Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাড়িটায় কেউ যেয়ো না – অনীশ দেব

    লেখক এক পাতা গল্প159 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    এক যে ছিল চোর (গল্প)

    সোমপ্রকাশ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিলেন৷ গায়ে জড়ানো শাল৷

    ঘর অন্ধকার৷ মাথার কাছে একটা জানলা খোলা৷ জানলা দিয়ে গাছের কয়েকটা পাতা, ডালপালা দেখা যাচ্ছিল৷ তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ছিল একটুকরো রাতের আকাশ৷ আর সেই আকাশে দু-একটা ফুটফুটে তারা৷

    শীতের সময়েও সোমপ্রকাশের অন্তত একটা জানলা খোলা রাখা চাই৷ নইলে ওঁর মনে হয় দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে৷

    কিন্তু এখন, একটা জানলা হাট করে খুলে রাখা সত্ত্বেও, সোমপ্রকাশের দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷

    ওঁর এমনটা হওয়ার কথা নয়৷ আর সন্ধে সাতটায় ঘর আঁধার করে বিছানায় শুয়ে পড়ার কথাও নয়৷

    এমনটা হয়েছে একটা কবিতার লাইন শুনে৷

    পাশের ঘরে ছেলে সুমিতাভকে ওর মা কবিতা মুখস্থ করাচ্ছেন৷ এসময়টায় সুমিতাভ মায়ের কাছে পড়তে বসে, আর সোমপ্রকাশ পাশের বেডরুমে জুত করে টিভি দেখতে বসেন৷

    আজও তাই বসেছিলেন, কিন্তু ওই কবিতার লাইনগুলো সব এলোমেলো করে দিল৷ মনটা ফিরে গেল অনেক পুরোনো সময়ে৷ সোমপ্রকাশ যখন সুমিতাভর বয়েসে ছিলেন৷ ক্লাস সিক্সে পড়তেন৷ গ্রামের স্কুলে৷

    সে প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ বছর আগের কথা৷

    বেড়ার ঘর৷ টালির চাল৷ ঘরের সামনে বড় উঠোন৷ উঠোনে বড়-বড় আমগাছ, জামগাছ আর কাঁঠালগাছ৷ একপাশে টিউবওয়েল৷ টিউবওয়েল ডিঙিয়ে গোয়ালঘর৷ গোয়ালঘরে গোরু-বাছুর৷

    সেসব কথা মনে পড়তেই সোমপ্রকাশ আলো-টালো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন৷ খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে পুরোনো দিনের ছবি দেখতে লাগলেন৷ গ্রামের বাড়িটা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷

    সেদিনটাও ছিল শীতের রাত৷ সন্ধে সাতটা কি সওয়া সাতটা হবে৷ ছেঁড়া ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে দিয়ে খাটের ওপরে বসে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ছিলেন সোমপ্রকাশ৷ পড়ছিলেন মানে দুলে-দুলে কবিতা মুখস্থ করছিলেনঃ

    ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,

    মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?’

    ওঁর কাছ থেকে হাতখানেক দূরে বসে ছোটভাই জয়প্রকাশ ‘কিশলয়’ বই নিয়ে বাংলা পড়া তৈরি করছিল৷ ও ক্লাস ফোরে পড়ে৷

    একটু আগেই দু-ভাই টিফিন খাওয়া শেষ করেছে৷ তেল দিয়ে মাখা মুড়ি আর পেঁয়াজের টুকরো৷ খালি বাটি দুটো মা এখনও নিয়ে যাননি৷ মা রান্নাঘরে রান্না করছেন৷ কোলের ছোটবোনটা মায়ের কাছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও, কেন কে জানে, চেঁচিয়ে কাঁদছে৷ এ-ঘর থেকে সোমপ্রকাশ ছোটবোনের কান্না দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলেন৷

    ‘ভাই, যা তো—বোনুকে একটু ধর গিয়ে৷ মা-কে জ্বালাচ্ছে…৷’

    দাদার কথায় বারকয়েক গাঁইগুঁই করে জয় বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছে কি দেয়নি, হঠাৎই শোনা গেল কয়েকজনের চিৎকার: ‘চোর! চোর!’

    চিৎকারটা ভেসে এল খুব কাছ থেকেই৷ যেন সামনের দাওয়া কিংবা উঠোন থেকে৷

    সোমপ্রকাশ আর দেরি করেননি৷ ‘চোর! চোর!’ চিৎকারের সঙ্গে নিজের কচি গলার চিৎকার মিলিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমেই দে ছুট৷

    ঘরের দরজা খুলে বেরোনোর সময় ওঁর মনে হয়েছিল রাতের অন্ধকারে চোরের মোকাবিলা করতে গেলে যা হোক একটা হাতিয়ার সঙ্গে থাকা দরকার৷ তাই যেতে-যেতেই দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা নিজের ক্রিকেট ব্যাটটা এক ছোবলে তুলে নিয়েছিলেন৷

    পিছন থেকে জয় ‘দাদা! দাদা!’ বলে চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু সে-ডাকে সোমপ্রকাশ ফিরে পর্যন্ত তাকাননি৷

    ছোটবেলায় সোমপ্রকাশ খুব দুরন্ত এবং ডাকাবুকো ছিলেন৷ সবসময় অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ করতেন৷ গ্রামের হরিমোহন সরখেল স্মৃতি পাঠাগার থেকে নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চারের বই নিয়ে আসতেন৷ লাইব্রেরির মেম্বার ছিলেন বাবা, কিন্তু সেই মেম্বারশিপের দৌলতে বাবার হয়ে সোমপ্রকাশই লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতেন এবং নিজের পছন্দসই বই নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতেন৷ বই পড়তে-পড়তে ওঁর সাহসটা বেশ শক্তপোক্ত হয়ে গিয়েছিল৷

    তাই এখন চোখের পলকে ঘর পেরিয়ে দাওয়া, দাওয়া পেরিয়ে অন্ধকার উঠোন৷

    কিন্তু কেউ তো নেই! তা হলে চিৎকারটা শোনা গেল কোত্থেকে? প্রথমবার শুনে তো মনে হয়েছিল খুব কাছ থেকেই আওয়াজটা এসেছে!

    ঘরের তুলনায় বাইরের খোলা উঠোনে শীত অনেক বেশি৷ কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হওয়ার আগ্রহে শীতের ব্যাপারটা সোমপ্রকাশের মাথাতেই ছিল না৷

    উঠোনের বাঁ-দিকে আম, জাম আর কাঁঠালের বড়-বড় গাছ৷ সেদিকটায় অন্ধকার আরও গাঢ়, আরও মিশকালো৷ টিউবওয়েলটাকে দেখা যাচ্ছে না৷

    উঠোনে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোম৷ না, ওঁর ভূত-টুতের ভয় ছিল না৷ বাবা সেই ছোট্ট বয়েস থেকে ওঁকে চার লাইনের একটা ছড়া শিখিয়ে দিয়েছেন৷ সেই ছড়ায় রাম-লক্ষ্মণ থাকায় ভূত কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে পারবে না৷

    শুধু বাবা কেন, ছোটকাকা, মেজকাকা, মা—সব্বাই সোমকে একই আশ্বাস দিয়েছেন৷

    এখন উঠোনে দাঁড়িয়ে সোম সেই চারলাইনের ছড়াটাই মনে-মনে আওড়াচ্ছিলেন এবং অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিলেন৷

    ঠিক সেই সময়েই আবার ‘চোর! চোর!’

    এবারের সমবেত চিৎকারে গলার সংখ্যা অনেক বেশি—তাই শব্দের ডেসিবেল মাত্রাও অনেক বেশি৷

    চিৎকারটা সোমদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে ছুটে চলে গেল৷ চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে গেল অনেকগুলো টর্চের আলো৷ ছোটার তালে-তালে আলোগুলো নাচছে৷

    সোমপ্রকাশ আর দেরি করলেন না৷ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ তিনি পেয়ে গেছেন৷

    উঠোন ঘিরে বাঁশের বেড়া৷ তারই এক জায়গায় বাখারি দিয়ে তৈরি বাউন্ডারি গেট—তারের হুড়কো দিয়ে আটকানো৷

    দু-সেকেন্ডে সেই হুড়কো খুলে সোমপ্রকাশ বেরিয়ে এলেন কাঁচা রাস্তায় এবং টর্চের আলোগুলো একটু আগে যেদিকে ছুটে গেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করলেন৷

    রাস্তার দু’পাশে নানারকম গাছপালা৷ তাদের ডালপালায় কুয়াশার ফুল ফুটে আছে৷ রাস্তার কোথাও-কোথাও শালের খুঁটিতে উলঙ্গ বালব জ্বলছে৷

    চেনা রাস্তা ধরে ছুটলেন সোম৷ এই রাস্তাটা শ্রীমানীদের পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে৷ দু-বছর আগে সোম ওই প্রাইমারি স্কুলেই পড়তেন৷

    সোমপ্রকাশ ছুটোছুটির ব্যাপারে বেশ দক্ষ৷ স্কুলের স্পোর্টসে তিনবার ছোট-ছোট কাপ পেয়েছেন৷ সুতরাং একটু পরেই তিনি ‘চোর! চোর!’ চিৎকার করা দলটাকে ধরে ফেললেন৷ তখন সবাই শ্রীমানীদের পুকুরের লাগোয়া একটা বড়সড় ফাঁকা জমিতে চলে এসেছেন৷

    এই জমিটার চরিত্র ভারী অদ্ভুত৷ জমির মালিকানা শ্রীমানীদের হলেও তাঁরা এ জমির দিকে নজর দেন না৷ ফলে গ্রামের গরিব মানুষরা এই জমির ছোট-ছোট টুকরোয় যে-যার মরজি মতন চাষবাস করে৷ ফলে এই জমিতে পাঁচ-সাত রকম ফসল দেখা যায়৷

    ‘ওই যে! ব্যাটা পুকুরপাড়ের দিকে যাচ্ছে৷ ওই যে…৷’

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখতে পেয়েছি…৷’

    টর্চের আলোয় সোম একঝলক দেখতে পেলেন একটা ছেলেকে৷ রোগাটে সরু চেহারা৷ গায়ে একটা সাদা হাফশার্ট আর কালচে হাফপ্যান্ট৷ একহাতে একটা ছোট প্যাকেট গোছের কিছু রয়েছে৷

    ছেলেটা তিরবেগে ছুটছে৷

    পুকুরপাড়ে অনেকগুলো বড়-বড় গাছ৷ তাদের পাতা বেশিরভাগটাই ঝরে গেছে৷ শুধু কালো-কালো ডালপালা মেলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে দুটো গাছ আবার হেলে পড়েছে পুকুরের ওপরে৷ এমনভাবে হেলে পড়েছে যেন গাছের ডালপালাগুলো পুকুরের জলের কানে-কানে কিছু বলতে চায়৷

    পাঁচমিশেলি খেতের ছোট-ছোট গাছ আর ভিজে মাটি মাড়িয়ে সবাই ছুটল পুকুরের দিকে৷

    একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে, ওই যে! ব্যাটা ওই গাছটায় উঠছে!’ এবং একইসঙ্গে তার হাতের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল একটা বড়সড় গাছের ওপরে৷ গাছটা পুকুরের ওপরে বেশ খানিকটা হেলে রয়েছে৷

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে…!’

    ‘ওই যে, বেয়ে ওপরে উঠছে—৷’

    গাছের ডালপালা আর অল্পস্বল্প পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সাদা শার্টের অংশ দু-এক পলকের জন্য চোখে পড়ল৷ তবে ছেলেটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠছে কি না সেটা খুব স্পষ্টভাবে ঠাহর হল না৷

    গাছটার কাছ থেকে খানিকটা দূরে ছুটন্ত ভিড়টা থমকে দাঁড়াল৷ সোমপ্রকাশ খেয়াল করলেন, ভিড়টা এর মধ্যে একটু পরিপুষ্ট হয়েছে৷ হইচই চেঁচামেচি শুনে গাঁয়ের আরও কিছু লোক চোর-তাড়া-করা দঙ্গলে নাম লিখিয়েছে৷ তার মধ্যে দু-চারজন কিশোর এবং বালকও রয়েছে৷

    উত্তেজিত জনতা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলছিল, উত্তেজনায় হাত নাড়ছিল৷ সেইসব কথাবার্তা থেকে সোম চোরের ‘গল্প’-টা কম-বেশি উদ্ধার করলেন৷ সেইসঙ্গে নানান টর্চের ছিটকে পড়া টুকরো-টুকরো আলোয় এটাও দেখতে পেলেন, ওই দঙ্গলের মধ্যে ওঁর বাবা, মেজকাকা এবং ছোটকাকাও রয়েছেন৷ তাঁদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটা চেনা মুখ নজরে পড়ল৷ যেমন সমীরকাকু—বেনিয়ামোড়ে ওঁর সাইকেল সারানোর দোকান আছে৷ পরেশ রায়চৌধুরী—গাঁয়ের একমাত্র পুরুতমশাই—গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশন, বিয়ে, কিংবা শ্রাদ্ধ—সবকিছুতেই ওঁর ডাক পড়ে৷ হূদয়দা— গ্রামে ওঁর মুদিখানা দোকানটাই সবচেয়ে চালু দোকান৷ রঘু পোরেল—রঘুদা ঢাক বাজায়, দুর্গাপুজোয় কালীপুজোয় কলকাতায় বাজাতে যায়৷ ওর বাড়িতে তিনটে ঢাক আছে, সোমপ্রকাশ দেখেছেন৷

    ‘চোর! চোর!’ আওয়াজ শুনে যে যেমন পোশাকে ছিলেন সেই পোশাকেই পথে নেমে এসেছেন৷ কেউ ফুলপ্যান্ট, কেউ লুঙ্গি, কেউ বা নিতান্ত গামছা পরে আছেন৷ তবে শীত ঠেকাতে গায়ে সোয়েটার, চাদর কিংবা শাল জড়ানো৷

    ভিড়ের মধ্যে বেশ কয়েকজনের হাতে নানানরকম অস্ত্র: যেমন, লাঠি, শাবল, উনুন খোঁচানোর বাঁকানো শিক, বাখারির টুকরো, আর এপাশ-ওপাশ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া আধলা ইটের টুকরো৷

    সোমপ্রকাশ ভিড়ের মধ্যে এমনভাবে মিশে ছিলেন যাতে ওঁর বাবা অথবা কাকারা ওঁকে দেখতে না পান৷

    সোমদের বাড়ির দু’পাশে ওঁর দু-কাকার বাড়ি৷ তার মধ্যে ছোটকাকার বাড়ির ওপাশে মিত্যুনকাকুর বাড়ি৷ মিত্যুনকাকু পেট্রোল-পাম্পে চাকরি করেন৷ ওঁর বাড়িতেই চুরির ঘটনাটা ঘটেছে৷

    মিত্যুনকাকুর দাওয়াতে অনেকরকম জিনিস একজায়গায় জড়ো করে রাখা ছিল৷ মুদিখানার জিনিস আর টুকিটাকি খাওয়ার জিনিস৷ সেখান থেকেই এই চোর কীসের একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে পালায়৷ মিত্যুনকাকুর স্ত্রী ছেলেটাকে উঠোনের ওপর দিয়ে ছুটে পালাতে দেখেন এবং ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করে ওঠেন৷ তারপরই শোরগোল শুরু হয়ে যায়৷ মিত্যুনকাকু চিৎকার করতে-করতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন৷ এবং ওঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে জড়ো হয়ে যায় এবং ছেলেটা যেদিকে ছুটে পালিয়েছে সেদিক লক্ষ্য করে দৌড়োতে শুরু করে৷

    সোমপ্রকাশের দু-কাকা ঘরেই ছিলেন৷ ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ‘সার্চ পার্টি’-তে জয়েন করতে ওঁদের দেরি হয়নি৷ তবে সোমের বাবার ছুটে আসতে একটু সময় লেগেছে, কারণ তিনি কালীতলার মন্দিরের চাতালে বসে তাস খেলছিলেন৷ মন্দিরের দরজা দিয়ে উপচে পড়া আলোয় তাস পেতে রোজ সন্ধেবেলায় এই আসর বসে৷

    সোমপ্রকাশদের গ্রামে সবার জীবনই খুব শান্ত ছন্দে চলে৷ সে-চলায় কখনও কোনও ঢেউ ওঠে না৷ সেই কারণেই বোধহয় জীবনগুলো একটু একঘেয়ে ম্যাড়মেড়ে হয়ে গিয়েছিল৷ তাই ওই সন্ধেবেলার উত্তেজনার ঢেউটা চুম্বকের মতো টানে সব্বাইকে টেনে নামিয়েছে শীতের রাস্তায়৷ বোধহয় শীতের রাতে সবাই একটু উত্তেজনার ওম পেতে চাইছিল৷

    সন্দেহজনক গাছটা লক্ষ্য করে কেউ একজন একটা আধলা ইট ছুড়ে মারল৷ অনেকে বোধহয় এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিল৷ কারণ, প্রথম ইটটা বাতাস কেটে রওনা হতেই তার পিছু-পিছু পরপর কয়েকটা ইট গাছ লক্ষ্য করে উড়ে গেল৷ দু-চারটে ইট গাছে লাগল, বাকিগুলো এদিক-সেদিক দিয়ে উড়ে গিয়ে অন্ধকার পুকুরের জলে পৌঁছে তাদের উড়ান শেষ করল৷

    চোরটার গায়ে যে একটা ইটও লাগেনি সেটা সবাই বুঝতে পারল৷ সেইজন্যই হয়তো বেশ কয়েকজন জমির কিনারায় গিয়ে এদিক-ওদিক টর্চের আলো ফেলে নতুন ইটের টুকরোর সন্ধান করতে লাগল৷

    সোমপ্রকাশ শুনছিলেন, চোর ছেলেটার হাতে কী-কী অস্ত্র থাকতে পারে সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে৷ অনেক তর্কবিতর্কের পর সকলে সিদ্ধান্তে এলেন যে, ছেলেটার কাছে ছুরি অথবা পিস্তল থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ, এই অস্ত্র দুটো হাফপ্যান্টের পকেটেও লুকিয়ে রাখা যায়৷

    এই জটলার মধ্যে অনেকেই বারবার মিত্যুনকাকুকে জিগ্যেস করছিলেন, ‘কী চুরি হয়েছে? কী চুরি হয়েছে?’

    মিত্যুনকাকু দু-চারবার ঢোঁক গিলে বললেন, ‘টাকা…টাকা৷ একটা প্যাকেটে প্রায় শ’ দেড়েক টাকা ছিল…৷’

    সত্যিই তো, চুরিটা তা হলে নেহাত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! অতগুলো টাকা বলে কথা!

    জটলার মধ্যে বেশ কয়েকজন হা-ডু-ডু খেলার মতন সতর্ক ভঙ্গিতে গাছটার দিকে এগোচ্ছিল৷ তাদের সকলের হাতেই টর্চ, আর ছোট কিংবা বড় হাতিয়ার৷

    পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ভিড় থেকে আরও দু-একটা বড়সড় ঢেলা ছুটে গেল গাছ লক্ষ্য করে৷ চোর ছেলেটাকে ভয় দেখানোর জন্য ‘চোর! চোর!’ ‘ধর ব্যাটাকে!’ ‘মার ব্যাটাকে!’ ইত্যাদি নানানরকম চিৎকার শোনা যেতে লাগল৷ কেউ-কেউ বলতে লাগল, ‘বদমাশটাকে একবার হাতে পেলে হয়! পিটিয়ে ছালচামড়া গুটিয়ে নেব৷’

    সাহসী যে-কয়েকজন গাছের কাছে এগিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে দুজন তরতর করে গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল৷ তাদের সুবিধের জন্য গাছের ডালপালায়, তাদের বেয়ে ওঠার পথে, টর্চের আলো ফেলতে লাগল কয়েকজন৷ একইসঙ্গে হইচই চেঁচামেচিও চলতে লাগল৷

    তারই মধ্যে আচমকা ‘ঝপাং’৷

    এই শীতের রাতে চোরবাবাজি পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে৷

    একজন বলল, ‘কী সাংঘাতিক! এই ঠান্ডায় পুকুরের জলে কেউ ঝাঁপ দেয়!’

    উত্তর পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই: ‘হ্যাঁ—দেয়৷ চোররা দেয়৷ ওদের চামড়া বেজায় মোটা৷ ঠান্ডায় ওদের কিস্যু হয় না৷’

    চোর ছেলেটি পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ায় জনগণ বেশ অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেল৷ হইহই করে পুকুরপাড় বরাবর ছড়িয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ঢিল মারতে লাগল৷ টর্চের অনেকগুলো আলো চোর ছেলেটাকে তাক করে চলে বেড়াচ্ছে৷ আর চোর ঠান্ডা জলের পুকুরে পাগলের মতো, কিংবা জলে পড়া ইঁদুরের মতো এলোমেলো সাঁতার কাটছে৷ তারই মধ্যে দেখা গেল ছেলেটা ওর বাঁ-হাতটা জলের ওপরে সামান্য উঁচু করে আছে৷ আর সেই হাতে একটা সাদাটে প্যাকেট না কী যেন!

    পুকুরের জলে বৃষ্টির মতো ঢিল পড়ছিল৷ তার বেশ কয়েকটা মনে হয় ছেলেটার গায়ে-মাথায় লাগল৷ কিন্তু কোনও যন্ত্রণার চিৎকার শোনা গেল না পুকুরের জল থেকে৷ হয়তো সে-চিৎকার এতই চাপা যে, কারও কানে পৌঁছোনোর মতন নয়৷

    অন্ধকারে মাছের মতো সাঁতার কাটছিল ছেলেটা৷ জল কেটে-কেটে ও পশ্চিম পাড়ে উঠে পড়ল৷ ভিজে জামা গায়ে লেপটে আছে৷ হাফপ্যান্ট থেকে টপটপ করে জল পড়ছে৷ ও হয়তো ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছিল, কিন্তু টর্চের আলো-ছায়ায় সেটা ভালো করে বোঝা গেল না৷

    পাড় বেয়ে আগাছার ঝোপঝাড় ঠেলে সরিয়ে ও আবার ছুটতে শুরু করল৷ চিৎকার করতে-করতে জনগণ তাড়া করল ওকে৷

    ছেলেটা যেদিকে দৌড়চ্ছে সেদিকে কয়েক বিঘে জুড়ে সনাতন নাহাদের বাঁশবাগান৷ বাঁকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই বাগানে৷ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাথা তুলে আছে কালো-কালো বাঁশঝাড়৷

    পুকুর ছাড়িয়ে এদিকটায় আসামাত্রই তাপমাত্রা যেন আরও দু-এক ডিগ্রি নেমে গেল৷ সোমপ্রকাশ এবার শীতটা ভালোরকম টের পেলেন৷

    কয়েকটা বাঁশঝাড়কে এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে রোগাসোগা ছেলেটা আচমকা একটা বাঁশঝাড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে গেল৷ ব্যাপারটা খুব দ্রুত ঘটলেও ওর পিছু ধাওয়া করা দঙ্গলের দু-তিনজন সেটা খেয়াল করল৷

    ‘এইখানে! এইখানে! এই বাঁশঝাড়টার ভেতরে লুকিয়েছে! এই যে—এটার ভেতরে…৷’ কয়েকজন উঁচু গলায় শোরগোল শুরু করল৷

    সেই বিশেষ বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে লোকজন ভিড় জমাল৷ সবক’টা টর্চের আলো বাঁশঝাড়ের ওপরে গিয়ে পড়ল৷

    এতক্ষণ ধরে ব্যবহারের ফলে টর্চের আলোগুলো বেশ হলদেটে আর মলিন হয়ে গেছে৷ কিন্তু সেই স্তিমিত আলোতেও ছবিটা দেখা গেল৷

    বাঁশঝাড় থেকে লম্বা-লম্বা বাঁশ ফোয়ারার মতো মাথা তুলেছে৷ দুটো বাঁশ তো এতটাই লম্বা যে, আকাশে অধিবৃত্ত এঁকে ঝুঁকে পড়েছে অন্ধকার মাঠের দিকে৷

    শীতের সময়৷ বাঁশগাছের সব পাতাই প্রায় খসে পড়েছে৷ বাঁশগাছগুলো কঙ্কালের হাতের আঙুলের মতন দেখাচ্ছে৷ ওপরদিকে আঙুলগুলো ফাঁক-ফাঁক দেখালেও নীচের দিকে এসে জট পাকিয়ে গেছে৷ এ ছাড়া বাঁশঝাড়ের গোড়ায় জমে আছে, ছড়িয়ে আছে, অসংখ্য শুকনো বাঁশপাতা৷

    দেখা গেল, অনেক বাঁশের জটলার মধ্যে ছেলেটা একটা বাঁশ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকে আছে৷ থরথর করে কাঁপছে৷

    লোকজন অন্ধকারে বেশি কাছে এগোতে সাহস পেল না৷ কে জানে, ছেলেটার সঙ্গে কী না কী অস্ত্র আছে! তাই একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা চেঁচামেচি করতে লাগল, নানান হুমকি দিতে লাগল৷ আবার কেউ-কেউ ঢিল ছুড়তে লাগল৷

    ব্যাপারটা সোমপ্রকাশের ভালো লাগছিল না৷

    অথচ চোরকে তাড়া করে বেড়ানোর এই আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট সময়ের মধ্যে দুবার কি তিনবার ওঁর মনে হয়েছিল, হাতের ক্রিকেট ব্যাটটা চোরকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন৷

    এখন সে-কথা মনে পড়ে ওঁর খারাপ লাগল৷

    চারপাশে অন্ধকার আর শীত৷ বাঁশবাগানের এখানে-ওখানে কুয়াশা দিয়ে তৈরি হাওয়ামিঠাই ভাসছে৷ আকাশে ফ্যাকাশে সরু চাঁদ৷

    সোমপ্রকাশ ছোট-ছোট ছেলেদের ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে বড়-বড় লোকদের দেখছিলেন৷ বাবা, মেজকাকা, ছোটকাকা, সমীর-কাকু, ঠাকুরমশাই, মিত্যুনকাকু, হূদয়দা, রঘুদা—এ ছাড়া আরও অনেক চেনা-অচেনা মুখ৷ তাদেরই কেউ-কেউ চোরকে লক্ষ্য করে হুঙ্কার ছাড়ছে৷

    ‘এই ছোঁড়া, বেরিয়ে আয়—বেরিয়ে আয় বলছি!’

    ‘ফাঁড়িতে একটা খবর দিলে হয় না? পুলিশের ডান্ডা খেলে ব্যাটা সিধে হয়ে যাবে…!’

    ‘এই শীতে ওর কষ্ট হচ্ছে না?’ কে একজন প্রশ্ন করল—যে-প্রশ্নটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল৷

    উত্তরে আর-একজন দুরছাই ঢঙে জবাব দিল, ‘হুঁ! চোরদের আবার শীত! দেখলেন না, পুকুরের ঠান্ডা জলে সাঁতরে দিব্যি উঠে এল!’

    ‘টাকার প্যাকেটটা উঁচু করে ধরে রেখেছিল—যাতে জলে না ভেজে৷’

    ‘বাঁশঝাড়ের মধ্যে কেমন নিশ্চিন্তে ঘাপটি মেরে আছে—ব্যাটার সাপখোপের ভয়ও নেই৷’

    ‘এই শীতে সাপ আর কোথায়! সব তো গর্তে সেঁধিয়ে আছে…৷’

    ‘অ্যাই, বেরো—বেরিয়ে আয়! চুপচাপ যদি বেরিয়ে আসিস তা হলে কিচ্ছু বলব না৷ আয়, বেরিয়ে আয়…৷’

    কিন্তু এসব কথায় চোর ছেলেটা তেমন কর্ণপাত করল বলে মনে হল না৷ বাঁশ আঁকড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল—যেন একটা পাথরের মূর্তি৷ তবে ওর শরীরটা উঁচু কম্পাঙ্কে কাঁপছিল৷

    রাত ক্রমে বাড়ছিল৷ বড়রা নিজেদের মধ্যে নানান আলোচনা করছিল৷ আলোচনার মূল বিষয় ছিল: এখন কী করা যায়? এভাবে তো আর সারারাত দাঁড়িয়ে থাকা যায় না৷

    বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল, ছ’জন এই বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে পাহারা দেবে৷ এবং পালা করে এই পাহারা চলবে ভোর পর্যন্ত৷ তারপর সকালবেলা চোরটাকে টেনে বের করে একটা হেস্তনেস্ত করা হবে৷ মিত্যুনবাবুর টাকাটা যে করে হোক উদ্ধার করতে হবে৷

    ব্যস, লাঠিসোঁটা নিয়ে ছ’জন জোয়ান বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ খোলা জায়গায় শীত ঠেকানোর জন্য কয়েকজন তাদের চাদর-শাল ইত্যাদি ওই ছ’জনকে ধার দিলেন৷ কোন দলের পর কোন দল পাহারা দেবে সেসব আলোচনাও করে নিল বড়রা৷ তারপর সবাই ফেরার পথ ধরল৷

    সোমপ্রকাশও বাবা-কাকার নজর এড়িয়ে বাড়ির পথ ধরেছিলেন৷ অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটে যাওয়ার সময় ঝিঁঝিঁর শব্দ কানে এসেছিল, আর কয়েক ঝাঁক জোনাকির সঙ্গে সোমের দেখা হয়েছিল৷

    বাড়ি ফিরে মা-কে প্রথমে ম্যানেজ করেছিলেন সোমপ্রকাশ৷ চোর ধরার রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প মা-কে শুনিয়েছিলেন৷ তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন—কারণ, কাল ভোরবেলা তো আবার ওই বাঁশবাগানে যেতে হবে!

    চোখ বুজে শুয়ে থাকলেও বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা চোরের ছবিটা সোম যেন দেখতে পাচ্ছিলেন৷ ছবিটা কিছুতেই সরতে চাইছিল না৷

    পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় সোমপ্রকাশের আবার এক অ্যাডভেঞ্চার৷

    বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই সোম চুপিসাড়ে তৈরি হলেন৷ তারপর ঘুমন্ত মা-কে ফাঁকি দিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে৷

    ভোরের কুয়াশা সরিয়ে সোম বাঁশবাগানের দিকে চললেন৷ অন্ধকার সবে ফিকে হতে শুরু করেছে৷ আলো ফুটছে আকাশে৷ কিন্তু আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ মাঝ-আকাশ থেকে বেশ খানিকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে৷

    ভোরের শীত ঠেকাতে সোয়েটারের ওপরে মায়ের একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছেন সোম৷

    বাঁশবাগানের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ কাল রাতের বাঁশঝাড়টাকে ঘিরে প্রায় বারো-চোদ্দোজন লোক জড়ো হয়ে গেছে৷ হাতে লাঠিসোঁটা আর টর্চ৷ কিন্তু সেখানে কোনও ছোট ছেলে নেই৷

    দৃশ্যটা সোমপ্রকাশের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে৷

    বাঁশবাগানের মাথার ওপরে বাঁকা চাঁদ৷ চারপাশ ঠান্ডা, শান্ত৷ অসংখ্য বাঁশঝাড় কাছাকাছি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে—যেন সব ভাই-ভাই৷ তারই একটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে চোর-শিকারির দল৷

    বাবার নজর এড়াতে আসল বাঁশঝাড়টার পাশের একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন সোম৷ বাঁশের কাটাকুটির ফাঁকফোকর দিয়ে সব দেখতে লাগলেন, শুনতে লাগলেন৷

    ভোরের আলো ফুটেছে৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে শিকারিদের সাহসও বেড়েছে৷ বাঁশঝাড়টার খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে তারা এখন ছেলেটাকে লাঠির খোঁচাখুঁচি দিচ্ছে৷ শাসাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, এমনকী পিটিয়ে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে৷

    ছেলেটা সেই একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে৷ একটা বাঁশকে জড়িয়ে ধরে আছে৷ শুধু মাথাটা কাল রাতের তুলনায় আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে৷

    ছেলেটা এখন আর শীতে কাঁপছে না৷

    সাহস করে মিত্যুনবাবু ওকে লাঠি দিয়ে জোরালো একটা খোঁচা দিলেন৷ ছেলেটা সঙ্গে-সঙ্গে কাত হয়ে গেল৷ হেলে পড়ল একজোড়া বাঁশের ওপরে৷

    ‘ব্যাটা ঠান্ডায় অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি?’

    ‘দেখুন, দেখুন—মিত্যুনবাবুর প্যাকেটটা এখনও হাতে ধরে আছে৷ মিত্যুনবাবু, আপনি খুব লাকি—আপনার টাকা ফেরত পেয়ে গেলেন৷ ব্যাটা ওটা হজম করতে পারেনি—৷’

    সকলে সেই কথায় সায় দিয়ে ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ করে উঠল৷

    আরও কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচির পর সবাই যখন বুঝতে পারল ছেলেটা একেবারে নিস্তেজ, তখন তারা ওর কাছে এগিয়ে গেল৷ ওকে ধরে চ্যাংদোলা করে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে এল বাইরে৷ শুইয়ে দিল মাটিতে৷

    এবং সবাই চমকে উঠল—একেবারে ভূত দেখার মতো৷

    এ তো বোবা কানাই! বেনিয়ামোড়ের কাছে নরসিং জানার চায়ের স্টলের পাশে বসে ভিক্ষে করে!

    সেইজন্যই কাল রাত থেকে ও কোনও কথা বলেনি—বলতে পারেনি৷

    ঝুঁকে পড়ে ওকে পরীক্ষা করল কয়েকজন৷ হাত রাখল নাকের নীচে, কানের নীচে৷ একজন তো ছেলেটার বুকে কান চেপে ধরল৷

    তারপর, ধীরে-ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল৷

    এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল সবাই৷ না, কানাই আর বেঁচে নেই৷

    মিত্যুনকাকু হঠাৎই নীচু হয়ে কানাইয়ের ডানহাতে ধরা কাগজের প্যাকেটটা নিতে হাত বাড়ালেন৷ কিন্তু তার আগেই কৌতূহলী আর-একজন প্যাকেটটা তুলে নিয়ে খুলতে শুরু করেছে৷

    কে একজন বলল, ‘যাক, মিত্যুন—তোমার টাকাটা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল…৷’

    ততক্ষণে প্যাকেট খোলা হয়ে গেছে৷ প্যাকেট বলতে সাধারণ কাগজের ঠোঙা—কয়েকটা ভাঁজ দেওয়া৷

    প্যাকেট খুলতেই সবাই আরও অবাক৷

    প্যাকেট থেকে বেরিয়ে পড়েছে টাকা নয়—কয়েকটা হাতে গড়া আটার রুটি৷

    সবাই অবাক চোখে মিত্যুনবাবুর দিকে তাকাল৷

    মিত্যুনবাবু তখন চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করে ফেলেছেন৷

    সোমের বাবা বললেন, ‘মিত্যুন, তুমি এত বড় মিথ্যুক! চুরিটাকে বড় করে দেখানোর জন্যে এরকম মিথ্যে কথা বললে! তোমার মিথ্যের জন্যে একটা ছেলের…একটা ছেলের প্রাণ গেল!’

    মিত্যুনবাবু একেবারে চুপ৷ মাথা নীচু৷

    শুধু মিত্যুনবাবু কেন, কানাইয়ের মৃতদেহ ঘিরে সবাই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল৷ দেখে মনে হচ্ছিল, কানাই নয়, ওরা ওদের বিবেকের মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ওরাই যেন আসলে চোর—কানাই ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছে৷

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleখুনির রং – অনীশ দেব
    Next Article প্রতিঘাত – অনীশ দেব

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }