Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিপ্রদাস – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প273 Mins Read0

    বিপ্রদাস

    ষোল

    দয়াময়ীর আচরণে বন্দনার প্রতি যে প্রচ্ছন্ন লাঞ্ছনা ও অব্যক্ত গঞ্জনা ছিল সতীকে তাহা গভীরভাবে বিঁধিয়াছিল। কিন্তু শাশুড়ীকে কিছু বলা সহজ নয়, তাই সে একখানি চিঠি লিখিয়া বোনের হাতে দিবার জন্য স্বামীকে ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল। দুপুরের ট্রেনে বিপ্রদাস কলিকাতায় ফিরিবে। এমন সময় দয়াময়ী আসিয়া প্রবেশ করিলেন। এরূপ তিনি কখন করেন না,—ছেলে এবং বৌ উভয়েই বিস্মিত হইল—সতী মাথায় আঁচল টানিয়া দিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল, শাশুড়ী নিষেধ করিয়া কহিলেন, না বৌমা, যেও না। তোমার অসাক্ষাতে তোমার বোনের নিন্দে করবো না, একটু দাঁড়াও। বিপিন, জানিস তুই, কেন এত ব্যস্ত হয়ে আমি বাড়ি চলে এলুম?

    বিপ্রদাস বলিল, ঠিক জানিনে মা, কিন্তু কোথায় কি-একটা গোলযোগ ঘটেছে এইটুকুই আন্দাজ করেচি।

    মা কহিলেন, গোলযোগ ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারত। এর থেকে মা দুর্গা আমাকে রক্ষে করেছেন। কাল বেহাই-মশাই বোম্বায়ে চলে যাবেন, কথা ছিল তার পরে বন্দনা এসে কিছুদিন থাকবে ওর মেজদিদির কাছে। কিন্তু মেয়েটার মাথায় যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে ত এখানে সে আর আসতে চাইবে না, বাপের সঙ্গে সোজা বোম্বায়ে চলে যাবে। যদি না যায় যেতে বলে দিস। বৌমা, মনে দুঃখ করো না মা, অমন বোনকে বনবাসে দেওয়া চলে, কিন্তু ঘরে এনে তোলা চলে না।

    বিপ্রদাস নিরুত্তরে চাহিয়া রহিল, তাহার বিস্ময়ের অবধি নাই। দয়াময়ী বলিতে লাগিলেন, আমার পোড়াকপাল যে ওকে ভালবাসতে গিয়েছিলুম, মনে করেছিলুম ও আমাদেরই একজন। ওর চালচলনে গলদ আছে,—ভেবেছিলুম, সে-সব ইস্কুল-কলেজে পড়ার ফল,—চাঁদের গায়ে উড়ো মেঘের মত, বাতাস লাগলে উড়ে যাবে—থাকবে না। হাজার হোক সতীর বোন ত বটে! কিন্তু ও বর বেছে নিলে কায়েতের ঘর থেকে, কে জানত বিপিন, বামুনের বংশে জন্মে ওরা এত অধঃপাতে গেছে!

    বিপ্রদাস কহিল, ও—এই কথা! কিন্তু ওরা যে জাত মানে না এ খবর তুমি ত শুনেছিলে মা?

    দয়াময়ী বলিলেন, শুনেছিলুম, কিন্তু চোখে দেখিনি, বোধ হয় মনে বুঝতেও পারিনি। রূপকথার গল্পের মতো। কিন্তু চোখে দেখলে যে কারো পরে কারো এত বেতেষ্টা জন্মায় তা সত্যিই জানতুম না বাবা। বলিতে বলিতে ঘৃণায় যেন তিনি শিহরিয়া উঠিলেন, কহিলেন, মরুক গে। যা ইচ্ছে হয় করুক, কে আর আমার ও—কিন্তু আমার বাড়িতে আর না।

    বিপ্রদাস চুপ করিয়া আছে দেখিয়া বলিলেন, কৈ জবাব দিলিনে যে বিপিন?

    জবাব ত তুমি চাওনি মা! হুকুম দিলে বন্দনা যেন না আসে,—তাই হবে।

    তাহার কথা শুনিয়া দয়াময়ী দ্বিধায় পড়িলেন, হুকুমটা কি অন্যায় দিচ্ছি তোর মনে হয়?

    হয় বৈ কি মা! বন্দনা অন্যায় কিছু করেনি, সামাজিক আচার-ব্যবহারে আমাদের সঙ্গে তাদের মেলে না, তারা জাত মানে না, এ কথা জেনেই তাকে তুমি আসার আহ্বান করেছিলে, ভালোও বেসেছিলে। তোমার মনে হয়ত আশা ছিল তারা মুখেই বলে কাজে করে না,—এইখানেই তোমার হয়েচে ভুল, আঘাতও পেয়েচো এই জন্যে।

    দয়াময়ী বলিলেন, সে হয়ত সত্যি, কিন্তু ওর বিয়ের ব্যাপারটা শুনলে তোরই কি ঘেন্না হয় না বিপিন? তুই বলিস কি বল ত!

    বিপ্রদাস স্মিতমুখে কহিল, তার বিয়ে এখনো হয়নি, কিন্তু হলেও আমার রাগ করা উচিত নয় মা। বরঞ্চ এই ভেবে শ্রদ্ধাই করবো যে ওদের বিশ্বাস সত্য কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেলে, ওরা ঠকালে না কাউকে। কিন্তু কলকাতায় অনেককে দেখেচি যারা বাক্যের আড়ম্বরে মানে না কিছুই, জাতিভেদ বিশ্বাসও করে না, গালও দেয় প্রচুর, কিন্তু কাজের বেলাতেই গা ঢাকা দেয়,—আর তাদের খুঁজে মেলে না। তাদেরই অশ্রদ্ধা করি আমি সবচেয়ে বেশি। রাগ করো না মা, তোমার দ্বিজুটি হলো এই জাতের।

    শুনিয়া দয়াময়ী মনে মনে যে অখুশী হইলেন তা নয়। দ্বিজুর সম্বন্ধে বলিলেন, ওটা ঐ রকম ফাঁকিবাজ। কিন্তু, আচ্ছা বিপিন, বন্দনাকে যদি তুই ঘৃণাই করিস নে, তবে তার ছোঁয়া কিছু খাসনে কেন? ওকে রান্নাঘরে পাঠাতুম বলে তুই সে-ঘরে খাওয়াই ছেড়ে দিলি, খেতে লাগলি আমার ঘরে। আর কেউ না বুঝুক, আমিও বুঝতে পারিনি ভাবিস?

    বিপ্রদাস বলিল, তুমি বুঝবে না ত মা হয়েছিলে কেন? কিন্তু আমি যে সত্যিই জাত মানি মা, আমি ত তার ছোঁয়া খেতে পারিনে। যেদিন মানবো না সেদিন প্রকাশ্যেই তার হাতে খাবো, একটুও লুকোচুরি করবো না!

    দয়াময়ী বলিলেন, তুই জানিস নে বিপিনি, কি করে আমি তার কাছ থেকে এইটি ঢেকে বেড়াতুম। মেয়েটা এখানে আসুক না আসুক, দেখিস যেন একথা কখনো সে টের না পায়। তার ভারী লাগবে। তোকে সে বড় ভক্তি করে। তাঁহার শেষের কথাগুলি যেন সহসা স্নেহরসে আর্দ্র হইয়া উঠিল।

    বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, আমাকে সে ভক্তি করে কিনা জানিনে মা, কিন্তু তার ছোঁয়া যে খাইনে এ সে জানে।

    অমন অভিমানী মেয়ে এ জেনেও তোকে অত ভক্তি করতো? তার মানে?

    ভক্তি করার কথা তোমরাই জানো মা, কিন্তু আমি জানি সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, তোমাদের সমস্ত ঢাকাঢাকিই সেখানে নিষ্ফল হয়েছে।

    দয়াময়ী ক্ষণকাল নীরবে কি ভাবিলেন, তার পরে বলিলেন, তাই বুঝি সে অতো করে পীড়াপীড়ি করতো?

    কিসের পীড়াপীড়ি মা?

    দয়াময়ী বলিতে লাগিলেন, আমি বিধবা মানুষ, আমার ভাতে-ভাত হলেই চলে, কিন্তু সে তা কিছুতে দেবে না। মার্কেট থেকে নানা নতুন তরকারি আনাবে, নিজে কুটে বেছে দেবে, বামুনপিসিকে দিয়ে দশখানা তরকারি জোর করে রাঁধিয়ে নিয়ে তবে ছাড়বে। ও জানতো সামনে এসে যার দেওয়া চলে না তাকে পরের হাত দিয়ে ঘুষ পাঠাতে হয়। কেন, খেয়েও কি বুঝতে পারিস নি বিপিন, অমন রান্না পিসি তার বাপের জন্মেও রাঁধতে জানে না?

    বিপ্রদাস সহাস্যে উত্তর দিল, না মা, অত লক্ষ্য করিনি। শুধু মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো তোমার অতিথিদের সে-রান্নাঘরের বিপুল আয়োজনের টুকরা-টাকরা হয়ত আমাদের এ-রান্নাঘরেও ছিটকে এসে পড়েছে। কিন্তু সে যে দৈবকৃত নয় একজনের ইচ্ছাকৃত এ খবর আনন্দের। কিন্তু তোমার শেষ আদেশ জানিয়ে দাও মা। ট্রেনের সময় হয়ে এলো, আমাকে এখনি ছুটতে হবে,—তার নিমন্ত্রণ তুমি রাখলে, না প্রত্যাহার করলে তাই বলো।
    দয়াময়ী সতীকে উদ্দেশ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি বলো বৌমা?

    ছেলেবেলায় সতী শাশুড়ীর সম্মুখে স্বামীর সহিত কথা কহিত, কিন্তু এখন আর বলে না। প্রায়ই পাশ কাটাইয়া চলিয়া যায়, নয় নিরুত্তরে থাকে। কিন্তু আজ কথা কহিল, আস্তে আস্তে বলিল, থাক গে মা, এখানে তার আর এসে কাজ নেই।

    জবাব শুনিয়া শাশুড়ী খুশী হইতে পারিলেন না। তাঁহার অভিলাষ ছিল অন্য প্রকার, অথচ নিজের মুখে প্রকাশ করাও চলে না। বলিলেন, বড়মানুষের মেয়ের অভিমান হলো বুঝি?

    না মা, অভিমান নয়, কিন্তু যা করে আমরা চলে এসেচি তার পরে আর তাকে এখানে ডাকা চলে না।

    কেন চলবে না বৌমা, একটা অন্যায় যদি হয়েই থাকে তার কি আর সংশোধন নেই?

    নেই বলিনে, কিন্তু দরকার কি? আগেও অনেকবার সে আসতে চেয়েছে, কিন্তু কখনো আমরা রাজী হতে পারিনি, এখনো সমস্ত বাধা তেমনি আছে। সে ঢুকতো বলে উনি রান্নাঘরের সম্পর্ক ছেড়েছিলেন, কাজ কি তাকে এখানে এনে?

    বিপ্রদাস কহিল, সে নালিশ তার, তোমার নয়। বলিয়াই হাসিয়া ফেলিল, কহিল, তবু বন্দনা আমাকে প্রচণ্ড ভক্তি করে, স্বয়ং মা তার সাক্ষী।

    সতী মুখ তুলিয়া চাহিল, বোধ হয় হঠাৎ ভুলিয়া গেল,শাশুড়ী আছেন, বলিল, শুধু মা কেন আমিও তার সাক্ষী। মেয়েরা ভক্তি যখন করে তখন নালিশ আর করে না। দেবদেবতাও কম পীড়ন করেন না, তবু পূজো বন্ধ করে না, বলে—দুঃখ দিয়েছেন তিনি ভালোর জন্যেই। শাশুড়ীকে বলিল, তোমাকেও বন্দনা কম ভক্তি করেনি মা, কম ভালোবাসে নি। তোমার ধারণা তোমার ঘরে সে খাবার আয়োজন করে দিত কেবল ওঁর জন্যে? তা নয়, করত সে তোমাদের দু’জনের জন্যেই,—তোমাদের দু’জনকেই ভালোবেসে। তার পরে দিয়েছিলে তুমি রান্নাঘরের ভার—সকলকে খেতে দেবার কাজ, কিন্তু তোমাকে অবহেলা করে সে আর সকলকে পোলাও-কালিয়া খাওয়াতে পারত না মা, ভাতে-ভাত সবাইকেই গিলতে হতো। কিন্তু আর কেন তাকে টানাটানি করা? আমরা যা চেয়েছিলুম সে আশা ঘুচেছে—সে আর ফিরবে না মা। এই বলিয়া সতী দ্রুত প্রস্থান করিল।

    দারুণ বিস্ময়ে উভয়েই হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। সতীর স্বভাবে এরূপ উক্তি, এরূপ আচরণ এমনি সৃষ্টিছাড়া যে ভাবাই যায় না সে প্রকৃতিস্থ আছে। বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি মা?

    দয়াময়ী কহিলেন, জানিনে ত বাবা।

    কিসের জন্যে বন্দনাকে তোমরা চেয়েছিলে মা? কিসের আশা ঘুচলো?

    দয়াময়ী মনে মনে লজ্জায় মরিয়া গেলেন, কিছুতে মুখে আনিতে পারিলেন না, কি তাঁর সঙ্কল্প ছিল। শুধু বলিলেন, সে-সব কথা আর একদিন হবে বিপিন, আজ না।

    মা, অক্ষয়বাবুর মেয়ের সম্বন্ধে কি কিছু স্থির করলে? তাঁদের ত একটা জবাব দেওয়া চাই।

    আমার আপত্তি নেই বিপিন, তোদের মত হলেই হবে। দ্বিজুকেও জিজ্ঞাসা করিস সে কি বলে। এই বলিয়া তিনিও ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। বিপ্রদাস সংশয়ে পড়িল। স্পষ্ট বিশেষ হইল না, কিন্তু স্পষ্ট করিয়া লইবারও সময় আর ছিল না।

    বিপ্রদাস কলিকাতায় আসিয়া দেখিল বাড়ি খালি। বন্দনা ও তাহার পিতা ঘণ্টা-কয়েক পূর্বে চলিয়া গেছেন। এ সংশয় যে তাহার একেবারে ছিল না তা নয়, কিন্তু এতটাও আশঙ্কা করে নাই। অন্নদা কারণ জানে না, শুধু এইটুকু জানে যে যাবার ইচ্ছা রায়সাহেবের তেমন ছিল না, কেবল কন্যাই জিদ করিয়া পিতাকে টানিয়া লইয়া গেছে। বন্দনার পরে দাবী কিছুই নাই, থাকার দায়িত্বও তাহার নয়, এখানে সে অতিথি মাত্র, তবু সে যে দেখা না করিয়া পীড়িত দ্বিজদাসকে অচেতন ফেলিয়া রাখিয়া অকারণ ব্যস্ততায় চলিয়া গেছে,—মনে করিতে তাহার ক্লেশ বোধ হইল। অনেকটা রাগের মতো—নির্দয়, নিষ্ঠুর বলিয়া যেন শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু প্রকাশ করা তাহার প্রকৃতি নয়, সে ভাব তাহার মনের মধ্যেই রহিয়া গেল।

    দিন-চারেক পরে বিপ্রদাস হাইকোর্ট হইতে ফিরিল প্রবল জ্বর লইয়া। হয়ত ম্যালেরিয়া, হয়ত বা আর কিছু। চোখ রাঙ্গা, মাথায় যন্ত্রণা অত্যন্ত বেশি, অন্নদা কাছে আসিলে বলিল, অনুদি, অসুখ ত কখন হয় না, বহুকাল জ্বরাসুর দৈত্যটাকে ফাঁকি দিয়ে এসেচি, এবার বুঝি বা সে সুদে-আসলে উসুল করে। মনে হচ্ছে কিছু ভোগাবে, সহজে নিষ্কৃতি দেবে না।

    অবস্থা দেখিয়া অন্নদা চিন্তিত হইল, কিন্তু নির্ভয়ের সুরে সাহস দিয়া বলিল, না দাদা, তোমার পুণ্যের দেহ, এতে দৈত্য-দানার বিক্রম চলবে না। তুমি দু’দিনেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়ে দিই—আমি তাচ্ছিল্য করতে পারবো না।

    তাই দাও দিদি, বলিয়া বিপ্রদাস শয্যা গ্রহণ করিল।

    অন্নদা বিপদে পড়িল। ওদিকে হঠাৎ বাসুদেবের অসুখের সংবাদে কাল দ্বিজদাস বাড়ি গেছে, দত্তমশাই শহরে নাই—মনিবের কাজে তিনিও ঢাকায়। একাকী কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া সকালে আসিয়া বলিল, বিপিন, একটা কথা বলব ভাই, রাগ করবে না ত?

    তোমার কথায় কখনো রাগ করেচি অনুদি?

    অন্নদা পাশে বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিল, প্রাণ দিয়ে রোগের সেবা করতেই পারি, কিন্তু মুখ্যু মেয়েমানুষ জানিনে ত কিছু, বাড়িতেও খবর পাঠাতে পারচি নে, ছেলের অসুখ—ফেলে রেখে বৌ আসবে কি করে—কিন্তু বন্দনাদিদিকে একটা খবর দিলে হয় না?

    বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, বোম্বাই কি এ-পাড়া ও-পাড়া দিদি, যে, খবর পেয়ে সে দেখতে আসবে। হয়ত তার নুন আনতেই এদিকের পান্তা ফুরিয়ে যাবে। তাতে কাজ নেই।

    অন্নদা জিভ কাটিয়া বলিল, বালাই ষাট, এমন কথা মুখে আনতে নেই ভাই। বন্দনাদিদি কলকাতায় আছে, এখানো তার বোম্বায়ে যাওয়া হয়নি।

    বন্দনা কলকতায় আছে?

    হাঁ, তার মাসীর বাড়িতে বালিগঞ্জে। মেসো পাঞ্জাবের বড় ডাক্তার, মেয়ের বিয়ে দিতে দেশে এসেছেন। হঠাৎ হাওড়ার ইস্টিশানে দেখা, তাঁরাও নাবচেন গাড়ি থেকে, এঁরাও যাচ্চেন বোম্বায়ে। মাসী জোর করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলেন, বললেন, দৈবাৎ যখন পাওয়া গেল তখন মেয়ের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তিনি কিছুতে ছেড়ে দেবেন না। শুধু একদিন আটকে রেখে ওর বাপকে তারা যেতে দিলে।

    বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, মাসীটি কি চেনা?

    হাঁ, আপনার বড়মাসী। দূরে দূরে থাকে। সর্বদা দেখাশুনো হয় না, সত্যি, কিন্তু আপন লোক বটে।

    তুমি এত কথা জানলে কি করে অনুদি?

    কাল এসেছিলেন তাঁরা বেড়াতে, দ্বিজুর খবর নিতে। দুপুরবেলায় ওপরের বারান্দায় বসে নাতির জন্য কাঁথা সেলাই করচি, দেখি বাইরের উঠানে দু-গাড়ি লোক এসে উপস্থিত। মেয়ে-পুরুষে অনেকগুলি। কে এঁরা? উঁকি মেরে দেখি আমাদের বন্দনাদিদি। কিন্তু সাজসজ্জায় এমনি বদলেছে যে হঠাৎ চেনা যায় না, যেন সে মেয়ে নয়। কি করি, কোথায় বসাই,—ব্যস্ত হয়ে উঠলুম। খানিক পরে দিদি এলেন ওপরে, সকলের খবর নিলেন, খবর দিলেন,—তাঁর নিজের মুখেই শুনতে পেলুম অন্ততঃ মাসখানেক কলকাতায় থাকা হবে। বললেন, বেশ আছি। থিয়েটার, সিনেমা, চড়িভাতি, বাগান-বাড়ি—আমোদের শেষ নেই। নিত্য নতুন ঘটা।

    বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, বাসুর অসুখের খবর তাকে দিয়েছিলে?

    হাঁ, দিলুম বৈ কি। শুনে বললেন, ও কিছু না,—সেরে যাবে।

    বিপ্রদাস ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিল, তাকে খবর দিয়ে কি হবে অনুদি, আমিও সেরে যাবো। সে কটা দিন তুমি একলা পারবে না আমাকে দেখতে?

    অন্নদা জোর করিয়া কহিল, পারবো বৈ কি ভাই, কিন্তু তবু মনে হয় একবার জানানো উচিত, নইলে বউ হয়ত দুঃখ করবে। হাজার হোক বোন ত?

    ঠিকানা জানো?

    আমাদের শোফার জানে। ওদের পৌঁছে দিয়ে এসেছিল।

    বিপ্রদাস অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা দাও একটা খবর। কিন্তু অতো আমোদ-আহ্লাদ ছেড়ে কি সে আসতে পারে? মনে ত হয় না দিদি।

    অন্নদা বলিল, মনে আমারও বড়ো হয় না ভাই। তার সাজগোজের কথাই কেবল চোখে পড়ে। তবুও একবার বলে পাঠাই।

    বিপ্রদাস নিরুৎসুক ক্লান্তকণ্ঠে শুধু বলিল, পাঠিও দিদি, তাই যখন তোমার ইচ্ছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিরাজবৌ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article বামুনের মেয়ে – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }