Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প236 Mins Read0

    বাতাসে গুনগুন – ১

    ১

    চুলোয় বসানো পাতিল থেকে দুধ উপচে পড়ছে। কথার তালে দুধের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন ডলি। দুধ পোড়ার গন্ধ নাকে আসতেই চেয়ার ছেড়ে ছুটে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। খুব দ্রুত চুলাটা বন্ধ করে আবার চলে এলেন ডাইনিংরুমে। উৎসুক কণ্ঠে আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,

    — দুধ পোড়ার গন্ধ এলো!

    —হুম। কথায় কথায় ভুলেই গিয়েছি দুধের কথা।

    চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি দেখা যাচ্ছে ডলির। অনেকটুকু দুধ পড়ে নষ্ট হওয়ায় যতখানি তিনি বিরক্ত, তারচেয়ে বেশি বিরক্ত তার ছোট মেয়ে নিশাতের উপর। মেয়েটা নির্বিকারভাবে নুডলস খেয়ে যাচ্ছে। এই যে বিগত তিনমাস যাবৎ তাকে বুঝানো হচ্ছে, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এসব বাদ দিয়ে আগের মত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়। অথচ সে কারো কথা কানে নিচ্ছে না। এখনও তাকে এই কথাটাই আবারও বুঝানো হচ্ছিলো, আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যা। বিভিন্নভাবে মেয়েটাকে বুঝাচ্ছিলেন তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে। নিশাত একদম চুপ। কোনোধরণের উত্তরই সে দিচ্ছে না। না ইশারায়, না কথা বলে। এমন একটা ভাব নিয়ে নুডলস খাচ্ছে মনে হচ্ছে আশপাশে কেউ নেই। কেউ কিছু বলছে না। সে কাউকে দেখছে না। কারো কথাও শুনতে পাচ্ছে না। গলার স্বর উঁচু করে নিশাতকে ডলি বললেন,

    –জগতে কি ঐ ছেলেই তোর আপন? আমরা কেউ না? আমাদের তোর ভাল্লাগে না?

    নুডলসের বাটির দিকে তাকিয়ে নিশাত মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো,

    — লাগে।

    — অন্যদিকে তাকিয়ে কথার উত্তর দিস কেনো বেয়াদব!

    হাত থেকে কাঁটা চামচ বাটিতে রেখে নিশাত বললো,

    — আজব! তুমি চেঁচাচ্ছো কেনো আম্মা?

    — চেঁচাবো না? কি শুরু করেছিস তুই?

    — কি করলাম আমি?

    — আমি আমার মেয়েকে আগের মত ফেরত চাই। ব্যস…

    –আমি স্বাভাবিক আছি।

    –কচু স্বাভাবিক আছিস তুই। তোর পরিবর্তন হচ্ছে কি হচ্ছে না, এসব কি এখন তুই আমাকে শিখাবি?

    — বাবা, তুমি আম্মাকে কিছু বলো না কেনো?

    –তোর আম্মা তো খারাপ কিছু বলেনি।

    –তোমাদের একই কথা শুনে শুনে আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি বাবা। এবার থামো। প্লিজ!

    চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো নিশাত। রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে গিয়ে সজোরে দরজা আটকে দিলো সে।

    মেয়ের চলে যাওয়া চুপচাপ দেখতে থাকলেন আমজাদ-ডলি।

    .

    নিশাত দরজা আটকে দিতেই আমজাদ সাহেব মুখ ঘুরিয়ে ডলির দিকে তাকালেন। বললেন,

    –কথা তো আস্তেও বলা যায় তাই না ডলি? দেখো তো তোমার চেঁচামেচি শুনে মেয়েটা বাটিতে নুডলস রেখেই চলে গেলো।

    ভ্রু কুঁচকে ফেললেন ডলি। মুখ ভেংচি কেটে আফজালকে বললেন,

    –ভালো করে বাটিতে তাকিয়ে দেখো। তোমার মেয়ে পেঁয়াজ আর মরিচগুলো খায়নি। নুডলস, ডিম, গাজর সবটাই খেয়েছে।

    —ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু আরেক বাটি নুডলস তো খেতে পারতো। তোমার চিৎকার শুনে তো চলে গেলো।

    ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে এলো ডলির। চেয়ারে হেলানো পিঠটাকে সোজা করে আফজাল সাহেবকে ধমকে জিজ্ঞেস করলেন,

    — কি বললে?

    — নাহ্, কিছু না।

    চেয়ার ছেড়ে তিনিও উঠে গেলেন। বুঝাই যাচ্ছে অবস্থা বেগতিক। এখানে আরো কয়েক সেকেন্ড বসে থাকা মানে তার উপর তুফান বয়ে যাওয়া। চুপচাপ বাসার দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

    আমজাদ সাহেব বের হওয়া মাত্র চেয়ারে আবার হেলান দিয়ে বসলেন ডলি। খুব বেশিই যন্ত্রণাদায়ক মনে হচ্ছে সবকিছু। বড় মেয়েটা থাকলে খুব ভালো হতো। তার মায়ের পর বড় মেয়েই একমাত্র মানুষ যার সাথে কথা বলে তিনি শান্তি পান। মেয়েটা খুব বুঝে তাকে। শুধু তাকে না, সবাইকে বুঝে খুব ভালোভাবে। মনের দিক থেকে খুব শক্ত। যেকোনো খারাপ পরিস্থতিতেও হাসিখুশি থাকে। আর ছোটটা হয়েছে বড়টার একদম উল্টো। একদম নরম স্বভাবের। সামান্য কষ্টেই মেয়েটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারে না। ঈষিতাকে নিয়ে কখনোই দুশ্চিন্তা করতে হয়নি ডলির। যত চিন্তা নিশাতকে নিয়ে। আজ যদি ঈষিতার সাথে কোনো ছেলে এমন প্রতারণা করতো তাহলে কখনোই সে এভাবে ভেঙে পড়তো না। আর নিশাত! তাকে দেখলে ডলির মনে হয় মেয়েটা একদম টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ঈষিতার অভাব আজকাল খুব বেশিই অনুভব করছেন তিনি। একমাস আগেই এসে গিয়েছে মেয়েটা। চারদিন ছিলো এ বাসায়। সাথে স্বামী, শাশুড়ি আর ননদদেরকেও নিয়ে এসেছিলো। আর দশদিন বাদে ননদের বিয়ে। সেবার এসেছিলো বিয়ের শপিং করতে। মেয়ের সাথে বসে একটু কথা বলার সময়ই পাননি তিনি। আগামী একমাসেও ঈষিতার সাথে তিনি কথা বলতে পারবেন না তা তিনি জানেন। ঐ বাড়ির একমাত্র বউ সে। বিয়ে পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতেই সময় পার। দায়িত্ব তো সব ওকেই নিতে হবে। মেয়ের এমন ব্যস্ত সময়ে মা হিসেবে এধরণের আবদার ধরা মানে খুবই বাজে ব্যাপার। ঈষিতার অনুপস্থিতির কথা ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডলি। হাত বাড়িয়ে পানি ভর্তি গ্লাসটা নিতেই কল এলো উনার মোবাইলে। স্ক্রিনে ঈষিতার নাম ভাসছে। পানির গ্লাস আবার টেবিলে রেখে তড়িৎ গতিতে কলটা রিসিভ করলেন তিনি। উৎসুক কণ্ঠে তিনি বললেন,

    — জানিস ঈষু, আমি তোর কথাই ভাবছিলাম!

    — কি ভাবছিলে? কবে আমার সাথে একটু মুখোমুখি বসে কথা বলবে?

    –হুম।

    –আসছি আমি আগামীকাল।

    — সত্যি?

    — হ্যাঁ।

    –আর কয়দিন পর বিয়ে আর তুই এখন?

    — কাজ আপাতত সব শেষ। আবার শুরু হবে মেহমান আসা শুরু হলে। তাছাড়া নাহিদ ভাই দেশে আসছে বললাম না?

    –হ্যাঁ।

    নাহিদ ভাইকে নিতে আসছি আমরা। আমি, তোমাদের জামাই, নিঝুম আর নিম্মি। আমরা আগামীকাল আসবো। নাহিদ ভাই আসতে আসতে পরশু দুপুর। উনাকে নিয়ে একবারে নরসিংদী চলে যাবো।

    — তোর শাশুড়ী কিছু মনে করবে না তো তুই যে এই সময় ঢাকা এসে থাকবি?

    –আরে নাহ। মা-ই তো বললো বেশ দৌঁড় ঝাঁপ করেছো। মায়ের কাছে একরাত থেকে আসো। মায়ের হাতের রান্নাও খেয়ে আসো।

    –উনার মতো আমার নিশাতের শাশুড়ীটা এমন হলে আমার দুশ্চিন্তা কমে যেতো।

    –পাগলটা কোথায় আম্মা? নিম্মি দুবার কল করলো একটু আগে। রিসিভ করলো না।

    –রাগ করে দরজা আটকে বসে আছে।

    — শুনো, ওকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে যাবো।

    –কোথায়?

    –কোথায় আবার? নরসিংদী।

    –ওকে নিস না তো তোদের সাথে। সারাদিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। বিয়ে বাড়িতে কত মানুষ আসবে। সবার মাঝে এমন গোমড়া মুখে বসে থাকলে তো মানুষ খারাপ বলবে। আমি ভেবেছি আমরা ওকে নিয়ে বিয়ের দিন সকালে গিয়ে বিকালেই চলে আসবো।

    — এটা কি বললে আম্মা? আমার শাশুড়ী প্রথম দাওয়াতটাই তোমাদের দিলো। কতবার করে বলে গেলেন বিয়ের এক সপ্তাহ আগে তোমাকে দেখতে চায় ঐ বাড়িতে। কত আশা নিয়ে বসে আছেন, তুমি জানো?

    — আমার তো ইচ্ছে ছিলো এক সপ্তাহ আগেই যাবো। নিশাতের হাল দেখেই তো আমার ওকে নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে হয়না। মানুষ দেখলেই জিজ্ঞেস করে, নিশাত কি অসুস্থ? এমন চুপচাপ হয়ে গেছে কেনো? ভালো লাগে না রে ঈষু এসব শুনতে।

    –ওর হাওয়া বদল দরকার আম্মা। ওকে তুমি আমার সাথে দাও। মানা করো না। বাড়ি ভরা মানুষ আমাদের। ঐখানে সারাদিন তো একা থাকে। এজন্য এসব থেকে বের হতেও সময় লাগছে।

    — ও রাজি হবে?

    –ওর পারমিশন নিচ্ছে কে? ওর দুলাভাই তো বলেছে ও রাজি না হলে ওকে কানে ধরে নিয়ে যাবে।

    — আচ্ছা দেখ কি হয়। কি খাবি তুই? কি কি রান্না করবো?

    –তোমার হাতে চিংড়ি ভুনা খাইনা অনেকদিন।

    –আচ্ছা করবো। আর কিছু?

    –নাহ। এটা হলেই চলবে। আর ওদের জন্য রান্না করবেই। এতেই হবে।

    — রওয়ানা হচ্ছিস কখন?

    — এইতো সকালেই। সাড়ে ছয়টায়।

    — নাস্তা তো তাহলে এখানেই করবি।

    –হ্যাঁ বাসায় এসে করবো।

    –আচ্ছা আয়।

    –রাখি আম্মা। এসে কথা বলবো।

    — ঠিকাছে।

    আনন্দে চোখজোড়া চিকচিক করছে ডলির। ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে আফজাল সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করলেন তিনি। বাজারে পাঠাতে হবে লোকটাকে।

    ২

    উত্তরের দিকটার ঘরটাতে তালা ঝুলছে আজ পাঁচ বছর হলো। নাহিদ বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম এবং শেষবারের মতো পাঁচবছর আগে একবার এসেছিলো। আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটা থেকে নাহিদের ঘরের চাবিটা বের করছেন শালুক। তার বড় ছেলে দেশে ফিরছে ভাবতেই চোখজোড়া খুশিতে চিকচিক করতে থাকে। গুনে গুনে পাঁচবছর একমাস তেরোদিন পর ছেলেটা বাড়ি আসছে। কতদিন পর ছেলেটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারবেন তিনি। নিজহাতে ছেলের প্লেটে খাবার বেড়ে খাওয়ানোর সুযোগটাও হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে ঘরের ভেতরে চলে এসেছেন শালুক। অন্ধকারে দেয়ালে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা বের করলেন তিনি। বাম দিক থেকে তিন নম্বর সুইচটা এ ঘরের লাইটের সুইচ। এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার। সুইচ অন করার সাথে সাথেই লাইটটা জ্বলে উঠলো। নাহ, নষ্ট হয়নি লাইটটা! ভেবেছিলেন এতদিনে হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুরো ঘরের ফার্ণিচার সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে এতদিন। দরজা জানালাও খোলা হয়নি এতবছর। পুরো ঘরে ভ্যাপসা গন্ধে ভরে গেছে। সেইসাথে ঘরভর্তি ধূলোও আছে। বাতাস আসা-যাওয়ার অবস্থা নেই অথচ ধূলোর আনাগোনা দিব্যি আছে। নিজের মনেই হাসলেন শালুক।

    নিজের ঘরে যাওয়ার সময় ঈষিতা দেখতে পেলো ভাসুরের ঘরে আলো জ্বলছে। কেউ গিয়েছে হয়তো ওঘরটাতে। বিয়ের পর এই দুইবছরের সংসারে আজ পর্যন্ত ঐ ঘরে পা ফেলেনি ঈষিতা। কখনো দেখার ইচ্ছেও হয়নি অবশ্য। যে মানুষটার ঘর, তাকেই তো কখনো সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি। আজ পর্যন্ত ছবি আর ভিডিও কল পর্যন্তই যা কথা হয়েছে। তাই হয়তো তার ঘর দেখার সাধটাও হয়নি। কিন্তু আজ হঠাৎ ঐ ঘরের আলো জ্বলতে দেখে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। পা বাড়িয়ে সেদিকটাতে এগিয়ে গেলো ঈষিতা। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলো তার

    শাশুড়ী সাদা কাপড় বিছানো খাটটাতে বসে আছে। ভ্যাপসা গন্ধ লাগছে ঈষিতার নাকে। নাক কুঁচকে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো,

    — আপনি এই ময়লা কাপড়ের উপর বসে আছেন কেনো আম্মা? কত্ত ধূলো পড়ে আছে দেখছেন!

    — ঘরটা পরিষ্কার করতে আসলাম।

    — আপনি কেনো করবেন? ঘরে কাজের লোক আছে ওরা করবে।

    –আমার ছেলের ঘর আমিই পরিষ্কার করবো।

    –এই পরিবেশে নিঃশ্বাস নিলে অসুস্থ হয়ে যাবেন। চলেন, ঘরে চলেন।

    — নাহ, আমি সুন্দর কইরা ঘরটা গুছাবো। ওরা যত্ন নিয়া গুছাবে না।

    — আচ্ছা আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। আপনি বের হোন। আপনাকে কিছু করতে হবে না।

    — আমি তোমারেও করতে দিবো না।

    –আমি যত্ন নিয়েই করবো।

    –জানি যত্ন নিয়া করবা। তবু আমি নিজ হাতেই করবো। তুমি এসব বুঝবানা বউ। আমার ছেলে কতগুলা বছর পর দেশে আসতাছে। আমিই ওর ঘর গুছাবো। এটাও আমার জন্য খুশির ব্যাপার।

    চোখে পানি ছলছল করছে শালুক আক্তারের। দেয়ালে হেলান দিয়ে শাশুড়ির চোখে জোরপূর্বক আটকে রাখা পানিটুকু দেখতে পাচ্ছে ঈষিতা। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে এই দৃশ্য। নাহিদের কথা বলতে বলতে তার চোখে পানি চলে আসে। তিনি জোরপূর্বক প্রতিবারই চোখের পানি চোখের সীমানা পর্যন্ত আটকে রাখার চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ সময়ে চোখের পানি আটকে রাখতে তিনি সক্ষম হোন আর কোনো কোনো সময় ব্যাপারটা তার নাগালের বাহিরে চলে যায়। ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। বড্ড মায়া হয় এই মানুষটার জন্য ঈষিতার। সেইসাথে অবাক হয় নাহিদের কথা ভেবে। কি করে পারে মানুষ বছরের পর বছর এত ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে? সামান্য অভিমানের কাছে কি এতখানি ভালোবাসা তুচ্ছ? বুকচিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ঈষিতার। শাশুড়ীর সামনে এগিয়ে এসে বললো,

    আম্মা আপনি সাদা কাপড়গুলো আস্তে ধীরে সরিয়ে দিন। আমি ঝাড়ু আর ফার্নিচার মোছার কাপড় নিয়ে আসি।

    –বললাম না তোমাকে করতে হবে না। আমিই করবো।

    –হ্যাঁ, আপনিই তো করবেন। আমি শুধু আপনার এ্যাসিসট্যান্ট। একটু হেল্প তো করতেই পারি তাই না?

    মুচকি হাসলেন শালুক। ঈষিতার দিকে তাকিয়ে বললেন,

    –তোমার চালাকি আমি বুঝি নাই ভাবছো? সব বুঝি। আমার এ্যাসিসট্যান্টগিরি করার বাহানায় তুমি যে টুকটুক কইরা সব কাজ করবা তা আমি জানি।

    –আরেহ না আম্মা! আমি তেমন কিছু করবো না। আপনিই করবেন।

    –হইছে হইছে যাও। যা আনতে যাইতাছিলা গিয়া নিয়া আসো।

    ঘর থেকে বেরিয়ে ঝাড়ু আনতে গেলো ঈষিতা। শালুক আক্তার এগিয়ে গেলেন জানালার দিকে। পর্দাগুলো সরিয়ে জানালা খুলতেই চোখ গেলো ঠিক বরাবর বাড়িটার জানালার দিকে। শালুক একনজরে তাকিয়ে রইলেন সেদিকটায়। ফিরে এসে ঈষিতা দেখতে পেলো তার শাশুড়ী গভীর মনোযোগ দিয়ে ঐ বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন। পিছন থেকে ঈষিতা বললো,

    — এটা ঐ মেয়ের ঘরের জানালা তাই না?

    ঈষিতার কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন শালুক। জানালার কাছ থেকে সরে এসে খাটের উপর থাকা কাপড়টা সরাতে সরাতে তিনি বললেন,

    — ড্রেসিংটেবিলের কাপড়টা সরাও। তারপর ঐটা ভালোমতো মুছো। ফার্নিচার মোছার কাপড় কয়টা আনছো?

    — দুইটা।

    — বুদ্ধিমানের কাজ করছো। দাও দেখি এদিকে। এদিকে ফ্লোরে রাখো কাপড়টা। ঈষিতা খাটের এককোনায় কাপড় রেখে ড্রেসিংটেবিলে হাত লাগালো পরিষ্কার করার জন্য। খাট পরিষ্কার করতে করতে তার শাশুড়ী জিজ্ঞেস করলেন,

    — মজার কথা শুনবা?

    –বলেন।

    — দুই বাড়ির মাঝে একটা দেয়াল দাঁড় করানো হইছিলো। তখন নাহিদ ক্লাস সিক্সে পড়ে। দুই বাড়ির সীমানার দেয়াল আরকি। এরপর ও যখন ইন্টার পরীক্ষা দিলো তখন একদিন টুপ করে দেয়ালের অর্ধেক ভাইঙা পড়ে গেলো। পুরা সীমানার দেয়াল অক্ষত অথচ এই দুই জানালার বরাবর দেয়াল ভাঙলো। সেই থাইকা রুম্পার ঘরের জানালা নাহিদের ঘর থাইকা স্পষ্ট দেখা যায়।

    — তখন কি প্রেম শুরু হয়েছে দুজনের?

    –তা ঠিক জানিনা। কতবছরের প্রেম ছিলো ওদের দুজনের তা নাহিদ আমাদের বলে নাই।

    — দেয়াল তো ঐ ভাঙাই আছে। এই ঘটনা জানাজানির পর দেয়াল তো আরো উঁচু মজবুত করে করার কথা ছিলো।

    আর দেয়াল উঁচু! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তখন আর দেয়াল উঁচু কইরা লাভ কি হইতো? তবে রুম্পারে এই ঘর থেকে সরায়া নেয়া হইছিলো। এই ঘরে ওর বড় ভাই আর ভাবীরে থাকতে দেয়া হইলো।

    — রুম্পাকে দেখেছিলাম দুইমাস আগে। আপনার ছেলের সাথে মার্কেটে যাচ্ছিলাম। আমরা বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বের হচ্ছি আর রুম্পা বাচ্চাদের নিয়ে ওর বাবার বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে। মেয়েটা বোধহয় প্রেগন্যান্ট।

    — আবার বাচ্চা হবে?

    — হ্যাঁ তাইতো দেখলাম।

    –যাক ভালো। সবাই ভালো থাকুক।

    — ওরা ভালোই আছে আম্মা। ঐ ঘটনার জের আজ পর্যন্ত নাহিদ ভাই আর এই পরিবারই ভোগ করছে। মেয়ে তো সব ভুলে নিজের মত করে ভালোভাবেই বেঁচে আছে। দুটো বাচ্চার পর আবার আরেকটা হবে। আর নাহিদ ভাই এতবছরে একটা প্রেমই করতে পারলো না।

    — ঐ একটা ঘটনায় ঘরের ছেলে ঘর থেকে অনেক দূরে ছিটকে গেছে বউ তোমার শ্বশুরকে আমি বারবার বলছিলাম ওকে বিদেশ পাঠানোর দরকার নাই। ও দেশেই থাকুক। ধীরে ধীরে সব ঠিক হবে। কেনো জানিনা মনে কুকথা আসতাছিলো যে নাহিদ গেলে আর ফিরবে না। দূরে সরে যাবে অনেক আমাদের কাছ থেইকা। তোমার শ্বশুরের তখন লোমে লোমে জেদ। সে যা বলছে তাই হবে। আমারে সে দাম দিলো না। নাহিদরে সে পাঠাইলোই। আমার ধারণা ঠিক হইছিলো। ছেলে সত্যিই দূরত্ব তৈরী করলো। ঠিকমত ফোন দিতো না। দিলেও শুধু আমার সাথে আর ভাইবোনের সাথে কথা বলতো। তোমার শ্বশুরের সাথে মাসে-দুইমাসে একবার কথা হইতো। তাও খুবজোর তিন চারমিনিট। নাহিদরে বিদেশ পাঠানোর পর প্রথম দুই তিনমাস তোমার শ্বশুর ঠিক ছিলো। এরপর ধীরে ধীরে তারে পুত্রশোক ধরা শুরু করলো। সে টের পাইতাছিলো নাহিদ তার কাছ থেইকা অনেক দূরে চইলা যাইতাছে। ওরে বিদেশ পাঠানো ছিলো সবচেয়ে বড় ভুল। ও আমাদের অনেক আদরের ছিলো। চারজনের মধ্যে বেশি মায়া আমরা তারেই করি। বড় সন্তান তো আমাদের! প্রথম মা বাপ ডাক তো আমরা তার কাছেই শুনছি। আলাদা টান লাগে ওর প্রতি বুঝলা!

    কথাগুলো বলে থেমে গেলেন শালুক। নিঃশ্বাস নিচ্ছেন ঘনঘন। আবারও কান্না আটকানোর চেষ্টা করছেন তিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শাশুড়ির দিকে তাকাচ্ছে ঈষিতা। ড্রেসিংটেবিল পরিষ্কার শেষে আলমারীতে হাত লাগালো সে।

    শালুক আবার তার কথায় ফিরে গেলেন।

    –তোমার শ্বশুর এই দূরত্ব মানতে পারে নাই। ধীরে ধীরে অসুস্থ হওয়া শুরু করলো। কত যে ছেলেটারে একনজর দেখতে চাইতো! আমারে, তোমার জামাই আর ননদগুলারে খালি বলতো নাহিদরে দেশে ফিরার কথা বুঝানোর জন্য। আমরা তার কথা মোতাবেক বুঝাইতাম। আমি আর তোমার ননদরা কান্নাকাটি করতাম।

    ও ফিরে নাই। পুরা ছয়টা বছর পার হইয়া গেলো। তোমার শ্বশুর বিছানা নিয়া নিলো। শেষ সময় চলে তার। ফাহাদ ফোন দিয়া বললো,

    –আব্বার আর সময় নাই। এইবার তো দেশে আসো!

    হয়তো ওর মন গলছিলো এত বছর পর। সে রওয়ানা হইলো ঠিকই। কিন্তু তোমার শ্বশুর ওরে দেখতে পারলো না। ও সকাল পৌনে সাতটায় ঢাকায় এয়ারপোর্টে পা রাখলো আর তোমার শ্বশুর সোয়া সাতটায় মারা গেলো। নাহিদরে দেখা মানুষটার কপালে ছিলো না। সবই কপাল বুঝলা। এরপর পনেরোদিন দেশে ছিলো। আবার বিদেশ ফেরত গেলো। এখন পাঁচ বছর পর দেশে আসতাছে। নিঝুমের বিয়ে না থাকলে ও আসতো না। নিঝুম আর নিম্মিরে ও খুব ভালোবাসে। ফাহাদরে এতটাও না। দেখো না ওর বিয়েতে আসে নাই।

    মুচকি হেসে ঈষিতা বললো,

    — ভাইদের তো বোনের প্রতি মায়া বেশি থাকে। ফাহাদ তো আর বোন না।

    — হুম। ঠিক বলছো। ভাইরা বোনদের বেশি আদর করে। আরেক ভাই থাকলে এতটাও আদর করে না। যাও তো আমার ঘর থেইকা নীল রঙের বড় ফুলওয়ালা চাদরটা নিয়া আসো। নাহিদের নীল খুব প্রিয়।

    — আনি আম্মা।

    .

    ভাসুরের ঘর থেকে বের হয়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে এগুচ্ছে ঈষিতা। নাহিদের দূরত্ব আর শ্বশুড়ের মৃত্যুর ঘটনা এই নিয়ে বহুবার শাশুড়ির কাছে শুনেছে ঈষিতা। অজানা কোনো কারণে গল্পটাতে ক্লান্তি ধরে না তার। বরং কষ্ট হয়। সেইসাথে আফসোসও। জীবনের মোড়গুলো কখনো কখনো বহুবছরের ভালোবাসা আর সম্পর্কগুলোতে পঁচন ধরিয়ে ছাড়ে।

    ৩

    সকাল পৌণে আটটা। আমজাদ সাহেবের বাসার কলিংবেল বাজছে। রান্নাঘর ছেড়ে দ্রুত পায়ে ছোট তয়লাটাতে হাত মুছতে মুছতে এসে দরজা খুলে দিলেন ডলি। দরজা খোলা মাত্রই দুহাত বাড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো ঈষিতা। ডলির আক্তারের মুখে প্রশস্ত হাসি লেপ্টে আছে। মেয়ের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম আর নিম্মি। মেয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিঝুম আর নিম্মিকে জড়িয়ে ধরলেন ডলি। আহ্লাদী কন্ঠে তাদের জিজ্ঞেস করলেন,

    — কেমন আছো তোমরা?

    — ভালো আছি খালাম্মা।

    — নিঝুর চেয়ে আমি বেশি ভালো আছি খালাম্মা। বেয়াদবটা ঘর ছেড়ে চলে যাবে। আমার সাথে আর ঝগড়া করার কেউ থাকবে না। আদরও আর ভাগ করতে হবে না। সব আমার একার।

    বেশ উল্লাসিত কণ্ঠে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো নিম্মি। ভ্রু কুঁচকে মুচকি হেসে নিম্মির দিকে তাকিয়ে আছে নিঝুম। ওপাশ থেকে ঈষিতা বললো,

    — বিয়ের পর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে তুমিই বেশি কাঁদবে।

    — হ্যাঁ, তোর বিয়ের সময়ও নিশাত এভাবেই বলতো না রে ঈশু। এসব পরে কিচ্ছু মনে থাকবে না তোমার। জানো ঈশু চলে যাওয়ার পর নিশাতের কান্না থামতে সময় লেগেছে পনেরোদিন। হায়রে কি যে কান্না! ঈশু চলে যাওয়ার রাত থেকে পরের দুইদিন বাসায় ও মরা কান্না জুড়িয়ে রেখেছিলো।

    — আম্মা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছো কখন থেকে। ঘরে যাই?

    –ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ। ঘরে চল, ঘরে চল। আচ্ছা ফাহাদ কোথায়?

    –ভাড়া মিটিয়ে আসছে। ওহ, ঐতো চলেও এসেছে।

    ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলেন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে বড় মেয়ে জামাই। হাসি মুখে সালাম দিলো ফাহাদ,

    — আসসালামু আলাইকুম আম্মা।

    –ওয়া আলাইকুম আসসালাম। ভালো আছো বাবা?

    –জ্বি আম্মা। আপনি ভালো আছেন?

    –এইতো আছি। আসো ভিতরে আসো।

    ঘরে প্রবেশ করতে করতে ঈষিতা মাকে জিজ্ঞেস করলো,

    — আব্বা কই?

    — বাজারে পাঠিয়েছি চিংড়ি আনতে।

    –আচ্ছা! আর নিশু?

    — ঘুমুচ্ছে।

    –ও জানে না আমি আসবো?

    — হুম।

    — উঠলো না কেনো তাহলে?

    — সারারাত ঘুমায় না। কাঁদে আর সারাঘর হাঁটে। ভোরের আগ মুহূর্তে এসে ঘুমায়।

    হঠাৎ করেই চনমনে পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেলো। হাসিমাখা চেহারাটা মুহূর্তেই বিষাদে মোড় নিলো ডলির। চোখেমুখে একরাশ অশান্তি জমে গেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিঝুম আর ঈষিতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসতে হাসতে নিঝুম বললো,

    মহিলা দেবদাস হওয়ার শখ জেগেছে। এই যে রাতে এই ঘর ঐ ঘর হাঁটাহাঁটি করে, কোনো একদিন ভূতের দেখা পেলে শখ মিটে যাবে। যাই, ওর ঘরে যাই। ঘুম থেকে উঠাই ওকে।

    নিঝুম এগিয়ে যাচ্ছে নিশাতের ঘরের দিকে। পিছন পিছন যাচ্ছে ঈষিতা আর নিম্মি। ফাহাদের দিকে তাকিয়ে ডলি জিজ্ঞেস করলেন,

    তোমাকে চা এখন দিবো? নাকি নাস্তার পর খাবে?

    — চা বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।

    –আচ্ছা তাহলে আমি রুটিগুলো সেঁকে ফেলি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও।

    –আম্মা চালের রুটি করেছেন না?

    — হ্যাঁ, হ্যাঁ। চালের রুটিই তো।

    –আচ্ছা। আমি কাপড় পাল্টে আসি। ততক্ষণে ওরাও নিশুকে নিয়ে আসুক। একসাথে বসে নাস্তা করবো।

    — ঠিকাছে।

    রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন ডলি। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলো ফাহাদ। ঘুম ঘুম লাগছে তার। আরেকটু পর উঠে নাহয় ফ্রেশ হওয়া যাবে।

    .

    দুবার ডাক দেয়ার সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকালো নিশাত। বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে বসতে বললো,

    — কখন আসলে তোমরা?

    –দশ মিনিট হলো। চোখ ফুলে আছে কেনো? সারারাত কেঁদেছিস তাই না?

    –নাহ্।

    — মিথ্যা বলো কেনো নিশু?

    — সত্যি বললে কি হবে নিম্মি? আবীর কি ফেরত আসবে?

    — আচ্ছা সকাল সকাল এসব বাদ দেই। তোমাকে নিয়ে নাস্তা করবো। খুব ক্ষিদা পেয়েছে। উঠো জলদি। হাত মুখ ধুয়ে আসো।

    — হুম।

    বালিশের পাশে থাকা পাঞ্চক্লিপটা নিয়ে চুল আটকাতে আটকাতে ওয়াশরুমের দিকে গেলো নিশাত।

    ঈষিতার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে নিঝুম বললো,

    — ভাবী আপাতত এসব বাদ দাও। ও তো যাচ্ছেই আমাদের সাথে। এখানে থাকতে এসব কথা বললে যদি ও বিগড়ে যায় পরে আর আমাদের সাথে যাবে না। ওখানে গিয়ে আস্তে ধীরে এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।

    সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালো ঈষিতা। বাজে হাল হয়েছে মেয়েটার চেহারার।

    নিশাতের হাজার অসুস্থতায়ও চোখের নিচে এমন কালো দাগ পড়েছে বলে ঈষিতার মনে পড়ছে না। শুকিয়েও গিয়েছে খুব। এজন্যই মা এতটা চিন্তায় ডুবে আছে ওকে নিয়ে। কিন্তু নিশাত মায়ের এই দুশ্চিন্তা কবে বুঝবে?

    .

    কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে ফাহাদ চলে গেলো ঈষিতার বেডরুমে। এটা তাদের জন্যই বরাদ্দ থাকে। যখনই এ বাড়িতে বেড়াতে আসে তখন এ ঘরটাতেই থাকে তারা। বরাবরই ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পায় সে। ঈষিতা এ ঘরটাতে সারাবছর না থাকলেও এই ঘরটা সারাবছরই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে তার শাশুড়ী। মেয়ের অনুপস্থিতিতে এই ঘরটাতে বসে থাকেন তিনি। তার ভাষ্যমতে এই ঘরে অশান্তি কমানোর টনিক আছে। কারণ এটা তার বড় মেয়ের ঘর। একমাত্র বড় মেয়ের মাঝে যতটা স্বস্তি তিনি পান জগতের আর কারো কাছে তিনি সেটা পাননা। শুধুমাত্র তাদের বাড়ীর অন্যান্য মানুষদের খুব মনে ধরেছে তাই মেয়েকে ঢাকার বাহিরে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর নয়তো ফাহাদ জানে কখনোই তার কাছে মেয়ে দিতেন না তার শাশুড়ী।

    ৪

    নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই। এমন সময় বাসার কলিংবেল বাজলো। চেয়ার ছেড়ে উঠলেন ডলি। দরজা খুলতেই দেখতে পেলেন আমজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন বাজারের ব্যাগ হাতে। হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিলেন তিনি। বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো ঈশিতা। বাবার দিকে এগিয়ে তার দু’হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,

    — ভালো আছো বাবা?

    –তোরা বাসায় আসলে তো ভালোই লাগে। শান্তি লাগে বুঝলি। ফাহাদ ভালো আছো?

    –জ্বী বাবা। আপনি সুস্থ আছেন তো?

    — হ্যাঁ, হ্যাঁ। বেশ আছি। নিম্মি আর নিঝুম, কি খবর তোমাদের?

    — খুব ভালো আংকেল।

    — ভালো, ভালো। তোমাদের আম্মা ভালো তো?

    — জ্বী ভালো।

    — বাবা, বসেন আমাদের সাথে। নাস্তা করবেন।

    –না আমি নাস্তা খেয়েই বের হয়েছি। তোমাদের সাথে বসে এক কাপ চা খেতে পারি। তার আগে হাত মুখটা একটু ধুয়ে আসি।

    — জ্বী, জ্বী অবশ্যই।

    .

    নাস্তার টেবিলে বসার পর থেকেই নিশাতকে লক্ষ্য করছে ফাহাদ। কথাবার্তা একদম বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েটা। আগে বাসায় আসলে নিশাতের কথার অত্যাচারে টিকে থাকা দায় ছিলো। রাতে পযন্ত ঘুমোতো দিতো না। তিনটা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত জাগিয়ে রাখতো। এবার আসার পর থেকে সৌজন্যের খাতিরে বলা কথাগুলো ছাড়া আর একটি কথাও বললো না সে। একটা মানুষ নিজে তো বদলায়, সেইসাথে তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকেও বদলে দেয়। তার বিশাল বড় উদাহরন হচ্ছে আবীর নিজে। বিয়ের পর থেকেই আবীরকে তার চেনা। কতশত গল্প করেছে এই মানুষটার সাথে তার হিসাব নেই ফাহাদের কাছে। আবীরের বদলে যাওয়াটা শুরুতে ফাহাদেরই মানতে কষ্ট হচ্ছিলো। কি করে পারে মানুষ এতটা বদলাতে? এত দিনের একটা সম্পর্ক বেমালুম ভুলে যেতে? আর সেখানে নিশাতের এমন হাল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। ফাহাদ জানে নিশাতের ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। অথবা কখনো হয়তো ঠিকই হতে পারবে না। ক্ষতটা আজীবন হয়তো পেলে পুষে রাখবে। কিন্তু তবুও সে চায় মেয়েটা আগের অবস্থায় ফিরে যাক। চোখের সামনে একটা মানুষের ডুবে যাওয়া কখনোই মেনে নেয়া যায় না। সে জানে নিজের মানুষের ডুবে যাওয়া কতটা কষ্টের। যে ডুবে যায় সে ডোবার পর কতটা কষ্টে থাকে তা ফাহাদের জানা নেই। কিন্তু তার আপনজনেরা কতখানি অশান্তিতে ভোগে তা সে ভালোই জানে। নাহিদকে তো চোখের সামনেই দেখেছে ডুবতে। সেই কষ্ট পুরো পরিবার বয়ে বেড়াচ্ছে আজ ১২ বছর। নিশাতকে কখনোই নিজের বোনের চেয়ে কম ভাবেনি ফাহাদ। মেয়েটা চিরতরে ডুবে গেলে আরো একটা কষ্ট নতুন করে যোগ হবে জীবনে যেটা সে কখনোই চায়না। যতখানি সম্ভব চেষ্টা করবে ওকে সামলে রাখার। বাকিটা ভাগ্য। ভাগ্যের বিপরীতে তো চলা সম্ভব না। এসব ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাহাদ।

    ওপাশ থেকে ঈশিতা নিশাতকে বললো,

    — নিশু, আমি লিস্ট এনেছি। অনেক কিছু কিনতে হবে। তুই নাস্তা সেড়ে তৈরী হয়ে নে। নিউমার্কেট যাবি।

    মুখের ভিতর একপাশে নাস্তা রেখে ভ্রু কুঁচকে নিশাত জিজ্ঞেস করলো,

    — আমি?

    — হ্যাঁ তুই।

    — আর কে যাবে?

    — নিম্মি, নিঝু আর তোর দুলাভাই।

    — তুই যাবি না?

    — না।

    — কেনো?

    গত কয়েকদিন কাজের খুব প্রেশার যাচ্ছে। আমি ছুটাছুটি করবো না। একদিন একটু রেস্ট নেই। আম্মার সাথেও তো কথা হয়না কতদিন। বাসায় বসে আম্মার সাথে একটু সময় কাটাই।

    –হুম।

    নিম্মি বললো,

    — নিশাত, শুনো না তুমি পছন্দ করে আমাকে জুয়েলারী কিনে দিও।

    সাথে সাথে নিঝুম পাল্টা প্রশ্ন করলো,

    — কি রে নিম্মি তুই না কয়দিন আগে জুয়েলারী কিনলি বিয়েতে পরবি বলে?

    –বৌ-ভাতের জন্য নিবো।

    — আচ্ছা আবার বৌ-ভাতেরও!

    পাশ থেকে ঈশিতা বলে উঠলো,

    — ওর তো গায়ে হলুদের জন্যও গয়না নেয়া হয়নি।

    এর মধ্যে ফাহাদ বিরক্ত হয়ে বললো,

    –আরো কিছু থাকলে সেগুলোও বলো!

    নিম্মি ও নিঝু ঈষিতাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে বললো,

    –শুনো আমাদের ভাবীই ভালো। সব খেয়াল রাখে।

    — শোন্ নিশু, বিয়েতে যা লাগবে কিনে নিবি। তোর দুলাভাই কিনে দিবে। ওখানে গিয়ে বলিস না এটা নেই ওটা নেই।

    — আমার কিছু লাগবে না।

    — সব ম্যাচিং আছে তোর?

    — কি ম্যাচিং আছে না আছে সেসব নিয়ে এখন আর ভাবি না।

    — কেনো? এমন ভাবে কথা বলিস মনে হয় যেনো মরে গেছিস?

    — ধরে নে তাই।

    –আমি জানি না এতকিছু। তুই কিনবি ব্যস। এরপর তোর মন চাইলে পরবি না মন চাইলে পরিস না। নিম্মি ওর জন্য জামা কিনবে তিনটা। তুমি পছন্দ করে কিনবে। সাথে ম্যাচিং যা লাগে সব কিনবে। ঠিকাছে?

    –ঠিকাছে।

    — আমি আজই দর্জির কাছে দিয়ে যাবো। আম্মা যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে। ভাবলেশহীনভাবে নাস্তা সেরে টেবিল ছেড়ে হাতটা ধুয়ে নিজের ঘরে গেলো নিশাত। পিছন পিছন নিম্মি আর নিঝুমও গিয়েছে কাপড় পাল্টে একটু সাজগোজ করে নিতে।

    .

    ফাহাদের পাশে ঈশিতা বসে বললো,

    –দেখছো ওকে?

    — হুম।

    –মনে হয় যেনো ওর সবকিছু থমকে গেছে।

    –এই দৃশ্য আমার জন্য নতুন না। এর অভিজ্ঞতা আমার আছে। তোমার এই

    মুহূর্তে কেমন লাগছে তাও আমি জানি। এখন ধৈর্য্য ধরা ছাড়া কিছু করার নেই।

    — আম্মা আর বাবা ওকে নিয়ে প্রচুর দুশ্চিন্তায় ভুগে।

    –খুব স্বাভাবিক।

    –আম্মা প্রকাশ করে আর বাবা পুরোটা দুশ্চিন্তা চেপে রাখে।

    নিজেরটা চেপে রেখে তোমার মাকে সামলায়।

    –হুম।

    –ঈশু আমাদের যতটা চেষ্টা করার দরকার আমরা ততটা করবো।

    –তোমার আম্মা গতকাল কি বলছিলো জানো?

    — কি?

    — নিশাতকে আগলে ধরো। ও যেনো আমার নাহিদের মত দূরে ভেসে না যায়।

    –কারণ আম্মা জানে প্রিয় মুখ দূরে ভেসে চলে যাওয়ার মানে কি।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম
    Next Article রুদ্র – খাদিজা মিম

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.