Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প450 Mins Read0

    বঙ্কিম-মানস

    ০১.

    আলোচনার সুবিধের জন্যে সাহিত্য-শিল্প সম্বন্ধে আমার স্কুল ধারণাটি প্রথমেই জানিয়ে রাখছি। মাটি থেকেই ঘাস জন্মায়, তাই বলে মাটি আর ঘাস এক জিনিস নয়। তেমনি কাঁচামাটি আর পোড়া ইট এক বস্তু নয়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তাদের জ্ঞাতিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব, হয়তো সহজও, কিন্তু সাহিত্য সে-রকম কোনো পদার্থ নয় যে তাকে কতগুলো উপাদানের সমষ্টি মাত্র বললেই তার স্বরূপ বোঝা যাবে। শব্দের মধ্যে পদের যে অর্থগত তফাৎ, অভিধানের শাব্দিক অর্থ আর কাব্যের চরণান্তৰ্গত পদের অভিধা যেমন ভিন্ন, তেমনি সাহিত্য আর সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে তফাৎ বিস্তর। এ কারণেই বিষয়বস্তুর উচ্চতা কিংবা তুচ্ছতা সাহিত্য-রসের পরিমাপক নয়। শিল্প বলতে যে-কথাটি আমরা বুঝতে ও বোঝাতে চাই তা বিশ্লেষণ-সাধ্য নয়। মাটি থেকে ঘাস হল, এ আমরা দেখলাম, কিন্তু কেমন করে হল তা বোঝানো যায় না। যে-কোনো লিখিত রচনাকেই যদি সাহিত্য বলে ধরা যায় তাহলে লেখাপড়া-জানা লোক মাত্রই লেখে এবং সব লেখাই সাহিত্য। কিন্তু সেসব রচনাকে সাহিত্য বলি না। সে কি কেবল বিষয়বস্তুর তুচ্ছতার জন্যে? তাহলে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির ঘরোয়া চিঠিপত্র পর্যন্ত সাহিত্য হল কী করে? আদিকালের সেই তত্ত্ব এবার স্মরণীয় শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্টত্যগ্রে আর নীরস তরুবরঃ পুরতো ভার্তি। অথবা একালের সোনার হাতে সোনার কাকন কে কার অলঙ্কার কিংবা তেলা মাথায় তেল–এগুলির যে-কোনো একটি শব্দ পাল্টালেই সব সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন কোনো মুখের ছবিতে একটি তিল এদিক-ওদিক করলেই মুখের আদলই যাবে বদলে। সাহিত্য-শিল্প তেমনি একটি অনুভব-সাধ্য ব্যপার। ওটি থাকে তো রসও রইল, শিল্পও রইল। আর যা শিল্প তা-ই রস এবং তা-ই সাহিত্য। শিল্প-রস, কিংবা সৌন্দর্য সবকিছুর মূলে রয়েছে মানবিক রস, ইংরেজিতে যাকে বলে Human interest- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ না থাকলে তা মানুষের পছন্দসই হতেই পারে না। আর যা তৃপ্তি দেবে না, চেতনায় ঘা দেবে না, তা সাহিত্য নয় নিশ্চয়ই। আবার অনেক সময় মানবিকতা থাকলেও যেমন মানবিক রস জন্মাতে পারে, তেমনি এর অভাব ঘটলেও মানবিক রসের অভাব হয় না। চিত্তের উল্লাসই শুধু কাম্য নয়, চিত্ত বিক্ষোভও উৎকৃষ্ট সাহিত্য-রস হতে পারে; যেমন করুণ, ভয়ঙ্কর, বীভৎসাদি রস।

    কাব্যের সুষমা ও ব্যঞ্জনার যেমন তর্জমা হয় না, সাহিত্য-শিল্পও তেমনি ব্যাখ্যান্তৰ্গত নয়। সংস্কার বশে আমরা সাহিত্যের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিচ্ছবি পেতে চাই বটে, কিন্তু তা সাহিত্যসৃষ্টির বা পাঠের মূল লক্ষ্য নয়। তার প্রমাণ আমরা কাজের কথা কেজো করে না বলে প্রত্যক্ষকে পরোক্ষ করে, ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে ও রসিয়ে বলি। সৌন্দর্য আমাদের প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক জীবনে কাজে আসে না। সাহিত্য সৃষ্টির ও পাঠের পেছনেও কোনো প্রয়োজনের প্রেরণা থাকতে পারে না। আমাদের দেশে তাই সাহিত্যও একটি কলা এবং নন্দনতত্ত্বের অন্তর্গত। কিন্তু আমরা তো কেবল সৌন্দর্যচর্চায় বাঁচিনে। আমাদের রয়েছে জীবন, সমাজ ও ধর্ম। তাই আমাদের বিষয়বুদ্ধি সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রয়োজনকেও পেতে চায়। কেননা সৌন্দর্য-পিপাসা অল্পেতে এবং ক্ষণিকে মেটে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনবোধের শেষ নেই। এ কারণেই পুরোনো সাহিত্যে আমরা সৌন্দর্যের সাথে নৈতিক বা ধার্মিক আদর্শের প্রতিফলনও কামনা করেছি। ন্যায়ের জয় ও অন্যায় বা অধর্মের ক্ষয় দেখবার আগ্রহই প্রধানত পাঠক বা শ্রোতাকে সাহিত্যরসিক করে তুলত। এ-যুগের পাঠক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আদর্শ খোঁজে। আমরা ভুলে যাই যে এ Utility হচ্ছে আনুষঙ্গিক তথা by product. তাই এর উপরই সব গুরুত্ব দিলে সাহিত্য-শিল্প গৌণ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে কাঞ্চন ফেলে আঁচলে গেরো দেয়ার বিড়ম্বনাই ভোগ করতে হয়। আজ পাঠক ও সমালোচক সাহিত্যে সেই বিড়ম্বনা-জালই বিস্তার করছেন। তাই কথায় কথায় পশ্চাৎমুখিতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং প্রগতিবাদিতা সাড়ম্বরে উচ্চারিত হয়। এই বিড়ম্বনার খপ্পরে পড়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। এর কিছুটা তার আত্মকৃত পাপ।

    .

    ০২.

    বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন য়ুরোপীয় জীবন-মহিমায় মুগ্ধ। কিন্তু তিনি সম্বিৎ হারাননি। তাই তিনি জীবনের সাধনা ও আবাহন করেছেন জীবনব্যাপী নিজের জন্যে নয়-বাঙালি হিন্দুর জন্যে। (বঙ্কিমচন্দ্রের মানস-গঠন যুগে বৃটিশ-ভারত গড়ে উঠেনি, তাই বঙ্কিমে ভারতীয় জাতীয়তা নেই; আছে বাঙালি হিন্দু-জাতীয়তা।বঙ্কিমের স্বদেশও ভারত নয়, বাঙলা দেশ)। কিন্তু অভিমানী, তীক্ষ্ণ আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও অতিমাত্রায় স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে য়ুরোপের এ মহিমা প্রকাশ্যে স্বীকার করায় কিংবা বরণ করায় বাধা ছিল; সে-বাধা জাতীয় মর্যাদার অভিমানপ্রসূত। তাই তিনি খিড়ফিপথেই য়ুরোপের অবদান অঞ্জলিভরে গ্রহণ করলেন। বলা চলে, রৌদ্রশ্রান্ত লোকের মতো পরম তৃপ্তিতে অবগাহন করলেন। তাই শাড়ি-সিঁদুর পরা মেমসাহেবই তার আদর্শ নারী। তেমনি মর্যাদায়, সাহসে ও পৌরুষে দৃপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ানই তার আদর্শ পুরুষ। সেজন্যে বহুপত্নী ও উপপত্নীর দেশে ভ্রমর, সূর্যমুখী, মতিবিবি চরিত্র সম্ভব হল। মাতৃঘটিত কলঙ্কের জন্যে যে-নারীকে স্বামীঘর ছাড়তে হয়, সে প্রফুল্ল পরপুরুষের সঙ্গে দেশময় ঘুরে বেড়ানোর পর স্বামীগৃহে আদর্শ বধূরূপে বরণডালা পায়। যে জাতিদ্রোহী রাজপুতেরা মুঘলের কাছে আত্মবিক্রয় করেছিল, সে রাজপুতের স্বাজাত্যবোধে ও স্বদেশপ্রেমে এত মহিমা আরোপিত হল। তাঁর প্রথম নায়ক জগৎসিংহ মানসিংহের সন্তান।

    অনুকরণের অপবাদ সহজে কেউই গ্রহণ করতে চায় না। বঙ্কিমচন্দ্র অতিমাত্রায় এই দুর্বলতায় ভুগতেন। তাই তিনি অন্তরে যত য়ুরোপমুখী, বাইরে তার বিরূপতাও তত অধিক। এমন অবস্থায় সাধারণত দু-কূল রক্ষা করা যায় না। বুদ্ধিমানের চোখে বঙ্কিমচন্দ্রের এই দুর্বলতা ঢাকা রইল না। তাঁর কৃষ্ণ উনিশ-শতকী আদর্শ রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রভাবজ সৃষ্টি। তাঁর সাম্যবাদে দু-কূল রক্ষার অপচেষ্টা প্রকট এবং তার ধর্মতত্ত্ব পাশ্চাত্য Rationalism-এর অপপ্রয়োগে দুষ্ট।

    যে উপকৃত হতে চায় অথচ কৃতজ্ঞ হতে চায় না, সে আর যাই হোক নৈতিক বলে বলী নয়; তার চরিত্র দ্বিধামুক্ত হতে পারে না, এবং তার আচরণ ও কর্ম সহজ ও ঋজু হয় না। এজন্যে বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তায় প্রত্যয়দৃঢ়তা ও উদারবিস্তার নেই; অসামঞ্জস্য আছে অনেক। তিনি খিড়ফি দোর দিয়ে য়ুরোপের প্রসাদ লুট করতে চাইলেন, কিন্তু সদর দরজা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে কিছু গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। ফল দাঁড়াল এই যে, শেষ বয়সে যখন তিনি আগের মতো স্থিতধী রইলেন না, তখন আন্তরিক উত্তেজনায় য়ুরোপের সাহিত্য-দর্শন ও সভ্যতার প্রতিই যে কেবল অবজ্ঞা দেখালেন, তা নয়, হিন্দুয়ানীর মহিমা প্রচার না করে উপন্যাস লিখে সময় নষ্ট করেছেন বলে আফসোসও করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ বয়সের এই উগ্রতা ও একগুয়েমি তার স্থায়ী কলঙ্ক।

    এই একই কারণে তিনি নিজে প্রগতিবাদী ও জাতিগত-প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় উন্নয়নমূলক কোনে কাজে বা আন্দোলনে তাঁর সমর্থন ও সহযোগিতা মেলেনি বরং বিরূপতা দেখিয়ে নিজের ওজন হালকা করেছেন। এসব কাজ বা আন্দোলন মন্দ বলে যে তিনি দূরে সরে ছিলেন তা নয়, আসলে তাঁর অদ্ভুত অভিমান ও স্বাতন্ত্র্য-প্রীতিই তাঁকে অসামাজিক ও উৎকেন্দ্রিক করে রেখেছিল। এই উৎকেন্দ্রিকতা বজায় রাখার দায়ে পড়েই তাকে কৃত্রিম অনুদারতা ও রক্ষণশীলতার অভিনয় করতে হয়েছিল। কেননা বঙ্কিমচন্দ্র কমকের কথায়, ভাষার ব্যাপারে কমলাকান্তের দপ্তর, লোকরহস্য প্রভৃতি বিবিধ রচনায় ও প্রবন্ধে উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। এই মনস্তান্ত্রিক জেদের প্রতিকার তাঁর মতো প্রতিভা ও মনস্বীও হাতে ছিল না; বিস্ময় এখানেই এবং এ কারণেই। সমকালীন কৃতী পুরুষদের সঙ্গেও তিনি তেমন সৌহার্দ্য স্থাপন করতে পারেননি তাঁর এই আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের জন্যেই। খুব কম লোকের সঙ্গেই তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল।

    বঙ্কিমচন্দ্র যা-কিছু লিখেছেন তা কেবল হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর উন্নতির জন্যেই। এমন যে রোমান্টিক রচনা কপালকুণ্ডলা, তাতেও মতিবিবির মাধ্যমে হিন্দুয়ানীকেই (হিন্দুসতীর পতিপ্রাণতাকে) মহিমান্বিত করেছেন। যে বঙ্কিমচন্দ্রের দিনের সাধনা ও রাত্রির স্বপ্ন ছিল ধর্মে, সমাজে ও রাষ্ট্রে হিন্দুকে আদর্শ মানুষ ও জাতি হিসেবে দাঁড় করানো, তার এ ধরনের প্রচেষ্টার আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

    বঙ্কিমচন্দ্র নিজে সাহিত্যে একমাত্র utility-বাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সাহিত্যের সেই বিচারে যদি আজ তিনি ঘায়েল হন, তবে কর্মদোষে আস্থা রাখা ছাড়া উপায় কী? বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গাঁয়ের বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন সেকালের হুগলী কলেজে। তাঁর মানস গড়ে উঠেছিল বই পড়ে আর গাঁয়ের পুরোনো ধরনের পরিবেশে। কাজেই কলকাতা শহরের মুক্তবুদ্ধি শিক্ষিত তরুণের মনের স্পর্শ তিনি পাননি। তাঁর অহেতুক ও নিরর্থক অভিমান জিইয়ে রাখার অবাঞ্ছিত সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন এভাবেই।

    এসব সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র এযাবৎ শ্রদ্ধার আসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই আসীন রয়েছেন। উনিশ তকে এ শ্রদ্ধা তিনি পেয়েছিলেন অসামান্য শিল্পী ও রোমান্স-রচয়িতা হিসেবে। তিনি লেখক তথা শিল্পী হিসেবে ছিলেন উনিশ শতকের বাঙলার বিস্ময়। আর বিশ শতকের গোড়ার দিককার বিপ্লবীদের (অরবিন্দ ঘোষ প্রভৃতির) বদৌলতে আনন্দমঠ, রাজসিংহ, সীতারাম প্রভৃতির জন্যে তিনি হলেন ঋষি। এ পর্যায়ে তাকে আর শিল্পী কিংবা সমাজবেত্তা হিসেবে যাচাই করবার অবকাশ বা প্রবৃত্তি কারুরই রইল না। তিনি হিন্দুজাতীয়তা ও স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রদ্রষ্টা ও উদ্গাতা ঋষিরূপেই কেবল পূজা পেতে থাকলেন। [ অথচ তখনই স্বাধীনতা চাওয়া অনুচিত- এটাই ছিল উপন্যাসগুলোতে বঙ্কিমের প্রতিপাদ্য। তখন য়ুরোপীয় আদলে শিক্ষিত ও উদ্যোগী মানুষ তৈরি করাই তার লক্ষ্য।

    আজ স্বাধীনতা-উত্তর যুগে যখন সে প্রয়োজন মিটে গেছে, তখন বঙ্কিমের মন-মনন ও লেখা নিয়ে সমালোচনা–বিজ্ঞানসম্মত চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ চলবে। এ ধোপে utility-বাদী সমালোচকের দৃষ্টিতে বঙ্কিম জাতির শিরোমণিও হতে পারেন, আবার শিল্পী ও মনীষীকুলকলঙ্ক বলে নিন্দিতও হতে পারেন, দুই সম্ভব। আমার ধারণা, হবেনও তাই। কিন্তু কেবল শিল্পী হিসেবে যেসব সমালোচক তার যোগ্যতা যাচাই করবেন, সেসব রসগ্রাহী পাঠক-সমালোচকের বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তলোকে তার মর্যাদার আসন অক্ষয় হয়ে থাকবে। এ শ্রেণীর লোকের কাছে বঙ্কিম কী বলেছেন তা বড় নয়, কেমন করে বলেছেন তা-ই দ্রষ্টব্য।

    উনিশ শতকী শূন্যতায় বঙ্কিমের আবির্ভাব ও সৃষ্টি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। মধুসূদনও প্রতিভা কিন্তু তার প্রভাব ছিল সীমিত। আমরা যদি প্রত্যেক মানুষের স্বভাবের ও মননের বৈচিত্র্য স্বীকার করে নিই, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবাদর্শের জন্যে তাকে মোটেই দোষ দেয়া যায় না। আমাদের পছন্দসই হল না বলে তা মন্দ হতে পারে না।

    কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আমাদের ক্ষোভ এই যে তাঁকে আমরা যুগন্ধর ও যুগোত্তর প্রতিভা বলে জানতাম। এতকাল পরে যখন তার সম্বন্ধে আচ্ছন্নভাব কেটে গেছে, তখন দেখতে পাচ্ছি–তাঁর অপূর্ণতা এবং প্রতিভাসুলভ মৌলিকগুণের অভাব। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক, পেয়েছি তার চাইতে কম, তাই এত ক্ষোভ।

    তিনি উনিশ শতকের শেষার্ধের লোক হয়েও এবং তাঁর সমকালের য়ুরোপীয় নাস্তিক্য দর্শন, সংশয়বাদ, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রদর্শন, সমাজ প্রভৃতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান এবং ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, মার্কস ও ডারুইন মতবাদের সঙ্গে পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তিনি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় হিন্দু-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর ধারণায় হিন্দু রাজত্ব হলেই হিন্দুজাতির প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙলাদেশে উনিশ শতকের শেষার্ধেও হিন্দু রাজত্ব ছিল দিবাস্বপ্ন মাত্র। যে য়ুরোপ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেখানে যে গণতন্ত্রের বীজ সর্বত্র উপ্ত হচ্ছে এই উচ্চাভিলাষী মনীষীর তা নজরে পড়ল না। কেবল শাসনে নয়, শিক্ষা ও ধনাগম সংস্থাতেই যে তথা অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপরই যে এ-যুগের উন্নতির বীজ নিহিত একালের রাষ্ট্রসংস্থার ভিত্তি রচিত, তা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের উপলব্ধির বাইরে। তিনি হিন্দুর বাহুবল ও চরিত্রবলের ধ্যান করতেন। জ্ঞানবল ও ধনবল তাঁর চিন্তায় গুরুত্ব পায়নি; অথচ এ-যুগে শক্তির উৎস হচ্ছে এ দুটোই। বাঙলাদেশে মুসলমানকে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দুর স্বাধীনতা-বাঞ্ছ যে পূর্ণ হবার নয়– এ বাস্তব বুদ্ধি তাঁর কাছে প্রশ্রয় পায়নি। ফলে তাঁর সাধনা আপাত সফল হলেও পরিণামে ব্যর্থ হল।

    হিন্দু-মুসলমান কি কোনোকালে একজাতি ছিল যে বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া যাবে? বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বিজাতি-বিদ্বেষী। সাধারণভাবে বিচার করলে এতে অন্যায়-অস্বাভাবিকতা কিছুই পাওয়া যাবে না। কেননা বঙ্কিম যে-মুসলমানকে গাল দিয়েছেন, তারা তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠী। যে বিদেশী বিজাতি ও বিধর্মী এদেশে চেপে বসল আর দেশবাসীর স্বাধীনতা ও সম্পদ কেড়ে নিল, তাদের প্রতি বিরূপ থাকাই তো স্বাভাবিক ও শোভন। সহজাত এই বিরূপতা দেশী মুসলমানের গায়েও লাগল, কেননা ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে এবং আভিজাত্যবোধে দেশী মুসলমানেরাও নিজেদের তুর্কী-মুঘলের জ্ঞাতি ভাবতে শিখেছে। যেমন দেশী খ্রীস্টানরা স্বজাতি ভেবেছে ইংরেজকে। শাসক-শাসিতের পূর্বসম্পর্ক স্মরণ করে উনিশ শতকের হিন্দু লেখকমাত্রই মুসলমানদের প্রতি কমবেশী বিরূপতা দেখিয়েছেন। সে-বিরূপতা বিদ্বেষ ও বিদ্রূপ-রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি মধুসূদনের মতো সংস্কারমুক্ত প্রতিভাও এ দোষ থেকে মুক্ত নন। তার প্রহসনে মিয়াজান ও কৃষ্ণকুমারী নাটকে যবন–অপহৃতা পদ্মিনী প্রসঙ্গ স্মত। তবু অন্যদের কথা আলোচ্য নয় এজন্যে যে তাঁরা কেউ প্রভাবশালী ছিলেন না। কিন্তু বঙ্কিম যুগস্রষ্টা প্রতিভা বলে স্বীকৃত। কাজেই তাদের পক্ষে এ অনুদার ও অবিজ্ঞজনোচিত মনোভাব দুষণীয়। শাসক-শাসিতের পূর্ব সম্পর্ক যা-ই থাক না কেন, ইংরেজ-শাসনে যখন হিন্দু-মুসলমানের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা, তখন দূরদর্শী জাতিপ্রাণ মনীষীর কর্তব্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের সংহতি সাধনা করা। বঙ্কিমের মনন-দৈন্য এখানে যে, তিনি প্রয়োজন-সচেতন ছিলেন না। একচক্ষু হরিণের মতো তিনি হিন্দু-জাগরণের চারণ কবি ব্রতকেই বড় মনে করেছেন, দেশের সামগ্রিক স্বার্থের দিকে নজর রাখেননি। তাই তিনি হিন্দুর ঋষি হলেন বটে, কিন্তু দেশের চিন্তানায়কের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রইলেন।

    আত্যন্তিক আত্মরতি পরপ্রীতির পরিপন্থী। বঙ্কিম স্বজাতিকে বড় ভালোবাসতেন। তাঁর চিন্তা, ধ্যানধারণা সবই একান্তভাবে হিন্দুর জন্যে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোনো নীতি-উপদেশে মানুষকে সহজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না-বরং প্রতিহিংসা বৃত্তি উসকিয়ে দিলে সহজেই উত্তেজনা সৃষ্টি করা সম্ভব। তিনি বাস্তবে করলেনও তাই। যেহেতু ইংরেজ শাসক, সেহেতু ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিহিংসা-বৃত্তি জাগিয়ে তুললে সমূহ বিপদ। তাই তিনি হিন্দুদের মনে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির জন্যে পুরাতন দুশমন (বর্তমানে মৃত হলেও) মুসলমানদের বিরুদ্ধে (আসলে তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠীই লক্ষ্য) হিন্দুদের উত্তেজিত করে তুললেন–নানা সত্য ও কাল্পনিক অত্যাচারের ও অমানুষিকতার চিত্র তুলে ধরে। হিন্দু উত্তেজিত হল। বলা চলে হিন্দুমনে মুসলিম বিদ্বেষের সাথে সাথে স্বাজাত্য ও স্বদেশপ্রেম জাগল–হিন্দু জাতি গড়ে উঠল, কিন্তু ভাঙল মুসলমানের মন। ক্ষুব্ধ হল শিক্ষিত মুসলমান। [মুসলমান-এর পরিবর্তে তুর্কী কিংবা মুঘল শব্দ ব্যবহার করলে কোনো বিদ্বেষ-তিক্ততাই হয়তো সৃষ্টি হত না।]

    মুসলমান ছিল এদেশে শাসক জাতি। তাদের উত্তম্মন্যতা শাসিতের প্রতি হয়তো অবজ্ঞার সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু বিদ্বেষ তাদের ছিল না। তাই ইংরেজ যখন তাদের শাসন-ক্ষমতা কেড়ে নিল, তখন ইংরেজকে তাড়াবার জন্যে তারা নিজেরা সগ্রাম করল এবং হিন্দুদের সহযোগিতাও করল কামনা। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যই তাদের প্রধান কাম্য ছিল; এবং ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দ অবধি মুসলমানগণ হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্যের ভিত্তিতে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামী মনোভাব বজায় রেখেছিল। এরপরে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমানরা ব্রিটিশের প্রতি সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। অবশ্য এরপরও যারা ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজ-বিরোধী হয়ে রইলেন, তাঁরাই পরবর্তীকালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক জাতীয়তা গড়ে তুলবার সাধনা করেন। ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চলে এ সাধনা সাফল্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাঙলাদেশে মুসলমানেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের হাতে পীড়িত হচ্ছিল বলে বঙ্কিমকেই হিন্দুমানসের প্রতীক ধরে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল ১৯৩৭ সাল থেকে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বাঙলায় নয়, বঙ্কিম সাহিত্য প্রভাবিত বাঙলাতেই অখণ্ড জাতীয়তায় ফাটল ধরল এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাঙলাদেশে মুসলিমলীগের ভিত্তি দৃঢ় মূল হল। এরপর এল দাঙ্গা, এল আজাদী। পাকিস্তান কায়েম হল। আমাদের ধারণা প্রতিভামাত্রই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, স্থিতধী ও বাস্তব সমস্যা-সচেতন। কিন্তু এ তৌলে বঙ্কিম টেকেন না।

    .

    ০৩.

    এবার বঙ্কিমচন্দ্রকে আদর্শবান শিল্পী ও উদ্দেশ্যমূলক রোমান্টিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে বিচার করা যাক। এজন্যে কিছু ভূমিকার দরকার।

    শহর কলকাতা গড়ে ওঠে পালিয়ে আসা লোক নিয়ে। জব চার্নক থেকে শুরু করে হিন্দু মুসলমান সবাই এল এভাবেই। কেউ এল আত্মরক্ষার জন্যে, কেউ এল আত্মগোপনের জন্যে আর বেশির ভাগ এল আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রসারের উদ্দেশ্যে। কাজেই দেশ ও সমাজ থেকে বিচ্যুত জনসমষ্টি নিয়ে গড়ে উঠল নতুন বন্দর কলকাতা। এসব লোকের কিছুটা অনন্যতা স্বীকার করতে হয়; তাদের উচ্চাভিলাষ, অধ্যবসায়, বিপদের ঝুঁকি নেবার সাহস, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি নিশ্চয়ই ছিল। ইংরেজ বেনের বানিয়ান হয়ে ওরা নিজেদের ভাগ্য তৈরি করতে থাকে। তারপর পলাশীর যুদ্ধের পর যখন শাসক-শাসিতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে ও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে পাশ্চাত্য মন-মনন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হল, তখন তাদের মানস-দৈন্য ও ঘরোয়া দীনতা তাদের মনে তীব্র গ্লানিবোধ জাগাল। য়ুরোপীয় রেনেসাঁস প্রসূত Rationalism যে-স্বরূপে সেদেশে প্রকাশ পেল, তা সেদেশেরই ধর্মে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও ব্যক্তিজীবনে বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তন এনেছিল। নবলব্ধ বিজ্ঞানবুদ্ধির আলোকে তারা পুরোনো বিশ্বাস ও সংস্কারের সঙ্গে পুরাতন সমাজ, ধর্ম, আর ব্যক্তি-জীবন-ধারণাকেও পাল্টাল। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে এই নতুন মূল্যবোধের ফলে সেদেশের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারীর মর্যাদা, স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, মানবতা, যুক্তিবাদ প্রভৃতি বিশেষ গুরুত্ব পেল। যার ফলে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, সমাজজীবনে সংস্কারমুক্তি, ধর্মে আচার শৈথিল্য, ব্যক্তিজীবনে ন্যায়নিষ্ঠা ও বন্ধনমুক্তি, মুখে মানবপ্রীতি, মন-মননে দ্বন্দ্ব অত্যধিক বিজ্ঞানানুগত্য, যুক্তিবাদে আস্থা প্রভৃতি শিক্ষা, সুরুচি ও আভিজাত্য প্রকাশের কৃত্রিম-অকৃত্রিম অবলম্বন হল। বিজ্ঞানভিত্তিক নাস্তিক্য ও সংশয়বাদই এ-যুগের দর্শনের মূল আলোচ্য।

    ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের মাধ্যমে কলকাতার শিক্ষিতজনেরা য়ুরোপের এই মানস-সম্পদ লাভ করে আশায়-উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়ে উঠল। তাদের নিস্তরঙ্গ নিশ্চিন্ত জীবনে যে বিচলন এল, অনভ্যস্ত চোখে হঠাৎ যে-আলো ঝলসিয়ে উঠল, তাতে টাল সামলানো সম্ভব ছিল না। রাজা রামমোহন রায় থেকে এজুরা পর্যন্ত সবাই তাই বেশ কিছুকাল উত্তেজনায় অস্থিরচিত্তে ছুটোছুটি করেছেন। সবারই মনের কথা, বদলাও–পাল্টাও, নতুন কিছু করো। এর তাৎপর্য ও স্বরূপটি বুঝে নিতে হবে। গরিব যখন অপ্রত্যাশিতভাবে ধনী হয়, কিংবা কোনো ভুঁইফোড় ব্যক্তি শিক্ষিত হয়ে বড় চাকুরে হয়, তখন সে তার জীবনের মান উন্নয়নের জন্যে বড় ব্যস্ত হয়ে ওঠে! রুচি পালটিয়ে রাতারাতি সংস্কৃতিবান হয়ে অভিজাতশ্রেণীর একজন হবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। গত শতকের কলকাতার শিক্ষিত-মনেও পাশ্চাত্য প্রভাবে এমনি আকুলতা জেগেছিল পাশ্চাত্য আদর্শে জীবনযাপনের জন্যে এবং পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলবার আগ্রহে! তাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের পরিবার ও সমাজ। গোটা জাতির কথা কেউ ভাবেনি। বিশেষ করে তা তখনি সম্ভব বলে কল্পনা করাও ছিল দুঃসাধ্য। তাই রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণ প্রমুখ সবাই যা-কিছু করেছেন তা কলকাতার ভেতরেই। এ হচ্ছে কলকাতার হঠাৎ-জাগা ধনী ও ভূঁইফোড় ইংরেজিশিক্ষিতদের পরিবার ও সমাজ গড়ে তোলার আন্দোলন। এ যুগে শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন গোটা জাতির উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হতে পারে এবং হয়ও। তার কারণ মফস্বলের লোকেরাও শিক্ষিত এবং খবরের কাগজ ও বইপত্রের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের বাহ্য ও মানস-দূরত্ব ঘুচে গেছে। কিন্তু উনিশ শতকী আন্দোলনের এ ব্যাখ্যা চলতে পারে না। তাদের অবচেতন মনে গোটাজাতির চিন্তা যদি থাকেও তা ছিল একান্তভাবে পরোক্ষ, আকস্মিক এবং অপ্রধান। সুতরাং আমাদের উনিশ শতকী রেনেসাস ছিল একান্তই আত্মকেন্দ্রিক এবং সংকীর্ণ চেতনার প্রসূতি। তখনো তার হিন্দু চেতনার উর্ধ্বে উত্তীর্ণ হয়ে বাঙালি জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেনি। তাই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণের কর্ম ও চিন্তার মধ্যে সংখ্যাগুরু মুসলমানকে পাইনে।

    এ সময়কার হিন্দু, মুসলমান ও ইংরেজ–এই ত্রৈকোণ সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণেও মূল্যবান তত্ত্ব পাওয়া যাবে। একটা দৃষ্টান্ত নিলে এ সম্পর্কের স্বরূপটি ধরা সহজ হবে। ১৯৪২ সনে চক্রবর্তী রাজাগোপাল আচারিয়া পাকিস্তান-দাবীকে মেনে নেয়ার ও জাপানির সাহায্যে ইংরেজ তাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অথচ এ দুটোর একটাও কংগ্রেসের আদর্শ ও লক্ষ্যানুগ ছিল না। ব্রিটিশের প্রতি বিরাগ ও আজাদী-বাঞ্ছার তীব্রতাই রাজা গোপালকে এমনি আদর্শবিরোধী ভাবনায় প্রেরণা যুগিয়েছিল।

    অনুরূপভাবে সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলমান শাসনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা ও বিদ্বেষ হিন্দুকে মুসলমানবিরোধী ও অসহিষ্ণু করে তুলেছিল। অন্তরে আজাদী লাভের বাসনা থাকলেও বাস্তবে তা তাদেরকে সংগ্রামী করে তুলবার মতো তীব্র ছিল না। তাই লাঞ্ছিত চাকুরের মনিব বদলের স্বস্তি ও আনন্দই তারা পেতে চেয়েছিল। শাসনদণ্ড মুসলমানের থেকে ব্রিটিশের হাতে যাওয়ায় তারা এই স্বস্তি ও আনন্দই লাভ করেছিল। উনিশ শতকের হিন্দু বাঙালির উল্লাস এই মনোভাবেরই ফল এবং স্বাক্ষর। পুরোনো মনিব মুসলমান যখন ব্রিটিশ-বিরূপতায় মনে, ধনে ও মানে খর্ব হচ্ছিল, তখন হিন্দুমনের পুরোনো বিদ্বেষ-বিদ্রূপ, বিরূপতা ও অবজ্ঞারূপে প্রকাশ পেতে থাকে। এর অনপনেয় সাক্ষ্য বহন করছে উনিশ শতকের হিন্দুর রচনা। শত্রুর দুর্ভোগে বিদ্বিষ্ট মনে যে উল্লাস জাগে তারই আভাস পাই উনিশ শতকের হিন্দুর বচনে ও আচরণে। এ সূত্রে সিপাহি বিপ্লবকালে তৃপ্তমন্য বাঙালি হিন্দুর ভূমিকাও স্মর্তব্য।

    মুসলমানেরা ছিল শাসকের জাতি। প্রজা হিন্দুর প্রতি তাদের বিদ্বেষ থাকার কথা নয়, বরং থাকতে পারত তাদের উত্তম্মন্যতাজাত অবজ্ঞা। অবজ্ঞা অনুকম্পা ও তাচ্ছিল্য জাগায়, বিদ্বেষ ও বিরূপতার রূপ নেয় না কখনো। কাজেই ইংরেজ যখন তাদের হাত থেকে রাজ্য কেড়ে নিল, তখন তারা ব্রিটিশের সঙ্গে সংগ্রামে হিন্দুর সহযোগিতা কামনা করেছিল। এইজন্যে উনিশ শতকের মুসলিম-মানসে হিন্দু-বিদ্বেষ ছিল না বরং প্রয়াস ছিল হিন্দুকে কাছে টানবার। কংগ্রেস-পূর্ব যুগের এবং কংগ্রেসের সগ্রামকালীন ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য স্যার সৈয়দ আহমদ হিন্দুর ব্রিটিশ-প্রীতি ও সহযোগিতার আত্যন্তিকতা দেখে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পরিণাম চিন্তা করে ব্রিটিশের প্রতি মুসলমান সমাজেও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে তৎপর হন। এই প্রচেষ্টা অবশ্য সৈয়দ আহমদ, আমীর আলী, আমীর হোসেন, আবদুল লতিফ, সলিমুল্লাহ, আগাখান প্রমুখ একশ্রেণীর ইংরেজিশিক্ষিত লোকের প্রয়াস; এবং মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান এঁদের মানস-সন্তান। অন্যান্য শিক্ষিত মুসলমানরা (বিশেষ করে মৌলবীরা) ১৯৩৭ সাল অবধি জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন।

    অবশ্য এর মধ্যে আরো একটি মানস-ধারা ছিল। একদিকে ছিল শিক্ষায় ও ধনে দ্রুত পতনশীল মুসলমান অভিজাতশ্রেণী, অপরদিকে ছিল দ্রুত বর্ধিষ্ণু হিন্দু শিক্ষিত ও ধনী সম্প্রদায়। . উভয়ের মধ্যে ছিল পারস্পরিক অশ্রদ্ধা। ঐতিহ্যগৰী দাম্ভিক অভিজাতরা নতুন গজিয়ে ওঠা সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো রকমেই শ্রদ্ধাবান হয়ে উঠতে পারছে না। আবার বিদ্যা, পদমর্যাদা এবং ধনগর্ব নতুনদেরও উদ্ধত করে তুলছে। এই মানসদ্বন্দ্ব ও তার পরিণতি মূলত তারাশঙ্করের জলসাঘর কিংবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী বা তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতনের মতো। কেবল তফাৎ এই, নতুন-পুরাতনের এই দ্বন্দ্বের আকস্মিক ভিত্তি হল হিন্দু ও মুসলমান। দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগের উৎসও হল তাই এই দ্বন্দ্ব–যা বিশ শতকের প্রথমার্ধ ব্যাপী জাতিবৈর বা সাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানির কারণ হয়ে রইল।

    ব্রিটিশ মুসলমানের হাত থেকেই রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল, তাই তাদের মুসলমান-ভীতি তাদেরকে করেছিল মুসলমানের প্রতি বিরূপ ও আস্থাহীন। অন্যদিকে এদেশে তাদের শাসন স্থায়ী করার জন্যে তারা Devide and rule নীতি গ্রহণ করল। ফলে হিন্দু তোষণ ও পোষণ এবং মুসলমান শোষণ ও দলনই হল তাদের লক্ষ্য–যা প্রায় গোটা উনিশ শতক ধরে চলেছে। পরে উনিশ শতকের শেষপাদে ও বিশ শতকে ব্রিটিশ-কৃপায় পাওয়ার তেমন কিছু ছিল না। তখন হিন্দু মনেও জাগল স্বাধীনতার স্পৃহা ও ব্রিটিশ-বিরূপতা। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশের নীতিও পরিবর্তিত হয়ে মুসলমান তোষণ এবং হিন্দু দলন শুরু হল।

    এমনি পরিবেশে উনিশ শতকে বাঙালি হিন্দুর ধন, বিদ্যা ও পদমর্যাদা অর্জিত হয়েছিল। আর আগেই বলেছি পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও জীবনরীতির সংস্পর্শে এসে বাঙালি হিন্দুর যে- জাগরণ এল, যাকে রিনেসাঁস বলে চিহ্নিত করা হয়, তা কলকাতাবাসী ধনী ও শিক্ষিতের ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনের মানোন্নয়ন প্রয়াসে- আত্মোন্নয়ন লক্ষ্যেই নিবদ্ধ ছিল। তাদের দৃষ্টি ছিল সাগরপারে, আর লক্ষ্য ছিল আত্মবিকাশ। গোটা দেশের কথা ভাববার সময় সুযোগ ও সম্ভাবনা তখনো দেখা দেয়নি। কাজেই এ রিনেসাঁস কেবল সংকীর্ণ অর্থেই সত্য। তাই একে দিয়ে গোটা দেশের কল্যাণে কোনো বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য সাধন ছিল অসম্ভব।

    এমনি পরিবেশের সন্তান হচ্ছেন উনিশ শতকী মনীষীরা। বঙ্কিমচন্দ্রও তাই ব্যতিক্রম নন। অতএব বঙ্কিমের চিন্তায়, বচনে ও আচরণে কোনো অসঙ্গতি নেই। বরং বলতে গেলে তার মধ্যেই উনিশ শতকী মানসের স্বাভাবিক বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। সে হিসেবে বঙ্কিম যুগসৃষ্টি, যুগধর ও যুগ প্রতিভূ। এ-কথাটি যুগের পরিপ্রেক্ষিতে খুঁটিয়ে বুঝতে চাইনে বলেই বঙ্কিম আমাদের কারুর চোখে ঋষি আবার কারুর কাছে মুসলিম-বিদ্বেষী।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচট্টগ্রামের ইতিহাস – আহমদ শরীফ
    Next Article আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট – আহমেদ রিয়াজ

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }