তালটি ঠুকে তাক ক’রে যাই তীর ধনুকে
ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে গতরাতে খবরটা ফ্ল্যাশ হচ্ছিল। নিশীথ মাহাতোর খর্বকায় চেহারা, মাথাজোড়া টাক, আর মোটা নাকের নিচে কাঁচাপাকা গোঁফওয়ালা ছবিসমেত। ‘বাঘমুণ্ডির জঙ্গল থেকে প্রাক্তন মাওবাদি সমাজসেবী নিশীথ মাহাতোর বিকৃত মৃতদেহ আবিষ্কার। সন্দেহভাজন হিসেবে দোকানের কর্মচারী গ্রেফতার। তদন্তের সূত্রে উঠে আসছে একাধিক নাম। মাওবাদি যোগাযোগকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ।’
খবরে কালকের ক্রাইমসিনের ছবি বারবার ফ্ল্যাশ হচ্ছিল। বাঁশের গর্তগুলো দেখিয়ে রিপোর্টার কালকের ঘটনার যথাসম্ভব নারকীয় ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কোনো একটা চ্যানেলে দেখলাম ঘটনাটার একটা মেলোড্রামাটিক নাম দিয়েছে, “নিশীথের শরশয্যা!” চরম বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে গোটা এলাকা জুড়ে নেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন
অসীমকে কাল গভীর রাতে ওর বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়েছে। সোনালি মাহাতোর সঙ্গে অসীমের বিয়ের আগে একটা সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে। বিবাহ বহির্ভূত ভাবে সেটা চলছিল কিনা, তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ হবে। অসীম যে সে রাতে অনেক গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছে তা কনফার্ম করেছে ওর বাড়ির মালিক। মোবাইল টাওয়ার লোকেশনে ওকে চড়িদায় উপস্থিত দেখাচ্ছে। রাত ১২টার পর ওর মোবাইল সুইচড অফ হয়ে গেছে, তার পর থেকে ও কোথায় ছিল কিছুই সেরকম পরিষ্কার নয়।
আমি একটা মনিটরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ফ্রেমটা স্থির। শুধু লোকজন নড়ছে, চড়ছে; নির্বাক চলচ্চিত্রের মত। ফ্রেমটাকে মাউজ ক্লিকে পজ করে মতিদা বললেন, এই ফুটেজটা একটা এটি.এমের বাইরের সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে নেওয়া। এটাই বাঘমুণ্ডি থানার আন্ডারে শেষ এ.টি.এম। আর নিশীথ মাহাতোর দোকানের সবথেকে কাছের এ.টি.এমও বটে। এই রাস্তা ধরেই খুনীকে খয়রাবেড়ার দিকে যেতে হবে।
“হুঁ। চিনি তো।”
“ডাক্তার বলেছেন অ্যাপ্রক্সিমেট টাইম অফ ডেথ রাত সাড়ে বারোটা থেকে আড়াইটের মধ্যে। এখানে রাত দশটা থেকে ভোর চারটা অবধি ফুটেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখো। নাথিং সাসপিশাস অ্যাক্সুয়ালি। চারটে গাড়ি পাস করেছে। দুটো সুমো, একটা ইন্ডিকা, একটা পুলিশের রেগুলার পি.সি.আর ভ্যান। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু সব নর্মাল।”
“কী আশ্চর্য! আচ্ছা এই পি.সি.আর ভ্যানও তো কোনো সাসপিশাস অ্যাক্টিভিটি নোট করেনি? তাহলে তো কন্ট্রোল রুমে খবর আসত?”
“না। কোনো খবর নেই সেরকম।”
“আচ্ছা এই একটা রাস্তা দিয়েই কি খয়রাবেড়া যাওয়া যায়?”
“না। অযোধ্যা পাহাড়ের দিক দিয়েও যাওয়া যায়। কিন্তু ওদিকে রাতে টহল আছে। ভোটের জন্য চেক পোস্ট বসেছে কদিন আগে। প্রতিটা গাড়ি চেক হচ্ছে। ওদিকটা দিয়ে নিয়ে যাবে না।” মতিদা আমার দিকে ঘুরে বললেন।
আমি হতাশভাবে মাউজ ক্লিক করে করে একের পর এক ফুটেজ দেখে গেলাম।
“অসীমকে জেরা করার সময় এই পয়েন্টটায় চাপ দিতে হবে। বডি কীভাবে নিয়ে গেল খয়রাবেড়ায়!” মতিদা একটা ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন।
“আমরা কি অসীমকে খুনী ধরেই চলব?”
মতিদা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, “মানে! অন্য কোনো অপশন আছে নাকি?”
“না…মানে…”
মতিদা হাতের ফাইলটা এগিয়ে বললেন, “ফরেনসিক প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টটা পড়। দুরকম ব্লাড স্টেইন পাওয়া গেছে দোকানে, একটা বি পজিটিভ, আরেকটা এ নেগেটিভ। প্রথমটা অসীমের ব্লাড গ্রুপ, দ্বিতীয়টা নিশীথ মাহাতোর।”
ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজছিল। আমি এক কাপ ধোঁওয়া ওঠা চা হাতে নিয়ে মতিদাকে দিলাম। কোনো উত্তর দিলাম না।
মতিদা ফাইলে নোট নিতে নিতে বললেন, “ঝালদার কেসটায় অসীম নাকি সাক্ষীদের প্রভাবিত করতে চাইছিল। নিশীথ মাহাতো রাজি হচ্ছিলেন না। অসীমের বোনের বিয়ে সামনে। টেন্সড ছিল। চাকরি থেকে বসে যাওয়ার ভয়ে এমন ঘটনা ঘটাবে, জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না।
“এই কথাগুলো কে বলল মতিদা?”
“শ্যামল। ও তো স্টেটমেন্ট দেবে বলছে। অনেক দিন ধরেই চলছিল নাকি ঝামেলা।”
“আচ্ছা!” আমি অন্যমনস্কভাবে বললাম।
“কী ভাবছিস?” মতিদা লেখা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, “আপাতত দুটো খটকা। অসীম বুধবার সকালে কথাপ্রসঙ্গে আমাকে জানায় যে ওর হাত কেটেছে। কিন্তু যে মঙ্গলবার রাতেই একটা খুন করেছে…সে এই তথ্যটা পরের দিন জেনেবুঝে আমাকে দেবে কেন?”
“আর দ্বিতীয় খটকা?”
“হেমন্তর উইটনেস। অসীম সাক্ষী রেখে খুন করবে?”
“এ তো সহজ হিসাব। সোনালি, হেমন্ত, অসীম…সব তো মিলিত এরা…তিনজনে মিলে ঘটনাটাকে ডাকাতির রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে….খুবই পরিচিত মোডাস অপারেন্ডি…”
“ভীষণ পরিচিত বলেই খটকা লাগছে। অসীম, হেমন্তর মত একটা ভীরু ছেলের সাক্ষীর উপর এতটা নির্ভর করবে? সোনালি মাহাতোই বা দোকানে রক্তপাত দেখে অসীমকে এতবার ফোন করবে কেন?”
“কী বলতে চাইছিস?”
“আপাতত এটাই যে অসীম যদি খুন করেও থাকে, সেই ব্যাপারটা সোনালির জানা ছিল না বলে মনে হয়। দোকানে ঢুকে ও কিছু একটা আন্দাজ করে আর হেমন্তর সঙ্গে মিলে ব্যাপারটাকে একটা ডাকাতির রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে।”
“মানে পুলিশ ব্যাপারটাকে যাতে ডাকাতি ভেবে বিভ্রান্ত হয়?”
“হ্যাঁ। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, অসীম যে সে রাতে দোকানে আসবে বা নিশীথ মাহাতোর সঙ্গে ওর যে একটা ঝামেলা হতে পারে সে কথা সোনালি জানত।”
“তাতে কিন্তু অসীমের কেসটাই আরও দুর্বল হচ্ছে দর্শনা,” মতিদা কলমে ঢাকনা লাগাতে লাগাতে বললেন, “সমস্ত সারক্যামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স অসীমের বিরুদ্ধে। ফুটপ্রিন্ট আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে গেলে আর কিছু দেখতে হবে না। ওর অ্যারেস্ট কেউ ঠেকাতে পারবে না! তোর যুক্তিগুলো ধোপে টিকবে না।’
“কিন্তু মতিদা, যে খুনটা ও দোকানেই করতে পারত, সেটা এত দূরে কষ্ট করে করতে গেল কেন!” আমি অধৈর্য হয়ে বললাম।
“রাগ থেকে। দীর্ঘদিন ধরে রাগ জমিয়ে রেখে প্ল্যান করে খুনটা করা হয়েছে।” মতিদা শান্তভাবে বললেন।
“এক্সাক্টলি!” আমি টেবিল চাপড়ে বললাম, “যে পরিমাণ রাগ থেকে এই খুনটা করা হয়েছে, সেরকম রাগ ঘটার কি কোনো কারণ ঘটেছিল?”
“সেটা অসীমকে ভালো করে জেরা করলেই বোঝা যাবে। ঘটনাটাকে ডাকাতি আর কিডন্যাপিংয়ের রূপ দিতেও এরকম করতে পারে ও। ভুলে যাস না, এর আগে ওর বিরুদ্ধে মাথা গরম করে গুলি চালানোর অভিযোগ আছে। আমি ওকে একেবারেই ক্লিন চিট দিতে পারছি না, যতই আমার কলিগ হোক না কেন!” মতিদা একটু শক্তভাবে বললেন।
“আমি তা বলছি না মতিদা…অসীম নিশ্চয়ই খুন করতে পারে…. মোটিভ আর সুযোগ দুটোই যখন আছে…জাস্ট জেরায় বসার আগে আমি পয়েন্টসগুলো সাজিয়ে নিতে চাইছিলাম। খটকাগুলো আপনার সঙ্গে শেয়ার করছি, উত্তর পাচ্ছি না বলেই।”
“আচ্ছা বল।” মতিদা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন।
“হত্যার পদ্ধতিটা কেন মাওয়িস্ট ঘেঁষাই হতে হল? কেমন যেন একটা এক্সিকিউশন, একটা প্রতিশোধমূলক হত্যার স্টেজ সাজানো হয়েছে মনে হল না?”
মতিদা ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, “অথচ মাওয়িস্টরা কিন্তু কোনো ক্লেইমই করেনি। আর নিশীথ মাহাতোর মত হাই প্রোফাইল বিশ্বাসঘাতককে এক্সিকিউট করে ওরা চুপচাপ থাকবে এটা অবিশ্বাস্য!”
“একদমই। কিন্তু অসীমকে যদি খুনী ভেবে নিই, তাহলে ও এরকম একটা পদ্ধতি ভাবল কেন?”
“তুই বুঝতে পারছিস না দর্শনা। খুনের মোটিভ পাওয়া গেছে, ওর দোকানে যাওয়ার সাক্ষী আছে, বাকি ফরেনসিক রিপোর্ট মিলে যাবে বলেই মনে হচ্ছে…এমন অবস্থায়…”
“তাহলে যেটা মিলছে না সেটা বলি?” আমি সোজা হয়ে বসে বললাম। “কী!”
“হেমন্তর বাড়ি থেকে উদ্ধার এক লাখ কুড়ি হাজার টাকার বান্ডিল। এই টাকাটার উৎস যদি নিশীথ মাহাতোর ড্রয়ার হয়, তবে এত টাকা সেখানে কী করছিল?”
“সে তো কত প্রয়োজনেই থাকতে পারে। হয়তো ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছেন।”
“তোলেননি। আমি স্টেটমেন্ট চেক করেছি।” আমি জোর গলায় বললাম। “তাহলে হয়তো কেউ দিয়ে গেছে?”
“কে সে?”
“সেটা বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আরেকটু খোঁজখবর করতে হবে।”
“আমি কি খোঁজখবর শুরু করে দেব?”
মতিদা একটু দোনামনা হয়ে বললেন, “আচ্ছা কর। কিন্তু এ তো ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। অসীমের হাজতবাস ঠেকায় কে! আমি শুধু ভাবছি উমানাথনের প্রতিক্রিয়াটা কী হবে?”
“ডাক্তার উমানাথন? কেন! তাঁর সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?” আমি অবাক হয়ে বললাম।
মতিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “উমানাথনের কেসটা তোকে একদিন ডিটেইলে বলব। খুব ইন্সপায়ারিং গল্প। ভদ্রলোক দিলদরিয়া মানুষ। এই অসীম, বিধু, আরও কিছু ছেলেপিলে আছে আমাদের পুলিশেই, উমানাথনকে এরা নিজেদের দ্বিতীয় জনক ভাবে। পড়াশুনা করানো, চাকরির পরীক্ষা দেওয়ানো, একেবারে হাত ধরে পথ চলতে শিখিয়েছেন ভদ্রলোক। এই সব করতে গিয়ে নিজে বহুবার বিপদেও পড়েছেন। খুব দুঃখ পাবেন অসীমের খবরে।”
“গল্পটা এখনই বলুন না।”
মতিদা কিছু বলার আগেই একজন কনস্টেবল এসে জানাল বড়েরিয়া থেকে অসীমের মা বাবা এসেছেন। কান্নাকাটি করছেন আর অসীমের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেছেন। মতিদা হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন সম্ভব নয়। এখন ইন্টেরোগেশনে ঢুকব। আজই কোর্ট থেকে রিম্যান্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। অপেক্ষা করতে বলে দাও।” মতিদা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
অফিসের বেঞ্চে অপেক্ষারত দুই শীর্ণদেহ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমাকে আর মতিদাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করলেন ওঁরা। মতিদা প্রতিনমস্কার করে বসতে বললেন ওঁদের। তারপর ইন্টেরোগেশন রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
মতিদার পিছন পিছন যেতে যেতে অন্য একটা ঘটনা নজরে এল আমার। লেডিজ লকাপে সোনালি মাহাতো উঠে বসে আছে। নিশীথ মাহাতোর মৃত্যুর খবরে এক ফোঁটা কাঁদেনি মেয়েটা! ওর বডি ল্যাংগুয়েজটা অদ্ভুত। হাঁটুদুটো ভাঁজ করা, দু হাতের আঙুলগুলো ইন্টারলক করে হাঁটু দুটোতে জড়ানো, চোখে তীব্র ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা; শ্যামল ব্যানার্জি ডিউটিতে ঢুকছিলেন সেসময়। আমার মনে হল সোনালির দৃষ্টিতে এস.এইচ.ও ব্যানার্জি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন!
***
অসীম একটা চেয়ারে গুটিয়ে বসেছিল। মাথা ঝুঁকিয়ে কী যেন ভাবছিল। আমরা ঘরে ঢুকতেই মাথা উঁচু করে দেখল। এক রাতের মধ্যে ওর বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। চোখের তলায় আই ব্যাগ গজিয়েছে, চোয়াল ভেঙে গেছে। অসীমকে ক্লান্ত আর বিষণ্ন দেখাচ্ছিল।
মতিদা চেয়ার টেনে বসে গম্ভীর স্বরে বললেন, “এই ঘটনায় তোমাকে কোনোদিন জেরা করতে হবে, একেবারেই ভাবিনি অসীম! তোমার কী সমস্যা হচ্ছিল, একবার যদি কাউকে খুলে বলতে!”
অসীম মতিদার দিকে তাকাল। নিষ্পলক দৃষ্টি।
“সমস্ত এভিডেন্স এখন তোমার বিরুদ্ধে, সেটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ আলাদা করে সহযোগিতার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না বোধহয়?”
“কী জিজ্ঞাসা করবেন করুন।” অসীম ক্লান্ত গলায় বলল।
“সময় নষ্ট না করে, সরাসরি মঙ্গলবার রাতের কথা জিজ্ঞাসা করি। সেই রাতে তুমি নিশীথ মাহাতোর দোকানে গিয়েছিলে কেন?”
অসীম কোনো উত্তর দিল না।
মতিদা চেয়ারটাকে টেনে সামনে এগিয়ে বসে বললেন, “দেখ অসীম, তোমার সেদিন দোকানে ঢোকার, নিশীথ মাহাতোর সঙ্গে দীর্ঘ ঝামেলার, তাঁর সঙ্গে তোমার কথোপকথনের… প্রত্যেকটি ব্যাপারে সাক্ষী আছে। সেই দীর্ঘ প্রসেস, দীর্ঘ জেরায় আমাদের যেতে বাধ্য করবে? না, ব্যাপারটা ছেঁটে ছোট করবে?”
অসীমের মুখের পেশীগুলো শক্ত হচ্ছিল। ওর মনোভাব কিছুটা হলেও বুঝতে পারছিলাম। এতদিন টেবিলের এপারে থেকে অভ্যস্ত যে, সে কোনো ঝানু আসামির মত নো কমেন্টস বলে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারে না। তাহলে গায়ে যে সন্দেহভাজনের ছাপটা পাকাপাকিভাবে পড়ে যায়, সেটা তার থেকে বেশি আর কে জানবে!
মতিদা অধৈর্য হয়ে বললেন, “তাহলে তুমি কিছু বলবে না? বেশ…” চেয়ারটা টেনে মতিদা ওঠার উপক্রম করলেন।
“আমি নিশীথ মাহাতোকে রিকোয়েস্ট করতে গিয়েছিলাম। ঝালদার কেসটায় যদি কোনো সাহায্য করতে পারেন।” অসীম অস্ফুটে বলে উঠল।
“প্রথম থেকে বল।”
অসীম একটু থমকাল। তারপর বলল, “সেদিন ডিউটির পর আমি সরাসরি দোকানে যাই। তখন হেমন্ত দোকান থেকে বেরোচ্ছিল। নিশীথদা হিসেবনিকেশ করছিলেন। আমি গিয়ে ঝালদার কেসে সাহায্য চাই। তারপর …”
“নিশীথ মাহাতো তখন হিসেবনিকেশ করছিলেন না খাচ্ছিলেন?” আমি ওকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“হিসেব করছিলেন।” অসীম আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
“তুমি ঝালদার ঘটনায় নিশীথ মাহাতোর সাহায্যই চাইলে কেন?” মতিদা প্রশ্ন করলেন।
“ওদিকে ওঁর চেনাশুনা আছে…যদি কিছু করতে পারেন।”
“কীরকম সাহায্য চেয়েছিলে?”
“ঝালদার কেসে অনেক সাক্ষী ছিল। আমি কোন পরিস্থিতিতে গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম, অনেকেই দেখেছে। কিন্তু এখন আর কেউ সাক্ষী দিতে চাইছে না। তাই নিশীথদাকে রিকুয়েস্ট করতে গিয়েছিলাম, যদি তাদের বুঝিয়েটুঝিয়ে রাজি করানো যায়।”
“ব্যাস, এটুকুই?”
অসীম সামান্য থেমে বলল, “তারপর… নিশীথদা সাহায্য করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। আমি রিকুয়েস্ট করি, উনি রাজি হন না… কথাকাটাকাটি…. তর্কাতর্কি হয়।”
“এই নিয়ে কতবার তুমি নিশীথ মাহাতোকে অ্যাপ্রোচ করেছে?”
“সাত আট বার হবে।” অসীম একটু ভেবে উত্তর দিল।
“তোমার বোনের বিয়ে কবে?”
“অক্টোবরে।” অসীম মাথা ঝুঁকিয়ে বলল।
“টাকাপয়সার যোগাড়যন্ত্র হয়েছে?”
“করার চেষ্টা করছিলাম।” অসীমের মুখটা কালো হয়ে গেল।
“আর সাসপেনশন নিয়ে যে এনকোয়ারি বসেছে, তার শুনানি কবে?”
“সামনের মাসের আঠারো তারিখ।”
“সাসপেনশন হলে উইদাউট পে তে থাকতে, বোনের বিয়ে ভেস্তে যেত। তাই তো?”
অসীম কোনো উত্তর দিল না। প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে ঘাড়ে হাত বুলাল।
“নিশীথবাবুর সঙ্গে তো অনেকদিনই কথা হচ্ছে, এইবারই এরকম তর্কাতর্কি হয়, না আগেও হয়েছিল?”
অসীম মতিদার দিকে চোখ ঘুরাল। তারপর বলল, “এর আগে সাহায্য করবেন বলেছিলেন…সেদিন…না বলে দিলেন।”
“বেশ। তারপর কী হল?” মতিদা ঝড়ের গতিতে নোট নিচ্ছিলেন।
“তারপর কিছু না। ঝগড়াঝাটির সময় ধাক্কাধাক্কির ফলে আলমারির কাচে আমার হাতটা কেটে যায়। তারপর…
“দাঁড়াও।” মতিদা অসীমকে থামিয়ে বললেন, “কে কাকে ধাক্কা মেরেছিল?”
অসীম একটু ইতস্তত করে বলল, “ঠিক ধাক্কা নয়। আমি নিশীথদার কাঁধ ধরে…”
“থেমে গেলে কেন? বলো বলো!”
অসীম ঢোক গিলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, “আমি উত্তেজনার বশে নিশীথদার কাঁধ ধরে ফেলেছিলাম। নিশীথদা জোর করে আমার হাত সরিয়ে দিতেই হাতটা আলমারির কাচে গিয়ে লাগে। আর কেটে যায়।”
“তারপর?” মতিদা লেখা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। “তারপর কিছু না। আমি বেরিয়ে আসি।”
“বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। “মাথার ঠিক ছিল না। এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছিলাম।”
“কটার সময় বেরোও ওখান থেকে?”
অসীম ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করে বলল, “পৌনে বারোটা…বারোটা হবে…এক্সাক্ট মনে নেই।”
“তোমার ফোন সুইচড অফ ছিল কেন?” আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম। “ভালো লাগছিল না। তাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
“পলাশপ্রিয়া থেকে বেরিয়ে কী করেছিলে তার কোনো সাক্ষী আছে?” অসীম দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “নাহ! এমনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলাম। মাঠে ঘাটে বসেছিলাম। কেউ দেখেছে কিনা জানি না।”
“কোনো সাক্ষী থাকবে না। তার কারণটা আমি বলছি,” মতিদা পাশ থেকে কঠোর গলায় বলে উঠলেন, “সেদিন ঝগড়াঝাটির পর তুমি সংযম হারাও। তোমাদের মধ্যে একপ্রস্থ ধস্তাধস্তি হয়। কাচে তোমার হাত কাটে। আহত অবস্থায় তুমি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠো। নিশীথ মাহাতোকে তাড়া করো। যেহেতু সেসময় শাটার ফেলা ছিল, প্রাণ বাঁচাতে নিশীথবাবু করিডরের দিকে দৌঁড়ান। তুমি পিছনে তাড়া করো। তারপর মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেল।”
“নাহ! না।” অসীম মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করল।
“তাতেও তোমার রাগ কমেনি, তুমি মনে মনে ঠিক করো, লোকটাকে মেরেই ফেলবে।”
“না।” অসীম আবার অস্বীকার করল।
“এরপর তোমার মনে হয়, এই খুনটাকে একটা অপহরণের রূপ দিলে ভালো হয়। তোমার প্ল্যান ছিল, যে সেদিন তুমি শেষ দেখে ছাড়বে।”
“না! আপনি ঠিক ভাবছেন না।” অসীম প্রতিবাদ করে বলল।
মতিদা কর্ণপাত না করে বলে চললেন, “এরপর তুমি বাইরে যাও, বস্তা আনো, নিশীথ মাহাতোকে ভরো, তারপর খয়বাবেড়ায় নিয়ে গিয়ে মাওয়িস্ট কায়দায় লোকটাকে বাঁশের কঞ্চির মাথায় গেঁথে ফেল। তারপর সোনালি মাহাতোর সঙ্গে মিলে একটা ডাকাতি এবং অপহরণের মিথ্যে কেস সাজাও।”
“সোনালি! ও এর মধ্যে কোথা থেকে এল!” অসীম যেন আকাশ থেকে পড়ল।
“হ্যাঁ। সোনালি মাহাতো, যে তোমার সঙ্গে প্রথম থেকে এই প্ল্যানে ছিল। নিশীথবাবুকে কীভাবে সরালে অসীম?”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান।” অসীম মতিদাকে থামিয়ে বলল, “সোনালির ব্যাপারে কী বলছেন?”
“কেন তুমি জানো না?”
“না। বুঝতে পারছি না।” ও খুব অবাক হয়ে বলল।
আমি ওকে হেমন্ত আর সোনালির স্টেটমেন্ট শোনালাম। অসীমকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। খুব নীচু স্বরে বলল, “সোনালি! আশ্চর্য!”
“সোনালিকে কতদিন ধরে চিনতে অসীম?” মতিদা প্রশ্ন করলেন।
অসীম মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করছিল। মতিদা আবার বললেন, “অসীম!”
ও একটু থতমত খেয়ে বলল, “চিনি তো ছোট থেকেই। একই গ্রামে বাড়ি।”
“আর সম্পর্ক কতদিনের ছিল?”
অসীমের গালে একটা লালচে ছোপ পড়েই মিলিয়ে গেল। নীচু গলায় ও বলল, “বছর পাঁচেকের।”
“তারপর?”
“তারপর কিছু না। ওর বিয়ে হয়ে যায়।”
“সোনালির বিয়ের পরে সম্পর্কটা আবার কবে থেকে কন্টিনিউ হয়?”
“আর কন্টিনিউ হয়নি।” অসীম মতিদার চোখে চোখ রেখে বলল।
“মিথ্যে কথা বলছ। সোনালি তোমাকে ফোন করত।”
“হতে পারে। কিন্তু আমি কোনোদিন ফোন তুলিনি।” অসীম সামান্য জেদি
গলায় বলল।
“নিশীথ মাহাতো খুনে সোনালি আর তোমাকে ষড়যন্ত্র ও খুনের চার্জে গ্রেফতার করা হবে। তোমার চাকরি তো যাবেই, যাবজ্জীবন হয়ে যাবে। এখনও কোঅপারেট করো, ভালো কথা বলছি।” মতিদা গলায় সামান্য সহমর্মিতা ঢেলে বললেন।
অসীম মাথাটাকে ঝুঁকিয়ে চুলের ভিতর দিয়ে আঙুল চালাল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি সম্পূর্ণ কো-অপারেট করছি।”
“নিশীথ মাহাতোর আহত শরীরটাকে কীভাবে সরালে? বল অসীম?”
“আমি কাউকে আঘাত করিনি। কারুর বডি সরাইনি।” অসীম মতিদার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল।
মতিদা হাতের ঘড়ি দেখছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ফার্স্ট আওয়ারে টাইম দিয়েছেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে রিম্যান্ড নেওয়ার নিয়ম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের রিপোর্ট চাইবেন ম্যাজিস্ট্রেট। আমি জানতাম বেরোনোর সময় হয়ে গিয়েছিল।
মতিদা ওঠার আগে আমি বলে উঠলাম, “আরেকটা প্রশ্ন অসীম।” অসীম আমার দিকে তাকাল।
“তোমার কটা অ্যাকাউন্ট?”
অসীম প্রথমে প্রশ্নটা বুঝল না। আমি আবার বললাম, “স্যালারি অ্যাকাউন্ট ছাড়া অন্য কোনো অ্যাকাউন্ট আছে?”
“না।” অসীম একটু সতর্ক হয়ে বলল, “কেন বলুন তো?”
“জাস্ট কৌতূহল হল।”
বাইরে জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। মতিদা আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমি পিছন পিছন গিয়ে বললাম, “মতিদা, অসীম সে রাতে যে ইউনিফর্ম পরে ছিল, সেটা একবার ফরেনসিকে পাঠাবেন। ব্লাড স্পট যদি পাওয়া যায়…”
কনস্টেবলরা ওদের তিনজনকে জিপে ওঠাচ্ছিল। হেমন্ত, সোনালি আর অসীম। অসীম ওর মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। অসীমকে দেখলাম শক্ত থাকার জন্য খুব চেষ্টা করছে।
“আবার একটা টেস্ট দর্শনা! এত এভিডেন্স থাকতে…” মতিদা একটু অসহায় ভাবে বললেন।
“প্লিজ মতিদা।”
দূরে অসীমের বিধ্বস্ত বাবা মাকে দেখে মতিদা মাথা নেড়ে বললেন, “ওকে।”
কিছুক্ষণ পরে জিপটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। দুজন কনস্টেবলের মুখের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা অসীমের বিষণ্ণ, উদ্বিগ্ন মুখটা দ্রুত আমার দৃষ্টির পরিধি থেকে মিলিয়ে গেল।
