খুড়োর কল
আজ এত ভয়ানক গরম পড়েছে যে এমনটা পুরুলিয়ায় আসার পর থেকে একবারের জন্যও দেখিনি। ট্যুরিস্ট কম আসছে এখন। সকালের ব্যস্ত সময়টা বাদ দিয়ে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। একরোখা অথচ জমাট গরমের হলকা টহল দিচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। রোদ্দুরের তেজে ড্রেনের জল পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। মাটি ফেটে ফুটিফাটা হয়ে গেছে এদিকওদিক। সামনের মাসগুলোয় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠোর হতে চলেছে।
দিবাকর বিশ্বাসের ফাইলটা মতিদা সহজেই বার করে দিয়েছিলেন। কেস নম্বর ৫৬৬/৫/২০০৫। বাঘমুণ্ডি পি.এসের মিসিং ডায়েরি। ভদ্রলোকের পেশাগত পরিচয় সমাজকর্মী, বাড়ির অ্যাড্রেস নৈহাটি পালপাড়া; একটা কালার্ড পাসপোর্ট ছবি সাঁটা ফাইলে। সাধারণ দেখতে একজন ভদ্রলোক, শুধু তাঁর চোখদুটিতে বুদ্ধি আর সরসতার ছাপ। বাড়ির নম্বর হিসেবে বি.এস.এন.এলের একটা ল্যান্ডলাইন নম্বর দেওয়া আছে। ফোন লাগাতে দিজ নাম্বার ডাজনট এক্সিস্ট বলে দিল। নৈহাটি পি.এসে ফোন করে ভদ্রলোকের বাড়ির সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বললাম। সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী অর্থাৎ সন্তান থাকার সম্ভাবনা কম। নেক্সট কিন কে সেটা জানা খুব দরকার। এদিকে হাড়গোড় বেলগাছিয়া পৌঁছে গেছে দুদিন আগে। সন্দীপকে ফোন করেছিলাম রাতে। প্রাথমিক একটা রিপোর্ট দিতে বলেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যদিও এটা সরাসরি ওর ডিপার্টমেন্ট নয়। তবে চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছে। যদি সুপারইম্পোজিশন করা যায়, তবে তার রিপোর্ট ফর্মালি আসতে আসতে এক সপ্তাহ।
ফাইলটায় মিসিং সম্পর্কিত ইনফর্মেশন ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই। ওটা যে কিডন্যাপিং, সেটা পর্যন্ত উল্লেখ নেই। ২০শে আগস্ট বিকেল পাঁচটা নাগাদ দিবাকর বিশ্বাসকে অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে শেষবার দেখা যায়। এটা বেলা দশটার খবর। তারপর তাঁকে দেবাশিস মাহাতো নামে এক আলট্রা নেতার বাইকে চড়ে যেতে দেখা যায়। ফোর্সফুল অ্যাবডাকশনের কেস নিশ্চয়ই নয়, তা নাহলে উনি পেশাগত ঝুঁকি মাথায় রেখেও দেবাশিসের মত আলট্রার বাইকে চড়বেন কেন! পাতা উল্টেপাল্টে দেখলাম, দেবাশিস মাহাতোর কোনো ছবি নেই। বাড়ির অ্যাড্রেসে ঝালদার নাম লেখা। সাধারণত এই ধরণের কেসে সাসপেক্টের বাকি ইনফর্মেশনের সঙ্গে তার ছবিও ফাইলে থাকার কথা। নেই দেখে একটু আশ্চর্য হলাম।
এই কেসের আই.ও সোমনাথ বড়াল গত হয়েছেন দুবছর আগে। কেস খুব সামান্য দিন বাঘমুণ্ডি পি.এসে ছিল, আই.বি আর সি.আই.ডি খুব তাড়াতাড়ি তদন্ত তুলে নেয় নিজেদের হাতে। বাকি তথ্য তাই জানার সুযোগ সেভাবে নেই। ডিটেইলড ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট সম্ভবত সি.আই.ডি-এর কাছে। সেসবের অ্যাক্সেস পেতে গতকাল পুরকায়স্থ স্যারকে ফোন করেছিলাম। উনি যথাসম্ভব সাহায্য করবেন বলেছেন। ডি.আই.জি অভিনন্দন রায়ের নাম করে বলেছেন, এই মামলায় ওঁর সাহায্য নিতে। কিন্ত আপাতত সে গুড়েও বালি। ডি.আই.জি একসঙ্গে তিনটে রেঞ্জ দেখেন। বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম আর পুরুলিয়া। এই মুহূর্তে কোথায় আছেন বলতে পারলেন না কেউই।
সময় বালির কণার মত হাত থেকে পিছলে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। দিবাকর বিশ্বাস সম্পর্কে বাকি তথ্য যতক্ষণ না এসে পৌঁছাচ্ছে, মতিদা অ্যাডভাইজ দিলেন ততক্ষণে একবার ঝালদা থেকে ঘুরে আসতে। পুরুলিয়া জেলার ঝালদা, বান্দোয়ান আর জয়পুর এই তিনটে অঞ্চলে সর্বাধিক মাওবাদী প্রভাব ছিল। দিবাকর বিশ্বাস অপহরণে অভিযুক্ত দেবাশিস মাহাতোও ঝালদার ছেলে ছিল। মতিদা ঝালদা থানাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন। থানার এস.এইচ.ও ঝালদার লোকাল, যদি ঘটনা সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে পারেন। শুধু দেবাশিস মাহাতো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ নয়, আমি ঝালদায় যেতে চাইছিলাম আরও একটি কারণে। খালি মনে হচ্ছিল, দিবাকর বিশ্বাস আদিবাসী শিশুদের পড়াতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিলেন। কোন পরিস্থিতিতে তাঁর কলমে ঐ কবিতাগুলো জন্ম নিয়েছিল তা জানতে কৌতূহল হয়। কোন পরিস্থিতিতে তাঁর মত আন্ডারকভার অফিসার ধরা পড়ে যান? কোন অবস্থায় তাঁকে মাওয়িস্টদের হাতে এভাবে খুন হতে হয়! সেই সময়ের পরিস্থিতির উত্তাপ, এত বড় একটা গণবিপ্লবের পরিকাঠামো তৈরি করা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস এবং মাওবাদীদের প্রতিসন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগের অন্তরালে সেই সব গ্রামগুলোয় ঠিক কী হয়েছিল? কে সঠিক উত্তরটা বলতে পারে আমায়?
বিধু অথবা অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করলে পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যায় না। আগে তবু দুয়েক কথায় বিধুর আবেগগুলো দমছুট হয়ে ফুটে বেরোতো। এখন সে সাবধানী হয়েছে, কেই বা মৃত, রক্তাক্ত ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চায়! আজও ও চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিল। দিবাকর বিশ্বাসকে চিনত কিনা জিজ্ঞাসা করাতে মাথা নাড়াল। মতিদা বলেছিলেন, গ্রামগুলোয় বিস্তর খোঁজাখুঁজি হয়েছিল। গ্রামগুলো থেকে প্রচুর মানুষকে থানায় ডিটেইন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। দুহাজার পাঁচে বিধু অবশ্য বছর দশেকের ছেলে, ওর পক্ষে কিছু মনে রাখা সম্ভব নয়। নামটা শুনে শুধু একবার ভুরুটা কুঁচকাল।
ঝালদা থানার এস.এইচ.ওর নাম সর্বেশ্বর হালদার। এই থানাতেই ২০০৫ থেকে সাত অবধি অ্যাসিট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর ছিলেন। তারপর বদলির পর প্রোমোটেড হয়ে এখানেই আবার ফিরে এসেছেন। থানাটা বাঘমুণ্ডি পি.এসের মতই বড়সড়। বরং এখানকার পরিকাঠামো আরও ভালো। সর্বেশ্বর হালদার আমাকে আপ্যায়ন করে বসালেন। চা-টা খাওয়ালেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, “বলুন কী জানতে চান?”
সর্বেশ্বর হালদার কালো ফ্রেমের চশমাটার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, “আসলে একটা কেসে দেবাশিস মাহাতো বলে একজন ফেরার আলট্রার নাম উঠে আসছে। লোকটার ব্যাপারে যদি কোনো ইনফর্মেশন পাওয়া যায়…”
“হ্যাঁ, মতি আমাকে ব্রিফ করে রেখেছে, যদিও খুব বেশি সাহায্য করতে পারব বলে মনে হয় না। তবু কী জানতে চান বলুন।”
“আমি আসলে ঐ অশান্ত সময়টা নিয়েই একটু জানতে চাইছিলাম। শুধুই দেবাশিস মাহাতো সম্পর্কে নয়। আপনার কাছে এলাম, কারণ শোনা যায় এই অঞ্চলের গভীরে আলট্রাদের উপনিবেশ ছিল…একটু যদি বলেন।”
সর্বেশ্বর হালদার একটু অন্যমনস্কভাবে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর হালকা হেসে বললেন, “উপনিবেশ! ….হ্যাঁ তা ঠিকই বলেছেন। ওরা বলত কমিউন। তবে যেভাবে প্রচার করা হয়, শুরুটা কিন্তু আদৌ খুন, জখম, পুলিশ অপহরণ, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ইত্যাদি দিয়ে হয়নি।”
“তবে?” আমি আগ্রহী হয়ে তাকালাম।
“এখন তো শাসক পাল্টেছে, বলতে আর বাধা নেই…” সর্বেশ্বর হালদারের ঠোঁটটা শ্লেষে একটু বেঁকে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “অবশ্য ফ্যাঁসাদে পড়ে তৎকালীন শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরাও স্বীকার করেছিলেন..”
“একটু বিস্তারিত যদি বলেন…”
“অপ্রাপ্তি শব্দটা বোঝেন নিশ্চয়ই? বঞ্চনা শব্দটাও শুনেছেন। চরম দারিদ্র্য আর তার সঙ্গে রেশন দুর্নীতি, কালোবাজারি, বেহাল স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসব যোগ দিলে কী হয় বুঝছেন হয়তো! বিদ্যুতের সংযোগটুকু পর্যন্ত ছিল না ম্যাডাম। লোকে পাতাসেদ্ধ, পোকামাকড় খেয়ে বাঁচত। লোকে বলে মাওবাদী বিপ্লব আসলে অন্ধ্রের আমদানি, পশ্চিমবঙ্গের মাটির সঙ্গে এর যোগ নেই। কিন্তু অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনা যে বিপ্লবের মাটি গড়ে দেয়, তার কোনো আলাদা প্রদেশ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।” সর্বেশ্বর হালদার একনাগাড়ে বলে একটু দম নিলেন। “মাওয়িস্ট আলট্রারা গ্রামের লোকের প্রচুর সাহায্য পেয়েছিল বুঝলেন। রাষ্ট্র আর প্রশাসনের ব্যাপারটা আঁচ করতে সময় লেগে গেল। ততদিনে ওরা গ্রামগুলোতে নিজেদের মত করে সরকার গড়ে ফেলেছে। যাকে বলে প্যারালাল গর্ভমেন্ট। কনট্রাকটর, সুবিধাবাদি ব্যবসায়ী, অর্থলোলুপ নেতা, সবার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে লড়ার একটা মারাত্মক বেস তৈরি হয়ে গেছে…গণ আন্দোলনের একটা বিশাল সম্ভাবনা!”
“তারপর?”
“তারপরই যাকে বলে সশস্ত্র অভ্যুত্থান, তাই হল। প্রথম কাজ ছিল গেরিলা জোন তৈরি করা, সেকেন্ড হল গেরিলা জোনে গেরিলা বেস তৈরি করা। গেরিলা জোনে প্রশাসনিক লোকজন যেতে পারলেও গেরিলা বেস দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। গেরিলা আর্মিকে ওরা ধীরে ধীরে মার্চিং আর্মিতে পরিবর্তন করে ফেলল। গণ মিলিশিয়া তৈরি হল…২০-৩০ জন লোকাল ছেলেপুলে তীর ধনুক ছুরি টাঙ্গি ভল্লা যা পেল তাই নিয়ে ঢুকতে লাগল মিলিশিয়ায়। মিলিশিয়ার বেস্ট ফাইটারগুলোকে তুলে নিয়ে কমব্যাট ইউনিফর্ম আর সিরিয়াস অস্ত্র তুলে দিতে লাগল মাওয়িস্ট হাইকমান্ড। প্ল্যাটুন থেকে কোম্পানি, কোম্পানি থেকে ব্যাটেলিয়ন তৈরি হল। রিপোর্ট বলে এই ঝালদাতেই প্রায় চার-পাঁচ হাজার মানুষ মিলিশিয়ায় ছিল, এই লেভেলের সাপোর্ট ছিল ওদের।” সর্বেশ্বর হালদার কথা শেষ করে জল খেলেন।
“আর প্রশাসন? তার ভূমিকা?” আমি জানতে চাইলাম।
“ঐ যে বললাম। টের পেতে দেরি হয়েছিল। যখন পেল তখন সাক্ষাৎ সমর। প্রথমেই টার্গেট হল পুলিশ আর জেলা স্তরের কিছু নেতা। প্রশাসনের বুলডোজার চালায় পুলিশ, অতএব পুলিশকে লক্ষ করে গুলিবৃষ্টি, মাইন বিস্ফোরণ সবই চলতে লাগল। নেতাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে-টেরে রাস্তার মোড়ে ফেলে রেখে যেত। আমি পুলিশের লোক হয়েও বলছি, এসব নেতামন্ত্রীদের চক্করে পুলিশ সাধারণ লোকের উপর অত্যাচার কম করেনি। কাজেই স্থানীয়দের রাগ ছিলই। তার সঙ্গে অস্ত্র আর অর্থ এসে যোগ হলে যা হয়…দলে দলে গ্রামের ছেলে আলট্রাদের প্রতিটা স্টেপ সমর্থন করে দলে ভিড়তে লাগল।”
“দেবাশিস মাহাতোও তো লোকাল ছেলে?”
সর্বেশ্বর হালদার ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ। দেবাশিস ঝালদার ছেলে ছিল। তবে সত্যি কথা বলতে কী, দিবাকর বিশ্বাসের অপহরণের আগে ওর নামই আমরা কেউ জানতাম না। ওর কার্যকলাপের কথা কিন্তু ঝালদায় নয়, অযোধ্যা বাঘমুণ্ডি বেল্টেই বেশি শোনা যায়। বিশ্বাসের কেসের পর ওর নামটা প্রকাশ্যে আসে। নিশীথ মাহাতোর মত ড্রেডেড আলট্রার ডানহাত ছিল। সে সময় বাঘমুণ্ডি পি.এস থেকে ওর খোঁজে লোক পাঠিয়েছিল। রঘুনাথপুর কলেজের পার্ট টাইম শিক্ষক ছিল, এ বাদে আমরা আর বিশেষ কোনো ইনফর্মেশন দিতে পারিনি।”
“পার্ট টাইম শিক্ষক! মানে দেবাশিস মাহাতোর পেটে বিদ্যা ছিল?”
সর্বেশ্বর হালদার ফিকে হেসে বললেন, “সে আর বলতে! হিস্ট্রিতে এম.এ করেছিল। শুনেছি লিফলেট ডিজাইন থেকে শুরু করে শিক্ষিত তরুণ যুবকদের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাম্পেইন চালানো সবই ওর মাস্টারপ্ল্যান ছিল। মেইনস্ট্রিমের ছেলেপুলেদের কীভাবে আদিবাসীদের সম্পর্কে সহানুভূতিশীল করে তোলা যায় এসব নিয়ে প্ল্যানিংয়ের দায়িত্বে ছিল দেবাশিস। কিন্তু বিদ্যে থাকলেই বা কী যায় আসে? সন্ত্রাসের রাজনীতিতে জড়িয়ে গেল….তারপর হারিয়ে গেল…”
“ওর বাড়িতে কখনও রেইড টেইড হয়নি?”
সর্বেশ্বর হালদার ঠোঁটটা উল্টিয়ে বললেন, “ওর বাড়ি ছিল গেরিলা জোনে। সেখানে ঢোকার মত পরিস্থিতিই ছিল না।”
“এখন ওর বাড়িতে কে থাকে?”
“কেউ না। ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। মা না বাবা কে একটা আত্মহত্যা করেছিল। ভাই বোন টোন বোধহয় ছিল, তারাও কেউ আর পুরুলিয়ায় থাকে না। পুরো ফ্যামিলি শেষ। আরও অনেক ফ্যামিলির মত। সন্ত্রাসের শেষে হাতে রইল শূন্য।”
“মানে আপনি বলছেন, আলট্রারা অস্ত্র নিয়ে যে সন্ত্রাস চালিয়েছিল, সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের চেষ্টা করেছিল, সেটা আল্টিমেটলি উদ্দেশ্য থেকে সরে গেল?”
সর্বেশ্বর হালদার ফিকে হাসলেন। তারপর বললেন, “যে জিনিসটা নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয় না, সেটা হল এই গেরিলা জোনগুলোর পিছনে একটা বিরাট অ্যামাউন্টের বাজেট অ্যালোকেট হত। এদের ফিনান্সিয়াল কমিটি ছিল, নিয়মিত মিটিং হত। মূল সমস্যা শুরু হল এখান থেকেই।”
“বুঝলাম না।”
“বলছি। জঙ্গলে উৎপাদিত সামগ্রী, যেমন ধরুন শালপাতা, মহুয়া, তেঁতুল, লাক্ষা, বাঁশ, মসলাপাতি, শালকাঠ এগুলো নিয়ে যেসব কনট্রাকটর এতদিন লুটে খেয়েছে, তাদের কাছ থেকে মোটা টাকার ট্যাক্স নিত মাওবাদীরা। লোকালি যেসব কোম্পানি কাজ করত, তাদেরকেও নিয়মিত চাঁদা দিতে হত। এছাড়া ধরুন ব্যাঙ্ক লুট, সরকারী কোষাগার লুট, অ্যাবডাকশনের র্যানসম এসব তো ছিলই। কত টাকা কালেক্ট হত তার কোনো আন্দাজ আছে?”
“কত?”
“পার কনট্রাকটর পিছু ছ থেকে সাত লাখ ধরে রাখুন বছরে। মানে যদি খুব কম করেও ধরি, তবেও কিন্তু কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। এরিয়া কমান্ডার সেগুলো গেরিলা বেসগুলোর মধ্যে ভাগ করে দিত। কত টাকা আসলে অস্ত্র কিনতে লাগত, কত পকেটে থাকত আর কত সত্যি সত্যি আদিবাসী কল্যাণে লাগত, তার হিসেব কে রাখে!”
“হুম।” আমি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম।
সর্বেশ্বর হালদার সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “অর্থই সব অনর্থের মূল ম্যাডাম। এবার বুঝছেন তো, নিশীথ বা দেবাশিসের মত নেতারা কেন সত্যিকারের উন্নয়ন বা কো-অপারেটিভের দিকে এগোয়নি? কেন টুকিটাকি মাছ চাষ আর শস্যোৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল নিজেদের? উন্নয়নের দিকে হাঁটা মানে কোম্পানি আর কনট্রাকটরের চাঁদা বন্ধ, মোটা মোটা টাকা রোজগার বন্ধ, অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাস চালানো বন্ধ, জুলুম বা হামলাবাজির মত শক্তি প্ৰদৰ্শন বন্ধ। সে কি আর কেউ চায়? বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেলে…”
“আরেকটা ব্যাপারও বোধহয় ছিল।” আমি ভেবে বললাম।
“কী?” সর্বেশ্বর হালদার আমার দিকে তাকালেন।
“যদি সত্যিই উন্নয়ন হত, যদি সাধারণ মানুষ সাবলম্বী হয়ে যেতেন, তবে কি আদৌ তাঁরা মাওবাদী সন্ত্রাস আঁকড়ে থাকতেন? তাঁদের ছোট ছোট ছেলেপিলে ডিরেক্ট কমব্যাটে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে, সেটাই বা তারা মেনে নিতেন কতদিন!”
“ঠিক! আসলে কী বলুন তো ম্যাডাম, যারা খুব সাধারণ, তাদের স্বপ্নগুলো কোন হাটে বেচাকেনা হয় তারা বুঝতে পারে না। তাই তাদের কাছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র হিসেবেই থাকে। দেশ হয়ে উঠতে পারে না।” সর্বেশ্বর হালদার একটা অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললেন।
***
জিপে ফিরতে ফিরতে সর্বেশ্বর হালদারের কথা ভাবছিলাম। দেবাশিস মাহাতোর মত উচ্চশিক্ষিত মানুষ এমন একটা গণবিপ্লবে সামিল হলেন, তারপর অস্ত্র আর অর্থের ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে গেলেন! উনিও কি সুবিধাবাদী প্রাক্তন নকশালদের মত বিদেশে সেটল করে ফেলেছেন! অবশ্য এরকম তো কতই হয়েছে। সিনিয়রদের থেকে শুনেছি কত নকশাল সুযোগ পেয়ে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার সঙ্গে সততার সত্যিই কোনো যোগ নেই! আমি একটু বেশি আশা করছি।
মোবাইলে কুঁক কুঁক করে একটা নোটিফিকেশন ঢুকল। জিমেইলটা খুললাম। সন্দীপ একটা বিরাট লম্বাচওড়া ফাইল ইমেইল করেছে। খুলে দেখলাম সেটা ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজির এক্সপার্টের তৈরী পাঁচ পাতার প্রাইমারি রিপোর্ট। দিবাকর বিশ্বাসের কঙ্কাল সম্বন্ধীয়। সঙ্গে সন্দীপের ছোট্ট একটা নোট; ইউ আর লাকি দর্শনা! কেন লাকি সেটা জানতে গিয়ে সন্দীপের নোটটা পড়লাম— ইংরেজিতে ও লিখেছে, “আসলে সেপটিক ট্যাঙ্কের ভিতরে অনেকগুলো মাইক্রো এনভায়রনমেন্ট থাকে, ছোট ছোট বাস্তু সিস্টেম। ট্যাঙ্ক খুললেই আমরা যে অংশটা দেখি সেটা আসলে শুকনো বর্জ্য পদার্থের একটা আস্তরণ। এর তলায় থাকে বিশাল আয়তনের জৈব তরল, যার মধ্যে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। যাবতীয় পচনের কাজ এই তরলেই হয়। ট্যাঙ্কের একদম নিচে থাকে কাদা আর বালি। ঐ অংশে অক্সিজেনের সাপ্লাই নেই বললেই চলে। যে দুরকম হাড়ের স্যাম্পল পাঠিয়েছিলে তার মধ্যে প্রথমগুলো ঐ উপরের শুকনো আস্তরণে আটকে ছিল। আরশোলা হাড়ের উপরের সারফেসটাকে খুবলে খেয়েছে, আর তলার জৈব তরলে যেটুকু অংশ ডুবে ছিল সেগুলো গলে গিয়ে একদম ফোঁপড়া হয়ে গেছে।
আর দ্বিতীয় রকমের স্যাম্পল অর্থাৎ স্কাল, রিবের হাড় এবং বাকি রিমেইনস ট্যাঙ্কের একদম নিচে বালির স্তরে আটকে ছিল। সেখানে অক্সিজেন না থাকায় হাড়ের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। দুরকম স্যাম্পল খতিয়ে দেখে এক্সপার্ট মত দিয়েছেন যে খয়রাবেড়া লেক আর নিশীথ মাহাতোর সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কাল একই ব্যক্তির, তবে ডি.এন.এ টেস্ট করলে কনফার্মেটরি হবে।
মৃতের মৃত্যুকালে বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, উচ্চতা ছফুটের কাছাকাছি, মৃত্যুর সময় পনেরো থেকে কুড়ি বছর আগে। মৃত্যুর কারণ গানশট। দিবাকর বিশ্বাসের খুলিতে বুলেট উন্ড আছে। একটাই বুলেট ডান কানের ঠিক পিছন দিকে দিয়ে ঢুকে ডান অক্ষিগোলকের উপরে খুলিতে এখনও আটকে আছে।
সন্দীপ লিখছে দিবাকর বিশ্বাসকে সম্ভবত পিছন দিক থেকে গুলি করা হয়। বুলেট এন্ট্রি পয়েন্ট উপর থেকে নিচে বা নিচ থেকে উপরে নয়, সমান্তরালভাবে গুলি ঢুকেছে খুলিতে। অর্থাৎ যিনি বন্দুক চালিয়েছেন তার উচ্চতা দিবাকরের উচ্চতার খুব কাছাকাছি। স্কাল এবার ফেশিয়াল রিকনস্ট্রাকশনে গেছে। ভিকটিমের ছবির সঙ্গে স্কালের অ্যানাটমিকাল পয়েন্ট মিলে গেলে একশ ভাগ নিঃসন্দেহ হয়ে বলা যাবে, যে কঙ্কালটি নিহত আই.বি অফিসার দিবাকর বিশ্বাসের।
সন্দীপকে একটা রিপ্লাই মেইল লিখলাম। বুলেট উন্ডটা কোন ধরণের গান থেকে হয়েছে সেটা জানা দরকার। খুব দরকার!
