Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বিষ্ণু জ্যাঠামশাইয়ের প্রত্যাবর্তন

    ছোটগল্প সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প18 Mins Read0

    বিষ্ণু জ্যাঠামশাইয়ের প্রত্যাবর্তন

    রজনীগন্ধার ঝাড়ে আজ প্রথম ফুলের ছড়া এসেছে।

    নতুন বাড়ি, নতুন বাগান। পাড়াটাও নতুন। ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে গড়ে উঠছে নতুন বসতি। সবকটা বাড়িই ঝকঝকে। বাড়ির সঙ্গে একটা বাগান থাকার বিলাসিতায় এখনও ঠিক ধাতস্থ হতে পারেনি সুকোমল। প্রত্যেক দিনই ফেরার পর একটুক্ষণ সে অবাক হয়ে দেখে। আগে সে ফুলটুল গ্রাহ্য করত না।

    ঠিক সাদা নয়, একটু সোনালি আভা আছে এই রজনীগন্ধায়। সুকোমল ফুল ছিড়বে না, গন্ধ। নেওয়ার জন্য নাকটা কাছে নিতেই কোথা থেকে একটা ভোমরা এসে পড়ল, প্রায় নাকের সঙ্গে ছোঁয়া লেগে যায় আর কী! ভয় পেয়ে সরে এল সুকোমল।

    ওরা কী করে খবর পায়? আজই প্রথম ফুল ফুটেছে বাগানে, অমনি একটা ভোমরা চলে এসেছে। ভোমরা, না ভ্রমরা? কবিরা ভ্রমর ভালোবাসে, কালিদাস শকুন্তলা নাটকে মেয়েদের ঠোঁট আর। ভ্রমর নিয়ে চমৎকার ইয়ার্কি করেছেন। অবশ্য বাংলা কবিতায় তোমরার সঙ্গে ভোমরার মিল ভালো হয়। কিংবা, এটা কি ভিমরুল অথবা গুবরে পোকা? হতেও পারে। কিন্তু কবিতায় ওরা স্থান পায় না।

    নতুন বাড়িতে কী করে যেন ঠিক টিকটিকিও চলে আসে। সুকোমল এর মধ্যেই রান্নাঘরে দুটো টিকটিকি দেখেছে। বাগানের কোনও গাছই বড় হয়নি। আম, লিচু ও সবেদা গাছ লাগান হয়েছে। কবে ফল ফলবে ঠিক নেই, তবু পাখি এসে বসে। বিনা মজুরিতে মিষ্টি আওয়াজ শুনিয়ে যায়।

    একতলায় ঘরগুলো বন্ধ। সুকোমল সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল দোতলায়। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অপসৃময়মান আলোয় সারা বাড়িটা আরও নিঝুম মনে হয়।

    জয়া থাকলে অন্যরকম মনে হত।

    একজন মাত্র মানুষের থাকা-না-থাকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। যে-কোনও একজন নয়, গৃহকত্রী কিংবা গৃহিণী। সে না থাকলে বাড়ি ঠিক গৃহ হয় না। সেই জন্যেই সংস্কৃতে বলে গৃহিনি গৃহমুচ্যতে। জয়া যদি দোকানপাটে যায় কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্য সল্টলেকে বাপের বাড়িতে, তখনও এরকম ফাঁকা লাগে না। রাত্তিরেও সে ফিরবে না, এই বোধটাই নির্জনতা এনে দেয়।

    অথচ, জয়া কয়েকটা দিন থাকবে না বলেই সুকোলের মনটা বেশ হালকা হয়ে আছে। কিংবা উৎফুল্লও বলা যেতে পারে। জয়ার সঙ্গে তার ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়নি। ভালোবাসার সম্পর্কে মাঝে-মাঝে দু-একটা আঁচড় লাগলেও চিড় ধরেনি। এখনও বেশ ফষ্টিনষ্টি হয়। অর্থাৎ জয়া থাকলে যেমন ভালো লাগে, তেমন জয়া নেই বলেই যে মনের মধ্যে খানিকটা ফুরফুরে হাওয়া বইছে, তাও অস্বীকার করা যায় না।

    জয়ার অনুপস্থিতিতে সে কোনওরকম অপকর্মের পরিকল্পনাও করেনি। শুধু সন্ধের পর নিঃসঙ্গতাকে আদর করবে।

    দোতলায় চওড়া বারান্দা। বেতের চেয়ার। এখানে বসলে এমনও মনে হতে পারে যে এটা মধুপুর কিংবা শান্তিনিকেতন। এই দিকটা এখনও খোলা, চোখে পড়ে একটা পুকুর।

    দুলালকে ডাকতে হল না, সে চা নিয়ে এল। দুলালের জন্য পেছন দিকে একটা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য টালির চাল। নির্মাণে ত্রুটি আছে, এরই মধ্যে বৃষ্টির সময় ভেতরে জল পড়ে। মিস্ত্রিরা কি ইচ্ছে করে কাজের লোকের ঘরটা খারাপ করে বানিয়েছে? ওরাও তো দুলালের মতনই গরিব। দুলাল চায়ের সঙ্গে তিনখানা চিঠিও এনে রাখল টেবিলে। তারপর জিগ্যেস করল, রাত্তিরে কী খাবেন? মুরগির ঝোল করে দেব? মাছও আছে।

    এ যেন হোটেল কিংবা ডাকবাংলো। অন্য সময় জয়াই এসব ঠিক করে। এখন সে ইচ্ছেমতন খাবারের অর্ডার দিতে পারে। নিজের বাড়িতে বসে হোটেল কিংবা ডাকবাংলোর স্বাদ।

    নিজের বাড়িও ঠিক নয়।

    ঠিক সাড়ে ছটার সময় সে বাথরুমের জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। পরদার আড়ালে চোরের মতন নিজেকে লুকিয়ে। আলো জ্বালেনি।

    সামনে রাস্তা, পেছন দিকেও এখনও বাড়ি ওঠেনি। কিন্তু ডানদিকে, বাঁ-দিকে পরপর বাড়ি। ডানদিকের কাঁচা হলুদ রঙের বাড়িটির দোতলার বাথরুমে প্রত্যেকদিন এইরকম কাছাকাছি। সময়ে একটি কিশোরী মেয়ে গা ঘোয়। অবশ্যই তার জানলা বন্ধ থাকে। ঘষা কাচ। আলো জ্বলা। থাকে বলে দেখা যায় তার ছায়ামূর্তি।

    নগ্ন হতেও পারে। বয়েস পনেরো বা ষোলো। ওই বয়সের মেয়েরা স্নানের সময় সব কিছু খুলে ফেলে কি না, তা সুকোমল জানবে কী করে? তবে ছায়ার মতন মেয়েটি গায়ে জল ঢালে, সাবান মাখে, নীচু হয়, এদিকে ফেরে, ওদিক ফেরে, ঠিক যেন ছায়ানৃত্য।

    স্নান বা গা ধোওয়া শেষ করে মেয়েটি বাথরুম থেকে বেরিয়ে যখন অন্য ঘরে যায়, তখন তার জাঙিয়া ও ব্রা-পরা শরীর দেখা যায় এক ঝলক বিদ্যুতের মতন, কোনও-কোনওদিন পুরো পোশাকেই থাকে। সেটা এমন কিছু নয়, ওই বাথরুমের ছায়াত্য দেখতেই বেশি ভালো লাগে। প্রায় রোজই সে দেখতে আসে, নেশার মতন। জয়া থাকলেও, ঠিক এই সময় সুকোমল বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।

    এর বেশি কিছু নয়। সুকোমল কোনওদিনই মেয়েটিকে কোনও ইঙ্গিত করে না, আলাপও করতে চাইবে না, শুধু দেখা, যেমন সুন্দর কিছু দেখা, যেমন বাগানের ফুল সে এখনও ছেড়ে না, যেমন ঝরনার জলে সে কখনও হিসি করে না, যেমন সে কোনও ছবির মাঝখানে হাত রাখে না।

    ফিরে এসে সে চিঠিগুলো পড়ল।

    দুটো চিঠি এলেবেলে, তৃতীয় চিঠিটি পড়তে-পড়তে তার ভুরু কুঁচকে গেল। এক জ্যাঠামশাই চিঠি লিখেছে, শনিবার বিকেলে তিনি সুকোমলের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তাঁর একটা বিশেষ কথা আছে।

    সুকোমল বিষ্ণু জ্যাঠামশাইয়ের মুখখানা দেখতে পেল।

    সুকোমল শনিবার বিকেলে বাড়ি থাকবে কি না, কিংবা তার কোনও অসুবিধা আছে কি না, তা জ্যাঠামশাই জানতে চাননি, সরাসরি তাঁর আসার কথা ঘোষণা করেছেন।

    জয়া নেই বলে সুকোমল কয়েকটা দিন চমৎকার একাকিত্বের স্বাধীনতা উপভোগ করছে, এর মধ্যে এক জ্যাঠার উপদ্রব। যাঁর প্রতি সুকোমলের বিন্দুমাত্র পারিবারিক দায়িত্ব নেই। কোনও টান নেই। বিষ্ণু জ্যাঠাকে অনেক বছর দেখেইনি সুকোমল, বেঁচে যে আছেন, তাও খেয়াল করেনি। ওর এক ছেলে পরিতোষের সঙ্গে মাঝে-মাঝে দেখা হয়েছে কোনও নেমন্তন্ন বাড়িতে। পরিতোষ কোনও হাসপাতালের ডাক্তার, বাড়ি করেছে কল্যাণীতে। সুকোমল যোগাযোগ রাখে না।

    সুকোমল ইচ্ছে করলেই বিষ্ণু জ্যাঠাকে নিষেধ করে দিতে পারে। পরিতোষের নিশ্চিত টেলিফোন আছে, সুকোমল জানিয়ে দিতে পারে যে আগামী অন্তত তিন মাসের মধ্যে তার সময় হবে না। তিনমাস পরেও যদি বুড়োটা বেঁচে থাকে, তখন তৈরি করা হবে অন্য ছুতো।

    তবু চিঠিখানা হাতে নিয়ে সুকোমল হাসতে লাগল আপনমনে।

    ২.

    যে-কোনও রাস্তায় কোনও গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হলেই সুকোমলের মনে হয়, নিশ্চয়ই তাতে তার চেনা কেউ আছে। সে উৎকণ্ঠামাখা মুখ নিয়ে উঁকি মারবেই, ভিড় ঠেলেঠুলে। দেখতে চায় আহত বা নিহত মানুষের মুখ। দেখেই চোখ ফিরিয়ে নেয়, আপনজন না হলে ওইসব মুখ সে মনে গেঁথে রাখতে চাইবে কেন?

    একদিন অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের বারে, অনেক রাতে, বেশ কয়েক পাত্র পান করবার পর সে বন্ধুদের হঠাৎ বলেছিল, জানিস, একদিন আমার চোখের সামনে…বাস চাপা পড়ে…আমি মরে গেলাম।

    বন্ধুরা হেসে উঠল।

    বাক্যটার অসঙ্গতি বুঝতে না পেরে সুকোমল বিরক্তভাবে বলে উঠল, হাসছিস কেন? এতে হাসির কী আছে।

    বন্ধুরা তবু হাসছে। মাতালের অশালীন হাসি। তবু বুঝতে পারেনি সুকোমল, বিরক্তি রূপান্তরিত হল রাগে, সে চিৎকার করে উঠল, এটা হাসির কথা? অ্যাঁ? আমি সত্যিই দেখেছি, বিজিত বাসের তলায়—

    পাশের সঙ্গীটি বলল, তাই বল! বিজিতের কথা জানি। কিন্তু তুই একটু আগে কী বললি?

    কী বলেছি?

    তুই বললি, তুই নিজে মরে গেছিস, নিজের চোখে দেখেছিস।

    মোটেই সে কথা বলিনি।

    হ্যাঁ বলেছিস! আর খাস না।

    সুকোমল অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। অন্যরা চলে গেল অন্য গল্পে।

    নেশার সময় কথা জড়িয়ে যায়। বাক্য গঠন ঠিক থাকে না। এরকম হতেই পারে। তবু সুকোমল মাথার চুল খিমচে ধরে ভেবেছিল, nyctophobia, নিজের জমিতে, অন্যের বাড়িতে শুয়ে থাকার অনুভূতিকে কী বলে? এ যেন, নিজের দেশ আছে নাগরিকত্ব নেই।

    সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ঠেসে দিতে গিয়ে সুকোমলের হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ষোলো বছর বয়সে, এই বিষ্ণু জ্যাঠারই বড় ছেলে বাঁটুলদা তাকে বিড়ি খাওয়াতে শিখিয়েছিল। গ্রামের বাড়ির ডানদিকে ছিল একটা লেবু বাগান, বড়-বড় গন্ধ লেবু হত, সেখানে বসে বিড়ি খাওয়ার পর বাঁটুলদা বলতো, কয়েকটা লেবুপাতা চিবিয়ে নে, তাহলে কেউ মুখে গন্ধ পাবে না। একদিন সে ঠিক ধরা পড়ে গিয়েছিল বিষ্ণু জ্যাঠার কাছে। কান ধরে টানতে-টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভেতরের বাড়িতে। খুব জোরে চিমটি কেটেছিলেন ঘাড়ে। ঘাড়ে চিমটি কাটা ছিল ওঁর প্রিয় শাস্তি।

    বিষ্ণু জ্যাঠার কি মনে আছে সে কথা?

    আজ ওঁর সামনে সিগারেট ধরিয়ে সুকোমল কি তার প্রতিশোধ নিল?

    সুকোমল নিজের মুখে লেবুগন্ধ পাচ্ছে।

    বিষ্ণু জ্যাঠা জিগ্যেস করলেন, বউমা কোথায়? ছেলেমেয়েরা?

    হাতঘড়ি দেখে চমকে উঠল সুকোমল। সাড়ে ছটা বেজে গেছে?

    সে বলল, জ্যাঠামশাই, আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।

    সে দৌড়ে ঢুকে গেল বাথরুমে। হ্যাঁ দৌড়েই। অন্যদিন দৌড়োয় না। পাশের বাড়ির বাথরুমে আলো জ্বলছে, শুরু হয়ে গেল ছায়ানৃত্য। বুকটা ধকধক করছে, মুখে লেবু পাতার গাঢ় সবুজ গন্ধ, এখন তার বয়েস ষোলো, আজই প্রথম সে দৃঢ় নিশ্চিত হল যে, বাথরুমে কিশোরীটি একেবারে নগ্ন, সে আয়নার সামনে আপনমনে দুলে-দুলে নাচছে।

    বাথরুম থেকে বেরিয়ে আজই প্রথম কিশোরীটি দৌড়ে না গিয়ে, আস্তে-আস্তে তার ব্রা-পরা বুকের কাছে দুটি হাত রাখল, তার ঘাড়ের রং জ্বাল দেওয়া দুধের মতন, একবার যেন এদিকে তাকিয়ে ফুলের পাপড়ি মেলার মতন হাসল না?

    ষোলো বছর বয়সটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করল সুকোমল, কিন্তু তার মুখের লেবু পাতার গন্ধটা মিলিয়ে যাচ্ছে।

    বয়েসটা বাড়াতে-বাড়াতে সে আবার ফিরে এল বারান্দায়।

    জয়া গেছে হাজারিবাগে। তাদের ছেলে রণ সেখানকার স্কুলে পড়ে। জয়া মাঝে-মাঝে ছেলের জন্য উতলা হয়ে পড়ে, ছুটি পর্যন্ত ধৈর্য রাখতে পারে না, তিনমাস অন্তর ছেলেকে দেখার জন্য ছুটে যায়। ওর এক বোনকে সঙ্গে নিয়ে যায়, হাজারিবাগের একটা ছোট হোটেলে ওঠে।

    এত সব কথা বিষ্ণু জ্যাঠাকে বলার কী দরকার?

    সে কিছু না ভেবেই বলল, বাড়িতে তো আর কেউই নেই, আমার একটাই ছেলে, সে বিহারের একটা স্কুলে পড়ে, আর আপনার বউমা…আপনাকে আর বলতে লজ্জা কী, আজকাল আমার সঙ্গে থাকে না, মানে আমাকে আর পছন্দ নয়, এখনও পাকাঁপাকি কিছু ঠিক হয়নি, দেখা যাক কী হয়!

    বিষ্ণু জ্যাঠার চোখদুটো স্থির হয়ে গেল, মুখে কিছু বললেন না।

    পঁচিশ বছর আগে সত্যিই এরকম কিছু ঘটলে তিনি সব দোষ সুকোমলের ঘাড়ে চাপিয়ে প্রচণ্ড দাবড়ানি দিতেন।

    পঁচিশ বছর আগে, সুকোমলের বয়েস তখন সদ্য চব্বিশ পেরিয়েছে, তার জীবনের প্রথম নারী, কৃষ্ণকলি, বাঘ-আঁচড়া গ্রামে এক বিয়েবাড়িতে, বিশাল জমিদার বাড়ি, কত রকম মানুষ, বাসি বিয়ের দিন সাংঘাতিক ঝড়-বৃষ্টি, কে কোথায় শুচ্ছে তার ঠিক নেই, তখনই কৃষ্ণকলির সঙ্গে সে, দুজনে মিলে একা, ঝড়ের দাপটেই সম্ভবত অত কাছাকাছি এসেছিল। দুজনেরই সেই প্রথম। শরীর চেনা, সম্পূর্ণভাবে। ভালোবাসা এবং যৌন টান এবং মধ্যবিত্ত নৈতিকতা। সুকোমল ঠিক করেছিল কৃষ্ণকলিকে সে বিয়ে করবেই। তখন সে সদ্য এম. এ. পাশ করে কলকাতায় চাকরি খুঁজছে, ইন্টারভিউ দিচ্ছে প্রত্যেক সপ্তাহে। এই জ্যাঠামশাই-ই প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন, মাকে সুকোমল রাজি করিয়েছিল প্রায়, কিন্তু জ্যাঠামশাই জাত-ফাতের তফাতের কথা বলে চ্যাঁচামেচি করতে লাগলেন, বাবা চলে গেলেন সেই দলে। যদি কোনওরকমে একটা চাকরি জুটে যেত, সুকোমল কারোর তোয়াক্কা না করে কৃষ্ণকলিকে নিয়ে চলে যেত অন্য কোথাও। কিন্তু একটা। পয়সা উপার্জন নেই—মনে পড়ল, প্রায় এক বছর ধরে পাগলের মতন ছুটোছুটি করেছে। সুকোমল, এক-একটা চাকরি, মরীচিৎকার মতন হয়েও হচ্ছে না। সন্ধেবেলা নির্জন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে শেকসপিয়ারের নাটকের রাজা তৃতীয় রিচার্ডের মতন সুকোমল বিকটভাবে আর্তনাদ করেছে, আ হর্স, আ হর্স, মাই কিংডম ফর আ হর্স। একটা পুরো ভবিষ্যত, নতুন জীবন, একটা সাম্রাজ্য, একটা চাকরির বদলে, শুধু একটা ঘোড়ার বদলে…

    কৃষ্ণকলি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, প্রাণ যায়নি অবশ্য, রক্ত বমি করতে-করতে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যায়, তারপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কানপুরে। তার একটা বিয়েও হয় কারোর সঙ্গে, এরকমই শোনা গেছে। কৃষ্ণকলি নিশ্চয়ই সারা জীবন সুকোমলকে একটা কাপুরুষ বলে ঘেন্না করে যাচ্ছে। সে-কথা ভাবলেই এখনও সুকোমলের বুক কাঁপে।

    কৃষ্ণকলি কবিতা ভালোবাসত, সব সময় থাকত যেন স্বপ্নের ঘোরে, তার কথায় থাকত গানের ভাষা। কৃষ্ণকলিকে পেলে সুকোমলের জীবন অন্যরকম হত, অন্য সন্তান, অন্য বাড়ি, সুকোমল কবিতা লেখা ছাড়ত না। ভাবতে-ভাবতে, চব্বিশ বছর বয়সে ফিরে গিয়ে তার সাংঘাতিক কষ্ট। হতে লাগল। এখনই আবার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল, আ হর্স, আ হর্স, মাই কিংডম ফর আ হর্স!

    সেই সম্ভাব্য অন্য জীবন থেকে তাকে বঞ্চিত করেছে এই বুড়োটা। ওর টুটিটা চেপে ধরলে কেমন হয়? সুকোমল ইচ্ছে করলে ওঁকে দিয়ে এখন তার পা চাটাতে পারে। নিশ্চয়ই টাকাপয়সা চাইতে এসেছে।

    চোখের সামনে কৃষ্ণকলির মুখটা দুলছে, সেই ঝড়-বাদলের রাত্রির মুখ, সুকোমলের এখন চব্বিশ বছর, আড়ালে গজরেছে, যা-তা গালাগালি দিয়েছে, কিন্তু বিষ্ণু জ্যাঠার সামনে একটা কথাও বলতে পারেনি। সে ছিল অসহায়, বেকার যুবক!

    একটা বুড়ো হাড়গিলে পাখির মতন বসে আছেন বিষ্ণু জ্যাঠা। চোখে জ্যোতি নেই।

    ওকে আঘাত দেওয়ার অন্য একটা পন্থা মনে পড়ল সুকোমলের। ঘর থেকে একটা মদের বোতল আর দুটি গেলাস নিয়ে এসে বলল, জ্যাঠামশাই আপনি খান এসব?

    বিষ্ণু জ্যাঠা ঘাড় নাড়লেন, দু-দিকে, আস্তে-আস্তে।

    একটা গেলাসে ঢালতে-ঢালতে সুকোমল বলল, আমার প্রত্যেক দিন খানিকটানা খেলে চলে না।

    তাদের পরিবারে আর কেউ কোনওদিন মদ্যপান করেনি। গ্রামের এক ডাক্তারকে বাড়িতে ডাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ বাবা-জ্যাঠারা ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করতেন, লোকটা ডাক্তারি জানে। ভালো, কিন্তু মাতাল! যদিও মাতাল অবস্থায় ডাক্তারকে দেখা যায়নি কোনওদিন, এটা তাঁর গৃহভৃত্যের রটনা মাত্র। প্রতিদিন মদ্যপান করার কথাটাও সুকোমলের অতিশয়োক্তি, মাঝে-মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে…আমেরিকা থেকে কেউ এলে চম্পক তার হাত দিয়ে ভালো-ভালো বোতল পাঠায়। তখন ভক্তিভরে বন্ধুদের ডেকে তা পান করা হয়। আজ সে বিষ্ণু জ্যাঠার সামনে মাতলামি করবে। বড় একটা চুমুক দিয়ে, আর একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বাচ্চা ছেলেকে ভোলাবার ভঙ্গিতে বলল, আপনি অন্য কিছু খাবেন? কোকাকোলা কিংবা দুলাল সরবৎ বানিয়ে দিতে পারে।

    বিষ্ণু জ্যাঠা বললেন, না, থাক।

    শীত করছে? একটা কম্বল এনে দেব?

    নাঃ। তেমন শীত নেই। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।

    পরিতোষরা সব ভালো আছে?

    আছে একপ্রকার। যার-যার মতন। সুকু, তুমি তো বই-টই লেখো শুনেছি। টাকা পয়সা ভালো পাও?

    এইবার টাকার কথা আসছে!

    বিষ্ণু জ্যাঠা দুনিয়াসু সবাইকে তুই বলতেন, এখন সুকোমলকে তুমি। প্রার্থী হয়ে এসেছেন তো।

    আপনি আমাকে কিছু বলবেন বলে চিঠিতে লিখেছিলেন।

    পরে বলব। কাল সকালে। এখন তুমি প্রকৃতিস্থ নাই।

    সুকোমল হাহা করে হেসে উঠল। মাত্র ছ-চুমুক দিয়েছে, এর মধ্যেই অপ্রকৃতিস্থ? মদ সম্পর্কে এখনও সেই গ্রাম্য ধারণা নিয়ে ইনি বসে আছেন।

    টেলিফোন বেজে উঠতেই সুকোমল উঠে গেল ঘরের মধ্যে।

    একটা প্রাফের ব্যাপারে প্রকাশকের ফোন। দু-মিনিটে কথা শেষ। তবু সুকোমল সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।

    চব্বিশ বছর বয়েসটা আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাকা ধূমপায়ীর মতন সে কাশল দু-বার। কৃষ্ণকলিকে বিয়ে করলে সে-জীবন কি এর চেয়ে ভালো হত? দিনের পর দিন এক খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে, এক বিছানায় শুয়ে, কৃষ্ণকলি কি জয়ার চেয়ে কোনওভাবে অন্যরকম হত? না-পাওয়া কৃষ্ণকলি কি আরও আকর্ষণীয় নয়? তার মনের মধ্যে কৃষ্ণকলির একটুও বয়েস বাড়েনি। জয়ার সঙ্গে ইদানীং পুরো ব্যাপারটা খুবই মাঝে-মাঝে হয়। বিয়ের অষ্টম বছরে, একদিন সঙ্গমরত অবস্থায় সুকোমলের হঠাৎ মনে হয়েছিল, শেষ হচ্ছে না কেন, এতক্ষণ কী দরকার; তারপর হঠাৎ কৃষ্ণকলির মুখ ও শরীর মনে পড়তেই আবার উত্তেজনা ফিরে এল। কৃষ্ণকলিকে বিয়ে করলে, অষ্টম বছরে, সেরকমই কি কিছু হত না? অন্য কারোর মুখ!

    শারীরিক টান কমে গেলেও যে ভালোবাসা থাকতে পারে, তা বুঝতে-বুঝতে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। যেমন জয়ার সঙ্গে আছে। এই রকম বয়েসে জয়া আর কৃষ্ণকলি একই। শরীরের গুরুত্ব কমে গিয়ে নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব। তাও অনেকের হয় না। জয়া তার বন্ধু, কৃষ্ণকলিও কি। বন্ধু হতে পারত? শুধু পাশের বাড়ির বাথরুমে ছায়া-নর্তকীটি আলাদা। সে ধরা-ছোঁওয়ার অতীত।

    বারান্দায় আবার ফিরে আসতে-আসতে সুকোমল ভাবল, বুড়োটা কিছু চাইতে এসেছে, সেটা জানার জন্য কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? উনি রাত্তিরে এখানে থেকে যাবেন, ধরেই। নিয়েছেন, তা থাকুন। কিন্তু রবিবার সকালে সুকোমলের অনেক কাজ থাকে। বন্ধুবান্ধব আসে, সেখানে জ্যাঠাশ্রেণির কারোকে বসতে দেওয়ার প্রশ্ন আসে না।

    সুকোমল বলল, জ্যাঠামশাই, আপনি কী বলবেন, এখনই বলে ফেলুন। এরকম চার গেলাস খেলেও আমার নেশা হয় না।

    বিষ্ণু জ্যাঠা বেশ কয়েক মুহূর্ত সুকোমলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, আমি গত মাসে একবার খুলনা গেছিলাম।

    প্রস্তাবটা ঠিক বুঝতে পারল না সুকোমল। হঠাৎ খুলনার কথা কেন? বিষ্ণু জ্যাঠা বললেন, বিনা পাসপোর্টেও যাওয়া যায়, তিনশো টাকা লাগে, কোনও অসুবিধা নাই।

    আমাদের গ্রামের বাড়িটা তোমার মনে আছে সুকু?

    মনে থাকবে না কেন? সে-বাড়িতে সুকোমলের বাল্য, কৈশোর, যৌবনেরও কয়েকটা বছর কেটেছে। প্রতিটি গাছপালা, পুকুরঘাটের ভাঙা সিঁড়িটার কথা পর্যন্ত মনে আছে।

    বিষ্ণু জ্যাঠা বললেন, বাড়িটা প্রায় আছে একই রকম। শুধু উপরের তলায় একটা ঘর তোলা হয়েছে। খেজুর গাছ, বাতাবি লেবুর গাছ, উঠোনের জামরুল গাছটাও রয়ে গেছে।

    সুকোমল জিগ্যেস করল, পাশের গন্ধলেবুর বাগান?

    বিষ্ণু জ্যাঠা বললেন, না সেটা নেই। সেখানে বাড়ি উঠেছে। আমাদের বাড়িটায় এক মুসলমান ভদ্রলোক থাকেন, আমার পরিচয় জেনে খুব খাতিরযত্ন করলেন। কথায়-কথায় তিনি বললেন, ছেলেরা কেউ কাছে থাকে না, তিনিও এ বাড়ি বিক্রি করে শহরে চলে যেতে চান। শুনেই আমার মনটা বড় আনচান করে উঠল। আমাদের বাড়ি ছিল। ভদ্রলোক বিক্রি করে দিতে চান, আমরা আবার কিনে নিতে পারি না? সেইজন্যেই তোমার কাছে ছুটে এলাম। সুকু, তুমি বাড়িটা যদি কেনো, আমাদের পিতৃপুরুষের আত্মা সুখী হবে।

    —আমি বাড়িটা কিনে নেব?

    —বাপ-ঠাকুরদার ভিটা ধরে রাখতে পারলে পুণ্য হয়।

    —আপনি কী বলছেন জ্যাঠামশাই? এটা সম্ভব নাকি!

    —অসম্ভব কেন হবে? বর্তমান মালিক বেচে দিতেই তো চান। তোমার এখন টাকাপয়সা হয়েছে, যদি কিনে নিতে পার, আমি দেখাশোনা করব…আমার ছেলেরা কেউ রাজি নয়, আমার কথায় পাত্তাই দেয় না…

    একটু থেমে, তিনি আলোয়ানে একবার মুখ চাপা দিলেন, চোখের জল মুছলেন নাকি? ধরা গলায়, অনেকটা আপনমনে আবার বলতে লাগলেন, এক ছেলে বাড়ি করেছে কল্যাণীতে। আর এক ছেলে টালিগঞ্জে। আমি বদলাবদলি করে থাকি, কোথাও আমার মন টেকে না। বড় কষ্ট হয়। মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছেন, সুখী কে? যে অঋণী ও অপ্রবাসী হয়ে মরতে পারে, সেই সুখী। আমার কোনও ঋণ নাই, এই প্রবাসে আমি মরতে চাই না রে, আমার জন্মস্থানে গিয়ে যদি শেষ নিশ্বাস ফেলতে পারি, আমার হাড় জুড়োবে। সুকু, তোর কাছে বড় আশা নিয়ে এসেছি!

    দেশ ভাগ হয়ে গেছে কত বছর আগে! তার পরেও অনেক দিন বিষ্ণু জ্যাঠা মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। শেষপর্যন্ত চলে আসতে বাধ্য হন। সেও তো হয়ে গেল তেইশ-চব্বিশ বছর। এখনও এ দেশ বিষ্ণু জ্যাঠার কাছে প্রবাস। তিনি ফিরে যেতে চান।

    এত বড় এই বাড়িটা দেখে মনে করেছেন সুকোমলের অনেক টাকা হয়েছে, বিষ্ণু জ্যাঠা জানেন, এ বাড়িটা সুকোমলের নয়, আর বাজারে এখনও তার কত ধার! সে-ও ঋণী। অপ্রবাসী কি?

    টাকা থাকলেই বা কী হত, বাংলাদেশে গিয়ে বাড়ি কেনা যায় নাকি? চম্পকের বন্ধু রফিক একবার শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে মুগ্ধ। সেখানে কত নতুন-নতুন বাড়ি উঠছে। রফিকের শখ হল সেও শান্তিনিকেতনে একটা বাড়ি বানাবে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির কাছাকাছি একটা জমি পছন্দ হওয়ার পরে জানা গেল, রফিক আমেরিকায় থাকলেও তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট। সে আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে বাড়ি কিনতে পারলেও ভারতে তার জমি কেনার অধিকার নেই।

    সুকোমল বললেন, তা হয় না জ্যাঠামশাই। বাংলাদেশে জমি-বাড়ি কেনা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়।

    বিষ্ণু জ্যাঠা অবিশ্বাসের সুরে বললেন, টাকা দিয়ে যদি কিনি, ফেরৎ চাইছি না তো, সেটা আমাদের নিজেদের বাড়ি ছিল—

    সুকোমল বলল, পৃথিবীতে মানুষের নিজের বাড়ি বলে কিছু নেই!

    আমেরিকার আদিবাসীদের (যাদের ওরা বলে ইন্ডিয়ান, আমরা বলি রেড ইন্ডিয়ান) একটা গোষ্ঠীর অধিপতি শ্বেতাঙ্গদের বলেছিলেন, আকাশ, বাতাস, নদী, অরণ্য যেমন বিক্রি করা যায় না, তেমনি পৃথিবীর ভূমিও বিক্রয়ের অধিকার কারোর নেই, ভূমি কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না।

    এই প্রথম সুকোমল স্নেহের দৃষ্টিতে বিষ্ণু জ্যাঠার দিকে তাকাল।

    কী দাপট ছিল এক সময় এই মানুষটার। এখন ছেলেবউদের সংসারে থাকতে হয়। উপার্জনহীন অক্ষম বৃদ্ধকে দিনের-পর-দিন সহ্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব না হতেই পারে। অযত্ন, অবহেলাই তাঁর নিয়তি। ফিরে যেতে চাইছেন নিজস্ব অধিকারের দিনগুলিতে। সেখানে ফেরা আর কোনওক্রমেই যায় না। কী করুণ, ভাঙাচোরা একটা মানুষ!

    কাঁপা-কাঁপা গলায় তিনি বললেন, বাতাবি লেবু গাছ, জামরুল গাছ ওরা আমারে দেখে চিনতে পেরেছিল…বাবা সুকু, তুই আমার এই কথাটা রাখ। তুই চেষ্টা করলে পারবি, তোরা যাবি মাঝে মাঝে, আমি পাহারা দেব, নাতি-নাতনিরা জানবে কোন মাটিতে বাপ-ঠাকুরদা জন্মেছিল, জন্মস্থান হল সবচেয়ে পুণ্যস্থান—

    সুকোমল বলতে যাচ্ছিল, অনেক মানুষেরই জন্মস্থান আর দেশ এক হয় না—

    কিন্তু বলতে হল না, এই সময় দুলাল এসে দাঁড়াল।

    ওর আসার দরকার ছিল না, এটা যেন একটা ছবি, ছবিতে রং-এর সামঞ্জস্য লাগে, রেখা ও আয়তনের সামঞ্জস্য রাখতে হয়, ছবির একদিকে যদি খুব উজ্জ্বল লাল রং-এর কোনও কিছু। থাকে, তাহলে আর একদিকে সেই রং-এর যেমন ব্যালান্স করতে হয়, সেইরকমই, এই ছবিতে, এই মুহূর্তে জ্যাঠামশাই ও তার মাঝখানে প্রয়োজন ছিল দণ্ডায়মান মূর্তি।

    দুলাল উত্তেজিতভাবে বলল, দাদা, বাগানে একটা সাপ বেরিয়েছে, এই অ্যাত্ত বড়, ফণা তুলেছিল…

    সাপের কথা শুনলে অস্থির হবে না, এমন মানুষ হয়?

    জ্যাঠামশাইকে ভুলে গিয়ে সুকোমল দৌড়ল দুলালের সঙ্গে।

    বাগানে এরই মধ্যে জড়ো হয়ে গেছে অনেক লোক, এত তাড়াতাড়ি সবাই কী করে খবর পায়? কাছাকাছি বাড়ির সব কাজের লোক, ড্রাইভার, মালি, পথচারী, কারোর-কারোর হাতে লাঠি, মহিলা বা স্ত্রীলোকও আছে, কোনও কিশোরী মেয়ে নেই।

    সবাই নানা সুরে চিৎকার করছে, সাপটাকে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।

    দুলাল নিজের চোখে সাপটিকে ফণা তোলা অবস্থায় দেখেছে, আরও কয়েকজন দেখেছে বলে দাবি করল। খুবই বিরক্ত সাপ, রজনীগন্ধার ঝাড়ের কাছে একটা গর্তে ঢুকে পড়েছে, এই মাত্র।

    এই অঞ্চলটা কলকাতা শহরের অন্তর্গত হয়নি এখনও, সদ্য গড়ে ওঠা শহরতলি, এখানে সাপ থাকা বিচিত্র কিছু নয়। ছিল জলাভূমি, সাপ, ব্যাং, ইঁদুর, পোকামাকড়দের নিজস্ব এলাকা। মানুষ এসে যদি জলাভূমি ভরাট করে, ভিত গেঁথে বাড়ি বানায়, তাহলে ওরা যাবে কোথায়?

    তা বলে বাগানে একটা বিষাক্ত সাপ ঘুরে বেড়াবে, এটাও তো মেনে নেওয়া যায় না। পাশেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি। কয়েকজন রজনীগন্ধার ঝাড়ে লাঠির বাড়ি মারছে। প্রথম ফোঁটা ফুলটা নষ্ট হয়ে গেছে এরই মধ্যে, এবারে গাছগুলোও যাবে। কিন্তু ও ভাবে গর্ত থেকে সাপটাকে বার করা যাবে না! সাপ আর সন্ন্যাসীদের নিজস্ব কোনও বাসস্থান থাকে না, সাপ যে-কোনও গর্ত দেখলেই ঢুকে পড়ে, সাপিনিরাও সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান খোঁজে না, তবু

    পৃথিবীতে এত সাপ এখনও টিকে আছে, সন্ন্যাসীও কম নয়। সুকোমলের পেছনে-পেছনে নেমে এসেছেন বিষ্ণু জ্যাঠামশাই। পেছনে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা শুনে তিনি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন গর্তটার কাছে। মুখটা উঁচু করে বললেন, কোনও চিন্তা নাই, আমি সাপটাকে ধরে দিচ্ছি!

    সঙ্গে-সঙ্গে সুকোমলের একটি দৃশ্য মনে পড়ে গেল।

    তখন তার এগারো বছর বয়েস, বাড়ির দু-পাশেদুটো পুকুর, ডান দিকেরটাই বড়, তার বাঁধানো ঘাটের তলায় কয়েকদিন ফোঁসফোঁস শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বিষ্ণু জ্যাঠা কোনও এক কায়দায় খালি হাতে সেই সাপটাকে ধরে টেনে বার করেছিলেন। প্রায় হাতচারেক লম্বা গোখরো সাপ, একেবারে কালান্তর যম। বিষ্ণু জ্যাঠা তার মুণ্ডুটা চেপে ধরে বনবন করে ঘোরাতে লাগলেন। ওরকম ভাবে ঘোরালে নাকি সাপের হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তখন বিষ্ণু জ্যাঠা

    পূর্ণবয়স্ক পুরুষ, চওড়া কাঁধ, লোহার দরজার মতন বুক মাথায় ঝাঁকড়া চুল, ঘাটের একদঙ্গল নারী-পুরুষ বিষ্ণু জ্যাঠার সাহস আর তেজের তারিফ করছে। এগারো বছরের সুকোমলের সেদিন, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিষ্ণু জ্যাঠাকে মনে হচ্ছিল মহাদেবের মতন।

    কয়েক মুহূর্ত এই দৃশ্যটা দেখল সুকোমল। কিন্তু এগারো বছর বয়েসটাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা। যায় না। বড় পলকা সেই বয়েস। শ্লেটে আঁকা ছবির মতন সহজেই মুছে যায়। হুহু করে আবার বয়েস বাড়তে লাগল সুকোমলের। ঊনপঞ্চাশে পৌঁছে সে ভাবল, এই রে, বুড়োটা এবার সাপের কামড় খেয়ে মরবে। যৌবন বয়েসে যা পেরেছিলেন, এখনও কি তিনি প্রমাণ করতে চান যে তাঁর সে তেজ রয়ে গেছে?

    গর্তটার কাছে, মাটিতে বসে পড়ে বিষ্ণু জ্যাঠা গম্ভীরভাবে বললেন, কেউ আমাকে একটা সাঁড়াশি এনে দাও তো!

    সুকোমলের বয়েস বেড়েই চলেছে, থামছেনা, উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে বর্তমান, বাস্তবতা। সে এখন আটাত্তর, শরীরের সব পেশি শিথিল, চোখে তেজ নেই, সে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে, তার ছেলে তখন কোথায় থাকবে সে জানে না। জয়া কোথায় সে জানে না। বন্ধুরা চলে গেছে একে-একে। এই বাড়িটার কী হবে সে জানে না, কিন্তু অনেক মানুষ তাকে ঘিরে আছে, উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সবার সামনে সুকোমলকে প্রমাণ দিতে হবে যে তার অস্তিত্বের, তার বেঁচে থাকার। কোনও মূল্য আছে। এতখানি জীবন পার হয়ে এসে তাকে আবার পরীক্ষা দিতে হবে, সবাই দেখছে, সবাই জানতে চাইছে, সবাই বিচারক। সুকোমলের সারা শরীরটা কেঁপে উঠল, সে। ব্যাকুলভাবে নিজেকেই জিগ্যেস করতে লাগল, পারব তো? এই যে জীবনযাপন করে গেলাম, তা যে একেবারে অকিঞ্চিৎকর নয়, পারব, পারব তার প্রমাণ দিতে?

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিরলে নিরালায়
    Next Article বুড়োর দোকান

    Related Articles

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }