণ। আবার প্রকারান্তরে দুর্বলতাও বটে। এই শ্রেয়োবোধের সঙ্গে সৌন্দর্য চেতনার সহজ স্বাভাবিক মিলন রবীন্দ্রসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। তা তাকে দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বলোকের সর্বযুগের, সর্বদেশের আপনার জন করে তুলেছে যেমন, তেমনি অন্যদিকে শিল্পের এই অতি গভীর প্রতীতি, অতি প্রসারিত জীবন-দৃষ্টি তার শিল্পকর্মের অনন্যতা কতকাংশে খর্ব করেছে। জীবনের সরু, মোটা, বঙ্কিম তীর্যক অনেকগুলো স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা রবীন্দ্রমানস মথিত করেনি, সেজন্যে তার মানসিকতার বিকাশ ঘটেছে অনেকটা ঋতু বৈচিত্রের মতো স্বাভাবিক নিয়মে। দুয়েকটা বিস্ফোরণ ছাড়া রবীন্দ্রমানসে কোনো বিপ্লব কিংবা ব্যাপক পরিবর্তন নেই। উদ্ভিদের সহনশীলতায় তিনি ক্রমাগত আলোর পানে এগিয়ে গেছেন। নদীর একনিষ্ঠ স্রোতের মতো একটি স্থির লক্ষ্যের পানে আমৃত্যু ধেয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের চেতনা।

    এ অন্তঃসলিলা ধারাস্রোতের সঙ্গে আরো নানা ধারার মিলন এর গতিতে দিয়েছে বেগ, কখনো বা এসেছে বন্যা। জল কূল ছাপিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ। বিশ্বেও লেগেছে দোলা। কিন্তু মৌল ধারাটি কোথাও রুদ্ধ কিংবা ব্যাহত হয়নি। এমনকি জীবনের অন্তিম ক্ষণেও সূর্যের প্রলম্বিত রশ্মি ছটার মতো সুন্দরভাবে অন্তরের সত্য বোধটি কবিতার আকারে তার মুখ থেকে একটি আলো লাগা শিশির বিন্দুর মতো ঝরে পড়েছে।

    আজীবন সুন্দরের সঙ্গে সত্যের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার দুর্মর প্রচেষ্টারই তো নাম রবীন্দ্রনাথ। এ বিষয়ে তার ঐকান্তিকতা ধর্ম প্রচারকের চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না। অত্যন্ত সুকুমার সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর, শ্রদ্ধার ভারে আনত একখানা মন নিয়ে তিনি যেন প্রচারকের ভূমিকায় নেমেছিলেন। কিন্তু প্রচারকের লেবাস তিনি কখনো অঙ্গে ধারণ করেননি। হৃদয়ের সত্যোপলব্ধি প্রকাশের জন্য কবিতা লিখেছেন। কবিতা লিখে তার মনে হয়েছে যা বলতে চেয়েছেন, কিছুই বলা হয়নি। গল্প লিখেছেন তাই। তার পরেও মনে হয়েছে কালির অক্ষরে প্রাণের সুবর্ণ তরঙ্গমালা যেমনভাবে উচিত তেমনভাবে বেঁধে রাখতে পারেননি। তারপরে লিখেছেন নাটক, হয়তো প্রবন্ধ। এতগুলো মাধ্যমে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার পরেও তৃপ্তি আসেনি। শরণ নিতে হয়েছে সঙ্গীতের। দ্রাক্ষাকুঞ্জের মর্মরিত বিবাগী হাওয়ায় সমস্ত অন্ত র-প্রাণ মেলে ধরেও মনে হয়েছে অস্তিত্বের গোপন গহন অন্তঃপুরে আরো সৃষ্টির বীজ বুঝি রয়ে গেল। অস্তিত্বের গভীরে যেখানে চাপ-চাপ আঁধারের নিশুতি, যেখানে মানুষ নিজের অজান্তে আদিমতার ছাপ বয়ে বেড়ায়, সেখানেও পৌঁছেছে সৌন্দর্যের ‘গন্ধহীন চামেলীর লাবণ্য বিলাসের’ আহ্বান। সত্যের শুভ্রস্বরূপ তায়িত জলের মতো চেতনার গভীর স্তরকেও করেছে রঞ্জিত। সেজন্য তিনি শুধু অলঙ্কার আর আলোর প্রতিমা নির্মাণ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। রং, রেখা আর তুলির সাহায্যে আপন হৃদয়ের প্রতিরূপ নির্মাণের জন্য তাকে আসতে হয়েছিল চিত্রকলার বর্ণিল জগতে।

    অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্যের শিখা এবং সবল কাণ্ডজ্ঞানের অঙ্কুর তার মধ্যে অতি শৈশবে জেগেছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দুটি বোধ ঘনিষ্ঠ হতে ঘনিষ্ঠ হয়ে সোনার সঙ্গে সোহাগার মতো মিশে গেছে।

    জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায় প্রচারিত ব্রাহ্মধর্মে মহর্ষির আত্যন্তিক অনুরক্তির কথা স্মরণ না রেখে রবীন্দ্র সাহিত্যের আলোচনা করলে তা একপেশে হতে বাধ্য।

    কবির অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মজীবনীতে লিখেছেন: হে ধ্রুব সত্য সনাতন! কাল সহকারে কত বিষয়ের কত প্রকারে পরিবর্তন হইতেছে, কিন্তু তোমার কারুণ্য স্বরূপের কদাচ পরিবর্তন নাই। নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হইতেছে, রাজ্য ও রাজা বিনষ্ট হইতেছে, মাস ও পক্ষের অতীত হইতেছে, শীত ও বসন্ত গমনাগমন করিতেছে, বাল্য ও যৌবন তড়িতসমান তিরোহিত হইতেছে, কাল ও মৃত্যু নিরন্তর ক্রীড়া করিয়া চরাচর শাসন করিতেছে কিন্তু তোমার কারুণ্যস্বরূপের কোনো পরিবর্তন নাই।

    বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথেরা প্রার্থনায় এই মন্ত্র উচ্চারণ করতেন। কবি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কঠোর এই উপাসনার মন্ত্রকেই দৈনন্দিন জীবনচর্চার একমাত্র নিয়ামক হিসেবে কঠিন আত্মবিশ্বাসে গ্রহণ করেছিলেন। ফার্সী সাহিত্যের রসিক পাঠক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা রামমোহন রায়ের প্রচারিত ব্রাহ্মধর্মকে বেদ কিংবা বেদান্তের উপর প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে বিফল হয়ে মানুষের ‘হৃদয় মন্দিরে’ প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করার উপযোগী নির্ভার করার জন্য তার ত্যাগ তিতিক্ষা তাকে পরবর্তী সময়ে মহর্ষিতে রূপান্তরিত করেছিল।

    বস্তুত রবীন্দ্রনাথের উপর তার পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব এত ব্যাপক, এত সুগভীর যে দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনী পাঠকের মনে হবে গীতাঞ্জলী, নৈবেদ্য, গীতিমাল্য, গীতালী ইত্যাদি আত্মনিবেদনমূলক কাব্যগুচ্ছ তার পিতার মুখের কথাই শুধু ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করেছেন। তার অনেকগুলো গানের বেলাতেও এই একই কথা খাটে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের প্রায় রচনাতেই সৌন্দর্যের বসনে ভূষিত সত্যবোধের যে কারুণ্য স্বরূপকে আপন মহিমায় স্থিত দেখি তাও মহর্ষিরই পরমারাধ্য সত্যের প্রতিরূপ যেন। সত্য এবং সৌন্দর্যের এই সম্মিলিত আহিতাগ্নিতে এই যে নিঃশেষে তিলে তিলে আত্মবলিদান এবং তার যে ফল- তা কবিতা হোক, গল্প হোক, নাটক নভেল হোক, পত্র-সাহিত্য হোক, চিত্রকলা হোক, ভাষণ কিংবা ভ্রমণ বৃত্তান্ত অথবা প্রবন্ধ, প্রার্থনা সমালোচনা বাদ প্রতিবাদ যাই হোক না কেন একযোগে সবকিছুকে বলব রবীন্দ্রনাথের ঐশ্বর্যময়ী সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ।

    যা কিছু মনের উপর ভারস্বরূপ হয়ে স্বাভাবিক বিকাশের পথ রোধ করে দাঁড়ায়, সেই জড়ের উপর প্রাণের বিজয় ঘোষণাই হলো রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনার মূলমন্ত্র। জীবনের ভোগে, উপভোগে নিষ্প্রাণ জড়কে পোষ মানানোই হলো সত্যিকার বীরের চারিত্র্য ধর্ম। মানবিক আশা কম্পিত এবং নৈতিক শ্ৰেয়োবোধে মণ্ডিত নগ্ন মনুষ্যত্বই প্রকৃত জীবনশিল্পীর অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্র। কবি শেলী তার রিভোল্ট অফ ইসলাম কাব্যের ভূমিকায় কথাটিকে আরো সহজ, আরো প্রাঞ্জলভাবে বলেছেন: ‘Still love is the only thing which shall guide the moral world of human being.’

    রবীন্দ্রনাথের রচনায় জীবনের আশ্বাসের মতো বিভিন্নভাবে সহস্র ধারায় ঘটেছে এই মানবিক প্রেমের নিঃসরণ। সত্যের স্থির অকম্পিত শিখাকে বুকে ধারণ করেছিলেন যিনি, সৌন্দর্যের স্পর্শমাত্রেই যিনি আন্দোলিত হয়েছেন মানুষের পাপ, লোভ, রিরংসাকে হত্যা করার জন্য অন্তরস্থিত সত্যের পাষাণে–সৌন্দর্যের তলোয়ার শানিয়েছিলেন যিনি, সেই রবীন্দ্রনাথের সাধনা সম্যক উপলব্ধি করতে হলে মূল উৎসের থেকে দূরে গিয়ে বিচার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

    বহু দেশের চিত্তসম্পদ আত্মস্থ করলেও রবীন্দ্রমানসের মর্মমূলে ভারতীয় জীবনবোধই ছিল সব সময়ে জীয়ন্ত। আর্যঋষির চেতনায় তার মানসপট সিঞ্চিত ছিল। সুখী পরিবারের সুস্থ পরিবেশে প্রাচীন সংস্কৃতির চর্চা তার শিল্পী মনের সমস্ত আয়তন জুড়ে যে অনপনেয় রঙিলা ছাপ ফেলেছিল কোনোদিন তার রঙছুট হয়নি। অতৃপ্ত শিশুর সঞ্চরণশীল চেতনায় প্রাচীন ঋষির বাণী ঋষিপ্রতিম পিতৃদেবের মৌন সংযত স্নেহঘন ছোঁয়ার শিহরন অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্যের শিখা এবং সবল কাণ্ডজ্ঞানের অঙ্কুর জাগিয়ে তুলেছিল। রবীন্দ্র মানসের যে কঠিন ফ্রেম যার উপর প্রবল একটি আলোকিত ঝরনার মতো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিচেতনা সমুজ্জ্বল বিশ্বাসে আমৃত্যু উড্ডীন ছিল, ঠাকুর বাড়ির কারখানাতেই তার সৃষ্টি এবং দেবেন্দ্রনাথ তার যাদুকর কারিগর।

    নিঃসঙ্গ বালকের মনে অনন্তের তৃষ্ণার বীজরূপী উপনিষদের বোধ কোমল চিত্তবৃত্তির সঙ্গে তরল সঞ্জীবনী সুধার মতো মিশে গিয়েছে। অস্তিত্বের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া সুপ্রাচীন ফসিলীভূত প্রাণের ললিতবাণী সহস্র শিখায় জ্বালিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল আরো অনেক কিছুর।

    আপন পরিবারেই তিনি ভারতীয় সাধনার বিভিন্ন ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। বেদ উপনিষদ, গীতার সারসত্য যেমন একদিকে তেমনি অন্যদিকে হাফিজ, খৈয়াম প্রমুখ ইরানী সাধকের সাধনার রাঙা স্রোতের ধারাও শৈশবে রঞ্জিত করেছে তার চিত্ততল। প্রাচীন ভারতের মহিমামণ্ডিত প্রতিভা বাল্মীকি, কালিদাস, বেদব্যাস,ভবভূতির সংস্কৃত কাব্য তিনি আগ্রহ সহকারে পড়েননি শুধু বিধৃত কাব্য চিত্রাবলীও বালকের সচঞ্চল অনুভূতি দিয়ে আপনার করে নিয়েছিলেন। হাজার বছরের তমসা বিদীর্ণ করে রবীন্দ্রনাথের কল্পনা প্রাচীন ভারতের দেবদেউল, তুষার মণ্ডিত শৈলশিখর, বেত্রবতী, শিপ্রা, শ্রাবন্তী, উজ্জয়িনী, প্রশান্ত পোবন, সুকুমার ঋষিকুমার, নিবিড় অরণ্যানী মহানুভব রাজন্যবর্গ সকলকে চিনে নিয়েছিল। সে যে কত গভীর চেনা, কত নিবিড় আত্মীয়তা রবীন্দ্র সাহিত্যের পাঠক তার মর্মোপলব্ধি করতে পারবেন।

    শুধু সংস্কৃত কেন প্রাচীন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রাণপ্রবাহের স্পন্দন তার চেতনায় এক অপরূপভাবে তরঙ্গিত হয়েছে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে মেলে তার কিঞ্চিত পরিচয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সংস্কৃতির অভিঘাতে রামমোহন মনীষার আশ্রয়ে বাংলা সাহিত্যের যে নব অঙ্কুরোদগম বিদ্যাসাগর, মধুসূধন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিহারীলাল প্রমুখ সাহিত্যসাধকের সঞ্চারিত প্রাণাবেগে যার সমৃদ্ধি একটু একটু করে প্রায় তার সবটুকু মর্মমধু আত্মসাৎ করেছিলেন। সুদক্ষ অস্ত্র চিকিৎসকের মতো ভার জীর্ণ অংশ কেটে ফেলে পূর্বসূরি সাহিত্যসাধকের প্রাণকণা সূর্যশিখার উপকরণস্বরূপ সঞ্চয় করেছিলেন।

    এতে শেষ নয়, পূর্ব পুরুষের জীবন সগ্রাম, রাষ্ট্রবিপ্লব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা নিরূপদ্রব শান্ত স্নিগ্ধ জীবনে কেঁপে ওঠা প্রাণের রসময় প্রবাহ- যা উত্তর পুরুষের মুখে মুখে বাড়ির পাশের ছোট্ট নদীটির মতো তিরতিরানো ধারায় বয়ে গেছে, সমগ্র বাংলাদেশের সে লোকায়ত সংস্কৃতিকেও তিনি কোল দিয়েছিলেন, হজম করেছিলেন তার মর্মমঙ্গল লোকায়ত সংস’র মতো তিনি

    রবীন্দ্র সাহিত্যে রামায়ণের ব্যাপকতা, মহাভারতের গাম্ভীর্য, কালিদাসের উপমা, অলংকার, বৈষ্ণব কবির ললিত গানের বাণী, ইরানের রসসিক্ত প্রাণের পেলবতা, লোক সংস্কৃতির সাদামাটা চেতনা, ভারতচন্দ্রের নিপুণতা এবং অগ্রজ কবিদের কোনো কোনো পর্ভূক্তি, কোনো পদ, কোনো শব্দের অবিকৃত অথবা ঈষৎ ভিন্ন প্রয়োগ দেখে বোঝা যায় তিনি স্বদেশের অতীতের মানস ফসল কি গভীর আন্তরিকতায় বুকে তুলে নিয়েছিলেন, কি মমতায় অন্তরের ‘সহস্র ব্যগ্র বাহু মেলে’ দেশের ঐতিহ্যকে আলিঙ্গন করেছিলেন। য়ুরোপ প্রবাসকালে অল্পবয়স্ক বালক কি প্রচণ্ড অনুসন্ধিৎসা। নিয়েই য়ুরোপকে দেখেছিলেন। মনে য়ুরোপ কি তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করেছিল। ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্রে’ আমরা এমন একজন তরুণকে দেখি যার দৃষ্টি কড়া আলোকের বন্ধুত্সবের তলায় নিচ্ছিদ্র, নিরন্ধ, ঘনায়মান অন্ধকারকে স্পর্শ করেছে। এমন একটি মনের অনুরণন আমাদের কানে এসে বাজে- যে মন হাসির ফোয়ারার অন্তরালবর্তী কীটদষ্ট মনের ভঁজে ভাঁজে থমকে থাকা করুণ ক্রন্দনের সন্ধান পেয়েছে।

    য়ুরোপের অহমিকা তাকে আহত করেছে কিন্তু গরিমাও মুগ্ধ করেছে। শেকসপীয়রের মানবোপলব্ধি, মিল্টনের কল্পসাঁতার, শেলীর মুক্ত প্রমিথিউস, বায়রনের উদ্দামতা, কীটসের তন্ময়তা, ব্রাউনিঙের অধ্যাত্মোপলব্ধি, গ্যয়টের মানবীয়তা, রাসকিনের প্রগাঢ়তা, টলস্টয়ের ব্যাপ্তি এবং ফরাসী সাহিত্যিকদের বাগবৈদগ্ধ তাকে স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া আরো নানা প্রাণের স্পর্শ প্রাণে এসে অবশ্যই লেগেছে। তবে তিনি য়ুরোপের মধ্যযুগের সাধকদের মধ্যেই সহমর্মিতা খুঁজে পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি।

    রেনেসাঁ প্রভাবিত পশ্চিম য়ুরোপের চিন্তন এবং মনন পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে না হলেও আংশিক গ্রহণ করেছিলেন। য়ুরোপের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, যুক্তিপ্রেম, নরনারীর সমানাধিকার তার উপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিল তার ফলেই তিনি সামন্ততন্ত্রের খোলস ভেঙে ব্যক্তিচিন্তার মুক্তি ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই রেনেসাঁ চেতনার সঙ্গে ভারতবোধের সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ মনুষ্যত্বের আদর্শ সমুজ্জ্বলভাবে দল মেলেছে।

    সদা জাগ্রত মন দিয়ে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে যিনি বিশ্ব সংস্কৃতির মধু ভাণ্ডার থেকে এত বেশি গ্রহণ করেছিলেন, তার দানের পরিমাণও যে সেখানে বিপুল হবে তাতে অবাক হবার কিই বা আছে!

    ইতিহাসের এক যুগসন্ধিকালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। সাম্রাজ্যবাদের প্রসার এবং তার ফলে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের মধ্যে মরণপণ সংগ্রাম, পরাধীন দেশসমূহের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং তদুপরি পর পর দুটি রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে প্রবলের ক্ষোভ প্রতিহিংসাকে তিনি জ্বলন্তভাবে দেখতে পেয়েছেন। পরাধীন ভারতের বঞ্চিতের চিত্তক্ষোভ তার বুকে অতি শৈশবেই বেজেছিল ।

    তারপর যতই বয়স বেড়েছে দেশপ্রেম মনে আরো প্রগাঢ়ভাবে ঘনীভূত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম নিকষিত হেম যেন। দেশের প্রতি অন্ধ হয়ে সত্তার আলোময় স্বরূপ দিয়ে দেশের মাটিকে এমনভাবে কেউ ভালোবেসেছেন কিনা আমার জানা নেই। যাদের শতাব্দীব্যাপী দুঃখ দুর্দশা তিনি চোখে দেখেছেন, কানে শুনেছেন ইতিহাসে পাঠ করেছেন, তাদেরকে হিংসার দিকে নয়, ঘৃণার দিকে নয় শান্তির ললিত উদার দিগন্তের পানে আপন বাণীর মন্ত্রশক্তিতে আকর্ষণ করার সেকি অনিন্দ্র প্রচেষ্টা! আপন দেশের হতভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে বিশ্বের হতভাগ্য দেশসমূহকে ভালোবেসেছেন। ফ্যাসীবাদ বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, ‘নাইট’ খেতাব পরিত্যাগ করেছেন, শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আরো কত গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বিচিত্র কর্মধারার মধ্যে সর্বপ্রকারের আত্মশ্লাঘা জলাঞ্জলি দিয়ে সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের প্রতীক হিসেবে ফুটে উঠেছিলেন। সেজন্য দেখি বৃদ্ধ বয়সের জড়তাকে উপেক্ষা করেও ব্রাত্য জাতহারা’ রবীন্দ্রনাথ সর্বহারাদের রাষ্ট্র সোভিয়েট দেশ দর্শন করতে এসেছেন।

    রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভাষা নদীর স্রোতের মতো কেউ তাতে নিজের নাম লিখে রাখতে পারে না। কিন্তু বাংলাভাষায় নিজের নাম লিখে রেখেছেন। ভাষার মতো সংস্কৃতিকেও দেশসীমা কালসীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারে না- অদলবদল রূপান্তরের মাধ্যমে ধাবমান হরিণীর মতো দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। কালের বিবর্তনে জীর্ণ অংশ ঝরে যায়। নতুন প্রাণের স্পন্দনে নবাঙ্কুর গজায়। রবীন্দ্রনাথ অতীত বর্তমানের বিশ্ব সংস্কৃতির স্রোতে অবগাহন করে তার প্রাণের শিখা ছেঁকে পরিশ্রুতভাবে প্রকাশ করেছেন। আপন বাণীর মতো করে জীবন রচনা করেছেন। বিশ্বাভিসারী প্রাণের উদার আকুতি কর্মের পাষাণগলা স্রোতে ভাষায়িত করেছেন ।

    আমাদের আনন্দ আমাদের গৌরব রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে মানুষের উপযোগী ভাষা হিসেবে রূপায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা মানুষ হওয়ার প্রেরণা পাই। রবীন্দ্রনাথের নাম মনে এলেই কিশোর কবি সুকান্তের সে কয়টি পঙক্তি বার বার মনে পড়ে যায়:

    এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে
    তোমার দানের মাটি
    সোনার ফসল তুলে ধরে।

    ১৯৬৯

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleযদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা
    Next Article সূর্য তুমি সাথী – আহমদ ছফা

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }