Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বৃশ্চিকচক্র – পিয়া সরকার

    পিয়া সরকার এক পাতা গল্প320 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খট্‌কা

    বড়েরিয়ায় কিছু সোর্স লাগানো ছিল। অসীম আর সোনালির মাহাতোর সম্পর্ক নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা বলে গিয়েছিলেন মতিদা। আজ থানায় ঢোকার আগে তাদের একজনের ফোন এসেছিল। ফোনটা সেরে থানার গেটে ঢুকতে যাকে দেখলাম তাকে এ সময় দেখব একবারে আশা করিনি।

    নিরঞ্জন সেন থানা থেকে বেরোচ্ছিলেন। লম্বা চেহারায় স্কাই ব্লু রঙের ডেনিম

    ব্লু জ্যাকেট, আর ডার্ক ব্লু রঙের জিনস। চোখে হালকা বাদামী সানগ্লাস। পুরোদস্তুর কেজো চেহারা।

    আমি এড়িয়ে যাব বলে বাঁদিকে হাঁটা লাগিয়েছিলাম। উনি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে ডাকলেন, “আরে পালাচ্ছেন নাকি?”

    “না, না।” আমি জোর করে হাসি টেনে বললাম।

    “কী দিনকাল পড়ল! লোকে আগে ইনসিওরেন্স এজেন্ট দেখলে উল্টো রাস্তায় হাঁটত, এখন সাংবাদিকদেরও দেখছি একই অবস্থা।”

    “না। আসলে একটু কাজ ছিল।”

    “আপনাদের কাজেই তো আসা। আর আপনিই পালিয়ে যাচ্ছেন!”

    “আমাদের কাজ? কী কাজ?”

    “বোঝো! বনপলাশীতে ছিলাম তিনদিন। থানা থেকে ফোন এল, জিজ্ঞাসা করল কিছু আনইউজুয়াল দেখেছি নাকি? আমি যা বলার বললাম, তখন বলল থানায় এসে স্টেটমেন্ট দিয়ে যান। তাই তো এলাম! বাঁকুড়া থেকে সোজা বাঘমুণ্ডি।”

    “কবে ফোন পেয়েছিলেন?”

    “আজই সকালবেলা।”

    “ওহ। আসলে ওটা অন্য অফিসার দেখছেন। আমার আজ দুপুরে ডিউটি, তাই হয়তো রিপোর্টটা পাইনি।”

    “আচ্ছা, আচ্ছা।”

    “আপনি আনইউজুয়াল মুভমেন্ট কিছু খেয়াল করেছিলেন?”

    “আরে সব গল্প কি এখানে দাঁড়িয়েই শুনবেন? লাঞ্চটাঞ্চ কিছুই হয়নি, মুখার্জি হোটেলটা…”

    “না ঠিকাছে। আমি তো স্টেটমেন্ট শিটটা দেখতেই পাবো।” আমি এড়ানোর চেষ্টা করলাম।

    “বাবা! আরে মশাই আপনি তো আমাকে বাঘের মত ভয় পাচ্ছেন দেখছি। চিন্তা নেই, অভিনন্দন রায়ের ইন্টারভিউ চাইব না। ও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর গণেশ হুঁইয়ের পুরুলিয়ার গল্পটাও শোনাব। একদম ফ্রি অফ কস্ট।” নিরঞ্জন ঝকঝকে হেসে বললেন।

    “পুরুলিয়ার গল্প!”

    “হ্যাঁ। আমাদের আজকের পেপার পড়েননি?”

    “না, মানে আমি…”

    “দাঁড়ান।” নিরঞ্জন মোবাইল খুলে স্ক্রল করে একটা ওয়েবপেজ বার করলেন।

    “নিশীথ মাহাতো মার্ডার কেস; ব্রুটালি কিলড আর্মস ডিলার গণেশ হুঁই লাইকলি টু শেয়ার এ ডার্ক পাস্ট উইথ নিশীথ মাহাতো।”

    লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো বোল্ড অক্ষরে লেখাগুলো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল।

    মুখার্জি হোটেলে লাঞ্চটাইম পেরিয়ে গিয়েছিল। অগত্যা দুজনে দুপ্লেট আলুপকোড়ি নিয়ে বসলাম।

    “আগে কোনটা শুনবেন বলুন? বনপলাশী না হুঁই?” নিরঞ্জন আয়েশ করে বসে বললেন।

    “বনপলাশী।” আমি একটু ইতস্তত করে বললাম।

    নিরঞ্জন হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে বললেন, “আপনি শুধু ক্যাপেবল অফিসার নন, একইসঙ্গে ব্রুটালি অনেস্ট আর ডেডিকেটেড। নিশীথ মাহাতোর কেসটাকে আপনি আপনার পার্সোনাল ক্রাইসিসের থেকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছেন। আপনাকে বেশিদিন এসব থানায় টানায় মানায় না।”

    “আপনিও একথা বলছেন!” আমি অবাক হয়ে বললাম। “আরও কেউ বলে বুঝি?”

    আমি চুপ করে গেলাম।

    “আই.পি.এস দেওয়ার কথা ভাবছেন না?” নিরঞ্জন প্রশ্ন করলেন।

    “নাহ! পড়ার সময় কই? আপনি বনপলাশীর ব্যাপারে কী বলছিলেন বলুন না?”

    “বেশ। তাই বলি তবে। বিশেষ কিছু নয় যদিও। দোলের আগের দিন, মানে যেদিন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হল সেদিন সন্ধের কথা। আপনি তো পুরুলিয়াতে নেমে গ্যাঁট গ্যাঁট করে জিপে চড়ে বসলেন। আমি গরীব মানুষ। বাইরে গাড়ির সঙ্গে দরাদরি করছিলাম। তখন দেখি সাক্ষাৎ ঘ্যাঁঘাসুর গোটা পরিবার সমেত পাশের গাড়িতে চেপে বসলেন। গন্তব্যটা পর্যন্ত এক মাইরি!”

    “ঘ্যাঁঘাসুর!”

    “আরে ট্রেনের সেই ভদ্রলোক। মনে নেই?”

    “ওহ! আমার সঙ্গেও একবার দেখা হয়েছিল, বৃহস্পতিবার বোধহয় …. হোলির পরের দিন।”

    “মাত্র একবার? আপনি ভাগ্যবান মহিলাসিংহ মশাই। আমার তো এবেলা ওবেলা, দরজা খুললেই। পাশের কটেজেই ছিলাম কিনা!” নিরঞ্জন করুণ মুখ

    করে বললেন।

    “ও বাবা!”

    “হ্যাঁ। তো সেইদিন সন্ধেবেলা এই ধরুন সাড়ে সাতটা নাগাদ হবে, হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজা ঠেলে বেরিয়ে দেখি ভদ্রলোক তুমুল চিৎকার জুড়েছেন। উনি ইভনিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলেও গিয়েছিলেন। ফেরার পথে, উনি এক ভদ্রলোককে দেখেন। রাস্তার ধারে বাইক থামিয়ে খয়রাবেড়ার জলে কী যেন ফেলছিলেন। দূর থেকে কী জিনিস কিছুই বুঝতে পারেননি। জিনিসটা নীল রঙের প্লাস্টিকে মোড়া ছিল, লোকটা একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকটা বার করে জলে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। খয়রাবেড়ার ধারে গিয়ে দাঁড়াবেন বলে আমাদের ঘ্যাঁঘাসুরও রাস্তা থেকে নেমে লেকের দিকে এগোন। লোকটা তখন ব্যাগ গুছিয়ে ফেরার পথ ধরবে। হঠাৎ এঁকে দেখে নাকি ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। আর এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে বাইকে চেপে পালায়। ঘটনায় ভদ্রলোকের হাঁটু ছড়ে গিয়েছিল। কনুইতেও ব্যথা পেয়েছিলেন।

    বনপলাশী রিসোর্ট প্রায় দশ কাঠা জমির উপর তৈরি করা। রিসোর্টের গেট থেকে একশ মিটার দূরত্বে সুবিশাল খয়রাবেড়া লেক। লেকের দিকে মুখ করা পরপর সারি দেওয়া কটেজ টাইপ রুম। পিছনে সবুজ পাহাড়ের ব্যাকড্রপ ঘেরা অসম্ভব নির্জন আর নিস্তব্ধ একটা পরিবেশ। প্রতিটা কটেজের ব্যালকনি থেকে লেকের গভীর টলটলে জল দেখা যায়। সামনে দিয়ে রাস্তা ঘুরে পিছনে পাহাড়ের দিকে হারিয়ে গেছে। পিছনদিকের ঐ পাহাড়েই নিশীথ মাহাতোর বডি পাওয়া গিয়েছিল।”

    “তারপর কী হল?” আমি বনপলাশীর ব্যাকগ্রাউন্ডটা মনে করতে করতে বললাম।

    “তারপর আর কী! বেচারা রিসোর্ট ম্যানেজার মাথা ঠাণ্ডা করে বোঝানোর চেষ্টা করল। ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করল। রিসোর্টের বাইরে কিছু ঘটলে তা তো আর রিসোর্টের দায় নয়। তা ভদ্রলোক কী আর এত অল্পে থামার পাত্র! পুলিশে ডায়েরি, কনজিউমার ফোরাম, গুগলে ওয়ান স্টার রিভিউ সবকিছুর ধমকি দিতে শুরু করলেন। শেষে রিসোর্ট ম্যানেজার ওঁর ছেলের সঙ্গে কথা বলে ম্যানেজ করেছে বলে মনে হল, নাহলে আরেকটু এগোলে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস অবধি চলে যাওয়াও আশ্চর্য ছিল না।” নিরঞ্জন হ্যা হ্যা করে হেসে বললেন।

    “ইন্টারেস্টিং! কবের ঘটনা বললেন?” নিরঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করলাম। “দোলের আগের দিন… মানে সোমবার।”

    “হুম। মানে যেদিন ভবেশ বাউরির বডি আবিষ্কৃত হয়।”

    “কার বডি?”

    “ও কিছু না। অন্য একটা কেস।”

    “আচ্ছা। তো আমি ভাবলাম যদি নিশীথ মাহাতো খুনের সঙ্গে এই ঘটনার

    কিছুমাত্র যোগাযোগ থাকে। তাই আর কী!”

    “অনেক ধন্যবাদ। আমি দেখে নিচ্ছি।” আমি মৃদু হেসে বললাম।

    “ধুর! আপনি মশাই খুব ফর্মাল। চারপাশে একটা দেওয়াল নিয়ে ঘোরেন। আপনার রাতে ঘুম হয়?”

    “ঘুম হবে না কেন?” আমি হেসে ফেললাম।

    “মানে আপনার কখনও বিরক্ত লাগে না?”

    আমি আলুপকোড়ি শেষ করে বললাম, “কেন?”

    “না, মানে এত কেস…. এত ক্রিমিনাল… কখনও মনে হয় না ধুত্তোরি! যা খুশি হোকগে যাক।”

    “না! আমি খুব সাধারণ মানুষ নিরঞ্জন। আমার মা একটা কথা হামেশাই বলতেন, বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর। আমি আজও বিশ্বাস করি, লেগে থাকলে দিনের শেষে কোথাও না কোথাও সত্যিটাই জেতে।”

    “কিন্তু যে আইনকানুনের সাহায্য নিয়ে আপনি এই সত্যিটায় পৌঁছাবেন, তা যে অংশত অন্ধ! একটা ইমপার্ফেক্ট ব্যবস্থা নিয়ে কতদূর এগোনো যায়?”

    “কোনোকিছুই কি পার্ফেক্ট হয় জীবনে নিরঞ্জন? যাঁরা আইন বানিয়েছেন, তাঁরাও পার্ফেক্ট ছিলেন না। পার্ফেকশন ইজ অ্যান ইমপসিবল পসিবিলিটি। তাই আইনকানুনেও গলদ আছে। কিন্তু আইনের মাধ্যমে ন্যায়নিষ্ঠ, যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য মানুষের যে সংগ্রাম, তাই বা কম কী? এই জার্নিটাকে আপনি অস্বীকার করবেন কীভাবে?”

    “এনকোর! এনকোর!” নিরঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করার ভঙ্গি করলেন।

    “ইস! খুবই বাজে লেকচার দিয়ে ফেললাম। এরকমই বাজে বকিয়ে আপনি আজকের ঘুমটার বারোটা বাজাবেন, তাড়াতাড়ি গণেশদার গল্পটা শুরু করুন।”

    “লম্বা গল্প, শুনবেন তো? আর এই গরীব অশিক্ষিত সাংবাদিকের ভাঁট বলে খবরটাকে ইগনোর করবেন না। খবরটার পেছনে কিন্তু সলিড খাটাখাটনি আছে।”

    “আমি কিন্তু অলরেডি অল ইয়ার্স।”

    আলুপকোড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আরও দুপ্লেট অর্ডার দিয়ে নিরঞ্জন সিগারেট ধরালেন।

    “জঙ্গলমহলে মাওবাদী হামলার ক্রোনোলজিটা অনেকটা এরকম—

    ২০০৩ এর অক্টোবরে বান্দোয়ান থানার এস.এইচ.ও রাধামাধব দাশের হত্যা দিয়ে যে হামলার টাইমলাইন শুরু, সাত বছর পরে ২০১০ এর উর্মা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার সহ চারজন কর্মচারীকে অপহরণ দিয়ে শেষ। এই বিরাট টাইম পিরিয়ড ধরে গোটা এলাকায় মাওবাদী সন্ত্রাস কীভাবে চলেছিল আর কেন চলেছিল, তা নিয়ে থিসিস লেখা হয়েছে প্রচুর। আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি সম্পূর্ণ অন্য একটা অ্যাঙ্গলে বলি।”

    নিরঞ্জনের সিগারেটের লাল ফুলকি জ্বলছিল নিভছিল।

    “সেইসময়ে মাওয়িস্টরা যে ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করতেন, যেমন ধরুন, নাইন এম.এম বল বুলেট, 0.303 অ্যামিউনিশন, 5.56 ইনশাস, 7.62 মিমি বল বুলেট, কালাশনিকভ, অটোমেটিক রাইফেল, অ্যান্টি পার্সোনেল মাইন…. কী ছিল না বলুন তো? এবার প্রশ্ন হচ্ছে এই আর্মস অ্যান্ড অ্যামিউনিশনের ফান্ডিংগুলো আসত কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমি একসময় রাজ্যের আর্মস স্মাগলিংয়ের বিগত কুড়ি বছরের ইতিহাস ঘেঁটেছিলাম। গণেশ হুঁই সম্পর্কে আলাদা করে কিছু জানার জন্য নয়। ওর সম্পর্কে ইন্টারেস্টটা তৈরি হয় নবগ্রামের অস্ত্র মামলার পর। গত ছমাস ধরে কিছু পুরোনো সোর্স ধরে গণেশের প্রোফাইলটা ঘাঁটি আর এই কানেকশনটা বেরোয়।”

    “আপনার এই সোর্স বিশ্বাসযোগ্য?”

    “একশভাগ। মহম্মদ ইকবাল বহুদিন ধরেই গণেশ হুঁইয়ের সাথী, বন্ধু। সে না বললে আমি আর কোথা থেকে কানেকশনের খবর পাব? আর ন্যাশনাল নিউজপেপারে মনগড়া কাহিনী ছাপলে তো দুদিনে ছবি হয়ে যাব।”

    “আপনার টাইমিংটাও মোক্ষম! কানেকশনের খবরটা একেবারে সঠিক সময়ে পাবলিশ করলেন!”

    নিরঞ্জন হো হো করে হেসে বললেন, “ঐটাই তো সব ম্যাডাম! সময়টা মোক্ষম হতে হবে! কাজের সুবাদে হাতে বহু তথ্য আসে। কিন্তু সবই যদি একেবারে ছাপিয়ে দিই, তবে তো আর ঐ প্রবাদটা খাটে না। কী যেন বেশ? লোহা গরম…”

    “লোহা গরম থাকতে থাকতে হাতুড়ি মারো।”

    “ঠিক! এদিকে পুরুলিয়ায় নিশীথ মাহাতো মারা গেলেন, ঐ দিকে মুম্বাইয়ের জেলে গণেশ হুঁই। দুজনেই পুরুলিয়ার মাওয়িস্ট অতীতের সঙ্গে জড়িত। এমন অদ্ভুত সমাপতন দেখা যায় না, কী বলুন? মৃত্যুতেও কেমন এক হয়ে গেলেন!” নিরঞ্জন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

    “কিন্তু গণেশদা কীভাবে এই গোটা ব্যাপারটায় জড়িয়ে পড়লেন, সেটা বলুন।”

    “সে গল্প বলিউডি মুভিকেও হার মানাবে। পুলিশের বিশ্বাসযোগ্য খোঁচড় থেকে আর্মস স্মাগলার হয়ে ওঠার এই জার্নিটায় গণেশ হুঁইয়ের গোটা জীবনটাই পাল্টে গিয়েছিল। নিন খান,” নিরঞ্জন আমার দিকে আলুপকোড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন।

    গরম আলুপকোড়ি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। নিরঞ্জন জিভে ছ্যাঁকা সামলাতে সামলাতে বললেন, “নিরানব্বই সালের ঘটনা। ঠাকুরপুকুর ট্রাম ডিপোর মাঠে একটা ট্রাক থেকে কোটি টাকা মূল্যের বেআইনি আফিম ধরে কলকাতা পুলিশের একটা ইউনিট। শুট-আউটে মারা যায় ড্রাগ র‍্যাকেটের মূল পাণ্ডা ন্যাটা বাপি। গুলি কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর রক্তিম পাল চালিয়েছিল বলে প্রচার পেলেও, ধস্তাধস্তির সময় গুলিটা আসলে চলে গণেশের হাত থেকে; রক্তিমেরই সার্ভিস রিভলভার ব্যবহার করে। ট্রাকে বাপির যে সাকরেদ ছিল সে পালায়। গণেশ হুঁই মার্কড হয়ে যায়। এই লাইনে রাইভ্যালরি খুব মারাত্মক জিনিস। বেশ কয়েকবার প্রাণঘাতী হামলা থেকে বাঁচে গণেশ। এর ঠিক ছমাস পরে চেতলার কাছে একটা খুনোখুনির কেসে গণেশকে ফাঁসিয়ে দেয় ন্যাটা বাপির গ্যাং। জেলে দেখে নেব এই টাইপের কোনো প্ল্যান ছিল বোধহয়।

    কলকাতা পুলিশ সময়কালে গণেশকে অ্যাবানডন করে, আর হুঁই জেলে চালান হয়ে যায়। শোনা যায়, জামিনের ব্যাপারেও নাকি পুলিশের তরফ থেকে কোনো হেল্প করা হয়নি।”

    “হুম!” আমি গম্ভীর হয়ে বললাম।

    “জেলে গণেশের আলাপ হয় মুন্না হাকিব বলে ন্যাটা বাপির রাইভাল দলের সঙ্গে। তারা গণেশকে লাইনের নিয়মকানুন শেখায়। আর বলে একটাই শর্তে জামিনের ব্যবস্থা হবে। গণেশকে ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। পুলিশের ঘরে চোরের আর চোরের ঘরে পুলিশের খবর চালান দেওয়া। ডেঞ্জারাস গেম। ততদিনে জেলে ন্যাটা বাপির দলের অত্যাচারে গণেশের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সে রাজি হয়ে যায়। এবং জামিন পেয়ে বাইরে আসে।”

    “তারপর?”

    “তারপরের গল্পটা আপনার আর শুনতে ভালো লাগবে না। যে উর্দিটা আপনি পরে থাকেন, সেই একই উর্দিকে অনেক পাষণ্ড ইচ্ছামত ব্যবহার করে এসেছে দিনের পর দিন। গণেশের জেল পরবর্তী গল্পটা সেইরকমই কিছু উর্দির অবদান।”

    “আপনি বলুন। আমি শুনছি। এত বড় একটা আর্মস র‍্যাকেট চালাতে গেলে ডিপার্টমেন্টের ইনসাইডারদের হেল্প লাগে সেটা না বোঝার মত বোকা আমি নই।” আমি নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললাম।

    “বেশ। শুনুন তবে। কন্ট্রাব্যান্ড মানে ড্রাগের বাজারে একটা শব্দের খুব প্রচলন আছে। লুক অ্যালাইক। যেমন ধরুন হেরোইনের লুক অ্যালাইক হল বোরিক পাউডার। আফিম থেকেই হেরোইন তৈরী হয়। কালারের ডিফারেন্স এতটাই মাইক্রোস্কোপিক লেভেলের যে খুব এক্সপার্ট চোখ ছাড়া সেটা ধরা সম্ভব নয়। জামিন পাওয়ার পর গণেশ ড্রাগ ব্যবসায় ভিড়ে যায়। এবং একদল পুলিশ অফিসারের সৌজন্যে এই লুক অ্যালাইকের ট্রিকটা শিখে যায়। যা ড্রাগ বাজেয়াপ্ত হত, তার সত্তরভাগ বোরিক অ্যাসিড দিয়ে রিপ্লেস করে প্যাকেটের পর প্যাকেট আসল ড্রাগ সরিয়ে, বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হত। বিরাট মুনাফা! তারপর সবাই মিলে লাভের গুড় ভাগ করে নেওয়া। গণেশ খুব অল্প দিনেই নিজের ট্যালেন্ট দেখালো এবং পাকেচক্রে কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়ল জঙ্গলমহলে।”

    “কীভাবে?”

    “নদীয়া আর মুর্শিদাবাদে তখন বেআইনি পোস্ত চাষের রমরমা। নাওদা, বালিয়া, ডমকুল, তেহট্ট, করিমপুর আর ঐদিকের মুর্শিদাবাদের হরিহরপুর; ৫০০০ থেকে ২০০০০ টাকা জমি প্রতি লিজে মাওবাদীরা পোস্ত চাষ করতে শুরু করল। এক কেজি পোস্তর দাম উঠল ৩৫০০০ টাকা। ড্রাগ তৈরি করার মোক্ষম উপাদান। লাভের টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনত আলট্রারা। এই পোস্ত কেনাবেচা করতে গিয়েই গণেশের সঙ্গে মাওয়িস্টদের আলাপ।”

    “সেখান থেকে অস্ত্র ব্যবসায় ঢুকে পড়া?”

    “একদম। গণেশ হুঁইয়ের মাথা শার্প ছিল। ততদিনে ডাবল এজেন্টের কাজ করে সে হাত পাকিয়েছে। সে বুঝল, জঙ্গলমহলে অন্তত দশ পনেরো বছর অস্ত্র ব্যবসা রমরমিয়ে চলবে। টাকাও বাতাসে ভাসবে। অতএব…”

    “গণেশ হুঁই সেসময় পুরুলিয়ায় কার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন, মানে প্রাইমারি পয়েন্ট অফ কনট্যাক্ট কে ছিল? নিশীথ মাহাতো কি?”

    “হতেই পারে।” নিরঞ্জন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।

    “আপনার এই সোর্সের সঙ্গে একবার কথা বলা যায়?”

    নিরঞ্জন একটু সতর্ক হয়ে বললেন, “তা কী আর বলা যায়? উর্দি পরার একটু অসুবিধাও তো আছে ম্যাডাম, লোকে বিশ্বাস করবে না।”

    “গণেশ হুঁই কি এখানেও ডাবল এজেন্টের ভূমিকা পালন করত?”

    নিরঞ্জন উত্তরে একটা শ্রাগ করে বললেন, “হতেও পারে। আমি ঐ রিপোর্টে সেই সম্ভাবনার কথা লিখেওছি। কিন্তু কোনো সলিড প্রুফ আমার কাছে নেই। কাজেই কোনো মন্তব্য করতে পারব না।”

    “আসলে গোটা খবরের সত্যতাটা….”

    “আরে মিথ্যে হলে শূলে চড়াবেন না হয়…”

    “কী যে বলেন!”

    নিরঞ্জন হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “আরে আমি লোকটা জল মেশানো হতে পারি, খবরগুলোয় জল নেই। নিশীথ তখন এরিয়া কমান্ডার ছিলেন। কাজেই দুজনেই দুজনকে চিনত এ আমি একেবারে সিওর।”

    “হতেই পারে। কিন্তু নিশীথ মাহাতো মার্ডার কেসে গণেশদার কোনো হাত থাকা কষ্টকল্পনা! দুজনে দুহাজার কিলোমিটার দূরে ছিল।”

    “আহা! গণেশের হাত না থাকুক, কিন্তু অন্য কোনো অদৃশ্য সুতো এদের দুজনকে বেঁধে ছিল কিনা আপনি কী করে জানলেন? ঈশ্বরের অদৃশ্য হাত টাইপ?” নিরঞ্জন দাঁত বার করে হেসে বললেন।

    আমি কোনো উত্তর দিলাম না। অদৃশ্য হাতের খোঁজ তো গত আঠারো বছর ধরে করছি। বিছানার মধ্যে ছন্নছাড়া মার শরীরের দৃশ্যটা আমার মাথার মধ্যে আবার পেরেক ফোঁটার মত বিঁধে গেল।

    ***

    বনপলাশীর রেজিস্টার থেকে বয়স্ক ভদ্রলোকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব বলে দিলেন ম্যানেজার। লোকটির নাম হীরক দত্ত, বাড়ি হাওড়া। সমস্যা হল ফোন করতেই। বাঘমুণ্ডি থানা থেকে ফোন করছি জেনে ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে দিলেন। তারপরে ট্রাই করতে ফোনটা বন্ধ পেলাম। আশ্চর্য তো!

    বনপলাশীর বোর্ডারদের আগে একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছিল, কাউকে ফোনে, কাউকে সরাসরি। তখন কী এই লোকটাকে জেরা করা হয়েছিল! বিভাস বনপলাশীর চার্জে ছিল। ওকে ফোনে ব্যাপারটা বলতে ও দেখে বলবে জানাল। খয়রাবেড়া লেকের একটা অংশ বনপলাশীর মেইন গেটের সিসিটিভির রেঞ্জে। বিভাসকে সোমবার সন্ধের ফুটেজ চেক করতে বললাম। মঙ্গলবার রাতে নিশীথ মাহাতো খুন হয়েছেন। সোমবার সন্ধেবেলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি জলে কিছু ফেলতে এসেছিলেন, এবং ধরা পড়ে যাওয়ায় তড়িঘড়ি পালান। ব্যাপারটা একেবারে ফেলনা নয়।

    সোনালি মাহাতোকে আমার কিছু প্রশ্ন করা বাকি ছিল। তার উত্তর একমাত্র ওর কাছেই পাওয়া যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিছুক্ষণ পরে সিভিক ভলান্টিয়ার সোনালিকে রুমে দিয়ে গেল। শাঁখা পলা খুলে সিঁদুরের ছাপ মুছে ফেলেছে ও। ওকে আর আগের মত জেদি লাগছিল না। গত দুদিনের আত্মবিশ্বাস কোথায় যেন টাল খেয়েছে। দেখে মনে হল ও একদম ভালো নেই।

    “বসো।” চেয়ারটা দেখিয়ে ওকে বললাম।

    “আমি ঠিক আছি।” শীতল কণ্ঠে বলল সোনালি।

    “না বসলে প্রশ্ন করব কীভাবে?”

    “আর কী হবে প্রশ্ন করে…সব তো শেষ হয়ে গেল…” সোনালির গলা ধরে এল।

    “কী শেষ হয়ে গেল?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

    ও আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন এই সামান্য কথাটুকু বুঝতে না পারায় আমি ওকে বিরাট অবাক করেছি। ও আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকল। ওর মুখ চোখ দেখে মনে হল একটা ভয়ানক ঝড় আসতে চলেছে।

    “কটা প্রশ্ন…নতুন করে করব…বসো এখানে।” আমি ওকে আবার বললাম। “খালি প্রশ্ন…প্রশ্ন…আর প্রশ্ন…কী করবেন আপনি এত প্রশ্ন করে? অসীমের তো জেল হবে। তাই না?” সোনালি বহু কষ্টে অবরুদ্ধ ক্ষোভদুঃখ আটকে রেখেছিল। এটা স্বভাববিরুদ্ধ বলে ওর কষ্ট হচ্ছিল বেশি।

    “কটা প্রশ্নের উত্তর পেলে সে সম্ভাবনা একটু কমবে।”

    “আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।” ও তীব্র রাগ নিয়ে আমার দিকে তাকাল। “তাতে আমার কী লাভ?” আমি শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলাম।

    “একথা ওকথায় আরও তথ্য বার করে আপনি অসীমকে আরও ফাঁসিয়ে দেবেন। আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না।”

    “আপাতত একটা প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দিতেই হবে সোনালি। এর উপর গোটা কেসের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। অসীমের চাকরি কতটা কী বাঁচাতে পারব জানি না, হয়তো হাজতবাস আটকাতে পারি।”

    সোনালি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। খানিকক্ষণ ওর মনে মনে একটা যুদ্ধ চলল; বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল। তারপর ইতস্তত করে বলল, “কী… কী জানতে চাইছেন? কী ধরনের তথ্য?”

    “আপাতত এটুকুই যে, অসীমের স্যালারি অ্যাকাউন্টে লোনের পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে থেকে সদ্য সদ্য একলাখ টাকা তোলা হয়েছিল কেন?”

    সোনালি মাহাতোর মুখ থেকে কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে রক্ত শুষে নিল। আতঙ্কিত হয়ে ও বলল, “আমি…আমি কিছু জানি না।”

    “তুমি সব জানো সোনালি। বলো, নাহলে অসীম আরও বিপদে ফাঁসবে।”

    “সে কথা…না…কোনো কথা নেই…আমি কিছু জানি না।” সোনালি অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল।

    আমি রেকর্ডার অফ করে চেয়ারে হেলান দিলাম। তারপর বললাম, “ঠিক তিরিশ দিন সময়, এর মধ্যে চার্জশিট তৈরি হবে। সেকশন ৩০২, ৪৪৭, ৩৬৩, ৩২৫, ৪২৭, ৫০৬, ৩৪ আইপিসি ধারা লাগবে, যাবজ্জীবন তো বটেই, সঙ্গে জরিমানা, অনাদায়ে আরও কিছু বছর জেল। তুমি রেডি তো?”

    ও কোনো উত্তর দিল না। ভয়, সংশয় আর দ্বিধা নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি অপেক্ষা করছিলাম, জানতাম ও বলবে। কিছুক্ষণ পরে ফ্যাঁসফেসে গলায় ও বলল, “আমি যদি সবটা বলি তবে আপনি কথা দিতে পারেন যে ওর কিছু হবে না?

    রেকর্ডার অন করে বললাম, “পুলিশ কথা-টথা দিতে পারে না। তবে নির্দোষের যাতে সাজা না হয় সেটা দেখা আমাদের কাজ। তার জন্য সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো দরকার।”

    সোনালি চোখের জল মুছে বলল, “বলুন কী জানতে চান।”

    জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ আসছিল। সারা ঘরে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, শুধু মাথার উপরের পাখাটা খটখট শব্দ তুলে ঘুরে যাচ্ছিল। সোনালির বিপন্ন, অপরাধী মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুমি তোমার থেকে প্রায় পনের বছরের বড় নিশীথ মাহাতোকে বিয়ে করলে কেন?”

    ও এই প্রশ্নটা আশা করেনি। চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফেলল। তারপর বলল, “এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি একান্তই জরুরি?”

    “হ্যাঁ।”

    “বাড়ি থেকে জোর করেছিল বলে বিয়ে করেছিলাম।” সোনালি ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিল।

    “নিশীথ মাহাতোকে চিনতে?”

    “আমার বাবাকে আমার স্বামী জমিজমা সংক্রান্ত একটা কাজে সাহায্য করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাকে বিয়ে করতে চাইলেন। বাবা রাজি হয়ে গেলেন।”

    “তুমি রাজি হলে?”

    “হ্যাঁ। বাড়ি থেকে চাপ ছিল।”

    “তোমার বয়স তখন পঁচিশ। তুমি সুন্দরী। একজন অনাকর্ষণীয় চেহারা মানুষ, যার ওরকম একটা অতীত আছে, তাকে বিয়ে করতে তোমার বাধেনি?”

    “বাবা বলেছিলেন।”

    “তাতে কী? তুমি তো শিক্ষিত মেয়ে। তোমার নিজস্ব মতামত ছিল না?” সোনালি মুখ গোঁজ করে বসে রইল।

    “তোমার বাপের বাড়ির গ্রামের লোকে তো অন্য কথা বলছে।”

    সোনালি মাথা তুলে তাকাল।

    আমি ভাবলেশহীন মুখে বলে চললাম, “তোমার অসীমের সঙ্গে গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পাঁচ বছরের সম্পর্ক। এর মধ্যে নিশীথ মাহাতোর বিয়ের প্রস্তাব আসে। তোমার বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তুমি টাকা আর ক্ষমতার লোভে রাজি হয়ে যাও।”

    দুর্বল গলায় সোনালি বলল, “মিথ্যে কথা।”

    “মিথ্যে নয়। একাধিক সাক্ষী আছে। এমনকি তোমার বাবাও একথা বলেছেন যে নিশীথ মাহাতোকে বিয়ে করতে তুমি কোনো আপত্তি করোনি। অসীমের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে আসতে একবারও ভাবোনি।”

    সোনালির চোখ দিয়ে আবার জল গড়াচ্ছিল। কোনোমতে কান্না চেপে বলল, “আমি ভুল করেছিলাম।”

    “ভুল তুমি পরে করোনি? বিয়ের পর একবছর যেতে না যেতেই তুমি অসীমকে ফোন করে বিরক্ত করেছ। তোমার পুরোনো কল রেকর্ডস ঘেঁটে এরকমই তথ্য বেরিয়েছে।”

    “অসীম ফোন ধরেনি। দেখা করতে চায়নি।”

    “সেটা কোনো ফ্যাক্টর নয়। অসীমের সঙ্গে আবার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছিলে কেন?”

    সোনালি উত্তর দিল না।

    “তুমি যখন বলবে না, তখন আমি বলি?”

    ও চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে।

    “বিয়ের পরে তোমার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক তেতো হয়ে যায়। মতের অমিল হয়। তুমি আবার আগের সম্পর্কে ফিরতে চাও। অসীমকে বারবার ফোন করে দুর্বল করে দিতে চাও। এর মধ্যে নিশীথ মাহাতো ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। তোমাদের মধ্যে অশান্তি হয়। তুমি অসীমকে হাত করে তোমার স্বামীকে সরিয়ে দেবে ঠিক করো। তাই তো?” আমি গলাটা তুলে বললাম।

    সোনালির দুঃখটা মুহূর্তে রাগে বদলে গেল। চেঁচিয়ে উঠে ও বলল, “সব বাজে কথা। আমার স্বামী সব বুঝতে পেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু অসীমের সঙ্গে কোনো কথা আমার হয়নি। সে আমাকে ঘেন্না করত।”

    “সেটাই কি স্বাভাবিক নয় সোনালি?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

    সোনালি মাহাতো এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। খানিকক্ষণ ওর গলার কণ্ঠা ওঠানামা করল। চোখে বড় বড় অশ্রুবিন্দু ভিড় করল। কোনোমতে কান্না চেপে ও বলল, “আমি ক্ষমা চাইতে চেয়েছিলাম। ও সে সুযোগটাও আমাকে দেয়নি।”

    “নিশীথবাবু তোমাদের সম্পর্কের কথা কীভাবে জানতে পেরেছিলেন?” আমি ওর দিকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললাম।

    “আমি আমার ভাইয়ের মাধ্যমে অসীমকে ডাকতে চেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ভাইয়ের কথা উনি শুনে ফেলেন।”

    “কী রিয়াকশন ছিল ওঁর? রেগে গিয়েছিলেন?”

    সোনালির মুখটায় একটা অদ্ভুত কাঠিন্য দেখা দিল। বলল, “না। আমার স্বামী রাগ প্রকাশ করতেন না। পুষতেন।”

    “বুঝলাম না।”

    “আমার স্বামী সহজ লোক ছিলেন না। এর বেশি আমি কিছু বলব না।” সোনালি মাহাতোর কাছে অসহজ লোকের সংজ্ঞাটা ঠিক কী সেটা পরিষ্কার হচ্ছিল না। ঠিক করলাম সরাসরি ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করব।

    “হেমন্ত জবানবন্দি দিয়েছে যে অসীম একাধিকবার নিশীথবাবুর দোকানে এসেছে। কী কারণে সে দোকানে আসত তুমি জানো?”

    “হ্যাঁ…জানি।” সোনালি উপরে নিচে মাথা নাড়াল।

    “কী ব্যাপারে আসত?”

    সোনালি কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর ইতস্তত করে বলল, “ও একটা ব্যাপারে হেল্প চেয়েছিল।”

    “কীরকম ব্যাপারে?

    “আপনি বুঝতে পারছেন না…এটা ঠিক বলা যায় না।” সোনালি মাহাতো অসহায় ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাল।

    “তুমি পুরোটা বললে বুঝব।” আমি শান্ত হয়ে বললাম।

    “ও…ওর ঝালদার কেসটায়…ও বিচ্ছিরিভাবে ফেঁসে গিয়েছিল। সব সাক্ষ্যপ্রমাণ ওর বিরুদ্ধে ছিল। আমার স্বামীর কাছে ও আসে হেল্প চাইতে। তারপর…”

    “তারপর?” আমি অপেক্ষা করছিলাম ওর উত্তরের।

    লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সোনালি বলল, “আমার স্বামী সাহায্যের বদলে ঘুষ চেয়েছিলেন। প্রথমে পঞ্চাশহাজার…তারপর পঁচাত্তর…তারপর একলাখ। আমার সঙ্গে সম্পর্কটা জানার পর থেকে প্রতিবার ঘুষের পরিমাণ বাড়াচ্ছিলেন।”

    “অসীম কী করেছিল?” আমি খুব উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করলাম। সোনালি মাথা নীচু করে বলল, “ও রাজি হয়েছিল।”

    “মানে ঘুষ দিতে রাজি হয়েছিল!”

    “হ্যাঁ।”

    অসীমের অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্টটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বোনের বিয়ের জন্য পাঁচ লাখ লোন থেকে ও এক লাখটাকা সে রাতে ঘুষ দেবে বলে এনেছিল। নিশীথ মাহাতো ঘুষের টাকা নিয়ে অসীমকে হ্যারাস করছিলেন। ঝালদা কেসে নিজের সাসপেনশন আটকানোর জন্য অসীম সে ফাঁদে পা দিয়েছিল। সরকারী কর্মচারীর ঘুষ দেওয়া নেওয়া মানা বলে, একথা ও জেরায় একবারের জন্যও জানায়নি। তাতে এই কেসে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ত বই কমত না। ঠাণ্ডা মাথায় শুধু সেটুকুই বলেছে, যাতে ওর উপস্থিতিটুকু আর ওর হাতের রক্তপাত জাস্টিফাই করা যায়। কিন্তু সোনালি এত কথা…

    ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুমি কী করে এত কথা জানলে?”

    “আমার সামনেই তো সব কথা হত। অসীম বহুবার ফোন করেছে ওকে। দুবার টাকা নিয়েছিলেন। একবার পঞ্চাশ একবার পঁচাত্তর…কিন্তু কোনোবারই কিছু করছিলেন না। ও ফোন করলে নানারকম কথা বলে কাটিয়ে দিতেন। শেষে একদিন ফোনে বললেন এক লাখ টাকার বন্দোবস্ত করতে। অসীমকে কীভাবে ঝামেলায় ফেললে আমি মানসিকভাবে আরও কষ্ট পাব, সেটা খুব ভালো বুঝতেন। তাই…”

    আমি স্বামী স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝিতে ঢুকতে চাইছিলাম না। ওকে থামিয়ে বললাম, “সেরাতের ঘটনাটা বলো। তুমি তো আন্দাজ করেছিলে অসীম আসবে দোকানে…তাই না?”

    সোনালি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।

    “কীভাবে বুঝতে পেরেছিলে বল।”

    সোনালি শাড়ির আঁচলে নাকটা মুছে বলল, “বুঝেছি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। কিন্তু ঐদিনই যে আসবে সেটা জানতাম না। জেনেছি অনেক পরে।”

    “পুরোটা বলো।”

    সোনালি একটু থেমে গুছিয়ে নিল পুরোটা। তারপর বলল, “আমি যেদিন বাপের বাড়ি যাই তার আগের রাতের কথা। বাইরের দরজায় তালা দিচ্ছি, হঠাৎ দেখি ও। দুদিন আগেই লাখ টাকার কথা হয়েছে। ওকে দেখে আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। ওর চোখ লাল, খুব তাড়াতাড়ি শ্বাস নিচ্ছিল। ঘরে ঢুকে আমার স্বামীর নাম নিয়ে ডাকাডাকি করল।”

    “তারপর কী হল?”

    “আমার স্বামী খাচ্ছিলেন। বললেন পরে কথা বলবেন। পরের দিন আসতে।”

    “তখন অসীম কী করল?”

    “তারপর…অসীম…”, সোনালি ঠোঁট চেটে বলল, “অসীম এক ধাক্কায় ডাইনিংয়ের চেয়ার ফেলে দিয়ে বলল, আপনি যা করছেন ঠিক করছেন না। এর ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে।”

    “তারপর?”

    “তারপর আর কিছু না। যেরকম ঝড়ের মত এসেছিল, সেরকমই চলে গেল।”

    “তোমার স্বামী কী করলেন?”

    সোনালি আবার শক্ত হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার স্বামী কোনো ব্যাপারেই মুখে প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। তার মনের ভাষা বুঝতে তার হাসিটাই যথেষ্ট ছিল। আমি মনে মনে জানতাম ভয়ানক কিছু একটা হবে।”

    “সেদিনের হাসি কীরকম ছিল?”

    “নিষ্ঠুর। মনে হল একটা বড় মাকড়সা ধীরে ধীরে জাল বুনছে।” সোনালির মুখটা রাগে বিতৃষ্ণায় তিতো হয়ে গিয়েছিল।

    আমি ওকে একটু সময় দিলাম। অনেকক্ষণ একটানা কথা বলার ফলে ও হাঁপিয়ে গিয়েছিল। জলের গ্লাস থেকে এক নিঃশ্বাসে জল খেয়ে ও বলল, “এরপর দোলের দিন দুপুরে আমাকে ফোন করে আমার স্বামী বললেন, হেমন্ত ছুটি নিচ্ছে। দোকানে থাকতে হবে। পরের দিন দুপুরে ফিরব। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোমার প্রেমিক আজ রাতে দোকানে আসছে। অনেক হিসেব বাকি আছে। শাসিয়ে গিয়েছিল তো, কে কিসের ফল ভুগবে বোঝা যাবে এবার!”

    “তুমি কোনো কথা বলনি?”

    “তার আগেই ফোনটা কেটে গেল। তাছাড়া আমি আন্দাজ করছিলাম যে উনি কী করবেন…অসীমের কাছ থেকে উনি আবার টাকা চাইবেন…এত টাকা যে অসীম দিতে পারবে না…”

    আমি সোনালির দিকে চেয়ে ছিলাম। ও বিস্মৃতের মত কথা হাতড়ে হাতড়ে বলে চলল, “পরদিন যখন ওকে ফোনে পেলাম না ভয় পেয়ে গেলাম। প্রথমেই মনে হল অসীমের বিপদ। ওকে ফোন করলাম। ওর ফোন বন্ধ ছিল। টেনশনে গলা শুকিয়ে গেল। দোকানে গেলাম। গিয়ে দেখি রক্তারক্তি কাণ্ড। অসীমকে আবার ফোন করলাম। বারবার ফোন করলাম। ফোন তখনও বন্ধ ছিল। মনে হল রাগের মাথায় অসীম কিছু করে বসেনি তো! মাথা ঠাণ্ডা হতে প্ল্যান করলাম। ঠিক করলাম যে এটাকে একটা ডাকাতির রূপ দিয়ে দিই। ক্যাশ থেকে টাকা হেমন্তকে দিলাম আর বাক্সগুলো বার করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দিলাম।”

    “কত টাকা ছিল তুমি জানতে?”

    “না।”

    “এই একই স্টেটমেন্ট তুমি কোর্টে দেবে তো?”

    সোনালির চোখে জল চিকচিক করছিল। আমার কথার সরাসরি কোনো উত্তর দিল না। ম্লান হেসে বলল, “আমাকে একবার অসীমের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন?”

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইলিয়াড – হোমার
    Next Article বিসাশন – পিয়া সরকার

    Related Articles

    পিয়া সরকার

    বিসাশন – পিয়া সরকার

    October 21, 2025
    পিয়া সরকার

    বিসাশন – পিয়া সরকার

    September 12, 2025
    পিয়া সরকার

    বৃশ্চিকচক্র – পিয়া সরকার

    September 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }