Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিপ্রদাস – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প273 Mins Read0

    বিপ্রদাস

    একুশ

    অনেকদিনের পরে বিপ্রদাস নীচের আফিসঘরে আসিয়া বসিয়াছে। সম্মুখে টেবিলের পরে কাগজপত্রের স্তূপ—কতদিনের কত কাজ বাকী। দেহ ক্লান্ত, কিন্তু দ্বিজুর ভরসায় ফেলিয়া রাখাও আর চলে না। একটা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা টানিয়া লইয়া সে পাতা উলটাইতেছিল, বাহিরে মোটরের বাঁশী কানে গেল এবং অনতিবিলম্বে পূবের খোলা দরজা দিয়া বন্দনা প্রবেশ করিল। আজ একা নয়, সঙ্গে একটি অপরিচিত যুবক, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে ফুলকাটা কটকি চটি এবং কাঁধ হইতে তির্যক ভঙ্গিতে জড়ানো মোটা সাদা চাদর। বয়স ত্রিশের নীচে, দেহের গঠন আর একটু দীর্ঘচ্ছন্দের হইলে অনায়াসে সুপুরুষ বলা চলিত। বিপ্রদাস অভ্যর্থনা করিতে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

    বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই, ইনিই মিস্টার চাউড্রি—বার-অ্যাট-ল। কিন্তু এখানে অশোকবাবু বলে ডাকলেও অফেন্স নিতে পারবেন না এই শর্তে আলাপ করিতে দিতে রাজী হয়ে সঙ্গে এনেচি। আলাপ হবে, কিন্তু তার আগে আপন কর্তব্যটা সেরে নিই—এই বলিয়া সে কাছে আসিয়া হেঁট হইয়া নমস্কার করিয়া বলিল, পায়ের ধূলোটা কিন্তু এঁর সুমুখে নিতে পারলুম না পাছে মনে করে বসেন ওঁদের সমাজের আমি কলঙ্ক। কিন্তু তাই বলে যেন অভিমানভরে আপনিও ভেবে নেবেন না নতুন কায়দাটা আমার মাসীর কাছে শেখা। তাঁর পরে আপনার প্রসন্নতার বহরটা আমার পরিমাপ করা কি না!

    বিপ্রদাস কহিল, তোমার মাসীমার কাছে এইভাবেই আমার গুণগান করো নাকি? নবাগত যুবকটির প্রতি ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, বন্দনার মুখে আপনার কথা এত বেশি শুনেচি যে অসুস্থ না থাকলে আমি নিজেই যেতুম আলাপ করতে। দেখেই মনে হলো চেহারাটা পর্যন্ত চেনা, যেন কতবার দেখেচি। ভালোই হলো অযথা বিলম্ব না করে উনি নিজেই সঙ্গে করে আনলেন।

    ভদ্রলোক প্রত্যুত্তরে কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার পূর্বেই বন্দনা শাসনের ভঙ্গীতে তর্জনী তুলিয়া কহিল, মুখুয্যেমশাই, অত্যুক্তি অতিশয়োক্তিকে ছাড়িয়ে প্রায় মিথ্যার কোঠায় এলো, এবার থামুন নইলে হাঙ্গামা করবো।

    ইহার অর্থ?

    ইহার অর্থ এই হয় যে আমাদের অতি-সাধারণদের মত সত্যি-মিথ্যে যা খুশি বানিয়ে বলা আপনারও চলে। আপনি মোটেই অসাধারণ ব্যক্তি নয়,—ঠিক আমাদের মতোই সাধারণ মনুষ্য।

    বিপ্রদাস কহিল, না। সকলকে জিজ্ঞেসা করো, তারা একবাক্যে সাক্ষ্য দেবে তোমার অনুমান অশ্রদ্ধেয়, অগ্রাহ্য।

    বন্দনা বলিল, এবার তাদের কাছেই আপনাকে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঐ সিংহচর্মটি দু’হাতে ছিঁড়ে ফেলে দেবো, তখন আসল মূর্তিটি তারা দেখতে পাবে,—তাদের ভয় ভাঙবে। আমাকে আশীর্বাদ করে বলবে তুমি রাজরানী হও।

    বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, আশীর্বাদে আপত্তি নেই, এমন কি নিজে করতেও প্রস্তুত, কিন্তু আশীর্বাদ ত তোমরা চাও না, বলো কুসংস্কার, বলো ও শুধু কথার কথা।

    বন্দনা পুনরায় আঙুল তুলিয়া বলিল, ফের খোঁচা দেবার চেষ্টা? কে বলেছে গুরুজনদের আশীর্বাদ আমরা চাইনে,—কে বলেচে, কুসংস্কার? এবার কিন্তু সত্যই রাগ হচ্চে মুখুয্যেমশাই।

    বিপ্রদাস গম্ভীর হইয়া বলিল, সত্যই রাগ হচ্চে নাকি? তবে থাক এ-সব গোলমেলে কথা। কিন্তু হঠাৎ সকালবেলাতেই আবির্ভাব কেন? কোন কাজ আছে নাকি?

    বন্দনা কহিল, অনেক। প্রথম আপনার কৈফিয়ত নেওয়া। কেন আমার বিনা হুকুমে নীচে নেমে কাজ শুরু করেছেন?

    করিনি, করবার সঙ্কল্প করেছিলুম মাত্র। এই রইলো—বলিয়া সেই মোটা খাতাটা বিপ্রদাস দূরে ঠেলিয়া দিল।

    বন্দনা প্রসন্নমুখে কহিল, কৈফিয়ত satisfactory; অবাধ্যতা মার্জনা করা গেল। ভবিষ্যতে এমনি অনুগত থাকলেই আমার কাজ চলে যাবে। এবার শুনুন মন দিয়ে। ততক্ষণ এঁর সঙ্গে বসে গল্প করুন—মুখুয্যেদের ঐশ্বর্যের বিবরণ, প্রজা-শাসনের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী—যা খুশি। আমি ওপরে যাচ্ছি অনুদিকে নিয়ে সমস্ত গুছিয়ে নিতে। কাল সকালের ট্রেনে আমরা বলরামপুর যাত্রা করবো, দিনে দিনে যাবো—ঠাণ্ডা লাগার ভয় থাকবে না। মিস্টার চাউড্রির ইচ্ছে সঙ্গে যান,—বড়ঘরের বড়রকমের যাগ-যজ্ঞ-ক্রিয়া-কলাপ দীয়তাং ভুজ্যতাং ঘটা-পটা কখনো চোখে দেখেন নি,—আর কোথা থেকেই বা দেখবেন—

    বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করিল, তুমি নিজে নিশ্চয়ই অনেক দেখেচো—

    বন্দনা কহিল, এ প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর ও ভদ্ররুচি-বিগর্হিত। উনি দেখেন নি এই কথাই হচ্ছিলো। তা শুনুন। ওঁকে অনুমতি দিয়েছি সঙ্গে যাবার, তাতে এত খুশী হয়েচেন যে তার পরে আমাকে সঙ্গে করে বোম্বাই পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সম্মত হয়েচেন।

    বিপ্রদাস মুখ অতিশয় গম্ভীর করিয়া কহিল, বলো কি? এতখানি ত্যাগ স্বীকার আমাদের সমাজে মেলে না, এ শুধু তোমাদের মধ্যেই পাওয়া যায়। শুনে বিস্ময় লাগচে।

    বন্দনা বলিল, লাগবার কথাই যে। জপ-তপও আছে, ষোল-আনা হিংসেও আছে। এই বলিয়া সে চোখের দৃষ্টিতে এক ঝলক বিদ্যুৎ ছড়াইয়া বাহির হইয়া যাইতেছিল, বিপ্রদাস তাহাকে ডাকিয়া কহিল, এ যেন কথামালার সেই কুকুরের ভূষি আগলানোর গল্প। খাবেও না, আর ষাঁড়ের দল এসে যে মনের সাধে চিবোবে তাও দেবে না। মানুষ বাঁচে কি করে বলো ত?

    বন্দনা দ্বার-প্রান্তে থমকিয়া দাঁড়াইয়া কৃত্রিম রোষে ভ্রূ-কুঞ্চিত করিল, বলিল, ঠিক আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ, কিচ্ছু তফাত নেই। লোকগুলো কেবল মিথ্যে ভয় করে মরে।

    তুমি গিয়ে এবার তাদের ভয় ভেঙ্গে দিয়ে এসো।

    তাই তো যাচ্চি এবং ভূষির সঙ্গে একজনের উপমা দেবার দুর্বুদ্ধিরও শোধ নিয়ে আসবো—এই বলিয়া বন্দনা দীপ্ত কটাক্ষে পুনরায় তড়িৎ-বৃষ্টি করিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।

    বিপ্রদাস কহিল, মিস্টার—

    অশোক সবিনয়ে বাধা দিল,—না না, চলবে না। ওটাকে বাদ দিতে বাধবে না বলেই ধুতি-চাদর এবং চটি-জুতো পরে এসেচি বিপ্রদাসবাবু। উনিও ভরসা দিয়েছিলেন যে—
    বিপ্রদাস মনে মনে খুশী হইয়া বলিল, ভালোই হ’লো অশোকবাবু, সম্বোধনটা সহজ দাঁড়ালো। পাড়াগাঁয়ে মানুষ, মনেও থাকে না, অভ্যাসও নেই, এবার স্বচ্ছন্দে আলাপ জমাতে পারবো। শুনলুম আমাদের পল্লীগ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছেন, সত্যিই যদি যান ত কৃতার্থ হবো। আমাদের সংসারের কর্ত্রী আমার মা, তাঁর পক্ষ থেকে আপনাকে আমি সসম্মানে আমন্ত্রণ করচি।

    বিপ্রদাসের বিনয়-বচনে অশোক পুলকিতচিত্তে বলিল, নিশ্চয় যাবো—নিশ্চয় যাবো। কত দরিদ্র অনাথ আতুর আসবে নিমন্ত্রণ রাখতে, কত অধ্যাপক পণ্ডিত উপস্থিত হবেন বিদায় গ্রহণ করতে—আনন্দোৎসবে কত খাওয়া–দাওয়া, কত আসা-যাওয়া, কত বিচিত্র আয়োজন—

    বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, সমস্ত বাড়ানো কথা অশোকবাবু, বন্দনা শুধু রহস্য করেছে।

    রহস্য করে তার লাভ কি বিপ্রদাসবাবু?

    একটা লাভ আমাদের অপ্রতিভ করা। বলরামপুরের মুখুয্যেদের ওপর সে মনে মনে চটা। দ্বিতীয় লাভ আপনাকে সে কোন ছলে বোম্বায়ে টেনে নিয়ে যেতে চায়।

    অশোক বলিল, প্রয়োজন হলে বোম্বাই পর্যন্ত আমাকে সঙ্গে যেতে হবে এ কথা আছে, কিন্তু মুখুয্যেদের পরে সে চটা, আপনাদের সে লজ্জিত করতে চায় এমন হতেই পারে না। কালও বলরামপুরে যাবার স্থির ছিল না, কিন্তু আপনাদের কথা নিয়ে ওর মাসীর সঙ্গে হয়ে গেল ঝগড়া। মাসী বললেন, বিপ্রদাসের মা সর্বসাধারণের হিতার্থে যদি জলাশয় খনন করিয়ে থাকেন ত তাঁর প্রশংসা করি, কিন্তু ঘটা করে প্রতিষ্ঠা করার কোন অর্থ নেই,—ওটা কুসংস্কার। কুসংস্কারে যোগ দেওয়া আমি অন্যায় মনে করি। বন্দনা বললেন,—ওঁরা বড়লোক, বড়লোকের কাজেকর্মে ঘটা ত হয়েই থাকে মাসীমা। তাতে আশ্চর্যের কি আছে? আমার পিসীমা বললেন, বড়লোকের অপব্যয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই মানি, কিন্তু ও-ত কেবল ও-ই নয়, ও-টা কুসংস্কার। তোমার যাওয়াতেই আমার আপত্তি। বন্দনা বললেন, আমি কিন্তু কুসংস্কার মনে করিনে মাসীমা। বরঞ্চ, এই মনে করি যে, যা জানিনে, জানার কখনো চেষ্টা করিনি, তাকে সরাসরি বিচার করতে যাওয়াই কুসংস্কার। ওঁর জবাব শুনে পিসীমা রাগে জ্বলে গেলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবার অনুমতি নিয়েছো?

    বন্দনা উত্তর দিলেন, বাবা বারণ করবেন না আমি জানি। দিদির স্বামী অসুস্থ, তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার ভার পড়েছে আমার ওপর।

    ভার দিলে কে শুনি? তিনি নিজেই বোধ হয়? প্রশ্ন শুনে বন্দনা যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। আমার মনে হলো তাঁর মাথায় দ্রুত রক্ত চড়ে যাচ্ছে, এবার হঠাৎ কি একটা বলে ফেলবেন, কিন্তু, সে-সব কিছুই করলেন না, শুধু আস্তে আস্তে বললেন, যে যা খুশি জিজ্ঞেসা করলেই যে আমাকে জবাব দিতে হবে ছেলেবেলা থেকে এ শিক্ষা আমার হয়নি মাসীমা। পরশু সকালে মুখুয্যেমশাইকে নিয়ে আমি বলরামপুরে যাবো এর বেশি তোমাকে বলতে পারবো না।

    পিসীমা রাগ করে উঠে গেলেন। আমি বললুম, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন? আমার ভারী ইচ্ছে করে ঐ-সব আচার-অনুষ্ঠান চোখে দেখি। বন্দনা বললেন, কিন্তু সে-সব যে কুসংস্কার অশোকবাবু। চোখে দেখলেও যে আপনাদের জাত যায়। বললুম, যদি আপনার না যায় ত আমারও যাবে না। আর যদি যায় ত দুজনের একসঙ্গেই জাত যাক, আমার কোন ক্ষতি নেই।

    বন্দনা বললেন, আপনি ত বিশ্বাস করেন না, সে-সব চোখে দেখলে যে মনে মনে হাসবেন।

    বললুম, আপনিই কি বিশ্বাস করেন নাকি? তিনি বললেন, না করিনে, কিন্তু মুখুয্যেমশাই করেন। আমি কেবল আশা করি তাঁর বিশ্বাসই যেন একদিন আমারও সত্যি বিশ্বাস হয়ে ওঠে। বিপ্রদাসবাবু, আপনাকে বন্দনা মনে মনে পূজো করে, এত ভক্তি সে জগতে কাউকে করে না।

    খবরটা অজানা নয়, নূতনও নয়, তথাপি অপরের মুখে শুনিয়া তাহার নিজের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া গেল।

    ক্ষণেক পরে প্রশ্ন করিল, আপনাদের যে বিবাহের প্রস্তাব হয়েছিল সে কি স্থির হয়ে গেছে? বন্দনা সম্মতি দিয়েছেন?

    না। কিন্তু অসম্মতিও জানান নি।

    এটা আশার কথা অশোকবাবু। চুপ করে থাকাটা অনেক ক্ষেত্রেই সম্মতির চিহ্ন।

    অশোক সকৃতজ্ঞ-চক্ষে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিল, নাও হতে পারে। অন্ততঃ, নিজে আমি এখনো তাই মনে করি। একটু থামিয়া কহিল, মুশকিল হয়েছে এই যে আমি গরীব, কিন্তু বন্দনা ধনবতী। ধনে আমার লোভ নেই তা নয়, কিন্তু পিসীমার মতো ঐটেই আমার একমাত্র লক্ষ্য নয়। এ কথা বোঝাবে কি করে যে, পিসীমার সঙ্গে আমি চক্রান্ত করিনি।

    এই লোকটির প্রতি মনে মনে বিপ্রদাসের একটা অবহেলার ভাব ছিল, তাহার বাক্যের সরলতায় এই ভাবটা একটু কমিল। সদয়কণ্ঠে কহিল, পিসীর ষড়যন্ত্রে আপনি যে যোগ দেননি সত্যি হলে এ কথা বন্দনা একদিন বুঝবেই, তখন প্রসন্ন হতেও তার বিলম্ব হবে না, ধনের পরিমাণ নিয়েও তখন বাধা ঘটবে না।

    অশোক উৎসুক-কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এ কি আপনি নিশ্চয় জানেন বিপ্রদাসবাবু?

    ইহার জবাব দিতে গিয়া বিপ্রদাস দ্বিধায় পড়িল, একটু ভাবিয়া বলিল, ওর যতটুকু জানি তাই ত মনে হয়।

    অশোক কহিল, আমার কি মনে হয় জানেন? মনে হয়, ওঁর নিজের প্রসন্নতার চেয়েও আমার ঢের বেশি প্রয়োজন আপনার প্রসন্নতায়। সে যেদিন পাবো, আমার না-পাবার কিছু থাকবে না।

    বিপ্রদাস সহাস্যে কহিল, আমার প্রসন্ন দৃষ্টি দিয়ে ও স্বামী নির্বাচন করবে এমন অদ্ভুত ইঙ্গিত আপনাকে দিলে কে—বন্দনা নিজে? যদি দিয়ে থাকে ত নিছক পরিহাস করেছে এই কথাই কেবল বলতে পারি অশোকবাবু!

    না পরিহাস নয়, এ সত্য।

    কে বললে?

    অশোক একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া কহিল, এ-সব মুখ দিয়ে বলার বস্তু নয় বিপ্রদাসবাবু। সেদিন মাসীমার সঙ্গে ঝগড়া করে বন্দনা আমার ঘরে এসে ঢুকলেন—এমন কখনো করেন না—একটা চৌকি টেনে নিয়ে বসে বললেন, আমাকে বোম্বায়ে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। বললুম, যখনি হুকুম করবেন তখনি প্রস্তুত। বললেন, যাচ্চি বলরামপুরে, সময় হলে তার পরে জানাবো। বললুম, তাই জানাবেন,কিন্তু মাসীকে অমন চটিয়ে দিলেন কেন? তাঁদের ঐ-সব পূজো-পাঠ, হোম-জপ, ঠাকুর-দেব্‌তা সত্যিই ত আর বিশ্বাস করেন না, তবু বললেন, বিশ্বাস করতে পেলে বেঁচে যাই। কেন বললেন ও কথা? বন্দনা বললেন, মিথ্যে বলিনি অশোকবাবু, ওঁদের মতো সত্য বিশ্বাসে ঐ-সব যদি কখনো গ্রহণ করতে পারি আমি ধন্য হয়ে যাব। মুখুয্যেমশায়ের অসুখে সেবা করেছিলুম, তাঁর কাছে একদিন বিশ্বাসের বর চেয়ে নেবো। তার পরে শুরু হলো আপনার কথা। এত শ্রদ্ধা যে কেউ কাউকে করে, কারো শুভ-কামনায় কেউ যে এমন অনুক্ষণ মগ্ন থাকতে পারে এর আগে কখনো কল্পনাও করিনি। কথায় কথায় তিনি একদিনের একটা ঘটনার উল্লেখ করলেন। তখন আপনি অসুস্থ, আপনার পূজো-আহ্নিকের আয়োজন তিনিই করেন। সেদিন বেলা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি আসতে কি একটা পায়ে ঠেকলো, যতই নিজেকে বোঝাতে চাইলেন ও কিছু নয়, ওতে পূজোয় ব্যাঘাত হবে না, ততই কিন্তু মন অবুঝ হয়ে উঠতে লাগলো পাছে কোথা দিয়েও আপনার কাজে ত্রুটি স্পর্শ করে। তাই আবার স্নান করে এসে সমস্ত আয়োজন তাঁকে নূতন করে করতে হলো। আপনি কিন্তু সেদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, বন্দনা, সকালে যদি তোমার ঘুম না ভাঙ্গে ত অন্নদাদিদিকে দিও পূজার সাজ করতে। মনে পড়ে বিপ্রদাসবাবু?

    বিপ্রদাস মাথা নাড়িয়া বলিল, পড়ে।

    অশোক বলিতে লাগিল, এমনি কতদিনের কত ছোটখাটো বিষয় গল্প করে বলতে বলতে সেদিন রাত্রি অনেক হয়ে গেল, শেষে বললেন, মাসী তাঁদের কুসংস্কারের খোঁটা দিলেন, আমি নিজেও একদিন দিয়েছি অশোকবাবু—কিন্তু আজ কোন্‌টা ভালো কোন্‌টা মন্দ বুঝতে আমার গোল বাধে। খাওয়ার বিচার ত কোন দিন করিনি, আজন্মের বিশ্বাস এতে দোষ নেই, কিন্তু এখন যেন বাধা ঠেকে। বুদ্ধি দিয়ে লজ্জা পাই, লোকের কাছে লুকোতে চাই, কিন্তু যখনই মনে হয় এ-সব উনি ভালোবাসেন না, তখনি মন যেন ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে।
    শুনিতে শুনিতে বিপ্রদাসের মুখ পাংশু হইয়া আসিল, জোর করিয়া হাসির চেষ্টা করিয়া বলিল, বন্দনা বুঝি এখন খাওয়া-ছোঁয়ার বিচার আরম্ভ করেছে? কিন্তু সেদিন যে এসে দম্ভ করে বলে গেল মাসীর বাড়িতে গিয়ে ও আপন সমাজ, আপন সহজ বুদ্ধি ফিরে পেয়েছে, মুখুয্যেদের বাড়ির সহস্র প্রকারের কৃত্রিমতা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বেঁচে গেছে!

    অশোক সবিস্ময়ে কি একটা বলিতে গেল কিন্তু বিঘ্ন ঘটিল। পর্দা সরাইয়া বন্দনা প্রবেশ করিয়া বলিল, মুখুয্যেমশাই, সমস্ত গুছিয়ে রেখে এলুম। কাল সকাল সাড়ে-ন’টার গাড়ি।

    পূজো-টুজো, বাজে কাজগুলো ওর মধ্যে সেরে রাখবেন। এত বিড়ম্বনাও ভগবান আপনার কপালে লিখেছিলেন।

    বিপ্রদাস হাসিয়া বলিল, তাই হবে বোধ হয়।

    বোধ হয় নয় নিশ্চয়। ভাবি এগুলো কেউ আপনার ঘুচোতে পারতো। তা শুনুন। কালকের সকালের খাবার ব্যবস্থাও করে গেলুম, আমি নিজে এসে খাওয়াবো, তার পরে কাপড়-চোপড় পরাবো, তার পরে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যাবো। রোগা মানুষ কিনা—তাই। চলুন অশোকবাবু, এবার আমরা যাই। পায়ের ধূলো কিন্তু আর নেবো না মুখুয্যেমশাই, ওটা কুসংস্কার। ভদ্রসমাজে অচল। এই বলিয়া সে হাসিয়া হাত-দুটা মাথায় ঠেকাইয়া বাহির হইয়া গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিরাজবৌ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article বামুনের মেয়ে – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }