Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বৃশ্চিকচক্র – পিয়া সরকার

    পিয়া সরকার এক পাতা গল্প320 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    নেড়া বেলতলায় যায় কবার

    “এতদিন ভাবছি কবে/ তোমার দেখা পাই
    ছিল জান জিরো পার্সেন্ট/ বেকারজীবনটাই
    ছিল না ঝিন চ্যাকাচ্যাক/ সুট-বুট আর টাই
    তোমার এই টাচ লেগে/ আজ হয়েছি হাইফাই”

    বছর বারোর ছেলেটা তারস্বরে গাইতে গাইতে সামনে এসে হাত পাতলো। গায়ের ধূসর রঙের টি-শার্ট হয়তো কখনও কোনোকালে বটল গ্রিন রঙের ছিল। বুকের খোলা বোতামের ফাঁক দিয়ে কণ্ঠার হাড় স্পষ্ট। আমি অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই, গানটা ও আবার গাইবে ঠিক করল।

    হাওড়া স্টেশন থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে ছেড়েছে সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ। পুরুলিয়া জাংশন পৌঁছাতে আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট মত লাগবে। সামনেই দোলযাত্রা আর হোলির ছুটি, তাই পুরুলিয়ার এখন রমরমা ট্যুরিস্ট সিজন আনরিজার্ভড সেকেন্ড সিটিংয়ের রিজার্ভেশন, তবে এত সকালের ট্রেন বলেই হয়তো মারাত্মক দমচাপা ভিড়টা নেই। আমার সহযাত্রী বলতে একটা গোটা পরিবার, হলিডে ট্রিপে পুরুলিয়া চলেছে। আট থেকে আটষট্টি বছর বয়সের রেঞ্জের আট জন মানুষ; ফলে উচ্চগ্রামে কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা এসব চলছেই। এঁরা যাবেন অযোধ্যা হিলস আর সংলগ্ন অঞ্চল ঘুরতে, তবে মূল আকর্ষণ খয়রাবেড়া লেক। ঘন জঙ্গলে ভরা পাহাড়ঘেরা নীলচে একটা জলাশয়, সেই জলাশয়কে কেন্দ্র করে একটা মাঝারি সাইজের রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। পুরুলিয়ায় এখন পলাশের সময়ও বটে। একটা ক্যানন ডিজিটালের শোল্ডার ব্যাগ মাঝেমাঝেই লাগেজের ফাঁক থেকে উঁকি মারছে। পরিবারের কর্তা বয়স্ক ভদ্রলোকটি দেখলাম ডেস্টিনেশন নির্বাচনে খুব একটা খুশি নন। স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলেদের বৌ, নাতি নাতনিদের নিয়ে এর থেকে দীঘা গেলে ভালো ছিল বলে গজগজ করছেন অনেকক্ষণ থেকে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্ব, গোটা সংসারকে বেশ রোয়াবে রাখেন বোঝা যাচ্ছে। বেড়ানোর প্ল্যানটা কার, সেটা অবশ্য এখন বোঝার উপায় নেই।

    বাচ্চা ছেলেটা আবার গলা ফাটিয়ে গানটা ধরেছিল। ঠিক নামার মুখে এই যৎসামান্য বিনোদনের জন্য আমার খুশি হওয়াই উচিত। পকেট থেকে টাকা বার করতে করতে একবার ওর আঙুলগুলোর দিকে তাকালাম। দুটো পাথরের টুকরোতে তিন আঙুলে তাল ঠুকে যাচ্ছে। কেরদানি দেখে গাল টিপে দিতে ইচ্ছা করল। দশটা টাকা হাতে দিতেই ছেলেটা ঝিন চ্যাকাচ্যাক হাসল। তারপর এগিয়ে গেল সামনে।

    শিশু ভিখারি— ডেনড্রাইট চক্র— আর.পি.এফের হুঁশিয়ারি শব্দগুলো মাথায় একবার উঁকি মেরেই ধোঁয়া হয়ে গেল। এই কয়মাসে দর্শনা বোস তবে অনেক আইন ভাঙতে শিখে গেছে!

    “পুরুলিয়া?”

    উল্টোদিকের উইন্ডো-সিটের ভদ্রলোক অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছেন খেয়াল করেছি। পাত্তা দিইনি। ইনি এই ট্যুরিস্ট পরিবারের অংশ নন। লোকটাকে দেখে ইন্টারেস্টিং মনে হলেও, খেজুরে আলাপের থেকে ঘুমানোটা সবসময়ই বেশি পছন্দ করি। কিন্তু চলন্ত গাড়িতে, লোকজনের ভিড়ে আমি মোটেই ঘুমাতে পারি না, আবার ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলে বন্ধ চোখের পাতার পিছনে নানা দুশ্চিন্তা ভিড় করে। তার থেকে বরং ‘দুর্গ-রহস্য’ ভালো। হোক না পাঁচ বারের রি-রিড। কিন্তু এবার সরাসরি প্রশ্ন করাতে আর এড়ানো গেল না লোকটাকে।

    “হুম। আপনি?”

    “আমিও। ইয়ে একটা কথা, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনি দর্শনা বোস তো?”

    লোকটার দিকে চমকে তাকালাম। সল্ট-পিপার চুল, ছোট্ট কপাল, ঘন ভ্রুর তলায় উজ্জ্বল চোখ জোড়া। চৌকোনো চিবুক, সামান্য মোটা ঠোঁট। বয়স মধ্য তিরিশ। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসলেন। আর হাসতে মনে হল, এই মুখের আদলটা পরিচিত। কোথায় যেন দেখেছি। ভদ্রলোক ডেনিমের শার্টের পকেট থেকে আইকার্ড বার করে আমার দিকে বাড়ালেন।

    “সাংবাদিক?” আইকার্ড না দেখেই বললাম।

    “হ্যাঁ। নিরঞ্জন সেন। দ্য পিপলের পলিটিকাল করেসপন্ডেন্ট। নবগ্রাম আর্মস স্মাগলিং মামলাটা কভার করেছিলাম। আপনার একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আনফরচুনেটলি…” লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাকিয়ে হাসল। কথায় সামান্য অবাঙালি টান আছে।

    “আপনি বোধহয় জানেন না আমার…”

    “ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি চলছিল, তাই তো? জানি তো। তবু আমাদের একটু নির্লজ্জ হতেই হয়। যদি একটা বাইট-টাইটও পাওয়া যেত!”

    লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম। দুপাশের ধূ-ধূ প্রান্তর, জানালার ওপারে উল্টোদিকে দৌড় দিচ্ছে। মাঝেমাঝে দু-একটা খালবিল, নারকোল আর খেজুর গাছের সারিতে চোখ থামতে চাইলেও ফুরসত পাচ্ছে না।

    “আরে আপনি তো গম্ভীর হয়ে গেলেন! চিন্তা নেই, এখন আর বাইট চাইব না। আপাতত আপনার কেসটার পলিটিকাল রেলিভ্যান্স মৃত।”

    লোকটার কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললাম। “তাহলে এখন দেশে ফগ ছাড়া আর কী চলছে?” হেসে বললাম লোকটাকে।

    নিরঞ্জন দাঁত বার করে হাসলেন। তারপর আঙুল উঁচিয়ে এক মিনিট বলে, ব্যাগ থেকে গতকালের পেপারের ইস্যু বার করলেন। দ্য পিপলের ফার্স্ট পেজের খবর, “মাওয়িস্ট পোস্টার ফাউন্ড ইন পুরুলিয়া।”

    “ওহ! এটা?” পেপারটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

    পাশের সহযাত্রীরা কথা থামিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। চোখগুলো নিরঞ্জনের থেকে বেশি আমার দিকে ঘোরাফেরা করছিল। নিরঞ্জন হয়তো সেটা বুঝেই প্রসঙ্গ বদলালেন। “বসন্তকালটা পুরুলিয়া বেরানোর জন্য আদর্শ কী বলেন?”

    “আর আদর্শ! ঠিক এটাই, এটাই বাপ্পাকে বলছিলাম। পুরুলিয়া কিন্তু এখন সেফ নয়,” নিরঞ্জনের হাতের পেপারটার দিকে তাকিয়ে বয়স্ক ভদ্রলোক ফোঁস ফোঁস করে ছেলেকে বলে উঠলেন, “তোমরা আজকালকার ছেলেরা খুঁটিয়ে নিউজপেপারটুকু পড়ো না, জিজ্ঞাসা করো এই ভদ্রলোককে। ছত্রিশগড়ের ওই মাওবাদী লিডার…কী যেন নাম বেশ…”

    “পোয়াম…মোতিরা পোয়াম।” নিরঞ্জন মৃদু গলায় বললেন।

    “ঠিক! ও তো এখন এখানে, অ্যাবসকন্ডিং হওয়ার পর তো এখানেই লুকিয়েছে। কী বলুন না, আপনাদের পেপারেই তো প্রথম খবরটা বেরিয়েছিল?”

    “হ্যাঁ, মানে ওটা…”

    “দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনিই কি করেসপন্ডেন্ট ছিলেন?”

    নিরঞ্জন বিরক্ত হচ্ছিলেন এবার। ছত্রিশগড়ে সি.আর.পি.এফ জওয়ানদের জিপ ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে উড়েছে দুমাস আগে। ইনটেলিজেন্স বলছে মোতিরা পোয়াম এখন পুরুলিয়াতেই। খবরটা দুমাস আগেই হেডলাইন হয়েছে। দ্য পিপলের সাবস্ক্রিপশন আমার নেই। কাজেই সেখানে এ বিষয়ে পরে আর কী কী ছেপেছে আমার জানা নেই। তবে মিডিয়া মোটামুটি খবরটার পিছনে লেগে আছে সেটা জানি।

    নিরঞ্জন কথার উত্তর না দেওয়াতে ভদ্রলোকের উৎসাহ বেড়ে গেল। আর এ ধরণের ক্ষেত্রে, বাঙালির আলোচনার পরিধিটা বিরাট হয়। মাওবাদি থেকে শুরু করে মনোহর দাস মোদি, জো বাইডেন, বাশার-অল-আসাদ এমনকি কবরে শায়িত মোল্লা ওমর পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে। নিরঞ্জন ভদ্রলোকের সঙ্গে ন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনাল কোনো পলিটিকসেরই আলোচনায় উৎসাহী ছিলেন না। করুণ মুখে আমার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোক অবশ্য সেটা খেয়াল করলেন না।

    “ইয়ে…মেসোমশাই! কোনো সমস্যা হবে না। পোস্টার পড়লেও জায়গাটা তো অযোধ্যা হিলসের রেঞ্জে, ওদিকে নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো। কিচ্ছু হবে না।” আমি গলা খাঁকড়ে বললাম।

    মেসোমশাই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, “আমাদের দেশে আবার নিরাপত্তা! তা আপনিও কি প্রেসের নাকি?”

    “হ্যাঁ। উনিও প্রেসের। চলুন দর্শনা। পুরুলিয়া ঢুকবে ঢুকবে করছে।” আমার কিছু বলার আগেই নিরঞ্জন সেন উঠে দাঁড়ালেন।

    জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম। ট্রেন এখনও পূর্ণগতিতে ধাবমান পুরুলিয়া কত কাছে জানা নেই, তবে বসে বসে কোমর ধরে গেছে ঠিকই। লাগেজ বলতে একটা ট্রলি। বসে আছি মাঝামাঝি একটা জায়গায়, একটু এগিয়ে থাকলে ক্ষতি নেই।

    নিরঞ্জন গেটের দিকটায় এগিয়ে গিয়েছেন এবং একটা গোটা ফাঁকা বার্থ পেয়ে বসেও পড়েছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই সিগারেট অফার করলেন।

    “নিজে আইন ভেঙে আবার পুলিশকেও দলে টানছেন?”

    “আপনি যে এইমাত্র একটা অপুলিশোচিত ব্যবহার করে আমার মাথাটি বাঁচালেন, তার জন্য একটা ভদ্রতামূলক জেশচার আর কী!” নিরঞ্জন আবার দাঁত বার করে হাসলেন। খেয়াল করলাম, উপরের পাটির সামনের দুটি দাঁতের গড়ন অদ্ভুত! ইনসাইজর দুটো বেশি লম্বাটে, ফলে হাসলেই নিচের পাটির দাঁতগুলোকে বেশি কভার করে ফেলছে। এরকম দাঁতের শেপ কোথায় যেন দেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। দাঁতের গঠনের জন্যই কি মুখের আদল চেনা চেনা লাগছে!

    নিরঞ্জনকে বললাম, “ধন্যবাদ। আমি পাবলিকলি স্মোক করি না। আর আপনিও ওটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলুন।”

    “বাপরে! আপনি কী কড়া!” নিরঞ্জন ছদ্ম ভয় পাওয়ার ভান করলেন, “বাই দ্য ওয়ে, আপনার নতুন পোস্টিং তো বাঘমুণ্ডিতে?”

    “হ্যাঁ! আপনি কি এটা আন্দাজে বললেন?”

    নিরঞ্জন ঠোঁটটা উল্টে বললেন, “ঠিক তা নয়। বেশ কিছু দিন ধরেই এদিকটার হাওয়া গরম হচ্ছে আবার। লোকসভা নির্বাচন সামনেই। এদিককার পলিটিকাল সিনারিওটা জানেন তো?”

    “হ্যাঁ। রাষ্ট্রীয় জনহিত পার্টি, মানে যারা সেন্টারে তারাই গত বিধানসভায় এ জেলার আশি ভাগ সিট পেয়েছে। রাজ্য আর কেন্দ্রের সংঘাত চলে আর কী!” আমার ঠোঁটে একটা ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলে গেল।

    নিরঞ্জনও হাসলেন, “ঠিক! এদিকে পিপল লিবারেশন গেরিলা আর্মির এবছর কুড়ি বছরের বর্ষপূর্তি। পোস্টারগুলো এই সময় সেই জন্যেই পড়েছে। তার মধ্যে মোতিরা পোয়ামের হাইড-আউট এখন এ জেলায়। বাজারে গুজব, রাজ্যের শাসক দল লোকসভার আগে মাওয়িস্ট ইনসার্জেন্সির ইস্যু চাগিয়ে তুলে ভোটের ইকুয়েশন পাল্টাতে চাইছে। মাওয়িস্ট সমস্যায় রাজ্যসরকারের রেকর্ড অসম্ভব ভালো কিনা! এ সব সূত্রেই বেশ ক’বার এসেছি এদিকে। বাঘমুণ্ডি পি.এসের এস.এইচ.ও শ্যামল ব্যানার্জীর সঙ্গে সামান্য পরিচয় আছে। উনিই বলছিলেন আপনার কথা। সত্যি বলতে কী, বেশ অবাকই হয়েছি।”

    “কেন বলুন তো?”

    “দেখুন আপনার যা এক্সপেরিয়েন্স, মানে এর আগে আপনি ছিলেন হোমিসাইডে, তারও আগে প্রোটেকশন অফ উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড সেলে, রাজ্য পুলিশ নিশ্চয়ই আপনার ক্যালিবারের বিশেষ মর্যাদা দিতে পারবে বলেই ভেবেচিন্তে বাঘমুণ্ডির মত রুরাল পোস্টিংয়ে পাঠিয়েছে?”

    একটা বাদামওয়ালা যাচ্ছিল। পাঁচ টাকার একটা প্যাকেট কিনে মুখে দুটো বাদাম ঢুকিয়ে বললাম, “আরে না না। আপনি যেসব ইনসার্জেন্সির কথা ভেবে আমাকে প্রশ্নগুলো করছেন, ওসব কোবরার মত সেন্ট্রাল এজেন্সি দেখে। আমি ছাপোষা অফিসার, আমার তদন্ত পেটি কেস নিয়ে….”

    নিরঞ্জনের চোখগুলো চক্চক করছিল। লোকটার মধ্যে একটা অদ্ভুত কনফিডেন্স কাজ করে, দেখে মনে হয় অতি ক্যাজুয়ালি ভীষণ সিরিয়াস কাজ করে ফেলতে পারেন। সিগারেটের প্যাকেটটা সত্যি সত্যি জানালা দিয়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, “তা কী হয় ম্যাডাম? একজন পুলিশ অফিসারের জীবনে একটা কথা ধ্রুব সত্য। কী বলুন তো?”

    “কী?”

    “ক্রিমিনাল আর টাকা…যখনই থাকিবে নসিবে, আপনি আপনি আসিবে। আমার মন বলছে আপনি এখানে নিরাশ হবেন না। বাই দ্য ওয়ে, পুরুলিয়া তো প্রথম এলেন নাকি?”

    লোকটার কথার উত্তর দিতে গিয়েও গিলে নিলাম।

    নিরঞ্জন আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসলেন। তারপর বললেন, “দিল-কি-বাত-এ গণতন্ত্রের চারটে স্তম্ভকে একসঙ্গে কাজ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, শোনেননি? খবর আপনার কাছে যা আসবে, আমার কাছেও তাই আসবে। একটু আগে বা পরে। অনেকসময় হয়তো আপনার থেকেও আগে আমার কাছে এসে পৌঁছাল। আমি কিন্তু আপনাকে খবরটা পাস করতে একটুও দ্বিধা করব না। এবার আপনারটা আপনি নিজে ভালো বুঝতে পারবেন। নিন, দুটো বাদাম খাওয়ান দেখি। আমি চা খাওয়াচ্ছি। এই চা-ওয়ালা…”

    ***

    এ.সি.পি পুরকায়স্থ আসার আগে একবার দেখা করতে বলেছিলেন। ট্রান্সফারের চিঠিটা তখন সবে হাতে পেয়েছি। এ.সি.পির অফিসে সেদিন তুমুল ব্যস্ততা। লেক গার্ডেন্সের দিকে একটা চুরি হয়েছে। সম্ভবত রাজ্য পুলিশের কোনো কর্তাব্যক্তির বাড়িতে। কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি থেফ্ট সেল ইনভেস্টিগেশন করছে, ভবানীভবনেরও কজন অফিসারকে ডাকা হয়েছে।

    পুরকায়স্থ স্যারের রিটায়ারমেন্টের আর বছর দেড়েক বাকি। বাবার ব্যাচমেট, আমাকে স্নেহ করেন বুঝি। নাহলে সামান্য এস.আইয়ের পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ে এতটা ইন্টারেস্ট দেখাবেন কেন! কিন্তু স্নেহের যা দাম বাজারে, তাই মুফতে পেলে তা আসল না নকল সন্দেহ জাগে!

    সামনে রাখা ফাইলগুলোতে তড়িৎগতিতে সই করতে করতে এ.সি.পি গম্ভীর গলায় বললেন, “আই নো, ইউ আর পিসড অফ দর্শনা। কিন্তু জল বহুদূর গড়িয়েছে। গণেশ হুঁইয়ের ব্যাপারটায় এই অ্যাডভান্টেজটা না পেলে, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারতাম না।”

    পুরকায়স্থ স্যার নিবিষ্ট মনে ফাইল সই করছিলেন। আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম, স্যার কোন অ্যাডভানটেজের কথা বলছেন। কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন করার ফলে, রাজ্য আর কেন্দ্রের মধ্যে রাজনৈতিক তরজা চলছে গত তিন বছর ধরেই। রাজ্য পুলিশের এক্তিয়ারের মধ্যে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারছে এন.আই.এ বা এ.টি.এসের মত এজেন্সি। গণেশদার কেসটাতেও তাই হয়েছে।

    “গণেশ হুঁইকে মুম্বাই এটিএস ডিটেইন না করলে, রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে এই কেসের রেসপন্সিবিলিটি এত সহজে সরত না দর্শনা। তুমি নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পারছ। গত দু’মাস ধরে ডিপার্টমেন্টাল ইনটিগ্রিটি ধরে রাখাই চাপ হয়ে গেছে। গণেশের মত পুরোনো ইনফর্মারের সঙ্গে কার যোগাযোগ ছিল না বলতো? ট্রান্সফার আর সাসপেনশনের বন্যা বয়ে চলেছে। টালা পার্কের ও.সি, আসানসোল পুলিশ কমিশনারেটের এ.এস.পি, এস.ডি.পি.ও বর্ধমান… অ্যান্ড দ্য লিস্ট ইজ গ্রোয়িং…কোনোদিন আমার উপরেও হয়তো খাঁড়ার ঘা নেমে আসবে। ইন ফ্যাক্ট, এই কেসটায় যদি তুমি একা ফাঁসতে, তবে পানিশমেন্টারি গ্রাউন্ডে তোমার ডিমোশন হওয়া কিছু আশ্চর্য ছিল না। এটা তাও অল্পের উপর দিয়ে গেছে। আর ইউ লিসনিং টু মি দর্শনা?” পুরকায়স্থ স্যার বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন।

    “ইয়েস স্যার।”

    পুরকায়স্থর মুখটা একটু নরম হল। চশমাটা খুলে কাচ মুছতে মুছতে উনি বললেন, “দেখ তোমার নেক্সট পোস্টিং যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। অন্ততঃ মোতিরা পোয়ামের ঘটনার পরপরই হঠাৎ করেই বাঘমুণ্ডি পি.এসের পোস্টটা খুব ভাইটাল হয়ে গেছে। আমি জানি তোমার মধ্যে কাজ করার খিদে আছে। অ্যাজ এ সিনিয়র পুলিশ অফিসার, আমি চাইব তোমার মধ্যে খিদেটা বেঁচে থাকুক। অ্যান্ড ইয়ং লেডি, ইউ আর মোর দ্যান লাকি। তিনটে ইনক্রিমেন্ট লসের ট্রমাটা, কাজের মধ্য দিয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করো। দিজ ইজ দি বেস্ট অ্যাডভাইজ আই ক্যান গিভ ইউ।”

    “ইয়েস স্যার।” উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকলাম এ.সি.পি পুরকায়স্থকে

    বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সইসাবুদ করে যখন ভবানীভবন ছাড়লাম তখন কলকাতা শহরের বুকে ঘন হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।

    বাতাসের গা থেকে হিম এখনও পুরো মিলিয়ে যায়নি। বুকের ভিতর হঠাৎ খালি হয়ে গেল। আজকাল এই অনুভূতিটা প্রবল হয়ে মাঝে মাঝে বুকের উপর চেপে বসে। কোথা থেকে যেন খর হাওয়ার স্রোত আসে, উষ্ণ ধোঁয়াটে কিছু বাস্প আমার শরীরের চারপাশে ঘুরপাক খায়, তারপর ধীরে ধীরে মিশে যায় চারপাশে। কারা যেন ছিল এতদিন পাশে, কারা যেন নরমস্বরে বলেছিল, ‘আমি আছি, ছায়ার মতই থাকব’ তোমার সঙ্গে; তাদের…তাদের মুখগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই পোড়া মুখগুলো আমার স্বপ্নে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অথচ কোনো কথা বলে না!

    বাঘমুণ্ডি, পুরুলিয়া! পুরকায়স্থ স্যার ঠিকই ধরেছিলেন। আয়াম পিসড অফ। এই মুহূর্তে কলকাতার কাছে পিঠে কোথাও পোস্টিং হলে, গণেশদা বা সুমন্তর লিঙ্কগুলো সম্পর্কে আইডিয়া করতে পারতাম। এই এতগুলো মাস সাসপেনশনে বসে, উইদাউট ইউনিফর্মে যে কাজ করেই উঠতে পারিনি। এখন অন্তত, গণেশদার সমসাময়িক ইনফর্মারদের কাউকেই কি খুঁজলে পাওয়া যেত না? সুমন্তর শেষ অ্যাডভাইসটার কথা মনে পড়ে। “মালটা তোদের হেফাজতেই আছে, উগড়িয়ে নে।” হেফাজত থেকে বেরিয়ে গণেশদা ধরা ছোঁওয়ার বাইরে চলে গেছে; অথচ মায়ের মুখটা পনের বছর পরেও একই রকম জ্যান্ত!

    পুরুলিয়ায় পোস্টিংয়ের খবরটা পাওয়ার পর বাবার রিঅ্যাকশনটা অদ্ভুত ছিল। অবশ্য এরকমই একটা কিছু আশা করেছিলাম। পুরুলিয়ার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে আমার। রঘুনাথপুরে মায়ের মামাবাড়ি। মায়ের সঙ্গে জড়িত সামান্যতম স্মৃতির প্রতি বাবা শীতল। আত্মীয়তার সূত্রে, মায়ের জীবদ্দশায় বেশ কয়েকবার গেছি পুরুলিয়া। খুব ছোটবেলার ঘটনা সেসব। তারপরে হাজার ইচ্ছা করলেও বাবা নিয়ে যায়নি। প্রতিবারের মত, কেন প্রশ্ন করলে তার উত্তরও দেয়নি। পুরুলিয়া তাই, আমার মনের কোণে ছাতা পড়া পুরোনো বইয়ের পাতার মত মলিন হতে হতে, খসে পড়ে গেছে।

    পিছন ফিরে একবার ভবানীভবনের বিল্ডিংটাকে দেখলাম। বিপ্লবী ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্যের স্ট্যাচুটার কাছে একটা লাইট বসেছে। শ্বেতপাথরের ফলকে জ্বলজ্বল করছে, “শহিদ ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।” স্ট্যাচুটাকে দেখে না জানি কেন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেলাম। শহিদ শব্দটার প্রতি এরকম অজানা অনুভূতি আগে কোনোদিনও হয়নি। আকাশের দিকে তাকালাম। হেমন্তের গাঢ় নীলচে কালো মেঘমুক্ত আকাশ। ঝকঝক করে তারা জ্বলছে। লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ওদের মধ্যে অগণিত বিস্ফোরণ হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে তার অনন্ত দীপ্তিটুকুই শুধু চোখে পড়ে। মানুষের বুকের ভিতরে যখন এমন বিস্ফোরণ ঘটে, তখন তার আশেপাশের মানুষ টের পায় কি? সে কি নিজেই সবসময় টের পায়!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইলিয়াড – হোমার
    Next Article বিসাশন – পিয়া সরকার

    Related Articles

    পিয়া সরকার

    বিসাশন – পিয়া সরকার

    October 21, 2025
    পিয়া সরকার

    বিসাশন – পিয়া সরকার

    September 12, 2025
    পিয়া সরকার

    বৃশ্চিকচক্র – পিয়া সরকার

    September 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }