গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক’রে
ঘুমের মধ্যে উদ্ভট স্বপ্ন দেখা আমার বহুকালের অভ্যাস। আজকের স্বপ্নটা প্রচণ্ড অস্বস্তিকর ছিল। দেখলাম, মতিদা এস.পি অফিসের সামনে জিপ থেকে নেমেছেন। মিডিয়া তাঁকে খ্যাপাষাঁড়ের মত তাড়া করছে। ফুলটস বলের মত একের পর এক প্রশ্ন উড়ে আসছে। পুলিশের ভিতরেই এমন নৃশংস হত্যাকারী বসে থাকলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে, অসীম প্রামাণিকের বিরুদ্ধে এর আগে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন ডিপার্টমেন্ট তাকে বসিয়ে রাখেনি, অসীম এবং সোনালির পরকীয়া সম্পর্ক কতদিন ধরে চলছিল, সোনালি মাহাতোর একাধিক পুরুষ সংসর্গের দোষ ছিল কিনা, কী কী সূত্রের ভিত্তিতে কেসের সমাধান হল, কতদিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিল করবে পুলিশ— বেশিরভাগ প্রশ্নের গতই এরকম। কোনোটার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে, কোনোটাতে নো কমেন্টস বলে, কোনোটাতে ইনভেস্টিগেশনের স্বার্থে কিছু বলা যাবে না বলে মতিদা পেশাদারি ভঙ্গিতে ডাক করে যাচ্ছিলেন। মিডিয়া বুম নিয়ে তাড়া করে এল ওঁর দিকে। উনি তটস্থ হয়ে মুখ ঢাকলেন।
অ্যালার্মটা বেজে উঠল এই সময়ে। ভোরে থানা থেকে ফিরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি অকাতরে! ভাগ্যিস অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ফোনটা তুলে দেখি দেড়টা বাজে। চারটে মিসড কল, কুড়িটা মেসেজ। প্রথম মেসেজটাই মতিদার। নিশীথ মাহাতোর পি.এম রিপোর্টের ছবি তুলে পাঠিয়েছেন।
পি.এম রিপোর্ট অনুযায়ী নিশীথ আত্মরক্ষা করার সুযোগ পাননি। হামলা সম্পূর্ণ অতর্কিতে হয়েছে। শরীরে কোনো ডিফেন্সিভ উন্ড নেই। পাকস্থলীতে অপাচ্য খাবার রয়েছে। খাওয়ার প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে। মাথার খুলির আঘাত মারাত্মক, খুলি ফেটে রক্তপাত হয়েছে। ডাক্তারি ভাষায় একেই বোধহয় ইন্টারক্রেনিয়াল ব্লিডিং বলে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কজ অফ ডেথ নয়। বাঁশের তীক্ষ্ণ সূঁচালো কঞ্চির ফুঁড়ে যাওয়ায় প্রচুর ব্লাড লস হয়েছে ভিকটিমের। এবং একসময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে।
মতিদা মেসেজে জানিয়েছেন যে তিনজনেরই পুলিশ রিমান্ড পাওয়া গেছে। এস.পি অসীমকে স্বয়ং জেরা করবেন তাই আপাতত ওকে পুরুলিয়া সদর থানায় রাখা হবে। হেমন্ত আর সোনালি চলে আসবে বাঘমুণ্ডিতে। ডিপার্টমেন্টের উপর অসম্ভব পলিটিকাল প্রেশার রয়েছে। একমাসের মধ্যে এই মামলার চার্জশিট রেডি করে দিতে হবে বলে জানিয়েছেন এস.পি। আজ আর বাঘমুণ্ডি পি.এস ফিরবেন না জানিয়ে দিয়েছেন মতিদা।
দ্বিতীয় মেসেজ পাঠিয়েছেন পি.পি স্যার। ওঁর কাছে থেকে গণেশদার মৃত্যুর সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। এখনও কিছু জানা যায়নি সেভাবে। তবে, মৃত্যুর আগে গণেশদার ব্যারাক আর সেল চেঞ্জ হয়েছিল। জেলের খাতায় তার রেকর্ড নেই। সেটা কে করিয়েছিল জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
তৃতীয় মেসেজটা বিভাসের। ওকে অসীমের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট পাঠাতে বলেছিলাম। ও হাতের কাজগুলো সেরে কাজটা করবে জানিয়েছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বিধুকে একটা ফোন করলাম। আজ একটু নিশীথ মাহাতোর বাড়ি যাব ঠিক করেছিলাম। লোকটার অতীত সম্পর্কে যদি কিছু জানা যায়। যৌথ তদন্ত তো, আশা করি মতিদার বিরাগের কারণ হব না। দুজন কনস্টেবল সমেত দসকার দিকে রওনা দিতে দিতে আড়াইটে বেজে গেল।
বিধু গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। ওর উস্কোখুস্কো কোঁকড়া চুলগুলো হাওয়ায় আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।
“তুই কি কিছু ভাবছিস বিধু?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। ও একইরকম গম্ভীর হয়ে বলল, “না, কিছু না।”
“অসীমের অ্যারেস্টে মন খারাপ হয়েছে?”
বিধু বিষণ্ণ হেসে বলল, “মন খারাপ করে কী করব? একসাথে বড় হয়েছি। একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছি। একটু উথালপাতাল তো লাগবেই। তবে অসীমদা খুন করতে পারে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
“হুম! আমি গম্ভীরভাবে বললাম।
“অসীমদা খুন করেনি আমি জানি।” বিধু আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
আমি ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরের জানালার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তদন্তে আবেগের কোনো জায়গা নেই বিধু। অসীম খুব বিচ্ছিরিভাবে জড়িয়ে গেছে। বাঁচার চান্স আছে কিনা বলতে পারছি না।”
“আপনি পারবেন বাঁচাতে। আমি জানি।”
বিধু স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল।
“তার জন্য আর কে নিশীথ মাহাতোকে খুন করতে পারে, তা জানা দরকার। আমি তো অন্তর্যামী নই বিধু! ইনভেস্টিগেশন গড়ানোর আগেই অসীম গ্রেফতার হয়ে গেল। নিশীথ লোকটা কেমন ছিলেন…” আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম। “পরের ধনে পরধনী, সুকা বিকা মহাজনী।” বিধু গাড়ি চালাতে চালাতে বাইরে থুতু ফেলে বলল।
“মানে?”
“মানে কিছু না। পাগলের বকবক।”
আমি ওর দিকে ঘুরে বসে বললাম, “আমার প্রথম থেকেই মনে হচ্ছে তুই নিশীথ মাহাতোর সম্পর্কে অনেক কিছু জানিস। কিন্তু বলতে চাইছিস না। এর কারণ কী?”
বিধু আমার দিকে তাকাল না। গাড়ির স্পিড তুলে বলল, “দেখুন ম্যাডামদিদি। এ অঞ্চলে সব নি-কাপড়ের দল। জাড় আসলে পাথরই আড় ওদের। উঁচু উঁচু লোকেদের ব্যাপারে কথা বললে সে আড়টুকুও যাবে। আমি আর কাউকে বিপদে ফেলতে চাই না।”
“আর কাউকে বলতে?” আমি জল খেতে গিয়ে থমকে জিজ্ঞাসা করলাম। “মানে…আমার আশেপাশে, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের…”
“ও। তা বেশ। তুই বলিস না। কিন্তু যার কাছে গেলে জানা যাবে তেমন লোকের হদিশ দে।”
বিধু কোনো উত্তর দিল না।
“তোদের উমানাথন স্যারের সঙ্গে দেখা একবার দেখা করব। উনি তো এ
অঞ্চলে বহুদিন আছেন, যদি কিছু জানেন।”
“উনি কিছু জানেন না।” বিধু জোরগলায় বলে উঠল।
“সেটা আমাকেই বুঝতে দে না।”
বিধু আর কোনো কথা বলল না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ভিতরে ভিতরে ও ক্ষুব্ধ।
শেষে গাড়িটা দসকায় ঢোকার একটু আগে ও বলল, “আমি ঘটনা বলতে পারি, কিন্তু নাম বলব না। আমাকে সাক্ষী ডাকলে, একটা শব্দও বলব না। এই শর্তে যদি আপনি রাজি থাকেন, তবে আমি বলব।”
“বেশ। তাই বলবি।”
গাড়ি চারিদিকে সবুজে সবুজে মোড়া একটা গ্রামে ঢুকছিল। দুদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত, ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর, তাল, খেজুর, নারকোল, বাঁশগাছ ঘেরা শান্ত পাড়াগাঁয়ের বুক চিরে ধূসর পথ এগিয়ে গেছে। দিগন্তজুড়ে ডুংরিগুলোর অস্পষ্ট রেখা দেখা যায়। যত দূরে চোখ যায়, পথ এঁকে বেঁকে দিগন্তরেখার দিকে এগিয়ে চলেছে। একটা বাম্পারে ঝাঁকুনি বাঁচাতে বাঁচাতে বিধু বলল, “মুরুগুমা ড্যামের ওখানে চারবছর আগে একটা রিসোর্ট হয়েছিল। জমি নিয়ে স্থানীয় একটা সাঁওতাল পরিবারের সঙ্গে রিসোর্ট মালিকের ঝামেলা হয়। তার ঠিক দেড় সপ্তাহের মাথায় সে ঝামেলা মিটেও যায়। কিন্তু সেই সাঁওতাল পরিবার জমির এগ্রিমেন্টে টিপ ছাপ মেরে কোথায় চলে যায় কেউ খোঁজ পায়নি। আরও তিনবছর আগের কথা, বলরামপুরের সেল্ফ হেল্প গ্রুপে টাকাপয়সা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়। যে সব আদিবাসী মেয়েরা কাজ করত তারা কম টাকা পেয়েছে বলে অভিযোগ জানায়। সেইসময় এই এন.জি.ওর কাজে নিশীথ মাহাতো মোটা টাকা অনুদান পেয়েছিল। আদিবাসী মেয়েদের কল্যাণ, সেল্ফ হেল্পের বকেয়া টাকা এসবে কাজে লাগানোর টাকা। কিন্তু ঐ মেয়েরা তখন টাকা তো পায়ইনি, তার উপরে ওদের পরিবার যে সরকারি সাহায্যগুলো পেত, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েগুলোকেও গ্রুপ থেকে অপবাদ দিয়ে বার করে দেওয়া হয়।”
“আর?”
“আর! আর কত বলব ম্যাডামদিদি? একটু ধরাচূড়ো ছেড়ে মাঠেঘাটে নামুন, সব আঁধার কেটে যাবে। আমার বাপ বলে, আগের সরকারের জমানায় দুর্নীতির
চোটে লোকে রেশনটুকু পেত না। আর এই সরকারের আমলে পেটের ভাতটুকু হয়ত জোটে, কিন্তু পেট অবধি পৌঁছানোর আগে পিঠে এত কিল খেতে হয় যে খিদেটাই মিটে যায়।”
“নিশীথ মাহাতোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো কখনও থানায় এসেছে?”
বিধু ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, “কে করবে? উনি ভোটে দাঁড়ান না, কিন্তু এ জেলায় জনমোর্চার হর্তা কর্তা যে উনি, সেকথা সবাই জানে। কার জানপ্রাণের ভয় নেই?”
“নিশীথ তো অনেকদিন মাওবাদি দলে ছিলেন, তখন তোরা কেউ ওঁর নামে কিছু শুনেছিস?”
“আমরা সব তখন অনেক ছোট। শুনলেও মনে নেই।” বিধু রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
“তখনকার পরিস্থিতি কেমন ছিল?” আমি বাইরেটা দেখতে দেখতে বললাম।
“কেমন আবার! যেমন টিভিতে দেখাতো তেমনই।” বিধু নির্বিকারভাবে বলল।
“মানে সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি পাল্টায়নি?”
“কোথায় আর ম্যাডামদিদি! প্রথম দিকে সব ঠিকই ছিল। ওরা বলল এ জঙ্গল আমাদের। পাহাড় আমাদের। নেতারা, মন্ত্রীরা সব লুটে পুটে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের ঠেকাতে হবে। দরকারে অস্ত্র চালাতে হবে। ওদের পিছনে তখন অনেক সাধারণ মানুষের সাপোর্ট ছিল। ওদের ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত…”
“শেষ পর্যন্ত?”
“শেষ পর্যন্ত লঙ্কায় রাবণরাজা জিতে গেল। লোকে দেখল…মাও হোক, নেতা হোক, বা মন্ত্রীই হোক, কেউ সাধারণ লোকের ভালো চায় না। সবাই যে যার আখের গোছায়। অথচ কত কিছু করার ছিল। ডেইলি লেবারের কম মজুরি, চাষাবাদের অসুবিধা, স্বাস্থ্য, পড়াশুনা— কত কিছুই তো ঠিক করার ছিল! এত বড় জঙ্গলমহল জুড়ে, কত কোঅপারেটিভ করা যেত। কো-অপারেটিভ গড়ে জঙ্গলের জিনিস বেচে লাভের টাকা আদিবাসীদের হাতেই থাকত। সে সব কই হল? মাঝখান থেকে যেটুকু ডেভেলপমেন্টের কাজ হত সরকার থেকে, সেসব নষ্ট করে দিতে থাকল ওরা। আমাদের কোনো লাভ হল না দিদি।”
“আর এখন?”
“এখন তো দিকুরা এসে জঙ্গলপাহাড়ের সব মধু শুষে চলে যাচ্ছে। তাদের হেল্প করছে স্থানীয় কিছু হোমরাচোমরা। নিজের লোকেরাই যদি নিজের লোকের রক্ত চোষে, তবে সে জাতের আর কী থাকে?”
“কিন্তু তুই যে ঘটনাগুলো বললি, এগুলোতে যদি নিশীথবাবুর হাত থেকেও থাকে, তবে তো অনেকের আততায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খড়ের গাদায় সুঁচ খুঁজতে হবে।”
“এরা কেউই খুন করার ধ্বক রাখে না ম্যাডামদিদি। যদি রাখত, তবে মুখ বুজে এতকিছু সহ্য করত না। আপনি খড়ের গাদায় সুঁচ নয়, বরং আতশবাজি খোঁজার চেষ্টা করুন। আগুন লাগিয়ে সব খতম করে দেওয়ার সাহস রাখে যে।” বিধু গাড়িটাকে থার্ড গিয়ারে তুলে বলল।
***
বিধুর কথাগুলোতে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বিগত চার-পাঁচ দিন ধরে যে ঝড়টা উঠেছে, তার প্রভাবে পুরো ডিপার্টমেন্ট কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। বিধুর মন অসম্ভব খারাপ, তাই আজ চা বা অন্য কিছু খাওয়ানোর কথা বলল না। আমাকে নিশীথ মাহাতোর বাড়ির ঠিক সামনেটায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল।
এই পাড়াটা গ্রামের অন্যান্য জায়গাগুলোর তুলনায় একটু আলাদা। বেশ কতগুলো পাকাবাড়ি আছে, বর্ধিষ্ণু পরিবারের বসবাস। নিশীথ মাহাতোর বাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট সাইজের জমির উপর। গেট খুলতেই মোরাম বিছানো রাস্তা। রাস্তার দুধারে জমিতে ফুলগাছ লাগানো। জমির তুলনায় বাড়ির আকার ছোট। এল প্যাটার্নের পাকা বাড়ি। সবুজ গ্রিল দেওয়া লম্বাটে করিডর, বাঁদিকে পরপর তিনটে ঘর। এল প্যাটার্নের কোনায় রান্নাঘর, বাথরুম, পায়খানা। পিছন দিকে উঠোন; কুয়ো, তুলসীমঞ্চ, টুকটাক ফল আর ফুলের গাছপালা। একজন কনস্টেবলকে ডিউটিতে রাখা ছিল। বারান্দায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সে ঢুলছিল। এ কদিনের অযত্নে বাড়িটা থেকে সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের ঝকঝকে তকতকে ভাবটা উধাও হয়ে গেছে।
তিনটে ঘরের প্রথমটা বৈঠকখানা। একটা তক্তাপোষ, সাত আটটা প্লাস্টিকের চেয়ার, দেওয়ালে বর্তমান রাজ্যসরকারের কেষ্টবিষ্টুদের সঙ্গে নিশীথ মাহাতোর ছবি। মহান সিং, বা নিশীথের মাওবাদি অতীত সম্পর্কে বোঝা যাবে এমন কোনো চিহ্ন নেই। নিশীথ মাহাতো নিজের বিপ্লবী অতীত মুছে ফেলেছিলেন।
দেওয়ালের শোকেসে টুকটাক বইপত্র ছিল। বার করে দেখলাম সোনালি মাহাতোর নাম লেখা। কনস্টেবলরা সেগুলো নামিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করল। ঘর থেকে বেরিয়ে প্যাসেজটায় একটা ডাইনিং টেবিল পাতা। স্টিলের দুটো থালা, একটা জাগ, চারপাঁচটা চামচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আমি এগিয়ে গিয়ে পাশের বেডরুমটায় ঢুকলাম। এ নিয়ে কতবার যে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে পা দিলাম, তা নিজেই হয়তো ভুলে গেছি। প্রতিটা বাড়ির একটা নিজস্ব ভাষা থাকে। যাঁরা বাস করতেন তাঁদের টুকরোটুকরো অভ্যেস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, যা ক্রাইম প্যাটার্ন বুঝতে পরে সাহায্য করে।
নিশীথ মাহাতোর বেডরুমটা বড়। দুটো বড় জানালা থাকায় আলোকোজ্জ্বল। ঘরে টেবিলে কিছু কাগজপত্র, একটা ফুলদানিতে শুকনো ফুল, বেশ কটা ফাইল, দক্ষিণদিকের দেওয়ালে পুরুলিয়া জেলার ম্যাপ আর নিশীথ মাহাতোর একটা পুরোনো ছবি। ঠুড়গা ড্যামের ধারে দাঁড়িয়ে হাসছেন। আমি টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্রগুলো হাতড়ে দেখলাম। বেশিরভাগই হিসেব নিকেশের কাগজ, গোটা ছয়েক ভিজিটিং কার্ড। পলাশপ্রিয়া আর অন্যান্য দোকানের বিলবই, সমবায়ের কাগজ। এগুলো সব থানায় নিয়ে গিয়ে ঘাঁটব বলে মনে মনে ঠিক করলাম।
ঘরের কোনায় একটা বড়সড় গোদরেজ আলমারি, একটা ড্রেসিং টেবিল। সিঁদুরের কৌটো, লিপস্টিক, আলতা ইত্যাদি প্রসাধনী সাজানো। ড্রয়ার হাতড়াতেই আলমারির চাবিটা পেয়ে গেলাম। ভিতরটায় শাড়ি আর শার্ট প্যান্ট, পাঞ্জাবি, পাজামা এসব ভাঁজ করে রাখা। লকারটাতে বিশেষ কিছু নেই। টুকটাক গয়নাগাটি, কটা চেক বুক, এফ.ডির সার্টিফিকেট। নিশীথের অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে আলাদা কোনো ধারণা দিতে পারে, এমন কিছু নেই। আমি হতাশ হয়ে খাটটার কাছে গেলাম।
বিছানাটা সাত বাই আট, টানটান চাদর পাতা। খাটের তলায় কিছু নেই। এদিকের দেওয়ালে নিশীথ আর সোনালি মাহাতোর বিয়ের ছবি। খাটের পাশে দেওয়াল ঘেঁষিয়ে আরেকটা সরু আলমারি রয়েছে, তার মাথায় একটা সুটকেস শোয়ানো। এই আলমারির পাল্লাতেই চাবি ঝুলছিল। ভিতরে মেডিক্যাল রিপোর্টের ফাইল, বিয়ের অ্যালবাম, শীতের জামাকাপড়, কাঁসার বাসন। পাল্লাটা বন্ধ করে উপরের সুটকেসটার হ্যান্ডল ধরে টানতেই সরসর করে সামনের দিকে সরে এলো। সুটকেসটা আনলকড ছিল, ডালা খুলে দেখলাম ভিতরটা ফাঁকা। পিছন দিকে আরও কিছু রয়েছে কিনা দেখার জন্য টেবিলের কাছের চেয়ারটা টেনে নিয়ে উপরে উঠে দাঁড়ালাম। একটা বহু পুরোনো চামড়ার ছোট অ্যাটাচি দাঁড় করানো রয়েছে দেওয়ালের একদম গা ঘেঁষে। হাত বাড়িয়ে সেটাকে টানা গেল না। এদিক ওদিক দেখে, ঘরের কোণ থেকে দরজার খিলটা নিয়ে এসে একটু সরানোর চেষ্টা করতেই প্রায় আটফুট উঁচু থেকে অ্যাটাচিটা মাটিতে পড়ে গেল। লক করা। বহুদিন খোলা হয়নি বলে লকে জং ধরেছে। পাশের ঘর থেকে কনস্টেবলকে ডেকে আনলাম। ছোটখাটো তালা ভাঙার জন্য লোহার সরু শিক থাকে ওদের কাছে। লক ভাঙতে কটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া হলুদ রঙয়ের বই, শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া কাজুবাদামের একটা প্যাকেট, খান পাঁচেক পেন, ক্রেয়নের একটা প্যাকেট আর একটা বাদামী রঙের লেদার জ্যাকেট দেওয়া মোটাসোটা ডায়েরি চোখে পড়ল। বইগুলো শিশুপাঠ্য। অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি-ডি, বাচ্চাদের ছড়ার বই। উল্টেপাল্টে দেখে বইগুলো রেখে দিয়ে ডায়েরির পাতা উল্টালাম। আর পাতা উল্টিয়ে অবাক হয়ে গেলাম!
মুক্তোর মত হস্তাক্ষরে আবোলতাবোলের হরেক ছড়ার বিশ্লেষণ করে রেখেছে কেউ। হাতের লেখার প্যাটার্ন দেখে মনে হয় ছেলেদের লেখা। ছড়ার লাইন কোট করে, অবিকল সুকুমার রায়ের ধাঁচে কাঠবুড়ো, আহ্লাদী, ভীষ্মলোচন, আরও অজস্র চরিত্রের ছবি এঁকে ডায়েরির প্রতিটা পাতা নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে তুলেছে। কটা পাতা উল্টানোর পরও ডায়েরি মালিকের নামের হদিশ পাওয়া গেল না। ডায়েরিতে পাতার পর পাতা রোজনামচা লিখে গেছেন তিনি।
দু-এক পাতা পড়ে মনে হল, বাঘমুণ্ডিতেই কোনো একটা সংগঠনের তরফে শিশুদের নিয়ে কাজ করতেন ভদ্রলোক। রোজনামচার তারিখ বহু পুরোনো। ২০০৪ এ শুরু হয়েছে, ২০০৫ এর অগস্টে শেষ।
পাতাগুলো যত উল্টাচ্ছিলাম তত ধন্দ লাগছিল। বেশ কটা ছড়া লেখা ডায়েরিগুলোয়। বেশিরভাগ ছড়া আবোলতাবোলের, কিন্তু কয়েকটা নিজস্ব। সুকুমারের ছড়ার আদলে যেন নিজের ছড়া লিখে গেছেন লেখক। কিছু পংক্তি হুবহু মিলে যায়, কিছু মেলে না একেবারেই!
যেমন…
“আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা—
ছায়ার সঙ্গে কুস্তি ক’রে গাত্রে হল ব্যথা!
ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জানো না বুঝি?
সবার থেকে দুষ্ট ছায়া, রাতের ছায়া খুঁজি।”
পরের পাতার একটি এনট্রি এরকম—
“রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা
তার উপরে বসল রাজা—
নাকে যেন ঘষছে ঝামা
রেগে আগুন বদনখানা;
রাজা তুই কেমন কানা?
ছায়া চোখে পড়ে না?”
কী বলতে চাইছেন ভদ্রলোক কিছুই পরিষ্কার নয়। আমি পরপর কতগুলো পাতা উল্টালাম। কবিতাগুলো অদ্ভুত থেকে অদ্ভুততর হচ্ছিল।
আবোলতাবোলের অতি বিখ্যাত ‘ননসেন্স পোয়েট্রির’ মত করে নিজের কিছু সৃষ্টি করতে চাইছিলেন কী! এ পাতা ও পাতা পাল্টিয়ে শেষ পাতাটায় গিয়ে আবার থমকে গেলাম। রুল টানা পাতায় বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা,
“মিথ্যে লড়াই মিথ্যে ফাইট
ভেল্কি, ফাঁকি, অলরাইট।
শেকহ্যান্ড আর দাদা বল
সব শোধবোধ ঘরে চল।”
হাতের লেখা বেশ আঁকাবাঁকা, যেন খুব অন্যমনস্কভাবে দুচার লাইন লিখে গেছেন।
এর কী মানে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আবার প্রথম থেকে পাতা উল্টে রোজনামচাগুলো পড়লাম। রোজনামচার মাঝে মাঝে রাজা বলে কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের কথা লিখে গেছেন ভদ্রলোক। একটা বাক্যে গিয়ে চোখ আটকালো।
“আমাদের খেলাটা নাকি আবোলতাবোলের নিয়মে খেলতে হবে!”
ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখে অ্যাটাচিতে রেখে দিলাম। এই অ্যাটাচিটা নিশীথ মাহাতো কেন নিজের কাছে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন! ওঁর সঙ্গে এটার কী সম্পর্ক? এটা কি ওঁরই হাতের লেখা? নাকি ওঁর কোনো পরিচিতর? আদৌ এই কেসের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কী! বিভিন্ন রকম চিন্তা করতে করতে অ্যাটাচিটা হাতে নিয়ে বাইরে এলাম। কনস্টেবলের হাতে দিয়ে সিজার লিস্ট যোগ করতে বললাম। থানায় নিয়ে গিয়ে আরেকবার পড়া যাবে।
নিশীথ মাহাতোর প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। সকলের মুখে একই উত্তর— তাঁরা কিছু দেখেননি। তাঁরা কিছু জানেন না। শহরাঞ্চল হলে, ব্যাপারটা হয়তো বিশ্বাসযোগ্য হত না। কিন্তু নিশীথ মাহাতোর বাড়ির লাগোয়া বাড়িগুলি বেশ অনেকটা দূরে। প্রত্যেক বাড়িতেই সামনে ও পিছনদিকে অনেকটা করে জমি ছাড়া। গাছগাছালিতে ঘেরা। কাজেই কার বাড়িতে কী হচ্ছে তা ঐ নজরে পড়া সম্ভব নয়। ঠিক পিছনের বাড়ির ভদ্রলোক তো কথা বলতেই চাইলেন না। নিশীথ মাহাতোর সঙ্গে নাকি তাঁর কথা বন্ধ ছিল। তাঁর বাগান নিশীথবাবুর উঠোনের পাঁচিল লাগোয়া। বাগানে একাধিক নারকোল গাছ। নারকোল ঝুনো হয়ে নিশীথবাবুর উঠোনে গিয়ে পড়ত। তাতে উঠোনের সিমেন্টের মেঝেতে, পায়খানার ট্যাঙ্কে ফাটল ধরতে পারে বলে নিশীথ নাকি একাধিকবার তর্কাতর্কি করেছেন। ফলনদার নারকোল গাছ কাটাতে রাজি না হওয়ায় নিজেই, লোক ডেকে কাটিয়ে দেবেন বলে ধমকি দিয়েছিলেন।
ফোনে টুং করে একটা মেসেজ ঢুকল। বিভাস অসীমের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টের ছবি পাঠিয়েছে। ডাউনলোড করে এই মাসের এনট্রিগুলো দেখে আমার কোঁচকানো ভুরুটা একটু সোজা হল। এরকমই একটা কিছুর আশঙ্কা করেছিলাম।
