কালকে যা হ’য়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে
পলাশপ্রিয়ার আকার পাশের দোকানগুলোর থেকে বড়। সাইনবোর্ডের ক্যালিগ্রাফি নজরকাড়া। গাড়ি থেকে নেমে যেটা চোখে পড়ল, সেটা হল যে দোকানে ঢোকার রাস্তা দুটি। সামনের দিকেরটা, যেদিকটা মেইন রোডে, সেটায় শাটার ফেলা। পিছন দিকে আরেকটা দরজা আছে। শ্যামল ব্যানার্জি আমাদের সেইদিকে নিয়ে চললেন। আমরা চায়ের দোকানের পাশের গলিটায় ঢুকলাম।
দোকানের মাপ আট বাই দশ। চড়িদায় রাস্তার দুধারে বেশ কিছু হস্তশিল্পের দোকান আছে, পলাশপ্রিয়া ডানদিকের লাইনে। গা লাগোয়া ডানদিকে একটা চায়ের দোকান এবং বাঁদিকে চারফুট জায়গা ছেড়ে অন্য দোকান। চায়ের দোকানটার পাশ দিয়ে গলি রাস্তাটা ভিতরের পাড়ার দিকে চলে গেছে।
“চায়ের দোকানটায় কেউ কিছু দেখেছে? জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে?” মতিদা গলিতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন।
“দোকানটা রাত সাড়ে আটটায় বন্ধ হয়ে যায় স্যার। দোকানি বাড়ি চলে গিয়েছিল। ঘটনার সম্পর্কে কিছু জানে না।” শ্যামলস্যার হাঁটতে হাঁটতে বললেন।
ডানদিকের রাস্তাটায় ঢুকলে পিছনদিকের দরজাটা চোখে পড়ে। একটা লোহার গেট দেওয়া সরু একফালি ঘাসজমি, তার শেষে সিমেন্টের দুধাপ সিঁড়ির পরে কাঠের দুপাল্লা দেওয়া দরজা। ঘাসজমির এক কোণে টিনের শেড দেওয়া টয়লেট; টয়লেটের দরজায় তালা মারা, দরকারে খুলে নিয়ে ব্যবহার করা হয়। জমিটার চারধারে চারফুট পাঁচিল তোলা। গলির ওপাশে একটা পোড়ো জমি, জমির ওধারে লোকালয়।
পুলিশের গাড়ি দেখে ফুটপাতে কৌতূহলী জনতার ছোটখাটো জটলা হয়েছিল। সেটাকে পাশ কাটিয়ে মতিদা আর আমি ঘাসজমিটায় পা রাখলাম। ঘড়িতে এখন একটা। ওয়ারলেসে নির্দেশ পাঠালেন মতিদা, “বাড়তি ফোর্স দরকার। ক্রাউড সরাতে বলুন কুইকলি।” মতিদার হাতে সার্জিকাল ক্যাপ ছিল। আমরা বুটে সেগুলো পরে নিলাম।
গলিটার ঘাসগুলো বিবর্ণ, বুড়োটে। মধ্যে মধ্যে নুড়ি পাথর রয়েছে, শুকনো জমিতে যেমন থাকে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখেও আলাদা কিছু বোঝা গেল না। অ্যাবডাকশন হয়ে প্রায় চল্লিশ ঘন্টা হয়ে গেছে। ক্রাইমসিন ইতোমধ্যেই অনেকটা করাপ্টেড।
“এটাই এসকেপ রুট মনে হচ্ছে। সামনের দিক দিয়ে তো বেরোবে না। শাটার খোলার শব্দে লোকজনকে সচকিত করার ইচ্ছে থাকবে না।” মতিদা মন্তব্য করলেন।
শ্যামলস্যার জমির উপর খুব সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে বললেন, “অন্যদিন দোকানে হেমন্ত বলে ছেলেটাই থাকে। কাল যে নিশীথ মাহাতো ছিলেন, সেটা যে বা যারা অ্যাটাক করেছে, তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে।”
“হুম।” মতিদা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কী যেন ভাবতে ভাবতে বললেন, “আচ্ছা, দোকানের ছেলেটা কী যেন নাম, সে আর নিশীথ মাহাতোর ওয়াইফ গতকাল কোন দরজাটা খুলে ঢোকে?”
“শাটারটা।”
“লকের চাবি?”
“দুটো। একটা হেমন্তর কাছে থাকে, আরেকটা নিশীথবাবুর কাছে।”
“হুম”, মতিদা চিন্তিত মুখে বললেন, “শাটার ফেলা ছিল, লকও লাগানো ছিল?”
“হ্যাঁ স্যার। মঙ্গলবার রাতে যাওয়ার সময় হেমন্ত নিজে হাতে শাটার নামিয়ে গেছে বলেছে।” শ্যামলস্যার তোতাপাখির মত বলে গেলেন।
মতিদা ভুরু কুঁচকে বললেন, “ওকে রাতে শাটার নামাতে দেখেছে এমন সাক্ষী আছে? আর ও যে বাড়ি গিয়েছিল, সেই অ্যালিবাই চেক করা হয়েছে?”
“হ্যাঁ স্যার। সেসব ক্রসচেক করেছি। ওর নিজের অ্যালিবাই স্ট্রং। পরের দিন হোলি ছিল বলে, ওর পাড়ার কিছু ছেলেপিলে অত রাতেও আড্ডা মারছিল। মদের আসর আর কী। তারা হেমন্তকে ঢুকতে দেখেছে সোয়া বারোটা নাগাদ।”
পাঁচিল লাগোয়া পোড়ো জমিটা ছাড়িয়ে কতগুলো একতলা বাড়ি রয়েছে। পিছনের এই গলিটায় কোনো লাইট নেই। ফলে রাতে কী হয়েছিল চট করে নজরে পড়ার কথা নয়। আশেপাশের বাড়িগুলো ভালো করে দেখতে দেখতে
বললাম, “এখান থেকে হেমন্তর গ্রামে যেতে কতক্ষণ সময় লাগে?”
“ওই পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতন লাগে।” শ্যামল ব্যানার্জি কপাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন।
মতিদা টয়লেটের লকটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। দরজা টিনের, কিন্তু লকটা শক্তপোক্ত। সেটা টেনেটুনে দেখে তিনি বললেন, “এই হেমন্ত ছেলেটাকে আরেকবার ভালো করে ইন্টারোগেট করতে হবে দর্শনা। ও হয়তো সরাসরি ইনভল্ভড নয়, কিন্তু শ্যামল যেটা বলল, যে নিশীথবাবু কাল রাতে দোকানে থেকে গিয়েছিলেন, এই তথ্য ইনসাইডার হয়ে ও লিক করতে পারে।”
“হ্যাঁ স্যার। নিশ্চয়ই।”
“এই গলির দিকের দরজাটা কি খোলা ছিল শ্যামল?”
“হ্যাঁ স্যার। ওরা দুজন শাটার খুলে ঘরের ভাঙচুর দেখেছে। তারপর দরজার কাছে এসে দেখেছে এটার পাল্লাদুটো ভেজানো।”
“মানে তার আগে ওরা গলির দিকে আসেনি?”
“না।”
আমরা দরজাটার সামনে চলে এসেছিলাম।
মতিদা আর শ্যামলস্যার দুজনেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছিলেন। সিঁড়িতে সিমেন্টের উপর একটা বিশেষ দাগ দেখে আমি থমকে গেলাম।
“এটা একটু দেখুন স্যার!” আমি মতিদাকে ডাকলাম।
সিঁড়িতে হাজারো পায়ের ছাপ আর ধুলোর আস্তরণের মধ্যেও একটা প্রায় আয়তাকার কালচে খয়েরি দাগ। মতিদা নেমে এসে দাগটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন। আতস কাচের তলায় দাগটার মধ্যে জালি জালি সরু সরু খোপ কাটা ডিজাইন দেখা যাচ্ছে।
“এটা কিসের দাগ বল তো? রক্তে ভেজা বস্তা কী!” মতিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। সাধারণত কোনো মেটিরিয়াল রক্ত লেগে ভিজে গেলে, সেগুলো শক্ত সারফেসে এই রকম ছাপ ফেলে। ফেব্রিক, চুল বা চামড়ার উপর রক্তের এই ধরণের ছাপকে ট্রান্সফার প্যাটার্ন বলে। এক্ষেত্রে মেটিরিয়ালটা চটের বস্তা বলে মনে হল আমার।
“এই ছাপটার ছবি নেওয়া হয়েছে শ্যামল?” ভালো করে দাগটাকে দেখতে দেখতে মতিদা বললেন।
“আমি দেখছি স্যার।” শ্যামল স্যার শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন।
“এই নিশীথ মাহাতোর ওজন কত হবে? দৈহিক স্ট্যাটিসটিকস?” আমি ছাপটার দিকে তাকিয়ে বললাম।
“আন্দাজ পাঁচ আট। ভারি চেহারা। আশি পঁচাশি কেজি তো বটেই। কেন বলো তো?”
“না, মানে অ্যাটাকারের দৈহিক ক্ষমতার আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। মনে হচ্ছে, নিশীথ মাহাতোর শরীরটাকে বস্তায় ভরে টানা হয়েছে।”
“অ্যাটাকার না অ্যাটাকারদের? একজনই কীভাবে সিওর হচ্ছ?” শ্যামলস্যার প্রশ্ন করলেন।
“সিওর নই। আন্দাজ করছি স্যার। একাধিক হলে তো চ্যাংদোলা করে নিয়ে
যেত। একজন হলে তাকে আগে থেকে প্ল্যান করে বস্তা মজুত রাখতে হবে। একটা অচৈতন্য শরীরকে টানা তো সহজ নয়।”
“ঠিক।” মতিদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, “একটা জিনিস খেয়াল করো, ব্লাডলসটা কিন্তু প্রোফিউজ নয়। তাহলে ঘাসের উপরেও ছাপ থাকত। অন্তত খালি চোখে ধরা পড়ত।”
আমরা তিনজন ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। দরজাটা একটা তিনফুট বাই দুফুট করিডরে খোলে। করিডরের মেঝেতে বস্তা ঘষটানোর দাগ স্পষ্ট। বস্তার সুতোর জাল প্যার্টান কাটাকুটি করেছে মেঝেতে। দাগগুলো শেষ হয়েছে মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্তের একটা বড়সড় ছাপের কাছে। প্রায় ছয় সেমি ব্যাসের একটা গোলাকার বৃত্ত জুড়ে রক্ত জমাট বেঁধেছে, যেটাকে আমরা ব্লাড পুল বলি। কেন্দ্রের ব্লাড পুলটাকে ঘিরে বেশ কটা স্যাটেলাইট স্প্যাটার, ধূমকেতুর লেজের মত রক্তবিন্দু এদিক ওদিক ছিটিয়ে আছে। ব্লাড পুল থেকে আধফুটেরও কম দূরত্বে বাঁদিকের দেওয়ালে রক্তের দাগ। মেঝে থেকে আন্দাজ তিনফুট উচ্চতায়। দাগটা প্রথমে থেবড়ে গেছে, তারপর সরু রেখার মত রক্তধারা নিচে দেওয়াল বেয়ে নেমে এসেছে। ব্লাড পুল আর দেওয়ালের গ্যাপটার মধ্যেও বড় বড় রক্তের ফোঁটা।
“ভগবান!” মতিদা একটা জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। আমি মতিদার পিছনে থমকে দাঁড়িয়ে দেওয়াল দেখছিলাম।
“একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না শ্যামল। তুমি কি ব্যাপারটা খেয়াল করেছ?”
“কী স্যার?” শ্যামলস্যার মতিদার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
মতিদা হাতের রুলটা অন্যমনস্কভাবে হাতের তালুতে ঘষতে ঘষতে বললেন, “সোনালি মাহাতো আর হেমন্ত বুধবার একইসময় দোকানে পৌঁছেছে। সেটা বেলা দেড়টায়। অথচ থানায় রিপোর্ট লেখাতে এসেছে তিনটের সময়। এই দেড় ঘন্টা উনি কী করলেন? হেমন্তই বা কী করল? এই হিসেবটা তো মিলছে না!”
“বলছে তো নিশীথবাবুকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছিল। আত্মীয়স্বজনের কাছে ফোন করছিল। আমি দুজনেরই কল রেকর্ড বার করতে দিয়েছি। পেলেই আপনাকে জানাব।” শ্যামল ব্যানার্জি তড়িঘড়ি উত্তর দিলেন।
“আশেপাশের লোকজন কী বলছে? তারা কী দেখেছে?”
“হেমন্ত তাদেরকে ডেকে আনে। সবাই মিলে থানায় খবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।”
“কটার সময় ডাকতে যায়?”
“সেটা জিজ্ঞাসা করিনি স্যার।”
“মানে এই টাইম গ্যাপের ব্যাপারটা তোমার মাথাতে আসেনি?”
শ্যামল ব্যানার্জি কোনো উত্তর দিলেন না। আড়চোখে দেখলাম বিরক্তিতে ভুরুটা কুঁচকালেন।
“নিশীথ মাহাতোর কল রেকর্ডস বার করতে দিয়েছ?” মতিদা একটু বিরক্তস্বরে বললেন।
“দিয়েছি স্যার।”
“হ্যাঁ। ওটাও জরুরী। ঘটনার দিন কোনো আনলিসটেড কল এসেছিল কিনা সেটা জানা দরকার।”
“ঠিক স্যার।” শ্যামল ব্যানার্জি ঘাড় নাড়িয়ে বললেন।
“হেমন্ত আর সোনালি এদের দুজনকে থানায় ডেকে পাঠাও। দ্বিতীয় দফার জেরাটা হোক। কল রেকর্ডস কবের মধ্যে পাবে?”
“পেতে পেতে কাল বিকেল।”
“কাল সকালেই ওদের ডেকে পাঠাও দর্শনা। ফার্স্ট আওয়ারে। আর বিভাস বলে একজন আছে টিমে, ওকে বল যাতে এই কল রেকর্ডসের ব্যাপারটা ফাস্ট ট্র্যাক হয়।”
“ওকে স্যার।”
“মোবিলাইজ আদার্স অলসো। কোন গাড়িতে করে নিশীথ মাহাতোকে সরানো হয়েছে সেই ব্যাপারটায় স্পেসিফিকালি প্রচুর টাইম আর ম্যানপাওয়ার লাগবে; তুমিও পারলে দেখ। ওটা খুব জরুরী। আর আশেপাশের বাড়িগুলোতে আর দোকানে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমি দুজনকে ডেপুট করে দেবো।” মতিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“রাইট স্যার।”
“আশেপাশের বাড়িগুলোতে আমি অলরেডি খোঁজখবর নিয়েছি স্যার। কেউ কিছু দেখেনি বলছে। তবে, পুবদিকের বাড়ির এক বয়স্ক লোক বলেছেন, যে সারা রাত দোকানে লাইট জ্বলেছে।” শ্যামলস্যার কথাটা এমনভাবে বলে উঠলেন, যাতে মনে হল আর খবর নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
“এদিকে মেইন রোডে সিসিটিভি ক্যামেরা কোথায় কোথায় আছে?” মতিদা ওঁকে একটুও পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“একটা চড়িদা ছাড়িয়ে ব্যাঙ্কের এ.টি.এমের বাইরে লাগানো আছে। আর পুরুলিয়ার দিকে যেতে বড় ইমারতি জিনিসের দোকান পড়ে একটা, সেখানে। বাঘমুণ্ডির এস.বি.আইয়ের বাইরেও আছে অবশ্য।”
“হু। ফুটেজগুলো দেখতে হবে।”
আমি রক্তের দাগগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। দেওয়ালের উপরে যে ছাপটা পড়েছে, তার উপরেও আরেক ধরণের ট্রান্সফার প্যাটার্ন গড়ে উঠেছে। সরু সরু সমান্তরাল রেখা। দেখে মনে হয় আহত অবস্থায় দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বসে পড়েছিলেন। মাথার চুল রক্তে ভিজে, সরু রেখার মত ছাপ ফেলেছে দেওয়ালে।
“রক্ত কিন্তু ওদিকেও আছে।” শ্যামল ব্যানার্জি বলে উঠলেন।
“সেকী!”
“আসুন।”
করিডরটা শেষ হয়েছে আর দুপা এগিয়েই। করিডরের শেষে একটা ঘর। মেঝেতে কুড়ি পা মত এগিয়ে আবার রক্তের ছাপ। এবার অশ্রুবিন্দুর আকারে। ছোট বড় সাইজের। রক্তবিন্দুর এই ট্রেইলটা ফলো করে এগোলে একটা আলমারির সামনে পৌঁছানো যায়। কাঠের ফ্রেম, উপরের দুটো তাকে কাচের পাল্লা, নিচেরটায় কাঠের। উপরের তাকগুলো ফাঁকা। শুধু দ্বিতীয় তাকে লক্ষ্মী গণেশের একটা মূর্তি উল্টে পড়ে আছে। কোনো একটা অভিঘাতে বাঁদিকের পাল্লার কাচ চুরচুর হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। নিচে কিছু বাক্স এদিক ওদিক ছড়ানো। ক্রাফ্টের কিছু আইটেম মাটিতে পড়ে। আলমারির পাশে একটা জলভরা কুঁজো। একটা নোংরা ফেলার বালতি। মাটিতে পুরোনো দাগ দেখে বোঝা যায় বালতিটা জায়গা থেকে সামান্য সরেছে। রক্তবিন্দুগুলো কুঁজোর সামনে মেঝেতে পাশাপাশি ঘন হয়ে পড়েছে। পাল্লার কাচের মধ্যেও রক্তের অস্পষ্ট ছাপ।
শ্যামল ব্যানার্জি হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে কাঠের পাল্লাটা খুললেন। ভেতরে তিনটে তাক। কিছু বাক্স এখনও রাখা আছে। তাকের উপরে একটা ড্রয়ার। খোলা, চাবি ঝুলছে।
“এই ড্রয়ারটা থেকে টাকা গেছে।” শ্যামল ব্যানার্জি বললেন। “কত টাকা?”
“তিরিশ হাজার।”
“এটা কে বলেছে?” মতিদার কপাল কুঁচকে গেল।
“হেমন্ত।”
“হুম, এমনিতে তো ড্রয়ারটা দেখে ফোর্সফুলি খোলা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। চাবিটা জেনারেলি কোথায় থাকে?”
“চাবি ঐ বিছানাটায় বালিশের নিচে থাকে।” শ্যামল ব্যানার্জি ঘরের বাঁদিকের একটা ক্যাম্প খাটের দিকে আঙুল বাড়ালেন।
“টাকা যে তিরিশ হাজারই কী করে জানলে শ্যামল?” মতিদা আবার ভুরু কুঁচকালেন।
“হেমন্ত একটা বিলবই দেখিয়েছে স্যার। গত দুদিনে পনের হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে। আর ও বলছে ড্রয়ারে এক্সট্রা ক্যাশ ছিল পনেরহাজার টাকার।” শ্যামল ব্যানার্জি খুব সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে বললেন।
“তাতে সহজ কোনো ইনফেয়ারেন্স টানা যায় না শ্যামল। এই ইনফোটার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা দরকার। বিক্রির একটাকাও এদিক ওদিক হয়নি, এটা কেমন একটু অবিশ্বাস্য। আর নিশীথ মাহাতোর ব্যাঙ্ক ট্রান্সজাকশনের রেকর্ডটা চেক করবে দর্শনা।” মতিদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“ওকে স্যার।”
মতিদা আর শ্যামল ব্যানার্জী দুজনে খাটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। খাটের বিছানা বিন্যস্ত। একটা খবরের কাগজ আধখোলা করে রাখা। বসার ফলে এক জায়গার চাদর কুঁচকে আছে। চাদরের উপর খবরের কাগজ। পাশেই একটা টুল। সম্ভবত খাওয়ার থালা ওখানেই রাখা ছিল। কেউ যেন খেতে বসে খাওয়া ছেড়ে জাস্ট উঠে কোথাও গেছে।
খবরের কাগজের পাতাটার দিকে নজর পড়তে আমি একটু চমকে গেলাম। জেলার খবরের পাতায় ভবেশ বাউরির মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে। নিশীথ মাহাতো নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে এই খবরটা পড়ছিলেন! ওরা দুজন এই ব্যাপারটা দেখেছেন কিনা বুঝলাম না।
খাটটা ঘরের ঠিক মাঝখানে পাতা। কোণে একটা স্ট্যান্ডফ্যান। এবাদে পুরো ঘরটায় ছটা লোহার তৈরি র্যাকে শিল্পসামগ্রী গুছিয়ে রাখা। বেশিরভাগই পেপার ম্যাশের তৈরি মুখোশ, অ্যানিমাল হেড, গালার কাজ করা বাহারি ল্যাম্পশেড, চটিজুতো, মেয়েদের চুড়ি। এছাড়াও টেরাকোটার ওয়াল হ্যাঙ্গিং রয়েছে কিছু। পেপার ম্যাশের মুখোশ দেওয়ালেও ঝোলানো।
মতিদা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি বোলালেন। র্যাকের পিছনদিকগুলোও ছাড়লেন না। শ্যামল ব্যানার্জিকে বললেন, “একজন কে কর্মচারি ছেড়ে গেছে বলছ না? তার খোঁজ নেওয়া হয়েছিল?”
“হ্যাঁ স্যার। হেমন্তর বন্ধু।”
“কাজ কেন ছেড়েছিল?”
“পুরুলিয়ার হোটেলে কাজ পেয়েছে স্যার।”
“সেই ফ্যাক্ট চেক করেছ? ছাড়ার সময় কোনো মতান্তর?”
“হোটেলে ফোন করেছিলাম স্যার। সব ঠিকই আছে। এ মাসের দু তারিখ থেকে কাজে যোগ দিয়েছে।”
“হুম।” মতিদা আবার চারিদিকে নজর বুলালেন।
আমার মনে কতগুলো বিচ্ছিরি সংশয় উঁকি দিচ্ছিল। আমি আবার আলমারিটার সামনে ফেরত গেলাম। রক্তবিন্দুগুলো মন দিয়ে দেখলাম।
আসানসোলে থাকতে ডিপার্টমেন্ট একবার একটা ওয়ার্কশপে পাঠিয়েছিল। পরিষ্কার মনে আছে, এই অশ্রুবিন্দু আকারের রক্তের ফোঁটাগুলোকে লো ভেলোসিটি ব্লাড স্প্যাটার বলে। অর্থাৎ গভীর কোনো ক্ষতের ফলে ধমনী থেকে বিপুল চাপে রক্ত বেরিয়ে আসেনি। চামড়া কেটে রক্ত পড়েছে এবং গ্রাভিটির টানে রক্ত, বিন্দু আকারে ঝরে পড়েছে। অর্থাৎ আলমারির সামনে যে ধরণের ইনজুরি হয়েছে, আর করিডরে যে ইনজুরি দেখে এসেছি তা আলাদা।
মতিদাও রক্তবিন্দুগুলো লক্ষ করছিলেন। আমার কাছে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বললেন, “এখনও পর্যন্ত যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আততায়ী পিছনের দরজা দিয়ে ঢোকে, ঘরের ভিতরে ঢুকে আলমারির সামনে যায়। সেখানে একটা ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। যদি এটা সত্যিই ডাকাতির ব্যাপার হয়, ধরে নিতে হবে ক্যাশবাক্স থেকে টাকাপয়সা নেওয়ার সময় নিশীথ বাবু বাধা দিতে যান। তখন ধস্তাধস্তিতে আহত হন এবং এই রক্তপাত হয়।” মতিদা আমার দিকে তাকালেন। বুঝলাম, আমার মতামত চাইছেন।
আমার চোখ রক্তবিন্দুর পথ অনুসরণ করছিল। মেঝের দিকে তাকিয়ে বললাম “মেজর আঘাতটা হয়েছিল এই দরজার কাছে। এখানে ওঁর মাথায় হিট করা হয়, দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খান, এবং তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আততায়ী বডিটাকে বস্তায় ভরার আগে, বডি মাটিতে কিছুক্ষণ পড়ে ছিল। নাহলে মেঝেতে ব্লাডপুলটা জমত না।”
“ঠিক। এবার খুব ভাইটাল প্রশ্ন, নিশীথ মাহাতো কি আদৌ বেঁচে আছেন?”
আমি মতিদার দিকে তাকালাম। ওঁর অভিজ্ঞ মুখে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছিল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “বলা মুশকিল স্যার; সিভিয়ার হেড ইনজুরিতে তো মানুষ বাঁচে না। এবার ব্লাড লসের পরিমাণটা খুব বেশি নয়, তাই সম্ভাবনা একটা থেকে যাচ্ছে।”
মতিদা আমার কথা শুনে থুতনিতে হাত রেখে কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “এখানে তো যা দেখার মোটামুটি হল। তুমি একটু ব্যাঙ্কে চলে যাও। আমি থানায় গিয়ে সিজার লিস্টটা দেখি। একটু পরেই ফরেন্সিক এসে পৌঁছাচ্ছে, তাদের সঙ্গে থাকতে হবে।”
দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়ালাম। দুটো ভাইটাল প্রশ্ন বিছের মত মাথায় বিষাক্ত কামড় বসাতে থাকল। এক, পিছন দিকের দরজায় কে ধাক্কা দিল? সে নিশীথ মাহাতোর পরিচিত না হলে উনি দরজা খুলবেন কেন? দুই, নিশীথ বাবুকে আক্রমণের উদ্দেশ্যটা ঠিক কী! যদি ডাকাতি হয়, তবে চিনে যেতে পারেন এই ভয়ে তাঁকে এখানেই মেরে রেখে গেল না কেন আততায়ী? বস্তায় ভরে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার অর্থ কী! ঘটনার পর প্রায় দুদিন কেটে গেছে। র্যানসম ডিমান্ডও তো আসেনি! মাথার ভিতরে কে যেন বলে উঠল, “ঠাণ্ডা মাথায় ভাব দাশু। ঠাণ্ডা মাথায়।”
***
ব্যাঙ্ক থেকে কাজের ইনফর্মেশন সেরকম পাওয়া গেল না। নিশীথ মাহাতোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দুটো। একটা নিজের নামে, একটা পলাশপ্রিয়ার। পলাশপ্রিয়ার সাইনিং অথরিটি নিশীথ মাহাতোর। ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার ছাড়া ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অ্যাক্সেস দেবেন না। নিজের নামেরটা জয়েন্ট বলে, ফোনে সোনালি মাহাতোর পারমিশন নিয়ে এক মাসের স্টেটমেন্ট বার করে দিলেন। এর বেশি চাইলে রিটেন কনসেন্ট নিয়ে আসতে হবে।
এই মাসের প্রথমে নিশীথ মাহাতো চোদ্দ হাজার টাকা তুলেছেন। তারপর দুটো ক্রেডিট, একটা চেক, আরেকটা এম.আই.এস স্কিমের টাকা। অ্যাকাউন্টে সর্বমোট ব্যালান্স দু লাখ। ফিক্সড ডিপোজিট আছে ৬ লাখ টাকার। এ বাদে আর কোনো তথ্য পাওয়া গেল না।
ব্যাঙ্কের গেটে বিধুর সঙ্গে দেখা। থানার জন্য টাকা তুলতে এসেছে। অসীম আজ থেকে ডিউটি জয়েন করেছে। ভবেশ বাউরির কেসে, দসকায় গেছে। কাজটা এগোচ্ছে জেনে একটা স্বস্তি হল।
স্টেট ব্যাঙ্কের এ.টি.এমে টাকা নেই। আমার টাকা তোলার দরকার ছিল। গ্রিন চ্যানেল খারাপ, চেক বুক আনিনি। নেক্সট এ.টি.এমটা আরও চার কিমি দূরে। বিধু গাড়িতে ছেড়ে দেবে বলল। ও ওর স্বভাবসিদ্ধ টোনে কিছু খাওয়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করছিল। আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। এখন খাবার নয়, একটু খোলা হাওয়ার দরকার।
মার্চ মাসেই বেশ গরম লাগছে। গাড়িতে চড়েছি বলে একটু নিষ্কৃতি। নিউজফিড আবার চেক করলাম। গণেশ হুঁই সংক্রান্ত কোনো নতুন আপডেট নেই। কে মারতে পারে গণেশদাকে? কাকের মাংস কাকে খায় না, জোঁকের গায়ে জোঁক বসে না এই প্রবাদবাক্য এই লাইনে খাটে না। নিজের দলের লোকের হাতেই কি খুন হল গণেশদা, নাকি সাধারণ কোনো মারপিটের ফলশ্রুতি! গণেশদার সঙ্গে কাটানো বিকেলগুলোর কথা মনে পড়ল, আর নিজেই নিজের মনোবিকারে চমকে গেলাম। তিক্ত স্মৃতিও কি সময়বিশেষে হাতড়ায় মানুষ! রক্তাক্ত, বিস্ফারিত চোখের গণেশদার মাটিতে শোওয়ানো মৃত চেহারাটা কল্পনা করে মনে তৃপ্তি এল কী! এলেও তা অনুভব করতে পারলাম না। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ জুড়ে সত্যসন্ধানের যে জিলিপি রেসে সামিল হয়েছি, তার ট্র্যাকটা বড় দীর্ঘ লাগল।
“নিশীথ মাহাতো তো মরে গেছে?” বিধু গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করল। আমি চমকে উঠলাম। বললাম, “কে বললো?”
“সবাই বলছে।”
“সবাই মানে কে?”
“স্যার বলছিলেন। নিশীথ মাহাতোকে নিয়ে গিয়ে ফালা ফালা করে কেটে ফেলেছে নাকি!” বিধু হাতের এমন একটা ভঙ্গি করল যেন ছুরি দিয়ে মাখন কাটছে।
“কোন স্যার?”
“ডাক্তার স্যার। ডাক্তার উমানাথন।”
“নিশীথ মাহাতো মরে গেছে উনি কী করে জানলেন?”
বিধু সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেল। বলল, “আরে ওরকম ভাবে বলেননি। বললেন, দ্যাখ…এসব কেসে কেউ বাঁচেটাচে না। অনেক রক্তটক্ত পড়ে আছে নাকি দোকানে?”
আমি প্রশ্নটা কাটানোর চেষ্টা করলাম। নিশীথ মাহাতো যে মরে যেতে পারে, এমন গুজগুজ ফুসফুস যদি পুলিশের অন্দর থেকেই ছড়ায়, তবে বিপদ। উমানাথনই বা কোথা থেকে ডিটেইল পেলেন? অবশ্য আশ্চর্য নয়, সেদিনের মিটিংয়ের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানিয়েছে। পুলিশ মহলে লোকটার দুর্দান্ত প্ৰতিপত্তি, যা দেখছি!
বিধু একমনে গাড়ি চালাচ্ছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এসব ছাড়। আমার কাজ করে দিতে হবে।”
“কী কাজ?” বিধু সঙ্গে সঙ্গে দাঁত বার করল।
“এ তল্লাটে যত ভাড়ার গাড়ি চলে তাদের ফোন নম্বর জোগাড় করে দিতে হবে। লিগালগুলো তো ডিপার্টমেন্ট পেয়ে যাবে, ইল্লিগালগুলো লাগবে।”
“হয়ে যাবে। কালই দিয়ে দিচ্ছি।”
“আরেকটা ব্যাপার বল। তুই তো লোকাল। নিশীথ মাহাতোর সঙ্গে কারুর শত্রুতা ছিল বলে শুনেছিস কখনও?”
বিধু জিভ কেটে বলল, “ওসব বড় বড় লোকের ব্যাপার ম্যাডামদিদি। আমরা কী করে জানব?”
“না, কখনও কারুর সঙ্গে তর্কাতর্কি, কোনো গণ্ডগোল, কখনও কিছু শুনিসনি?”
“নাহ!”
আমার হঠাৎ অসীমের সঙ্গে শ্যামল ব্যানার্জির কথাগুলো মনে পড়ে গেল। “অসীমকে নিশীথ মাহাতো কোন কাজে সাহায্য করেছেন জানিস কিছু?”
“না না, আমি কীভাবে জানব?” খুব তাড়াতাড়ি উত্তরটা দিয়ে বিধু গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। দশ মিনিটের মধ্যে আমরা এ.টি.এমটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাঘমুণ্ডি থানার সীমানায় এটাই লাস্ট এটিএম এদিকে। এটার কথাই বোধহয় শ্যামল ব্যানার্জি বলছিলেন। এ.টি.এম থেকে বেরোতেই মতিদা ফোন করলেন। ফরেন্সিক টিম স্যাম্পল কালেকশন শুরু করেছে। পি.ওতে রিপোর্ট করতে হবে।
