Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প450 Mins Read0

    কথাসাহিত্যে সমস্যা ও এর বিষয়বস্তু

    ০১.

    সভ্যতার আদিম স্তরে এমন একদিন ছিল যখন স্কুল ক্ষুন্নিবৃত্তি ও যৌনবোধ ছাড়া মানুষের আর কিছুই ছিল না। জনসংখ্যা কম ছিল, বিস্তৃত ভুবন পড়েছিল তাদের পায়ের তলায়। কাজেই জীবন জীবিকার সমস্যা ছিল না মোটেই। তাই সেকালের অজ্ঞ মানুষ চারদিককার নিসর্গ ও প্রকৃতির প্রতি সবিস্ময়ে তাকাবার অবসর পেয়েছে প্রচুর। যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই বিস্ময় ও কল্পনার প্রশ্রয়। সেদিনকার বিস্ময়-ব্যাকুল মানুষ তাই মনোময় রূপকথা সৃষ্টি করে জগৎ ও জীবনের কল্প-নির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে স্ব স্ব কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে। এরূপে ভূত, প্রেত, রাক্ষস, দৈত্য, পরী, যক্ষ ও দেবতা মানুষের মনোরাজ্যে বিচরণ করতে থাকে।

    দ্বিতীয়স্তরে মানুষের জীবনবোধ প্রসারিত হল। উচ্চবিত্তের লোকমনে আত্ম-প্রসারের প্রেরণা জাগল। কিন্তু কল্পলোকের পূর্বতন অধিবাসীরাও ঠাই ছাড়ল না। তারাও রইল। উচ্চবিত্তের মধ্যে এ আত্মপ্রসার প্রবৃত্তি দেখা দিল জরু ও জমির অধিকার লিপ্সারূপে। তারা রাজ্য ও রাজকন্যার সন্ধানে ছুটল দিকে দিকে। সৃষ্ট হল রোমান্স। এবারকার অভিযানে নায়ক রাজকুমার, মন্ত্রীপুত্র, কোটাল আর বিত্তশালী সওদাগর। সেদিনও বেনে-বুদ্ধি রাজশক্তির সঙ্গে জোট মিলিয়ে পাল্লা দিয়ে চলত!

    কিন্তু গণমানব-মনে এতবড় দুরাকাঙ্ক্ষা তখনও জাগেনি। একে তারা তাদের পক্ষে অশোভন ঔদ্ধত্য বলে মেনে নিল। তাই তারা পড়ে রইল একান্তে। কিন্তু ব্যবহৃত হল উচ্চবিত্তের জীবন লীলার হাতিয়াররূপে। এভাবে শুরু হল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পটভূমিকায় অজ্ঞ মানুষের কল্পবিহারী মনোজীবনের লীলা। কথা সৃষ্টি হল–রূপকথা ও উপকথা। এ কথার তথা সাহিত্যের নায়ক হচ্ছে উচ্চাভিলাষী উচ্চবিত্তের মানুষ।

    সভ্যতার তৃতীয়স্তরে যদিও মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা বাড়ল–মানুষ অধিকতর জীবনমুখী হল, তথাপি তা গণজীবনেতর রইল। কল্পবিহারী মন মর্ত-প্রবাস শুরু করল বটে, তবে কল্পলোকের প্রতিবেশীকে ত্যাগ করল না। এতটুকু যে করল, তাও গরজে পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। নিম্নবিত্তের ও কতক লোকের উচ্চাভিলাষ জাগল, জীবনে ভোগেচ্ছা বাড়ল, জীবিকা-প্রয়াস হল তীব্রতর। এরূপে জীবনবোধের প্রসার হল। সৃষ্টি হল রোমান্স।

    এ স্তরে বাস্তব ও স্বপ্ন, কল্পনা ও প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বোধি, জগৎ ও জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ল। সৃষ্টি হল অভিজাতদের গরজে ও স্বার্থে জাতীয় মহাকাব্য।

    একেই আমরা বলছি আদি মধ্যযুগ। মানব-সভ্যতার ইতিহাসে এ স্তর দীর্ঘস্থায়ী হয়েছ। এ যুগের মুখ্য নীতি হচ্ছে জোর যার মূলক তার। অর্থাৎ যোগ্যতরের উধ্বর্তন। এ যুগের ক্রম পরিণতিতে মানুষের হৃদয়বৃত্তির বিকাশ হয়েছে। বহু মহত্ত্বলি, নানা আপ্তবাক্য আমরা শুনলাম। বিচিত্রগামী বুদ্ধিবৃত্তির আভা পরিব্যাপ্ত হল সর্বত্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও জীবিকা সম্মুখীন হল কঠিনতর সমস্যার। জনসংখ্যা পেল বৃদ্ধি। স্থায়ী বসবাস হল। জীবন-বোধ প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল জীবনের চাহিদাও। অথচ প্রয়োজনের ওজনমতো ভোগ্যবস্তু বাড়েনি, ফলত দেখা দিল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। লেগে গেল কাড়াকাড়ি, মারামারি ও হানাহানি। মানুষের এ আত্মধ্বংসী সংগ্রামে, এ দুর্যোগকালে এগিয়ে এলেন অভিজাত প্রজ্ঞাসম্পন্ন বুদ্ধিমানগণ। প্রচারিত হল ধর্মের নামে নীতিশাস্ত্র। এরূপে শুরু হল নিয়তি, অদৃষ্টবাদ, ইহ-পরকাল, স্বর্গ-মর্ত্য, জন্মান্তর, পাপ-পুণ্য, রিজিকের মালিক রাজ্জাক, সুখ-দুঃখ, প্রেম-প্রীতি, ন্যায়-নীতি প্রভৃতি হাজারো কথার মারপ্যাঁচে মানুষকে দ্বন্দ্বে নিরস্ত করবার অশেষবিধ প্রয়াস। এভাবে মানুষকে ত্রিবিধ নিয়মনীতির নিগড়ে বেঁধে রাখবার চেষ্টা চলল। ধর্মের বিধি, সমাজের নীতি ও রাজার শাসন-ই সেই নিগড়। চিরকালই দেখা গেছে Law maker-রা সাধারণত Law abider হয় না, কাজেই এসব তৈরি হয়েছে দুর্বলকে দ্বন্দ্বে সংগ্রামে নিরস্ত রাখবার জন্যেই। তাদের সে উদ্দেশ্য বহুল পরিমাণে সফল হয়েছিল, তবু যুগ ও জন-প্রয়োজনে পাল্টাতে হল নিয়ম ও আদর্শের ধরন ও ধারণ। এরূপে কত ধর্মের জন্ম মৃত্যু হল

    .

    তারপর এল শেষ মধ্যযুগ। মানুষ আরো বাড়ল। জীবনবোধ তীক্ষ্ণতর হল। বৃদ্ধি পেল ভোগলিপ্সা। ফলে জীবনোপভোগের পরিধি হল প্রসারিত। ভোগ্যসামগ্রীর চাহিদাও বাড়ল। অধিকাংশ লোকের মনে জাগল উচ্চাভিলাষ। জীবন-ধারণ পদ্ধতি ও জীবিকা-উপায় উদ্ভাবনে। অতৃপ্ত মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠল। দেখা দিল ভাববিপ্লব, আদর্শ বিভ্রাট, জীবনজিজ্ঞাসা, বুদ্ধিবৃত্তির বিচিত্রলীলা। বিজ্ঞান-দর্শনের কচকচি আর ঠোকাঠুকি। আস্তিক্য, নাস্তিক্য, ভাব, যুক্তি ও বিবর্তনবাদের সুরাসুরিক দ্বন্দ্বে নতুন ভাব-চিন্তা ও যুক্তির আবির্ভাব ঘটল। এ দ্বন্দ্বের ঝুঁকি নিল য়ুরোপ। যুগার্জিত বিশ্বাস-সংস্কার এবং জগৎ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হল পরিবর্তিত। সমাজের অভ্যস্ত জীবন বিপর্যস্ত হল ভিতরে বাইরে। এ কারো কাছে অমৃত, কারো কাছে গরল।

    বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়া বিশাল দুনিয়াকে করে দিল সংহত ও ঘোট, এ ভাব বিপ্লব ও তদানুষঙ্গিক যন্ত্রদানব অল্পকালের মধ্যে পৃথিবীকে পুরে ফেলল আপন মুঠির মধ্যে। এ ভালোই হল। কেননা, কোনো নতুন মানুষের অমঙ্গলের জন্যে আসে না, অন্তত এ পর্যন্ত তার পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। নতুনকে বরণ ও ধারণ করেই মানুষ ও মনুষ্য-সভ্যতা এগিয়ে এসেছে।

    নতুন যান্ত্রিক পরিবেশে জীবিকার্জন পদ্ধতিতে বিপর্যয় ঘটল। ধনবণ্টন সমস্যার অর্থনৈতিক আবর্তে জীর্ণ হয়ে পড়ল পুরোনো সমাজকাঠামো। বিত্তশালীদের জীবনে জীবনোল্লাস যেমন বাড়ল, তেমনি বিত্তহীনদের চিত্তে জাগল চরম বিক্ষোভ-সে বিক্ষোভ হতবাঞ্ছর। এর ফলে চিরকালের একটা মানসিক ব্যবধান ঘুচল। আগে আর্থিক সমতার কথা, জন্মসূত্রে নয় কর্মসূত্রে জীবন নিয়ন্ত্রণ ও উপভোগের বিষয়, পরলোকে বিশ্বাসী নিয়তিনির্ভর অজ্ঞ মানুষ ভাবতে সাহস পায়নি। এবার তাদের চোখ খুলে গেল, মনের সংকোচ গেল টুটে। উঠল জগতে ও জীবন জন্মসূত্রে সমাধিকারবাদ ও সুযোগবাদের ধ্বনি। ফলে মানুষ অবিশেষের মনে জাগল অপরিমেয় ভোগেচ্ছা এবং তজ্জাত লোভ ও ঈর্ষা। আর তা থেকে শুরু হল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। বিঘোষিত হল গণতন্ত্রের জয়।

    এভাবে আধুনিক যুগ হল শুরু। বিজ্ঞানই এ যুগের উদ্বোধক। ভাবের রাজ্যেও পৌরোহিত্য তারই। এ-যুগ অধিকারবাদের যুগ। সে-অধিকার আদায়ে সংগ্রামী মানুষ আমরা। এ যুগে আকাশ ও প্রকৃতি থেকে মানুষের দৃষ্টি নেমে এল জীবনের উপর–মাটির দিকে। ভোগেচ্ছার পরিপূর্তিই আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমরা বস্তুতান্ত্রিক, আমরা নাস্তিক। কোনো বৃহৎ ও, মহৎ বুলি আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারছে না। মুগ্ধ করে না স্বর্গ-সুখ। বিভীষিকা সৃষ্টি করে না দোজখের যন্ত্রণা। আমরা বলি–মানবের তরে মাটির পৃথিবী।

    চিরকাল দুর্বলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা চলে সঙ্ঘবদ্ধতায়। তাই আজ নিঃস্ব লোকেরা জোট বেঁধেছে। দোহাই কাড়ছে মানবতার। দুর্বল যখন বাহুবলে অন্যায়-নিপীড়নের প্রতিকারে অক্ষম হয়, তখন তাঁর মুখে ফোটে ন্যায়-নীতির আবেদন। সে চেষ্টা করে সমশ্রেণীর ও সমভাবে নিপীড়িত জনের সহানুভূতি ও সহায়তা লাভের। যখন নিপীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন মরিয়া হয়ে আত্মস্বার্থে লোক জুটে যায়। শুরু হয় সংগ্রাম। আমাদেরও এ মানবতা-মন্ত্রের পশ্চাতে রয়েছে বঞ্চিত বুকের বেদনার বিক্ষোভ। আসলে এটাও আমাদের ভোগেচ্ছা ও ঈর্ষার শোভন বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বক্তব্যটি এই জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে ও যাচ্ছে, সে পরিমাণে যখন ভোগ্যসামগ্রী বাড়ছে না, তখন টানাটানি অপরিহার্য। এহেন দুর্দিনে যখন কারো কারো গাছতলাও জুটছে না তখন, তোমাদের সৌধে বাস শোভা পায় না। এ হৃদয়হীন অসামাজিক মনোভাব। তোমাদের অট্টালিকা, প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রাপ্তি ও প্রাচুর্য দেখে আমাদের আশ্রয় ও অশনহীনতার দাহ বেড়ে যায়। অতএব, তোমরাও কিছুটা নেমে এসো, আমরাও কিছুটা উঠে আসি। তোমারও প্রাসাদের পাট চুল, আমারও কুটিরের অভাব ঘুচল। এবার তোমার আমার অভাব সমান হল। আমার মনের ঈর্ষাজাত লোভ-ক্ষোভের জ্বালা জুড়োল। তুমি আমি হলাম বন্ধু, আত্মীয় এবং অখণ্ড মানব জাতি। তবে অভাব রয়ে গেল। তা আর কী করা যাবে! এসো, দেখা যাক, নতুন যন্ত্র প্রয়োগে নতুন উপায়ে ও নতুনতর কৌশলে বুড়ি ধরণীর রস আরও কিছুটা নিঙড়ানো যায় কী না। এতে আরো প্রবল নৈতিক যুক্তি রয়েছে। আমরাই যখন আয়োজনাতিরিক্ত আমন্ত্রণ করি না, তখন স্রষ্টা খাওয়া-পরার ব্যবস্থাতিরিক্ত জন সৃষ্টি করেছেন–এ কথা ভাবব কেন? Terminus-এ প্রথম উঠেছে বলেই কী রেলগাড়ির গোটা Compartment-এ-কোনো লোকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? এ-ই হচ্ছে আজকের মানুষের মনের কথা, মুখের বুলি ও সংগ্রামের কারণ। এর সমাধান ছাড়া এড়ানোর উপায় নেই।

    কাজের কথা বলতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে রূপকথা শোনালাম, এর প্রয়োজন ছিল। পটভূমিকা ছাড়া বক্তব্য অর্থহীন হত।

    সাহিত্য মনুষ্য-মনেরই সন্তান। তার যখনকার যে মনোভঙ্গি, তা-ই তখন প্রতিফলিত হয় তার সৃষ্ট সাহিত্যে। এজন্যেই সাহিত্যকে জীবনের প্রতিচ্ছবি বলা হয়। বলা হয় ব্যক্তিক ও জাতীয় জীবনের মুকুর। বাহ্য সমস্যার সঙ্গে মানুষের এ মনোবিবর্তনের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে মানুষের অতীত সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প। মানুষের অজ্ঞতার ক্রমবিদূরণ, জীবনবোধের প্রসার, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বোধির ক্রমবিকাশ, হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির অভিজ্ঞতালব্ধ ক্রমোন্নতি প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়েছে এসব সাহিত্যে। বিস্ময়াবিষ্ট অজ্ঞ মানুষের সাহিত্য ছিল ভূত-প্রেত-দেও-পরী-রাক্ষসের লীলা, তারপরের যুগে পেলাম রাজা বাদশাহর জীবন-বিলাস চিত্র। তারপরে পেয়েছি ন্যায়নীতি আদর্শবাদ-পুষ্ট ইহ-পারলৌকিক জীবনের মোহনীয় ও বিভীষিকাময়ী কাহিনী। মানুষের জীবন জীবকার সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে মনোভঙ্গি যেমন বদলেছে, জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসা-পদ্ধতি যেমন বিবর্তিত হয়েছে, সাহিত্যেরও তেমনি সমভাবে রূপান্তর ঘটেছে আদর্শে, রূপকল্পে ও রকল্পে। বিবর্তিত হয়েছে ভাষা, পালটে গেছে ভঙ্গি, পরিবর্তিত হয়েছে রস-রুচিবোধ। বিষয়বস্তুও হয়েছে বহুবিচিত্র। আজকের সাহিত্যকে তাই পুরনো নিয়ম-নীতির নিরিখে যাচাই করা চলবে না। আজকের সাহিত্যের সাধারণ নাম রস সাহিত্য নয়–গণসাহিত্য। আজকের সাহিত্য-শিল্প কুশলতা মাত্র নয়, গণমানবের আত্মিক উন্নতির জন্যেই সাহিত্য। সমাজের জন্যে নয়, রাষ্ট্রের জন্যেও নয়–একান্তভাবে ব্যক্তিসত্তায় আস্থাবান মানুষের জন্যেই হবে এ সাহিত্য। মানুষ অবিশেষের মর্যাদা ও অধিকার-বোধ জাগানো ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রচিত হবে সাহিত্য। প্রতি মানুষের জীবনের মর্যাদা ও মূল্যমান যথার্থভাবে বুঝিয়ে দিয়ে মানুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তুলবার সাধনার অবলম্বন ও বাহন হচ্ছে এ সাহিত্য। তাই আজকের সাহিত্য অবসরবিলাসীর চিত্তবিনোদনের জন্যে নয়, কেজো মানুষকে প্রেরণা ও প্রতিষ্ঠা দানের জন্যেই। হালকাভাবে বললেও স্বীকার করতে হবে যে : যার খায় তার গুণ গাইতে হয়। এককালের লেখকেরা ধনীর আশ্রয়-নির্ভর ছিলেন, তাই সাহিত্যে স্তুতি গেয়েছেন ধনীমানবের। আজ গণমানবই তাদের খোরপোশ যোগায়। কাজেই আজ সাহিত্য সৃষ্টি হবে গণমানুষের স্বার্থে ও কল্যাণে। সেকালের ধনীদের স্তুতিকার হবেন একালের গণমানবের চাটুকার।

    আজদের দিনের বিশ্বসাহিত্যে সার্থক স্রষ্টাগণ মানুষকে নিবিড়ভাবে জানবার ও জানাবার এই মহান ব্রতই গ্রহণ করেছেন। আজকের দিনে লেখকের সাহিত্য কথা-শিল্প নয়–জীবন-শিল্প। একনিষ্ঠভাবে সাধনা চলেছে জীবনের অর্থ খুঁজবারও। মার্ক টোয়েন, সমর্সেট মম, পার্লক, হেমিংওয়ে, জোলা, রোলা, আনাতোলা ফ্রাঁ, টুর্গেনিত, গোর্কী, ডস্টয়ভী, টলস্টয়, শেখভ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি আমাদের এ পথেরই সন্ধান দিয়েছেন। কল্লোল কালিকলমের যুগ থেকে পশ্চিমবঙ্গেও এ সাধনাই লঘু-গুরুভাবে চলে আসছে।

    .

    ০২.

    আমরাও ব্রত গ্রহণ আর সাধনার দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু সিদ্ধি আজো যেন নাগালের বাইরে। এর যেসব কারণ আমরা অনুমান করেছি, সেগুলোই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

    আজকের সাহিত্যান্দোলনের উদ্গাতা য়ুরোপ। আজকের সাহিত্য মানুষের জীবনভিত্তিক। সে জীবন বাহ্যত সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাষ্ট্রিক হলেও তাদের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াজ যে-মনোজীবন, তার স্বরূপ উদ্ঘাটনই শিল্পীর মূল লক্ষ্য। কাজেই সেকেলে-ধারায় একেলে সাহিত্য সৃষ্ট হতে পারে না।

    সাহিত্যের আধুনিক রূপকল্প হচ্ছে য়ুরোপের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফল। তাই তাদের কাছে যা স্বতঃস্ফূর্ত, আমাদের কাছে তা অনুকৃতি মাত্র। আর অনুকৃতি মাত্রেই কৃত্রিম। বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার শক্তি যেমন আমাদের জন্মায়নি, অথচ আমরা পূর্ণ যান্ত্রিক সেবা ও সুবিধে গ্রহণ করছি; ওদের তৈরি যন্ত্রের অনুকরণে আমরাও অনুরূপ যন্ত্র তৈরি করে নিচ্ছি, কিন্তু নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারছিনে। সাহিত্য শিল্পে আর আদর্শেও তেমনি আমাদের অনুরূপ অক্ষমতা ও অনুকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। প্রতীচ্য সংস্কৃতি বরণে ও ধারণে আমরা ভুঁইফোড় বলেই আমাদের স্বীকরণ ক্ষমতা জন্মায়নি। এসব গুণ আহরণ করা চলে না, অন্তর্নিহিত শক্তিবলে অর্জন করতে হয়, পেলব্ধ হওয়া চাই। ফলে অশিক্ষিত লোক স্যুট পরলে যেমন তা তার দেহে খাপ খায় না, আমাদের মনের সঙ্গে য়ুরোপীয় ভাবধারাও তেমনি মিশে যেতে পারছে না। তাই আমাদের আত্মবোধ যত প্রবল, গণবোধ তত সাবলীল নয়। এজন্যেই শিক্ষা-প্রবুদ্ধ ও সংস্কৃতিপরায়ণ য়ুরোপে যা সহজেই সম্ভব হয়েছে, নতুন শিক্ষিত আমাদের কাছে তা-ই উঠেছে সমস্যা হয়ে।

    আমরা কী লিখব আর কেমন করে লিখব তার সৃষ্টি-সম্ভব ধারণা আমাদের মনে গড়ে ওঠেনি। অথচ সাহিত্য-শিল্প হচ্ছে কী ভাবছি তা নয়, ভাব কীভাবে প্রকাশ করছি তা-ই। কাজেই আমাদের কথা-শিল্পে, রূপকল্প ও রসকল্পএই উভয় দিক দিয়েই সমস্যা রয়ে গেছে।

    মহৎ সৃষ্টির জন্যে জগৎ ও জীবনকে একান্তভাবে অনুভব করতে হয়। তার জন্যে দরকার দৃষ্টি ও সংবেদনশীল মন। সৃষ্টির আগে দৃষ্টি নিখুঁত ও সামগ্রিক হওয়া চাই। এজন্যে আমাদের দুটো প্রাথমিক সাধ্যবস্তু রয়েছে। একটা হচ্ছে, জৈব-জীবনের বৃত্তি-প্রবৃত্তি তথা মানব-মনের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতনতা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানব- চরিত্রে ও আচরণে প্রতিবেশিক প্রভাব সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জন। শিল্পীরা হচ্ছেন স্রষ্টা। আর ভাব-ভাষার জাদুস্পর্শে সজীব, সচল ও ক্রিয়াশীল মানুষ সৃষ্টি করা কী সহজ কথা! কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সামগ্রিক স্বরূপ দৃষ্টিতে বা মনে ধরা না দিলে তার চলচ্চিত্র দেওয়া অসম্ভব। যেমন ঢাকা শহরের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি জবাব খুঁজে পাইনে, কেননা এর সামগ্রিক রূপ আমার কাছে পষ্ট নয়। না জানার চেয়ে কম জানাতেই ভুল হয় বেশি।

    মানব-প্রবৃত্তি সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান না থাকলে সৃষ্ট চরিত্র অস্পষ্ট ও অস্বাভাবিক হতে বাধ্য। আর সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস-সংস্কার, অদৃষ্টবাদ, নিয়তিনির্ভরতা, আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব যে মানুষের আচরণকে বিচিত্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তা না জানলে, সজীব ও স্বাভাবিক মানুষ সৃষ্টি হবে কী করে?

    এক কথায়, মানুষের প্রতিমুহূর্তের বাহ্যাচরণ ও জীবন-প্রচেষ্টার মধ্যে মনুষ্যজীবনের বৃত্তি প্রবৃত্তির যে অদৃশ্য প্রভাব রয়েছে, তার যথার্থ স্বরূপ না জানলে বা কারণ-ক্রিয়া জ্ঞান না জন্মালে কোনো রচনাই শিল্পায়ত্ত হবে না।

    আমাদের মনে হয়, এ দুটো অভিজ্ঞতার অভাবেই মুখ্যত আমাদের ছোট গল্প সার্থক হচ্ছে না, আর লেখকেরা উপন্যাস রচনায় সাহস পাচ্ছেন না। যারা সাহস করে এগিয়ে আসছেন, তারাও প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছেন। এ কারণেই বহু প্রশংসিত সূর্য দীঘল বাড়িতে দৃষ্টি আছে, সৃষ্টি নেই। অর্থাৎ দৃষ্টির পরিচয় আছে, কিন্তু সৃষ্টির স্বাক্ষর তেমন নেই।

    এদিকে আমাদের যা ছিল তা-ও হারাতে বসেছি। পারিবারিক ও সামাজিক যে নিবিড় আত্মীয়তাবোধ ছিল, শিক্ষা-প্রবুদ্ধ জনগণ তাও হেলায় ত্যাগ করেছে। আমরা যতই বৃহত্তর মানবতাবোধ তথা মনুষ্যপ্রীতির দোহাই কাড়ছি, আমাদের আত্মীয়তাবোধ যেন ততই ম্লান হয়ে আসছে। অপ্রেম ও অসামাজিকতা যেন বেড়ে চলেছে। এর জন্যে দায়ী আমাদের নতুন-গড়া মধ্যবিত্ত মনোভাব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি প্রয়োজনে আমাদের শিক্ষিত সাধারণের হাতে যোগ্যতাতিরিক্ত টাকা আসে, তাঁরা এখন উচ্চবিত্তের লোক। তাদের জীবনের ব্রত ধন-আহরণ আর লক্ষ্য একখানা গাড়ি ও ধানমণ্ডিতে একখানা বাড়ি। এসব ভুঁইফোড় ধনী আভিজাত্য-লোভে ও ঐশ্বর্যগর্বে নিজেদেরকে বিরাট গণসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছেন। অথচ এঁরাই হচ্ছেন সমাজ-সংস্কৃতির শক্তির উৎস। এর সঙ্গে একটি মারাত্মক সরকারি নীতিও হয়েছে যুক্ত। সরকার কর্মচারীদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছেন, এতে চাকুরিজীরিদের অভাব অনেক পরিমাণে লাঘব হয়েছে। যদিও তারা সংখ্যায় নগণ্য, তবু প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তারাই হচ্ছেন সমাজের দিশারী। পাঁচ কোটি লোকের দেশে কয়েক লক্ষ লোকের আর্থিক দৈন্য ঘুচলেই দেশ কিছু উন্নত হয় না। পক্ষান্তরে শিক্ষিত লোকদের এভাবে গণসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরকার ভেদনীতির প্রয়োগে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন মাত্র। এতে নেতৃত্বাভাবে অজ্ঞ অসহায় পাঁচ কোটি লোকের। অভাব-নিপীড়ন বাড়লই। যদি নতুন-গড়া শিক্ষিত শ্রেণীরও যথার্থ চিত্তবিক্ষোভ ও হতবাচ্ছা থাকত, তবে তাদের প্রভাবে দেশের গণমন সহজে জাগত। আত্মরক্ষার গরজেই সমবেত প্রয়াস চলত দেশের উন্নতির জন্যে।

    আমাদের এ-কথা ভুললে চলবে না যে শ্ৰমিক-নেতা যেমন শ্রমিক নন, কৃষক-নেতা যেমন চাষী নন, জননেতা যেমন জনগণের নাগালের বাইরে, তেমনি লেখকগণও সাধারণত অনভিজাত নন। কাজেই যে-সমাজ থেকে লেখকের আবির্ভাব সে-সমাজই এখন ধ্যান করছে গাড়ি-বাড়ির। কাজেই গণ-সমাজের প্রতি তাদের সে-নজর কোথায়–যে দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলে দুদবোধ ও সহানুভূতির ছোঁয়ায় গণহৃদয়-মন ও আশা-আরজু লেখকের নিজ হৃদয়-মনে মুকুরের মতো প্রতিফলিত হয়? উনিশ শতকের কোলকাতার মধ্যবিত্তদের মতোই আত্মসর্বস্ব হয়ে উঠেছে এই বিত্তশালীরা।

    আমাদের সামাজিক জীবনের আর এক মস্ত বিড়ম্বনা–মিথ্যা আত্মসম্মান-বোধ ও আভিজাত্যচেতনা। যে-কেউ একটু লেখাপড়া করে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলে আত্মপরিচয় দেয়। আসলে আমাদের সমাজে সাম্প্ৰত-পূর্ব যুগে শ্ৰেণী হিসেবে কোনো মধ্যবিত্ত ছিল না। আসলে সবাই বিত্তহীন। চাকুরি না করে যে খেতে-পরতে পারে না, সে বিত্তবান হয় কী করে! একজন দিনমজুর বা রিকশাওয়ালা ও আমাদের তথাকথিত মধ্যবিত্তের মধ্যে বিত্তের দিক দিয়ে তফাৎ কোথায়! কাজ না পেলে ওরও ভাত জুটে না, এরও আহার মেলে না। এ আত্মপ্রবঞ্চনা-আর্তনাদকে আস্ফালন দিয়ে ঢাকবার এ চেষ্টা আমাদের নিজেদেরও স্বরূপ উপলব্ধির পথে প্রবল বাধা। তাই আজো আমরা অকপটে আত্মকথাও শিল্পায়ত করতে পারিনি। মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত এই বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত শ্রেণীর মতো অসহায় দুঃখী মানুষ এদেশে সত্যিই আর নেই। এদের বিত্তের সঙ্গে বৃত্তি বেসাত যুক্ত না হলে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোটানো মুস্কিল, বৃত্তি যা জোটে তা সামান্য কেরানিগিরি, নয় মাস্টারি। আজকের দুর্মূল্যের দুর্দিনে যে জীবন-যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে দাঁড়াবার ঠাই পাচ্ছে না, এরা কুলি-মজুরের চাইতেও অসহায়। কেননা এরা দুঃখের কথা কইতেও পারে না, সইতেও পারে; ভিক্ষাবুলিও নেয়া চলে না, গাছতলায় বাস করতে পারে না। এবং এদের জীবনবোধ অশিক্ষিতদের চেয়েও বেশি বলে বেদনাও তীব্রতর।

    আবার বিক্ষুব্ধচিত্তেও সার্থক সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাতে চিত্ত বিক্ষোভজাত উচ্ছ্বাস শিল্পীর সংযমবোধ ও রসদৃষ্টি ব্যাহত করে। এ ধরনের সৃষ্টি সাধারণত হয় গীতাত্মক বা বিবৃতিমূলক। সার্থক সৃষ্টির জন্যে শান্ত, সমাহিত অথচ সহানুভূতি ও সংবেদনশীল মনোভঙ্গির প্রয়োজন, পরিমিত দূর থেকে বা উপর থেকে দেখলে যে-কোনো বস্তু বা ঘটনার সামগ্রিক স্বরূপ যেভাবে দৃষ্টিগোচর হয়, ভেতর থেকে তা কখনো সম্ভব নয়, সে-অবস্থায় শুধু বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত রূপই চোখে পড়ে। তা ই চিত্রিত করতে গেলে খাপছাড়া হয়ে ওঠে।

    আর একটি ক্রটি প্রায়ই চোখে পড়ে। আমাদের অনেক গল্প-লেখক মনে করেন, গীতিকবিতার সঙ্গে ছোটগল্পের বিশেষ পার্থক্য নেই। অনুভূতি ও ভাবের দিক দিয়ে হয়তো এ ধারণা আংশিক সত্য, কিন্তু আঙ্গিকের দিক দিয়ে এদের আসমান-জমিন তফাৎ। কিন্তু তাঁরা তাঁদের অনুভূত তত্ত্বটি সংলাপের ও বিবৃতির মাধ্যমে কোনোরকমে প্রকাশ করেই ছুটি নিতে চান। ফলে অনেক গল্পই রূপে ও রসে তথা আঙ্গিকে ও চিত্রণে গল্প হয়ে ওঠে না। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাতে চাইলে যেমন শুধু দিগন্তে একটা সূর্য এঁকে দিলেই হয় না; আকাশ, নদী, গাছপালা, কুটির প্রভৃতির উপর অস্তায়মান সূর্যের রশ্মি ছড়িয়ে সূর্যাস্তকালীন দৃশ্য পরিস্ফুট করতে হয়, তেমনি গল্পের বক্তব্যের অনুকূল প্রতিবেশ বা পটভূমিকা সৃষ্টি করে বক্তব্যকে শিল্পায়ত করতে হয়। এ-না হলে গল্প অচল।

    আর একটা বিষয় যথাযযাগ্য গুরুত্ব সহকারে আমাদের বুঝে দিতে হবে। যন্ত্র- বিজ্ঞানের প্রভাবের ফলে এ যুগে জনজীবনে বিপর্যয় এসেছে। সে-বিপর্যয় আর্থিক ও মানসিক। আমাদের আনন্দের পিপাসা আছে, অথচ আনন্দ নেই। আনন্দের সামগ্রী যতই বাড়ছে ততই আনন্দ যেন আলেয়ার মতো ফাঁকি দিচ্ছে, মরীচিৎকার মতো শুধু মানসিক পীড়নই বাড়াচ্ছে। য়ুরোপ তাই বিক্ষুব্ধ, চঞ্চল আর ব্যাকুল শান্তি ও আনন্দের সন্ধানে কেমন যেন ছটফট করছে। আমাদের দেশেও সে অবস্থা এল বলে!

    আগের দিনে আনন্দ-উৎসব ছিল পার্বণিক ব্যাপার, নিত্য ঘটত না। তাই যাত্রা, পাঁচালি, খেলা প্রভৃতির আয়োজনের উত্তেজনায় ও স্বপ্নে কাটত কয়দিন, আর স্মৃতিতে মাধুর্যে কাটত বহুদিন। এভাবে কেটে যেত স্বপ্ন ও স্মৃতিঘেরা বছর। অবরুদ্ধ বধূ বাপের বাড়ি নাইরে যাবার স্বপ্নে, নাইহরের সুখ-উত্তেজনায় আর নাইহর অন্তে তার মধুর স্মৃতি মন্থন করে সহজেই বছর ফুরিয়ে দিতে পারত। আর আজ সিনেমা, খেলাধূলা, ভ্রমণ, কিছুই যেন চোখে নতুন ঠেকে না, মনে লাগায় দোলা। শহুরে মেয়েরা নাইরে প্রিয়-পরিজনের সান্নিধ্যের মাধুর্য আর কল্পনাও করতে পারে, অবাধে চলাফেরার সুবিধে সেই সুখ-স্বপ্ন ও উল্লাস থেকে বঞ্চিত করেছে তাদের। তার উপর পৃথিবী একখানি ছোট মানচিত্রের মতো ঝুলে রয়েছে চোখের সামনে। বিদ্যার প্রসারে, আর বইপত্রের বদৌলত আগ্রহ ও কৌতূহল জাগাবার কোনো অজানা-অচেনা বস্তুই রইল না, সবকিছু পড়া-পাঠেরে মতো মনে হয় পুরোনো, নীরস ও একঘেয়ে। তাই আজকের দিনে উচ্চবিত্তের মানুষের মনেও স্বপ্ন বা স্মৃতি কোনোটাই ঠাই পায় না। মানবের মনোজীবনের এই শ্রান্তিও মনুষ্যজাতির একটা বড় সঙ্কট। এই বিড়ম্বনাও আজকের রাষ্ট্রিক ও অর্থনীতিক দ্বন্দ্ব-হানাহানির জন্যে কতকটা দায়ী। তৃপ্তি নেই, আনন্দ নেই। তাই স্বস্তি আর শান্তিও দুর্লভ। এতে একটা নৈরাশ্যবাদ আমাদের পেয়ে বসেছে, আশাবাদ জাগাতে হবে আমাদের মনে।

    আমাদের মনে রাখতে হবে সাহিত্য শুধু জনচিত্তের বিশ্লেষণ করবে না, প্রচলিত সমাজ-চিত্র দেবে না, সমাজকে নিয়ন্ত্রিতও করবে, দিশাও দেবে পরোক্ষভাবে, প্রভাবিত করবে অতি সন্তর্পণে। কিন্তু তাই বলে উগ্র ও প্রত্যক্ষ আদর্শবাদ থাকবে না। এটুকু আদর্শবাদ ও রোমান্টিকতা প্রচ্ছন্ন না থাকলে, সাহিত্যের উদ্দেশ্যই যাবে ব্যর্থ হয়ে। কেননা শুধু বাস্তব দিয়ে চিত্র হতে পারে, শিল্প হবে না। রচনায় শিল্পীর মনের রঙ-রস ও চিন্তা মেশাতেই হবে। কিন্তু কোনো আদর্শবাদই জৈবধর্ম বা প্রাণধর্ম বা পরিবেশের প্রতিকূল হলে চলবে না। তথাপি এ-যুগে লেখকদের হতে হবে জীবন শিল্পী। আদর্শবাদ থাকবে প্রচ্ছন্ন। মহৎ সৃষ্টির এ-ই লক্ষণ।

    এ যুগের গল্প-উপন্যাসের পটভূমি বিশাল–গোটা দুনিয়া। জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা, স্বাদেশিকতা ও বিশ্বমানবতা এ যুগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা, যদিও স্বাজাত্যবোধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল-ভরসার আকর, আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য; কিন্তু তবু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিতসাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নিৰ্দ্ধন্দু ও নির্বিঘ্ন করতে হলে, পরিবার-পরিজনেরও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই। সামাজিক কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক মঙ্গলের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আর স্বাজাতিক কল্যাণের গরজে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছার কামনা জেগে ওঠে। অতএব, স্বাতন্ত্র-বোধ অসম্ভব!

    কথাসাহিত্য রূপ ও রসের দিক দিয়ে চার ভাগে বিভক্ত হতে পারে : ক, চিত্রধর্মী, খ. মনোসমীক্ষাধর্মী, গ. বিশ্লেষণধর্মী ও ঘ. রোমান্টিক।

    কথাসাহিত্য ও নাটকের সংলাপের ভাষা নিয়েও কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে একটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে স্মরণীয় ও বিবেচ্য। সাধুভাষার কাছাকাছি না হলে কোনো কথ্যভাষাই দেশের সর্বাঞ্চলের লোকের বোধগম্য ও প্রয়োগ-যোগ্য হবে না। এটা বুঝেছিলেন বলেই পূর্ববঙ্গঘেঁষা উত্তরবঙ্গের লোক প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন ভাগীরথী তীরাঞ্চলের ভাষা। নতুন কথ্যভাষা গ্রহণ করবার গরজ আমাদের থাকলে, কুষ্টিয়া যশোহর বা খুলনা অঞ্চলের কথ্যরূপ গ্রহণ করাই শ্রেয়। বিশেষত সাহিত্যের ভাষা চিরকালই কিছুটা কৃত্রিম। প্রমথ চৌধুরী প্রবর্তিত কথ্যভাষাও অকৃত্রিম নয়। ও ভাষার অবিকল প্রতিরূপ কথায় ব্যবহৃত হয় না কোথাও।

    আমরা অনেক সমস্যা তুলে ধরলাম। তাতে উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই। শক্তিমানের সামনে কোনো সমস্যাই টিকতে পারে না। এগিয়ে চলার পথ করে নিতে পারে সে। আমরা জানি, আমরা নব-শিক্ষিত ও নতুন সংস্কৃতিসেবী, আমাদের জাতীয় জীবনও আধুনিক অর্থে গড়ার মুখে। তবু আমাদের কথা-সাহিত্যক্ষেত্রে দু-চারজন যথার্থ শিল্পীকে ইতিমধ্যে পেয়েছি। বেশ কয়েকটা ভালো সৃষ্টিও হয়েছে। অবশ্য আরো কিছুকাল হয়তো প্রতিভার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। এতে হতাশ হবার কিছুই নেই। কোনো দেশেই প্রতিভা গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না।

    .

    ০৩.

    আধুনিক যুগে ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে মানুষ নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপনের ফলে আর্থিক বৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে গ্লানি, মনন-জীবন করেছে পঙ্গু। তাই অধিকারবাদের লড়াই শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। ব্যবহারিক জীবনের যে-মনোজীবন রয়েছে, তা দুঃখ-দৈন্য ও অভাব উৎপীড়নের প্রতিক্রিয়ার ফলে আজ লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত।

    আমাদের দেশের সমস্যা যেমনি জটিল, তেমনি মারাত্মক। কিন্তু এদেশে যারা মার খায়, তারা সহ্য করতে অভ্যস্ত। আর যারা মার দেয়, তারাও একে অন্যায় বলে উপলব্ধি করতে অক্ষম। ফলে যে-চেতনা যে-মর্যাদাজ্ঞান, যে-অধিকার আদায়-প্রয়াস বিপ্লব আনে, তা আমাদের দেশে আজো স্বপ্ন। ১৩৫০ সালের মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষের নির্বাক-নির্বিদ্রোহ আত্মাহুতিই এর প্রমাণ।

    তাই য়ুরোপের অনুকরণে আমাদের দেশে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে-শৌখিন আন্দোলন শুরু হল, তাতে জনগণের আন্তরিক যোগ ছিল না। অনুভূতি- বিহীন মনীষালব্ধ বাণীর বাহক ও প্রচারক আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টা তাই ব্রত না হয়ে বিলাসরূপে প্রকাশ পেল। যে জিজ্ঞাসা, সমাজবোধ, সমস্যা-সচেতনতা, সামাজিক জীবনচেতনা ও বাস্তবানুভূতি, মানুষের প্রকৃতি ও প্রবৃদ্ধি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং রুচি-আদর্শ সজাগতা সার্থক সৃষ্টির পক্ষে অপরিহার্য, তা আমাদের আদর্শপ্রিয় য়ুরোপমুখী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিরল। এইজন্যে তাদের রচনায় মনন-বৈচিত্র্য নেই। তাদের রচনা যে বিচিত্রধারায় ও মননে সার্থক হয়ে উঠছে না, তার কারণ বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতির অভাব। শুধু আদর্শের প্রতি আনুগত্য, কল্পনা, শ্রুতিস্মৃতি ও অনুকরণ দ্বারা সার্থক সৃষ্টি সম্ভব নয়। মানুষের মন ভাঙাগড়া আর সমাজ ভাঙাগড়ার মতো সৃষ্টি কী অল্প-সাধনায় সাধ্য!

    একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারি, ইসলামের মূলবাণী হচ্ছে Live and let live. মানে নিজে বেঁচে থাকো এবং অপরকে বাঁচতে সাহায্য কর। ইসলাম বলে–এমন কিছু তুমি তোমার ভাই-এর জন্যে কামনা করো না, যা তুমি নিজের জন্যে পছন্দ করতে পার না; অর্থাৎ যে-দুঃখ, যে-বেদনা, যে-আঘাত তুমি এড়িয়ে চলতে চাও; সে-দুঃখ, সে-বেদনা, সে-আঘাত তুমি অপরকে দিও না। আজকের হিংসা-কোন্দল-হরণ-শোষণ-জর্জরিত মানুষের কাছে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বাণী কী আছে, যা এই হানাহানি আর কাড়াকাড়ির দুনিয়াতে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে নিঃশঙ্ক শান্তি দান করতে পারে? জীবনের সমস্যা, তথা ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যা এই আদর্শের আলোকে প্রত্যক্ষ করে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশের জনসাধারণ আধিদৈবিক, আধিভৌতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সর্বপ্রকার দুর্যোগ-দুর্ভোগকে মনুষ্যসাধ্য-বহির্ভূত তকদিরের মামলা বলে আত্মপ্রবোধের ছলে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে অভ্যস্ত। এই অদৃষ্টবাদ মানুষের পুরুষ্কারকে যুগ যুগ ধরে অপমানিত ও নিরুদ্যম করে আসছে। এখানেই ঘটেছে আমাদের প্রাণধর্মের, মনুষ্যত্বের ও আত্মশক্তির অপমৃত্যু। একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা–এই হচ্ছে আমাদের স্বীকৃত জীবন-দর্শন। এ মারাত্মক সর্বনাশা সংস্কার থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে। কর্মবিমুখ, সাধনাভীরু, আকাভ ক্ষাবিহীন জনসাধারণ আলস্যকে উদাসীনতা, অক্ষমতাকে নিস্পৃহতা, কাপুরুষতাকে সহনশীলতা, আত্মবিশ্বাসকে অহঙ্কার, পরাজয়কে অদৃশ্যশক্তির ইচ্ছা, অভাব-অনটনকে আত্মিক শোধনের উপায় ও পার্থিব জীবনের দুঃখ-বেদনাকে পারলৌকিক জীবনে সুখের আভাস ঠাওরিয়ে, পৌরুষহীন নিষ্ক্রিয় জীবনকে শ্রেয় মনে করে নিয়েছে। আজকের দিনে খলতা, কপটতা, প্রতারণা, মিথ্যা, অন্যায়, দুর্নীতি পরিণত হয়েছে মানুষের জীবন-বেদে। এ অবস্থা অশুভ এবং পরিণাম ভয়াবহ। ন্যায়নীতি ও সত্য আজ নির্বাসিতা। ন্যায়নীতিবোধ জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ। ন্যায়নীতি, সত্যপ্রীতি হারালে জাতি দাঁড়াবে কিসের জোরে? মিথ্যায় সুবিধা আছে, কিন্তু শক্তি নেই, তাই পতন অনিবার্য। এ কথার কথা নয়, ইতিহাসের বাণী। এজন্যে আমাদের সাহিত্যে প্রতারণা, মিথ্যা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিভীষিকাময় পরিণতির চিত্র অঙ্কিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ন্যায়-নীতি-সত্য যে আত্মমর্যাদা ও মনুষ্যত্বের পরিপোষক, মনোবল ও আত্মশক্তির বিকাশক, এ ধারণাও জন্মিয়ে দিতে হবে ইতিহাসের নজির দিয়ে। মিথ্যা, প্রতারণা ও দুর্নীতির পঙ্ককুণ্ড থেকে জাতিকে উদ্ধার করার ব্রতও গ্রহণ করতে হবে আমাদের সাহিত্য-স্রষ্টাদের।

    শহরগুলোর বস্তিবাসীরা অশিক্ষা-অজ্ঞতা-অক্ষমতার দরুণ জীবনযুদ্ধে ঘায়েল হয়ে হয়ে ক্রমে উচ্ছন্ন যাচ্ছে। খাওয়া-পরার সংগ্রাম তীব্র ও দুর্বিষহ হচ্ছে আর মাথা গুঁজবার ঠাই ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। অপঘাতে অপমৃত্যুর হাত থেকে এদের বাঁচবার ইস বাতলে দিতে হবে সাহিত্যের মাধ্যমে। অন্তত শহর ছেড়ে শহরতলীতেও যেন বাঁচবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তারা, তেমন-পথের সন্ধান দিতে হবে তাদেরকে।

    এদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত কৃষিজীবী ও মজুর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কলকারখানা হওয়ার সাথে সাথে জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাবে যে-অনটন-সমস্যা এ যুগে দেখা দিয়েছে, তার সমাধানের চাবিকাঠি এদের হাতে নেই। অদৃষ্টবাদের জাদুমন্ত্রের প্রভাবে ওরা স্রষ্টা বা সমাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ করতেও ভুলে গেছে, দুঃখের দিনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও ভয় পায়–পাছে খোদা আরও রুষ্ট হন। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ওদের পক্ষ হয়ে ধনবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে। কিন্তু ওরা নিজেরা অদৃষ্টবাদী ও জড়ধর্মী। তাদেরকে আত্মসচেতন করে তুলতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রাণে প্রেরণা যোগাতে হবে আত্মমর্যাদার ও অধিকারবোধের। আজ তাদের জীবনে প্রেম পলাতক না হলেও স্বস্তি পলাতক। বুভুক্ষু, নিরন্ন, রোগগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ আশাহীন, ভাষাহীন পল্লীবাসীকে বাঁচানোর ও সমাজ-কর্মীদের প্রাণে সহানুভূতি ও সাড়া জাগানোর দায়িত্ব সমাজেরই। এরূপে আমাদের দরদী শিক্ষিত জনসাধারণ রাষ্ট্রের মারফত ওদের দুঃখমোচনে সক্ষম হবে। শিক্ষার আলোকে, আত্মমর্যাদাবোধের তীব্রতায় ওরা তখন নিজেরাই বুঝে নেবে নিজেদের দাবী-দাওয়া। বহুকালের অনভ্যাসের ফলে আমাদের দেশের কিশোর ও তরুণেরা বন্দুক-ভীরু হয়ে পড়েছে। বীরত্ব ও দুঃসাহসিকতার ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কিত করে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আমাদের কিশোর-তরুণদের। তাদের সাহস, চিত্তের দৃঢ়তা ও বুকের পাটা দেখে যেন ভয়ও ভয় পায়, ভেতো বাঙালির বদনাম ঘুচুক! পদ্মার দু-তীরে দুঃসাহসী পল্লীবাসী বর্ষাকালীন সর্বগ্রাসিনী পদ্মার প্রলয়-নাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে টিকে রয়েছে যুগ যুগান্তর ধরে, তাদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী আমাদের সাহিত্যের মূল্যবান উপাদান হতে পারে।

    চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সনাতন জীবনযাত্রা প্রণালী ও মনের গতি-প্রকৃতি আমাদের সাহিত্যে পরিবেশন করতে পারে বিচিত্ররস।

    পাটচাষীদের পাটের বাজারদর সম্পর্কিত আশা-নিরাশার চিত্রও সাহিত্য-বস্তু। এ বছ। পাটের দরে না-জানি কেমন করে, ঘরে ঘরে হল ভাবনা। লক্ষ লক্ষ লোকের মরণ-বাঁচন যে পাটের বাজারমূল্যের উপর নির্ভরশীল, পাটচাষীর সে-সমস্যা ও আশা-নৈরাশ্য সাহিত্যে অধিক পরিমাণে রূপায়ণ বাঞ্ছনীয় বৈকী! মেঘনা, পদ্মা আর বঙ্গোপসাগরের জেলেদের ক্ষুদ্রতরী যোগে ঝড়ের রাতের দুঃসাহসিক অভিযানও মনোজ্ঞ সাহিত্যের উপাদান।

    চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালীর নাবিকদের সমুদ্রযাত্রা, প্রবাস, দূরের পিপাসা, বর্মাপ্রবাসী চট্টগ্রামীদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী রহস্য-মধুর রোমান্টিক সাহিত্যের উপাদান হতে পারে।

    এছাড়া কলকারখানার মজুর, রিকশাওয়ালা, গাড়িওয়ালা, বিড়িওয়ালার জীবন তো রয়েছেই। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণও সাহিত্যিকদের ব্রত হওয়া উচিত। নারীর শিক্ষা, অবাধ চলাফেরা ও চাকুরি গ্রহণ ব্যাপারে-বাহ্যত না হোক-যুগসঞ্চিত ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক সংস্কারবশত আমাদের, বিশেষ করে প্রবীণদের মনে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দেখাদেখি যুগরীতির কাছে ঘরে ঘরে সবাই আত্মসমর্পণ করছে সত্য, কিন্তু সমর্থন করে না অনেকেই; প্রতিরোেধ নেই বলে সমর্থন আছে মনে করবার কারণ নেই। এর সামাজিক ও নৈতিক ঝুঁকি এবং মানসিক দ্বন্দ্বেরও সুন্দর চিত্রাঙ্কন চলতে পারে।

    মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত হতভাগ্যদের কথা আগেই বলা হয়েছে।

    মানুষের জীবনে সাহিত্যের উপাদানের অভাব কোনোদিনই হবে না। মানুষ যেমন আকৃতিতে বিচিত্র, তেমনি প্রকৃতি-প্রবৃত্তিতেও। মানুষের এই বিচিত্র জীবনলীলার কাহিনী কোনোদিন বলে শেষ করা যাবে না। তার উপর সৃষ্টি-স্রষ্টা, জগৎ-জীবন, প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিচিত্র সম্পর্ক সংযোগ তো আছেই–এসব রহস্য চির-নতুন সাহিত্যের চিরকালীন উপাদান।

    আমরা ইট-সুরকির কথা আলোচনা করলাম, কিন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে এদের গুরুত্ব বেশি নয়; স্ব স্ব রুচি ও সাধ্যানুসারে শিল্পীরা সাহিত্যসৌধ গড়ে তুলবেন; আকারে-প্রকারে, রূপে-রসে সে সব সৌধ হবে বহুধা ও বহু বিচিত্র। সৃষ্টির ব্যাপারে নির্দেশ চলে না। লেখকের মন-মানসের ধ্যানই স্রষ্টা। বাস্তব অভিজ্ঞতা, দেখবার চোখ, বুঝবার বুদ্ধি, অনুভব করবার হৃদয়, জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, মানব-মনের রুচি, গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান, সামগ্রিক জীবনবোধ–সর্বোপরি রূপায়ণশক্তি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে অপরিহার্য। এজন্যে সাধনা আবশ্যক।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচট্টগ্রামের ইতিহাস – আহমদ শরীফ
    Next Article আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট – আহমেদ রিয়াজ

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }