Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    অপেক্ষবাদের অ, আ, ক, খ – বারট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প236 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বাতাসে গুনগুন – ২০

    ২০

    হাতভরা জিনিস নিয়ে ঘরে ফিরেছে নিশাত। ব্যাগগুলো ড্রইংরুমে সোফার উপর রেখেই নিঝুমদের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো সে। নিঝুমদের ঘরে যাওয়ার সময় নিম্মি আর ঈষিতা এটা সেটা জিজ্ঞেস করলেও সে কোনোটারই উত্তর দেয়নি। কোনো এক ঘোরের মাঝে পড়ে আছে সে। আশপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব কিছুর আপাতত খেয়াল নেই নিশাতের। পুরোটা ধ্যান জুড়ে এখন শুধু নাহিদই আছে। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে মনের অনুভূতিগুলো ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করছে সে। সমস্ত অনুভূতি শুধু নাহিদকে জুড়েই। নিশাতকে চুপচাপ চলে যেতে দেখে নাহিদের ঘরে গেলো নিম্মি। পিছন পিছন গেলো ঈষিতাও। গায়ের শার্ট খুলে ফ্যানের নিচে বসে আছে সে। নিম্মি ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

    –নিশুর কি হয়েছে?

    –কি হবে?

    — ঝগড়া হয়েছে তোমার সাথে?

    — না তো। ঝগড়া হবে কেনো?

    — তাহলে ও আমাদের কথার উত্তর না দিয়ে চলে গেলো কেনো? ঘরে গিয়ে দরজাও আটকে দিলো।

    — কি জানি! ভালোই তো ঘুরে আসলো আমার সাথে। আচ্ছা দেখছি আমি।

    .

    দরজার বাহিরে টোকা পড়ছে। সেইসাথে শোনা যাচ্ছে নাহিদের ডাক।

    –নিশু! নিশু, দরজা খুলো।

    নাহিদের আওয়াজ পেতেই হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠলো নিশাত। দ্রুত পায়ে এসে দরজা খুলে দিলো। কোমড়ে হাত রেখে নাহিদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

    — কোনো সমস্যা?

    — নাহ্।

    — তাহলে?

    –তাহলে কি?

    –ওরা দুজন বললো তুমি নাকি ওদের সাথে কথা বলোনি। চুপচাপ এসে দরজা আটকে পড়ে আছো।

    — কিছু জিজ্ঞেস করেছিলো আমাকে ওরা?

    — আমরা দুজনই তো তোকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করলাম। এখন আবার বলছিস আমাদের কথাই শুনিস নি। কোন ধ্যানে পড়ে আছিস?

    — না, ধ্যান না। ঘুম পাচ্ছে খুব।

    — ও বোধহয় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। এজন্য তোমাদের কথা খেয়াল করেনি।

    — তো দরজা আটকে দিলি যে?

    –আমি কি দরজা খুলে কাপড় চেঞ্জ করবো?

    –ওহ আচ্ছা। খাবি না তাহলে রাতে?

    –না। হাবিজাবি খেয়ে পেট ভরে গেছে।

    –হাবিজাবি কেনো? ওখানে তো বিরিয়ানি ছিলো। খাওনি?

    — না।

    — ভাইয়া তুমি ওকে বিরিয়ানি খাওয়ালে না কেনো?

    –সাড়ে নয়টা থেকে বিলি শুরু হবে। খেয়ে আসতে গেলে অনেক রাত হয়ে যেতো। তাই চলে এসেছি।

    –দেরী হলে হতো। এত মজার বিরিয়ানি কেউ মিস করে নাকি? ওখানে গিয়েছো যেহেতু ওকে খাইয়ে আনা উচিত ছিলো।

    –আচ্ছা কাল সকালে গেলেও পাওয়া যাবে।

    –তবুও গরম গরম খেতে পারতো।

    –সকালেও তো আরেকদফা রান্না হবে। তখন নাহয় খাবে।

    –আচ্ছা সকালে গেলে আমিও যাবো।

    –ভাইয়া আমিও যাবো। আমাকেও নিতে হবে।

    –আচ্ছা সবাইকে নিবো। কাউকে রেখে যাবো না।

    .

    আবারও ঘরে চলে গেলো নিশাত। এমন আজব অনুভূতি এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয়না। আবীরের প্রেমে যখন পড়েছিলো তখন কি এমন হয়েছিলো? না তো। তাহলে এবার কেনো এমন হচ্ছে? সম্পূর্ণ মাতাল মাতাল লাগছে। চোখের সামনে সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তবু মনে হচ্ছে কিছুই হচ্ছে না। সব থমকে আছে। আশপাশের সবাই কথা বলে যাচ্ছে। সেসব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। ঘুমঘুম লাগছে খুব। কতদিন পর এমন ঘুম চেপেছে চোখে তা জানা নেই নিশাতের। জেনে লাভও নেই। আপাতত একটু ঘুম খুব জরুরি। কোনোমতে কাপড় পাল্টে লাইট নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো সে।

    .

    আলমারী থেকে নিজের বিয়ের শাড়ী আর গহনাগুলো নামিয়ে হাতড়ে দেখছেন শালুক। বৌ-ভাতের শাড়ীটা ছোট বউয়ের জন্য বরাদ্দ ছিলো যেটা ঈষিতাকে বিয়ের পরদিন সকালেই উনি দিয়েছেন। আর এই বিয়ের শাড়ীটা তোলা ছিলো নাহিদের বউয়ের জন্য, যেটা নিশাতকে দিবেন বলে মনে মনে আপাতত কল্পনা সাজাচ্ছেন। রাতের খাবার সেরে মায়ের ঘরে এসে বসলো নাহিদ। পুরোনো গহনা আর শাড়ি খাটের উপর দেখে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো,

    –এগুলো নামিয়েছেন কেনো?

    –এমনেই।

    –আপনার বেনারসীটা খুব সুন্দর আম্মা। যে পরবে তাকেই মানাবে।

    ছেলের সামনে গহনার চারটা বাক্স খুলে এগিয়ে দিলেন শালুক। জিজ্ঞেস করলেন,

    — দেখতো কোনটা বেশি ভাল্লাগে?

    –কার জন্য?

    কারো জন্য না। এমনিই জিজ্ঞেস করি। দেখ না কোনটা বেশি ভালো?

    সবচেয়ে হালকা গয়নার বাক্সটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে নাহিদ বললো,

    — এটা। যদিওবা পাতলা গড়নের জিনিস। কিন্তু বেশ ইউনিক।

    — এটা আমার নানী দিছিলো আমার বিয়েতে।

    — বুড়ির চয়েজ ভালো। বেশ ক্লাসি।

    –হ্যাঁ। সেই জমানার মানুষদের তুলনায় নানীর চিন্তাধারাও ছিলো ভিন্ন। আমার নানীই কিন্তু আমার আব্বারে পছন্দ করছিলো আমার মায়ের জন্য। নানার নাকি আব্বারে বিশেষ পছন্দ হয়নি। নানীর জোরাজুরিতে বিয়ে হইছলো।

    — কেনো? আপনার নানার সমস্যা কোথায়?

    –আব্বা নাকি বেশি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। এতো শুদ্ধভাষী মানুষ নানার অসহ্য লাগতো। এটা নানার ধারণা ছিলো আব্বা নাকি এসব শুদ্ধভাষার প্রচলন এনে গ্রামের রীতি বদলায় দিতেছে। তাছাড়া আব্বার চিন্তাধারার সাথে নানার চিন্তা মিলতো না।

    –একগুঁয়ে স্বভাবের ছিলো তাই তো?

    –হ্যাঁ। তাছাড়া আম্মাও বিয়ের পর আব্বার মত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো। এটা নিয়াও নানা ক্ষেইপা ছিলেন। বলতেন তার মেয়েকে নাকি আব্বা বিগড়ায়া দিছেন।

    — আপনাকেও তো এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর অনেক কথা শুনতে হয়েছে।

    –হুম, তোর দাদী আর বড় ফুফু খুব হাসাহাসি করতো আমারে নিয়া। বেশ কটাক্ষ কইরা কথা বলতো। তোর দাদী তো পান থেইকা চুন খসলেই ভেংচি কাইটা বলতো, “শিক্ষিত বেডার মাইয়্যা খালি শুদ্ধ কইরা কথাই কইতে শিখছে। কাম আর শিখে নাই।” খুব খারাপ লাগতো। এদের খোঁচা মারা কথা একদম নিতে পারতাম না। সেইসময় এইখানকার ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করা শুরু করলাম। কিন্তু পারলাম না। ফলাফল হইতাছে এখন আমি মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি। শুদ্ধ আর গ্রাম্য ভাষার মাঝামাঝি পর্যায়ের কথা বলি।

    মুখ টিপে হাসলো নাহিদ। হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ টেনে এনে কোলে রাখলো সে। বালিশের উপর দু’হাত ভর দিয়ে মাকে বললো,

    — নানা থাকায় একটা সুবিধা হয়েছে কি জানেন?

    — কি?

    –আঞ্চলিক টান ছাড়া আমরা কথা বলতে পারি। অন্য মানুষদের সাথে কথা বলতে গেলে বেশ অবাক হয় জানেন? বলে গ্রামে থেকেও আঞ্চলিক টান ছাড়া কথা বলি কেমন করে?

    — হুমম। তোর আব্বা অবশ্য খুব খুশি হইতো আমার আঞ্চলিক টান ছাড়া কথা বলা শুনলে। তোর দাদী ফুফু আমার সাথে যখন বাড়াবাড়ি শুরু করলো এসব নিয়া, তখন তোর আব্বাও একদম শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শুরু করে দিলো সবার সাথে। তোর দাদীর কি রাগ! তোর আব্বাও কম যায় না। উল্টা উত্তর দিয়া দিতো ভালো কিছু দেখলে উৎসাহ না দিয়া এমন খোঁচান কেনো? এই বাড়িতে পা রাখার পর থেইকা তোর আব্বার অনেক সহযোগিতা আমি পাইছি।

    –হ্যাঁ আম্মা। আব্বা সবাইকেই সাপোর্ট করে গেছেন আজীবন। শুধু মাত্র আমি ছাড়া। সেদিন আব্বা আমাকে একটু সাপোর্ট করলে হয়তো আজ জীবনটা অন্যরকম হতো আমার।

    কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নাহিদ। চুপচাপ ছেলের চলে যাওয়া দেখছেন শালুক। ছেলের বলা শেষ কথাগুলো শংকিত করে তুলছে তাকে। এখনও কেনো রুম্পার সেই ঘটনা মাথায় নিয়ে বসে আছে সে? তার জীবনে নিশাত আসা সত্ত্বেও কি রুম্পাকে সে পুরোপুরি মন থেকে বের করতে পারেনি? ভবিষ্যতে আবার এই মেয়েটার প্রতি রয়ে যাওয়া অবশিষ্ট অনুভূতির জন্য দুজনের মধ্যে কোনো সমস্যা হবে না তো? নিশাত বেঁকে বসবে না তো?

    .

    পাশাপাশি শুয়ে আছে ফাহাদ আর ঈষিতা। অনেকক্ষণ যাবৎ ঈষিতা তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বলছেনা। অনেকটাসময় ধরেই ফাহাদ লক্ষ্য করছে বিষয়টা। একটা পর্যায়ে সে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

    — কি বলবে বলে ফেলো।

    –তুমি জানলে কিভাবে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি?

    –দুইবছর সংসার করে কি এতটুকুও বুঝতে পারবো না? হুম বলার তো আছে কতকিছুই।

    — তো বলো।

    –নাহিদ ভাই আর নিশাতের মাঝে কিছু চলছে।

    — চলছে বলতে?

    — ইমোশনাল এটাচমেন্ট।

    –তোমাকে কে বললো?

    –কারো বলতে হবে? নিজের চোখে দেখছি। এই বাড়ির প্রত্যেকে দেখছে।

    — কই আমি তো দেখলাম না।

    — তুমি কি বাসায় থাকো নাকি?

    –আকাশ কুসুম ভাবনা বাদ দাও ঈষিতা।

    –আকাশ কুসুমের কি দেখলে?

    –আর নয়তো কি? এটা কি কোনো দিক দিয়ে যায় নাকি? আমার ভাইয়ের সাথে তোমার বোনের এ্যাফেয়ার কিভাবে হতে পারে?

    — তুমি কি বয়সের দিকটা বলছো?

    — হ্যাঁ। এত পার্থক্যে এ্যাফেয়ার হতে কখনো দেখেছো?

    — দেখিনি। কিন্তু হবে না এমনও তো কথা নেই।

    –হ্যাঁ নেই। কিন্তু তুমি যেটা বলছো সেটা ভুল। ওদের মধ্যে এমন কিছুই নেই। হ্যাঁ খুবজোড় বন্ধুর মত সম্পর্ক হতে পারে। সেটা আমিও খেয়াল করেছি ওরা একজন আরেকজনের সাথে বেশ ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার করে। তারমানে তো এই না যে তুমি এটাকে এ্যাফেয়ারের নাম দিয়ে দিবে।

    –ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ারের চেয়েও একটু বেশি কিছু ফাহাদ।

    –পাগল ছাগলের মত কথা বলো না তো! নিশাত সবেমাত্র একটু একটু করে রিকোভার করা শুরু করেছে। আর নাহিদ ভাই ঐ একটা ঘটনা নিয়ে এখনো বসে আছে। এমন একটা অবস্থায় দুজনের মধ্যে এ্যাফেয়ার কিভাবে হয়? চারদিনের পরিচয়ে যে যার যার অতীত ভুলে একজন আরেকজনের প্রেমে পড়ে যাবে এটা কি সম্ভব নাকি?

    –সেটা অতীত। বৰ্তমান তো না। অতীত ভুলা যেতেই পারে।

    — অযৌক্তিক কথাবার্তা!

    — মোটেই না।

    — কিভাবে সম্ভব এটা? নাহিদ ভাই কখনোই এত ছোট একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়াবে না।

    — তাহলে কি ঘরসুদ্ধ লোকজন সব ভুল দেখছি? ভুল বুঝছি?

    — অবশ্যই ভুল বুঝছো।

    — তুমি একাই সঠিক?

    — অবশ্যই আমি সঠিক I

    — আচ্ছা, তর্ক বাদ। সময় হলেই সব বুঝা যাবে।

    –এসব ফালতু চিন্তা বাদ দাও।

    –তোমার চিন্তা তুমি করো। আমার চিন্তা আমি করি। ঠিক আছে?

    ২১

    হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো নিশাতের। ঘুম ভাঙতেই মাথার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ফোনের স্ক্রিন অন করলো সে। ঘড়িতে সোয়া তিনটা বাজে। তার মনে পড়লো নাহিদের কথা। কি করছে উনি? জেগে আছে কি? এসব ভাবতে ভাবতেই শোয়া থেকে উঠে পড়লো সে। তড়িঘড়ি করে হাত মুখটা ধুয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ালো।

    বাসার ভিতর সদর দরজা বরাবর জুতার আলনা সাজানো। সেখান থেকে জুতা বের করছে নাহিদ।

    –কোথায় যাচ্ছেন?

    প্রশ্ন শুনে পাশ ফিরে তাকালো নাহিদ। ডাইনিংরুমে জ্বলতে থাকা লাইটের আলো আবছা হয়ে ছিটকে পড়ছে এখানটাতে। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে নিশাতকে। এলোমেলো চুলে দাঁড়িয়ে আছে সে। জুতা হাতে নিয়ে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো, – ঘুম থেকে উঠে পড়লে যে?

    –আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

    — হাঁটতে।

    –কোথায় হাঁটবেন?

    — এইতো বাহিরে রাস্তায়।

    –আমিও যাবো। – তুমি!

    –হ্যাঁ। আমাকেও নিয়ে যান আপনার সাথে।

    –আজকে ভোরে তোমাদের নিয়ে বিরিয়ানি খেতে যাওয়ার কথা। ঐ যে ওরসের বিরিয়ানি। নিম্মি বলছিলো তোমাদের সবাইকে নিয়ে যেনো যাই। কথা ছিলো ফজরের আজানের পরপরই সবাই বের হবো। অলরেডি সোয়া তিনটা বাজে। চারটার দিকে তো আজানই দিয়ে দিবে। তখন ওদের সঙ্গে একসাথে বের হও। আমি এখন একটু ঘুরে আসি।

    –আমাকে একটু নিলে কি হয়! নিয়ে যান না আমাকে সাথে করে!

    বাচ্চাদের মত আহ্লাদী কন্ঠে আবদার করছে নিশাত। আবদারটা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে সে বললো,

    — চুল আঁচড়ে আসো, যাও।

    –নিবেন আমাকে?

    –নিবো দেখেই তো বললাম।

    –দুই মিনিট। আমি যাবো আর আসবো। আপনি কিন্তু আমাকে রেখে চলে যাবেন না। দাঁড়াবেন কিন্তু আমার জন্য।

    কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই দৌঁড় দিলো নিশাত। মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো নাহিদের ঠোঁটের কোণে। হাতে পায়ে যেভাবে লম্বা হয়েছে মেয়েটা, লোকে দেখলে ভাববে মেয়ে তো সংসারের উপযুক্ত হয়ে গেছে। মনটা যে এখনো ছোট মানুষের মতই রয়ে গেছে সেটা দেখে বুঝার উপায় নেই। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই ঘরের ভিতর চলে এলো সে। সোফায় গা এলিয়ে বসে রইলো। হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই নিশাতের চোখে পড়লো নাহিদ ড্রইংরুমে বসা। চুলগুলো পাঞ্চক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে নিশাত বললো,

    — চলেন যাই।

    –যাবো না। আসো বসে গল্প করি।

    হতাশ হলো নিশাত। নাক মুখ কুঁচকে বললো,

    –কেনো?

    –রাতে ঘুরে বেড়ানো ব্যাপক আনন্দের। যেহেতু আগে কখনো রাত বিরাতে হেঁটে বেড়াওনি সেহেতু আমি সাজেস্ট করবো এই এতটুকু সময়ের জন্য ঘুরতে যাওয়ার দরকার নেই। তোমাকে নিয়ে কাল পরশু হাঁটতে যাবো। সময় নিয়ে বের হবো। ঠিক আছে?

    — কোথায় যাবো আমরা?

    — স্টেশন। অনেকটাসময় হেঁটে অভ্যস্ত তো তুমি তাই না? স্টেশন কিন্তু মোটামোটি দূর।

    — কতখানি?

    –এই ধরো হেঁটে গেলে আধঘন্টার মত লাগবে।

    –আরে ধুর! কোনো অসুবিধাই হবে না। এইটুকু সময় তো হাঁটতে পারবোই। সমস্যা হবে না।

    — আচ্ছা তাহলে আমরা হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন যাবো। পাশেই হোটেল আছে। অনেক পুরোনো। ওদের তরকারীগুলো কতটা স্বাদ হয় না খেলে বুঝতে পারবে না। বহুদিন হয় ওদের খাবার খাই না। শেষবার যখন দেশে এসেছিলাম তখন গিয়েছিলাম ওদের ওখানে।

    — ওহ্।

    –তারপর আমরা যাবো নদীর ঘাটে। ওখানে ঘাট আছে দুইটা। একটা লঞ্চ ঘাট। আরেকটা নৌকা ঘাট। নৌকা ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকবো। কতবছর যে যাই না ওখানে! খুব মিস করি জানো।

    –যান না কেনো?

    –আমি দেশে থাকলে তো যাবো?

    — দেশে থাকেন না কেনো?

    চুপ হয়ে গেলো নাহিদ। এই প্রশ্নের উত্তর নিশাতের অজানা নয়। তবু সে অহেতুক এই প্রশ্ন করছে এটা নাহিদ জানে। সেইসাথে এটাও জানে নিশাতের দ্বারাই এমন অদ্ভুত আর অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা সম্ভব। ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে নিশাতকে নাহিদ জিজ্ঞেস করলো,

    — এ্যাই মেয়ে, দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

    –আসলেই তো! আমি দাঁড়িয়ে আছি কেনো?

    –তুমি আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছো?

    –আশপাশে তো আর কেউ নেই। আর কাকে জিজ্ঞেস করবো?

    –তুমি কি আবীরকেও এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করতে?

    –আমি অদ্ভুত প্রশ্ন করি?

    — নাহ্ করো না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। বসো এখানে।

    কুশনটা কোলে নিয়ে নাহিদের পাশের সোফায় আসন ধরে বসে পড়লো নিশাত। পাঞ্চ ক্লিপটা খুলে নিজেই নিজের চুল এলোমেলো করতে করতে বললো,

    — আপনি রাতে ঘুমান না কেনো?

    — ঘুমাই তো।

    — আমি তো একদিনও দেখলাম না আপনাকে রাতে ঘুমাতে।

    –এতক্ষন আমি ঘুমিয়েই এসেছি নিশু। হ্যাঁ এটা বলতে পারো আমি একটানা ঘুমাই না। একটানা ঘুম আমার কখনোই আসে না। ঘুমাই, আবার জেগে উঠি, ঘুরাঘুরি করি। এরপর আবার ঘুমাই। এভাবেই আমার রাত কাঁটে।

    –আগে থেকেই এই অভ্যাস? নাকি রুম্পা চলে যাওয়ার পর থেকে?

    –রুম্পা যাওয়ার পর থেকে।

    –কখনো ইচ্ছে হয় না ওর সাথে কথা বলতে?

    — নাহ্।

    — দেখা হয়নি এরপর আর?

    –হুম হয়েছে তো। বহুবার হয়েছে।

    –আপনার দিকে তাকিয়েছে?

    –খেয়াল করিনি কখনো। ওকে দেখার সাথে সাথেই চোখ অন্যদিকে নিয়ে নিতাম।

    –কেনো?

    –এতকিছু কেনো জিজ্ঞেস করছো নিশাত?

    –এমনিই। বলুন না!

    –ও এখন আমার না। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। আর দশটা মানুষকে যেভাবে আমি দেখতাম ওকে আমি কখনো ওভাবে দেখিনি। সবসময় একরাশ ভালোবাসা নিয়েই তাকিয়েছি। একটা মেয়ের বিয়ের পর কিভাবে ওর দিকে ভালোবাসা নিয়ে তাকাবো? ও এখন অন্য কারো।

    নাহিদের উত্তরে নিশাত বেশ চুপসে গেলো। রুম্পার দিকে অন্যরকমভাবে তাকাতো। কিভাবে তাকাতো? রুম্পার দিকে যেভাবে তাকাতো ওভাবেই কি তার দিকে তাকায়? নাকি সেই জায়গাটা এখনো নাহিদের মনে পায়নি সে? এসব ভাবতে ভাবতেই মুখটা কালো হয়ে এলো নিশাতের। কেনো নাহিদ ওভাবে তাকাবেনা ওর দিকে? রুম্পা যতখানি ভালোবাসা পেয়েছে ততখানি ভালো ওকেও বাসতে হবে। ঐ ভালোবাসা নিশাতের চাই-ই চাই।

    ২২

    নাহিদদের বাসার ড্রইংরুমে গোল হয়ে বসে আছে নিম্মি, ঈষিতা, নিঝুম আর তাদের বাসার কাজের লোক দুটো। পিঠা বানাচ্ছে তারা। মোটা রুটি বেলে তাতে হরেক রকম নকশা কেটে যাচ্ছে। সোফায় শুয়ে শুয়ে ওদের সাথে গল্প করছে নিশাত। নিজের বেডরুমে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো নাহিদ। একটানা বসে কাজ করতে করতে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে তার। রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে একটু হাঁটাহাঁটির জন্য। ড্রইংরুমে আসতেই দেখতে পেলো সবাই কাজ করছে আর নিশাত আয়েশ করে শুয়ে আছে।

    — তুমি এখানে শুয়ে আছো কেনো?

    –এমনি।

    –ওরা সবাই পিঠা বানাচ্ছে, তুমিও বানাও।

    — আমি পারি না।

    — কি পারো তাহলে?

    — আমি শুধু খেতে পারি।

    –নামো এক্ষুনি। ওদের সাথে বসে কাজে লাগো।

    –না না। ওকে এখানে বসতে হবে না। ও উপরেই শুয়ে থাকুক।

    — কি সমস্যা নিঝু?

    –ও পিঠা বানাতে পারে না।

    — পারে না বলে বসিয়ে রাখবি?

    — ভাইয়া, ও অলরেডি কয়েকটা পিঠা নষ্ট করেছে। পরে ওগুলো আবার আমাদের ঠিক করে বানাতে হয়েছে। এই হাবিজাবি ডিজাইনের পিঠা কে খাবে?

    — এভাবে বলো কেনো ঈষিতা? তুমিও তো নষ্ট করেই শিখেছো।

    — হ্যাঁ ঠিক আছে। কিন্তু অনেক পিঠা বানানো বাকি। এখন ওকে শিখানো সম্ভব না। অযথা সময় নষ্ট হবে। অন্য আরেকদিন শিখাবো।

    — তোমাদের শিখাতে হবে না। আমিই শিখাবো। এই কুসুম এই রুটিটা আমাকে দে।

    হাতের তালু এগিয়ে দিলো নাহিদ। মোটা রুটিটা তালুর উপর নিয়ে নিশাতকে বললো,

    — এ্যাই, উঠো। কিচেনে গিয়ে স্টিলের বড় প্লেট আনো। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসো। আমি আসছি। নিঝু, তোর সামনের ঐ বড় খেজুর কাঁটাটা দে তো।

    .

    সোফা থেকে নেমে একপ্রকার লাফাতে লাফাতে রান্নাঘরে পৌঁছালো নিশাত। বেছে বেছে সবচেয়ে বড় চ্যাপ্টা ধাঁচের স্টিলের প্লেটটা নিয়ে টেবিলে এসে বসলো। নাহিদ আজ ওকে পিঠা বানানো শিখাবে। খুবই আনন্দের বিষয়। এই মুহূর্তের একটা ছবি তুলে রাখলে দারুন হতো! পাশেই চেয়ার টেনে বসে পড়লো নাহিদ। খেজুর কাঁটা দিয়ে রুটি থেকে বিভিন্ন আকারের পিঠা কেটে আলাদা করছে সে। একটা পিঠা নিয়ে নিশাতের প্লেটে দিয়ে বললো, “নাও, নকশা কাটো। যা মনে আসে তাই কাটো।”

    .

    দারুন উৎসাহে পিঠায় কাজ করা শুরু করতেই চুলগুলো এসে মুখের এসে উপর পড়তে শুরু করলো। বারবার কানের পাশে চুল গুঁজেও ফায়দা হচ্ছে না। মুখের সামনে এসে পড়ছেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নাহিদ। নিশাতের পিছনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো আঁটসাঁট করে খোপা বেঁধে দিচ্ছে সে। ঘটনা নিঝুমের নজরে পড়তেই মুখ টিপে হাসতে হাসতে নিম্মিকে বললো,

    — ঐ দ্যাখ, পিঠা বানানোর বাহানায় ওর চুল বেঁধে দিচ্ছে।

    নিঝুমের কথা শুনে সাথে সাথেই পিছন ফিরে তাকালো নিম্মি আর ঈষিতা। খুব মনোযোগ দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দেখেই ঘাড় ফিরিয়ে নিলো ঈষিতা। নিঝুমকে বললো,

    –দুই ভাইয়ের মধ্যে এত পার্থক্য কেনো?

    — প্লিজ আমার ভাইটার বদনাম নিয়ে বসে যেও না তো।

    –আসলেই তো! কি দুর্দান্ত ঘটনা হচ্ছে চোখের সামনে। অথচ তুমি পড়ে আছো ছোট ভাইয়ার বদনাম নিয়ে।

    — আমি এখনও কিছু বলাই শুরু করলাম না অথচ দুই বোন মিলে আমাকে উল্টা শাসাচ্ছো। তোমরাই বলো এতদিনে আজ পর্যন্ত দেখেছো তোমার ভাই আমার চুল বেঁধে দিয়েছে?

    — ও না পারলে বাঁধবে কিভাবে?

    –পারে না কেনো?

    –ওকে শিখানোর মত কেউ ছিলো না।

    — নাহিদ ভাই শিখলো কিভাবে? আম্মা শিখিয়েছে?

    –আম্মা শিখাবে কেনো? রুম্পা শিখিয়েছে। শোনো, এত হাহাকার করো না তো। ছোট ভাই জীবনে আর কোনো প্রেম করেনি। তোমার সাথে প্রেম করে তোমাকেই বিয়ে করেছে। তুমি ওকে চুল বাঁধা শিখাতে পারোনি সেটা তোমার ব্যর্থতা।

    –আসুক আজকে। ওকে দিয়ে চুল বাঁধিয়েই ছাড়বো।

    .

    নিশাতের চুল খোপা করে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলো নাহিদ। ঐপাশ থেকে দরজায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ছেলেকে দেখছিলেন শালুক। কি একটা কাজে ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন তিনি। ওদের দুজনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন সেখানেই। ক্রমশ দুজন কাছাকাছি আসছে। এটাই তো চাচ্ছিলেন তিনি। দুজন কাছাকাছি আসবে, ভালোবাসা হবে আর তারপর বিয়ে। তার ছেলের জীবনটা এবার গুছিয়ে আসছে। কতগুলো বছর যাবৎ এই ছেলেকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তায় রাত দিন কাটাতে হয়েছে সে হিসেব তো ছেলের জানা নেই। সন্তানেরা সে হিসেব রাখেও না। তবুও নাহিদকে তিনি ভালোবাসেন। সব সন্তানের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তার কোল আলো করে তো এই নাহিদই প্রথম এসেছিলো। তার মুখেই তো প্ৰথম মা ডাক শুনেছিলো। এসব স্মৃতির কাছে ছেলের অবহেলা তার খুব তুচ্ছ মনে হয়। নাহিদের অবহেলা তার ভালোবাসায় নূন্যতম প্রভাব ফেলতে পারে না। বরাবরই মনে প্রাণে ছেলের সুখ চান। পরীর মত কাওকে ছেলের জন্য চান যাকে পেয়ে ছেলে সুখী হবে। ছেলে তার পরী নিজেই খুঁজে নিয়েছে। এবার শুধু আজীবনের জন্য একই সুতোয় ওদের দুজনকে বেঁধে দেয়া বাকি। এই কাজটা হয়ে গেলে শালুকের কাঁধ থেকে বিশাল পাথরের বোঝা নামবে।

    — দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখো আম্মা? আবার মুচকি মুচকি হাসছো! নিশাতের পিঠা বানানো দেখো?

    ছেলের কথায় সুখচিন্তা থেকে বেরিয়ে এলেন শালুক। হাসতে হাসতে বললেন,

    — হো। ওর পিঠা বানানো দেখি।

    — ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এখানে বসে দেখো। আসো।

    এগিয়ে এসে নিশাতের অন্য পাশে বসলেন শালুক। নিশাত হতাশ কণ্ঠে শালুককে বললো,

    — আন্টি, আপনি আমার পিঠার সাইজ দেখে হাসছেন তাই না?

    –নাহ্। তোমার পিঠা দেখে হাসতে যাবো কেন?

    –সুন্দর হচ্ছে না তো।

    –এত বুঝো কেনো নিশু? তোমাকে তো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তাই না?

    –আরে শুনো, ভুলভাল নকশা আঁকলেও সমস্যা নাই। ঘরের মানুষই তো খাবে।

    –তোমার পিঠাগুলো আমিই খাবো। বাসার অন্য কাউকে দিবো না। ঠিক আছে? নিশ্চিন্ত হয়ে কাজ করো। আর শোনো এগুলো তুমি ভাজবে। সিরায় ডোবাবে। তারপর আমাকে সার্ভ করবে।

    –আচ্ছা।

    — পুড়ে গেলেও ভয়ের কিছু নেই। এগুলো সব আমার পেটে যাবে। আমি কাঁচা পোড়া সব খেতে পারি।

    আহ্লাদে গদগদ হয়ে প্রশস্ত হাসি দিলো নিশাত। হাসির মাঝে পরিতৃপ্তি উপস্থিত। আহ্লাদী কন্ঠে বললো,

    — জানেন আমি কাজ পারি না। কাজ করতে গেলে এটা সেটা নষ্ট করে ফেলি। এজন্য আম্মু আমাকে বকে। আপুও বকে। আমাকে রান্নাঘরে দেখলে তাড়িয়ে দেয়। আপনি খুব ভালো। আমি নষ্ট করবো জেনেও আপনি আমাকে করতে দিয়েছেন। আবার আমার নষ্ট করা জিনিসটাই খাবেন বলে আমাকে সাহস ও দিচ্ছেন। আপু আর আম্মু একদম আপনার মত না।

    ড্রইংরুম থেকে ঈষিতা উঁচু স্বরে বললো,

    — হ্যাঁ, হ্যাঁ…. আপু আর আম্মু তো এখন খারাপ হবোই। আপু আর আম্মুর চেয়ে বেশি আহ্লাদ করার জন্য অন্য কাউকে পেয়ে গেছো তো তুমি।

    ২৩

    রাত তিনটা পয়ত্রিশ। মেঘনা নদীর পাড়। নদীর ঢেউ আঁছড়ে পড়ছে বালুর ঘাটে। তীরে এসে জটলা বেঁধেছে অসংখ্য কচুরিপানা। এই ঘাটে নৌকা এসে ভিড়ে। মেঘহীন আকাশে চাঁদ আর তারার খেলা। নদীর পাড়ের শো শো শব্দ তোলা শীতল বাতাসে মাতাল হওয়ার উপক্রম। বালুর উপর পাশাপাশি বসে আছে নাহিদ আর নিশাত। একটু দূরেই বসে আছে ঈষিতা আর ফাহাদ। আজ আসার আগে ফাহাদকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে নাহিদ। সে কোনোভাবেই ঘুম ফেলে আসতে চাচ্ছিলো না। বাসার সবাই মিলে এমনভাবে চেপে ধরলো, শেষ পর্যন্ত আর না করতে পারলো না। একটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের পাশের হোটেলে গিয়েছিলো ওরা চারজন। চা আর পরোটা দিয়ে আলুর দম খেয়ে এসেছে সেই হোটেল থেকে। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো এই ঘাটে। চুপ করে আছে নিশাত। চুপচাপ বসে বাতাসের শব্দ শুনছে সে। চাঁদের রূপালি আলোয় বালুগুলো চকচক করছে। সামনেই বিশাল নদীটা আপন গতিতে ঢেউ তুলে ওদের দিকে আছড়ে পড়ছে। বাতাস এসে ওর চুলগুলো বারবার এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। পাশেই বসে আছে প্রিয় মানুষটা। উমমমম… শুধু প্ৰিয় না। সবচেয়ে প্রিয়। জীবনে সুখী হওয়ার জন্য কি এতটুকু যথেষ্ট নয়? প্রাণভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য এমন একটা মুহূর্তের চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কি হতে পারে?

    — নিশু?

    — হুম?

    –আগে কখনো রাতের বেলা নদীর ঘাটে এসেছো?

    — উহুম।

    –এই প্রথম এলে?

    — হুম।

    –আমার কি মনে হয় জানো?

    — কি?

    —জীবনে ছোটখাটো সুখগুলোও যে অনেকসময় স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয় সেটা তুমি জানো না। তুমি কখনো এই সুখগুলো উপভোগই করো নি।

    –হুম। তা ঠিক। ঢাকায় তো এমন জায়গা নেই ঘুরে বেড়ানোর। বেড়াতে যাওয়া মানে ঐ কোনো এক রেস্টুরেন্টে সেজেগুজে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করা। সেল্ফি তোলা। এইতো। আর দূরে তো সবসময় যাওয়া সম্ভব না।

    — নিশু, ছোট সুখগুলো উপভোগ করার জন্য বাসার বাহিরে খোলা হাওয়ায় দূরে কোথাও ঘুরে বেড়াতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এই যেমন ধরো, হিম ঠান্ডায় সবাই সকালে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। এর ব্যতিক্রম করে দেখেছো কখনো? শীতের সকালের সূর্য যখন একটু করে উঁকি দেয়া শুরু করে, সেই সময়টা উপভোগ করেছো কখনো? কুয়াশা ভেদ করে একটু একটু করে আলো ছড়াতে থাকার সময়টাতে বাসার ছাদে বসে এককাপ ধোঁয়া উঠা লাল চা খেয়ে দেখো। গ্রীষ্মের বিকেলে যখন দখিনা হাওয়ার আনাগোনা চলে সেই হাওয়ায় কখনো ঘুড়ি উড়িয়ে দেখো। তোমার ঘুড়িটা যখন আকাশে উড়তে থাকবে তখন মনে হবে আকাশে ঘুড়ি না, তোমার মন উড়ে বেড়াচ্ছে। রাতের বেলা ঢাকা দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। বাসার ছাদে উঠে মাঝেমধ্যে একা বসে থাকলেও তো পারো।

    –একা বসে থাকবো এত রাতে?

    — কেনো, সমস্যা কি?

    –একা এতরাতে ছাদে উঠবো কিভাবে? সাথে কেউ থাকলে যেতাম।

    — বড় হয়েছো নিশু। কিন্তু তুমি এখনও চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার করো। তোমার বয়সী মেয়েরা অনেক বেশি ইনডিপেন্ডেন্ট। তুমি ছোটখাটো অনেক বিষয়ে অন্যের উপর নির্ভরশীল যেটা একদম উচিত না। নিজে নিজে করতে শিখো। বিশেষ করে নিজের সুখের চাবি তুমি অন্যের হাতে রাখতে পছন্দ করো। কেনো নিশু? সুখের চাবি তো নিজের হাতেও রাখা যায় তাই না? অন্যের হাতে নিজের সুখের চাবি দিয়ে দেয়া মানে সুখ আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলা। যদি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চাও তো নিজের সুখটাকে নিজের কাছে রাখতে শিখো। দেখবে কষ্টগুলো সামলানো খুব সহজ হয়ে যাবে। কোনো ঘটনা খুব সহজে তোমাকে পীড়া দিতে পারবে না। নিজেকে সময় দাও। প্রতিদিন হাজার কাজের ভীড়ে, হাজার মানুষের ভীড় থেকে আলাদা হয়ে নিজের জন্য একা একটু সময় বের করো। নিজের মত করে কাটাও সেই সময়টুকু। শাড়ী পরে সেজেগুজে বসে থাকতে পারো, ঘুড়ি উড়াতে পারো, একা কোথাও বসে ফুচকা খেতে পারো, নিজের পছন্দমত কোনো মেন্যু রান্না করে খেতে পারো। নিজেকে খুশি রাখার জন্য অনেক কিছু আছে নিশু। তোমার পাশে কারো থাকতেই হবে কিংবা তোমার সুখের চাবি অন্য কারো হাতে দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। একাও সুখে থাকা যায়। শুধু একটু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও। ব্যস…

    –একটা কথা বলি?

    — হুম।

    –আপনার মাঝে কি যেনো একটা আছে। খুব কঠিন বিষয়গুলোও কেমন সহজ করে ফেলেন। এইতো তিন চারদিন আগ পর্যন্তও আবীর নামক অধ্যায়টা ভুলে যাওয়া আমার জন্য খুব কঠিন ছিলো। মনে হতো এটা সম্ভব না। অথচ সেই আমি এই অধ্যায় ভুলে গেলাম। আপনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার জন্য অন্যরকম এক অনুভূতি ছিলো। মুহূর্তগুলো সুন্দর ছিলো। অসম্ভব সুন্দর। প্রতিটা মুহূর্তের প্রেমে পড়েছি আমি। সম্পূর্ণ নতুন কিছু অনুভব করেছি আমি। মনে হচ্ছে নতুন কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। এই ভালোবাসা আমার পুরাতন ভালোবাসাকে ভুলিয়ে দিয়েছে।

    নাহিদের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বললো নিশাত। চোখের ভাষায় অব্যক্ত অনেক কিছু নাহিদকে বুঝাতে চাইছে সে। নাহিদ কি দেখতে পাচ্ছে ওর চোখজোড়া? চোখের ভাষা কি বুঝতে পারছে সে?

    — নতুন করে কাকে ভালোবেসেছো জানো? তুমি তোমার নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছো। জীবনে ভালোবাসা বলতে, সুখ বলতে শুধু আবীরকেই চিনেছো। কম বয়সে প্রেমের সাইড এফেক্ট এটা। নিজেকে জানার আগেই অন্যের প্রেমে পড়লে এমনই হয়। নিজেকে জানার, ভালোবাসার সুযোগ থাকে না। তুমি ছোট সুখের অভাবে ভুগছিলে যেটা আগে তুমি আবীরের কাছে খুঁজে পেতে। আবীর ছাড়াও যে আরো অনেক সুখের উপায় আছে তা তুমি জানতে না। তোমাকে আমি এত সময় কেনো দেই জানো?

    — কেনো?

    –যাতে তুমি ছোট সুখগুলো চিনতে পারো। সেগুলো উপভোগ করতে পারো। এই কষ্ট থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে পারো। ভবিষ্যতে আর কোনো কষ্ট যাতে তোমাকে স্পর্শ না করতে পারে, কষ্ট থেকে সহজে যাতে বের হয়ে আসতে পারো সেজন্যই তোমাকে নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াই। আবারও বলছি, জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখো। আমি চাই তুমি সবসময় হাসিখুশি থাকো। আর কয়দিন পর আমি চলে যাবো। সেখানে গিয়েও তোমার সাথে আমার রেগুলার কথা হবে। আমি যেনো কখনো না শুনি নিশুর মন খারাপ কিংবা নিশু ডিপ্রেসড। নিশু ভালো আছে, হাসিখুশি আছে এটাই শুনতে চাই।

    মন্ত্র মুগ্ধের মত নাহিদের কথা শুনছে সে। মানুষটা সত্যিই ওকে ভালোবাসে। তাইতো সুখে থাকার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অন্য দশটা পুরুষের মত ওর সুখের চাবি নিজের মুঠোবন্দি করতে চায়নি। নাহিদ আলাদা, সম্পূর্ণ আলাদা। এমন মানুষের জীবনসঙ্গী হতেও ভাগ্যের জোর লাগে। হয়তো কোনো পূণ্যের জোরে এই মানুষটা ওর ভাগ্যে এসেছে, ওকে ভালোবেসেছে। তবে মানুষটা একটু বোকাও বটে। ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারলো না। লোকটা বুঝতেই পারলো না সেই নতুন ভালোবাসার মানুষটা তো সে নিজেই। আর নয়তো হতে পারে সে খুব চতুর। হয়তোবা চাচ্ছে সে নিজ থেকে তাকে ভালোবাসার কথা জানাক।

    — নিশাত, আকাশে আলো ছড়াচ্ছে। ভোর হয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখো আকাশটা। কি সুন্দর লাগছে!

    আকাশের দিকে তাকানোর ইচ্ছে নেই নিশাতের। নাহিদের দিকেই তাকিয়ে আছে সে। মানুষটা মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখছে। নিশাতের খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর হাতটা আঁকড়ে ধরে বলতে,

    “আপনাকে মনের ডোরে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে হয় জনমভর।”

    ২৪

    আজ দোকানে যায়নি ফাহাদ। ভোরে সেখান থেকে ফিরে এসে দুপুর তিনটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। এরপর ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে নিজের ঘরে এসে বসেছে। পাশেই শুয়ে আছে ঈষিতা। মিনমিনে কণ্ঠে ফাহাদ ঈষিতাকে জিজ্ঞেস করলো,

    — সত্যিই কি ওদের মধ্যে কিছু চলছে?

    — তোমার কি এখনো কোনো সন্দেহ আছে ফাহাদ? গতরাত তো পুরোটাই কাটিয়ে দিলে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে। কখনো তো আমাকে নিয়ে সারারাত ঘুরে বেড়াওনি। গতকাল যাও নিয়ে গেলাম জোর করে, পুরো সময় তো ওদের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলে। আমার সময়টাই মাটি। কত ভালো কিছু মুহূর্ত আমরা কাটাতে পারতাম। আর তুমি কিনা….. তুমি খুবই বিরক্তিকর।

    — আর কিছু?

    রাগী চোখে ফাহাদের দিকে তাকালো ঈষিতা। ফাহাদ হাসতে হাসতে বললো, – আমাকে বকার একটা সুযোগ শুধু তোমার চাই। ব্যস, অমনি শুরু করে দাও বকা। আরে মেয়ে, আমাদের দু’জনের ঘুরে বেড়ানোর চেয়েও বড় ব্যাপার ছিলো ওদের দু’জনের মধ্যে কি চলছে সেটা বের করা।

    — এটা নতুন করে বের করার কি ছিলো? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি।

    — হ্যাঁ বলেছো। কিন্তু এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। এটা কিভাবে সম্ভব ঈষিতা? এতখানি বয়সের পার্থক্যে দুজন দুজনের সাথে কিভাবে সম্পর্কে জড়াতে পারে?

    নিশাতের তরফ থেকে এ ব্যাপারে আপত্তি নাও থাকতে পারে। কিন্তু নাহিদ ভাই? ও এই কাজ করবে এটা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

    — নিজের চোখে দেখে এসেছো। তোমাকে নতুন করে আমার আর কিছু বলার নেই।

    –হ্যাঁ দেখেছি তো নিজের চোখেই। দেখে যা বুঝলাম আসলেই কিছু চলছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গিয়ে আমার বিশ্বাস হয়েও হচ্ছে না। নাহিদ ভাইকে দিয়ে এটা কিভাবে সম্ভব? এমন সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলো ও? শুধু বয়সের ব্যাপারটাই না। আরো অনেক কথা আছে।

    — যেমন?

    –নাহিদ ভাই সবসময়ই ম্যাচিউরড মেয়ে পছন্দ করে। নিশাত পুরোপুরি ইমম্যাচিউরড। রুম্পা ভাইয়ার খুব বেশি যত্ন নিতো। এজন্যই ভাইয়া ওর প্রতি এত দুর্বল ছিলো। নিশাত যত্ন আত্তির কিছুই বুঝে না। উল্টা ওর যত্নই আরেকজনের করা লাগে। রুম্পার মত ও আজ পর্যন্ত কাওকে খুঁজে পায়নি, তাই কারো সাথে আর সম্পর্কেও জড়ায়নি। সেখানে আমার ভাই এমন বিপরীত চরিত্রের একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াবে তাও আবার এত বয়সে এত ছোট! এটা আসলেই অবিশ্বাস্য লাগছে।

    — উনি কি তোমাকে বলেছে রুম্পার মত কাউকে পায়নি বলে উনি সম্পর্কে জড়ায়নি?

    — না।

    –তাহলে বলছো কেনো?

    — খুব সাধারণ যুক্তি। রুম্পার মত কাউকে পায়নি বলেই তো সেই জায়গা আর কাউকে দেয়নি। আর আমার ভাই কেমন মেয়ে পছন্দ করে তা তো আমি জানি। নিশাত সম্পূর্ণই নাহিদ ভাইয়ের পছন্দের বিপরীত স্বভাবের।

    –মনের উপর তো জোর হয় না তাই না ফাহাদ? আমি যেমন হাজবেন্ড চেয়েছি তেমন তো আমি পাইনি। তবুও তো তোমাকে আমি ভালোবাসি। বিয়ের আগেও তুমি এমনই ছিলে। তখনও তোমাকে ভালোবাসতাম। সব বুঝে শুনেই তোমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। অনেক সময় পছন্দের চরিত্রের ভিন্ন মানুষটাকেও আমরা ভালোবেসে ফেলি। এমন হয়। অস্বাভাবিক কিছু না।

    –কার কাছে কেমন লাগছে জানি না। তবে সম্পর্কটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। এটা নিয়ে নিশাত আর নাহিদ ভাই দুজনকেই অনেক কথা শুনতে হবে। নিশাতের বান্ধবীরা ওকে বলবে বুড়ো বেটা বিয়ে করেছিস। আর ভাইয়ের বন্ধুরা বলবে কচি বাচ্চা বিয়ে করেছিস। সাথে আত্মীয়স্বজন তো আছেই।

    –এত কথা ভাবলে কি চলে ফাহাদ?

    –ভাবতে হয়। এই কথাগুলোই একটা সময় হাজবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্কে বাজে প্রভাব ফেলে।

    –তোমার ভাই বোকা না যে মানুষের কথায় নাচবে। আর নিশাত উল্টাপাল্টা কিছু করলে ভাইয়াই সামলে নিবে।

    — তুমি কি আমার ভাইকে খুব চতুর ভাবো?

    আমি বলছি না উনি চতুর। কিন্তু যথেষ্ট ম্যাচিউরড। অন্যের কথায় কান না দেয়ার জ্ঞানটুকু অন্তত আছে।

    মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ফাহাদ। ঈষিতা বুঝে পেলো না ফাহাদের হাসির অর্থ। আগ বাড়িয়ে এখন জিজ্ঞেসও করতে ইচ্ছে হচ্ছে না এই হাসির মানে। ওকে জিজ্ঞেস করা মানে তর্ক আরো বাড়বে, যেটা করার নূন্যতম শখ ঈষিতার আপাতত নেই। ফাহাদ এই সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করতে থাকুক। সময় হলে আপনাআপনিই সন্দেহ দূর হবে। হাতে অনেক কাজ। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ছয়টার দিকে রওয়ানা হবে মার্কেটের দিকে। গয়নাগুলো এখনও কেনা বাকী। নতুন শাড়ীগুলোর ব্লাউজও বানাতে দিয়ে আসতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো ঈষিতা।

    .

    দখিনা বাতাস ছুটে চলছে আপন গতিতে। উত্তরের আকাশে দুটো ঘুড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা লাল আরেকটা বেগুনি। দুপুরের দিকে বাজার থেকে ঘুড়ি দুটো কিনে এনেছে নাহিদ। ছাদের উপর নাটাই হাতে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত আর নিম্মি। ঘুড়ি উড়িয়ে অভ্যাস আছে নিম্মির। কোনো ঝামেলা ছাড়াই মন খুশিমত ঘুড়ি উড়িয়ে যাচ্ছে সে। আর নিশাত! ঘুড়ি উড়ানোর চেয়ে বেশি মন পড়ে আছে ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে মানুষটার দিকে। নিশাতের পিছনে দাঁড়িয়ে নাটাই ধরে রেখেছে সে। ঘুড়ি আসলে নাহিদই উড়াচ্ছে। নিশাত শুধু নাটাইটা দায়সাড়াভাবে ধরে রেখেছে। মানুষটার গায়ের ঘ্রান নিচ্ছে সে প্রাণভরে। মানুষটার গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে মাথার কাছে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে তাই এমন হচ্ছে তার। মাতাল হয়ে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম! মনে হচ্ছে যেনো এখুনি শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে নাহিদের উপর পড়ে যাবে সে। পিছন থেকে ধমকে উঠলো নাহিদ।

    — কি করছো নিশু? মনোযোগ কোথায় তোমার?

    –আপনার দিকে।

    — মানে?

    — এইতো দেখছি আপনি কিভাবে ঘুড়ি উড়ান।

    –তুমি তো কোনো চেষ্টাই করছো না। নাটাইটা কোনোমতে ধরে রেখেছো শুধু।

    — পাশের বাড়ির লোকগুলো এই জীবনে শুধরাবে না।

    বিরক্ত ভরা কন্ঠে বললো নিম্মি। ঘুড়ি থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে নিম্মির দিকে তাকালো নাহিদ।

    — কি হয়েছে?

    –দেখো না ফুফুর মেজো মেয়ে আর ছোট ছেলের বউটা তোমাদের দুজনকে কিভাবে দেখছে!

    এবার নিশাতও তাকালো পাশের বাড়ির ছাদে। খুব উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

    –মেজো মেয়ে কোনটা?

    — ঐ তো ছাই রঙের জামা পড়াটা।

    –এটাই রুম্পা?

    –না। এটা রুম্পার আগেরজন।

    — রুম্পা আসে না এই বাড়িতে?

    –আসে তো। এখনও তো বাড়িতেই আছে। আজ সকালে কাপড় নাড়তে এসে

    –দেখেছি ও ছাদে হেঁটে হেঁটে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে।

    — এ্যাই বাদ এসব আজাইরা কথা। নিশু ঘুড়ির দিকে ফোকাস করো।

    — আচ্ছা উনারা আমাদের এভাবে দেখছে কেনো?

    –তোমার সাথে ঘুড়ি উড়াচ্ছি এটা দেখতে ওদের কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে তাই আমাদের দেখছে।

    — ইন্টারেস্টিং কেনো লাগছে?

    –আমাদের দুজনকে সিনেমার হিরো হিরোইনদের মত লাগছে তাই।

    — সত্যি! নিম্মি সত্যিই হিরো হিরোইন মনে হচ্ছে আমাদের? আমাদের একটা ছবি তুলে দাও না জলদি করে। দেখি কেমন লাগছে আমাদের।

    সশব্দে হেসে উঠলো নিম্মি আর নাহিদ।

    নিশাতের মাথায় আলতো ধাক্কা দিয়ে নাহিদ বললো,

    — ইশশশ! ছবি তুলে দাও না! গাধা একটা! হিরো হিরোইনদের মত কেনো লাগবে আমাদেরকে?

    –আপনিই তো বললেন।

    –যা বলি তাই বিশ্বাস করতে হবে?

    — বিশ্বাস করবো না?

    — না, করবে না। মজা বুঝো না কেনো তুমি?

    — তাহলে ওরা ওভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?

    –বহুবছর পর দেশে ফিরেছি। তাই আমাকে দেখলেই তাকিয়ে থাকে। ওদের বাড়ির মেয়ের সাথে এ্যাফেয়ার ছিলো আমার। এজন্য আমার প্রতি ইন্টারেস্ট একটু বেশিই। তার উপর আজকাল তোমার সাথে আমাকে বেশি ঘুরতে দেখা যায়। এখন আবার ঘুড়ি উড়াচ্ছি। ওদের মনে তোমাকে নিয়ে এক হাজার প্রশ্ন ঘুরাটা খুব স্বাভাবিক। প্রশ্নের উত্তর তো আর আমাদের জিজ্ঞেস করতে পারবে না। তাই নিজেরাই আমাদের দেখে প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টা করছে। – কি উত্তর বের করতে পারে ওরা?

    — নিশুউউউ, আর কোনো অদ্ভুত প্রশ্ন না। ঘুড়ির দিকে তাকাও।

    — ভাইয়া, কয়টা বাজে? ফোনে চেক করো তো।

    — কেনো?

    –মার্কেটে যাবো তো আজকে।

    — কি কিনবি?

    –গতপরশু যে শাড়ীগুলো কিনে দিলে ওগুলোর ব্লাউজ পিস কিনে দর্জির কাছে দিয়ে আসবো। জুয়েলারীও কিনবো।

    —ওহ হ্যাঁ! জুয়েলারী তো কিনা হয়নি এখনো। ওগুলো তো আমার কিনে দেয়ার কথা ছিলো। আচ্ছা তোরা যা, আমিও আসছি। ডিজাইনগুলো তো আমার কাছে। কারিগরকে আমি বুঝিয়ে দিয়ে আসবো।

    নিশু, কাল আবার ঘুড়ি উড়াবো। নিচে গিয়ে রেডি হও। যাও।

    নিশাতের হাত থেকে নাটাইটা নিয়ে সুতা গুটিয়ে নিচ্ছে নাহিদ। নিশাত নিচে নেমে আসার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে ডাকলো সে,

    — নিশাত…

    থমকে দাঁড়ালো নিশাত। ঘাড় ফিরিয়ে বললো,

    — হুম?

    –লাল আর বেগুনী রঙের চুড়ি আছে তোমার?

    –লাল আছে। বেগুনী নেই।

    –কাঁচের চুড়ি?

    –হ্যাঁ লালগুলো কাঁচের।

    –নিয়ে এসেছো এখানে?

    –উহুম।

    –আচ্ছা তাহলে তোমার জন্য চুড়িও কিনতে হবে।

    — চুড়ি কেনো কিনবো?

    — শাড়ীর সাথে পরার জন্য।

    কোন শাড়ী?

    –সেদিন যে কিনলাম।

    –আমার জন্য তো শাড়ী নেইনি।

    — আমি নিয়েছি।

    বোকা বোকা চেহারা নিয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে নিশাত। পাশ থেকে নিম্মি বললো,

    — লাল আর বেগুনী শাড়ী রঙের শাড়ীগুলো ভাইয়া তোমার জন্য নিয়েছে।

    –কিন্তু ওগুলো তো উনার বান্ধবীর জন্য নিচ্ছে বললো।

    — হ্যাঁ বান্ধবীর জন্যই তো। তুমি তো আমার বান্ধবীই হও। ছোট্ট বান্ধবী।

    সামনের সব কয়টা দাঁত বের করে হাসছে নিশাত। নাহিদের মুখে ছোট্ট বান্ধবী ডাকটা কি সুন্দর শোনাচ্ছে!

    — তুমি শাড়ী নিতে চাচ্ছিলেনা তাই এ কথা বলেছি।

    –আমি তো শাড়ী পরে হাঁটতে পারি না। কিভাবে পরবো?

    –এমন করো কেনো নিশু? ভাইয়া শখ করে তোমার জন্য শাড়ীগুলো কিনেছে। ভাইয়া ভালোবেসে তোমাকে এই প্রথম কিছু দিলো। একটু চেষ্টা করলেই পারবে। দরকার পড়লে অনুষ্ঠানের আগে তোমাকে আমরা শাড়ী পরিয়ে প্র্যাকটিস করাবো। তাহলেই তো হলো।

    — আমি আজই ফিরে এসে শাড়ী পরবো। আপুকে বলবো আমাকে পরিয়ে দিতে। কথাগুলো বলেই দৌঁড়ে নিচে নেমে এলো নিশাত। নাহিদ ওর জন্য ভালোবেসে শাড়ী কিনেছে কথাটা ভাবতেই অজানা এক খুশি ভর করছে ওর উপর। এই খুশীর কোনো সংজ্ঞা আপাতত তার জানা নেই। ঠিক কতখানি খুশি লাগছে তার পরিমানটুকুও জানা নেই। অতিরিক্ত খুশিতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ছুটে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে নাহিদকে,

    –শুনতে পাচ্ছেন? আপনাকে আমার বিশাল সমুদ্র মনে হয়। সুখের সমুদ্র। যে সমুদ্রে আমি ডুবি-ভাসি সারাবেলা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম
    Next Article রুদ্র – খাদিজা মিম

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Our Picks

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    অপেক্ষবাদের অ, আ, ক, খ – বারট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }