Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বুদ্ধদেব গুহর প্রেমের গল্প

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প183 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    লিখন

    —এখনও রওয়ানাই হওয়া গেল না। কখন যে কী হবে তা ভগবানই জানেন!

    অপা, স্বভাবজাত প্রাণপ্রাচুর্যের সঙ্গে স্বগতোক্তি করল, নয়নের দিকে তাকিয়ে।

    সুস্মিতার সবে বিয়ে হয়েছে। একেবারে ছেলেমানুষ। স্বামী, নয়নের ওপর কতখানি জোর আছে ওর, এখনও তা পুরোপুরি পরখ করা হয়নি। তা ছাড়া, স্বভাবটাই ওর চাপা। সহজে উত্তেজিত হয় না। চুপচাপ ভাবতে ভালোবাসে।

    নয়ন বলল, নিয়োগী সাহেব, কর সাহেব, চট্টখন্ডী সাহেব সকলে বোস সাহেবকে সঙ্গে করে যখন এগিয়ে গেছেনই তখন সবই ঠিকমতোই হবে। আরও তো অনেকে গেছেন। তুমি এত চিন্তা কোরো না তো অপাবউদি। বলেই বলল, আমি এগিয়ে যাচ্ছি।

    অপা বলল, সাবধানে যেয়ো তুমি নয়ন। জঙ্গলের রাস্তা।

    তারপর চট্টখন্ডী সাহেবের বাংলোর বাগানের কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে সমবেত মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলল, চিন্তা না করেও পারা যায়? বলো তোমরা? পিকনিক করবে সারাণ্ডার জঙ্গলে। তাও আবার মুনলাইট পিকনিক। কখন হাতি, বাইসন, বাঘ বেরোবে তার ঠিক কী? অথচ এখনও রওনা হওয়াই হল না!

    —মুন তো উঠে গেছে অনেকক্ষণ, মুনলাইটেরও অভাব নেই, কিন্তু মুনলাইটে তো আর পেট ভরবে না। সেদিকে রান্নাবান্না করবেন কি আমাদের কর্তারা?

    মিসেস সান্যাল বললেন।

    পিকনিক করবে সারান্ডার জঙ্গলে। তাও আবার মুনলাইট পিকনিক।

    মনীষা বলল, যত গন্ডগোলের মূলে ওই লোকটি। ওই বোস সাহেব। উনি আসার পর থেকেই যত গন্ডগোল শুরু হয়েছে এখানে। ‘উঠল বাই তো কটক যাই।’

    মিসেস ব্যানার্জি বললেন, যা বলেছ ভাই। আমার স্বামীর জন্মই তো বড়োবিলে। তোমার কর্তাও তোমার শ্বশুরমশাই-এর আমল থেকেই আছেন এখানে, কিন্তু আজ অবধি বড়োবিল, বড়োজামদার লোকেদের মুখে ‘মুনলাইট পিকনিক’-এর কথা কখনো শুনেছ? বিশ্বকর্মা পুজোয়, সরস্বতী পুজোয় দুপুরের খাওয়াদাওয়া; ঠিক আছে। বিজয়া সম্মিলনি, কারও বাড়ির লনে; তাও ঠিক আছে। কিন্তু এ কী ব্যাপার?

    কোনো সন্দেহ নেই তাতে। যা হইহুল্লোড় চলেছে তাতে মিত্র. এস. কে. আর ব্রিগস কোম্পানি তো দূরের কথা, দুর্গাপুর স্টিলস, হিন্দুস্তান স্টিলসও না উঠিয়ে দিয়ে যায় এই লোকটা! আমাদের এখানের জীবনযাত্রা বেশ শান্ত, নিরিবিলি, সময় মাপা ছিল। নির্ঝঞ্ঝাট! সমস্ত উলটোপালটা করে দিল মানুষটা এসে।

    মিসেস গুহ বললেন, আরও একটা কথা, মিস্টার বোস এসে এদের প্রত্যেকেরই চরিত্র নষ্ট করে দিলেন।

    চরিত্র?

    মেয়েরা সমস্বরে গুঞ্জন তুললেন।

    এই লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ খনির এলাকাতে যৌবন চলকে-চলা খিলখিল হাসি সুশ্রী আদিবাসী রেজাদের বাস, হাজারে হাজারে ওরা এদেশীয় শহুরে শিক্ষিত মেয়েদের মতো সমাজভীতিতে জড়সড়ো নয়। ন্যাকাও নয়। হাঁড়িয়াও এখানে ‘কারো’ নদীর জলের মতোই ফেনা ছিটিয়ে বয়, জলেরই মতো। অতএব চরিত্র এখানে একবার বৃন্তচ্যুত হলে চৈত্র শেষের ঝরা শালপাতারই মতো মত্ত হাওয়াতে গড়াতে গড়াতে গিয়ে কোন গিরিখাত বা নরম উপত্যকায় গিয়ে প্রস্তরীভূত হবে যে, তা বলা মুশকিল।

    স্থানীয় প্রত্যেক মহিলাই তাই তাঁদের স্বামীদের চরিত্র সম্বন্ধে সবসময়ই সজাগ।

    চরিত্রের প্রশ্ন ওঠাতে মিতভাষী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং নি:সন্দেহে সুন্দরী অপা যুগল ভুরু তুলে মিসেস গুহর দিকে চেয়ে বলল, ‘চরিত্র’ বলতে তুমি কী বলতে চাইছ?

    রুনা বলল, বেলাদি, বোস সাহেবের চরিত্র দোষের, আপনি নিজে কি কিছু প্রমাণ পেয়েছেন?

    মহিলামহলে হাসির রোল উঠল।

    মিসেস গুহ লাল-গাল করে বললেন, এমন বোকা কথা বোলো না তুমি! তারপর বললেন, দ্যাখো রুনা, আমি কমার্সের ছাত্রী। তোমাকে বলতে পারি, চরিত্র হচ্ছে এক রকমের ইনট্যানজিবল অ্যাসেট। থাকলেও প্রমাণ করা যায় না যে আছে। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না। না থাকলেও প্রমাণ করা যায় না যে নেই। বলেই অপার দিকে চেয়ে বললেন, তোমার বরকে জিজ্ঞেস কোরো অপা, উনিও তো অ্যাকাউন্টেন্টের কাজই করেন।

    অপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সকলের অলক্ষ্যে। ভাবল, তার স্বামী প্রাণেশ অ্যাকাউনন্টেন্ট হতে পারে, কিন্তু সে যে নিজেই একটি ইনট্যানজিবল অ্যাসেট। আছে কী নেই, তা বোঝা পর্যন্ত যায় না। মুখে অবশ্য কিছুই বলল না।

    মনীষা বলল, একশোবার বোঝা যায় চরিত্র আছে কী নেই। গ্যাঁদাল পোকাকে টিপে মারলে তার দুর্গন্ধ চাপা থাকে না। তুমি কিন্তু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে বেলা।

    মিসেস গুহ বললেন, আমি বলতে চাইছিলুম মনের কথা। লোকটা আসার পর থেকে এখানে সকলেরই বড়ো মদ-বাতিক হয়েছে। আগে আমার উনি বাড়ি ফিরেই বলতেন, কই গো! নেবু থাকলে একটু নুন দিয়ে ফ্রিজ থেকে একটুকরো বরফ বের করে দাও দিকিনি এক গ্লাস। এই বোস সাহেবের সঙ্গে মিশে বলতে শুরু করেছেন ‘বিয়ার না খেলে এইরকম রুখু পরিবেশে নাকি শরীর ট্যাঁকানোই দায়। ডি-হাইড্রেশান হয়।’

    সকলেই হেসে উঠলেন মিসেস গুহর চোখ নাচিয়ে বলার ভঙ্গি দেখে।

    —যা বলেছ! দুষ্টের ছলের অভাব হয় না।

    চুমকি বলল।

    আমার ও-ও আজকাল বলতে শুরু করেছে, দারু পিয়া তো কেয়া বাফা? দিল খুশ ঔর পেটসাফা! হুইস্কি খেলে নাকি পরদিন…..। এখানের জলে যে মারাত্মক রকমের আয়রন আর আয়রনে কনস্টিপেশন করায় তা নাকি এত বছর পরে বোস সাহেবের কাছ থেকেই জানল। ঢং দ্যাখো এদের।

    অপা হেসে বলল, বোস সাহেব লোকটা তোমাদের সকলের বরদেরই এমন ভেড়া বানিয়ে দিল। সত্যি বাহাদুরি আছে বলতে হবে!

    উর্ণা বলল, তুমিও যেমন অপাদি। সবই সমান। কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে বুঝতে পারছিল না এরা। এতদিনে শক্ত-কাঁধের স্কেপ গোট জোগাড় হয়েছে এক-জন। মহাদেবের গায়ে তো কলঙ্ক লাগে না, সকলে মিলে বেদম কালি ছিটোচ্ছে। তোমাদের সকলের বরই যেন….।

    অপা বলল, এবার তোরা থাম তো! একটা লোককে নিয়ে এত আলোচনা আর ভালো লাগছে না। সে কে এমন কেউকেটা যে, তোরা আলোচনার অন্যকিছু খুঁজেই পাচ্ছিস না?

    উর্ণা বলল, যাই-ই বলো আর তাইই বলো; আপদ এখান থেকে গেলে বাঁচি।

    যাবে কবে?

    শুনছি তো শিগগিরই যাবে। জিয়োলজিস্ট মানুষ। কী সব প্রসপেক্টিং-টেকটিং করতে এসেছে।

    সুস্মিতা সশব্দে একটা মশাকে নিজের বাঁগালের ওপরে মেরে, মিনমিন করে বলল, সত্যি! সাড়ে সাতটা বেজে গেল এখানেই, ওরা কখন আসবে, কখন যাওয়া হবে? আর আমরা ফিরবই-বা কখন?

    তা ফিরতে ফিরতে দুটো-আড়াইটা হবে রাত। মনীষা বলল।

    —কী বললে? রাত আড়াইটে। ভাগ্যিস শাশুড়ি কাল টাটাতে ননদের বাড়ি চলে গেলেন। নইলে হত দুমপিট্টি।

    মিসেস সেন বললেন। কিন্তু যাওয়া হবে কোনদিকে?

    কথা ছিল কিরিবুরুর দিকে। কিন্তু কালই কিরিবুরুর কাছে রাস্তার ওপরে কাজের শেষে একজন রেজা তার বাচ্চাকে নিয়ে বসে জিরোচ্ছিল। একটা হাতি এসে বাচ্চাটাকে আলতো করে তুলে পাশের ঝুড়িতে বসিয়ে দিয়ে রেজাটিকে শুঁড়ে নিয়ে পাশের কারিকেন্দু গাছের মোটা ডালে ধোপা যেমন পাট দেয় কাপড়কে তেমন করে পাট দিয়ে শেষ করে দিয়েছে।

    —ও মাগো! বোলো না। ইস, শুনেই গা কীরকম করছে।

    উর্ণা বলল, তাহলে আমরা জামদা থেকে বিষ্টুমামাকে তুলে নিয়ে যাই। পাহারা দেবার জন্য।

    —বিষ্টু দত্ত মশায়ের সঙ্গে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ঝগড়া। ওঁকে গেটে হয়তো আটকেই দেবে।

    —দ্বারী দাঁড়িয়ে থাকে দ্বারে, আর উনি যান আড়ে আড়ে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ওঁর গভীর প্রেম। পরকীয়া তো। একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে না হলে কি চলে?

    —তিনি থাকলে না-হয় বড়ো জানোয়ার সামলাতেন। কিন্তু চিতি সাপ? কাঁকড়াবিছে?

    অপা ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে বিজলিবাতি থাকা সত্ত্বেও জ্বেলে বলল, এই রানু, রাতের বেলা সাপের কথা বলতে নেই।

    বলেই, এদিক-ওদিক এর-ওর পায়ের দিকে টর্চটা ফোকাস করে দেখল।

    ওরা হাসল। বলল, কী যে করে না অপাটা!

    —না বাবা! আমার ভীষণ ভয় করে।

    ঠিক এমন সময় জিপ এবং দুটো গাড়ি এসে পৌঁছোল। কেউ আর বাকি নেই; আই.টি.সি কোম্পানির এ রায়, কান্তিবাবু। এস লাল-এর ঠাকুরাল আর শর্মা সাহেব। ব্রিগস-এর ভট্টাচার্যি সাহেব। এইচ.এস.এল.-এর কে.জি. ঘোষ। মিলনী লাইব্রেরির কবিরাজ। আর মিত্রদের, প্রণববাবু, বিপ্লববাবু, হাজরাবাবু। সিসকোর দাড়িঅলা মাইতি। সকলেই বউ নিয়ে। যাদের বউ নেই তারাও কোথা থেকে জোগাড় করে আনলে এই বউ-এর হাটে মিলে যেত, চাঁদনি রাতে চেনা যেত না। মেয়েরা অ্যাম্বাসাডরে উঠলেন। স্ত্রী-পুরুষ নিয়ে প্রায় জনাচল্লিশেক লোক। বড়োবিল বড়ো জামদার বঙ্গসন্তানদের নেতৃত্বে এতবড়ো দুঃসাহসী মিশ্র এবং নৈশ অভিযান বোধ হয় এর আগে হয়নি কোনোদিনই।

    অপা পেছনের অ্যাম্বাসাডরে সামনের সিটে বাঁ-দিকে জানলার পাশে বসেছিল। চুপ করে ভাবছিল। হু-হু করে গাড়ি যাচ্ছে। অলক উড়ছে। ক্বচিৎ মহুয়ার গন্ধ ভেসে আসছে চৈতি হাওয়ায়। আগে জামদা ও বড়োবিলের মধ্যেও বেশ ভালো জঙ্গল ছিল। সভ্যতা (?) ক্রমশ এবং দ্রুত গ্রাস করে ফেলছে জঙ্গলকে, সবুজকে; যা-কিছু প্রাণবন্ত সব কিছুকে। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে টর্চটা বার করে গাড়ির মধ্যে পায়ের কাছে আলো ফেলে দেখল অপা।

    উর্ণা ডানপাশে বসেছিল। হেসে বলল, বাতিকগ্রস্ত হলে দেখছি তুমি। তোমার এমন সুন্দর পায়ে কামড় দেবে এমন সৌন্দর্যজ্ঞানহীন সাপ এদেশে নেই।

    রানু বলল, যাই বলিস। চিতি সাপকে ভয় করেই। জোড্ডার ধনঞ্জয়বাবুকে কামড়েছিল-না গত বছর!

    অপা ভাবছিল, চন্দ্রালোকিত জঙ্গল আর প্রান্তরের দিকে চেয়ে যে, যে মানুষটিকে নিয়ে এতক্ষণ এত আলোচনা হল সে মানুষটিকে সে দেখেইনি আজপর্যন্ত। তার স্বামী প্রাণেশের কাজ অ্যাকাউন্টস নিয়ে। টেকনিক্যাল ফিল্ডের লোকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ কম। ও শুনেছে ভদ্রলোক অবিবাহিত। তাই তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ হওয়ার সুযোগ হয়নি। ভালো বা মন্দ যা-ই শোনা যাক-না কেন কোনো মানুষ সম্বন্ধেই, তা যদি বাড়াবাড়ি রকমের হয়, তাহলে তার সম্বন্ধে মনে একটা তীব্র কৌতূহল জন্মায়ই! একটা কথা সম্বন্ধে শুধু ও সুনিশ্চিত। তার স্বামী তার সঙ্গে এক খাটে শুয়ে থেকেও যেমন অনুপস্থিত, এই অদেখা লোকটি শুধু তার কাছেই নয়, এই সমস্ত অঞ্চলেই প্রচন্ডভাবে উপস্থিত। চরিত্রে পজিটিভ হলে পুরুষমানুষদের সত্যিই পুরুষ পুরুষ লাগে। লোকে যে কারণে অদেখা সাধুসন্ত এবং চিত্রপরিচালকদের মতোই অদেখা মার্ডারার বা রেপিস্টকেও দেখতে ভিড় করে, ঠিক সে কারণেই লোকটাকে দেখতে চায় অপা। মানুষটা কেমন হবে তা নিয়ে কল্পনার জালবোনা শুরু করেছে ও মনে মনে। কলেজজীবনের পর ঠিক এমন একটা বোধ ওর জীবনে আর আসেনি। মনের মধ্যে একটা তীব্র চাপা উত্তেজনা বোধ করছে ও। একটা জিপ পিছিয়ে পড়ল। ড্রাইভার বলল, দত্তবাবুর দোকান থেকে এখন সাহেবরা শারাব আর ছোটুয়ার দোকান থেকে পান-সিগারেট কিনছেন।

    —আরও শারাব?

    মিসেস ব্যানার্জি বিরক্ত গলায় বললেন।

    রুনা বলল, জর্দার একশো-বিশের টিন আনিয়েছিলাম রাউরকেল্লা থেকে, জামাইবাবু আসবেন বলে। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। আমিও খাব আর বোস সাহেবকেও দেব। ভদ্রলোক পান খান।

    জিভে চিকচিক শব্দ করে মনীষা বলল, কোনো ভদ্রলোক পান খান নাকি এ যুগে? আবার জর্দা?

    উর্ণা বলল, শুধু জর্দা? কী খান না, তাই-ই বলো? তা প্রেমে-টেমে পড়লি না তো রুনা। দেখিস আবার। চারশো-বিশ লোকের জন্য একশো-বিশ জর্দা!

    আবার হাসির রোল উঠল।

    সুস্মিতা প্রতিবাদ করে উঠল অতর্কিতে। কন্টিনিউয়াসলি এরকম নিন্দা করা অন্যায়। তা ছাড়া, আমি ভদ্রলোককে দেখিনি। কিন্তু না দেখেও বলতে পারি, মন্দই হোন কী ভালোই হোন, হি ডাজ নট ডিজার্ভ সো মাচ অফ অ্যাটেনশন। তোমাদের আলোচনার কি আর কিছুই নেই রুনাদি?

    অপা বলল, সুস্মিতা ঠিকই বলেছে।

    উর্ণা বলল, ও। তোমার বুঝি বোস সাহেবকে ভালো লাগে; কী অপা; এতক্ষণ সেকথা বললে আমরা…..

    —আমি….?

    —ও, তুমি তো দেখোইনি…..। রুনা বলল।

    —পুরো নামটা পর্যন্ত জানি না।

    —এন বোস।

    —এনটা কী?

    রুনা বলল, জানি না। ‘নালিফায়িং’ বোস হলে মানাত।

    অপা বলল, তোর স্বামীর ইনিসিয়াল তো ‘ভি’—তাহলে তাঁকে ‘ভিলিফায়িং’ বাগচি বলে ডাকবি?

    —বয়স কত?

    —বেশি না। তোর-আমার বরেদেরই মতো।

    —তাহলে তো ইয়াং-ই।

    —আ ম্যান অ্যাজ ইয়াং অ্যাজ হি ফিলস অ্যাণ্ড…..আ ওম্যান ইজ অ্যাজ ইয়াং অ্যাজ শি লুকস।

    পেছনের সিট থেকে কে যেন বলে উঠল।

    দুই

    কিরিবুরুর রাস্তায় যেখানে পথগুলো সব ভাগ হয়ে কুমডি, থলকোবাদ, সালাইমনোহরপুর এবং কিরিবুরুর দিকে চলে গেছে সেইখানের ফরেস্ট গেটে গাড়ি দাঁড়াল। কী যেন জায়গাটার নাম? বরাইবুরু। মনে থাকে না অপার। সকলে একসঙ্গে হলে তারপর রওয়ানা হবে। বার বার গেট খুলবে না গার্ড। অ্যাডভান্স পার্টি পাস দিয়ে অন্যান্য গাড়ির নাম্বার-টাম্বার লিখিয়ে দিয়ে গেছে আগেই।

    সবাই এসে গেলে, গেট খুলিয়ে সব গাড়ি একসঙ্গে থলকোবাদের রাস্তায় চলল—কুমডির দিকে। লাল, ভারী, আকরিক ধুলোয় গা-মাথা গাড়ি সব লাল হয়ে উঠল। গাড়ির কাচ তুলে দিল ওরা। যারা জিপে আছে তাদের প্রত্যেকেরই কালকে আধখানা করে সাবান আর আধ বোতল করে শ্যাম্পু লাগবে ওরিজিনাল চেহারাতে ফিরে আসতে।

    ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাহাড় আর নদীর মাঝের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে দশ কিলোমিটার মতো যাওয়া হয়েছে। সামনে হেডলাইটের আলোতে দেখা যাচ্ছে একটা অব্যবহৃত শুকনো শালপাতায় ছাওয়া রাস্তা বাঁয়ে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়ে। আর কী-একটা নদী বয়ে চলেছে সামনে পথের পাশে পাশে।

    ড্রাইভার রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, শিকার রোড। আর নদীর নাম বলল, ‘কৌইনা’।

    হঠাৎ কী হল, গাড়ি ও জিপগুলো একের পর এক ব্রেক কষে প্রায় এ ওর বাম্পারে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

    সামনের গাড়ি থেকে কে যেন বলে উঠল, হাতি! ওরে বাবা হাতি!

    সঙ্গে সঙ্গে রুনা পেছন ফিরে জিপের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠল, বলল, ও কোন গাড়িতে?

    উর্ণা বলল, আমার হাজব্যাণ্ড কোথায় গেল? হাতি! হাতি! বলেই চিৎকার করে উঠল উর্ণা।

    রুনা বলল, লোকটা সত্যিই শয়তান! আমাদের মারবার ফন্দি করে এখানে নিয়ে এসেছে। কী দরকার ছিল এখানে খিচুড়ির লোভে এসে? বাড়িতে বেশ ছোটোপোনা আর এঁচড়ের তরকারি রেঁধে রেখেছিলাম!

    ইতিমধ্যে ছেলেরা জিপ থেকে নামছে দেখা গেল এবং লাল ধুলোর মেঘ পরিষ্কার হলে একথা প্রাঞ্জল হল যে, হাতি-উট কিছুই নয়, বোস সাহেব রাস্তার মধ্যে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়ে সব গাড়িকে রুখে দিয়েছেন।

    তাতেই সকলে ভেবেছিলেন যে, সামনে বিপদ।

    মেয়েরা সাহস করে গাড়ি থেকে নামছিলেন না। অতজন স্ত্রী-পুরুষের চ্যাঁচামেচিতে এবং অতগুলো গাড়ি ও জিপের ইঞ্জিনের আওয়াজে জায়গাটাকে একটা বাজারের মতো মনে হচ্ছিল। মেয়েরাও এবারে নামলেন। অপা একবার টর্চ জ্বেলে দেখে নিল চিতি সাপ-টা আছে কী নেই। সকলে জমায়েত হলে জানা গেল যে, বোস সাহেব সকলকে পায়ে হেঁটে বাকি পথটি যেতে অনুরোধ করছেন। চাঁদের আলো উপভোগ করবার জন্যে। গাড়ি জিপ সব পরে আসবে পেছন পেছন।

    অপা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দরজা বন্ধ করে উঠে পড়ে বলল, উন্মাদ!

    সকলেরই তীব্র আপত্তি। গরমের রাত। চিতি সাপ, কিং কোবরা, শঙ্খচূড়, কাঁকড়াবিছে, হাতি, বাইসন, মাথা চিবিয়ে খাওয়া বড়োবাঘ, হাড় চিবোনো ছোটোবাঘ, নাক খামচে নেওয়া ভাল্লুক, পেছনে ঢুঁ-মারা শুয়োর, পেটে শিং ফুটোনো শম্বর; থাকতে পারে না এমন জানোয়ার নেই যেখানে, সেখানে হেঁটে যাবে কোন খ্যাপা।

    বোঝা গেল যে, অ্যাডভান্স পার্টি অনেক আগেই পৌঁছেছেন। শুভেনবাবু ও নিয়োগী সাহেব খিচুড়ির বন্দোবস্ত এগিয়ে নিয়েছেন। মিস্টার বোস হেঁটে হেঁটে চলে এসেছেন এতদূর। ওঁদের রিসিভ করতে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরে।

    যখন কেউই রাজি হল না ওঁর এই পাগলামির প্রস্তাবে, তখন সকলে মিলে ওঁকে পাঁজাকোলা করে জিপে তোলার প্রস্তাব করা হল। উনি একেবারেই গররাজি। বললেন, আমি একাই ফিরে যাব। বেশিক্ষণ লাগবে না। খিচুড়ি হতে হতেই পৌঁছে যাব। তোমরা গিয়ে গান-টান গাও। খিদে হবে।

    যখন সকলেই জিপে ও গাড়িতে উঠে পড়লেন, তখন বোস সাহেব রাস্তার এক পাশে সরে গিয়ে সকলকে টা-টা করলেন হাত তুলে ব্যাসাল্ট পাথরের একটা বড়ো চাঙড়ের ওপরে বসে।

    অপা গাড়িতে বসেই শিউরে উঠল। কে জানে কত চিতি সাপ কিলবিল করছে ওই পাথরটারই ওপর। লোকটা কী মানুষ, না পিশাচ! কিন্তু লোকটা একেবারে লোকটারই মতো। অন্য কারও মতোই নয়।

    সবগুলো জিপ ও গাড়ি পর পর বোস সাহেবের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তার সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি লৌহ-আকরের লাল ধুলোতে একেবারে লাল করে দিয়ে। সবশেষ গাড়িটা অপাদের। বোস সাহেব ওদের দেখেও হাত নাড়লেন।

    এমন সময় রুনা বলল, ড্রাইভার গাড়ি রোকো।

    সকলে চমকে উঠলেন।

    রুনা দরজা খুলে নেমে গিয়ে বলল, এই যে মশাই, আপনার জন্যে পান আর একশো-বিশ জর্দা এনেছি। খেতে খেতে আসুন। কথা যখন শুনলেনই না কারওর।

    বোস সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ।

    অপা লক্ষ করল, ভদ্রতা-টদ্রতা জানে। মেয়েদের সঙ্গে মিশেছে বোধ হয়।

    রুনা হঠাৎ দেখল, অপা ওর একেবারে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রুনা কেমন অপ্রতিভ হয়ে বলল, চলি বোস সাহেব। তাড়াতাড়ি আসবেন।

    বলেই ঘুরে বলল, চলো অপা?

    অপা বলল, তোমরা যাও। আমি ওঁর সঙ্গে হেঁটেই যাচ্ছি।

    —সে কী?

    গাড়ি থেকে সমস্বরে অন্য মহিলারা বলে উঠলেন, সে কী? মাথা খারাপ হল তোমার? চিতি সাপ?

    উর্ণা বলল, প্রাণেশবাবুকে না বলে…..। তুমি কি তাঁকে বলেছ?

    অপা বলল, দৃঢ় গলায়, আমি তো স্কুলের ছাত্রী নই। নাবালিকাও নই। আমি ওঁর সঙ্গে আসছি। তোমরা সব এগোও।

    কয়েক মুহূর্ত গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। তারপরেই ড্রাইভার গিয়ারে দিল গাড়িকে। গাড়িটা এগোতেই আবার ধুলো উড়ল। প্রথম কিছুক্ষণ চোখে গভীর অন্ধকার দেখল অপা। ও শহরের মেয়ে। কখনো বড়োবিল বড়োজামদার মতো জায়গাই দেখেনি আগে। এরকম জায়গা তো নয়ই! অনেকক্ষণ পরে ওর হুঁশ হল। বোস সাহেব বললেন, আসুন। এইখানে, এই পাথরটাতে বসুন। চোখ দুটো জোরে বন্ধ করে রাখুন মিনিট খানেক, তারপর খুললেই চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এই নিন, পান খান একটা। জর্দা খাবেন?

    অপা কোনো কথা না বলে হাত বাড়িয়ে পানটা নিল। হাতে হাতে লাগতে ওর শরীরে হঠাৎ কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওর সাত বছরে বিবাহিত জীবনে ঠিক কখনো হয়নি এমন আগে। বিয়েবাড়ি ছাড়া কখনো পান খায় না ও। জর্দার তো কথাই ওঠে না। চোখ বন্ধ করে পান চিবুতে লাগল বত্রিশ বছরের খুকি অপা। পুরো এক মিনিট পরে যখন চোখ খুলল, তখন তার নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারল না।

    একবার অনেক দিন আগে বসন্তোৎসবে শান্তিনিকেতন গেছিল। সেখানেও শালবন, আম্রকুঞ্জ, পূর্ণিমাতে দেখেছিল। কিন্তু এমন রাত! দূরে পাহাড়ে আগুন লেগেছে। গরম হাওয়া ঝরঝর করে শুকনো শালপাতা উড়িয়ে গড়িয়ে নানান পাথরে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না।

    বোস সাহেব বললেন, উঠুন। এবার এগুনো যাক। জঙ্গলের রাত। দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। একার দায়িত্ব নেওয়া ভারি সহজ। তাতে কোনো বাহাদুরি নেই।

    অপা বলল, আমার নাম অপা। আমি প্রাণেশবাবুর স্ত্রী। এখানে আছি দু-বছর।

    —ওঃ। তাই বুঝি।

    অপা আবার বলল, আসলে কেউই আপনাকে কম্পানি দেওয়ার জন্যে রইলেন না তাই আমার খারাপ লাগল। গাড়িতে যখন আর কেউ থাকে না, তখন যিনি ড্রাইভ করেন তাঁর পাশে এসে অপরিচিতাও বসেন, ব্যাকসিটে বসে না থেকে। এটাই ভদ্রতা। আপনাকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়াটা নিছকই অভদ্রতা হত।

    বলেই ভাবল, কথা ক-টি বলার দরকার ছিল কি আদৌ?

    বোস সাহেব হাসলেন। বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন? বিয়ার-টিয়ার সব ঠাণ্ডা করা আছে। ফ্লাস্কে করে বরফও নেওয়া হয়েছে। সকলেই জানেন যে, দেরি হলেই ফাঁকিতে পড়বেন। এত সব সুন্দরী বউদের নিয়ে এমন জঙ্গলে পায়ে হেঁটে আমি যেতে বললেই-বা ওঁরা যাবেন কেন? শুধু আপনার ব্যাপারটাই কোনো হিসেবে মিলল না। একেবারেই মিলল না। বড়ো অবাক লাগছে আমার। সত্যিই অভাবনীয়।

    ব্যাগ থেকে বার করে অপা একবার টর্চটা জ্বালল। অভ্যেসবশে।

    —আলো জ্বালাবেন না। সাপ যদি কামড়ায়, তাহলে কামড়াবেই। কথায় বলে না, সাপের লেখা আর বাঘের দেখা! সাপেরটা লেখাই। ভয় জঙ্গলে নেই। ভয়টা আমাদের মনে।

    একটা মোড় নিল ওরা। কী সুন্দর যে লাগছে! জীবনে এত ভালো কখনো লাগেনি। অপা বিভূতিবাবুর ‘আরণ্যক’-এ পড়েছিল, ‘চাঁদের আলোর বুটিকাটা গালচে’। কাকে বলে, আজ তা নিজের চোখে দেখল। বিভূতিবাবুর লেখাতে তো এইসব জায়গার কথা কতই পড়েছে। এখনই এমন জঙ্গল, তা ওঁর সময় অত বছর আগে না-জানি কেমন ছিল। ভাবছিল অপা। ওর অ্যাকাউন্টেন্ট স্বামী, হিসেব ছাড়া কিছুই বোঝে না। রসকষ, সাহস বলতে কিছুই নেই মানুষটির। পোষা বিড়ালের মতো ভালো। আটারলি আনইন্টারেস্টিং।

    —আপনার পুরো নামটা কী? এন বোস মানে?

    অপা হঠাৎই প্রশ্ন করল।

    —আমার নাম নিরূপ।

    একটা মোড় নিল ওরা।কী সুন্দর যে লাগছে ! জীবনে এত ভালো কখনো লাগেনি ।

    —কিন্তু থাক এসব প্রসঙ্গ। এমন রাতে কথাই বলতে নেই। বাদবাকি পথ আমরা আর একটাও কথা বলব না। আপনিও ভাববেন আমিও ভাবব। আর দেখব। শুনব। নাকভরে গন্ধ নেব আমার বউয়ের গায়ের। আজ সন্ধেতে কোন সাবান দিয়ে গা ধুয়ে উঠল সে কোন ভালো লাগার জলপ্রপাতে, কে জানে? প্রতিপ্রহরেই তার নতুন শাড়ি, প্রতিপ্রহরে নতুন আতর, নতুন মুখ, প্রতিঋতুতে নতুন করে ঋতুমতী এমন বউ আর কার আছে বলুন?

    অপা কথা না বলে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে থাকল।

    পথটা এবার চড়াই উঠেছে। বড়ো বড়ো শাল গাছের বন। আরও কত গাছ। কিছুরই যে নাম জানে না অপা। পাশ দিয়ে নদীটা কত কী বলতে বলতে ছুটে চলেছে—কলকল খলখল করে। কী-একটা পাখি ডাকছে থেকে থেকে। কী পাখি? কে জানে? এর ডাক শোনেনি তো কখনো। বাঁ-দিকের উপত্যকা পেরিয়ে উঁচু উঠে গেছে পাহাড়। সাতশো পাহাড়ের দেশ-এ। এই সারাণ্ডার জঙ্গল। কতরকম পাথর আছে এইসব পাহাড়ে। কতরকম ধাতু। কত ফুল, কত লতা, কত পাখি, পোকা, সাপ, কতরকম জানোয়ার এইসব বনে বনে। যে মেয়ে চিতিসাপের ভয়ে বিজলির আলো-জ্বালা ঘর থেকে উঠোনে যেতেও টর্চ জ্বালে, সেই-ই চাঁদের আলোয় এই পাহাড়ে জঙ্গলে শাড়ি লুটিয়ে চটি পায়ে আপন মনে চলেছে নির্ভয়ে।

    মানুষটার ওপর নির্ভর করা যায়, নিশ্চিন্তে।

    হাওয়ার কী শব্দ! এক-একটা শুকনো শালের পাতা জঙ্গলের নীচে খসে পড়ছে উড়ে উড়ে, নেচে নেচে, ঘুরে ঘুরে তাতেই কী শব্দ হচ্ছে? একটা শুকনো পাতা পড়ার এত শব্দ! পৃথিবীতে এতও স্তব্ধতা আছে? অবাক হয়ে যায় অপা। আকাশ, চাঁদ, জঙ্গল, দিগন্ত সবকিছুর সঙ্গে এক নিবিড় একাত্মতা বোধ করতে লাগল ও। ওর মনে হচ্ছিল যে, ও এক শ্যাওলা পড়া কূপমন্ডূক সংস্কারবদ্ধতা থেকে হঠাৎই জিনপরি হয়ে উঠে এসে এই খারাপ নিরূপ মানুষটার হাত ধরে আজ চাঁদের আলোর মন্ত্রে দীক্ষিত হল। প্রকৃতিকে গুরু করল। মুক্তি পেল, সব বন্ধন থেকে। তেমন কোনোই কথা হয়নি মানুষটার সঙ্গে। কিন্তু অপা ওর জীবনে এই-ই প্রথমবার জানল যে, চিৎকার অথবা লক্ষ লক্ষ বাক্যের সঙ্গে বক্তব্যর কোনো সম্পর্ক নেই। তার স্বামী প্রাণেশ বিয়ের পর থেকেই সাত বছর হল আজ, প্রতিরাতে তার নগ্ন শরীরে হাত রেখে অনর্গল কথা বলে গেছে। আসলে সেগুলো অর্থহীন শব্দমাত্র। এই মানুষটার কিছু বলবার আছে। জীবন সম্বন্ধে; নিজের সম্বন্ধে। অথচ কিছু না বলেই সব কথা বলতে জানে। এই সব ভাবতে ভাবতে, চৈত্র শেষের সুগন্ধি চাঁদনি রাতের কথা শুনতে শুনতে মোহাবিষ্টর মতো হাঁটছিল অপা।

    কিছুক্ষণ পরই সামনের দিক থেকে একটা জিপের গোঙানি আসতে লাগল। নিশ্চয়ই যূথভ্রষ্টা তাকে, কেউ নিতে আসছে।

    কিন্তু কেন? অপাও তো একজন আলাদা মানুষ।

    আওয়াজটা জোর হচ্ছে। জিপটা এগিয়ে আসছে। কাকে পাঠাতে পারে তার স্বামী?

    সময় যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। আনন্দের সময়, মুক্তির সময়; জিপটা দ্রুত আসছে। অপা বলল, এমন করে যে জঙ্গলে নিরস্ত্রভাবে ঘুরে বেড়ান, কখনো বিপদ হলে?

    —আমি ভাগ্যলিপিতে বিশ্বাস করি। আপনি করেন না?

    বোস সাহেব বললেন, অপার দিকে মুখ ফিরিয়ে।

    অপা একটু ভাবল। বলল, জানি না। কখনো ভাবিনি এ নিয়ে।

    —বিপদ হলে হবে। নিরাপদেই তো কাটল অনেক দিন। পৃথিবীতে এমন বিপদ নেই, যন্ত্রণা নেই, দুঃখ নেই, এমন কোনো ভয়াবহ মৃত্যু নেই, যা আমার আগে অন্য কোনো-না-কোনো মানুষের জীবনে আসেনি। তারা যখন তার সম্মুখীন হয়েছে, আমিই-বা পারব না কেন? সবই প্রি-কণ্ডিশণ্ড। যা হবার, যখন হবার, তা হবেই।

    জিপটা এসে গেল।

    প্রাণেশ একাই এসেছে অন্য লোকের জিপ নিয়ে। তার নিজের ড্রাইভারকে আনেনি। অন্য কাউকেও আনেনি। যদি সিন-ক্রিয়েটেড হয়। যদি স্ক্যাণ্ডাল হয়। ভদ্রলোকেরা স্ক্যাণ্ডালকে বড়োই ভয় পান।

    জিপ থেকে প্রাণেশ নামল। মুখ দিয়ে তার ভুরভুর করে হুইস্কির গন্ধ বেরোচ্ছে।

    এখানে রাস্তাটা খুব সরু। একপাশে খাদ। ড্রাইভার এগিয়ে গেল জিপটা নিয়ে, ঘোরবার জন্য।

    অপার চোখের ওপর টর্চ ফেলে, যাতে চাঁদের আলো ওর চোখের ভাষা লুকিয়ে না রাখতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই; কেটে কেটে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

    —না তো।

    অপা বলল স্থির গলায়।—আলো সরাও চোখ থেকে।

    তোমার কিছু বলার নেই আমাকে? আলোটা সরিয়ে নিয়ে প্রাণেশ বলল।

    —আমার? না। কিছুই বলার নেই। কী থাকবে বলার?

    —কুমডিবাংলোর কম্পাউণ্ডে একটা হাতি এসেছে। সকলে বলছে, কিরিবুরুর হাতিটা। তাড়াতাড়ি জিপে উঠে এসো।

    —তুমি ওকে যেতে বলছ না? বিপদ কি আমার একার হবে হলে? হাতি তো দু-জনকেই মারতে পারে।

    প্রাণেশ ঘৃণামিশ্রিত উষ্মার সঙ্গে বলল, অত সহজে মরবার লোক উনি নন। তা ছাড়া, শিশু তো আর নন? ওঁকে আমি কী বলব? তুমি আমার বিয়ে করা বউ, দাবি, দায়িত্ব সবই আমার; তাই-ই দৌড়ে আসতে হল। ওঁর মরা-বাঁচা, ওঁরই ব্যাপার।

    —নিজেকে ছোটো কোরো না এমনভাবে।

    চাপা গলায় অপা বলল প্রাণেশকে। তারপর গলা আরও নামিয়ে বলল, লজ্জা করে আমার। তোমার ব্যবহারে লজ্জা করে।

    —লজ্জা? প্রাণেশ গলা চড়িয়ে বলল, তোমারও লজ্জা আছে নাকি? তা ছাড়া, আমি কখনোই বড়ো-ছোটো হই না। আমি সানফোরাইজড। চলো অপা, আমার সময় নেই নষ্ট করবার।

    —আমি যাব না।

    হঠাৎ শক্ত গলায় বলল, অপা।

    কথাটা বন্দুকের নল থেকে বুলেটের মতো ওর মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল।

    —যাবে না? যাবে না মানে?

    —মানে, তোমার সঙ্গে জিপে যাব না। নিরূপবাবুর সঙ্গে আমি হেঁটেই যাব।

    —নিরূপ-সুরূপ কারও সঙ্গেই তুমি হেঁটে যাবে না। উঠে এসো।

    রীতিমতো উত্তেজিত গলায় বলল প্রাণেশ।

    —না।

    —যাবে না কেন?

    —আমাদের অনেক কথা আছে।

    —কথা? কী এমন কথা যা স্বামীর সামনেও বলা যায় না?

    —স্বামী কোনো ফ্যাক্টরই নয়। এমন অনেক কথাই সব মেয়ের জীবনে থাকে, যা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বাইরে।

    —স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বাইরে বিবাহিতা স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে আবার কিছু থাকে নাকি? তাজ্জব কি বাত!

    —হ্যাঁ। একেবারেই বাইরের। তোমার বোঝাবুঝিরও বাইরে। অবশ্যই থাকে।

    ড্রাইভার জিপটা নিয়ে এসে পাশে দাঁড় করাল।

    প্রাণেশ বলল, আমি নিতে আসার পরও আমার সঙ্গে না যাওয়ার মানে তুমি বোঝো?

    —তুমি কি দ্বিরাগমন এলে?

    ঠাট্টার গলায় বলল, অপা।

    প্রাণেশ দাঁত কড়মড় করে মনে মনে বলল, এইজন্যেই মজিলপুরের জ্যাঠাইমা কনভেন্টে পড়া ফিরিঙ্গিমার্কা মেয়ে বিয়ে করতে বারণ করেছিলেন। গুরুজনের বাক্যি। বৃথা যায় না।

    —যাবে, কী যাবে না তুমি?

    —বলেছি তো। যাব না।

    বোস সাহেব স্থাণুর মতো চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন এতক্ষণ। বললেন, উঠুন অপা। উঠে পড়ুন। আপনি বড়ো বোকা। ছি! যে মানুষ ভালোবাসা বুঝতে না-পারে, সে সত্যিই বড়ো বোকা।

    অপা কী ভেবে উঠে এল, জিপে বসল।

    বলল, আপনিও আসুন। হাতিটা যদি সত্যিই এদিকে চলে আসে?

    —আসবে না; আসবে না। এক জানোয়ার অন্য জানোয়ারদের এড়িয়ে চলে।

    প্রাণেশ বলল, আমার হাসি পেল না। একটুও হাসি পেল না আপনার রসিকতায়।

    বোস সাহেব বললেন, কথা থাক। এখন আপনারা এগোন।

    বোস সাহেবের বাঁ-হাতটা কবজির কাছে জোরে চেপে ধরে অপা বলল ধমকের স্বরে, আসুন উঠে আসুন বলছি। ভালো হবে না কিন্তু না এলে।

    অবাক হলেন মানুষটা খুব। তাঁকে আজ অবধি এমন ভালোবাসামিশ্রিত আদেশের স্বরে কোনো নারী এমন করে কখনো ডাকেনি। তাও এত স্বল্পপরিচিত কেউ। রূপহীন রুখু মানুষটা অবাক চোখে চেয়ে রইলেন অপার দিকে।

    প্রাণেশ বলল, চলো ড্রাইভার; দের হো রহা হ্যায়।

    চাঁদের আলোয় জিপের মধ্যে বসা অপার চোখ দুটিকে যতটুকু ভালো করে দেখা যায় ততটুকু একঝলক দেখে নিয়ে নিরূপ বললেন, আমি আসছি। পথ তো সামান্যই বাকি আছে। আমি এখুনি আসছি।

    জিপটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

    অপার হাতের টানে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছিলেন বোস সাহেব। টাল সামলে নিলেন। জিপের টেইল-লাইটের লাল আলো দু-টি মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাল ধুলোর মেঘে ঢেকে গেল জায়গাটা। লালচে অন্ধকার যেন মুহূর্তের মধ্যে চাঁদটাকে শুষে নিল। বোস সাহেবের শরীর, মস্তিষ্ক, সমস্তই কেমন ভারশূন্য, হালকা লাগতে লাগল। চলন্ত জিপের মধ্যে থেকে প্রাণেশের মুখনি:সৃত দুটি শব্দ ‘আনসিভিলাইজড ব্রুট’। তাঁর কানের মধ্যে বাজছিল।

    বাঁ-হাতে তখনও অপার হাতের উষ্ণতা মাখা ছিল। একমুহূর্ত। তারপরই অপার হাতের গন্ধ শালফুলের মঞ্জরির গন্ধে, দূরাগত বায়ুবাহী মহুয়ার গন্ধে একীভূত হয়ে গেল। আবার তাঁর কানে তাঁর বউয়ের চুল ঝাড়ার আওয়াজ পাচ্ছেন বোস সাহেব। শাল গাছের পাতায় পাতায় হাওয়াটা ঝরনা তুলেছে। মুক্তি! আঃ চারধারে কী দারুণ অনাবিল বাধাবন্ধনহীন মুক্তি। খুব বেঁচে গেছেন। জীবনে এই প্রথমবার কোনো রক্তমাংসের নারীকে মানসিক এবং শারীরিকভাবেও ভালোবাসার মতো ভুল করে ফেলছিলেন আর একটু হলে। মানুষটি ভালোবাসার খুব কাছাকাছি চলে গেছিলেন। খুবই।

    রাত-চরা পাখির ক্বচিৎ ডাকে শিহরিত, চাঁদের আলোর বুটি-কাটা গালচের ওপর পা ফেলে ফেলে, অরণ্যমর্মরের মর্মস্থলে চোখ ও কানকে বাঁধা রেখে বোস সাহেব হাঁটতে লাগলেন, চন্দ্রাহত, প্রেমাহত হয়ে। আর অশরীরী অপা, বুটি-কাটা গালচেতে তাঁর আগে আগে নীরব পা ফেলে চলতে লাগল।

    জীবনে এই প্রথমবার মনে হয়েছিল যে, জঙ্গলে তিনি বোধ হয় পথ হারালেন।

    জিন-পরিরা বোধ হয় তাঁকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে আজ কোথাও।

    তিন

    ওঁদের মুনলাইট পিকনিক খুব জমে উঠেছে।

    পৃথ্বীরাজের মতো অপাকে ছিনিয়ে এনে হিসেবরক্ষক প্রাণেশ তার জীবনের ট্রায়াল ব্যালান্স খুব টাইমলি মিলিয়ে দিয়েছে। কাস্টিং বা পোস্টিং-এর একটি সামান্যতম ভুলও যে ট্রায়াল মেলাতে কী যন্ত্রণা দেয়, তা ভালো করেই জানে। রিলিভড হয়ে নিজের প্রায় বেহাত-হওয়া স্ত্রীকে মুঠোয় ফিরিয়ে আনার আনন্দে ও হুইস্কি খেয়ে চুর হয়ে উঠেছে। ওঁরা সকলেই বললেন, ইমোশনালি আপসেট হয়ে গেলে সহজেই মানুষ ড্রাঙ্ক হয়। তাতে দোষ নেই।

    হিসেবি মানুষদের কখনো দোষ হয় না। দোষের ভাগী সবসময়ই বেহিসেবিরা, মার্কামারা মাতাল যে, সে তো হেঁটেই আসছে। সে মানুষটা এ তল্লাটে থাকতে, মাতাল হওয়ার কলঙ্ক অন্য কারও গায়েই লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

    সকলেই দারুণ এনজয় করছেন। বড়োবিল-বড়োজামদার কাছেই যে, এত সুন্দর একটি জায়গা আছে এবং মেয়েদের নিয়ে এসেও যে, মুনলাইট পিকনিকে এমন মজা করা যায়, তা সকলেরই ধারণার বাইরে ছিল। মেয়েরা, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ দিয়ে শুরু করে এবং ‘ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে’ দিয়ে শেষ করে যাবতীয় চাঁদ সংক্রান্ত রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ফেলেছেন।

    এখন ছেলেরা কোরাসে ‘মন যে আমার কেমন কেমন করে, ঘরেতে রয় না সখী, নাগর গেছে পরের ঘরে’ গাইলেন দুলে দুলে। যে একরা হাতিটা আজ রাতে কিছুক্ষণ আগে ওইদিকে ভুল করে এসেছিল, যদি সে কাছাকাছি কোথাও থেকেও থাকত তো ছেলেদের এই কোরাস গান শুনে বড়োই ভয় পেত এবং নি:সন্দেহে ল্যাজ তুলে দৌড় লাগাত। বিষ্টু দত্তর ফোর-সেভেনটি ডাবল-ব্যারেল রাইফেলের গুলিকেও বোধ হয় বেচারি এর চেয়ে অনেক কম ভয় পায়!

    এদিকে খিচুড়িও হয়ে গেছিল।

    মুগের ডালের খিচুড়ি। সঙ্গে পেঁয়াজি, বেগুনভাজা, পাঁপড়ভাজা। চন্দ্রভান দারুণ রেঁধেছে খিচুড়িটা। গাঙ্গুলি, যাদব এবং ধর্মেন্দর তাকে হেল্প করেছিল। বাসমতী আর পানুইকেও নিয়ে আসা হয়েছিল বড়োবিল থেকে। ব্যানার্জি সাহেব ও ঘোষ সাহেবের বন্দোবস্তের কোনো ত্রুটি নেই। যেমন রাত, তেমনি কোম্পানি, আর তেমনই চাঁদ। মারমার কাটকাট। বিয়ার-হুইস্কির মুখে চন্দ্রভানের খিচুড়িতে পিকনিক একেবারে বরফির মতো জমে উঠেছে।

    মেয়েদের দলের মধ্যে বসে থেকেও যেন অনুপস্থিত ছিল অপা।

    কী-একটা পাখি ডাকছে থেকে থেকে, জঙ্গলের গভীরে উড়ে উড়ে। পাখিটা এসে বসল, একটা বড়োগাছে।

    সুস্মিতা জিজ্ঞেস করল, ঘোষদা, এটা কী পাখি?

    —ব্রেইনফিভার

    ঘোষ সাহেব বললেন।

    ব্রেইনফিভার!

    আশ্চর্য হয়ে নামটা শুনল অপা।

    চাঁদের আলোয় আলোকিত ঝাপসা গাছে পাখিটাকে দেখবার চেষ্টা করল মুখ ঘুরিয়ে। দেখতে পেল না। বুঝতে পারল না ও, চাঁদের আলোই ঝাপসা না ওর চোখ।

    খেতে বসার পর সবচেয়ে প্রথম ঘোষ সাহেবেরই খেয়াল হল, বোস সাহেবের কথা।

    আরে! মানুষটা গেল কোথায়? প্রাণেশরা তো ফিরে এসেছে প্রায় দেড়ঘণ্টার ওপর। দেখেছ! এক-জনেরও মনে হয়নি! তোমরা কী হে! সত্যি।

    ব্যানার্জি সাহেব আর ঘোষ সাহেব দু-জনেই উদযোগী হয়ে আই.টি.সি.র অভিজিৎ রায়ের জিপে জামদার কবিরাজ, দাশ আর বড়োবিলের মাইতি এবং হাজরা এই চার ইয়াংম্যানকে পাঠালেন বোস সাহেবকে পাকড়াও করে আনতে।

    আচ্ছা লোক যা হোক। সেন সাহেব বললেন। নিজে হুজুগ তুলে, নিজেই হাপিস।

    পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই ওরা সকলে হুড়মুড় করে জিপ নিয়ে ফিরে এল।

    —কী হল? হাতি? সকলে সমস্বরে শুধোলেন।

    দাস লাফিয়ে পড়ে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে।

    কী? কী? নিয়োগী সাহেব খিচুড়ি মুখে উত্তেজিত হয়ে বললেন।

    বোস সাহেবকে সাপে কামড়েছে। চিতি সাপ।

    চিতি সাপ? কী করে জানলে?

    পায়ের কাছেই উলটে পড়ে ছিল সাপটা। আমাদের দেখেই পালিয়ে গেল।

    কোথায়? কতদূরে?

    নারী ও পুরুষের মিলিত কন্ঠের ভয়ার্ত শিহরন উঠল।

    নিয়োগী সাহেব আবার বললেন, লোকটা একেবারে কমপ্লিট ক্যাওস করে দিলে। কেলেঙ্কারি কান্ড। হেড অফিসে এখন এক্সপ্লানেশান দিতে জীবন যাবে আমার।

    দাস বলল, বাংলোতে উনি প্রায় এসেই পড়েছিলেন। এই তো, একেবারে কাছেই। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, এই ঢালটা পেরোলেই দেখা যাবে। নালার পাশে, পথের ওপরেই পড়ে আছেন।

    বাঁধন দাও! বাঁধন!

    জোড্ডার ধনঞ্জয়বাবু খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন। আমাকেও কামড়েছিল! আমি তো বেঁচে আছি রে বাবা! এখনও! আশা ছাড়লে চলবে কী করে? চলো কে যাবে?

    —দড়ি। এই চৌকিদার! গাঙ্গুলি, যাদব, এই সুগান। দড়ি, দড়ি। কে যেন চিৎকার করে উঠল।

    ঘোষ সাহেব বললেন, আমি যাচ্ছি। ব্যানার্জি সাহেব আপনিও আসুন। নোয়ামুন্ডির হাসপাতালে নিয়ে যাব। ওখানকার ডাক্তাররা তো চেনেন আপনাকে। আমাকেও চেনেন।

    —তবু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ—সেন সাহেব বললেন। মেয়েদের মধ্যে থেকে কে যেন বললেন, বাড়াবাড়ির সীমা আছে। কত করে সকলে বললেন, চলে আসুন, চলে আসুন….

    —নিশ্বাস পড়ছে তো? কি দাশ?

    হিরো হিরো চেহারায় বড়ো বড়ো চুলঅলা বড়োজামদার দাস বলল, তা পড়ছে। কিন্তু এক্কেবারে ভোরের বাতাসের মতো। বাঁচবে কি না বলা যায় না।

    অপা দাঁড়িয়ে উঠল।

    অপার মনে পড়ল যে, মানুষটা বলেছিল : পথ সামান্যই বাকি। বলেছিল, এখুনি আসবে। শুধু পথের কথাটাই বলেছিল। গন্তব্যর কথাটা অব্যক্ত রেখেছিল। পুরোপুরিই। এতই কম কথা হয়েছিল মানুষটার সঙ্গে! অথচ! একবার বলেছিল, যে ভালোবাসা না বোঝে সে বড়ো বোকা! চারদিকের গোলমাল, চিৎকার, উত্তেজিত চ্যাঁচামেচির মধ্যে দাঁড়িয়ে অপা ভাবছিল, বেশ তো কাটছিল জীবন, ঘেরা টোপে; জীবনের মানে না বুঝে! কেন যে দেখা হল মানুষটার সঙ্গে!

    ঘোষ সাহেবের সঙ্গে অন্য যাঁরা যাবেন, দৌড়ে গিয়ে জিপে বসলেন। ঠিক এমন সময় অপা যূথবদ্ধা মহিলাদের মধ্যে থেকে দল ছুট হয়ে উঠে দাঁড়াল। প্রাণেশ যেখানে শতরঞ্চিতে চিত হয়ে শুয়েছিল, সেখানে গিয়ে প্রাণেশকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি যাচ্ছি, বুঝলে! তারপর স্থির পায়ে এসে ঘোষ সাহেবের পাশে সামনের সিটে উঠে বসল।

    —এ কী? এ কী? তুমি কোথায় যাবে অপা? তুমি? পাগল হলে? এ কী বউদি। নামুন, নামুন। সময় নেই একেবারেই সময় নষ্ট করবার।

    দাশ আর মাইতি একসঙ্গে বলে উঠল।

    ব্যানার্জি সাহেব কী করবেন বুঝতে না পেরে চিৎকার করলেন, প্রাণেশ, ও প্রাণেশ কোথায় গেলে? তোমার বউকে সামলাও। মুনলাইট পিকনিক! কোথা থেকে এসে একেবারে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল সবাইকে হে! হাড় জ্বালালে!

    প্রাণেশ মাতাল হয়ে গেছিল। সাফল্যে, জয়ে, বহমান, ভয়হীন জীবনে মানুষ বড়ো সহজে মাতাল হয়। হিসেবি যারা, তারা মাত্র এক রাউণ্ড লড়াইয়ের কথাই জানে। প্রাণেশ কখনো কল্পনা করেনি যে, জীবন একটা বক্সিং-রিং। যেকোনো রাউণ্ডেই যে-কেউই নক-আউট হতে পারে ভাগ্যের হাতে।

    অপা দৃঢ় গলায় বলল, আমি যাবই। আপনারা যাই-ই বলুন। এবার মেয়েরা সকলে দৌড়ে এলেন। একসঙ্গে। অনেক কথা বললেন, সমস্বরে।

    অপা অনুনয় করে বলল, প্লিজ, তোমরা আমাকে একটু বোঝো। শুধু আমাকেই নয়, তোমাদেরও……। আমাকে যেতে দাও।

    ঘোষ সাহেব বললেন, অপা। আমাদের সময় নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে।

    অপা স্থির শান্ত গলায় বলল, আমারও।

    চলুন ঘোষদা, আমরা যাই এবারে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজংলিমহল – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article চম্পাঝরন – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }