Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বীরবলের হালখাতা – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প129 Mins Read0

    পত্র ১

    পত্র ১

    সম্পাদকমহাশয় সমীপেষু,

    আপনি যে নূতন কাগজ বার করেছেন, তার যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে ততা সে হচ্ছে নূতন কথা নূতন ধরনে বলা। এ উদ্দেশ্য সফল করতে হলে নূতন লেখক চাই, নচেৎ সবুজপত্র কালক্রমে শ্বেতপত্রে পরিণত হবে।

    যদি আপনি মুখপত্রে ‘আমি’র পরিবর্তে ‘আমরা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, তথাপি ঐ বহুবচনের পিছনে যে বহু লেখক আছেন, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। বাংলায় দ্বিবচন নেই, সম্ভবত সেই কারণেই আপনি প্রথমপুরুষের বহুবচন ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, অদ্যাবধি কেবলমাত্র দুটি লেখকেরই পরিচয় পাওয়া গেছে : এক সম্পাদক, আর-এক শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

    শ্ৰীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে গুনতির মধ্যে ধরা গেল না; কেননা, আপনারা লেখার যা নমনা দেখিয়েছেন তার থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আপনার প্রধান ভরসাস্থল হচ্ছে গদ্য। কারণ, সোজা কথা বাঁকা করে এবং বাঁকা কথা সোজা করে বলা পদ্যের রীতি নয়।

    আর ছিলুম আমি, কিন্তু আর বেশিদিন যে থাকব কিংবা থাকতে পারব, এমন আমার ভরসা হয় না। হয় আপনি আমাকে ছাড়বেন, নয় আমি আপনাকে ছাড়ব। আমার লেখায়, আর যাই হোক সবুজপত্রের যে গৌরব বৃদ্ধি হয় নি, একথা সর্বসমালোচকসম্মত। এ অবস্থায় ‘বীরবল’ অতঃপর ‘আবল-ফজল’ হওয়া ব্যতীত উপায়ান্তর দেখতে পাচ্ছেন না। ভবিষ্যতে আইন-ই-আঙ্গরেজি নামকু যে নব-বিশ্বকোষ রচনা করব ‘সবুজপত্রে তার স্থান হবে না। যদি ‘ফৈজি’ হতে পারতুম, অহলেও নাহয় আপনার কাগজের জন্য একখানি দেশকালোপযোগী অর্থাৎ স্বয়ংবরা-তিরস্কৃত একখানি নলদমন’ রচনা করতে পারতুম; কিন্তু সে হবার জো নেই। আমাকে আবল-ফজল হতেই হবে। আশা করি, বাংলার নবীন আবল-ফজলদের মধ্যে কেউ-না-কেউ আমার সঙ্গে পেশা বদলে নেবেন; কেননা, সাহিত্যরাজ্যে বীরবলেরও আবশ্যকতা আছে। ইংরেজেরা বলেন, এক কোকিলে বসন্ত হয় না–অর্থাৎ আর পাঁচ-রঙের আর পাঁচটি পাখিও চাই। বাংলাসাহিত্যের উদ্যানে যদি বসন্তঋতু এসে থাকে, তাহলে সেখানে কোকিলও থাকবে, কাঠ-ঠোকরাও থাকবে, লক্ষ্মী-পেঁচাও থাকবে, হতুম-পেচাও থাকবে। মনোরাজ্যে যখন নানা পক্ষ আছে, তখন নানা পক্ষী থাকাই স্বাভাবিক। যেমন এক ‘বউ-কথা-কও’ নিয়ে কবিতা হয় না, তেমনি এক ‘চোখ-গেল’ নিয়ে দর্শনও হয় না।

    উপরোক্তভাবে বাদসাদ দিয়ে শেষে দাঁড়াল এই যে, আপনার কাগজের যা প্রধান প্রয়োজন, সেইটিই হচ্ছে তার প্রধান অভাব–অর্থাৎ নূতন লেখক। মনে রাখবেন যে, এদেশে আজকাল খাঁটি সাহিত্য চলবে না; চলবে যা, তা হচ্ছে জাতীয় সাহিত্য। যদিচ একথার সার্থকতা কি, সেসম্বন্ধে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। কোনো লেখা যদি সাহিত্য না হয়, তবুও তার আর মার নেইযদি তা তথাকথিত জাতীয় হয়। এর কারণ, প্রথমত, আমরা বিশেষ্যের চাইতে বিশেষণের অধিক ভক্ত; দ্বিতীয়ত, আমরা সাহিত্য-বিচার করতে পারি-আর-নাপারি, জাত-বিচার করতে জানি। বলা বাহুল্য যে, দু হাতে কখনো জাতীয় সাহিত্য গড়ে তোলা যায় না; দু হাতে অবশ্য তালি বাজে। আপনারা যদি না স্বজাতিকে অহর্নিশি করতালি দিতে প্রস্তুত হতেন, তাহলে আপনাদের হাতে জাতীয় সাহিত্য রচিত হত; কিন্তু সেবিষয়ে আপনাদের যখন তাদশ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না, তখন নূতন লেখক চাই।

    বাংলা লেখবার লোকের অভাব না থাকলেও ‘সবুজপত্রে লেখবার লোকের অভাব যে কেন ঘটছে, তার কারণ নির্ণয় করতে হলে বঙ্গসাহিত্যের বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনা করা আবশ্যক।

    বাংলাসাহিত্যে যে আজ বসন্তকাল উপস্থিত, ‘সবুজপত্রের আবির্ভাব তার একমাত্র প্রমাণ নয়। ইতিপবেই স্বদেশী জ্ঞানবক্ষের নানা ডালপালা বেরিয়েছে, এবং অন্তত তার একটি শাখায় অর্থাৎ ইতিহাসের অক্ষয় শাখায় এমন ফল ফটেছে ও ফল ধরেছে, যা সমালোচকদের নখদন্তের অধিকারবহির্ভূত; কেননা, সে ফল তামার এবং সে ফল পাথরের।

    কিন্তু আপনি পাঠকদের এই ফলাহারে নিমন্ত্রণ করেন নি। আপনি সবুজপত্রে যে ফল পরিবেষণ করতে চান, সে জ্ঞানবৃক্ষের ফল নয়, কিন্তু তার চাইতে ঢের বেশি মুখরোচক সংসারবিষবক্ষের সেই ফল, যা আমাদের পর্বপুরুষেরা অমতোপম মনে করতেন। সেই-জাতীয় লেখকেরা হচ্ছেন আপনার মনোমত, যাঁরা কিছুই আবিষ্কার করেন না কিন্তু সবই উম্ভাবনা করেন, যাঁরা বস্তুজগৎকে বিজ্ঞানের হাতে সমর্পণ করে মনোজগতের উপাদান নিয়ে। সাহিত্য গড়েন।

    আমাদের সাহিত্যসমাজে কবি-দার্শনিকের ভিড়ের ভিতর বৈজ্ঞানিকদেরই খুঁজে পাওয়া ভার, অতএব আপনার স্বজাতীয় সাহিত্যিকের অভাব এদেশে মমাটেই নেই। তাহলেও তাঁরা যে উপযাচী হয়ে এসে আপনাদের দলে ভিড়বেন, তার সম্ভাবনা কম; কেননা, যাতে করে দল বাঁধে, সেরকম কোনো মতের সন্ধান আপনাদের লেখায় পাওয়া যায় না।

    সকল দেশেই মনেরও একটা চলতি পথ আছে। অভ্যাসবশত এবং সংস্কারবশত দলে দলে লোক সেই পথ ধরেই চলতে ভালোবাসে; কারণ মখ্যত সে পথ হচ্ছে জনসাধারণের জীবনযাত্রার পথ। সে পথ মহাজনদের হাতে রচিত হয় নি, কিন্তু লোকসমাজের পায়ে গঠিত হয়েছে। আপনারা বঙ্গসরস্বতীকে সেই পরিচিত পথ ছেড়ে একটি নূতন এবং কাঁচা রাস্তায় চালাতে চান। আপনারা বলেন ‘সম্মখে চল’, কিন্তু বুদ্ধিমানেরা বলেন ‘নগণস্যাগ্রতোগচ্ছে’। আপনাদের মত এই যে, সামাজিক জীবনের পদানুসরণ করা কবি কিংবা দার্শনিকের মনের কাজ নয়। জীবনকে পথ-দেখানোই হচ্ছে সে মনের ধর্ম, অতএব কর্তব্য। সুতরাং আপনাদের দ্বারা উদ্ভাবিত, অপরিচিত এবং অপরীক্ষিত চিন্তামাগে অগ্রসর হতে অনেকেই অস্বীকৃত হবেন। বিশেষত, যখন সে পথের একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থান নেই, যদি-বা থাকে তো সে অলকা বর্তমানভারতের পরপারে অবস্থিত। শুনতে পাই, ইউরোপের সকল স্থূলপথই রোমে যায়। তেমনি এদেশের সকল হাঁটাপথই কাশী যায়। কিন্তু আপনারা যখন বাঙালির মনকে কাশীযাত্রা না করিয়ে সমদ্রযাত্রা করাতে চান, তখন যে নূতন লেখকেরা সবুজপত্র নিয়ে আপনাদের সঙ্গে একপংক্তিতে বসে যাবেন, এরূপ আশা করা বৃথা। সুতরাং আপনাদের সেই শ্রেণীর লেখক সংগ্রহ করতে হবে, যাদের কাছে আপনাদের সাহিত্য অচল নয়। এ দলের বহু লোক আপনার হাতের গোড়াতেই আছে।

    গত বৈশাখমাসের ‘ভারতী’-পত্রিকাতে আপনি বিলেতফেরত বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। প্রাচীন ব্রাহরণসমাজে এ সম্প্রদায়ের স্থান নেই, সতরাং নূতন ব্রাহরণসমাজ অর্থাৎ সাহিত্যসমাজে এদের তুলে নেওয়া হচ্ছে আপনার পক্ষে কর্তব্য। অতীতের উদ্ধারের পাল্টাজবাবু দিতে হলে পতিতের উদ্ধার করা আবশ্যক।

    বিলেতফেরতদের লেখায়, আর-কিছু থাক আর না-থাক, নূতনত্ব থাকবেই। মাইকেল দত্ত, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, এই তিনটি বিলেতফেরত কবির ভাষায় ও ভাবে এতটা অপূর্বতা ছিল যে, আদিতে তার জন্য এদের দুজনকে পুরাতনের কাছে অনেক ঠাট্টাবিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে যে কেউ ঠাট্টা করেন নি, তার কারণ, তিনি সকলকে ঠাট্টা করেছেন। এই থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বিলেতফেরতের হাতে পড়লে বঙ্গসাহিত্যের চেহারা ফিরে যায়।

    আসল কথা, এ যুগের বঙ্গসাহিত্য হচ্ছে বিলেতি ঢঙের সাহিত্য। যে হিসেবে দাশরথি রায়ের পাঁচালি ও গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা খাঁটি বাংলাসাহিত্য, সে হিসেবে নবসাহিত্য খাঁটি বঙ্গসাহিত্য নয়। এর জন্যে কেউ-কেউ দুঃখও করেন। চোখের জল ফেলবার কোনো সুযোগ বাঙালি ছাড়ে না। ব্যাস-বাল্মীকির জন্যও আমরা যেমন কাঁদি, পাঁচালিওয়ালাদের জন্যও আমরা তেমনি কাঁদি। কিন্তু সমালোচকেরা চক্ষের জলে বক্ষ ভাসিয়ে দিলেও বগসরস্বতী আর গোবিন্দ-অধিকারীর অধিকারভুক্ত হবেন না, এবং দাশরথিকেও সারথি করবেন না।

    আমাদের নবসরস্বতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিতা, এবং কলেজে-শিক্ষিত লোকেরাই অদ্যাবধি তাঁর সেবা করে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন; কেউ ফোঁটা কেটে, কেউ হ্যাট পরে। এই প্রভেদের কারণ নির্দেশ করছি। পরোকালে যখন ক্ষত্রিয়েরা একসঙ্গে সরা এবং সোম পান করতেন, তখন ব্রাহণেরা এই শান্তি-বচন পাঠ করতেন :

    ‘অহে সুরা ও সোম, তোমাদের জন্য দেবগুণ পথক পথক রুপে স্থান কল্পনা করিয়াছেন। তুমি তেজস্বিনী সরা, আর ইনি রাজা সোম, তোমরা আপন আপন স্থানে প্রবেশ কর।’

    আমরাও কলেজে যুগপৎ ইংরেজি-সরা এবং সংস্কৃত-সোম পান করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দুটি পাকস্থলী না থাকায় সেই সুরা আর সোম আমাদের উদরস্থ হয়ে পরস্পর লড়াই করছে। আমাদের সাহিত্য সেই কলহে মুখরিত হয়ে উঠেছে। আমাদের যে নেশা ধরেছে, সে মিশ্র-নেশা। তবে কোথাও-বা তাতে সুরার তেজ বেশি, কোথাও-বা সোমের। মনোজগতে যে আমরা সকলেই বিলেতফেরত, এইকথাটা মনে রাখলে সাহিত্যমন্দিরে আপনার সম্প্রদায়কে প্রবেশ করতে সাহিত্যের পাণ্ডারা আর বাধা দেবেন না, বরং উৎসাহই দেবেন; কেননা, আমরা সকলেই ইংরেজিসাহিত্যে শিক্ষিত, আপনারা উপরন্তু ইংরেজিসভ্যতায় দীক্ষিত।

    সামাজিক হিসেবে বিলেতফেরতদের এই গরগেহবাসের ফল যাই হোক, সাহিত্য হিসেবে এর ফল ভালো হবারই সম্ভাবনা। কারণ ইংরেজি-জীবনের সঙ্গে ইংরেজিসাহিত্যের সম্বন্ধ অতিঘনিষ্ঠ। ইংরেজি-জীবনের সঙ্গে যাঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় আছে, তিনি জানেন যে, ইউরোপে সাহিত্য হচ্ছে জীবনের প্রকাশ ও প্রতিবাদ; আর সে পরিচয় যাঁর নেই, তিনি ভাবেন যে ও শুধু বাদানুবাদ। সাহিত্যের ভাষ্য ও টীকা জীবনসুত্র হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তা শুধু কথার কথা হয়ে ওঠে। সেই কারণে নবশিক্ষিতসম্প্রদায়ের জীবনে ইংরেজি-জীবনের প্রভাব যে পরিমাণে কম, তাঁদের রচিত সাহিত্যে ইংরেজি-কথার প্রভাব তত বেশি। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের স্বদেশী বক্তৃতায় ও লেখায় নিত্য পাওয়া যায়। সংস্কৃতভাষার ছদ্মবেশ পরিয়েও বিলেতি মনোভাবকে আমরা গোপন করে রাখতে পারি নে। বিদেশী ভাবকে আমি অবশ্য মন থেকে বহিস্কৃত করে দেবার প্রস্তাব করছি নে, কারণ যেসকল ভাব সাত-সমুদ্র-তেরো-নদীর পার থেকে উড়ে এসে আমাদের মনোজগতে জড়ে বসেছে, তাদের বেবাক উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়, এবং সম্ভব হলেও তাতে মন উজাড় হয়ে যাবে। তবে যা জালে ওঠে তাই যেমন মাছ নয়, তেমনি যা ভুই ফড়ে ওঠে তাই গাছ নয়। বিলেতিজীবনে বিলেতিসাহিত্য যাচাই করে নিতে না পারলে এই বিদেশী ভাবের জঙ্গলের মধ্যে থেকে সাহিত্যের উদ্যান গড়ে তুলতে পারব না। এই পরখ করবার কাজটি সম্ভবত বিলেতফেরতেরাই ভালো করতে পারবেন।

    তবে সাহিত্যসমাজে প্রবেশ করতে এরা সহজে স্বীকৃত হবেন না। লিখতে অনুরোধ করবামাত্র এরা উত্তর করবেন যে, আমরা বাংলা লিখতে জানি নে। কিন্তু ওকথা শুনে পিছপাও হলে চলবে না। সেকেলে বিলেতফেরতেরা বলতেন যে, তাঁরা বাংলা বলতে পারেন না। অথচ সে বিনয় কিংবা সে স্পর্ধা যে সত্য নয়, তার প্রমাণ আজ বিলেতফেরতের মুখে-মুখে পাওয়া যায়। হতে পারে যে, বাংলা লিখতে পারি নে–একথা বলায় প্রমাণ হয় যে, বক্তা ইংরেজি লিখতে পারেন। অথচ এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, যে লেখা সাহিত্য বলে গণ্য হতে পারে, সে ইংরেজি কোনো দেশী লোক লিখতে পারেন না। যাঁরা আদালতে এবং সভাসমিতিতে ইংরেজিভাষায় ওকালতি এবং ‘কলাবতী’ করেন, তাঁরা যে ওভাষায় শুধু পড়া মুখস্থ দেন তা শ্রোতামাত্রেই বুঝতে পারে। আমরা আইন সম্বন্ধে এবং রাজনীতি সম্বন্ধে ইংরেজরাজপুরুষের কাছে নিত্য পরীক্ষা দিতে বাধ্য, সুতরাং ও-ই ক্ষেত্রে মুখস্থবিদ্যা যার যত বেশি সে তত বড়-বড় প্রাইজ পায়; কিন্তু তার থেকে এ প্রমাণ হয় না যে, ঐ প্রাইজের দৌলতে তাঁরা ইংরেজিসাহিত্যসমাজে প্রোমোশন পান। সুতরাং সাহিত্যবস্তু যে কি, তা যিনি জানেন তাঁকে ইংরেজি ত্যাগ করে বাংলা লেখাতে প্রবত্ত করতে কিঞ্চিৎ সাধ্য-সাধনার আবশ্যক হবে। বিলেতি বট ত্যাগ করলে বঙ্গসন্তান যে স্বদেশের সাহিত্যক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারেন, সেবিষয়ে আমার সন্দেহ নেই; তবে বট ছেড়ে যদি পণ্ডিতি-খড়ম পরে বেড়াতে হয়, তাহলে অবশ্য আরও বিপদের কথা হবে। কিন্তু বঙ্গসরস্বতীর মন্দিরে খোলাপায়ে প্রবেশ করাটাই যে কর্তব্য এবং শোভন, সুশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেরই সেটি বোঝা উচিত। অবশ্য পণ্ডিতি-খড়মের প্রধান গুণ এই যে, তা যত বেশি খটখটায়মান হবে, লোকে তত ‘সাধু, সাধু’ বলবে। কিন্তু এটি মনে রাখা উচিত যে, আশৈশব ওবস্তুর ব্যবহারে অভ্যস্ত না হলে খড়মধারীদের পদে-পদে হোঁচট খাওয়া অনিবার্য।

    বিলেতফেরতকে লেখক তৈরি করার প্রধান বাধা হচ্ছে যে, তাঁরা অধিকাংশই আইনব্যবসায়ী। উকিল ও কোকিল হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণীর জীব, যদিচ উভয়েই বাচাল। এর এককে দিয়ে অপরের কাজ করানো যায় না। তবে কথা হচ্ছে এই যে, যে লঙ্কায় যায় সেই যেমন রাক্ষস হয়ে ওঠে, তেমনি যে আদালতে যায় সেই যে রাসবিহারী হয়, তা নয়। সকলেই জানেন যে, এদেশের কত বিদ্যাবুদ্ধি আদালতের মাঠে মারা যাচ্ছে। তার কারণ, ও শুষ্ক এবং কঠিন ক্ষেত্রের রস আত্মসাৎ করা দুরে থাকুক, অনেকের মন তাতে শিকড়ও গাড়তে পারে না। এ অবস্থায় যে অনেকে আদালতের মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন, তার কারণ ও-স্থান ত্যাগ করলে হাঁসপাতালে যাওয়া ছাড়া এদেশে স্বাধীন ব্যবসায়ীর আর গত্যন্তর নেই। তাই নিত্যই দেখতে পাওয়া যায়, বহু বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোক এক ফোঁটা জল না খেয়ে দিনের পর দিন ন্যৰ্জশিরে কুঞ্জপঠে অগাধ আইনের পুস্তকের ভার বহন করে আদালতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সে গরেভারে পঠদণ্ড ভঙ্গ হলেও যে তাঁরা পষ্ঠভঙ্গ দেন না, তার আর-একটি কারণ এই যে, এই মরুভূমিতে তাঁরা নিত্য রজতমায়ার মরীচিকা দেখেন। সুতরাং এই আইনের দেশ একবারে ত্যাগ করতে কেউ রাজি হবেন না; তবে মধ্যমধ্যে সবুজপত্রের ওয়েসিসে এসে বিশ্রামলাভ করতে এদের আপত্তি না-ও হতে পারে। আপনি শুধু এইটুকু সতর্ক থাকবেন যে, এমন লোক আপনার বেছে নেওয়া চাই যার মন ইংরেজের আইনের নজিরবন্দী হয় নি।

    আমার শেষকথা এই যে, যেন-তেন-প্রকারেণ আপনার নিজের দলের লোককে, আর-কোনো কারণে না হোক— আত্মরক্ষার জন্যও, আপনাকে লেখক তৈরি করে নিতে হবে; কারণ তাঁরা যদি লেখক না হন, তাহলে তাঁরা সব সমালোচক হয়ে উঠবেন। ইতি।

    শ্রাবণ ১৩২১

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article সনেট-পঞ্চাশৎ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    চার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী

    September 22, 2025
    প্রমথ চৌধুরী

    সনেট-পঞ্চাশৎ – প্রমথ চৌধুরী

    September 22, 2025
    প্রমথ চৌধুরী

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    প্রমথ চৌধুরী

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.