Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প450 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    দোভাষী পুথির ভাষা

    ০১.

    ছাপাখানা প্রবর্তিত হবার পূর্বেকার হস্তলিখিত পুস্তকমাত্রেই পুথি নামে পরিচিত ছিল। পুথি শব্দ সংস্কৃত পুস্তিকা শব্দজাত। কাজেই পুথি বলতে প্রাচীন অমুদ্রিত গ্রন্থাবলীকেই বোঝানো উচিত। কিন্তু অধুনা কেউ কেউ আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা-হিন্দুস্তানী মিশ্রিত ভাষায় রচিত দোভাষী (দ্বিভাষী) কাব্যগুলোকেই বিশেষ অর্থে পুথি নামে অভিহিত করেন। সেজন্যে আমরাও পুথি সাহিত্য অর্থে দোভাষী পুথিই বুঝব।

    দোভাষী পুথির ভাষা সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটু ভূমিকা প্রয়োজন। আর্য-পূর্ব যুগে বাঙলা দেশে বিভিন্ন গোত্রের যে-সব লোক বাস করত, তাদের স্ব স্ব ভাষা ছিল বা সর্বজনীন একটি মিশ্রভাষায় (অস্টিক-দ্রাবিড়-মোঙ্গল ও অন্যান্য অনার্য ভাষার মিশ্রণজাত) তারা কথা বলত–এটা আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ খ্রীস্টীয় আট শতকে রচিত আমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প নামক সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, অসুরানাং ভবেৎ বাঁচা গৌড় পুড্রোদভবা সদা।–অসুরেরা গৌড় ও পুণ্ড্রবর্ধন জাত ভাষা ব্যবহার করে।

    বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম নিয়ে যখন ধর্মপ্রচারক ও শাসক হিসেবে মুখ্যত আর্য সংস্কৃতিবাহী ও আর্যভাষা (প্রাকৃত)-ভাষী একদল লোক বাঙলা দেশে তাদের প্রভাব বিস্তার করলেন, তখন এদেশীয় প্রাচীন অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত উন্নত আর্যধর্ম, দর্শন, ভাষা ও সংস্কৃতি বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করে নিল, এও আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ, সবল ও উন্নত শাসকজাতির কাছে দুর্বল, বিজিত ও শাসিত জাতির সংস্কৃতির পরাজয় ও বশ্যতা চিরকালীন ঐতিহাসিক সত্য ব্যাপার।

    বাঙলা দেশে যে-আর্যভাষা প্রথম প্রবেশ করেছিল তা বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষা নয়–বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বাণীবাহক পালি বা প্রাকৃত। ভারতের নানাস্থানে যূরোপীয়দের হাতে দীক্ষিত ভারতীয়গণ যেমন ইংরেজিকে তাদের নিজেদের ভাষারূপে গ্রহণ করে; বাঙালিরাও তেমনি পালি প্রাকৃতকে মাতৃভাষারূপে বরণ করে। কারণ, তাদের নিজেদের কোনো লিখিত ভাষা ও সাহিত্য ছিল বলে কোনো প্রমাণ মেলে না। এখনো কোল, মুণ্ডা, কুকী ও নাগাদের কোনো বর্ণমালা বা লিখিত ভাষা নেই। কাজেই বাঙালিরা পালি-প্রাকৃতকেই গ্রহণ করে বলে বিশ্বাস করা চলে। সংস্কৃতের সঙ্গে তাদের পরিচয় হতে পারেনি।

    উক্ত পালি-প্রাকৃত ভাষায় তাদের নিজেদের ভাষার যেসব শব্দের প্রতিশব্দ পাওয়া যায়নি, অথবা পালি-প্রাকৃতের যেসব শব্দ তাদের কাছে শ্রুতিসুখকর বা প্রয়োজনীয় ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ বলে মনে হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে তারা নিজেদের শব্দসম্পদ বর্জন করেনি। ফলে আজো বাঙলা ভাষায় আমরা বহু দেশী তথা অপ্রাকৃত শব্দ পাচ্ছি। কালক্রমে যে আরো বহু শব্দ লুপ্ত হয়ে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই।

    তারপর বিদেশী মৌর্য ও গুপ্ত শাসনকালে এবং পাল রাজাদের আমলে কিছু কিছু সংস্কৃত শব্দ আমদানি হয়ে বাঙালির ভাষায় স্থায়ীভাবে ঠাই পেল। এরপর ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজাদের আমলে এদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চার ধুম পড়ে গেল। সে সময় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বাঙালির উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালির ভাষা সংস্কৃত শব্দসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।

    এরপর আসেন মুসলমান ধর্মপ্রচারক ও শাসকগণ। এসময় অনিবার্য কারণে বহু ফারসি, তুর্কী ও আরবি শব্দ ভাষায় স্থায়ী আসন লাভ করে।

    এ পর্যন্ত সাহিত্য সৃষ্টির কাজ চলেছে পদ্যে। পদ্য আর গদ্য ভাষায় পার্থক্য বিস্তর। পদ্যে অল্পকথায় স্বল্প শব্দে ও অস্পষ্ট অন্বয়ে কাজ চলে, কিন্তু গদ্যের বাঁধন শ্লথ হলে চলে না। এজন্যে আমরা মুসলমান আমলের দলিল-দস্তাবিজে, চিঠিপত্রে আরবি-ফারসি শব্দমিশ্রিত বাঙলাগদ্যের সাক্ষাৎ পাই। কারণ তখনো গদ্যে সাহিত্যসৃষ্টির প্রচেষ্টা চালু না হওয়ায়, বাঙলা ভাষায় গদ্য সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস কেউ করেনি। আর এ-কথা কে না স্বীকার করবে যে, সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস ছাড়া কোনো ভাষাই মার্জিত ও শালীন হয়ে উঠতে পারে না। কেননা মুখের বুলি চিরকাল অপূর্ণ ও ত্রুটিবহুল, তাকে লিপিবদ্ধ করতে হলে অনেককিছু যোগ করতে হয়–অনেক পরিশোধনের প্রয়োজন। কারণ শিক্ষিত ও ভাবুক লোকের ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে অনেক বেশি শব্দের প্রয়োজন যা মননহীন অশিক্ষিত লোকের ঘরোয়া বা ব্যবহারিক জীবনে কাজে আসে না। এজন্যেই ভাবুক, পণ্ডিত আর মূর্খ-লোকের ভাষায় পার্থক্য থাকে–একটা ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ, অপরটা বাক্যার্থ সর্বস্ব। এ কারণেই চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের পরেও আমরা প্রয়োজনের তাগিদে বহু সংস্কৃত শব্দ অবচেতনভাবে বাঙলা-ভাষায় ব্যবহার করেছি। চর্যাপদের পর থেকে ভারতচন্দ্র বা তৎপরবর্তীকাল পর্যন্ত মধ্যযুগীয় ধারার বাঙলাসাহিত্য সর্বাঙ্গে বহন করছে তার প্রমাণ।

    এ পর্যন্ত ক্বচিৎ সংস্কৃত-মিশ্রিত ভাষায় কাব্য রচনা করা সম্ভব ছিল, কিন্তু বাঙালি চিরকাল গদ্যভাষায় কথা বললেও গদ্য রচনা করতে গিয়ে দেখা গেল, শব্দসম্পদের প্রচুর অভাব রয়েছে। আরো রয়েছে শব্দের পারস্পরিক অন্বয়সাধক প্রত্যয় ও বিভক্তির অপ্রতুলতা। তাই য়ুরোপীয় মিশনারি ও বাঙালি পণ্ডিতগণ যখন ধর্মপ্রচারে, শাসনকার্যে ও ব্যবহারিক প্রয়োজনে বাঙলা গদ্য সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করলেন, তখন এ দুটো সমস্যা তাদের কাছে দেখা দেয় তীব্রভাবে।

    এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, দুনিয়ার কোনো লিখিতভাষা তথা সাহিত্যের ভাষা অকৃত্রিম নয়। বাঙলা পদ্যের ভাষাও অকৃত্রিম ছিল না; অর্থাৎ সাহিত্যের ভাষায় তথা লিখিত ভাষায় কোনো কালে, কোনো দেশে কেউ ঘরোয়া কথা বলেনি।

    আমাদের যে-চলিতভাষা বা কথ্যভাষায় সাহিত্য রচিত হয়, তাও কী অকৃত্রিম? কাজেই নিতান্ত প্রয়োজনে বাঙলায় কৃত্রিম গদ্য সৃষ্টি হল সাধুভাষা নামে।

    বাঙলা গদ্য সৃষ্টি করতে গিয়ে কেউ আরবি-ফারসি বা ইংরেজি ভাষার সাহায্য নেবে তা ভাবা অস্বাভাবিক নিশ্চয়ই। তাই কেরী-রামমোহন-মৃত্যুঞ্জয়-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন প্রভৃতি সবাই সংস্কৃতের আশ্রয় নিলেন। প্রাকৃতজাত বাঙলাকে জ্ঞাতিত্ব সূত্রে তার প্র-প্র-প্রমাতামহী সংস্কৃতের উত্তরাধিকারিণী দাঁড় করিয়ে তারা বাঙলা ব্যাকরণ ও শব্দসম্পদ সংস্কৃতানুগ করে তুললেন। এছাড়া ব্যবসাদারী ও অনভিজ্ঞ নূতন লেখকদের উপায়ই বা কী ছিল! বরং এরূপ না করে অন্য কোন পন্থা গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক হত। বস্তুত সে-যুগে সে-অবস্থায় সংস্কৃতের সাহায্য না নিয়ে বাঙলা গদ্যকে একটা সুষ্ঠু ও শালীন রূপদান করা ছিল অসম্ভব। সে-যুগের কথাই বা বলি কেন, এ-যুগে আমাদের সাহিত্যে ব্যবহৃত চলতি ভাষায়ও কী সংস্কৃত শব্দ বাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে? এ ব্যাপারে আমরা উড়িয়া ও আসামী ভাষার দিকে লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারব, সংস্কৃত শব্দ আমদানি কেরী মৃত্যুঞ্জয়-বিদ্যাসাগরের স্বেচ্ছাচারিতার ফল নয়! ভাষাকে সাবলীল করার জন্যে অপরিহার্য ছিল সংস্কৃত ভাষার সাহায্য। অনাত্মীয় আরবি-ফারসি-ইংরেজির চেয়ে রক্তসম্পর্কিত সংস্কৃতির সম্পদ আত্মস্থ করা যে সহজ ও শোভন হয়েছে তা কে অস্বীকার করতে পারে? এখানে স্মরণীয় যে, বাঙলা ভাষার আদিকাল থেকেই আমাদের পদ্যরচনায় প্রয়োজনমতো সংস্কৃত শব্দ গৃহীত হয়েছে। আজকের দিনে ইংরেজি শব্দের পরিভাষাও সংগৃহীত হচ্ছে সংস্কৃত থেকেই।

    কিন্তু সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ আর সংস্কৃত রীতির আমদানি যে এক কথা নয়, তা প্রথমদিককার লেখকগণ সহজে বুঝে উঠতে পারেননি। আমি Daily morning walk করি এতে অধিকাংশ শব্দ ইংরেজি হলেও এ বাঙলা; Daily he walks in the প্রভাত বাংলা মিশ্রিত হলেও যে ইংরেজি তা কোনো শিক্ষিতলোককে বুঝিয়ে বলতে হয় না।

    তাই ইংরেজদের প্রয়োজনে ফরমায়েশি গদ্য রচনা করতে গিয়ে পণ্ডিতগণ সংস্কৃত অভিধান ঘেঁটে শব্দ বের করে সংস্কৃত ব্যাকরণানুগ যে-গদ্য সৃষ্টি করলেন, তা সেকালের বাঙালি জনসাধারণও হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ গৌড়ীয় ভাষাতে অভিনব যুবক সাহেব-জাতের শিক্ষার্থে কোনো পণ্ডিত (মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার) প্রবোধচন্দ্রিকা নামে যে গ্রন্থ রচিতে ছিলেন তাঁর ভাষা এবং সংস্কৃত সম্বন্ধে তাঁর ধারণা নিম্নরূপ :

    ‘অস্মদাদির ভাষার যুগপৎ বৈখরী রূপতামাত্র প্রতীতি সে উচ্চারণ ক্রিয়ার অতি শীঘ্রতা প্রযুক্ত উপর্বধোভাবাস্তিত কোমলতর-বহুল-কমলদল সূচীবেধন ক্রিয়ার মত এতদ্রূপে প্রবর্তমান সকল ভাষা হইতে সংস্কৃত ভাষা উত্তমা, বহুবর্ণময়ত্ব প্রযুক্ত একদ্ব্যক্ষর পশুপক্ষি ভাষা হইতে বহুত-রাক্ষর মনুষ্য ভাষার মত ইত্যনুমানে সংস্কৃত ভাষা সর্বোত্তমা ইহা নিশ্চয় …’।

    কিন্তু আশ্চর্য যে, এমন ওকালতির পরেও স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়ও এ ভাষায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তার প্রমাণ পাচ্ছি তাঁরই অন্য রচনায় :

    ‘মোরা চাষ করিব, ফসল পাবো রাজার রাজস্ব দিয়া যা থাকে তাহাতেই বছর শুদ্ধ অন্ন করিয়া খাব, ছেলে পিলাগুলিন পুষিব। যে বছর শুকা হাজাতে কিছু খন্দ না হয়, সে বছর বড় দুঃখে দিন কাটি, কেবল উড়ি ধানের মুড়ি ও মটর মসুর শাকপাতা শামুকগুলি সিজাইয়া খাইয়া বাঁচি। …. এ দুঃখেও দুরন্ত রাজা, হাজা শুকা হইলেও আপন রাজস্বের কড়াগণ্ডা ক্রান্তি বট ধূল ছাড়ে না। এক আধ দিন আগে পিছে সহে না, যদ্যাপিস্যাৎ কখন হয়, তবে তার সুদ দাম বুঝিয়া লয়, কড়াকপর্দকও ছাড়ে না। যদি দিবার ক্ষেতে না হয়, তবে সোনা মোড়ল পাটোয়ারি ইজারাদার তালুকদার জমীদারেরা পাইকপেয়াদা পাঠাইয়া হাল যেয়াল ফাল হালিয়াবলদ দামড়াগরু বাছুর বকনা কাঁথা পাথর চুপড়ী কুলা ধুচুনী পর্যন্ত বেচিয়া গোবাড়ীয়া করিয়া পিটিয়া সর্বস্ব লয়। মহাজনের দশগুণ সুদ দিয়াও মূল আদায় করিতে পারিনা। কত বা সাধ্য সাধনা করি–হ্যাঁতে ধরি, পায়ে পড়ি, হাত জুড়ি, দাঁতে কুটা করি। হে ঈশ্বর দুঃখির উপরেই দুঃখ। ওরে পোড়া বিধাতা আমাদের কপালে এত দুঃখ লিখিস। তোর কী ভাতের পাতে আমরা ছাই দিয়াছি?’

    শুধু বিদ্যালঙ্কারই নন; রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি সবাই বাঙলা গদ্যকে স্বাভাবিক ও শালীন করে তুলবার চেষ্টা করেছেন।

    রাজা রামমোহন রায় যথার্থই বুঝেছিলেন-প্রথমতঃ বাঙলা ভাষাতে আবশ্যক গৃহব্যাপারের নির্বাহযোগ্য কেবল কতকগুলি শব্দ আছে। এ ভাষা সংস্কৃতের যেরূপ অধীন হয়, তাহা অন্য ভাষার ব্যাখ্যা ইহাতে করিবার সময় স্পষ্ট হইয়া থাকে। দ্বিতীয়তঃ এ ভাষার গদ্যতে অদ্যাপি কোনো শাস্ত্র কিংবা কাব্য বর্ণনে আইসে না। ইহাতে এতদ্দেশীয় অনেক লোক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুই তিন বাক্যের Sentence গদ্য হইতে অর্থবোধ করিতে পারেন না, ইহা প্রত্যক্ষ কানুনের তরজমার অর্থবোধের সময় অনুভব হয়। (বেদান্তগ্রন্থের অনুষ্ঠান প্রকরণ)।

    ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় শব্দের বর্ণগত নিয়ম ও বৈলক্ষণ্যের প্রণালী ও অন্বয়ের রীতি যে গ্রন্থের অভিধেয় হয়, তাহাকে সেই সেই দেশীয় ভাষার ব্যাকরণ কহা যায়। (বাঙলা ব্যাকরণ)

    অতএব রামমোহন এ ভাষা সংস্কৃতের যেরূপ অধীন হয় অর্থে সংস্কৃত অভিধানের অধীনতার কথা বলেছেন, ব্যাকরণের নয়। সুতরাং তিনি বাঙলা ও সংস্কৃত ভাষার প্রকৃতিগত পার্থক্য স্বীকার করেছিলেন। তার ব্যাকরণের অপর দুটো উদ্ধৃতি থেকে আমাদের সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যাবে : ১. সংস্কৃত সন্ধি প্রকরণ ভাষায় উপস্থিত করিলে তাবৎ গুণদায়ক না হইয়া বরঞ্চ আক্ষেপের কারণ হয়। ২. এরূপ (দীর্ঘ সমাসবদ্ধ) পদ গৌড়ীয় ভাষাতে বাহুল্য মতে ব্যবহারে আসে না। এমনকি, অত্যধিক সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারকেও সংস্কৃত রীতির অনুসরণ বলে আখ্যাত করা চলে না। কারণ সংস্কৃত ভাষায় শব্দ বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত হয় না, সন্ধি ও দীর্ঘ সমাসবদ্ধ হয়েই পদ্যে ও গদ্যে ব্যবহৃত হয়। বাঙলায় দুয়ের অধিক শব্দে সন্ধি বা সমাস সাধারণত হয় না। সুতরাং বাঙলাকে সংস্কৃত শব্দে ভারাক্রান্ত করা চলে কিন্তু সংস্কৃত বাক্যরীতির অনুগত করা সম্ভব নয়।

    এসব দেখেশুনেই রামমোহন তাঁর রচনাবলীতে, মৃত্যুঞ্জয় তার প্রবোধচন্দ্রিকার কোনো কোনো কুসুমে, কালীপ্রসন্নসিংহ হুতোম প্যাচার নকসায়, বিদ্যাসাগর বেতাল পঞ্চবিংশতিতে, প্যারীচাঁদ আলালের ঘরের দুলালে, বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামে বাঙলা গদ্যের একটা বিশিষ্টরূপ দানের প্রয়াস পেয়েছেন।

    ইতিপূর্বেও সহজিয়াদের জ্ঞানাদি সাধনা, গোলক শর্মার হিতোপদেশ, কেরীর ইতিহাসমালা, গৌরীকান্তের কামিনী কুমার, রজীব লোচনের কৃষ্ণচন্দ্র চরিত, প্রমথ নাথ শর্মার নব বাবুবিলাস, ও নববিবি বিলাস, বৃটিশ মিউজিয়ামে প্রাপ্ত রূপকথা, (ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক আবিষ্কৃত), রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্য চরিত, তারিণীচরণ মিত্রের ঈসপের গল্পাবলী, চণ্ডীচরণ মুন্সীর তোতা ইতিহাস, হরপ্রসাদ রায়ের পুরুষ পরীক্ষা, রামকিশোর তর্কালঙ্কারের হিতোপদেশ, ভবানীচরণের কলিকাতা কমলালয় প্রভৃতি গ্রন্থে ও মার্সম্যান, জোন্স, ভরস্টার উইলকিন্স প্রমুখ সাহেবদের ভাষায় সংস্কৃতানুগত্যের নিদর্শন দুর্লক্ষ্য। ইতিপূর্বেকার চিঠিপত্র ও দলিল দস্তাবিজের ভাষায় ব্যতীত এ সময়কার সাহিত্যিক রচনায় আরবি-ফারসি শব্দের বাহুল্যও দৃষ্টিগোচর হয় না। শুধু প্রতাপাদিত্য চরিতে মাত্রাতিরিক্ত আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

    ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কেরী প্রভৃতি ধর্মপ্রচারের জন্যে ও রাষ্ট্রীয় কারণে জনসাধারণের সহজবোধ্য রীতির যে পক্ষপাতী ছিলেন, সে-যুগের ইতিহাস তারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। অতএব, সংস্কৃতানুরাগী পণ্ডিতগণের সৃষ্ট ভাষা বাঙলাদেশে স্থায়ী হয়নি।

    এ পর্যন্ত যা বললাম তাতে বোঝা যাবে বাঙলাভাষার গদ্যে ও পদ্যে একটা নিজস্ব রীতি বা শৈলী ছিল। তাতে মাত্র দুবার বিপর্যয় আসে–একবার দোভাষী রীতির প্রচলনে, আর একবার সংস্কৃত ব্যাকরণানুগ গদ্য রচনার ফলে। সৌভাগ্যবশত কোনোটাই স্থায়ী হয়নি।

    প্রাগুক্ত গ্রন্থসমূহের ভাষায় গ্রাম্যতাদুষ্ট (Slang) শব্দ আর কিছু আরবি-ফারসি শব্দও রয়েছে, কিন্তু সমাসবদ্ধ সংস্কৃত শব্দ নেই। অপরিহার্য রূপে কয়েক হাজার আরবি-ফারসি শব্দ বাঙলাভাষায় চালু আছে। আরো দু-দশটা শব্দ হয়তো আসবে কিন্তু তা প্রয়োজনের তাগিদে স্বাভাবিকভাবেই আসবে, জোর করে চালু করলে চলবে না।

    বিদেশাগত মুসলমান শাসকগোষ্ঠী ঘরে তুর্কী, দপ্তরে ফারসি, মসজিদে আরবি এবং সামাজিক ব্যবহারে আরবি-তুকী-ফারসি মিশ্রিত হিন্দুস্তানী ভাষা ব্যবহার করতেন। তাই মুসলমান আমলে যেমন ব্যবহারিক ও দরবারি জীবনে আরবি-ফারসি-তুর্কী শব্দ ঘরোয়া ও পোশাকি কথায় প্রতিশব্দ বা পরিভাষার অভাবে অপরিহার্যরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, ইংরেজ আমলেও তেমনি আমাদের কথাবার্তায় অসংখ্য ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এবং ক্রমে ক্রমে পরিভাষা সৃষ্টি করে বা সংস্কৃত থেকে শব্দ সগ্রহ করে আমরা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার সংকুচিত করেছি, অন্তত সাহিত্যের ভাষায় আমরা পারতপক্ষে ইংরেজি ব্যবহার করিনে। হাসপাতালে Admission নেওয়া, স্কুল-কলেজে পড়া, Examine দেওয়া, পাস করা, Refer করা, Report বা Return দেওয়া, Graduate হওয়া point বলা, Suggestion নেওয়া প্রভৃতি আজো শিক্ষিত বাঙালির ঘরোয়া কথাবার্তার ও চিঠিপত্রের ভাষার অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু সাহিত্যে এদের যে-পরিভাষা গ্রহণ করেছি, তার একটাও বাঙলা বা দেশী শব্দ নয়–সবগুলোই সংস্কৃত। যেমন ভর্তি, পরীক্ষা, স্নাতক, প্রবেশিকা, উত্তীর্ণ, বিশ্লেষণ, সমীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি। এমনকি আরবি-ফারসি ভাষার ঐতিহ্যবাহী মুসলমানদের সৃষ্ট পরিভাষাও আরবি-ফারসি নয়, বরং সংস্কৃত। এখন যেমন অসাহিত্যিক বাঙালি জনসাধারণ কথাবার্তায় ও চিঠিপত্রে প্রায় প্রতি বাক্যে দু-একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে, তেমনি পূর্বে এরূপক্ষেত্রে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করা হত। এখনকার যুগের জনসাধারণের কথাবার্তার বা চিঠিপত্রের ভাষা যেমন সাহিত্যে স্থান পায়নি, তেমনি তখনকার যুগেও মিশ্রভাষাও সাহিত্যে স্থান করে নিতে পারেনি, তার প্রমাণ আমাদের সেকালীন পদ্যসাহিত্য। যে-সব আরবি-ফারসি বা ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ বাঙলা-সংস্কৃতে পাওয়া যায়নি অথবা পরিভাষা সৃষ্টি সম্ভব হয়নি সেগুলো এখনও আমাদের সাহিত্যের ভাষায় চালু রয়েছে এবং খুব সম্ভব থাকবেও।

    সুতরাং চিঠিপত্র বা দলিল-দস্তাবিজের অসাহিত্যিক ভাষার দ্বারা কোনো ভাষার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে যাওয়া অসমীচীন। অতএব কেরী-বিদ্যাসাগরী প্রচেষ্টার পূর্বে বাঙলা সাহিত্যের ভাষা আরবি-ফারসি মিশ্রিত হবার প্রবণতা লাভ করেছিল বলে যারা মনে করেন, তাঁদের ধারণা তথ্যভিত্তিক নয়। এ যুগে কেউ বলে যে বাঙলা ভাষা ইংরেজি শব্দের দ্বারা পুষ্ট ও সুষ্ঠু হবার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তা যেমন ভুল, পূর্ব-ধারণায়ও রয়েছে তেমনি ধরনের অসঙ্গতি। বস্তুত বিদেশী বিভাষার শব্দ গ্রহণ যে-কোনো ভাষার দীনতারই পরিচায়ক। সগোত্রীয় সংস্কৃতের ঋণ স্বীকার করে বাঙলা সে-দীনতা ঘুচিয়েছে; কাজেই বিদেশী শব্দে তার প্রয়োজন সামান্য।

    .

    ০২.

    এবার আঠারো শতকের শেষার্ধে আমাদের জাতীয় অধঃপতন যুগে উর্দু-বাঙলা মিশ্র শৈলীতে রচিত দোভাষী পুথি সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধান-লব্ধ ধারণা পেশ করে আমাদের আলোচনা শেষ করব।

    নবাব সরফরাজ খান রাজ্যশাসনে উদাসীন ছিলেন। তার শাসন-শৈথিল্যের সুযোগে রাজ্যের প্রধানগণ উচ্ছল, লোভী ও আত্মপরায়ণ হয়ে উঠে। খলশ্রেষ্ঠ জগৎ শেঠের নেতৃত্বে স্বার্থপর অমাত্যগণ উড়িষ্যার নায়েব-সুবাদার আলীবর্দী খাঁকে বসালেন বাঙলার মসনদে। এদের সহায়তায় নবাবী লাভ হল বলে তিনি এঁদের মন যুগিয়ে চলতেন। ফলত এসব স্বার্থপর, উচ্ছল অত্যাচারী সামন্তগণই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে রাজ্যের ভাগ্যনিয়ন্তা। তদুপরি বর্গীয় উৎপাত তো ছিলই। শাসক যেখানে দুর্বল, শাসিতগণ সেখানে যথেচ্ছাচারী হবেই। সিরাজদ্দৌলা আমীরদের মন ও মান রক্ষা করে চলতে জানলেন না বা পারলেন না। কাজেই পলাশীতে অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় ঘটল।

    মানুষ চিরকাল আদর্শপ্রবণ ও পরানুকারী। ধনে-জনে-মানে যারা প্রধান, জনজীবনে তাদের আচার-আচরণই অনুকৃত হয়। ফলে এ সময় দেশব্যাপী স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা এবং ভোগ ও নগ্ন লালসার স্রোত বয়ে চলেছিল। এ কদর্যতার স্রোত অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রবেশ করেছিল সাহিত্যেও। এজন্যেই তারল্য, কৃত্রিমতা, বর্ণনায় নির্জীবতা–অলঙ্কারের ঘটা ও ছন্দের বহু বিচিত্র সম্ভার সত্ত্বেও ভারতচন্দ্রের রচনাকে করেছে কলঙ্কিত। ভারতচন্দ্রের পরে বাংলার রাষ্ট্রিক, নৈতিক ও সামাজিক অবস্থা আরো খারাপ–আরো ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছিল, সে-প্রমাণ শুধু ইতিহাস থেকেই নয়, সাহিত্য থেকেও পাচ্ছি। আঠারো শতকের এই শাসনতান্ত্রিক শৈথিল্যের, রাষ্ট্রিক ভাগ্য-বিপর্যয়ের এবং নীতি-নিষ্ঠাহীন বাঙালির অবনতি-প্রবণ সমাজের বিকৃতির অভিব্যক্তি স্বরূপ আমরা হিন্দু রচিত কবি গান, পীর পাঁচালী এবং মুসলমান রচিত দোভাষী পুথিগুলো পাচ্ছি। হিন্দুকবি রচিত পীর পাঁচালীর অনেকগুলোই দোভাষী পুথির অন্তর্গত। নির্বীর্য বাঙালির সামাজিক রুচিবিকৃতি ও নৈতিক অধঃপতনের দিনে মানসিক বিপর্যয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের সুযোগে নতুন বন্দর কলকাতা এবং পুরোনো শহর মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমানের গড়ে উঠে যথাক্রমে উক্ত দু-ধারার সাহিত্য। হিন্দুদের যেমন ধর্মসংপৃক্ত কবিগান, সত্যনারায়ণ পাঁচালী, মুসলমানদেরও তেমনি হামজা-হোসেন-হানিফা প্রভৃতি জেহাদ কাহিনী ও পীর-দরবেশের উপকথা নিয়ে গড়ে উঠে এ সাহিত্য। তখন রাজশক্তির লীলাভূমি কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও এদের সন্নিহিত অঞ্চলের হিন্দু মুসলমানদের আধ্যাত্মিক দেউলে ভাবও প্রকট হয়ে উঠে। মানুষ যখন উচ্চ নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শ হারিয়ে ফেলে তখন আত্মবিশ্বাস রক্ষা করে আত্মনির্ভর হতে পারে না। তখন সে হয়ে পড়ে একান্তভাবে দৈবনির্ভর, ভীরু এবং শক্তি-পূজক। এজন্যে এসময় এখানকার হিন্দুদের মধ্যে দক্ষিণরায়, সত্যনারায়ণ, কালুরায় ও ধর্মঠাকুরের পূজা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়, মুসলমানদের মধ্যেও সত্যপীর, বড় খাঁ গাজী, ইসমাইল গাজী, মোবারক গাজী, বনবিবি প্রভৃতি মানবভাগ্য নিয়ন্তা বলে শ্রদ্ধা-শিরনি পেতে থাকেন। রাজধানীর অধিবাসীরাই সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দুটোই সমভাবে ভোগ করে। বাঙলার কলঙ্কিত দুর্দিনের সাক্ষ্য রেখে গেছে এরাই।

    ইতিপূর্বেও পালদের পতন-যুগে আমরা বৌদ্ধ বজ্ৰমান, সহজ যান (তন্ত্র ও যোগ) প্রভৃতি পেয়েছি। সেন-রাজাদের দুর্দিনে পেয়েছি একদিকে চণ্ডী-মনসা প্রভৃতি, অপরদিকে শেখশুভোদয়া, গীতগোবিন্দ ইত্যাদি। (রাধাকৃষ্ণ লীলারূপ পঙ্ক থেকে পঙ্কজ হল বৈষ্ণব মত)। পাঠান পরাজয়ে পেলাম ধর্মঠাকুর, দক্ষিণরায়, কালুরায়, বড়গাজী, সত্যপীর প্রভৃতি আর মুঘল-শক্তির পতনে পেলাম বিদ্যাসুন্দর, কবি-গান, পুথিসাহিত্য। এ হচ্ছে স্রোতে ভেসে যাওয়া লোকের তৃণ ধরে বাঁচবার প্রয়াস।

    নবাবী আমলে চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা শহরে, শহরতলীতে ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে সিপাহী, রাজকর্মচারী, ব্যবসায়ী এবং আরো নানা পেশার অবাঙালি লোক-লস্কর এসে বসবাস করেছে! উর্দু-হিন্দি তথা হিন্দুস্তানীই ছিল তাদের মাতৃভাষা, স্বদেশের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে ও দেশীলোকের প্রভাবে বিকৃত হয়ে গেল তাদের বুলি। ঐ ভাষা এদেশে অবজ্ঞার্থে খ্যাত হল খোট্টাভাষা নামে। এসব খোট্টাভাষী বিদেশীরা প্রাত্যহিক জীবনের গরজে এদেশীয় লোকের ভাষাও আয়ত্ত করল অপটুভাবে। ফলে যে-কারণে [ অর্থাৎ প্রয়োজনানুরূপ শব্দসম্পদ আয়ত্ত করতে না পারার ফলে] ফরাসি-হিন্দির মিশ্রণে উর্দুর সৃষ্টি হল, অনুরূপ কারণে খোট্টাদেরও একটি বাঙলাভাষার উৎপত্তি হল। এর বিশেষত্ব হচ্ছে বাঙলা শব্দের বিকৃত উচ্চারণ এবং অপরিমেয় হিন্দুস্তানী শব্দের ব্যবহার ও বাভঙ্গির প্রয়োগ। এ ভাষা এখনো চালু রয়েছে উক্ত শহরগুলোতে।

    হিন্দুস্তানী ও বিদেশাগতদের পারস্পরিক অক্ষমতার ফলে ফারসি-হিন্দি মিশ্রিত যে ভাষা চালু হল Linguafranca হিসেবে, তা ফারসি অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে নতুন নামে আলাহিদা ভাষারূপে দাঁড়িয়ে গেল। উর্দুর (তবু) ভাষা পরিণামে কয়েক কোটি লোকের ঘরোয়া বুলিতে পরিণত হল। কালে সাহিত্যের বাহন হবার গৌরব অর্জন করেছে উর্দু।

    এভাবে দক্ষিণভারতেও সৃষ্টি হয়েছে দাখিনী উর্দু। খোট্টা বাঙালিরাও হয়তো ফারসি হরফে তাদের মিশ্রবাঙলা লিপিবদ্ধ করে উর্দুর মতো পৃথক একটা ভাষা তৈরি করতে পারত; কিন্তু বাঙলা দেশে বিদেশাগত হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যাল্পতার দরুন এবং বাঙলা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি কিংবা এর জন্য নওয়াবী আমল দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে আরবি-হরফে অনুলিখিত যে-কয়টি বাঙলা পুথি মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কর্তৃক সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলো দোভাষী পুথি নয়, সুতরাং একে উর্দুর মতো আলাহিদা ভাষা সৃষ্টির প্রয়াস বলে মনে করবার হেতু নেই। আরবি হরফে বাঙলা লিখবার অন্য স্থানীয় ও পারিবেশিক কারণ ছিল। ওগুলো বাঙলা বর্ণজ্ঞানহীন মাদ্রাসা-শিক্ষিত মৌলবাদীদের জন্যই। প্রতিবর্ণীকৃত। সে আলোচনা এখানে অবান্তর।

    সুতরাং খোট্টা বাঙালির শহুরে বাঙলায় যে-সাহিত্য পলাশীযুদ্ধের পাঁচ-সাত বছর পর থেকে কলকাতা, হাওড়া, হুগলী ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে রচিত হতে থাকে, তার সাথে বাঙালির কোনো যোগ ছিল না। চৌদ্দ-পনেরো শতক থেকে বিশুদ্ধ বাঙলায় যে-সাহিত্য রচিত হচ্ছিল এরা সে ভাষাশৈলীই সাম্প্রত কাল পর্যন্ত অনুসরণ করে চলেছে। দোভাষী পুথির কোনো প্রভাব যে পল্লীবাসী মুসলমানদের উপর পড়েনি, তার প্রমাণ এদের রচিত পুরোনো বা নতুন গানে, গাথায়, ছড়ায়, রূপকথায়, কাহিনী-কাব্যে সে ভাষার কোনো নিদর্শন নেই। আমাদের উক্তির সমর্থন পাওয়া যাবে হারামণি, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রবাদ-সংগ্রহে এবং পাঁচালিগুলোতে।

    পল্লী অঞ্চলে দোভাষী পুথি বহুলপঠিত হত বলে বিশ্বাস করবারও কারণ নেই। চকবাজার ও শহুরে বস্তিতে এর উদ্ভব ও প্রচার সীমাবদ্ধ বললে সত্যের বিশেষ অপলাপ হবে না। উনিশ-বিশ শতকের দোভাষী উপাখ্যানগুলো কারা, কাদের আদেশে, কোনো প্রেরণায় রচনা করেছেন ও করছেন তার উল্লেখ অনেক পুথির সমাপ্তিভাগে রয়েছে–বটতলার প্রকাশকের আদেশ, আর্থিক প্রেরণা এবং খোট্টা পাঠকদের চাহিদাই রয়েছে এগুলো রচনার মূলে। অতএব এ-সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির আন্তর বা বাহ্য যোগ কোথায়? অবশ্য বিশুদ্ধ ভাষায় রচিত ছাপা পুথির অভাবে গাঁয়ের লোকেরাও দোভাষী পুথি পড়েছে–শুনেছে কিন্তু সে-ভাষা অনুকরণ করেনি। কাজেই দোভাষী পুথি সাহিত্যের ঐতিহ্য-উত্তরাধিকারের প্রশ্নই অবান্তর। কল্যাণকর ইসলামী আবেশ বা মুসলিম ঐতিহ্যের আবহ পুথিতে দুর্লভ ও দুর্লক্ষ্য। দোভাষী পুথির আদি রচয়িতা ফকির গরীবউল্লাহ্ স্বয়ং ছিলেন পীর পূজারী। দেবগুণাধিকারী বড় খান গাজী ছিলেন তাঁর জীবন-নিয়ন্তা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুঘল আমলে আগত ধনিক ও বণিক অভিজাত মুসলমানগণের ঘরোয়া ভাষা আজো উর্দু, এবং বাঙালি মুসলমানদের মুখপাত্র হয়ে তাঁরাই উনিশ শতকে ও বিশ শতকের প্রথমদিকে প্রচার করেছিলেন যে, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু।

    সতেরো শতকের কবি কৃষ্ণরাম দাস তাঁর রায়মঙ্গলে সংস্কৃত নাটকের অনুকরণে সংলাপে বাস্তবরূপ দান করবার বাসনায় সত্যপীরের মুখে হিন্দুস্থানী ভাষা দিয়েছিলেন। ভারতচন্দ্র রায়মঙ্গলের সে দৃষ্টান্ত স্মরণ করেই লিখেছেন :

    মানসিংহ পাদসায় হইল যে বাণী।
    উচিত যে আরবি পারসী হিন্দুস্তানী ॥
    পড়িয়াছি যেই মত বর্ণিবারে পারি।
    কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি ॥
    না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল।
    অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।

    ভারত চন্দ্র-রামপ্রসাদ ছাড়া বিদ্যাপতি, শ্রীকবি বল্লভ, কৃষ্ণহরি দাস প্রভৃতি সত্যনারায়ণ পুথি রচয়িতাগণ এবং জঙ্গনামা রচয়িতা রাধাচরণ গোপ তাদের পাঁচালিতে মিশ্রভাষা প্রয়োগ করেছেন। বলা বাহুল্য, এঁরাও কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের লোক।

    কৃষ্ণরামদাসের হিন্দির নমুনা :

    শোতে হো দক্ষিণরায় এছা দাগাবাজী।
    বাধকে নে আনেছে তবে হাম গাজী ॥
    কালানল শেরকু তোড়নে কহে কান।
    সিতাব দেখনে চাই কেছাই সয়তান ॥

    বিদ্যাপতির রচনা :

    হইআ বান্দার বান্দা নুঙাইয়া শির।
    বন্দিব বড় খা গাজী পীর দস্তগীরা
    একদিলে বন্দিব দরদস্তা পীব।
    বড় খাঁ গাজী যেই করিল জাহির ॥

    শ্ৰীকবি বল্লভের রচনা :

    শুনহ বেইমান রাজা বাত কহু তোরে।
    রাখ্যাছ গোলাম মেরা কিসের খাতিরে ॥
    সাত হাজারের মার্তা লইয়াছে ভাড়া।
    মহল ভিতরে নাচে সাতশত ন্যাড়া

    জঙ্গনামা রচয়িতা রাধাচরণ গোপের রচনা :

    ইলাহি কহেন জীবরিল কর আর কি।
    আছামান জমীন ডুবাইছেন রসুলের ঝি
    সিতাব করিয়া এখন দুনিয়াকে যাও।
    বিবি ফাতেমাকে তুমি যাইঞা সমজাও ॥

    সম্ভবত এঁদেরই অনুকরণে গরীবউল্লাহ ১৭৬০ থেকে ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তার কাব্যগুলো রচনা করেন। দ্বিতীয় কবি মুহম্মদ এয়াকুব (?) গরীবুল্লাহর অসমাপ্ত হোসেন মঙ্গল বা জঙ্গনামা সমাপ্ত করেন ১৭৯৪ খ্রীস্টাব্দে। তৃতীয় কবি সৈয়দ হামজা ১৭৮৯-১৮০৫-৮ খ্রীস্টাব্দে তাঁর গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে মাত্র এই তিনজন দোভাষী পুথি লেখকের আবির্ভাব হয়েছে। উনিশ শতকে, বিশেষ করে বিশ শতকে প্রায় শতাধিক কবি বটতলার প্রকাশকদের অনুরোধে অর্থের বিনিময়ে নানা বিষয়ক পুথি রচনা করে দিয়েছেন। এদের অনেকেই পেশাদার লেখক। তাই পুথিগুলো প্রায় সবদিক দিয়েই বিশেষত্ব বর্জিত। পদ্যে কোনোরকমে কাহিনী বা বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে মাত্র। বহুগ্রন্থ প্রণেতা হিসেবে এদের মধ্যে উড়িষ্যার অবদুল মজিদ খান ভূঁইয়া, জনাব আলী, মালে মুহম্মদ, মুহম্মদ খাতের, আবদুর রহিম, মুহম্মদ মুনশী, শেখ আয়েজুদ্দিন, মনিরুদ্দিন প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। এবং এঁদের অনেকেরই নিবাস দক্ষিণরাঢ়ে তথা হাওড়া, হুগলী ও চব্বিশ পরগনাঞ্চলে।

    এসব দোভাষী পুথি কাদের জন্যে লিখিত হয় তার আভাস পাওয়া যাবে কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে।–কবি মালে মুহম্মদ তার সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল পুথি রচনার কারণ স্বরূপ বলেছেন:

    এই পুথি সায়ের ছিল আগুন যমানায়।
    সংস্কৃত সাধু ভাষায় হৈল তৈয়ার ॥
    পড়িতে বুঝিতে লোকে বড়ই কাছেল্লা।
    তেকারণে অধীন করে চলিত বাঙ্গালা।
    রসিক লোকের দেখে বহুত কাগতি।
    বারশও পঁয়ত্রিশ সালে লেখি এই পুথি ॥

    বারোশ পঁচাত্তর বাঙলা সনে হুগলী সন্তোষপুর নিবাসী কবি বেলায়েতকে তাঁর ফেসানায়ে আজায়েব বা আঞ্জুমান আরা জানে আলম রচনাকালে তার বন্ধু ভাষা সম্বন্ধে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা এরূপ :

    বোলচাল সব তুমি লেখ আমাদের।
    সকলের বুঝিতে পারে কী কহিব ফের ॥
    রঙ্গিন করিতে তুমি এই যে কাহিনী।
    শক্ত শক্ত লভূজো কিছু না লেখ আপনি ॥
    এমত না হয় যেন আমা সবাকায়,
    মানে পুছে ফিরি মোরা পণ্ডিত সবায় ॥

    কলকাতা শহরের কড়োয়া নিবাসী কবি শেখ আমীরুদ্দিন মনসুর হাল্লাজ পুথির প্রারম্ভে লিখেছেন :

    মাসাএখ মনসুরের কেচ্ছা ফার্ছিতে।
    লিখিয়াছিলেন কোনো ফাজেল লোকেতে।
    সেই তো রেছেলা ফের এছলামি বাঙ্গালায়।
    লিখিতে এরাদা হইল খাহেস আমায় ॥
    বাঙ্গালা লোকের কেচ্ছা শুনিতে বাসনা।
    তেকারণে বাঙ্গালাতে করিনু রচনা ॥

    এতেই বোঝা যাবে এঁরা কোনো বাঙালির জন্যে কোনো বাঙলায় পুথি রচনা করেছেন। আজ পর্যন্ত যারা দোভাষী পুথি রচনা করে চলেছেন, যাঁরা এ-পুথির প্রকাশক আর যারা পাঠক, তাঁদের সঙ্গে যে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত বাঙালির সাংস্কৃতিক ও ভাবগত কোনোপ্রকার সম্পর্ক নেই তা কে না স্বীকার করবেন?

    এসব পুথি দেখেই সম্ভবত উনিশ শতকের হিন্দু সাহিত্যিকগণ মুসলমান লেখকের রচনার সমালোচনা প্রসঙ্গে মুসলমান হইয়া এমন বিশুদ্ধ বাংলা লিখিয়াছেন ইত্যাদি উক্তি করতেন। অবশ্য দোভাষী পুথির অধিকাংশ উর্দু সাহিত্যের অনুবাদ। বাঙলা তর্জমায় উর্দুভাষার প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ ও বাঙ্গি রক্ষা করার ফলে কবিগণের পক্ষে অনুবাদ কার্য সহজ হয়েছিল। কিন্তু আমাদের পুথিকারদের কেউ কেউ উর্দু-হিন্দি শব্দ এতই বেশি প্রয়োগ করেছেন যে, তাঁদের রচনার কোনো কোনো অংশ বিকৃত হিন্দুস্তানী বলে ভ্রম হয়।

    এখানে আমরা ব্রজবুলি নামক কৃত্রিম ভাষার কথা স্মরণ করতে পারি। মৈথিল ভাষার অনুকরণে বৈষ্ণব যুগে (১৬১৭ শতকে) ব্রজবুলি (বাঙলা-মৈথিল মিশ্রিত) ভাষায় পদ রচনার রীতি দেখা দেয়, কিন্তু কৃত্রিম বলে তা বাঙলা সাহিত্যে টিকতে পারেনি। শেষপর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো সময়েই বাঙলাদেশে এর বহুল প্রচলন হয়নি। কেবল গোবিন্দ দাসই মনেপ্রাণে সাধনা করেছিলেন ব্রজবুলির। ফলে তাঁর রচনা (পদাবলী) হৃদয়াবেগহীন বাসর্বস্ব বাঁচাতুর্যে পর্যবসিত হয়েছে–ভাষার ঐশ্বর্য ঘুচাতে পারেনি ভাবের দীনতা। ভাষার জাদুকর হয়েও তাই তিনি আন্তরিকতার অভাবে কবিপ্রাণতায় বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস বা জ্ঞানদাসের সমকক্ষ হতে পারেননি। অথচ মৈথিল ভাষা (তথা ব্রজবুলি) ছিল বাঙলা ভাষার বৈপিত্রেয় বোন–সহোদরা। এজন্যেই এ-যুগে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীও অনুকৃত হয়নি। কৃত্রিম ভাষায় হালকা রচনার বিলাস করা চলে, কিন্তু সারবান মহিমময় সাহিত্য সৃষ্টি করা চলে না। অক্ষম লোকের কৃত্রিম ভাষা প্রয়োগের ফলে পুথি-সাহিত্য সৌন্দর্য ও শালীনতা হারিয়ে ফেলেছে। গাম্ভীর্যের কথা তো ওঠেই না। বাঙালির ব্রজবুলি-চর্চার পরিণতি থেকে আমাদের শিক্ষা পাওয়া উচিত। ইতিহাসের ইঙ্গিত অবহেলার ফল কখনো শুভ হয় না।

    বৈষ্ণব আমলের কৃত্রিম ব্রজবুলি টেকেনি, পুথির কৃত্রিম মিশ্ররীতিও কোথাও স্বীকৃতি পায়নি।

    এখানে ভাষা সম্বন্ধে দুটো কথা বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কোনো ভাষায় বিদেশী শব্দ আসে দুপ্রকারে। প্রথমত, নতুন বস্তু নির্দেশক হয়ে, দ্বিতীয়ত নতুন ভাব প্রকাশক রূপে। বাঙলা দেশে যে-বস্তু ছিল না বা নেই, সে-বস্তু যদি দেশে আসে, তবে তার নামবাচক বিদেশী বিভাষার শব্দগ্রহণ করতে বাধ্য হই আমরা। দ্বিতীয়ত বাঙালির মন-মননে যে-চিন্তা বা ভাব পূর্বে জাগেনি– যা ব্যক্ত হয়নি, সে-সব ভাব-চিন্তাব্যঞ্জক শব্দও বিদেশী ভাষা থেকে ধার না করে উপায় নেই আমাদের। অকারণে মূল-না-জানা ঐতিহ্য ও ব্যঞ্জনাবিহীন কতগুলো বোবা শব্দ এনে নিজের মুখের বুলিকে–সাহিত্যের ভাষাকে জড় করে তুলে লাভ কী? বিশেষত ঋণমাত্রেই দৈন্যের পরিচায়ক।

    তবে রসবৈচিত্র্য দান করবার জন্যে এক-আধটা চরিত্র-মুখে মিশ্রভাষা বা প্রাদেশিক বুলি বলানো সমর্থন করা যায়। এ রীতিও প্রচলিত আছে–যেমন নাটক, গল্প ও উপন্যাসের সংলাপে দেখা যায়। এতে অবশ্য গভীর ও গুরুতর ভাব প্রকাশ করা চলে না। চরিত্রকে হাস্যাস্পদ করে তোলাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বিদেশী কাহিনী বর্ণনার জন্যে বিদেশী ভাষাও আমদানি করলে স্বদেশী সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। আমাদের দোভাষী পুথিও তাই শালীন ভাষায় শালীন সাহিত্য বলে শিক্ষিতসাধারণের স্বীকৃতি পায়নি। যারা বাঙলাকে সংস্কৃতানুরূপ বা ফারসি-ঘেঁষা করতে চান, তাঁরা বাঙলাভাষাকে রেহাই দিয়ে সহজেই যথাক্রমে হিন্দি বা উর্দুকে বরণ করে নিতে পারেন, তাহলে সব দিক রক্ষা পায়।

    অবশ্য যে-পটভূমিকায় কাহিনী বিবৃত হবে, তার স্থানীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বস্তুবাচক বা ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিশেষ বিশেষ শব্দপ্রয়োগে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। য়ুরোপীয় কথা বর্ণনায় পদ্ম, চকোর, খঞ্জন আঁখি, মেঘবরণ কেশ, আলতা-রাঙা পা, কাজল-কালো চোখ প্রভৃতি কেউ আশা করে না। তেমনি ইরানি কাহিনীতে সবাই গোলাপ, বুলবুলি, সুর্মা, দ্রাক্ষা প্রভৃতির প্রত্যাশা করে। এতে ভাষা- বিকৃতির আশঙ্কা কেউ করে না।*

    [*ইরানী ভাষায় ইসলামধর্মের মৌলিক শব্দেরও অনুবাদ হয়েছিল–যেমন : আল্লাহ–খোদা, সালাত নামাজ, সিয়াম–রোজা, জান্নাত–বেহেস্ত, জাহান্নাম–দোজখ, মলক–ফিরিস্তা ইত্যাদি। ইরানের মাধ্যমে এগুলো এদেশেও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু ইমানের ভিত্তি নষ্ট হল বলে কেউ ভাবেনি। মুসলিম তমদুনও এতে খর্ব হয়েছে বলে কেউ প্রশ্ন তোলেনি।]

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচট্টগ্রামের ইতিহাস – আহমদ শরীফ
    Next Article আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট – আহমেদ রিয়াজ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }