Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প450 Mins Read0

    দুর্দিন

    ০১.

    আযাদী লাভের পর বিশ বছর কেটে গেল। কিন্তু আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঘুচল না ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে। আজো চলছে দলাদলি ও কোন্দল। অবশ্য মতাদর্শের বিতর্ক ও সংগ্রাম মন্দ কিছু নয়, অভিনব তো নয়ই। কিন্তু একই সমস্যা নিয়ে বিশ বছর ধরে মাথা ঘামানো, আর তার সমাধান খুঁজে না-পাওয়া এ-যুগের পক্ষে অদ্ভুত, অযৌক্তিক ও অকল্যাণকর।

    দল মোটামুটি দুটোই। একদল ধর্মীয় জাতীয়তায়, ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে আস্থাবান। অন্যদল দেশীয় ও ইউরোপীয় ভাব-চিন্তার অনুগত। প্রথম দল Nationalist, দ্বিতীয় দল Rationalist। আদর্শ হিসেবে কোনোটাই নিন্দার নয়। প্রথম দল ধর্মভাবে নয়–ধর্মীয় পরিচয়ে স্বাতন্ত্রকামী। তাঁদের আত্মপ্রীতি ও মর্যাদাবোধ তীক্ষ্ণ ও তীব্র। তাঁরা ঋণের কিংবা অপরের অনুসৃতির লজ্জা থেকে জাতিকে বাঁচাতে চান। তাঁদের যুক্তিতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার। কেননা ইসলাম হচ্ছে সর্বকালীন সর্বমানবিক সমস্যার সমাধান আর মানব-কাম্য কল্যাণের দিশারী। কাজেই ইসলামের অনুগত হও, কোরান-হাদিস অনুসরণ কর আর সুখে নিদ্রা যাও।

    মুশকিল হল এই তাঁরা মুখে বলছেন বটে, কিন্তু অন্তরে তাঁদের দ্বিধা ঘোচেনি, আর তাই হয়তো আচরণে তাদের কোনো সঙ্গতি দেখা যায় না। কেননা য়ুরোপীয় আদলে জীবন রচনায় তাঁরাও প্রয়াসী। য়ুরোপীয় মানস-সংস্কৃতির ফসল গ্রহণে কিংবা ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিকতায় য়ুরোপীয় জীবনধারার অনুকরণে তাদের সংকোচ দেখিনে। তা হলে তাদের স্বাতন্ত্র্যবাদ কী নিলক্ষ্য ফাঁকা বুলি মাত্র? তাও নয়। আসলে ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক স্বার্থে যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচেতনা জাগে, তাকে স্থায়ী ও জোরালো করবার জন্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তায় বিশ্বাস ও তার ভিত্তি দৃঢ়মূল করবার প্রয়োজন হয়। আর এ লক্ষ্যে সিদ্ধির অনুষঙ্গ হিসেবে আসে ধর্মীয় ঐতিহ্যের ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের যুক্তি। আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল, জয়ী হয়েছিলাম আমরা। কাজেই আমাদের সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে, বিশ বছর আগে। ওরা এখন আমাদের পাতের ভাতের ভাগী নয়, প্রতিবেশী মাত্র। তবু আমাদের দেশ ও জাতির হিতকামী অতি-সচেতন একদল বুদ্ধিজীবী অহেতুক শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। একটা অসুস্থ চিন্তা, একটা বিকৃত বুদ্ধি, একটা বিদ্বিষ্ট মন ও একটা অহেতুক শঙ্কা নিয়ে দেশের স্বার্থ ও জাতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্যে অতন্দ্র প্রহরীর ও গণ-অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তারা।

    যা তারা প্রচ্ছন্ন রাখতে চান, খোলাখুলিভাবে তার নাম দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু ও হিন্দুয়ানী ভীতি। এ কারণেই তারা বলছেন– হরফ বদলাও, বানান বদলাও, শব্দ বদলাও, ভাষা বদলাও, ভঙ্গি বদলাও; বদলাও বিষয়বস্তু, বদলাও নাম, বদলাও ভাব, বদলাও চিন্তা। কেবলই বদলাও যাতে বাঙলা ও বাঙালিত্বের নাম-নিশানা ঘুচে যায়, বিলীন হয় সাদৃশ্য, প্রতিষ্ঠা পায় পূর্ণ স্বাতন্ত্র। এর আগে নিশ্চিন্ত হওয়া চলে না। কেননা শত্রুকে ছোট ভাবতে নেই।

    বিশ বছর ধরে ক্রমবর্ধমান অসাফল্যের মুখ্য কারণ হচ্ছে, তাঁদের অভিপ্রায় প্রচ্ছন্ন করে তারা কেবলই ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের গর্ব আর জাতীয় স্বাতন্ত্রের গুরুত্ব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। অথচ দেহ-মনে তারা বরণ করেছেন য়ুরোপকে। কথায়-কাজে এ অনৈক্য, বুকে-মুখে এ বিরোধ অন্যের অশ্রদ্ধা জাগায়। অবচেতন ভাবেই শ্রোতার মন হয়ে ওঠে বিরূপ। তারা যদি সোজাসুজি বলতেন এড়িয়ে চলো হিন্দুর সাহচর্য, পরিহার কর হিন্দুয়ানী প্রীতি, বর্জন কর হিন্দুর সাদৃশ্যজ্ঞাপক সবকিছু, তা হলে হয়তো রাষ্ট্রিক অসদ্ভাবের সুযোগে সমর্থন পেতেন অনেক। কিন্তু তা তাঁরা বলেননি–বলেন না। হেঁয়ালি ছাড়তে চান না তাঁরা।

    এর ফলে বেড়ে যায় সাধারণের তাচ্ছিল্য আর বিরুদ্ধবাদীদের উত্তেজনা। বিরুদ্ধবাদীরা তখন যুক্তির আশ্রয় নেন। তাদের যুক্তি কতকটা এরূপ–যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলার অন্য নাম সংস্কৃতি। সংস্কৃতি কখনো পুরোনো হতে পারে না, তা হবে নিত্য নতুন। প্রতিদিনকার সূর্যের মতোই নতুন। বহতা নদীর স্রোতের মতোই নতুন। কেননা সংস্কৃতি পুরোনো হলে তা আর সংস্কৃতি থাকে না, হয় আচার। তখনকার ইসলামী সংস্কৃতির তথা এখনকার ইসলামী আচারের অনেক ভালো রীতি-পদ্ধতিই যুডাইজম থেকে নেয়া, যার নাম সুন্নত-ই-ইব্রাহীম। অতএব ইসলামী সংস্কৃতিও অবিমিশ্র ছিল না। সংস্কৃতি চালু থাকে সৃজনশীলতায় ও গ্রহণশীলতায়। যারা সৃষ্টি করতে পারে না, অন্যের সৃষ্টি বরণ করেই তারা হয় সংস্কৃতিবান। যারা সৃষ্টিও করতে পারে না, গ্রহণও করতে চায়, তারা আদিম স্তর পার হতে পারেনি, যেমন আফ্রো-এশিয়ার পার্বত্য ও আরণ্যক গোত্রগুলো। অতএব সংস্কৃতি কখনো অবিমিশ্র হয় না হতে পারে না। আমরা বাঙালিরা সৃজন করে নয়– গ্রহণ করেই হয়েছি সংস্কৃতিবান। আমাদের ধর্ম আরবের ও উত্তর-ভারতের। আমাদের ভাষা উত্তরভারতের বা আরো দূরের। আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতি মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কী, মুঘল ও ইংরেজ থেকে পাওয়া। আমাদের সমাজ সংস্থা এই ধর্ম আর প্রশাসনিক আদর্শভিত্তিক। আমরা নিজেরা হলাম অস্টো-মঙ্গোল-নিগ্রো-আর্য-সামীয়ের বর্ণসঙ্কর বা রক্ত-সঙ্কর জাতি। অতএব, পাঁচ রকমের মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের জাতি। পাঁচমিশেললি হয়েছে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। তাহলে কোনো অর্থে আমরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা বলি? আমরা গ্রহণ করি, আর নিজের মতো করে নিই, যার নাম স্বাঙ্গীকরণ। এই হচ্ছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের রূপ আর জাতীয় স্বরূপ। আমাদের পূর্বপুরুষ বিদেশী বিজাতি আরবের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে কী আমরা লজ্জায় মরি, না স্বস্তিবোধ করি!

    গ্রহণে-বরণেই যদি আমরা আজ অবধি টিকে থাকি, তাহলে আজকে হঠাৎ জাত গেল, ধর্ম গেল, ঐতিহ্য গেল, গেল ভাষা, গেল সাহিত্য, গেল সংস্কৃতি, বলে আর্তচিৎকারের বা আর্তনাদের কী কারণ ঘটল? বিশেষ করে আমরা যখন জানি যে সংস্কৃতির কোনো স্থায়ী রূপ বা স্বাতন্ত্র থাকতেই পারে না। এমনকি জীবন-চেতনা, নীতিবুদ্ধি, ধর্মবোধ, ঐতিহ্যের মূল্য, ভাষার রূপ বা সাহিত্যের আঙ্গিক ও বক্তব্যই কী অবিচল অবিকৃত থাকে? এক কোরআন কেন্দ্র করেই হাদিস অবলম্বন করেই কী আমাদের বাহাত্তর ফেরকা হয়নি? জীবনে কী প্রয়োজন-বুদ্ধি ও উপযোগ-চেতনা বদলাচ্ছে না? জীবনযাত্রী কী চলার পথে এগোয় না? মানুষের মন-বুদ্ধি-আত্মার কী বিকাশ নেই? সমাজ কী স্থাবর? তার কী কেবল অতীতই আছে, ভবিষ্যৎ নেই? তার কী কেবল অতীতের মোহ থাকাই বাঞ্ছনীয়, ভবিষ্যতের আকর্ষণ থাকা কাম্য নয়? নিজেকে নতুন করে রচনা করা কী অপরাধ না অমানবিক?

    যাঁরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের প্রবক্তা, তারাই আবার য়ুরোপীয় গণতন্ত্রের ভক্ত, গণতন্ত্রী সংবিধানের দাবীদার, রোমান-আইনের অনুরাগী, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় উৎসুক, রেডক্রসের মহিমায় মুগ্ধ, য়ুরোপীয় বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার প্রসাদ গ্রহণে উন্মুখ। য়ুরোপীয় মনীষার ফসল ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, বাণিজ্যবিদ্যা, প্রাচ্য-শাস্ত্র বিশ্লেষণ বিদ্যা, বিভিন্ন বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা আর সাহিত্যশাস্ত্র শিক্ষায় এবং অনুকরণেও তারা লজ্জাবোধ করেন না, কিংবা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের কথা ভাবেন না। য়ুরোপীয় আদলে প্রশাসনিক সংস্থা গড়ে তুলতে, স্কুল-কলেজ রাখতে, সৈন্যবাহিনী বিন্যাস করতে, কিংবা কলকারখানা স্থাপনে, পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানে, গৃহনির্মাণে ও আসবাবপত্র ব্যবহারে তাঁদের আত্মসম্মানে বাধে না। এঁরা গরুর গাড়ি-ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে মোটরে বিমানে-জাহাজে চড়তে, কিংবা হেকিম বাদ দিয়ে ডাক্তার ডাকতে, রেড়ির তেল ছেড়ে কেরোসিনের ব্যবহারে কিংবা বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োগে আত্মধিক্কারে মাথা নত করেন না।

    আজ আমাদের চুল কাটার ধরন থেকে জুতোর অবয়ব অবধি সবকিছুই য়ুরোপীয়। এভাবে অন্তরে-বাইরে মনে ও মেজাজে য়ুরোপীয় মানুষেরই প্রতিকৃতি আমরা। এমনকি য়ুরোপীয় জীবন চিন্তার প্রভাবে কোরআনের কানুন–আল্লাহর নির্দেশ সংশোধনেও তারা দ্বিধান্বিত নন জন্মনিয়ন্ত্রণ, উত্তরাধিকার বিধানের সংশোধন ও পত্নীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি স্মর্তব্য। তাহলে তাঁদের সংস্কৃতিটা কী বস্তু আর তার স্থিতি কোথায়, বোঝা ভার। তাঁরা পেন্টালুন ও পেন্টালুনের আদলে তৈরি পাজামা পরেন, আসকান-পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি রাখেন, বুফে খান এবং পাওরুটি ও সুপে আসক্ত; তবু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের বড়াই করেন।

    আরো মারাত্মক ব্যাপার এই যে, তারা মুসলিম সংস্কৃতির কথা বলেন না–বলেন ইসলামী সংস্কৃতির কথা। এবং ইসলামী সংস্কৃতি নামটা তাঁদের যথেচ্ছ প্রয়োগে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। নাচ-গান-নাটক-চিত্রকলা প্রভৃতি ইসলামে অবিধেয় বিষয়গুলোও তারা ইসলামী সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। যেমন বুলবুল চৌধুরীর নাচ, নজরুলের গান, মুসলিম চরিত্র নিয়ে রচিত নাটক, আবদুর রহমান চুঘতাইর চিত্র প্রভৃতি এবং যা-কিছু মুঘলাই ও ইরানি–তাঁদের কাছে ইসলামী। এভাবে যা-কিছু মুসলমান করে তা-ই ইসলামী হয়ে উঠেছে; যেমন ইসলামিয়া হোটেল, ইসলামিয়া কলেজ, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, ইসলামিয়া ব্যাঙ্ক, ইসলামিয়া ইস্যুর্যান্স প্রভৃতি।

    আমাদের না হোক, আরব-ইরানির কিংবা মুঘলের একটা সৃষ্টিশীল ও গ্রহণশীল মুসলিম সংস্কৃতি ছিল। য়ুরেশিয়ার সর্বত্র তা যথাকালে অনুকৃতও হয়েছিল। কিন্তু সে তো দূর অতীতের ইতিহাস। আজকের দিনে তার Revival-এর চিন্তা দিবাস্বপ্ন মাত্র। এরূপ চিন্তা দুর্বলতার ও অসামর্থ্যের সাক্ষ্য। এ সংস্কৃতির গৌরব-গর্বে নিষ্ক্রিয় থাকাও বিকৃত বুদ্ধির পরিচায়ক। গৌড় সুলতানের যে-বংশধর আজ অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত দিনমজুর, সে যদি তার খান্দানের গর্ব করে, যথার্থ হওয়া সত্ত্বেও তা মূল্যহীন ও অশ্রদ্ধেয়। কেননা ঐ পরিচয়ের যোগ্যতা হারিয়েছে সে। আমাদেরও যখন আজ বিশ্বকে দেবার মতো কিছুই নেই, আমাদের যখন আজ কেবল গ্রহণ করা ও গড়ে তোলার পালা চলছে, তখন পূর্বপুরুষের মহান সংস্কৃতির কথা বলে নিজেদের হাস্যাস্পদ করা অসমীচীন। কথায় বলে : স্বনামা পুরুষ ধন্য পিতৃনামা চ মধ্যমা। আমরা স্বনামে ধন্য নই, পিতৃনামেও নই পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি যখন জ্ঞানে, কর্মে ও চিন্তায় বিস্ময়করভাবে নিজেদের বিকাশ সাধন করছে, তখন আমরা পূর্বপুরুষেরও নয়–ধর্মীয় ঐক্যের সুবাদে আরব ইরানির অতীত কৃতির আস্ফালনে নিজেদের নিঃস্বতা, নিজেদের অযোগ্যতার লজ্জা ঢাকা দেবার প্রয়াসী। আত্মধ্বংসী এ আত্মপ্রবঞ্চনা কোনো শ্রেয়সের সন্ধান দেবে আমাদের?

    তাই সংস্কৃতির নামে এঁদের রক্ষণশীলতা, গ্রহণবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা আর প্রতিক্রিয়াশীলতা আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত করছে মাত্র। আমাদের প্রগতি ঠেকিয়ে রাখার সামর্থ্য এঁদের ছিল না, কিন্তু ইসলামের নামে জনপ্রিয়তাকামী সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েই এঁরা প্রবল। এভাবে সরকারি প্রশ্রয়ে ও উৎসাহে সংস্কৃতির ও মননের ক্ষেত্রে জনগণের স্বাভাবিক আত্মবিকাশের পথ করেছেন তারা বন্ধুর এবং দেশের rational বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের সুযোগ করেছেন হরণ।

    যে-দল Rationalist, তাঁরা জ্ঞান, কর্ম ও চিন্তার বিস্ময়কর য়ুরোপীয় বিকাশে মুগ্ধ। এতে তারা পেয়েছেন মানব-মহিমার সন্ধান। জীবন-সম্ভাবনার অনন্ত বিস্তার দর্শনে তাঁদের চিত্তলোক আন্দোলিত। জগৎ-রহস্যের নিঃসীম গগনে পাখা মেলতে চায় তাদের মনোবিহঙ্গ। তারা দেহ-মন আত্মার অবগাহন কামনা করেন এই নব-উপলব্ধ চেতনা-সমুদ্রে। চিত্তের এ চেতনালোকে ভূগোল নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই; আছে কেবল মানুষ আর আছে মানবিকতা ও মানবতার বিচিত্র বিকাশের আভাস ও আশ্বাস। অখণ্ডের সন্ধান যে পেয়েছে, খণ্ডে তার মন ভরে না। সমুদ্র-পর্বত যে দেখেছে, নদী আর টিলা তার অবহেলা পাবেই! Rationalist-রাও তাই জীবনকে রাষ্ট্রিক ও ধর্মীয় গণ্ডীর মধ্যে প্রত্যক্ষ করে না, দেখতে চায় নিখিল জগতের পটে। বিচিত্র ও বর্ণালি, বিমূর্ত ও বিমুক্ত অনুভবের সূক্ষ্ম শিকড় চালিয়ে দিয়ে জগৎ-রহস্য ও জীবন-ভাবনার স্বরূপ-চেতনার গভীরে উপলব্ধি করার প্রবণতা এ-যুগে অত্যন্ত প্রবল। সূর্য আজ প্রতীচ্য গগনে। তার আলো ও আলোর প্রসাদ পেয়ে জগদ্বাসী আজ ধন্য ও কৃতার্থ। পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার। যে আনে না–আনতে জানে না, সে হতভাগ্য। মানস-ঐশ্বর্যের দ্বার অবারিত দেখেও যে অবহেলা করে সে কৃপার পাত্র। সমুদ্র সামনে পেয়েও যে তাকিয়ে দেখে না, সে হৃদয়হীন।

    প্রতীচ্যের জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও জীবন-চেতনায় মুগ্ধ আমাদের Rationalist-রা তাই চরম তাচ্ছিল্যে শুচিবাইগ্রস্ত রক্ষণশীলদের বলতে চান : যে-সংস্কৃতি জীবনের প্রয়োজন মিটায় না, আত্মরক্ষার অস্ত্র যোগায় না, রোগের প্রতিষেধক জানে না, সিনেমা-রেডিয়ো-টেলিভিশন-টেলিফোন টেলিগ্রাফ কিংবা জাহাজ-বিমান দিতে পারেনি, যে-সংস্কৃতি বিজ্ঞানে-দর্শনে-সমাজতত্ত্বে-রাষ্ট্রতত্ত্বে, অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্য বিজ্ঞানে কোনো নতুন চিন্তায় সমর্থ নয়; অন্য কথায় যে-সংস্কৃতি আধুনিক জীবন-ভাবনার সহায়ক নয়, জীবনের মানস-সমস্যার সমাধান দেয় না, মনের খোরাক যোগায় না, ব্যবহারিক জীবনের কোনো অভাব মিটানোর যোগ্যতা যাতে অনুপস্থিত; যে-সংস্কৃতি কেবল নরকের ভয় ও স্বর্গের লোভ দেখিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ন্ত্রণে তৎপর; ভাব, চিন্তা, জ্ঞান ও কর্মের উদ্যোগে ও প্রসারে রক্তচক্ষু কিংবা কাতর; যে-সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রেরণা যোগায় না, যে সংস্কৃতি কল্যাণকে গ্রহণেও উৎসাহিত করে না, যে-সংস্কৃতি কেবল ধরে রাখে, কেবলই পিছুটান দেয়, অথচ যা দিয়ে মনও ভরে না, প্রয়োজনও মেটে না, এগিয়ে যাবার দিশাও দেয় না, বেঁচে থাকার উপায়ও বাতলায় না–সে-সংস্কৃতি দিয়ে আমরা কী করব?

    .

    ০২.

    Rationalist-দের কেউ কেউ পড়াশোনা ও দেখার মাধ্যমে য়ুরোপীয় চিত্তের–প্রতীচ্য মনীষার ও জীবন-ভাবনার স্বরূপটি জেনেবুঝে নিয়েছেন। তাদের চেতনায় জগৎ-ভাবনা উদ্দীপ্ত আর মানবিক আকাক্ষার ও জীবন-সমস্যার আঞ্চলিক পার্থক্য অবলুপ্ত। এঁরা শান্তিকামী, স্বস্তিপ্রয়াসী ও বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী। বর্ণ, ধর্ম ও রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতিতে এঁরা সম অধিকার ও সম। সুযোগের ভিত্তিতে সহ-অবস্থান নীতিতে আস্থাবান। এ হল দক্ষিণপন্থীদের কথা। এঁদের মধ্যে যারা বামপন্থী তাঁরা নিজেদের পরিকল্পনামতো বিশ্ব-সংসারকে ঢালাই করতে চান। মানুষের বর্ণ, ধর্ম, মনন ও প্রয়োজনের পার্থক্য স্বীকৃতি পায় না তাঁদের কাছে।

    এ দুই পন্থের অন্যান্যরা কিছু জেনে এবং কিছু শুনে প্রাগ্রসর প্রগতিবাদী আধুনিক মানুষ বলে আত্মপরিচয় দেন। কতগুলো বুলি কপচিয়ে তাঁরা সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবসমস্যা সচেতনতার আভাস দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এরাই যন্ত্রযুগের যন্ত্রণার কথা, অবক্ষয়ের কথা, সমাজের বিবর্তনধারার কথা বলে শ্রোতার মনে চমক লাগিয়ে দেন।

    মানুষের জীবনপ্রবাহে যে অবক্ষয় নেই, যান্ত্রিকতা যে যন্ত্রণার নয়, সমাজ বিবর্তন যে মানুষেরই অগ্রগতির ফল–এসব কথা তাদের বোঝানো যায় না। মানুষের অগ্রগতির তথা চলমানতার লক্ষণই এই যে, তার জীবনবোধ হবে বিচিত্রতর, সূক্ষ্মতর ও তীব্রতর। আর এর ফলে বাড়বে প্রয়োজনবোধ, দেখা দেবে অভাব, উদ্ভব হবে সমস্যার, খুঁজবে সমাধান। ফলে উপায় হবে বিচিত্র, উদ্দেশ্য হবে বিভিন্ন, মত হবে বিবিধ, পথ হবে বহুধা আর ঋজু থাকবে না জীবনচর্যা, সহজ হবে না বেঁচে থাকা। স্বাতন্ত্রে কিংবা আত্মনির্ভরশীল হয়ে চলা হবে অসম্ভব। পৃথিবীর মানুষ কেবল পারস্পরিক সহযোগিতায় বাঁচবে। মানুষ ফেরেস্তা নয়, অতএব জীবনযাত্রা হবে জটিল ও দুঃসাধ্য। দেখা দেবে দ্বন্দ্ব, লাগবে লড়াই, বাধবে সংঘর্ষ, এড়ানো যাবে না সংঘাত। তা হবে ব্যক্তিক, পারিবারিক, দৈশিক ও রাষ্ট্রিক। অতএব দোষ যন্ত্রের নয়, কারণও অবক্ষয় নয়, সমাজ কাঠামোও দায়ী নয় এর জন্যে। মানুষের লোভ ও কল্যাণবুদ্ধির অভাবই এর জন্যে দায়ী। তাই জীবন সংগ্রামের শেষ নেই। মানুষ যতই এগুবে, যতই দিন যাবে, সংগ্রামও হবে বিচিত্রতর, কঠিনতর আর জটিলতর। সে সংগ্রাম করবে প্রবৃত্তির ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে, অভাবের ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে, রোগ ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে।

    আর দেশ ও ধর্মের প্রতি অনুরাগ স্বাভাবিক মানুষের আজন্মের সংস্কার। স্বদেশ প্রেমিক ও সুনাগরিক মাত্রই স্বভাবত নিজের রাষ্ট্রের স্বার্থসচেতন। রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সে নিজের স্বার্থেই বিস্মৃত হতে পারে না, পারে না অবহেলা করতে। আর কোনো আস্তিক মানুষই তার ধর্মীয় চর্যায় আকর্ষণ হারায় না। কাজেই এ ব্যাপারে কারো উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠ হওয়ার কারণ দেখিনে।

    আমাদের দুর্দিন বলছি এজন্যে যে আমাদের একদল এগুতে চান না, তাঁরা সংগ্রাম-বিমুখ। স্থিতির মধ্যেই তাঁরা স্বস্তি খোঁজেন, পূর্বপুরুষের রিকথ সম্বল করে নিশ্চিন্ত হতে চান। তাঁরা আকাভ ক্ষাহীন, অনিশ্চয়তায় পা বাড়াতে অনিচ্ছুক তারা। আত্মরক্ষণই তাঁদের কাম্য, আত্মপ্রসারে আগ্রহ নেই।

    আর এক দলের সাধ আকাশ-ছোঁয়া। কিন্তু সাধ্য সামান্য। তাদের আকাঙ্ক্ষা প্রবল কিন্তু যোগ্যতা অর্জনে আগ্রহ ক্ষীণ, সাধনায় উৎসাহ দুর্লক্ষ্য। তাই সৃষ্টিশীল তো নয়ই, গ্রাহিকাশক্তিও তাঁদের সুষ্ঠু নয়। তাই আজো আমরা অনুকারক মাত্র। মনের দিক দিয়ে সুস্থ ও স্বস্থ কেউই নন। একদলের দৃষ্টি দূর অতীতের আরব-ইরান পানে। আর এক দল তাকিয়ে আছেন সুদূর পিকিং, মস্কো কিংবা লন্ডন-প্যারিস-নিউইয়র্কের দিকে। এসব কারণে আমাদের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচট্টগ্রামের ইতিহাস – আহমদ শরীফ
    Next Article আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট – আহমেদ রিয়াজ

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }