ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট্ ক’রে!
“নাম্বারটা লাখনৌয়ের রেজিস্টার্ড ম্যাডাম। গজানন যাদব বলে একটা লোকের নামে। নাম্বারটা গত দেড় মাস ধরে পুরুলিয়ায় অ্যাকটিভ ছিল। আপনি যে ডেটগুলো বলেছেন, সেগুলো ছাড়াও চার-পাঁচ দিন এক্সট্রা। ডেটগুলো কি বলব?”
টেকনিকাল টিম হেডের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।
একটু ভেবে বললাম, “নাম্বারটা নিশ্চয়ই প্রি-পেইড?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম।”
“না ডেট জেনে খুব একটা লাভ নেই। আমাকে কলরেকর্ডস আর টাওয়ার লোকেশনগুলো পাঠান। আর আপাতত নাম্বারটায় সার্ভেলেইন্স বসান। ফোনটা সুইচ অন হলেই আমাকে ইনফর্ম করবেন।”
টেবিলে দেবাশিস মাহাতোর সম্পাদিত পত্রিকাটা পড়ে ছিল। লাল প্রচ্ছদের উপর কালো ক্যালিগ্রাফিতে লেখা ‘কৌম’। ২০০৩ সালের ছাপা। পাতা উল্টাতেই একের পর এক নিবন্ধ, মাওইজম কী ও কেন, ভারতীয় উপমহাদেশে মাওইজম কতটা প্রয়োজনীয়, বাস্তব এবং কিছু অভিজ্ঞতা, জঙ্গলমহলের ডাক, গেরিলা জোন কী এবং কেন, অরণ্যের অধিকার শীর্ষক একাধিক লেখা; পড়তে বসলে দিন কেটে যাবে। আমি বইটায় প্রিন্টারের নাম খুঁজছিলাম। প্রচ্ছদের পিছনের পাতায় ছোট্ট করে ছাপানো রয়েছে নামটা। জয়কালী প্রিন্টার্স, রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া। একটা নাম্বার দেওয়া আছে, প্রত্যাশামতই সেটা গতকাল আউট অফ অর্ডার পেয়েছিলাম। এই ধরণের কাগজপত্র পরিচিত প্রিন্টার ছাড়া ছাপবে না বোঝাই যাচ্ছে। অতএব প্রিন্টারের কাছে দেবাশিস মাহাতোর খোঁজখবর পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু রঘুনাথপুর একটা বড়সড় টাউন। সেখানে জয়কালী প্রিন্টার্সকে পেতে সোর্স লাগবে। এতদিনে সে প্রিন্টার উঠেও যেতে পারে। বিভাসকে বললে কাজটা দ্রুত হবে বলে কাল ওকে খোঁজ নিতে বলে রেখেছিলাম।
আজ খবরের কাগজের হেডলাইনে মুম্বাই পুলিশের বিরাট সাফল্যের কথা বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। গণেশ হুঁই হত্যা মামলায় তদন্তের কাজ প্রায় শেষের পথে। গণেশ হত্যায় সুপারি কিলার নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্ৰথমে সন্দেহ করা হয়েছিল, ইমরান আহমেদ নিজেই গণেশকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নিযুক্ত উকিল সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখিয়েছেন যে গণেশের কেসটায় তিনি ইতিমধ্যেই গণেশকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। গণেশকে সরানোর বরাত দেওয়া হয়েছিল জেলের বাইরে থেকে। সুপারি অনেক হাত ঘুরে জেলেরই এক কয়েদির কাছে পৌঁছায়। সুবিধা করতে এমন এক ওয়ার্ডে গণেশকে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে আহমেদের দলের লোক নেই। পুলিশ ইতিমধ্যেই সেই সুপারি কিলারকে চিহ্নিত করে ফেলেছে। তবে, আসল বরাতটি কে দিয়েছিল, তার খোঁজ চলছে। একটা আর্টিস্ট-স্কেচ আঁকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি আততায়ী পুলিশের হাতে ধরা পড়বে বলে আশা প্ৰকাশ করেছেন পুলিশ কমিশনার।
“এই সুপারি ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং, সুপারি শব্দটাই কেন ব্যবহার করে জানেন ম্যাডাম?” দিব্যজ্যোতি পাশ থেকে ফোড়ন কাটল।
“শুনেছি কোন এক মারাঠি রাজা তাঁর দুরূহতম কাজের জন্য যে সেনাপতিকে নির্বাচন করতেন তাঁকে সুপারি সমেত একটা পান উপহার পাঠাতেন,” অন্যমনস্কভাবে পেপারওয়েট নাড়াতে নাড়াতে বললাম।
“আরিশালা!” দিব্যজ্যোতি পাশ থেকে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলে উঠল, “আপনাকে কে সুপারি দিল ম্যাডাম?”
“আমাকে!” আমি অবাক হয়ে বললাম।
“এই যে জানপ্রাণ লড়িয়ে, সেনাপতি সেজে কঠিন কাজটা করছেন, আপনার রাজাটা কে?” দিব্যজ্যোতি পাশ থেকে হাসতে হাসতে বলল।
দিব্যজ্যোতির প্রশ্নটা কেন এত অদ্ভুত লাগল জানি না। কোনো উত্তর না দিতে পেরে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। প্রতিটা তদন্তের একটা নিজস্ব গতিপথ থাকে। যতই গোয়েন্দা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একটা উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন, কাহিনীর শেষটুকু তাঁর হাত থেকে পিছলে পিছলে বেরিয়ে যায়। যত পরিণতি এগিয়ে আসে, তত পরিস্থিতি খরস্রোতা হয়। আমার মন বলছিল, এই কাহিনীর পরিণতি খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে।
মতিদাকে একটা ফোন করলাম। ফোনটা রিং হয়ে হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। বিধুর বিরুদ্ধে খুনের ধারায় চার্জশিট রেডি করছিলেন। শুনেছি ডক্টর উমানাথন কলকাতায় গেছেন। পুরুলিয়া ফিরছেন পরশুদিন সকালে। আসলেই ওঁকে জেরা করতে হবে জানিয়েছেন এস.পি। জনমোর্চা থেকে ব্যাপক প্রেশার আসছে এই ব্যাপারে। মতিদার বা নীচুতলার পুলিশ কর্মচারীদের ধারণা, উমানাথনকে সম্পূর্ণ বিনা কারণে হ্যারাস করার জন্য এই কেসে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আজ দুটো এক্সট্রা টিম তৈরি করা হয়েছে বিধু আর ওর সঙ্গীকে খোঁজার জন্য। বনদপ্তরকেও ইনফর্ম করা হয়েছে। যদি জঙ্গলে কোথাও লুকিয়ে থাকে ওরা!
আমার ফোনের কলার-আইডিতে দেখাচ্ছিল বিভাস ফোন করেছে।
***
জয়কালী প্রিন্টার্স একটা ঘুপচি মত দোকান। দোকানের বাইরে হলুদ সাইনবোর্ড ব্যাঁকা হয়ে ঝুলছে। সব ধরণের ছাপার কাজ সুলভ মূল্যে করা হয় লেখা রয়েছে বোর্ডে। ছফুট বাই দুফুটের সরু দরজাটার মুখে টিনের গেট বসানো। ভিতরে ঢুকলে একটা পাঁচ বাই ছয় মাপের ঘর দেখা যায়। সেখানে আদ্যিকালের প্রিন্ট মেশিনে একটা রোগা মত লোক কাজ করছে। বিল বই প্রিন্ট হচ্ছে। ঘটাংঘট ঘটাংঘট শব্দের তাণ্ডবে গলা তুলে কথা বলতে হয়।
“আমরা মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।” বিভাস লোকটাকে বলল।
চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, জয়কালী প্রিন্টার্সের শুধু বাইরেটা নয়, ভেতরটাও একইরকম আটপৌরে। নীল রঙের চুনকাম করা দেওয়ালের খুপরিতে লক্ষ্মী গণেশের মূর্তিতে শুকনো একটা গাঁদার মালা ঝুলছে। হরেক রকমের ক্যালেন্ডার ঝোলানো দেওয়ালে। স্টিলের র্যাকে ধুলো পড়া পুরোনো কাগজপত্র ফাইল রাখা। ছাদ থেকে তিনফুট নিচে ঢালাই দিয়ে সিমেন্টের বাঙ্ক বসানো। সেখানে ফাইলের সারিতে, বিভিন্ন রেজিস্টারের স্তূপে মাকড়সার জাল জড়িয়ে একাকার অবস্থা। ঘরে একটাই দরজা, তাতে সিন্থেটিক শাড়ি কেটে পর্দা ঝোলানো। ওপাশটা বোধহয় বাসস্থান।
লোকটা মালিককে ডাকতে গিয়েছিল।
কিছুক্ষণ পরে একটা হলদেটে গেঞ্জি আর নীল চেক লুঙ্গি পরা এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি ঘরে ঢুকলেন। বছর পঞ্চাশ বয়স হবে লোকটার, বুকে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা ঝুলছে, সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটেন।
“কী চাই?” লোকটা নাক উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“একটা পত্রিকার ব্যাপারে এসেছিলাম।”
“বৈশাখি পত্রিকা? কবে লাগবে? এখন একটু অন্য কাজের চাপ চলছে, তাড়া দিলে হবে না।” লোকটা বিরক্তিসহকারে বলল।
বুঝলাম লোকটা চশমা ছাড়া অন্ধ। নাহলে আমাদের ইউনিফর্মগুলো দেখতে পেত।
“না, না, অন্য একটা পত্রিকা। আপনাদের এখান থেকে ২০০৩ সালে ছাপা হয়েছিল। সেটার ব্যাপারে একটা তথ্য দরকার ছিল।”
বিভাস পত্রিকাটা এগিয়ে দিল।
লোকটা এবার চশমাটা নাকে পরে পত্রিকাটার দিকে হাত বাড়াল। একবার পত্রিকার দিকে, একবার আমাদের দিকে তাকাল। তারপর নির্বিকারে চশমাটা আবার চোখ থেকে খুলে বলল, “পুলিশ নাকি?”
“হ্যাঁ। বাঘমুণ্ডি পি.এস থেকে।” এবার আমি উত্তর দিলাম।
“বলুন কী জানতে চান।” লোকটা সন্দেহজনক ভাবে আমাকে দেখতে দেখতে বলল।
“এই পত্রিকাটা বার করতেন দেবাশিস মাহাতো বলে রঘুনাথপুর কলেজের এক শিক্ষক।”
“হ্যাঁ।” লোকটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, লোকটার অন্তত মনে আছে।
“আমরা তাঁর এক বন্ধুর খোঁজে এসেছি। পত্রিকার ব্যাপারে তিনি দেবাশিসের সাহায্যকারী ছিলেন। আপনার কি কিছু মনে আছে, কে ছিলেন?”
টিউবলাইটের অল্প আলোয় ঠিক দেখলাম কিনা জানি না, মনে হল লোকটার চোখের তারায় একটা হাসি খেলে এল। একইরকম সন্দেহজনক হেসে বলল, “আলবাত মনে আছে। কী জানবেন বলুন?”
“না, মানে তাঁর নাম ঠিকানা? কোথায় গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে?”
লোকটা ধীর পায়ে হেঁটে একটা চেয়ারের দিকে গেল, তারপর আমাদের দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলল, “এই তো, যেখানে এসেছেন। আমিই দেবাশিসের সেই বন্ধু। আমার নাম পরিমল সরকার।”
আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। বিভাসকে আড়চোখে দেখলাম ও হাঁ হয়ে গেছে। পরিমল সরকার আমাদের দুজনকে দুটো চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “বসুন। বলুন কী জানবেন।”
“আসলে একটা কেসের ব্যাপারে দেবাশিস মাহাতোর নামটা উঠে এসেছে। ওঁর সম্বন্ধে কিছু ইনফর্মেশন…”
লোকটা আমাকে থামিয়ে বলল, “কোন কেস? নিশীথ মাহাতোর মার্ডার?”
আমি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
“হুম।” লোকটা থুতনিতে হাত দিয়ে কী যেন চিন্তা করছিল। পত্রিকার পাতাগুলো অমনোযোগী ভাবে উল্টাতে উল্টাতে বলল, “বলুন কী জানতে চান।”
“মানে দেবাশিস মাহাতোর সম্পর্কে আপনি যা যা জানেন সবটাই, লোকটার সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইনফর্মেশন নেই আমাদের কাছে।”
পরিমল সরকার হো হো করে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসির শব্দে প্রিন্টিং মেশিনে কাজ করা লোকটা কাজ থামিয়ে এদিকে তাকাল।
“ব্র্যান্ডেড মাওয়িস্ট দেবাশিস মাহাতোর ব্যাপারে পুলিশ হেল্প চাইছে আরেক ব্র্যান্ডেড মাওয়িস্ট পরিমল সরকারের কাছে! ভালো মজা করতে পারেন আপনারা!”
“আপনিও?” আমি একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
লোকটা আহত পশুর মত আক্রোশ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে ডান চোখটা দেখছেন, এটায় ৮০ পার্সেন্ট ব্লাইন্ডনেস। টানা চড়া আলোর দিকে চোখ খুলে রাখার ফল। পা-টা দেখছেন? টানা উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে পায়ের চেটোতে মারার ফল। এবার বলুন?”
“আপনাকে কি দেবাশিস মাহাতোর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয়?” আমি অস্বস্তিটাকে গিলতে গিলতে বললাম।
“টর্চার করা হয় বলুন,” লোকটা ব্যঙ্গভরে হেসে বলল, “নাহ! দেবাশিসের কেসের সঙ্গে আমাকে কাস্টডিতে নেওয়ার সম্পর্ক নেই। আমাকে আলট্রা লিটারেচার বিলোনোর অভিযোগে যাদবপুর থেকে ধরা হয় ২০০৫ এর মার্চে। হাইকমান্ডের নির্দেশে কলকাতায় জনমত গড়ে তোলার জন্য যে টিম তৈরি হয়েছিল, তার সদস্য ছিলাম আমি।”
“দেবাশিস মাহাতোও তো প্রথমে জনমত সংগঠনের কাজে জড়িত ছিলেন?” আমি চেয়ারে নড়ে চড়ে বসে বললাম।
“অফকোর্স,” পরিমল হাঁটুর উপর চাপড় মেরে বললেন, “দেবু পড়ুয়া ছেলে ছিল। দলের সম্পদ ছিল। পার্টি ম্যানিফেস্টো গ্রন্থিত করা থেকে শুরু করে, দলগত নীতি নির্ধারণ, লোকাল ছেলেপুলেদের আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানানো, তাদের সদস্য হিসেবে দলে নেওয়া, আন্দোলনের গতিবিধি ঠিক করা…দেবাশিস বিরাট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।”
আমি টানটান হয়ে বসলাম। দেবাশিস মাহাতোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা খুব জরুরি, খুব জরুরি!
কেউ যেন পরিমল সরকারের স্মৃতি উস্কে দিয়েছিল… উনি ঘোরের মধ্যে বলে চললেন, “সে এক অদ্ভুত সময়। সত্তর দশকের নকশালবাদি আন্দোলন কেন ব্যর্থ হল, সেই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারতো দেবাশিস। কোন পথে এগোলে দলগত সাম্য বজায় থাকবে, কী করে গেরিলা জোনে একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক সিস্টেম গড়ে তোলা যায়, কোন পথে এগোলে দীর্ঘদিনের বঞ্চিত মানুষগুলো নিজেদের কথা মুখ খুলে বলতে পারবে, বধির সরকারকে কীভাবে মনোযোগী শ্রোতায় পরিবর্তন করা যেতে পারে, এই সব নিয়েই ও রাতদিন পড়ে থাকত।”
“আপনি কতদিন চিনতেন ওঁকে?”
পরিমল একটা উদগার সামলাতে সামলাতে বললেন, “কলেজ থেকেই। আমরা ৯১-এর ব্যাচ। তখন আমরা কেউই সে অর্থে অ্যাক্টিভ পলিটিক্স করি না। তৎকালীন শাসক দলের সদস্য ছিলাম। মত এবং আদর্শগত বৈষম্যের জন্য দুজনেই পার্টি ছাড়ি। দেবাশিস বলত, এভাবে হবে না। গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আমরা দুজন রাত জেগে পথ ভাবতাম, বিপ্লবের পথ, মুক্তির পথ।”
“তারপর?”
“দেবু প্রচুর টিউশনি করত। স্টুডেন্টদের পড়ানোর সময় ধীরে ধীরে তাদের মাথায় মাওয়িস্ট আদর্শগুলো ইনজেক্ট করতে শুরু করে। এরকমই এক স্টুডেন্টের বাড়িতে ওর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মেয়েটির বাড়ি থেকে প্রবল আপত্তি হয়। এবং সম্পর্কটি কেঁচে যায়। তারপর থেকেই ও একেবারে লাগামহীন ঘোড়া হয়ে ওঠে।”
“আপনারা অ্যাক্টিভ পলিটিক্সে কবে আসেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“১৯৯৪ সালে। তার দু বছর আগে দণ্ডকারণ্যে ছটা রিজিওনাল নকশাল গ্রুপ এক হয়ে সিপিআই(এম.এল-জনশক্তি) গড়ে উঠল। ৯৪তে বিলাসপুরে আমরা দুজন পলিটব্যুরো মিটিং অ্যাটেন্ড করলাম। দেবাশিস উল্লসিত হয়েছিল, বলেছিল সময় এসেছে। আমরা হয়তো এবার সত্যি পারব।”
আমি লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। লোকটার আপাত ভাবলেশহীন মুখটায় একটা ঔজ্জ্বল্য এসেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, “আমাদের সবার গেরিলা ট্রেনিং হয়। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেবাশিসকে হাইকমান্ড থেকে ফিনানশিয়াল দিকটার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওর গেরিলা জীবনের অনেকটাই সাংগঠনিক কাজে কেটেছে। গেরিলা জোনগুলোয় ফান্ড কালেকশন, সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার, অ্যানুয়াল বাজেট তৈরি, বেসগুলোর ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ডেভেলপমেন্ট…এইসবই ও প্রধানত দেখত।”
“কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেবাশিসবাবু নিজের আদর্শ থেকে সরে আসেন। গেরিলা জোনে অর্থনৈতিক দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েন, তাই তো? দিবাকর বিশ্বাসকে অপহরণ করে…”
“একদম বাজে কথা!” পরিমল সরকার গর্জে উঠে বললেন, “দিবাকর বিশ্বাসের যখন অপহরণ হয়, তখন দেবুর অলরেডি মোহভঙ্গ হয়েছে। ও কখনই বিশ্বাসের কিডন্যাপিং করতে পারে না।”
সাধু মাণ্ডির কথা মনে পড়ে গেল আমার। নিশীথ মাহাতোর পদক্ষেপের বিপরীতে গিয়ে সাধু আর বিধুকে আশ্বাস দিয়েছিলেন দেবাশিস।
“বাঘমুণ্ডি আর ঝালদায় যে গেরিলা মুভমেন্ট হয়, প্রথমে তার কমান্ডার ছিলেন লোকমান মুর্মু। পুলিশ এনকাউন্টারে উনি মারা গেলে নিশীথ মাহাতো সেই পোস্টে আসে। দেবাশিস প্রথম থেকেই ফিনান্সিয়াল কমিটির সভাপতি ছিল। বাঘমুণ্ডি বেল্টের ডেভেলপমেন্টগুলো দেখত। হাইকমান্ডের নির্দেশে আমি তখন কলকাতায়। একদিন কলেজ স্ট্রিটে দেখা হল। দেবাশিসের মুখ দেখে চমকে গেলাম। কী চেহারা হয়েছিল ওর! আমাকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকল, বলল, কিচ্ছু ঠিক নেই পরি। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যাদেরকে এতদিন বিশ্বাস করেছি, তাদের মুখগুলো মুখোশের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। যাদের এতদিন শত্রু ভাবতাম, দল তাদেরই কারুর কারুর সাহায্যে চলছে।” পরিমল সরকার এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলেন।
আমার মাথায় একটা সম্ভাবনার কথা এল। দেবাশিস মাহাতো কী বিশেষ কারুর কথা বলেছিলেন!
পরিমল সরকারকে প্রশ্নটা করতেই উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, “দেবু পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, এত রক্তক্ষয়ের বদলে আমরা কী পাচ্ছি সেটা ভাবতে হবে। রক্তক্ষয়ের আড়ালে নিজের লোকেরাই সেই রক্ত জোঁক হয়ে শুষে নিচ্ছে কিনা চিন্তা করতে হবে। বলেছিল সত্যিকারের উন্নয়নের নামে আই-ওয়াশ চলছে। আন্দোলনের উদ্দেশ্যে নয়, অস্ত্র ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের উপর জোর জবরদস্তি করাটা প্র্যাকটিসে পরিণত হচ্ছে। জানিয়েছিল অনেক ব্যাপার আছে, মেইনস্ট্রিমের কিছু লোক বিপ্লবের সুযোগে নিজের পকেট ভরছে। নিশীথ নাকি দেখেও সেসব দেখছে না।”
“দেবাশিস কাদের সম্পর্কে এমন বলছেন, জিজ্ঞাসা করেননি?” আমি ভয়াবহ একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
“করেছিলাম। দেবু কিছু বলতে চায়নি। বলেছিল, ও সমস্যার গোড়ায় আঘাত করবে। যে লোকগুলোর ভালোমন্দ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, তাদেরকে সত্যিটা জানিয়ে দেবে। বলেছিল নেক্সট পলিটব্যুরো মিটিংয়ে হাইকমান্ডকে সব জানাবে।”
আমার মাথায় একটা অস্পষ্ট সম্ভাবনা ক্রমশ পরিণত রূপ নিচ্ছিল। দিবাকর বিশ্বাসের খুনে দেবাশিস মাহাতো জড়িত ছিলেন না। বরং তিনি হয়ত গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছিলেন। নিশীথের সঙ্গে কে সেই মেইনস্ট্রিমের লোক যিনি দিনের পর দিন নিজের পকেট গরম করেছেন! দেবাশিস কি তাঁর পরিচয় জানতে পেরেছিলেন? তাঁকে কি কোনো থ্রেটের মুখে পালাতে হয়েছিল? তিনি কি এতদিন স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুরেছিলেন? বিদ্যুৎচমকের মত মনে হল, দেবাশিস কি তবে…
“আপনার সঙ্গে দেবাশিস মাহাতোর যোগাযোগ আছে? এনি লিঙ্ক?” আমি তড়িঘড়ি বলে উঠলাম।
পরিমল সরকার খুব অবাক হয়ে আমাকে বললেন, “মানে!”
“নিশীথ মাহাতো খুনে দেবাশিসবাবুর হাত থাকতে পারে। আপনার সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছিল?” উত্তেজনায় আমার নাকের ডগায় ঘাম জমছিল।
“ফাজলামি হচ্ছে? নিজেরাই ছেলেটাকে শ্যুট আউটে মেরে আবার নিজেরাই খোঁজ চাইছেন!”
“মানে!” আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
পরিমল সরকার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। বললেন, “তখন আমি আলিপুর জেলে। পাঁচ সালেরই কথা, দিবাকর বিশ্বাস সবে নিখোঁজ হয়েছেন। জেলের লাইব্রেরিতে অতি ওঁচা মানের কিছু খবরের কাগজ আসত। তারই একটায়, খবরের কাগজটার নাম বোধ হয়, ভোরের বার্তা, তার চারনম্বর পাতার এককোণে একদিন একটা খুব অস্পষ্ট সাদা কালো ছবি বেরিয়েছিল। একটা ডেডবডির ছবি। পিস্তলের গুলিতে মুখটা বিকৃত। কলকাতা পুলিশের তরফে বিজ্ঞাপন ছিল, আনআইডেন্টিফায়েড মেল বডি সনাক্তকরণের জন্য। অত ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো, চিনতে ভুল হয়নি। দেখলাম, দেবাশিস লাশ হয়ে গেছে। কত ছেলেকে এভাবে মেরে আনআইডেন্টিফায়েড বলে চালিয়ে দিল পুলিশ! আচ্ছা, কলকাতায় কি ও কোথাও লুকিয়েছিল? মানে পুলিশ ওকে খুঁজে পেল কী করে? আপনার উপরওয়ালাদের কাছ থেকে খোঁজটা এনে দিতে পারেন আমায়?”
পরিমল সরকারের গলা আবেগে কেঁপে গিয়েছিল। আমার কানে ওঁর কথা ভাসা ভাসা ঢুকছিল।
“আমি তখন জেলে…ছাড়া পেলাম দশ সালে…তখন সব চাপা পড়ে গেছে…কোথায় যাব, কী করব!” পরিমল সরকার আক্ষেপ করছিলেন।
“দেবাশিসবাবুর কোনো নিকটাত্মীয় ছিল? ঝালদা থানায় বলছিল ভাই বোন ছিল ভদ্রলোকের?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“ভাই-বোন তো নয়!” পরিমল মাথা নেড়ে বললেন, “একটাই ভাই। অনেক ছোট, পনের বছরের ছোট। দেবু ভাই বলতে অজ্ঞান ছিল।”
“একমাত্র ভাই? তিনি এখন কোথায়?” আমার গলায় এমন কিছু ছিল যে বিভাস চমকে আমার দিকে তাকালো।
“তা তো বলতে পারব না। ঝালদায় গিয়েছিলাম। ওর বাড়িটা তো ধ্বংসস্তূপ, কেউ থাকে না।” পরিমল খুব দুঃখিত মুখে বললেন।
“দেবাশিসবাবুর ভাই সেসময় কী করতেন জানেন?”
“আমার সঙ্গে যেবার দেবুর লাস্ট দেখা হয়, তখন দেবুর ভাই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল যতদূর মনে আছে। জার্নালিজম পড়তে উৎসাহী ছিল। দেবু কলেজের নামও বলেছিল…কিন্তু এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না বুঝলেন।”
“কী নাম ছিল দেবাশিস মাহাতোর ভাইয়ের?”
পরিমল মাথার রগ চেপে ভাবার চেষ্টা করলেন, বেশ পরিশ্রমের পর বলে উঠলেন, “শিবু…শিবাশিস। শিবাশিস মাহাতো।”
“তার সম্পর্কে আর কোনো ইনফর্মেশন? যতই অকিঞ্চিৎকর হোক…স্কুলের নাম, হবি, বন্ধুবান্ধব কিছু মনে পড়ছে না?”
পরিমল সরকার মনে মনে এর উত্তর হাতড়ানোর চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, “নাহ। কিছুতেই মনে পড়ছে না। আসলে দেবুর বাড়িতে আমি খুব কমই গেছি। যা দেখা সাক্ষাৎ হত, রঘুনাথপুরেই হত। তাও আমার যদি মনে পড়ে আপনাকে ফোন করব। নাম্বারটা দিয়ে যান।”
“শিবাশিসের কোনো ছবি? আপনার আর দেবাশিসবাবুর কোনো ছবি?”
পরিমল সরকার ঘরের এদিক ওদিক অসহায়ভাবে মাথা ঘোরালেন। তারপর বললেন, “আমার আর দেবাশিসের ছবি ছিল। কিন্তু এত বছরে কোথায় মিসপ্লেসড হয়ে গেছে, খোঁজা মুশকিল। আর শিবাশিসের তো কোনো ছবি নেই আমার কাছে।
“স্কেচ আর্টিস্টকে বলতে পারবেন কেমন দেখতে ছিল?”
“তাকে শেষ দেখেছি তিরিশ বত্রিশ বছর আগে। তখন সে নয় দশ বছরের বালক। এখন কি আর কোনো মিল থাকবে? এ ব্যাপারে আমি আপনাদের কোনো হেল্প করতে পারব বলে মনে হয় না।”
জয়কালী থেকে বেরিয়ে জিপে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। শিবাশিস মাহাতো…একটা নতুন নাম। যাকে কোথায় পাওয়া যাবে, কবে পাওয়া যাবে পুরোটাই ধোঁয়াশা। দেবাশিসবাবুর অমন একটা মৃত্যুতে তার প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। সে নিশ্চয়ই তার দাদাকে খুঁজেছিল। কেউ না মনে রাখলেও, সে নিশ্চয়ই মনে রেখেছিল। আমাদের চারপাশে যে সব প্রিয়জন থাকেন, তাদের হঠাৎ নেই হয়ে যাওয়াটা মানতে এক আলোকবর্ষ সময় লাগে না। ছন্দে গাঁথা প্রতিটা মানুষের জীবন, বিন্দুমাত্র ছন্দচ্যুতিতে প্রকৃতির অসুবিধা, জীবনের অসীম অপচয়! কিন্তু যারা সেই ছন্দে কম্পিত হতে অস্বীকার করেন, তাদের উপর ঠিক কতটা প্রতিকূল হয়ে জীবন প্রতিশোধ নেয়, তা আমার জানা আছে। অথচ সেই সব মানুষের প্রতিস্পর্ধাকেই তো আতশবাজির সঙ্গে তুলনা করি আমরা। আমি শিবাশিস মাহাতোকে অনুভব করতে পারছিলাম।
বিধুর সঙ্গে লোকটার যোগাযোগ থাকা স্বাভাবিক। লাখনৌয়ের নাম্বারটিও তিনিই সিওর ব্যবহার করছেন। মাথার ভিতরে যে সিঁড়িভাঙা অঙ্ক চলছিল, তার শেষ ধাপে পৌঁছে গেছি। এখন দরকার শিবাশিস অবধি পৌঁছানো। তবু, কটা তথ্যয় কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল!
রঘুনাথপুর…দেবাশিস মাহাতোর কেটে যাওয়া সম্পর্ক…পেপারে গুলিতে বিকৃত মুখের ছবি! এতগুলো সমাপতন, একসঙ্গে কেন! ভোরের বার্তার অনলাইন আকাইভ নেই। পেপারটাও বোধহয় উঠে গেছে। পরে একবার ভেবে দেখব মনে করে, মন থেকে অদ্ভুত অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলতেই মতিদা ফোন করলেন।
“কোথায় আছিস?” মতিদা খুব ব্যস্ত গলায় বললেন।
“রঘুনাথপুরে।”
“পুরুলিয়ায় মিট কর সাড়ে ছটায়। স্বয়ং ডি.আই.জির তলব।”
“কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা ছিল। কেসটা…”
“সব কথা হবে। ডি.আই.জির সামনে বলিস।”
“কিন্তু…”
মতিদা ফোনটা কেটে দিলেন। আমি সন্দীপের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। ব্যালিস্টিক রিপোর্টটা নিয়ে এক্সপার্টের কী বক্তব্য সেটা জানার দরকার ছিল। অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে জানার দরকার ছিল।
