Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প91 Mins Read0
    ⤶

    ০৭. কুঞ্জ আজ বাইরে গেছে

    কুঞ্জ আজ বাইরে গেছে। কালকের আগে আসবে না। নববালা আর বাসমতী রান্নাঘরে বসে বিড়ি টানছিল, আর সুখ দুঃখের কথা কইছিল।

    আবার হট্‌ হট্‌ করে ছোটো এক দেশে।—অরুচি ধরে গেছে বাবা!—এর থেকে এসব ছেড়ে-ছুঁড়ে ইস্টিশানে পানের দোকান দিলে হয়। তা থেকে খুব পেট চলবে। অথচ খাটুনি নেই।

    আর এই দস্যি কাজে? হাড় পিষে যায়! শুধু তো পার্ট করা নয়, এই রাবণের গুষ্টির ভাত রাঁধা!

    গল্প যখন উদ্দাম, হঠাৎ বুকের ভেতর ধড়ফড়িয়ে উঠল। এ কী, অধিকারীর গলা না? চলে গিয়েছিল যে? ওরা তো ধরে নিয়েছিল মাঝে মাঝে যেমন একদিনের জন্যে ড়ুব মারে কর্তা, তেমনি গেছে।

    এই নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনা করে তারা। কোথায় যায় অধিকারী? এদিকে তো খাজা-গোয়ার, ওর যে কোথাও কোনোখানে ভাবের লোক আছে, তা তো মনে হয় না। তবে আছে কে? বলে না। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। আসেও ঠিক নিয়ম মাফিক।

    জল্পনান্তে ওরা ধরে নিয়েছিল নিশ্চয় কোনো দেবস্থানে যায়। অনেকের আবার ওতে লজ্জা আছে। তাই চেপে যায় কথাটা। ঠাকুর দেবতা করে, লুকিয়ে।

    আজও তাই গিয়েছে জানে, হঠাৎ কর্তার গলার স্বর। কাকে যেন বলছে, নাঃ বেরোলাম না, ফিরেই এলাম। শরীরটা তেমন ইয়ে ঠেকাল না।

    হাতের বিড়ি ফেলে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বাসমতী বলে উঠল, শরীর বুঝি খারাপ?

    শত্রুর শরীর খারাপ হোক। বলে চলে যায় কুঞ্জ।

    কুঞ্জর কানে একটা সুর এসে বাজে। কে কোথায় কী সুর বাজাচ্ছে কে জানে। কুঞ্জর বিস্বাদ মনটা হঠাৎ একটা আনন্দের আস্বাদে ভরে যায়। কুঞ্জ ভাবছিল, এ পৃথিবীতে বুঝি ভালো জিনিস বলে কিছু নেই। কিন্তু তা তো নয়। আছে ভালো জিনিস আছে। সুর আছে।

    সুর আছে, এটা যেন কুঞ্জ প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল। সুর হারানো প্ৰাণ নিয়ে কেবল ভেসে এসেছে, জগতে শুধু বেসুরো অ-সুর আছে। আর কুঞ্জর হাতে চাবুক আছে। অথচ এখনও সুর আছে, গান আছে!

    কুঞ্জ তার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে ভাবে, তার পৃথিবীকে কি আবার সুরে ভরে তোলা যায় না? হয়তো ঠিক এই ভাষায় ভাবতে পারে না মুখ কুঞ্জ, তবে ভাবটা এই।

    জীবনের রাজপথে চলতে চলতে, তার অনেক গলি ঘুজিও চোখে পড়ে বৈকি। দেখা যায় সেখানেও লোকে দিব্যি বাস করছে বড়ো রাস্তার ধারের মানুষদের মতোই। কতসময় কত বিয়ে না। হওয়া স্বাম স্ত্রীকে ঠিক স্বামী-স্ত্রীর মতোই সংসার করতে দেখল কুঞ্জ, দেখল কত বিধবাকে সহজভাবে একটা আত্মীয়পুরুষের ঘর করতে। অথচ তাদের মধ্যে কোনোখানে অস্বচ্ছন্দতা নেই।

    কুঞ্জই বা কেন তবে একটা দৈবাৎ উল্টোপাল্টা হয়ে যাওয়া ঘটনাকে সোজা করে নিতে পারল না? কেন চিরদিন দেওয়ালের বাইরে রইল? এটা কি কুঞ্জরই ত্রুটি নয়? কুঞ্জ যদি দাবি খোটাত? কুঞ্জ যদি ভয়ে না মরত? কিন্তু কুঞ্জ ভয় পায়। কুঞ্জ ঠিক করল এবার, কুঞ্জ নির্ভয় হবে। কুঞ্জ দাবির বলে দেওয়াল ভাঙবে। দেখবে না কেমন মুখ দেখায় সে।

    বাঁকুড়ার পালটা একবার সেরে আসতে পারলে হয়। কিন্তু পালা তো সহজে মেটে না। বাঁকুড়া থেকে আবার পুরুলিয়া ডাক আসে। হাততালির স্রোতে কুঞ্জ নামের মানুষটার ভিতরের সত্তটা যেন ভেসে ভেসে দূরে সরে যায়। পুরো একটা লরি ভাড়া নিয়ে ভবানী অপেরা পার্টি বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়ায় রওনা হয়।

    এর ফাঁকে কুঞ্জর কাটোয়ায় বাড়িতে সনাতন নামের সেই পালিয়ে যাওয়া ছেলেটা ঝোড়ো কাকের মূর্তি নিয়ে এসে আরও দুটো পালানো মানুষের কীর্তি কাহিনিতে রং চড়িয়ে চড়িয়ে গল্প করে। পুরনো করে ফেলে, এখন মনের সুখে খাচ্ছে আর ঘুমোচ্ছে।

    আর খামে মোড়া একটা চিঠি এসে কুঞ্জর ঘরের চৌকির ওপর পড়ে আছে। পিয়ন ফেলে দিয়ে গেছে জানিলা দিয়ে।

    চিঠিটার মধ্যে শুধু একটাই লাইন, নাম সম্বোধনহীন।

    মতলবিটা কী? না খাইয়ে মারতে চাও বুঝি?

     

    পুরুলিয়া থেকে ফিরে এল ভবানী অপেরা পার্টি নতুন মেডেল নিয়ে।

    একটা ভেজালদার তার নিজ পরিবারের সকলের মৃত্যুর কারণ হওয়ায় যেমন লোকে বেশ হয়েছে বলেছে, তেমন কেঁদেছে, শিউরেছে। এবং নাট্যকার আর পরিচালকের দরদ আর দুঃসাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে লোকে।

    ভরা মন নিয়ে এসে ঢুকল কুঞ্জ, আর এসেই দেখল। সনাতন। দেখেই চড়াৎ করে পায়ের রক্ত মাথায় উঠল তার! বলল, তুই এখানে? আবার তুই মুখ দেখাতে এসেছিস? বলে পায়ের জুতো খুলে মারতে উঠে থেমে গেল।

    মুখ দেখানো শব্দটাই হঠাৎ মনের মধ্যে আলোড়ন তুলল। জুতো ফেলে বলল, আর দুটো কই?

    তারা আসেনি ঘাড় গুঁজে উত্তর দেয় সনাতন।

    তারা আসেনি? শুধু তুমি? কেন তোমারই বা আসবার দরকার কি ছিল? কোথায় তারা?

    জানি না।

    জানিস না? মিথ্যেবাদী হারামজাদা! একসঙ্গে ভাগলি, আর-

    আমি ভাগিনি, ওরাই আমায় বলে. সনাতন বোঝে এই মত্ততায় ছাড়া কথাগুলো বলা যাবে। না। তাই সনাতন তড়বড় করে বলে ওঠে, যা কষ্ট দিয়েছে আমায়! খেতে দেয়নি।–তাড়িয়ে দিয়েছে।

    খেতে দেয়নি? খেতে? নবাব খাঞ্জা খাঁ আবার খেতে চান! বলি ওরাই বা কোথা থেকে খেতে দেবে শুনি? ৰ

    সনাতন এখন রাজসাক্ষী। সনাতনকে এখন নিজের দিক বাঁচিয়ে কথা বলতে হবে। তাই সনাতনের বলতে বাধে না, কর্তার ঘর থেকে টাকা চুরি করে পালিয়েছে লিলি। আর সে টাকা শেষ হতে লিলি রোজগার ধরেছে। না করে উপায় কি! খেতে তো হবে।

    রোজগার!…কুঞ্জর অসতর্ক কণ্ঠ বিস্ময়ের চাবুকে আহত হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলে, কিসের রোজগার?

    সনাতন ঘাড়টা হোঁট করে। আর হঠাৎ তার সেই হোঁট হওয়া ঘাড়ের ওপর খটখট করে এসে পড়ে একটা ভারী জুতোর পাটি। বলবি আর? বলবি আর?

    সনাতন ছুটি দেয়। আর কুঞ্জ জুতোটা হাত থেকে ফেলে ঘরে ঢোকে। ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে যায় কুঞ্জ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চৌকির ওপরকার জিনিসটার দিকে।

    তারপর জুতোর হাতটা ধুয়ে এসে, আস্তে খামটা খোলে। পড়ে—মতলবিটা কি? না খাইয়ে মারতে চাও বুঝি?—আবার পড়ে।—আবার পড়ে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দুদিক থেকে জুতো দুপাটি কুড়িয়ে নিয়ে পায়ে দিয়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

     

    আবার আমতা লাইনের সেই গণ্ডগ্রামটার সেই পায়ে চলা সরু পথের উপর দুপাটি ভারী ভারী জুতোর ছাপ পড়ে…ভারী জুতো আর আধময়লা ধুতি শার্ট পরা একটা লোককে আবার সেই বেড়ার দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দেখা যায়।

    ভিতরের দৃশ্যটি যথাযথ। সেই উঠানে তুলসী ঝাড়, এখানে ওখানে গাঁদা টগর জবা, দাওয়ায় উঠতে তিনটে সিঁড়ি। কোনো কিছুর ওদিক ওদিক নেই। তবু যেন বুকটা কেঁপে ওঠে কুঞ্জর।

    তবু কুঞ্জ অধিকারীর মনে হয় যেন বাড়িটা শ্মশান শ্মশান। যেন এখুনি কোনোখান থেকে প্ৰেতাত্মারা কথা কয়ে উঠবে।

    কী হয়েছে? কেউই তো থাকে না কোনো দিন, তবে আজ এমন কেন? সত্যিই তো তাহলে—

    কিন্তু আজও কুঞ্জ দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কেন? কুঞ্জর যে সংকল্প ছিল এবার আর ভয় নয়। এবার নিজের দাবিতে সবলে। ঘরে প্রবেশ করবে। এবার বলবে, জগতে কতই দেখলাম। কত ভুলের কারবার ঠিক-এর বাজারে চলে যাচ্ছে, কত গলি ঘুজি রাজরাস্তায় এসে মিশেছে। তবে দৈবাতের একটা ভুল শুধরে নিতে বাধা কোথায়?…ভুল তুমিও করেছ, আমিও করেছি, ব্যস শোধ-বোধ। আবার জীবনের পথে—।

    কিন্তু সে সব কথা হারিয়ে গিয়ে আবার শুধু ভয় কেন? কেন আজও দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো? কতকাল ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে ও? অনন্তকাল?

    দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল কুঞ্জ। দেখতে পেল, উঠোনের দড়িতে একটা কথা শাড়ি সেমিজ শুকোচ্ছে, দেখল দাওয়ার ধারে মাজা ঘটিতে জল। তার মানে বাড়িতে জ্যান্ত মানুষ আছে। আর সে নিত্য কাজ করছে। কোথায় তবে গেল সে? পড়াশীর বাড়ি? পুকুরে জল আনতে? কতক্ষণের জন্যে?

    ভরা রোদুরের বিকেল, চারিদিক আলোয় খ খ করছে, শূন্য বাড়ির মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে গলাটা শুকিয়ে আসে কুঞ্জর। আর নিজেই হঠাৎ সে প্রেতাত্মার গলায় কথা বলে ওঠে, একটু জল পাওয়া যাবে? খাবার জল?

    কাকে বলে ওঠে, জানে না। কিন্তু তার এই অবোধ প্রশ্নের উত্তর এসে যায় হঠাৎ! ঘরের মধ্যে থেকে একটা ক্ষীণ রোগীকণ্ঠ উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে, কে? কে? জল চাইল কে? সদ্য ঘুম ভাঙার গলা? না? জ্বরে আচ্ছন্নর গলা।

    কুঞ্জর বিহ্বল চেতনা যেন ঝাঁকুনি খেয়ে হঠাৎ সজাগ হয়ে ওঠে। কুঞ্জর সেই সাহসী সংকল্প দৃঢ় হয়ে দাওয়া থেকে ঘরে এনে ফেলে কুঞ্জকে। অতএব কুঞ্জর ঘরে ঢোকা হয়।—হয়।—কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে পিছিয়ে আসতে হয় কুঞ্জকে। বুঝিবা চোখটাও বুজে। বিছানায় যে পড়ে আছে, সে কে!

    মুখের প্রায় সমস্ত চামড়াটা পোড়া কেঁকড়ানো, কালো জামড়ো পড়া।.তার মাঝখানে মাঝখানে সত্যিকার রঙের এক এক চিলতে আভাস যেন আরও ভয়াবহ বীভর্ৎসতার সৃষ্টি করেছে।

    যে সত্যিটা পরীর তুলনাবাহী ছিল। আর যার অহঙ্কারে সেদিন ওই মুখরা মেয়েটা সদৰ্পে বলেছিল, বাহবাও ছিল বৈ কি। ছিল রূপের বাহবা।

    কুঞ্জ ভাবতে পারত এ উমাশশী নয়, আর কেউ। ভাবতে পারত, উমাশশী মরে গেছে, এটা তার প্রেতাত্মা। কিন্তু কুঞ্জকে সেই ভাবনার শান্তিটুকুও দিল না। ওই শয্যাবিলীন নারী।

    শক্তি নেই। তবু মুখর হাসি হেসে বলে উঠল, ভেবেছিলাম জ্যান্ত থাকতে এই পোড়ামুখটা আর দেখাব না, একেবারে মরা মুখই দেখবে। হল না। দেখে ফেললে।

    উমাশশী নয়, বলে আর স্বস্তি পাওয়া যায় না। কুঞ্জ মেজেয় পাতা বিছানার ধারে মাটিতে বসে পড়ে হাহাকারের গলায় বলে, এ কী?

    উমাশশী হাসে। ভারী বিকৃত দেখায় মুখটা। ক্ষীণকণ্ঠে বলে, কোনটা? বিছানায় পড়ে থাকা, না পোড়া মুখটা?

    দুই! দুইই উমা। এ কী করে হল?

    উমা কষ্টে বলে, এত দেরিতে এলে, বলবার সময় আর কই? তা বলে ভেবো না, না খেতে পেয়ে মরছি। সে অহঙ্কার তুমি করতে পারতে না। এখনও অনেক টাকা আছে। গয়লা-বৌ আমার অনেক করছে, বলেছি তাকেই দিয়ে যাব।.চিঠিটা? ছলনা। দুষ্টুমি! তোমার টনক নড়াবার চেষ্টা। অসুখই। জ্বর রক্ত অতিসার। একেবারে শেষ করে ফেলল।

    কুঞ্জ আর্ত চিৎকার করে, ডাক্তার দেখেনি? ওষুধ পড়েনি?

    পড়েছিল। আবার হাসে উমা, গয়লা-বৌয়ের টোটকা। তার পর থেকেই চরমে উঠল আর কি। তোমার চিঠি আমি পাইনি। উমা— কুঞ্জ হাহাকার করে ওঠে, বাইরে বাইরে ঘুরছিলাম। এক কাল পালা নিয়ে–

    পাওনি বুঝেছিলাম।

    কুঞ্জ হাউ হাউ করে কেঁদে বলে, বুঝেছিলো? এখনও এত বিশ্বাস করেছিলে আমার ওপর?

    কি যে বল!

    উমা আরও আস্তে বলে,  যেদিন বেলেঘাটার বস্তিতে এসে দাঁড়ালে সেই দিনই—না তারও আগে বোধ হয়। নইলে চিঠি দিয়ে ডাকতে পেরেছিলাম কি করে?…আর এখনও তা পারলাম কি করে?

    উমা, আমি যাই! ডাক্তগণ ডেকে আনি—

    আঃ, থামো! পোড়া মুখটা যখন দেখেই ফেললে, তখন তোমার মুখটা দেখতে দাও দুদণ্ড।

    আমার মুখটাও পোড়া, উমা! অহঙ্কার করে বলে গিয়েছিলাম তোমার মেয়েকে তোমার কাছে দিয়ে যাব! অহঙ্কার রইল না। ফিরে গিয়ে দেখলাম সেই ঘাগরা পরা মেয়েটা— কুঞ্জ একটু থেমে বলে, দলের একটা ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়েছে।

    পালিয়েছে! এ্যাঁ! পালিয়েছে! উমা হঠাৎ ভাঙা গলায় উচ্চ হাসি হেসে বলে ওঠে, বাঃ বাঃ।। মায়ের উপর্যুক্ত মেয়ে হয়েছে তাহলে! দেখলে রক্তের গুণ? দূর দূরান্তরে রেখে একবারও চোখে না। দেখিয়ে, তবু কেমন গুণটি ফলালাম?

    আমি এ স্বপ্নেও ভাবিনি— কুঞ্জ কেঁচার খুঁট তুলে চোখ মোছে, কত ভালো পাত্তর ঠিক করেছিলাম। তার জন্যে।

    স্বপ্নেও ধারণা করনি? কেন গো? ওর মা-বাপের পরিচয়টা বুঝি ভুলে গিয়েছিলে?

    কুঞ্জ উত্তর খুঁজে না পেয়ে বারে বারে চোখটা মুছে নিয়ে বলে, মুখের এ অবস্থা হল কি করে?

    ওমা, এখনও তুমি মুখের কথা ভাবিছ? ভাবলাম ভুলে গেলে! কিছু না। আমার সেই ভালোবাসার লোকের ভালোবাসার চিহ্ন। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলার পুরস্কার।

    অ্যাসিড্‌!

    হ্যাঁ, শুনলাম আমাকে শিক্ষা দিতে হাতের কাছে রাখা ছিল। বস্তির কাকে দিয়ে আনিয়ে—

    থাক, উমা, কথা বোলো না, কষ্ট হচ্ছে। আমি ডাক্তার আনি।

    আনো তবে। তোমার আবার আক্ষেপ থেকে যাবে বিনি চিকিচ্ছেয় মলো—

     

    না, আক্ষেপ থাকেনি কুঞ্জর। করেছিল চিকিৎসা। কলকাতা থেকে ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিল। তার নির্দেশে কলকাতায় এনে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিল। কিন্তু বাঁচল না। উমাশশী। তবে কুঞ্জ তার প্রতিশ্রুতিও রাখল।

    সেই আধাপোড়া মুখটার মুখাগ্নি করল। করল শ্ৰাদ্ধ শান্তি। আর মোটা-বুদ্ধি গ্রাম্য লোকেরা যা করে তাই করল, সেই উপলক্ষে লোকজনও খাওয়াল বিস্তর।

    কর্তার পরিবার ছিল এখনও, এই দেখে তাজব হয়ে গেল সবাই। আর কর্তার সেই হঠাৎ চলে যাওয়াটার হদিশও পেল। ছিল গিন্নি রুগ্নটুগ্র।

    সব মিটে গেলে জীবনযুদ্ধে পরাজিতের চেহারা নিয়ে কুঞ্জ লিলিবালার অনেক খোঁজ করল, কিন্তু এই শহর কলকাতার রাক্ষসী ক্ষুধার জঠরে কোন অতলে তলিয়ে গেছে এক ফোঁটা লিলিবালা, কে কার পাত্তা দেবে? নিমাই নামের যে অপদাৰ্থ ছেলেটাকে ভর করে অবোধ দুঃসাহসী লিলিবালা ওই রাক্ষসীর গহ্বরে ঝাঁপ দিয়েছিল, সে ছেলেটা হয়তো পালিয়েছে প্ৰাণ বাঁচিয়ে।

    আর লিলিবালা প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টায় পথ ভুল করে ধীরে ধীরে নেমে গেছে মৃত্যুর অন্ধকারে।

    তবু সাহস করে ভবানী অপেরা পার্টির দরজায় এসে দাঁড়াতে পারেনি। যেখানে জীবন ছিল, আশ্বাস ছিল, আশ্রয় ছিল।

    কোথায় কি থাকে সেটা টের, পায় না বলেই না মানুষের এত ভুল পথে ঘুরে মরা!

     

    জ্বলন্ত নাটক নিয়ে রাজবাড়ির যাত্রা প্রতিযোগিতায় আর যোগ দেওয়া হল না কুঞ্জর, কবে যেন হয়ে গেছে সে সব। বায়না করাতে এসেও ফিরে যাচ্ছে লোকে, প্রোপ্ৰাইটারকে পাচ্ছে না।

    প্রোপ্ৰাইটার তখন লিলিবালার মৃত্যু সংবাদ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওটা পেলেই যেন বঁচে সে। নিশ্চিন্ত হয়ে কাজকর্মকরতে পারে।

    সেই বাঁচাটা হল না কুঞ্জর। সে খবরটা না পেয়েই ফিরে এল একদিন কাটোয়ায়। দলের অবস্থা তখন শোচনীয়। কেউ কেউ ছেড়ে গিয়ে অন্য কাজে যোগ দিয়েছে। মাইনে পাচ্ছিল না ঠিকমতো, করবে কি? আর যারা কুঞ্জর নিতান্ত পুষ্যি, তারা পড়ে আছে আর অধিকারীকে দুবেলা গাল পাড়ছে। কারণ খাওয়াদাওয়া খারাপ হচ্ছে।

    বাসমতী আর নববালা স্টেশনের ধারে পানের দোকান দিয়েছে। পানের সঙ্গে না কি পানীয়ও রাখছে তফাতে, অতএব তাদের জন্যে ভাবনা নেই। তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

     

    কুঞ্জ আসতেই ব্ৰজ বিপিন জগবন্ধু ছেকে ধরল, ভবানী অপেরা কি উঠে যাবে?

    কুঞ্জ তক্ষুনি রোদুরে তেন্তে পুড়ে এসেছে, তবু সমীহ করল না। যে মনিব অধস্তন সম্পর্কে উদাসীন, তাকে কে সমীহ করে? রোদুরে তেন্তে পুড়ে এসেছে কুঞ্জ, তবু তেতে উঠল না। শান্ত গলায় বলল, বোস বোস, বল দিকি তোরা কি চাস?

    আমরা?

    ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ওদের ভূমিকা এখানে কি!

    কুঞ্জ বলল, বল? বল কী চাস? থাকবে, না উঠে যাবে?

    ওরা একত্রে বলে উঠল, থাকবে, থাকবে।

    থাকবে না তো তারা কোথায় যাবে?

    বেশ, তবে থাকবে।.ভবানী অপেরা থাকবে, তোরা থাকবি। নতুন করে জীকিয়ে তুলি আর একবার, অনেকদিন অবহেলা করা হয়ে গেছে।

     

    বরুণ এ দলে নেই, বরুণের কাছে যেতে হয়। লেখক, কি লিখলে এর মধ্যে?

    কিচ্ছু না।

    সে কি তবে এতদিন সময় পেলে?

    মন লাগেনি। আর ভালো লাগছে না। আমায় এবার আপনি ছেড়ে দিন।

    ছেড়ে দেব? তোমায়? কুঞ্জ হেসে ওঠে, তোমায় ছাড়ব তো থাকবে কি আমার?

    সবই থাকবে। বরুণ নির্লিপ্ত গলায় বলে, চলেই যেতাম! নেহাত আপনার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারা গেল না। তাই—

    কুঞ্জ বলে, এই তো হল দেখা, কই যাও?

    বরুণ হেসে ফেলে বলে, আপনি অনুমতি করলেই যেতে পারি।

    ও, অনুমতির অপেক্ষা? অনুমতি না দিলে তো যাওয়া বন্ধ? ঠিক আছে, দিলাম না অনুমতি, এবার কি করবে করা?

    করবার আর থাকছে না কিছু। কিন্তু বাস্তবিকই আমাকে আর আটকাবেন না। রাস্তার লোক আবার রাস্তাতেই ফিরে যাই।

    হবে না। নাট্যকার, ওসব হবে না। কুঞ্জ আগের মতো উদাত্ত গলায় বলে, ভবানী অপেরা পার্টিকে আবার নতুন করে জাঁকিয়ে তুলতে হবে। সম্বল সহায়হীন হয়ে পারব কি করে?

    বরুণ নির্নিমেষ চোখে একবার ওই অতি উৎসাহী মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কলে, আর পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

    কুঞ্জ ঈষৎ মলিন হয়ে যায়। বলে, পারব না বলছ?

    বলছি না। মনে হচ্ছে, সেটাই বলছি।

    কিন্তু আমি বলছি বরুণ, পারব! কেউ পাশে থাকলেই সব পারা যায়। একটা ভালোবাসার লোক কাছে আছে, এটুকু জানতে পারলেই মনে বল আসে ভাই।…হাঁ, ভাই-ই বলব। এবার থেকে। কুঞ্জ একটু হাসে, বরাবর ইচ্ছে হত, মুখে এসে পড়ত, কিন্তু সামলে নিতাম। কেন জানো??

    বরুণ অবাক হয়ে তাকায়।

    এই নির্দোষ সম্বোধনটা মুখে এসে পড়লেও সামলে নেবার কারণ আবিষ্কার করতে পারে না সে।

    কুঞ্জ আর একটু হাসে, জামাই করব বলে।…বুঝলে? রেলগাড়িতে দেখে পর্যন্তই ওই বাসনা। দেখ মুখুমি? মাথা নেই মাথা ব্যথা! মেয়ে নেই জামাই!…বল, লিলি কি আমার মেয়ে? অথচ তাকে মেয়ে সাজিয়ে জামাই ঠিক করতে বসলাম! মুখুমির ফল ফলল তো? ওর বাপ আমার মুখে জুতো মেরে গেল।…

    কুঞ্জ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, তবে আক্ষেপটা রয়ে গেল এই, মেয়েটা আমায় মায়ামমতাহীন নিষ্ঠুর ভেবে গেল। মানে ভেতরটা তো ধরতে দিতাম না। ভাবতাম কে কখন সন্দেহ করে বসবে। হয়তো খুঁজে বার করতে চেষ্টা করবে। কার গর্ভের মেয়ে।

    বরুণ ওই বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, সনাতন কোনো খবর করতে পারল না??

    নাঃ! যে হারিয়ে যায়, সে নিজে না ধরা দিলে কার সাধ্য খুঁজে পায় রে ভাই! ভেবেছিলাম কষ্টে পড়লে ভুল বুঝবে। এসে দাঁড়াবে।।…কিন্তু এখন বুঝছি ভুল ভেবেছিলাম, দাঁড়াবে কেন? শুধু তো সে তার বাপেরই মেয়ে নয়, মায়েরও মেয়ে যে! আমার মধ্যে কি আছে না আছে টের তো পায়নি, আসবে কি জন্যে?

    বরুণ বলে, ও নিয়ে আর মন খারাপ করবেন না, মিস্টার দাস! ধরে নিন—সে যেখানে আছে ভালো আছে, সুখে আছে।

    তাই, তাই ভাবছি ভাই এখন। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মরণ খবরটা পেয়ে একেবারে নিশ্চিন্দি হয়ে বসি। হল না। তবে ওটাই ভাবিব, ভালো আছে সুখে আছে…তবে আর তোমার অপেরা পার্টি জাঁকিয়ে তুলতে বাধা কি ভাই?

    বরুণের হাতটা চেপে ধরে অধিকারী কুঞ্জ দাস।

    বরুণ সে হাত ছাড়িয়ে নেয় না।

    নরম গলায় বলে, না, বাধা আর কি। তুলুন জাঁকিয়ে।

    কুঞ্জ দাস সেই ধরা হাতটায় একটা নিবিড় চাপ দিয়ে বলে, তা হলে এবার আর ছাড়ছি না ভায়া, এবার একটা রোমান্টিক কাহিনি লিখতেই হবে।…আর চাবুক নয়, দুঃশাসন নয়, মহাকালের খাতা নয়, শুধু ভালোবাসার কথা। স্নেহ প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা।…মহাকালের খাতায় কার কি জমা খরচ লেখা হচ্ছে, আমরা কি তার হিসেব রাখতে যাবার অধিকারী? তবু শুধু শুধু বড়াই কেন? ও খাতায় হাত দেবার আস্পর্ধা করতে গেলে কোন ফাঁকে নিজের জমার ঘরেই শূন্য বসে যাবে কিনা কে জানে।

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article বিনুর বই ও নির্বাচিত ছোটোগল্প – অন্নদাশঙ্কর রায়

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }