Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বুকের ভিতর আগুন – জাহানারা ইমাম

    জাহানারা ইমাম এক পাতা গল্প58 Mins Read0

    অন্তিম সুর

    মোহন চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে ছিল। শান্টু পা টিপেটিপে ঘরে ঢুকল। একটুও শব্দ হয়নি, তবু মোহনের চোখ খুলে গেল, ডানহাত আপনাআপনিই উঠে গেল সিথানে। সেখানে রাখা আছে চকচকে এক চাইনিজ স্টেনগান। শান্টু হেসে ফেলল, ‘উরেব্বাপরে। হুঁশিয়ার বটে তুমি! তোমাকে অ্যামবুশ করে এমন বাপের ব্যাটা কেউ নেই।’

    ‘নেই কে বলল? এই-যে বাপের ব্যাটারা আমার পা দুটো অ্যামবুশ করে বসে আছে।’ মোহনের পরিহাস-তরল কণ্ঠস্বরে শান্টু খুব স্বস্তি অনুভব করল। একটু নিচু হয়ে মোহনের পায়ের পাতা দুটো দেখে বলল, ‘নাহ্, অ্যামবুশ করতে পারেনি। সময় থাকতে তোমায় উঠিয়ে আনতে পেরেছি। আর ক’দিন দেরি হলেই সেপটিক হয়ে যেত। চাচার ওষুধ এক্কেবারে ধ্বন্বন্তরি। ভালো না হয়ে যায়ই না।’

    ‘তা হবে। হাজা আর কাটা ব্যাটা বাপ-বাপ করে পালাতে দিশে পাচ্ছে না।’ বলেই মোহন হি হি করে হেসে দিল।

    স্বস্তির সঙ্গেসঙ্গে শান্টু অবাকও হচ্ছিল মনে-মনে। গত তিনমাসে কোনোদিন মোহন এতটা সহজ হাসিমুখে এইধরনের হালকা কথাবার্তা বলেছে বলে তার মনে পড়ে না। সেটা কি মহিতলার সফল অপারেশানের জন্য? নাকি সোলেমান মিয়ার বাড়িতে এমন আদর-যত্ন, ওষুধ-পথ্য সহকারে বিশ্রাম পাবার ফলে?

    মহিতলার অপারেশানটা সত্যিই খুব বিপজ্জনক ছিল। একে তো পায়ের তলায় হাজা হয়ে কিছুদিন থেকে সবাই বেশ কষ্ট পাচ্ছিল। ওদের প্রায় সবারই জুতো ছিঁড়ে গেছে। খালি পায়ে জলে-কাদায় পায়ের অবস্থা সত্যি করুণ। আর এ-বছর বর্ষাটাও জাঁকিয়ে বসেছে বটে! এত বৃষ্টিতে খানসেনারা অবশ্য বেশ বিপাকে পড়েছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদেরও কষ্ট কম নয। লতিফ বলেছিল, ‘দু-একটা দিন পা শুকনো রাখতে না-পারলে হাজা শুকোবে না। চল সবাই চাচার বাড়িতে ক’টা দিন থেকে আসি, চাচার কাছে খুব ভালো হাজার ওষুধ থাকে। পায়ের তলায় লাগিয়ে কয়েকটা দিন শুকনো রাখতে পারলেই একদম সেরে যাবে।’ মোহন রাজি হয়নি। তখনো মহিলার অপারেশানটা হয়নি। পাকসেনা মেরে একটা স্টেন কিংবা লাইটমেশিনগান ছিনিয়ে নেবার জন্য সে অধীর উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সেই উদ্দেশ্যে তার অপারেশানগুলি ও ক্রমাগত বেশি বিপদজ্জনক হয়ে উঠছিল। কমান্ডার রফিকের কাছ থেকে সে কথা আদায় করেছিল, অপারেশানে একটা স্টেন বা এলএমজি যদি সে ছিনিয়ে নিতে পারে, তবে সেটা তাকেই ব্যবহার করতে দিতে হবে। রফিক রাজি হয়েছিল। মহিতলার অপারেশানে একটা চাইনিজ স্টেনগান মোহনের হাতে এল বটে, কিন্তু ঐসঙ্গে তার পা-ও কেটে গেল মজা-পুকুরের পাঁকে কাচের টুকরো না শামুকের ভাঙা কানা—কিসে যেন তাও মোহন গা করেনি, পায়ের কাদা ধুয়ে একটা পুরনো কাপড়ের ফালি দিয়ে বেঁধে রেখে আরো অপারেশনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নতুন পাওয়া স্টেনগান দিয়ে শত্রুহননের উন্মাদনায় সে যেন মেতে গিয়েছিল। লতিফের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সে সোলেমান মিয়ার বাড়িতে যাবার নামও কানে তোলেনি। কিন্তু পা পেকে গিয়ে যখন প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল মোহন, তখন শান্টু নিজের হাতে নেতৃত্ব তুলে নিয়ে নির্দেশ দিল—’চলো রতনপুর।’

    বেহুঁশ মোহনকে কাঁধে বহন করে লতিফ, রকিব, শান্টুরা সবাই রতনপুরে চলে এল সোলেমান মিয়ার বাড়িতে। সেও আজ চার-পাঁচ দিন হয়ে গেল। এখন মোহন ভালোর দিকে।

    শান্টু বলল, ‘খুব বাঁচা বেঁচে গেছ ভাই। জোর বরাত আমাদের। তোমার কিছু হলে আমরা কোথায় যে ভেসে যেতাম।’ বলতে শান্টুর গলা ধরে এল, চোখ ছলছল। শান্টুর মমতার এই প্রকাশে মোহন ভেতরে-ভেতরে খুব বিহ্বল হয়ে পড়ে কিন্তু বাইরে সেটা বুঝতে দেয় না। কথা ঘুরিয়ে বলে, ‘তোমাদের পায়ে হাজার কী অবস্থা? শুকিয়েছে?’

    ‘হ্যাঁ শুকিয়েছে।’

    ‘লতিফ, রকিব, শিবেন ওরা সব কোথায়? দেখি না যে?’

    শান্টু হঠাৎ জবাব দিতে পারল না, মনে মনে বলল, ক’দিন যে আমরা সবাই তোমার ঘরেই থাকতাম সারাদিন সারারাত। তুমি তো দেখনি, জ্বরে বেহুঁশ ছিলে। আজ তোমাকে ভালো দেখে ওরা ক’দিনের ঘুম পুষিয়ে নিতে গেছে।

    মোহন বলল, ‘কি, চুপ করে আছ যে? জ্বরের ঘোরে তোমাদের সবার মুখ দেখতাম আমার চারপাশে, যেই একটু ভালো হয়েছি অমনি হাওয়া?’

    শান্টু হো হো করে হেসে উঠল, ‘সবই জানো দেখছি। তাহলে আর জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমাকে নিয়ে ক’দিন কারো ঘুম ছিল না। কাল থেকে তোমার বিপদ কেটে গেছে, কাল থেকে তারা ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে।’

    আবার মোহনের মনটা দুলে উঠল, এবার সে মুখে সেটা প্রকাশ করল, ‘সত্যি শান্টু, তোমরা যা করেছ আমার জন্য—’

    শান্টু বাধা দিল— ‘ছি নান্টু, আমরা যে তোমার ভাই, দুঃখের দিনের দরদী—’

    মোহন হেসে ফেলল, ‘এইতো বেশ কবিতার ছন্দে কথা বেরিয়ে আসছে।’

    শান্টু হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেল। মনে পড়ে গেল কয়েকমাস আগের কথা।

    সে আগে লুকিয়ে লুকিয়ে একটু-আধটু গান লিখত।

    বাড়ি থেকে আসার সময় তার দু-চারটে জামা-কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে গান লেখার খাতাটাও লুকিয়ে সঙ্গে নিয়েছিল। একদিন হঠাৎ মোহনের চোখে পড়ে যায় খাতাটা। ব্যাস্, শান্টুর লজ্জা দেখে কে। যেন সহযোদ্ধা কারো জিনিস চুরি করে লুকিয়ে রেখেছিল, সেইটে ধরা পড়ে গেছে। মোহন মুচকি হেসে বলেছিল— ‘আরে অত লজ্জা পাবার কী আছে? তুমিতো দেখছি উদীয়মান গীতিকার। এটা তো খুব ভালো কথা ভেতরে কবিতা, গান, ছন্দ এসব থাকলে ভালো যুদ্ধ করা যায়।’

    শান্টু তার স্বভাবসিদ্ধ হাঁ-ক্ করে শব্দ টেনে বলে উঠেছিল, ‘এ আবার কী আজব কথা। যুদ্ধ আর গান হল গিয়ে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস। যুদ্ধ তো ধ্বংস করে দেয় গান, কবিতা—এসব।

    ‘না দেয় না। আমাদের এই যুদ্ধ তো মানুষ মারার বা দেশ ধ্বংস করার যুদ্ধ নয়। এ হল আমাদের বাঁচার যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রেরণা দেয় কবিতা, উদ্বুদ্ধ করে গান। জানো, রাজশাহী থাকতে আমি স্কুল-ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলাম? আমিও ছড়া, গান এসব লিখতাম?’

    শুনে সেদিন শান্টু খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে উঠেছিল, ‘ইস্! কত যে তোমার গুণ, একে-একে বেরোচ্ছে। ডিবেটিং চ্যাম্পিয়ন, ম্যাগাজিন-সম্পাদক; এখন আবার ছড়া-কবি। এদিকে এই কয়মাসে তো ক্র্যাকশুটার গেরিলা হয়ে গেছ।’

    সেদিনের কথা মনে পড়ে শান্টুর মুখে একটুকরো হাসি ফুটে ওঠে। লজ্জা কাটিয়ে বলে ওঠে, ‘উদীয়মান গীতিকার যখন, তখন তো কবিতার ছন্দে কথা বোরোবেই। দেখেছ তো এত ডামাডোলের মধ্যেও ফাঁক পেলেই আমি দু-চারটে গান লিখে ফেলি। তোমাকে কিন্তু এরমধ্যে একদিনও ছড়া বা গান লিখতে দেখিনি। কেন লেখ না?’

    মোহন সিথানে হাত বাড়িয়ে স্টেনগানটা টেনে এনে বুকের ওপর রাখল। চকচকে যন্ত্রটার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু হেসে বলল, ‘লিখি তো। এখন আমি এইটে দিয়ে গান লিখি। মৃত্যুর আখরে লিখি জীবনের গান।

    দরজার কাছে কার ছায়া পড়ল। হাতে একটা গেলাস ধরে ফুলী ঘরে ঢুকল। ধীরপায়ে মোহনের চৌকির পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদুস্বরে বলল, ‘ভাইজান, দুধটুকু খেয়ে নিন।’

    মোহন মেশিনগান পাশে রেখে উঠে বসল। তার তীব্র জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত কোমলতায় নরম হয়ে এল, হাত বাড়িয়ে গেলাসটা নিয়ে বলল, ‘ক্যাম্পে থাকার সময় এই জিনিসটা খুব মিস্ করি। ছোটবেলা থেকে … বুঝলে … আমি হলাম গিয়ে দুধের ভক্ত।’

    শান্টু নাক কুঁচকে বলল, ‘উরেব্বাসরে। দুধ দেখলে আমার বমি আসে।’

    ফুলী হেসে ফেলল, ‘নান্টু ভাইজান দুধ খায় বলেই তো তার মাথা এমন সাফ। গায়েও কেমন জোর।’

    শান্টু হাতের বাইসেপ ফুলিয়ে বলল, ‘কেন, আমার গায়ে কি কম জোর? আসুক দেখি নান্টু আমার সঙ্গে কুস্তি লড়তে, এক প্যাচেই ফেলে দেব না!’

    সবাই হেসে উঠল।

    মোহন দুধ খাওয়া শেষ করে গেলাসটা ফুলীর হাতে ফিরিয়ে দিল। তারপর বিছানা ছেড়ে মেঝেয় নেমে দাঁড়াল। হাত দুটো মাথার ওপরে তুলে শরীর টান করে ঘাড় লম্বা করে আড়মোড়া ভাঙল। শান্টুর মনে হল এই কয়মাসে মোহন যেন আরো লম্বা হয়েছে। গোঁফ-দাঁড়ি-জুলপির জন্য মুখের রোগাভাব টের পাওয়া যায় না। কে বলবে এই ছেলের বযস ষোল পেরিয়ে মাত্র কয়মাস। গম্ভীর মুখে টেপা ঠোঁট আর জ্বলজ্বলে চোখে তীব্র দৃষ্টি তাকে এমন এক ব্যক্তিত্ব দিয়েছে যে তার সামনে দাঁড়াতেই যেন বুক কেঁপে ওঠে।

    ফুলীর ছোটবোন বকুল দৌড়োতে দৌড়োতে ঘরে ঢুকে একনিশ্বাসে বলে উঠল, ‘নান্টু ভাইজান শুনেছেন? শুনেছেন? কুসুমপুরে নাকি মিলিটারি-ক্যাম্প বসেছে?’

    বকুলের বয়স দশ। চারবোনের মধ্যে সেই সবচেয়ে চঞ্চল। সারা পাড়া টোটো করে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ির সবাই তাকে গেজেট বলে। সারা গ্রামের খবর তার নখদর্পণে।

    মোহনের চোখের দৃষ্টি আবার তীব্র হয়ে উঠল। ক্ষণপূর্বে যে কোমল আভা তার মুখে খেলা করছিল, তা এখন সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। সে প্রায় অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কার কাছে শুনলে?’

    ‘কফিলদ্দি গরু চরাতে গেছিল উই নাকডুবির মাঠে। পাশের গ্রামের রাখালও গরু নিয়ে এসেছিল, তার মুখে শুনেছে।’

    মোহনের হঠাৎ চোখ পড়ল ফুলীর দিকে। দেখল তার মুখ কেমন ভয়ার্ত, বিবর্ণ দেখাচ্ছে। তার বয়স পনের। তার বোঝবার বয়স হয়েছে পাশের থানায় মিলিটারি-ক্যাম্প করলে কী কী ভয়ের কারণ ঘটতে পারে।

    সোলেমান মিয়া কোথায় যেন গিয়েছিলেন, বাড়ি ফিরে সোজা মোহনের ঘরে ঢুকে বললেন, ‘বড় বিপদের আলামত দেখি যে নান্টু মিয়া। শুনে এলাম কুসুমপুরের কলেজ-বিল্ডিঙে মিলিটারিরা ক্যাম্প বসিয়েছে।’

    মোহন জিজ্ঞেস করল, ‘কুসুমপুর কতদূর এখান থেকে? ক্যাম্প বসার খবরটা কি খাঁটি?’

    ‘একেবারে খাঁটি খবর। কুসুমপুর এখান থেকে মাত্র চারমাইল। ওইখানে ঘাঁটি করল, কী যে মতলব ওদের, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একবার তো এ-গ্রামের উত্তরপাড়ায় আগুন দিয়েছিল, সেই তিন-চার মাস আগে। তখন মামাতো ভাইয়ের গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলাম। এখনতো সে গ্রামও পোড়া। সে-বাড়ির সবাই ভেগেছে কোথায়। এখন এই চার-চারটে মেয়ে নিয়ে আবার কোথায় পালাব বলো তো?’

    মোহনের বুকের মধ্যে কী-যেন উথাল-পাথাল করে ওঠে, কিন্তু ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটাও কথা বের হয় না। কেবল স্টেনগানটার ওপর তার ডানহাতের আঙুলগুলো চেপে বসে। সে শান্টুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রাতে ভাত খাবার পর মিটিং।’

    .

    রাতে সবাই গোল হয়ে ঘিরে বসেছে মোহনকে। কাজের সময়, বিপদের সময় মোহনের কণ্ঠস্বর আরো নেমে যায়। তাই ঠিকমতো শোনার জন্য সবাই ঘেঁধে বসে। সোলেমান মিয়া ছেলেদের পাশেই বসেছেন। রহিমা বিবি আর মেয়েরাও উপস্থিত আছে ঘরে। তবে তারা বসেছে একটু দূরে। মোহন বলল, ‘শান্টু, কাল সকালে তুমি আর রকিব দুজনে ডিম আর কলা বেচতে যাবে কুসুমপুরে ওদের ক্যাম্পে। সব দেখে বুঝে আসবে। চাচা কাল সকালের মধ্যে একঝুড়ি কলা আর ডিম জোগাড় করা যাবে?’

    ‘কলা আমার বাগানেই তো এককাঁদি পাকনা ধরেছে। ডিম মনে হয় কম আছে, কিছু কিনে আনা শক্ত হবে না। তবে ওর সঙ্গে কয়েকটা মোরগ-মুরগি ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারলে আরো ভালো হবে।

    রহিমা বিবি বললেন, ‘গোটা ছয়েক মোরগ-মুরগি বাড়ি থেকেই দেওয়া যাবে।’

    বকুল লাফিয়ে উঠল, ‘বাড়ির মুরগি দেবেন?’ তার কণ্ঠস্বরে পরিষ্কার প্রতিবাদ। বেলী বলে উঠল, ‘বেঁচে থাকলে কত মুরগি খাবি।’

    বকুল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আর কদিন পরেই দুটো মুরগি ডিম দেবে।’

    মোহন বকুলকে কাছে ডাকল। সে এলে মোহন তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল, ‘তুমি যাতে ভবিষ্যতে অনেক মুরগি পালতে পার, অনেক ডিম খেতে পার, তার জন্যই এখন তোমার মুরগিগুলো দরকার।’

    বকুলের চোখ ছলছল করছে, মোহনের কথা সে না-বুঝলেও ঘাড় কাত করে সায় দিল। সে অন্তত এটুকু বোঝে মোহন যে-সে লোক নয়, তাকে এতগুলো ছেলে মানে, তার বাপ-মা-বোনেরা মানে। মিলিটারিরা খামোকা এদেশের লোকজন মেরে ঘরবাড়ি জ্বলিয়ে দিচ্ছে, সেই মিলিটারিদের জব্দ করার জন্য নান্টু ভাইজান আর এই ছেলেগুলো প্রাণপাত করছে। কিন্তু তারজন্য তার শখের মুরগিগুলো দিতে হবে কেন? তবে নান্টু ভাইজান যখন চেয়েছেন, তখন তো দিতেই হবে।

    বকুলের চোখের কোণ থেকে টলটলে পানির ফোঁটা আঙুলের মৃদু টোকায় ঝরিয়ে মোহন বলল, ‘এইতো লক্ষ্ণী মেয়ের মতো কথা। ওই খানসেনাগুলোকে কুসুমপুর থেকে হটাতে হবে, বুঝেছ? তা না হলে আবার তারা এ গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে। তিন-চারমাস আগে একবার আগুন দিয়েছিল না? তোমাদের সবাইকে পালাতে হয়েছিল, তাই না? এবার হয়তো পালাবারও সুযোগ পাবে না, হয়তো মেরেই ফেলবে। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন পালাতে পারেনি, খানসেনারা বাড়িতে ঢুকে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে তাদের সবাইকে মেরে ফেলে। যাও, মায়ের কোলে গিয়ে বসো। কাল থেকে আর বাইরে যেয়ো না। কাউকে বলবে না এসব কথা। কেমন?’

    বকুল ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে মায়ের কাছে চলে গেল। তার মা তাকে কোলের মধ্যে টেনে নিলেন। মোহন সেদিকে তাকাতেই দেখল—বেলী, ফুলী, হেনা কেমন ভয়ভয় মুখে তার দিকেই চেয়ে আছে। মোহন চোখ ফিরিয়ে নিল। ব্রাশফায়ারের তোড়ে তার বোনের গায়ে গুলি লেগেছিল বলেই সে মরে বেঁচে গিয়েছিল। এই মেয়েগুলোর গুলি খেয়ে মরে বাঁচবার সেই ভাগ্য নাও হতে পারে। সে-কথা বোঝবার বয়স তিনবোনের হয়েছে। তাই ওদের মুখে ভয়ের ছায়া। মোহন মনে মনে বলল, ‘বোনেরা, ভয় পেয়ো না। আমার জীবন দিয়ে হলেও তোমাদের ইজ্জত বাঁচাব।’

    .

    পরদিন সকালে শান্টু আর রকিব গরিব ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশ ধারণ করল। প্রথমে গায়েমুখে হাতেপায়ে কিছুটা ধুলো ঘষে ফের সেগুলো ঝেড়েমুছে পুরনো ময়লা লুঙি আর আধাছেঁড়া গেঞ্জি পরল। ঝুড়িতে ডিম, মুরগি, কলা নিয়ে চলল কুসুমপুরে খানসেনাদের ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।

    সোলেমান মিয়া বললেন, ‘নান্টুমিয়া একটা কথা বলি। শুধু এই মিলিটারিদের মারলে কোনো ফায়দা হবে না। পরদিনই কুমিল্লা থেকে আরো মিলিটারি এসে আশেপাশের গ্রাম জ্বালাবে, লোক মারবে। ওরা যে-পথ দিয়ে আসে, সেই পথে যে ব্রিজটা আছে, সেটা যদি ভেঙে দেওয়া যেত, তাহলে ওরা এদিক পানে আর আসতে পারত না।’

    মোহন, ‘খুব ভালো বুদ্ধি দিয়েছেন চাচা’ বলে অনেকক্ষণ বসে-বসে ভাবল। কুমিল্লা থেকে কুসুমপুর আসার যে-পথ, সেই পথের ধারেই, একটু ভেতর দিকে পড়ে পীরগঞ্জ। ব্রিজটা যে-জায়গায়, সেখান থেকে পীরগঞ্জ একমাইল মতো হবে। কমান্ডার রফিকের পক্ষে ব্রিজটা ভাঙার পরিকল্পনা নেওয়া কঠিন কাজ হবে না। যদি একই রাতে কমান্ডার রফিকরা ভাটিখোলার ব্রিজ আর মোহনরা কুসুমপুরের ক্যাম্প ওড়ায়, তাহলে আপাতত সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচা যায়। সে রডারিক আর আবদুল্লাকে পুরো ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমরা এক্ষুনি পীরগঞ্জে রওনা হয়ে যাও। কমান্ডারের সাথে পরামর্শ করে, পারলে আজ রাতেই ফিরে আসবে।’

    এখন বেলা প্রায় এগারোটা। সোলেমান মিয়া বললেন, ‘চারটি ভাত পেটে দিয়ে যাও।’ তাঁর বাড়িতে সারাদিনই ভাত-তরকারি মজুত থাকে। ভোরে উঠেই একদফা ভাত, ডাল, লাবড়া রান্না হয়। বাসার মুনিষরা তাই দিয়ে ‘নাশতা’ খেয়ে ক্ষেতে যায়। দুপুরের জন্য মাছ বা গোশতও রান্না শেষ হয়ে যায় বারোটার মধ্যে। আরেক ডেকচি গরম ভাতও নামে এই সময়ের মধ্যেই। রডারিক আর আবদুল্লা লাবড়া দিয়ে ভোরের রান্না ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে ঝুড়ি আর কোদাল হাতে নিয়ে কামলার বেশে বেরিয়ে পড়ল পীরগঞ্জের পথে। এখান থেকে পীরগঞ্জ প্রায় পাঁচমাইল। ওরা দেড়ঘণ্টার মধ্যে পৌছে যাবে। কমান্ডার রফিক যদি আস্তানাতে থাকেন, তাহলে তাঁর সাথে পরামর্শ করে আজ রাতেই ওরা ফিরতে পারবে। আর যদি তিনি অপারেশনে বেরিয়ে যান, তাহলে ওদের রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ফেরত আসতে আসতে আগামীকাল হয়ে যাবে।

    .

    একটু ক্লান্ত লাগছিল। মোহন বিছানার ওপর কাত হল। কিন্তু বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারল না। সারা শরীর চনমন করছে। তার শরীর এখনো বেশ দুর্বল। কিন্তু বুকের ভেতরে যেন এক খ্যাপা ষাঁড় ঢু মারছে। মনে হচ্ছে স্টেনগানটা নিয়ে এখনি ছুটে বেরিয়ে যায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর, ট্রা-রা-রা-রা করে ব্রাশফায়ারে মাটিতে লুটিয়ে দেয় ঐ রক্তখেকোদের শরীরগুলো; যেমন করে ওরা লুটিয়ে দিয়েছিল তার নিরপরাধ, সরলবিশ্বাসী, অসতর্ক বাবা-মা, ভাই-বোনদের শরীরগুলো।

    মোহন খুব স্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে রইল, কিন্তু সেটা বাইরে। তার মনে হতে লাগল, তার বুকের ভেতরে এমনই ধড়াশ-ধড়াশ শব্দ উঠছে যে, তার চোটে তার শরীরটা জবাই-করা মোরগের মতো তড়পাচ্ছে। ক্রমে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, যন্ত্রণায় মুখের রং বদলে ফ্যাকাশে হতে লাগল। যে-মুহূর্তে মনে হল তার কণ্ঠনালী একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে, এখনি দমটা হৃদপিণ্ডের ভেতরে ফুস্ করে নিভে যাবে, সেই মুহূর্তে সে ‘মাগো’ বলে বুকফাটা চিৎকার দিয়ে একঝটকায় বিছানার ওপর উঠে বসল। এমনই তীব্র সে চিৎকার, সারাবাড়ির আনাচ-কানাচ যেন কেঁপে উঠল সেই চিৎকারে। কিন্তু বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। সোলেমান মিয়া রডারিকদের সঙ্গে বেরিয়ে গেছেন একটু এগিয়ে দেবার জন্য। রহিমা বিবি, ফুলী, হেনা, বকুলকে নিয়ে পেছনের সবজি-ক্ষেতে গেছেন সবজি তুলতে। ছিল শুধু বেলী। ‘কী হল, কী হল ‘ বলতে বলতে ছুটে এল সে। দেখে বিছানার ওপর বসে মোহন থরথর করে কাঁপছে। তার দুইচোখের তীব্রদৃষ্টি যেন কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে রয়েছে। যেন সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বেলী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, ‘কী হয়েছে নান্টু ভাই? শরীর খারাপ করছে? কোথাও ব্যথা?’

    মোহন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল। মাথা নেড়ে বলল ‘না, না, কিছুই হয়নি।’

    ‘হয়নি তো অমন জোরে মাগো বলে চিৎকার দিয়ে উঠলে কেন? তুমি লুকোচ্ছ আমাকে। বলো ভাই—’

    বেলী দু-পা এগিয়ে এল। মোহন আরো জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘সত্যি কিছু হয়নি আপু। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, স্বপ্ন দেখে বোধ হয়—’ সে উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজল। বেলী খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল। মোহনের দুইচোখ থেকে পানি পড়ে বালিশ ভিজতে রাগল, সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে মনে মনে বারবার করে বলতে লাগল, ‘আপু গো … আমার জান থাকতে তোমাদের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না… মা, মাগো … আমার জান থাকতে নয, আমার জান থাকতে নয়—’

    .

    কুসুমপুর ইন্টারমিডিয়েট কলেজের একতলা বিল্ডিংটা দেখতে লম্বা ব্যারাকের মতো। ঘরগুলো পরপর বসানো। সামনে খেলার মাঠ। দুপাশে দুটো গোলপোস্টও দেখা যায়।

    একতলা কলেজের ছাদে বেশকিছু রড বেরিয়ে আছে। কলেজটা দোতলা হবার প্ল্যান ছিল নিশ্চয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বা অন্য যে-কারণেই হোক, দোতলাটা আর হয়নি। পেছনে বেশকিছু গাছগাছালি। বেশির ভাগই ফলের। শান্টু আর রকিব ঝুড়িতে সওদাপাতি নিয়ে খেলার মাঠের সামনে পর্যন্ত গিয়ে আর এগোল না। ওইখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ওদের মাথায় ঝুড়িতে মোরগ, কলা

    এসব নিশ্চয় খানসেনাদের চোখে পড়বে, তারা নিশ্চয় ওদের ডাকবে। কাজ কি বাবা আগেভাগে গিয়ে! যদি গুলি করে বসে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ওরা ওইখানেই মাথার ঝুড়ি নামিয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসল। আর লক্ষ করতে লাগল মিলিটারিগুলোর গতিবিধি।

    বিল্ডিঙের বারান্দায় দাঁড়ানো, রাইফেল হাতে একজন খানসেনা হাত উঠিয়ে ওদের ডাকল। ওরা যেন খুবই ভয় পেয়েছে, এমনি ভাব দেখিয়ে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগল। ওদের এই ধীরগতিতে অধৈর্য হয়ে সৈনিকটা হঠাৎ চেঁচিয়ে ধমক দিয়ে উঠল; ওরা ভাষাটা বুঝল না, তবে মনে হল ‘জলদি উঠে আয় বেটা’ এইধরনের কোনো কথা হবে নিশ্চয়। ওরা তখন হুটোপোটি করে বারান্দায় উঠে সেন্ট্রিটার সামনে দিয়ে মেঝেতে ঝুড়ি রেখে প্রায় কুরনিশ করার মতো ঝুঁকে সালাম ঠুকল। লোকটা হেঁট হয়ে ঝুড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে কী যেন বলল। ওরা ভাষা না-বুঝলেও ঘন ঘন মাথা নেড়ে খুব সমঝদারের ভাব দেখিয়ে বলতে লাগল, ‘নিয়ে যান হুজুর, খুব সস্তা, আপনাদের জন্যই এনেছি।’ আর হাত দিয়ে ঝুড়িসুদ্ধ ভেতরে দিয়ে আসার ভঙ্গি করল। লোকটা কঠোর-স্বরে কিছু বলে মাথা আর তর্জনী নাড়ল, তার মানে— ‘খবরদার এক পা-ও এগোবি না’ বলে মনে হল। ওরা সঙ্গেসঙ্গে চুপসে বসে পড়ল। সৈনিকটা পেছনে তাকিয়ে কাকে যেন ডাকল, ঘরের ভেতর থেকে এক শ্যামবর্ণ বাঙালি-নন্দন বেরিয়ে এল। ওদের দেখে তার ভ্রু কুঁচকে গেল। ‘তোরা কোন্ গ্রামের লোক?’ তার এই প্রশ্নের জবাবে রকিব বলল, ‘আমরা বহুদূর থেকে জিনিস ফেরি করতে এসেছি। উ-ই মল্লিকপুরের লোক আমরা। গাঁয়ের লোক কেনেন। তারা নিজেরাই ফলায় এসব। আপনারা যদি কেনেন, তো চাল কিনে বাড়ি ফিরে যাই।’

    ‘কত দাম চাস্?’

    ‘যা দেবেন দয়া করে। পেট ভরার মতো চাল কিনতে পারলেই বেঁচে যাই।’

    ‘বোস্। দেখি লেফটেন্যান্ট সাহেবেরে বলে।’ সে ভেতরে চলে গেল। শান্টু আর রকিব পরস্পরের দিকে একবার তাকায়। তাদের ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি ফুটে ওঠে। লেফটেন্যান্ট সাঁহেব। তার মানে সেকেন্ড লেফটেনান্ট। তার অর্থ, তার অধীনে একপ্লাটুনের বেশি সৈন্য নেই এখন। একপ্লাটুন মানে তেত্রিশজন আর তার সঙ্গে এইরকম গোটাকতক বাঙালি রাজাকার।

    খানিক পরে দুজন রাজাকার এসে ঝুড়ি দুটো তুলে নিয়ে গেল। তারপর কত সময় যায়, কেউ আর আসে না দাম নিয়ে। ওরা এই অবসরে জুলজুল নয়নে চেয়েচেয়ে, সব দেখেশুনে নিচ্ছে। তারপর একসময় মনে হল দাম নিয়ে কেউ আর আসবে না আজ। সেন্ট্রিটা রাইফেল-হাতে লম্বা বারান্দার এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত হেঁটে বেড়াচ্ছে। শান্টু, রকিব তাকিয়ে দেখল পরপর মোট পাঁচটা ঘর। মাঝের দরজাটা ছাড়া দুপাশের দুটো-দুটো চারটে দরজাই বন্ধ। জানালাগুলোও। মাঝের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ঘরটাকে ওরা খাবারঘর বানিয়েছে। টেবিলে কিছু বাটি, গেলাস, জগ দেখা যাচ্ছে। একছড়া কলাও রয়েছে। খানিক পরে শান্টু, রকিব ভাবল আর দামের জন্য বসে থেকে লাভ নেই, ওদের যা দেখার দরকার ছিল, সব দেখে নিয়েছে। সেন্ট্রিটা হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছাকাছি আসতেই ওরা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘সেলাম হুজুর, যাই।’ লোকটা রাইফেলসুদ্ধ হাত নাড়িয়ে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল। অর্থাৎ কেটে পড়ো। ওরা মাথা নিচু করে, দুইহাত পেটের কাছে জড়ো করে, খুব ধীরপায়ে হেঁটে চলে এল। নাকডুবির মাঠের মাঝখানে দিয়ে হেঁটে রতনপুরে ঢুকে বাড়ি পৌঁছতে পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা।

    সব শুনে মোহন গম্ভীরভাবে শুধু বলল, ‘হু’। এখন রডারিক আর আবদুল্লার জন্য অপেক্ষা। কিন্তু অপেক্ষা করাটাই যেন মোহনের কাছে এখন সবচেয়ে শক্ত কাজ বলে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে নিজেই উড়ে চলে যায় পীরগঞ্জে। মানুষ কেন পাখির মতো উড়তে পারে না? কেন পারে না চিতাবাঘের মতো একরাতে শতেক মাইল পার হয়ে যেতে?

    রডারিকরা এল পরদিন গভীর রাতে। যা ভাবা গিয়েছিল — কমান্ডার রফিক অপারেশানে গিয়েছিলেন, তাই তাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না। কমান্ডার বলে পাঠিয়েছেন আগামী বুধবার রাতে ওঁরা ব্রিজ ওড়াবার অপারেশানে যাবেন। মোহনরাও যেন ঐ রাত্রেই কুসুমপুরের মিলিটারি-ক্যাম্প আক্রমণ করে। তার আগে নয়। বুধবার আসতে এখনো তিনদিন বাকি। মোহন মুখে কিছু বলল না, কিন্তু তার ভেতরের অধৈর্য আর অস্থিরতা বোঝা গেল দ্রুত হাত ওলটানোর ভঙ্গিতে। শান্টু বলল, ‘কী আর করবে! এই তিনদিন খেয়ে ঘুমিয়ে গায়ে বল করে নাও।’

    ‘বল আমার গায়ে যথেষ্ট আছে। এই তিনদিনে কুসুমপুরের শয়তানগুলো কি-না-জানি করে।’ রফিক বলল, ‘ওরা প্রথম চোটে মাত্র একপ্লাটুন সৈন্য নিয়ে এসেছে, তাতে মনে হয় না এসেই গ্রাম পোড়ানো শুরু করবে। মনে হয় ওরা প্রথমে একদল এসে ঘর-গেরস্থালি গোছাচ্ছে। পরে আরো সৈন্য আসবে। মনে হচ্ছে লম্বা প্ল্যান।’

    ‘সেইটাই তো ভয়। এখন ওখানে সৈন্য আর রাজাকার মিলে চল্লিশের বেশি হবে না। পরে আরো এসে গেলে মুশকিল হবে না?’

    ‘হবে হয়তো, কিন্তু কমান্ডার নান্টু, এখন আমাদের তিনদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।’

    মোহন খানিক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর হঠাৎ উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘এক কাজ করলে হয় না? চল্ আজই আমরা পীরগঞ্জে রওনা দিই।

    শুনে সবাই এতই অবাক হল যে, তিন-চারজনের গলা দিয়ে একসঙ্গে প্রশ্ন বেরোল, ‘পী-র গঞ্জে? হঠাৎ কিজন্য?’

    মোহন বলল, ‘আমরা ওখানে গিয়ে ওদের সঙ্গে প্রথমে ব্রিজ ভাঙব, তারপর ওখান থেকে সোজা কুসুমপুরে চলে এসে খানসেনাদের আক্রমণ করব।’

    সবাই চুপ করে প্রস্তাবটার যৌক্তিকতা ভাবতে থাকল। সোলেমান মিয়া বললেন, ‘নান্টু বেটা, তুমি এখানে বসে থেকে- থেকে খুবই অস্থির হয়ে পড়েছ, বুঝতে পারছি। কিন্তু একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখ। ব্রিজ ভাঙার অ্যাকশনটা সফল না- ও তো হতে পাবে? তখন কিন্তু দু-কূলই যাবে। তারচেয়ে কমান্ডার রফিকের প্ল্যানমতোই কাজ হোক। ‘তিনদিন পরে, একই রাতে তোমরা কুসুমপুরে ক্যাম্প আক্রমণ করো, ওরা ব্রিজ ভাঙুক। ওরা অ্যাকশানে যদি বিফল হয়ও, তোমরা তো এখানে খানসেনাগুলোকে মেরে শেষ করতে পারবে।’

    সোলেমান মিয়ার যুক্তি অকাট্য। মোহন মেনে নিল, কিন্তু তার ভেতরের দাপাদাপিটা থামল না।

    শান্টু, রফিক, শিবেন, রমাপদ— ওরা সবাই সোলেমান মিয়ার দলিজঘরের চওড়া বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। সকলের মুখেই রাগ আর হতাশার ছাপ। বেশ তো দুদিন ধরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। এখন আবার হঠাৎ বৃষ্টি থেমে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল কেন? আর তো ঘণ্টা-দুই পরেই তারা অপারেশানে বেরোবে। এখন বৃষ্টি থামার কোনো মানে হয়?

    রমাপদ খুব গভীরভাবে আকাশ নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, ‘নাহ্, মেঘেরা বেশিদূরে যায়নি। শুধু একটুখানি জিরিয়ে নিচ্ছে। চিন্তা কোরো না, এই বৃষ্টি একেবারে চলে যাবার বৃষ্টি নয়। আবার ঘুরে আসবে নে।’

    আসাদ বলল, ‘হুঃ তোকে বলেছে।’

    ‘তুই জানিস না। পূর্ণিমা-অমাবস্যার সময় অন্তত বলা যায় বৃষ্টি চলবে। একাদশীর থেকে শুরু হয়েছে না? পূর্ণিমা না কাটান পর্যন্ত এ বৃষ্টি চলবে, তুই দেখে নিস্।’

    ভেতরবাড়ি থেকে বকুল বেরিয়ে এসে ওদের ডাকল, ‘ভাইজানরা, খেতে এসো, ভাত বাড়া হয়েছে।’

    ওরা সবাই উঠে ভেতরবাড়িতে গেল। রোজকার মতো বারান্দায় পাটি পেতে খাবার ব্যবস্থা। রহিমা বিবি ছোট মোড়ায় বসে আছেন। বেলী, ফুলী, হেনা পরিবেশনের জন্য তৈরি। আজ বকুল বলল, ‘আমি ভাইজানদের পাতে মাছ দেব।’ বলে সে ভাজা মাছভর্তি গামলা উঠিয়ে সবার পাতে একটা করে মাছ দিয়ে যেতে লাগল। শান্টু হাসতে হাসতে বলল, ‘ভাগ্যিস, তুমি দিলে বকুল। তোমার পয়ে দেখবে আমরা আজ জিতে আসব।’ ফুলী মৃদুস্বরে বলল, ‘জিততেই হবে ভাই। নইলে আমরা কেউ বাঁচব না।’

    মোহন উঁচু গলায় বলে উঠল, ‘আমরা জিতবই। ওদের সবাইকে খতম না-করা পর্যন্ত, আমরা ফিরছি না। আমাদের ভয়টা কী? বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ। দু-দিকেই আমাদের লাভ।’

    বেলী হঠাৎ কেঁপে উঠল। তার স্বামী এখন কোথায় কোন্ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে, সে জানে না। সে জানে না তার স্বামী গাজী হয়ে ফিরে আসবে, না, শহীদ হয়ে সেই মাটিতেই শুয়ে থাকবে।

    সে বিশেষ কারো দিকে না তাকিয়ে মোহনের কথার জবাব দিল, ‘সাহস থাকা ভালো। তবে সাবধান থাকাও দরকার। কথায় বলে সাবধানের মার নেই। ‘

    মৌছন্ হো হো করে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ আপু, আবার মারেরও সাবধান নেই।’ বাকি সবাই-ও তার হাসিতে যোগ দিল।

    রাত দশটার দিকে চাঁদ আবার মেঘে ঢেকে গেল। ভিজে ভিজে হাওয়া দিতে লাগল। আশা হচ্ছে শিগগিরই আবার বৃষ্টি নামবে। শান্টু সুর করে বলতে লাগল, ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেব মেপে।

    রমাপদ বলল, ‘যা চাও, সব দেব। পুকুরের মাছ, গাইয়ের দুধ, সব দেব, না-মেপেই দেব, তবু তুমি এসো।’

    মোহন বলল, ‘এবার তাহলে রওনা দিই।’

    সবাই একে-একে সোলেমান মিয়া ও রহিমা বিবিকে সালাম করল। সোলেমান মিয়া ওদের মাথায় হাত রেখে অস্ফুটে দোয়া পড়লেন, রহিমা বিবি দোয়া পড়ে প্রত্যেকের মাথায় ফুঁ দিলেন। চারটি বোন নীরবে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, ছেলেরা সবাই চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা ফুটল না। সবাই বোধ করি মনে-মনে বলল, ‘যাইগো বোনেরা। জানি না আবার দেখা হবে কিনা।

    এখনো বৃষ্টি আসেনি, কিন্তু চাঁদ মেঘে ঢাকা। ওরা কলেজ-বিল্ডিং থেকে যখন প্রায় সিকি-মাইল দুরে, তখন হঠাৎ মেঘ সরে চাঁদের আলো ফুটে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে ওরা ঝাঁকড়া এক আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেখানে দাঁড়িয়ে কলেজের দিকে তাকাতেই সবার চোখে পড়ল একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিঙের সামনে। শান্টু বলে উঠল, ‘ট্রাক! ট্রাক কখন এল? দুপুরে যখন ওয়াচ করে গেছি, তখনো তো ছিল না!

    মোহন বলল, ‘তারপরে নিশ্চয় এসেছে। ইস্, বিকেলে কেন যে কাউকে ওয়াচে পাঠাইনি।

    নিজের ওপর রাগে তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল। এই কয়দিন রোজই দুবেলা দুজন করে এসে দেখেশুনে গেছে। কেবল আজই বিকেলবেলাটা কাউকে পাঠায়নি। কেন সে বিকেলে কাউকে পাঠায়নি ওয়াচ করার জন্য? তার কি আত্মবিশ্বাস বেশি হয়ে গিয়েছিল?

    রডারিক বলল, ‘ট্রাকটায় কতজন সৈন্য এসেছে কে জানে!’

    শিবেন বলল, ‘ধরে নিতে হবে ট্রাকভর্তি হয়েই এসেছে। কতজন এক ট্রাকে ধরতে পারে, হিসেব করে দেখ।’

    মোহন বলল, ‘ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। আমাদের সঙ্গে একটা স্টেন, আটটা থ্রি-নট-থ্রি আর প্রচুর গুলি আছে। গ্রেনেডও আছে যথেষ্ট। আমরা সংখ্যায় বারোজন। ওরা যদি পুরো বিল্ডিংটা বোঝাই হয়েও থাকে, তবু আমরা ওদের শেষ করতে পারব আমরা যখন আক্রমণ করব, তখন তো ওরা ঘুমিয়ে থাকবে। ঘুম ভেঙে কী হল বোঝাবার আগেই ওরা গুলি খেয়ে ঢলে পড়বে।’

    চাঁদ আবার মেঘে ঢেকে গেল। গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল। শান্টু গুনগুন করে বলতে লাগল, ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেব মেপে।

    কলেজের সামনের টানা-বারান্দায় একজন সেন্ট্রি ডিউটি দিচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে মোহন বলল, ‘ঘুরে যেতে হবে। কলেজের পেছনদিকে যেতে হবে। ওদিকে বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে। ওদিক থেকেই আক্রমণ করতে সুবিধে হবে আমাদের।’

    ফিফিন্ করে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। ওরা কলেজের পেছনে ফলের বাগানে পৌঁছতে পৌঁছতে বৃষ্টি বেশ জোরেই এল। একতলা কলেজ-বিল্ডিঙের পেছনদিকেও লম্বা বার

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম
    Next Article সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    Related Articles

    জাহানারা ইমাম

    একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম

    August 13, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }