Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিপ্রদাস – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প273 Mins Read0

    বিপ্রদাস

    পঁচিশ

    বন্দনার নির্বিঘ্নে বোম্বাই পৌঁছান—সংবাদের উত্তরে দিনকয়েক পরে দ্বিজদাসের নিকট হইতে জবাব আসিয়াছিল যে, সে নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় যথাসময়ে চিঠি লিখিতে পারে নাই। বন্দনা নিজের চোখে যেমন দেখিয়া গেছে সমস্ত তেমনি চলিতেছে। বিশেষ করিয়া জানাইবার কিছু নাই। মৈত্রেয়ীর পিতা কলিকাতায় ফিরিয়া গেছেন, কিন্তু সে নিজে এখনও এ বাড়িতেই আছে। মায়ের সেবা-যত্নে তাহার ত্রুটি ধরিবার কিছু নাই, সংসারের ভারও তাহারি উপরে পড়িয়াছে, ভালোই চালাইতেছে। বাড়ির সকলেই তাহার প্রতি খুশী। দ্বিজদাসের নিজের পক্ষ হইতেও আজিও অভিযোগের কারণ ঘটে নাই। পরিশেষে, বন্দনা ও তাহার পিতার শুভকামনা করিয়া ও যথাবিধি নমস্কারাদি জানাইয়া সে পত্র সমাপ্ত করিয়াছে।

    ইহার পরে তিন মাসেরও অধিক সময় কাটিয়াছে, কিন্তু কোন পক্ষ হইতেই আর পত্রাদির আদান-প্রদান হয় নাই। বিপ্রদাসের, মেজদিদির, বাসুর সংবাদ জানিতে মাঝে মাঝে বন্দনার মন উতলা হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু জানিবার উপায় খুঁজিয়া পায় নাই। নিজে হইতে তাঁহারা আজও খবর দেন নাই,—কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সমস্তই অপরিজ্ঞাত। ইহারই সুপারিশ করিতে দ্বিজদাসকে অনুরোধ করিয়া চিঠি লিখিবার লজ্জা এত বড় যে, শত ইচ্ছা সত্ত্বেও একাজ তাহার কাছে অসাধ্য ঠেকিয়াছে। এখন বলরামপুরের স্মৃতির তীক্ষ্ণতা ও বেদনার তীব্রতা দুই-ই অনেক লঘু হইয়া গেছে, কিন্তু সেখান হইতে চলিয়া আসার পরে সে প্রায় ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম করিয়াছিল। কিন্তু দিনের পর দিন ধরিয়া ব্যথাতুর বিক্ষুব্ধ চিত্ততল ধীরে ধীরে যতই শান্ত হইয়া আসিয়াছে ততই উপলব্ধি করিয়াছে তাহাদের সম্বন্ধ কোন সত্যকার সম্বন্ধ নহে। একত্রবাসের সেই দুঃখে-সুখে ভরা অনির্বচনীয় দিনগুলি বিচিত্র ঘনিষ্ঠতায় মনের মধ্যে যতই কেননা নিবিড়তার মোহ সঞ্চার করিয়া থাক আয়ু তার ক্ষণস্থায়ী। এ কথা বুঝিতে তাহার বাকী নাই যে, এই আচারনিষ্ঠ প্রাচীনপন্থী মুখুয্যে-পরিবারের কাছে সে আবশ্যকও নয়, আপনারও নয়। উভয় পক্ষের শিক্ষা, সংস্কার ও সামাজিক পরিবেষ্টনে যে ব্যবধান সৃষ্টি করিয়াছে তাহা যেমন সত্য, তেমনি কঠিন।

    ইতিমধ্যে স্বামীর কর্মস্থল পাঞ্জাব হইতে মাসী আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। শরীর ভালো নয়। পাঞ্জাবের চেয়ে বোম্বায়ের জল-বাতাস ভালো এ বুদ্ধি তাঁহাকে কোন্‌ ডাক্তার দিয়াছে সে তিনিই জানেন। কিন্তু আসিয়াছেন স্বাস্থ্যের অজুহাতে। বোম্বাই আসিবার পূর্বে বন্দনা দেখা করিয়া আসে নাই, এ অভিযোগ তাঁহার মনের মধ্যে ছিল, কিন্তু বোনঝির মেজাজের যেটুকু পরিচয় পাইয়াছেন তাহাতে ভগিনীপতি রে-সাহেবের দরবারে প্রকাশ্য নালিশ রুজু করিবার সাহস ছিল না, তথাপি খাবার টেবিলে বসিয়া কথাটা তিনি ইঙ্গিতে পাড়িলেন। বলিলেন, মিস্টার রে, এটা আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানিনে, কিন্তু আমি অনেক দেখেচি বাপ-মায়ের এক ছেলে কিংবা এক মেয়ে এমনি একগুঁয়ে হয়ে ওঠে যে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না।

    সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বীকার করিলেন, এবং দেখা গেল দৃষ্টান্ত তাঁহার হাতের কাছেই মজুত আছে। সানন্দে তাহার উল্লেখ করিয়া বলিলেন, এই যেমন আমার বুড়ী। একবার না বললে হাঁ বলায় সাধ্য কার? ওর ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি—

    বন্দনা কহিল, তাই বুঝি তোমার অবাধ্য মেয়েকে ভালোবাসো না বাবা?

    সাহেব সজোরে প্রতিবাদ করিলেন, তুমি আমার অবাধ্য মেয়ে? কোনদিন না। কেউ বলতে পারে না।

    বন্দনা হাসিয়া ফেলিল,—এইমাত্র যে তুমিই বললে বাবা।

    আমি? কখনো না।

    শুনিয়া মাসী পর্যন্ত না হাসিয়া পারিল না।

    বন্দনা প্রশ্ন করিল, আচ্ছা বাবা, তোমার মতো আমার মা—ও কি আমাকে দেখতে পারতেন না?

    সাহেব বলিলেন, তোমার মা? এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কতবার ঝগড়া হয়েছে। ছেলেবেলায় তুমি একবার আমার ঘড়ি ভেঙ্গেছিলে। তোমার মা রাগ করে কান মলে দিলেন, তুমি কাঁদতে কাঁদতে পালিয়ে এলে আমার কাছে। আমি বুকে তুলে নিলাম। সেদিন তোমার মার সঙ্গে আমি সারাদিন কথা কইনি। বলিতে বলিতে তিনি পূর্বস্মৃতির আবেগে উঠিয়া আসিয়া মেয়ের মাথাটি বুকের কাছে টানিয়া লইয়া ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া দিলেন।

    বন্দনা বলিল, ছেলেবেলার মতো এখন কেন ভালবাস না বাবা?

    সাহেব মাসীকে আবেদন করিলেন,—শুনলেন মিসেস ঘোষাল, বুড়ীর কথা?

    বন্দনা কহিল, কেন তবে যখন-তখন বলো আমার বিয়ে দিয়ে ঝঞ্ঝাট মিটিয়ে ফেলতে চাও? আমি বুঝি তোমার চোখের বালি?

    শুনচেন মিসেস ঘোষাল, মেয়েটার কথা?

    মাসী বললেন, সত্যি বন্দনা। মেয়ে বড় হলে বাপ-মায়ের কি যে বিষম দুশ্চিন্তা নিজের মেয়ে হলে একদিন বুঝবে।

    আমি বুঝতে চাইনে মাসীমা।

    কিন্তু পিতার কর্তব্য রয়েছে যে মা। বাপ-মা ত চিরজীবী নয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ না ভাবলে তাঁদের অপরাধ হয়। কেন যে তোমার বাবা মনের মধ্যে শান্তি পান না, সে শুধু যারা নিজেরা বাপ-মা তারাই জানে। তোমার বোন প্রকৃতির যতদিন না আমি বিয়ে দিতে পেরেছি ততদিন খেতে পারিনি, ঘুমোতে পারিনি। কত রাত্রি যে জেগে কেটেছে সে তুমি বুঝবে না, কিন্তু তোমার বাবা বুঝবেন। তোমার মা বেঁচে থাকলে আজ তাঁরও আমার দশাই হতো।

    রে-সাহেব মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিলেন, খুব সত্যি মিসেস ঘোষাল।

    মাসী তাঁহাকেই উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিলেন, আজ ওর মা বেঁচে থাকলে বন্দনার জন্যে আপনাকে তিনি অস্থির করে তুলতেন। আমি নিজেই কি কম করেছি ওঁকে। এখন মনে করলেও লজ্জা হয়।

    সাহেব সায় দিয়া বলিলেন, দোষ নেই আপনার। ঠিক এমনিই হয় যে।

    মাসী বলিতে লাগিলেন, তাই ত জানি। কেবলি ভাবনা হয় নিজেদের বয়েস বাড়চে,—মানুষের বেঁচে থাকার ত স্থিরতা নেই—বেঁচে থাকতে মেয়েটার যদি না কোন উপায় করে যেতে পারি হঠাৎ কিছু ঘটলে কি হবে। ভয়ে উনি ত একরকম শুকিয়ে উঠেছিলেন।

    বন্দনা আর সহিতে পারিল না, চাহিয়া দেখিল তাহার বাবার মুখও শুকাইয়া উঠিয়াছে, খাওয়া বন্ধ হইয়াছে, বলিল, তুমি মেসোমশাইকে অকারণে নানা ভয় দেখিয়েচো মাসীমা, আবার আমার বাবাকেও দেখাচ্চো। কি এমন হয়েছে বলো ত? বাবা এখনো অনেকদিন বাঁচবেন। তাঁর মেয়ের জন্যে যা ভালো, করে যাবার ঢের সময় পাবেন। তুমি মিথ্যে ভাবনা বাড়িয়ে দিও না বাবার।

    মাসী দমিবার পাত্রী নহেন। বিশেষতঃ রে-সাহেব তাঁহাকেই সমর্থন করিয়া বলিলেন, তোমার মাসীমা ঠিক কথাই বলেছেন বন্দনা। সত্যিই ত আমার শরীর ভালো নয়, সত্যিই ত এ দেহকে বেশী বিশ্বাস করা চলে না। উনি আত্মীয়, সময় থাকতে উনি যদি সতর্ক না করেন কে করবে বলো ত? এই বলিয়া তিনি উভয়ের প্রতিই চাহিলেন। মাসী কটাক্ষে চাহিয়া দেখিলেন বন্দনার মুখ ছায়াছন্ন হইয়াছে, অপ্রতিভকণ্ঠে ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, এ বলা অত্যন্ত অসঙ্গত মিস্টার রে। আপনার এক শ’ বছর পরমায়ু হোক আমরা সবাই প্রার্থনা করি, আমি শুধু বলতে চেয়েছিলুম—

    সাহেব বাধা দিলেন,—না, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। সত্যিই স্বাস্থ্য আমার ভালো না। সময়ে সাবধান না হওয়া, কর্তব্যে অবহেলা করা আমার পক্ষে সত্যিই অন্যায়।

    বন্দনা গূঢ় ক্রোধ দমন করিয়া বলিল, আজ বাবার খাওয়া হবে না মাসীমা।

    মাসী বলিলেন, থাক এ—সব আলোচনা মিস্টার রে। আপনার খাওয়া না হলে আমি ভারী কষ্ট পাবো।

    সাহেবের আহারে রুচি চলিয়া গিয়াছিল, তথাপি জোর করিয়া তিনি এক টুকরা মাংস কাটিয়া মুখে পুরিলেন। অতঃপর খাওয়ার কার্য কিছুক্ষণ ধরিয়া নীরবেই চলিল।

    সাহেব প্রশ্ন করিলেন, জামাইয়ের প্র্যাক্‌টিস কিরকম হচ্চে মিসেস ঘোষাল?

    মাসী জবাব দিলেন, এই ত আরম্ভ করেছেন। শুনতে পাই মন্দ না।

    আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিলে তিনি মুখের গ্রাসটা গিলিয়া লইয়া কহিলেন, প্র্যাক্‌টিস যাই হোক মিস্টার রে, আমি এইটেই খুব বড় মনে করিনে। আমি বলি তার চেয়েও ঢের বড় মানুষের চরিত্র। সে নির্মল না হলে কোন মেয়েই কোনদিন যথার্থ সুখী হতে পারে না।

    তাতে আর সন্দেহ আছে কি!

    মাসী বলিতে লাগিলেন, আমার মুশকিল হয়েছে আমার বাপের বাড়ির শিক্ষা-সংস্কার, তাঁদের দৃষ্টান্ত আমার মনে গাঁথা। তার থেকে একতিল কোথাও কম দেখলে আর সইতে পারিনে। আমার অশোককে দেখলে সেই নৈতিক আবহাওয়ার কথা মনে পড়ে, ছেলেবেলায় যার মধ্যে আমি মানুষ। আমার বাবা, আমার দাদা — এই অশোকও হয়েছে ঠিক তাঁদের মতো। তেমনি সরল, তেমনি উদার, তেমনি চরিত্রবান।

    রে-সাহেব সম্পূর্ণ মানিয়া লইলেন, বলিলেন, আমারও ঠিক তাই মনে হয়েছে মিসেস ঘোষাল। ছেলেটি অতি সৎ। ছ-সাত দিন এখানে ছিল, তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। এই বলিয়া তিনি কন্যাকে সাক্ষ্য মানিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বলিস বুড়ী, অশোককে আমাদের কি ভালই লেগেছিল। যেদিন চলে গেল আমার ত সমস্ত দিন মন খারাপ হয়ে রইলো।

    বন্দনা স্বীকার করিয়া কহিল, হাঁ বাবা, চমৎকার মানুষ। যেমন বিনয়ী তেমনি ভদ্র।
    আমার ত কোন অনুরোধে কখনো না বলেন নি। আমাকে বোম্বায়ে তিনি না পৌঁছে দিলে আমার বিপদ হতো।

    মাসী বলিলেন, আর একটা জিনিস বোধ হয় লক্ষ্য করেছো বন্দনা, ওর স্নবরি নেই। যেটি আজকালকার দিনের দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয় যে আমাদের মধ্যে অনেকেরই দেখতে পাওয়া যায়।

    বন্দনা সহাস্যে কহিল, তোমার বাড়িতে কোন স্নবের দেখা ত কোনদিন পাইনি মাসীমা।

    মাসী হাসিয়া বলিলেন, পেয়েছো বৈ কি মা। তুমি অতি বুদ্ধিমতী, তোমাকে ঠকাবে তারা কি করে?

    শুনিয়া রে-সাহেবও হাসিলেন, কথাটি তাঁহার ভারী ভালো লাগিল। বলিলেন, এত বুদ্ধি সচরাচর মেলে না মিসেস ঘোষাল। বাপের মুখে এ কথা গর্বের মতো শুনতে, কিন্তু না বলেও পারিনে।

    বন্দনা বলিল, এ প্রসঙ্গ তুমি বন্ধ করো মাসীমা, নইলে বাবাকে সামলানো যাবে না। তুমি এক-মেয়ের দোষগুলোই দেখেছো, কিন্তু দেখোনি যে এক-মেয়ের বাপেদের মতো দাম্ভিক লোকও পৃথিবীতে কম। আমার বাবার ধারণা ওঁর মেয়ের মতো মেয়ে সংসারে আর দ্বিতীয় নেই।

    মাসী বলিলেন, সে ধারণার আমিও বড় অংশীদার বন্দনা। শাস্তি পেতে হলে আমারও পাওয়া উচিত।

    পিতার মুখে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তির মৃদু হাসি, কহিলেন, আমি দাম্ভিক কিনা জানিনে, কিন্তু জানি কন্যা-রত্নে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। এমন মেয়ে কম বাপেই পায়।

    বন্দনা বলিল, বাবা, কৈ আজ ত তুমি একটিও সন্দেশ খেলে না? ভালো হয়নি বুঝি?

    সাহেব প্লেট হইতে আধখানা সন্দেশ ভাঙ্গিয়া লইয়া মুখে দিলেন, বলিলেন, সমস্ত বুড়ীর নিজের হাতের তৈরি। এবার কলকাতা থেকে ফিরে পর্যন্ত ও সমস্ত খাওয়া বদলে দিয়েছে। ডালনা, সুক্ত, মাছের ঝোল, দই, সন্দেশ আরও কত কি। কার কাছে শুনে এসেছে জানিনে, কিন্তু বাড়িতে মাংস প্রায় আনতেই দেয় না। বলে বাবার ওতে অসুখ করে। দেখুন মিসেস ঘোষাল, এই-সব বাঙলা খাওয়া খেয়ে মনে হয় যেন বুড়ো বয়েসে আছি ভালো। বেশ যেন একটু ক্ষিদে বোধ করি।

    বন্দনা বলিল, মাসীমার অভ্যেস নেই, হয়ত কষ্ট হয়।

    মাসী এই গূঢ় বিদ্রূপ লক্ষ্য করিলেন না, কহিলেন, না না, কষ্ট হবে কেন, এ আমার ভালোই লাগে। শুধু আবহাওয়ার চেঞ্জই ত নয়, খাবার চেঞ্জও বড় দরকার। তাই বোধ করি শরীর আমার এত শীঘ্র ভালো হয়ে গেল।

    ভালো হয়েছে, না মাসীমা?

    নিশ্চয় হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই।

    তা হলে আর কিছুদিন থাকো। আরও ভালো হোক।

    কিন্তু বেশীদিন থাকবার যে জো নেই বন্দনা। অশোক লিখেচে এ মাসের শেষেই সে পাঞ্জাবে চেঞ্জের জন্যে আসবে। তার আগে আমার ত ফিরে যাওয়া চাই।

    ভোজন-পর্ব সমাধা হইয়াছিল, সাহেব উঠি-উঠি করিতেছিলেন,—মাসী মনে মনে চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। প্রস্তাব উত্থাপনের সপক্ষে যে অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়া আনিয়াছেন, তাহা চক্ষুলজ্জায় ভ্রষ্ট হইতে দিলে ফিরাইয়া আনা হয়ত দুরূহ হইবে। সঙ্কোচ অতিক্রম করিয়া বলিলেন, মিস্টার রে, একটা কথা ছিল, যদি সময় না—

    সাহেব তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িয়া কহিলেন, না না, সময় আছে বৈ কি। বলুন কি কথা?

    মাসী বলিলেন, আমি শুনেচি বন্দনার অমত নেই। অশোক অর্থশালী নয় সত্যি, কিন্তু সুশিক্ষা ও চরিত্রবলে struggle করে একদিন ও উঠবেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আপনি যদি ওকে আপনার মেয়ের অযোগ্য বিবেচনা না করেন ত—

    সাহেব আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, কিন্তু সে কি করে হতে পারে মিসেস ঘোষাল? অশোক আপনার ভাইপো, সম্পর্কে সেও ত বন্দনার মামাতো ভাই।

    মাসী বলিলেন, শুধু নামে, নইলে বহু দূরের সম্বন্ধ। আমার দিদিমা এবং বন্দনার মায়ের দিদিমা দুজনে বোন ছিলেন, সেই সম্পর্কেই বন্দনার আমি মাসী। এ বিবাহ নিষিদ্ধ হতে পারে না মিস্টার রে।

    সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, বোধ হয় মনে মনে কি একটা হিসাব করিলেন, তারপরে বলিলেন, অশোককে যতটুকু আমি নিজে দেখেছি এবং যতটুকু বন্দনার মুখে শুনেছি তাতে অযোগ্য মনে করিনে। মেয়ের বিয়ে একদিন আমাকে দিতেই হবে, কিন্তু তার নিজের অভিমত ত জানা দরকার।

    মাসী স্নেহের কণ্ঠে উৎসাহ দিয়া কহিলেন, লজ্জা করো না মা, বল তোমার বাবাকে কি তোমার ইচ্ছে।

    বন্দনার মুখ পলকের জন্য রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণে সুস্পষ্ট স্বরে বলিল, আমার ইচ্ছেকে আমি বিসর্জন দিয়েছি মাসীমা। সে খোঁজ করার দরকার নেই।

    সাহেব সভয়ে কহিলেন, এর মানে?

    বন্দনা বলিল, মানে ঠিক তোমাদের আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না বাবা। কিন্তু তাই বলে ভেবো না যেন আমি বাধা দিচ্চি। একটু থামিয়া কহিল, আমার সতীদিদির বিয়ে হয়েছিল তাঁর ন’বছর বয়সে। বাপ-মা যাঁর হাতে তাঁকে সমর্পণ করলেন মেজদি তাঁকেই নিলেন, নিজের বুদ্ধিতে বেছে নেননি। তবু, ভাগ্যে যাঁকে পেলেন সে স্বামী জগতে দুর্লভ। আমি সেই ভাগ্যকেই বিশ্বাস করবো বাবা। বিপ্রদাসবাবু সাধুপুরুষ, আসবার আগে আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যেখানে আমার কল্যাণ ভগবান সেখানেই আমাকে দেবেন। তাঁর সেই কথা কখনো মিথ্যে হবে না। তুমি আমাকে যা আদেশ করবে আমি তাই পালন করবো। মনের মধ্যে কোন সংশয়, কোন ভয় রাখবো না।

    সাহেব বিস্ময়ে স্থির হইয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিলেন, মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না।

    মাসী বলিলেন, বিয়ের সময় তোমার মেজদি ছিলেন বালিকা, তাই তার মতামতের প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু তুমি তা নও, বড় হয়েছো, নিজের ভাল-মন্দের দায়িত্ব তোমার নিজের। এমন চোখ বুজে ভাগ্যের খেলা ত তোমার সাজে না বন্দনা।

    সাজে কিনা জানিনে মাসীমা, কিন্তু তাঁর মতো তেমনি করেই ভাগ্যকে আমি প্রসন্নমনে মেনে নেবো।

    কিন্তু এমন উদাসীনের মতো কথা বললে তোমার বাবা মনস্থির করবেন কি করে?

    যেমন করে ওঁর দাদা করেছিলেন সতীদিদির সম্বন্ধে, যেমন করে ওঁর সকল পূর্বপুরুষরাই দিয়েছিলেন তাঁদের ছেলে-মেয়ের বিবাহ, আমার সম্বন্ধেও বাবা তেমনি করেই মনঃস্থির করুন।

    তুমি নিজে কিছুই দেখবে না, কিছুই ভাববে না?

    ভাবা-ভাবি, দেখা-দেখি অনেক দেখলুম মাসীমা। আর না। এখন নির্ভর করবো বাবার আশীর্বাদে আর সেই ভাগ্যের পরে যার শেষ কেউ আজও দেখতে পায়নি।

    মাসী হতাশ হইয়া একটুখানি তিক্তকণ্ঠে বলিলেন, ভাগ্যকে আমরাও মানি, কিন্তু তোমার সমাজ, শিক্ষা, সংস্কার সব ডুবিয়ে দিয়ে মুখুয্যেদের এই ক’দিনের সংস্রব যে তোমাকে এতখানি আচ্ছন্ন করবে তা ভাবিনি। তোমার কথা শুনলে মনে হয় না যে তুমি আমাদের সেই বন্দনা। যেন একেবারে আমাদের থেকে পর হয়ে গেছো।

    বন্দনা বলিল, না মাসীমা, আমি পর হয়ে যাইনি। তাঁদের আপনার করতে আমার কাউকে পর করতে হবে না এ কথা নিশ্চয় জেনে এসেছি। আমাকে নিয়ে তোমরা কোন শঙ্কা করো না।

    মাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহলে অশোককে আসতে একটা টেলিগ্রাম করে দিই?

    দাও। আমার কোন আপত্তি নেই। এই বলিয়া বন্দনা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

    মিস্টার রে, আপনার নাম করেই তবে টেলিগ্রামটা পাঠাই—বলিয়া মাসী মুখ তুলিয়া সবিস্ময়ে দেখিলেন সাহেবের দুই চোখ অকস্মাৎ বাষ্পাকুল হইয়া উঠিয়াছে। ইহার কারণ খুঁজিয়া পাইলেন না এবং সাহেব ধীরে ধীরে যখন বলিলেন, টেলিগ্রাম আজ থাক মিসেস ঘোষাল, তখনও হেতু বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, থাকবে কেন মিস্টার রে, বন্দনা ত সম্মতি দিয়ে গেল।

    না না, আজ থাক, বলিয়া তিনি নির্বাক হইয়া রহিলেন। এই নীরবতা এবং ঐ অশ্রুজল মাসীকে ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করিল। একজন প্রবীণ পদস্থ লোকের এইরূপ সেন্টিমেন্টালিটি তাঁহার অসহ্য। কিন্তু জিদ করিতেও সাহস করিলেন না। মিনিট-দুই চুপ করিয়া থাকিয়া সাহেব বলিলেন, ওর বাপের ভাবনা আমি ভেবেচি, কিন্তু ওর মা নেই, তাঁর ভাবনাও আমাকেই ভাবতে হবে মিসেস ঘোষাল। একটু সময় চাই।

    মাসী মনে মনে বলিলেন, আর একটা স্টুপিড সেন্টিমেন্টালিটি। সাহেব অনুমান করিলেন কিনা জানি না, কিন্তু এবার জোর করিয়া একটু ম্লান হাসিয়া বলিলেন, মুশকিল হয়েছে ওর কথা আমরা কেউ ভালো বুঝতে পারিনে। শুধু আজ নয়, বাঙলা থেকে আসা পর্যন্তই মনে হয় ঠিক যেন ওকে বুঝতে পারিনে। ও সম্মতি দিলে বটে, কিন্তু সে-ও, না ওর নতুন রিলিজন ভেবেই পেলুম না।

    নতুন রিলিজন? মানে?

    মানে আমিও জানিনে। কিন্তু বেশ দেখতে পাই বাঙলা থেকে ও কি যেন একটা সঙ্গে করে এনেছে, সে রাত্রি-দিন থাকে ওকে ঘিরে। ওর খাওয়া গেছে বদলে, কথা গেছে বদলে, ওর চলা-ফেরা পর্যন্ত মনে হয় যেন আগেকার মতো নেই। ভোরবেলায় স্নান করে আমার ঘরে গিয়ে পায়ের ধুলো মাথায় নেয়। বলি, বুড়ী, আগে ত তুই এ-সব করতিস নে?

    তখন জানতুম না বাবা। এখন তোমার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে দিন আরম্ভ করি, বেশ বুঝতে পারি সে আমাকে সমস্ত দিন সমস্ত কাজে রক্ষে করে চলে। বলিতে বলিতে তাঁহার চক্ষু পুনরায় অশ্রুসজল হইয়া উঠিল।

    মাসী মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, এ-সব নতুন ধাঁচা শিখে এসেছে ও মুখুয্যেদের বাড়িতে। জানেন ত তাঁরা কি রকম গোঁড়া। কিন্তু একে রিলিজন বলে না, বলে কুসংস্কার। ও পূজোটুজো করে নাকি?

    সাহেব বলিলেন, জানিনে করে কিনা। হয়ত করে না। কুসংস্কার বলে আমারও মনে হয়েছে, নিষেধ করতেও গেছি, কিন্তু বুড়ী আগেকার মতো আর ত তর্ক করে না, শুধু চুপ করে চেয়ে থাকে। আমারও মুখ যায় বন্ধ হয়ে—কিছুই বলতে পারিনে।

    মাসী বলিলেন, এ আপনার দুর্বলতা। কিন্তু নিশ্চিত জানবেন একে রিলিজন বলে না, বলে শুধু সুপারস্টিশন। একে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়! অপরাধ!

    সাহেব দ্বিধাভরে আস্তে আস্তে বলিলেন, তাই হবে বোধ হয়। রিলিজন কথাটা মুখেই বলি, কখনো নিজেও চর্চা করিনি, এর নেচার কি তা—ও জানিনে, শুধু মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি মেয়েটাকে এমন আগাগোড়া বদলে দিলে কিসে? সে হাসি নেই, আনন্দের চঞ্চলতা নেই, বর্ষাদিনের ফুটন্ত ফুলের মতো পাপড়িগুলি যেন জলে ভিজে। কখনো ডেকে বলি, বুড়ী, আমাকে লুকোস নে মা, তোর ভেতরে ভেতরে কোন অসুখ করেনি ত? অমনি হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, না বাবা, আমি ভালো আছি, আমার কোন অসুখ নেই। হাসিমুখে ঘরের কাজে চলে যায়, আমার কিন্তু বুকের পাঁজর ভেঙ্গে পড়তে চায় মিসেস ঘোসাল। ঐ একটি মেয়ে, মা নেই, নিজের হাতে মানুষ করে এতবড়টি করেছি,—সর্বস্ব দিয়েও যদি আমার সেই বন্দনাকে আবার তেমনি ফিরে পাই—

    মাসী জোর দিয়া বলিলেন, পাবেন। আমি কথা দিচ্চি পাবেন। এ শুধু একটা সাময়িক অবসাদ, ধর্মের ঝোঁক হলেও হতে পারে, কিন্তু অত্যন্ত অসার। কেবল ওঁদের সংসর্গে আসার ক্ষণিক বিকার। বিবাহ দিন, সমস্ত দুদিনে সেরে যাবে। চিরদিনের শিক্ষাই মানুষের থাকে মিস্টার রে, দু দিনের বাতিক দু দিনেই ফুরোয়।

    সাহেব আশ্বস্ত হইলেন, তথাপি সন্দেহ ঘুচিল না। বলিলেন, ও কোথায় কার কাছে কি প্রেরণা পেলে জানিনে, কিন্তু শুনেচি সে যদি আসে সত্যিকার মানুষ থেকে কিছুতে সে ঘোচে না। মানুষের চিরদিনের অভ্যাস দেয় একমুহূর্তে বদলে। নেশা গিয়ে মেশে রক্তের ধারায়, সমস্ত জীবনে তার আর ঘোর কাটে না। সেই আমার ভয় মিসেস ঘোষাল।

    প্রত্যুত্তরে মাসী একটু অবজ্ঞার হাসি হাসিলেন, বলিলেন, বাজে বাজে। আমি অনেক দেখেছি মিস্টার রে—দুদিন পরে আর কিছুই থাকে না। আবার যাকে তাই হয়। কিন্তু বাড়তে দেওয়াও চলবে না,—আজই অশোককে একটা তার করে দিই—সে এসে পড়ুক।

    আজই দেবেন?

    হাঁ, আজই। এবং আপনার নামেই।

    সাহেব মৃদুকণ্ঠে সম্মতি জানাইয়া বলিলেন, যা ভালো হয় করুন। আমি জানি অশোক ভালো ছেলে। চরিত্রবান, সৎ—তা নইলে ওকে সঙ্গে নিয়ে বন্দনা কিছুতে আসতে রাজী হতো না।

    মাসী এই কথাটাকেই আর একবার ফাঁপাইয়া ফুলাইয়া বলিতে গেলেন, কিন্তু বাধা পড়িল। বন্দনা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, বাবা, আজ হাজি-সাহেবের মেয়েরা আমাকে চায়ের নেমন্তন্ন করেছে। দুপুরবেলা যাবো,—বিকালে আফিসের ফেরত আমাকে বাড়ি নিয়ে এসো।

    মাসী প্রশ্ন করিলেন, তাঁদের বাড়িতে তুমি ত কিছু খাবে না বন্দনা?

    না মাসীমা।

    কেন?

    আমার ইচ্ছে করে না। বাবা, তুমি ভুলে যাবে না ত?

    না মা, তোমাকে আনতে ভুলে যাবো এমন কখন হয়? এই বলিয়া সাহেব একটু হাসিলেন। বলিলেন, অশোক আসচেন। তাঁকে আজ একটা তার করে দেবো।

    বেশ ত বাবা, দাও না।

    মাসী বলিলেন, আমিই জোর করে তাকে আনচি। দেখো, এলে যেন না অসম্মান হয়।

    তোমার ভয় নেই মাসীমা, আমরা কারো অসম্মান করিনে। অশোকবাবু নিজেই জানেন।

    মেয়ের কথা শুনিয়া সাহেব প্রসন্নমুখে বলিলেন, আফিসের পথে আজই তাকে একটা টেলিগ্রাম করে দেবো বুড়ী। আজ শুক্রবার, সোমবারেই সে এসে পৌঁছতে পারবে যদি না কোন ব্যাঘাত ঘটে।

    দরোয়ান ডাক লইয়া হাজির হইল। অসংখ্য সংবাদপত্র নানা স্থানের। চিঠিপত্রও কম নয়। কিছুদিন হইতে ডাকের প্রতি বন্দনার ঔৎসুক্য ছিল না। সে জানিত প্রতিদিন আশা করিয়া অপেক্ষা করা বৃথা। তাহাকে মনে করিয়া চিঠি লিখিবার কেহ নাই। চলিয়া যাইতেছিল, সাহেব ডাকিয়া বলিলেন, এই যে তোমার নামের দু-খানা। আপনারও একখানা রয়েছে মিসেস ঘোষাল।

    নিজের চেয়েও পরের চিঠিতে মাসীর কৌতূহল বেশি। মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া বলিলেন, একখানা ত দেখচি অশোকের হাতের লেখা। ওটা কার?

    এই অকারণ প্রশ্নের উত্তর বন্দনা দিল না, চিঠি-দুটা হাতে লইয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

    সাহেব মুচকিয়া হাসিয়া বলিলেন, অশোকের সঙ্গে দেখচি চিঠিপত্র চলে। তার করে দিই, সে আসুক। ছেলেটি সত্যিই ভালো। তাকে বিশ্বাস না করলে বন্দনা কখনো চিঠি লিখত না।

    প্রত্যুত্তরে মাসীও সগর্বে একটু হাসিলেন। অর্থাৎ জানি আমি অনেক কিছুই।

    বিকালে আফিসের পথে হাজি-সাহেবের বাড়ি ঘুরিয়া রে-সাহেব একাকী ফিরিয়া আসিলেন। বন্দনা সেখানে যায় নাই। মাসী সুমুখেই ছিলেন, মুখ ভার করিয়া বলিলেন, বন্দনা চিঠি নিয়ে সেই যে নিজের ঘরে ঢুকেছে আর বার হয়নি।

    সাহেব উদ্বিগ্নমুখে প্রশ্ন করিলেন, খায়নি?

    না। সকালে সেই যে দুটো ফল খেয়েছিল আর কিছু না।

    সাহেব দ্রুতপদে কন্যার ঘরের দরজায় গিয়া ঘা দিলেন,—বুড়ী!

    বন্দনা কবাট খুলিয়া দিল। তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া পিতা স্তব্ধ হইয়া রহিলেন,—কি হয়েছে রে?

    বন্দনা কহিল, বাবা, আজ রাত্রের গাড়িতে আমি বলরামপুরে যাবো।

    বলরামপুরে? কেন?

    দ্বিজদাসবাবু একখানা চিঠি লিখেছেন,—পড়বে বাবা?

    তুই পড় মা, আমি শুনি, বলিয়া সাহেব চৌকি টানিয়া লইয়া বসিলেন। বন্দনা তাঁহাকে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া যে চিঠিখানা পড়িয়া শুনাইল তাহা এই—

    সুচরিতাসু,

    আপনার যাবার দিনটি মনে পড়ে। উঠানে গাড়ি দাঁড়িয়ে, বললেন, মাঝে মাঝে খবর দিতে। বললুম, কুঁড়ে মানুষ আমি, চিঠিপত্র লেখা সহজে আসেও না, ভালো লিখতেও জানিনে। এ ভার বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ে যান।

    শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন, তারপরে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলেন, দ্বিতীয় অনুরোধ করলেন না। হয়ত ভাবলেন অসৌজন্য যাকে এমন সময়েও একটা ভালো কথা মুখে আনতে দেয় না তাকে আর বলবার কি আছে!

    আমি এমনিই বটে। তবু আশা ছিল লিখতেই যদি হয় যেন এমন কিছু লিখতে পারি যা খবরের চেয়ে বড়। সে লেখা যেন অনায়াসে আমার সকল অপরাধের মার্জনা চেয়ে নিতে পারে।

    মনে ভাবতুম মানুষের জন্যে কি শুধু অভাবিত দুঃখই আছে, অভাবিত সুখ কি জগতে নেই?

    দাদার ইষ্টদেবতা শুধু চোখ বুজেই থাকবেন, চেয়ে কখনো দেখবেন না? অঘটন যা ঘটল সেই হবে চিরস্থায়ী, তাকে টলাবার শক্তি কোথাও নেই?

    দেখা গেল নেই,—সে শক্তি কোথাও নেই। না টললেন ভগবান, না টললো তাঁর ভক্ত। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা আজও তেমনি ঊর্ধ্বমুখে জ্বলচে, জ্যোতিঃর কণামাত্র অপচয়ও ঘটেনি।

    এ প্রসঙ্গ কেন তাই বলি। তিন দিন হলো দাদা বাড়ি ফিরে এসেছেন। সকালে যখন গাড়ি থেকে নামলেন তাঁর পিছনে নামলো বাসু। খালি পা, গলায় উত্তরীয়। গাড়ি ফিরে চলে গেলো আর কেউ নামল না। সকালের রোদে ছাদে দাঁড়িয়েছিলুম, চোখের সুমুখে সমস্ত পৃথিবী হয়ে এলো অন্ধকার,—ঠিক অমাবস্যা রাত্রির মতো। বোধ করি মিনিট-দুই হবে, তার পরে আবার সব দেখতে পেলুম, আবার সব স্পষ্ট হয়ে এলো। এমন যে হয় এর আগে আমি জানতুম না।

    নীচে নেমে এলুম, দাদা বললেন, তোর বৌদি কাল সকালে মারা গেছেন দ্বিজু। হাতে টাকাকড়ি বিশেষ নেই, সামান্যভাবে তাঁর শ্রাদ্ধের আয়োজন করে দে। মা কোথায়?

    ঢাকায় । তাঁর মেয়ের বাড়িতে।

    ঢাকায়? একটু চুপ করে থেকে বললেন, কি জানি, আসতে হয়ত পারবেন না, কিন্তু মাতৃদায় জানিয়ে বাসু তাঁকে চিঠি দেয় যেন।

    বললুম, দেবে বৈ কি।
    বাসু ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে বুকে মুখ লুকালো। তার পরে কেঁদে উঠলো। সে কান্নারও যেমন ভাষা নেই, চিঠিতে সে প্রকাশ করারও তেমনি ভাষা নেই। শিকারের জন্তু মরার আগে তার শেষ নালিশ রেখে যায় যে ভাষায় অনেকটা তেমনি। তাকে কোলে নিয়ে ছুটে পালিয়ে এলুম নিজের ঘরে। সে তেমনি করেই কাঁদতে লাগলো বুকে মুখ রেখে। মনে মনে বললুম, ওরে বাসু, লোকসানের দিক দিয়ে তুই যে বেশী হারালি তা নয়, আর একজনের ক্ষতির মাত্রা তোকেও ছাপিয়ে গেল। তবু তোকে বোঝবার লোক পাবি, কিন্তু সে পাবে না। শুধু একটা আশা বন্দনা যদি বোঝেন।

    এমন কতক্ষণ গেল। শেষে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললুম, ভয় নেই রে, মা না থাক, বাপ না থাক কিন্তু রইলুম আমি। ঋণ তাঁদের শোধ দিতে পারবো না, কিন্তু অস্বীকার করবো না কখনো। আজ সবচেয়ে ব্যথা সবচেয়ে ক্ষতির দিনে এই রইলো তোর কাকার শপথ।

    কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়াবো না, কথার আছেই বা কি। ছেলেবেলায় বাবা বলতেন, গোঁয়ার, মা বলতেন চুয়াড়, কতবার রাগ করেছেন দাদা,—অনাদরে অবহেলায় কতদিন এ বাড়ি হয়ে উঠেছে বিষ, তখন বৌদিদি এসেছেন কাছে, বলেছেন, ঠাকুরপো, কি চাই বলো ত ভাই? রাগ করে জবাব দিয়েছি, কিছুই চাইনে বৌদি, আমি চলে যাবো এখান থেকে।

    কবে গো?

    আজই।

    শুধু হেসে বলেছেন, হুকুম নেই যাবার। যাও ত দেখি আমার অবাধ্য হয়ে।

    আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই যাবার দিন যখন সত্যি এলো তখন তিনিই গেলেন চলে। ভাবি, কেবল আমার জন্যেই হুকুম? তাঁকে হুকুম করবার কি কেউ ছিল না জগতে?

    দাদাকে জিজ্ঞাসা করলুম, কি করে ঘটলো? বললেন, কলকাতাতেই শরীর খারাপ হলো—বোধ হয় মনে মনে খুবই ভাবতো—নিয়ে গেলাম পশ্চিমে। কিন্তু সুবিধে কোথাও হলো না। শেষে হরিদ্বারে পড়লেন জ্বরে, নিয়ে চলে এলাম কাশীতে। সেখানেই মারা গেলেন। ব্যস্‌!

    জিজ্ঞাসা করলুম, চিকিৎসা হয়েছিল দাদা?

    বললেন, যথাসম্ভব হয়েছিল।

    কিন্তু এই যথাটুকু যে কতটুকু সে দাদা নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না।

    ইচ্ছে হলো বলি, আমাকে এত বড় শাস্তি দিলেন কেন? কি করেছিলুম আমি? কিন্তু তাঁর মুখের পানে চেয়ে এ প্রশ্ন আর আমার মুখে এলো না।

    জিজ্ঞাসা করলুম, তিনি কাউকে কিছু বলে যাননি দাদা?

    বলিলেন, হাঁ। মৃত্যুর ঘণ্টা—দশেক পূর্ব পর্যন্ত চেতনা ছিল, জিজ্ঞেসা করলুম, সতী, মাকে কিছু বলবে?

    বললে, না।

    আমাকে?

    না।

    দ্বিজুকে?

    হাঁ। তাকে আমার আশীর্বাদ দিও। বলো সব রইলো।
    ছুটে পালিয়ে এলুম বৌদিদির শূন্য ঘরে। ছবি তোলাতে তাঁর ভারী লজ্জা ছিল, শুধু ছিল একখানি লুকনো তাঁর আলমারির আড়ালে। আমারি তোলা ছবি। সুমুখে দাঁড়িয়ে বললুম, ধন্য হয়ে গেছি বৌদি, বুঝেচি তোমার হুকুম। এত শীঘ্র চলে যাবে ভাবিনি, কিন্তু কোথাও যদি থাক দেখতে পাবে তোমার আদেশ অবহেলা করিনি। শুধু এই শক্তি দিও, তোমার শোকে কারো কাছে আমার চোখের জল যেন না পড়ে। কিন্তু আজ এই পর্যন্তই থাক তাঁর কথা।

    এবার আমি। যাবার সময় অনুরোধ করেছিলেন বিবাহ করতে। কারণ, এত ভার একলা বইতে পারব না—সঙ্গীর দরকার। সেই সঙ্গী হবে মৈত্রেয়ী এই ছিল আপনার মনে। আপত্তি করিনি, ভেবেছিলুম সংসারে পনেরো—আনা আনন্দই যদি ঘুচলো এক—আনার জন্যে আর টানাটানি করবো না। কিন্তু সে—ও আর হয় না,—বৌদিদির মৃত্যু এনে দিলে অলঙ্ঘ্য বাধা। বাধা কিসের? মৈত্রেয়ী ভার নিতে পারে, পারে না সে বোঝা বইতে। এটা জানতে পেরেছি। কিন্তু আমার এবার সেই বোঝাই হলো ভারী। তবু বলব বিপদের দিনে সে আমাদের অনেক করেছে, তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সময় যদি আসে তার ঋণ ভুলবো না।

    কাল অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে বাসু উঠলো কেঁদে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে গেলুম দাদার ঘরে। দেখি তখনো জেগে বসে বই পড়চেন। কি বই দাদা? দাদা বই মুড়ে রেখে হেসে বললেন, কি করতে এসেছিস বল? তাঁর পানে চেয়ে যা বলতে এসেছিলুম বলা হলো না। ভাবলুম ঘুমের ঘোরে বাসু কেঁদেছে, তাতে বিপ্রদাসের কি? অন্য কথা মনে এলো, বললুম, শ্রাদ্ধের পরে আপনি কোথা থাকবেন দাদা? কলকাতায়?

    বললেন, না রে, যাব তীর্থভ্রমণে।

    ফিরবেন কবে?

    দাদা আবার একটু হেসে বললেন, ফিরবো না।

    স্তব্ধ হয়ে তাঁর মুখের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। সন্দেহ রইলো না যে এ সঙ্কল্প টলবে না। দাদা সংসার ত্যাগ করলেন।

    কিন্তু অনুনয়-বিনয় কাঁদা-কাটা কার কাছে? এই নিষ্ঠুর সন্ন্যাসীর কাছে? তার চেয়ে অপমান আছে?

    কিন্তু বাসু?

    দাদা বললেন, হিমালয়ের কাছে একটা আশ্রমের খোঁজ পেয়েছি। তারা ছোট ছেলেদের ভার নেয়। শিক্ষা দেয় তারাই।

    তাদের হাতে তুলে দেবেন ওকে? আর আমি করলুম মানুষ? তারপর দুই হাতে কান চেপে পালিয়ে এলুম ঘর থেকে। তিনি কি জবাব দিলেন শুনিনি।

    বাসুর পাশে বসে সমস্ত রাত ভেবেচি। কোথায় যে এর কূল কিছুতে খুঁজে পাইনি। মনে পড়ল আপনাকে। বলে গিয়েছিলেন, বন্ধুর যখন হবে সত্যিকার প্রয়োজন তখন ভগবান আপনি পৌঁছে দেবেন তাকে দোরগোড়ায়। বলেছিলেন এ কথা বিশ্বাস করতে। কে বন্ধু, কবে সে আসবে জানিনে, তবু বিশ্বাস করে আছি আমার এই একান্ত প্রয়োজনে একদিন সে আসবেই।

    দ্বিজদাস

    পড়া শেষ হইলে দেখা গেল সাহেবের চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। রুমাল বাহির করিয়া মুছিয়া, বলিলেন, আজই যাও মা, আমি বাধা দেব না। দরোয়ান আর তোমার বুড়ো হিমুও সঙ্গে যাক।

    বন্দনা হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইল, বলিল, যাবার উদ্যোগ করি গে বাবা, আমি উঠি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিরাজবৌ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article বামুনের মেয়ে – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }