বোম্বাগড়ের রাজা
রাত প্রায় দেড়টা বাজছিল। আমি আর মতিদা পুরুলিয়া স্টেশনের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। ডক্টর উমানাথন কলকাতা গিয়েছিলেন তিনদিন আগে। কাল ভোরে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে ফিরবেন বলে হাসপাতালে জানিয়েছিলেন। “এরকম জটিল কেস আমি আগে দেখিনি দর্শনা। এই বিধু বা শিবাশিস এরা কি উমানাথনের আসল চেহারাটা ধরতে পারেনি!”
মতিদার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ফিজিক্সের নিয়ম মতিদা, যে কোনো অবজেক্টকে মোটামুটি পরিষ্কার ভাবে দেখতে গেলে, মিনিমাম ২৫ সেমি দূরে রাখতে হয়। তার থেকে কাছে চলে এলে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। খুব কাছে থাকা মানুষদের সম্পর্কেও বোধহয় এমন ঝাপসা একটা মনোভাব কাজ করে। তাদের সম্পর্কে আমাদের জাজমেন্ট ভুলভাল হয়।”
“কিন্তু…”, মতিদা খুব সংশয় নিয়ে বললেন, “আমরা কোনো ভুল করছি না তো! জানিস, একবার আমার মা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অত রাতে কোথায় যাব, কী করব, বুঝতে না পেরে স্যারকে ফোন করেছিলাম। স্যার মুহূর্তে জিপে চলে এলেন। তারপর রাত জেগে স্যালাইন, ইঞ্জেকশন, ওষুধ, পথ্য…ভোরে একটু স্টেবল হলে কলকাতার হাসপাতালে শিফ্ট! সেই লোক এরকম! কী করে হয় বলতো!”
আমি মতিদার কথার উত্তর দিলাম না। মোবাইল ব্রাউজারে দ্য পিপলের ওয়েবপেজ খুলে পড়ছিলাম।
মতিদা পাশ থেকে বিরক্ত স্বরে বললেন, “তখন থেকে কী করছিস বলতো?”
“কিছু না! এই জাস্ট ভাবছি।”
মতিদা পাশে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দুটো ফোন করার ছিল। প্রথম ফোনটা সুইচড অফ এল। দ্বিতীয় ফোনটা করলাম সন্দীপকে। ও বলেছিল যতই রাত হোক, বুলেটের ফাইনাল ব্যালিস্টিক রিপোর্টটা পাঠাবে।
চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার পুরুলিয়া স্টেশনে ঢুকল সকাল ছটা পনেরো নাগাদ। ডক্টর উমানাথনের কোচ বা বার্থ নম্বর কিছু জানা ছিল না। আমরা পুরুলিয়া স্টেশনে তাঁর জন্য অপেক্ষায় আছি, এ কথা সহজবোধ্য কারণেই বলা হয়নি। মতিদা ঠিক করলেন, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে টিকিট কাউন্টারের পাশে অপেক্ষা করবেন। বাঘমুণ্ডি যেতে গেলে এদিক দিয়েই বেরোতে হয়। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পনেরো পরেও ডক্টর উমানাথনকে দেখা গেল না। মতিদা অধৈর্য হয়ে বললেন, “কী ব্যাপার বলতো? ফেরেনি নাকি?”
“হাসপাতাল ঠিকঠাক জানে তো?”
“অফকোর্স। কাল রাতে আমার সুপারের সঙ্গে কথা হয়েছে। সুপার কনফার্ম করেছেন যে ফিরবেন। কিছু আঁচ করে ফেলল না তো?”
“ফোন করুন।”
“করলাম তো। সুইচড অফ।” মতিদা চিন্তিত স্বরে বললেন।
আমি মতিদার দিকে তাকালাম। “আপনি বলছেন জেরা হতে পারে জেনে ডক্টর উমানাথন কেটে পড়েছেন?”
মতিদা আমার কথার উত্তর দিলেন না। ক্ষিপ্র একটা গলায় বললেন, “আয় তো।”
চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার বেরিয়ে যাওয়ার পর পুরুলিয়া তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম আবার খাঁ-খাঁ করছিল। তিন নম্বরে ডাক্তারকে না পেয়ে আমরা আবার একে ফিরে এলাম। স্টেশন ম্যানেজারের ঘরটা স্টেশনের প্রায় শেষের দিকে। সাদা লালে রঙ করা ছোট টিলা বাড়ির মত। কাঠগোলাপ গাছ কাত হয়ে ঝুঁকে পড়েছে দেওয়ালে। পাবলিক টয়লেট, জলের কল, বসার জায়গা সব ধু-ধু ফাঁকা। একটা ঝালমুড়িওয়ালা বসে ছিল। সে ঘাড় নাড়িয়ে বলল কাউকে দেখেনি।
প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকেও লোকজন নেই। কটা চায়ের দোকান খুলেছে মাত্র। একজন পোর্টার জল ছিটোচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে মতিদা বললেন, “চল, একবার স্টেশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলি। টিটিকে ধরে যদি বার করা যায় যে লোকটা আদৌ ট্রেনে উঠেছিল নাকি!’
স্টেশন ম্যানেজার দ্রুত টিটিকে ফোনে ধরিয়ে দিলেন। রিজার্ভেশন লিস্ট ঘাঁটতে দশমিনিট সময় চেয়ে নিলেন টিটি। মতিদা উত্তেজনায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন। আমি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে এগিয়ে দিতেই পিছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর এল, “কী ব্যাপার! তোমরা এখানে যে?”
ডাক্তারকে আর পাওয়া যাবে না ভেবে নিয়ে মতিদা এত সিওর হয়ে গিয়েছিলেন যে চট করে কিছু বলতে পারলেন না। উমানাথন আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার, তোমরা সাতসকালে স্টেশনে কী করছ?”
মিনিট দশেক পরে ওঁকে নিয়ে আমাদের কোয়ালিসটা যখন পুরুলিয়া থানার দিকে রওনা হল, তখন ঘড়িতে সাতটা বাজে।
****
উমানাথনের মুখটা দমচাপা রাগে ফেটে পড়বে মনে হচ্ছিল। ইন্টেরোগেশন রুমের দরজাটা খুলে ঢুকতেই চেঁচিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে কী এগুলো মতি!
আমাকে এভাবে হ্যারাস করা হচ্ছে কেন?”
মতিদা চেয়ারটা টেনে সামনে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “দিবাকর বিশ্বাসের কেসটা আরেকবার রি-ওপেন করতে হবে স্যার। তাই আপনাকে একবার কষ্ট করতে হবে।”
উমানাথন বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেললেন। মাত্র কয়েকসেকেন্ড; তারপরেই চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তাই বুঝি! তা একটা ক্লোজড কেসে নতুন করে জেরা করতে কী সব ফর্মালিটি-টিটি আছে না? সেসব করা আছে তো তোমাদের?”
“ফর্মালিটির কথা এত মাথায় আসছে কেন আপনার? তদন্ত পিছোতে চাইছেন নাকি?” মতিদা কড়া স্বরে বললেন।
“শাটাপ! তোমাকে আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। তোমরা সবাই একই ক্যাটাগরির। আসল লোককে খুঁজে না পেয়ে, সাধারণ নিরীহ লোককে টর্চার
করো।”
“আপনাকে কোনো টর্চার করা হচ্ছে না। জাস্ট কটা প্রশ্ন…” আমি নীচু গলায় বলে উঠলাম।
“স্টপ ইওর হাউজওয়ার্মিং টেকনিকস, ওকে? তোমার যতদিন না বয়েস, তার থেকে বেশি সময় আমি পুলিশের সঙ্গে কাটিয়েছি।”
মতিদা পাশ থেকে বলে উঠলেন, “সেটাই আপনার সবথেকে বড় রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াল।”
“কী বলতে চাইছ কী মতি?” উমানাথনের চোখমুখ টকটক করছিল।
মতিদা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালেন। তারপর বললেন, “এত রাগ করছেন কেন স্যার, কটা প্রশ্নের উত্তর দিলেই তো মিটে যায়। আগে শুনুন তো প্রশ্নগুলো।”
“আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। আমার সে অধিকার আছে।”
“ষোলো বছর আগে সি.আই.ডিকেও বুঝি একই কথা বলেছিলেন?” মতিদা সরাসরি তাকিয়ে বললেন।
“মানে?”
“মানে কিছুই না, আইনকে হাতিয়ার করে, কটা পেন খাতা কম্বল বালিশ বিলিয়ে, কটা ওষুধপত্রের ফ্রি স্যাম্পল দিয়ে স্থানীয় মানুষদের হাত করে বেঁচে গিয়েছিলেন কি আগেরবার?”
উমানাথন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “তোমার কোনো আইডিয়া আছে তুমি কী বলছ?”
“ভুল কিছু বললাম?” মতিদা শান্ত স্বরে বললেন।
“আলবাত।” উমানাথন হুঙ্কার ছুড়ে বললেন, “আমি আমার জীবনের চল্লিশটা…চল্লিশটা বছর পুরুলিয়াকে দিয়েছি। এ জেলার জল, মাটি, মানুষকে ভালোবেসেছি। তারাও আমাকে ভালোবেসেছে। কখনও কোন সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য নিইনি, যা করেছি নিজের দমে করেছি। আর তুমি বলছ আমি ওদের ইউটিলাইজ করেছি!”
“দিবাকর বিশ্বাস বা নিশীথ মাহাতোর খুনে আপনার কী ভূমিকা আছে?”
“জাস্ট শাটাপ…শাটাআআআপ মতি! দিবাকরকে আমি জাস্ট চিনতাম। এই একই প্রশ্নের উত্তর আমি সি.আই.ডিকে অন্তত কয়েকশো বার দিয়েছি। দিবাকর কীভাবে খুন হল আমি জানি না।”
“আর নিশীথ মাহাতো?”
“নিশীথের মৃত্যুতে আমি খুব খুশি হয়েছি, এতটাই যে পার্টি দিতে ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু ওকে কে খুন করেছে আমি জানি না।” উমানাথন মতিদার চোখে চোখ রেখে বললেন।
“এখন তো জানেন?” মতিদা গুলির মত প্রশ্ন করলেন।
“মানে?”
“শিবাশিস মাহাতো কোথায়?” আমি এতক্ষণে একটা প্রশ্ন করলাম।
“এই ঘটনার সাথে শিবুর কী সম্পর্ক?” উমানাথন একটু থমকে গিয়ে উত্তর দিলেন।
“তাকে তো আপনি ছোট থেকে চেনেন?” আমি বলে উঠলাম।
“হ্যাঁ তাতে কী? এইসব খুন জখমের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সে মেধাবী ছেলে, কৃতী মানুষ।”
“দেবাশিস মাহাতোর নিখোঁজের সময় সে কোথায় ছিল?”
“সে দিল্লীতে পড়াশুনা করত, ওখানেই ছিল।”
“দিল্লীতে কোথায় পড়াশুনা করত?”
“জে.এন.ইউ তে। মাস কমিউনিকেশন বিভাগে।”
“তাহলে আপনি জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা বলছেন। ২০০৫ এর জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি ছাত্র বিক্ষোভে জে.এন.ইউয়ের পড়াশুনা বন্ধ ছিল। শিবাশিস মোস্ট লাইকলি এখানেই ছিলেন।”
আমি কথাটা সম্পূর্ণ বানিয়ে বলে উমানাথনের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম। উমানাথন টোপটা গিললেন।
“এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।” উমানাথন ইতস্তত করে বললেন। “আমি বলি?”
উমানাথন আমার দিকে তাকালেন।
“আমার বিশ্বাস আপনি শিবাশিস মাহাতোকে দিল্লীতে পালাতে হেল্প করেছিলেন। পুলিশকে বলেন সে অনেক আগেই দিল্লীতে ফিরে গেছে।”
উমানাথন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মতিদা আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, “কী প্রশ্ন করছিস এসব?”
“শিবাশিস মাহাতো বাঘমুণ্ডিতে কবে এসেছিল?” আমি মতিদার কথার উত্তর না দিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম।
“গত দুমাসে একবারও নয়।”
“আবার বাজে কথা বলছেন।” মতিদা গর্জে উঠলেন।
“এই নাম্বারটা চেনেন?” ভুয়ো নাম্বারটা দেখিয়ে বললাম। “এটা শিবাশিস ব্যবহার করছিলেন?”
উমানাথন কল রেকর্ডসটা দেখে বললেন, “শিবুর নাম্বার আমার কাছে সেভ করা আছে। মিলিয়ে দেখুন। এটা ওর নাম্বার নয়।”
“উনি এখন কোথায়?”
“সেটা আমি কীভাবে জানব? তার কাজের সুবাদে সে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেরায়।”
“কী কাজ করেন? কোথায় আছেন এখন?” মতিদা প্রশ্ন করলেন।
উমানাথন মুখ খোলার আগে ইন্টেরোগেশন রুমের দরজাটা খুলে গেল। বিভাস ঢুকল ঘরে। মতিদার কানে কানে কী যেন একটা বলল।
মতিদা আমাকে ইশারায় বললেন বাইরে আসতে। মতিদার মোবাইলে একটা ফোন এসেছিল।
“ভুয়ো নম্বরটা কিছুক্ষণ আগে একবার অন হয়েছিল। লোকেশন পুরুলিয়ার একটা ছোটখাটো হোটেল। ব্যাকাপ টিম রেডি ছিল, তারা সেই হোটেলে গিয়ে সমস্ত বোর্ডারদের ক্রস চেক করেছে। সবারটা মিলছে, শুধু পাওয়া যাচ্ছে না একজনকেই। পুলিশ পৌঁছানোর আগেই সে হোটেল ছেড়েছে।” মতিদা হতাশ হয়ে বললেন।
আমার পা টেবিলের একটু আগেই ফ্রিজ হয়ে গেল। সমস্ত সেন্স বলে উঠল, কাল দুপুর থেকে যাকে সন্দেহ করে চলেছি, এই নামটা অবধারিতভাবে তারই হতে চলেছে।
“নাম বলছে নিরঞ্জন সেন! এই লোকটা আবার কে!” মতিদা বলে উঠলেন, “একে আইডি করতে হবে আবার!”
“দরকার লাগবে না মতিদা! আমার মনে হয় শিবাশিস মাহাতো আর নিরঞ্জন সেন একই ব্যক্তি।” কথাগুলো বলার সময় আমার গলাটা সামান্য কেঁপে গেল।
***
“কী বলছিস পরিষ্কার করে বল।” মতিদা আকাশ থেকে পড়ে বললেন।
“আমরা ভুল লোককে সন্দেহ করছি মতিদা। দিবাকর বিশ্বাসের খুনের সঙ্গে উমানাথনের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু শিবাশিস মাহাতোকে চেনেন কিনা, সেটুকুই আমার কনফার্ম করার ছিল।”
“তোর মনে হচ্ছে উমানাথন সত্যি কথা বলছেন?”
“একশ ভাগ।”
“এটা তো তোর অনুমান।”
“কাল অবধি অনুমান ছিল। এখন আর নেই।”
“কিছু বুঝতে পারছি না কী বলছিস!” মতিদা ভীষণ কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলেন।
ফোন বার করে ব্যালিস্টিক রিপোর্টটা ওঁর দিকে এগিয়ে দিলাম।
“এটা কী…এটা তো ব্যালিস্টিক রিপোর্ট। এ তো আমি পড়েছি। জিরো পয়েন্ট থ্রি টু আই.ও.এফ রিভলভার, কিছু অস্বাভাবিক তো ছিল না!”
“আহা, এবারের ফুটনোটটা পড়ুন।”
মতিদা চশমা হাতড়ে নাকে লাগালেন। পড়তে পড়তে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। দিবাকর বিশ্বাসের খুলি থেকে উদ্ধার করা বুলেট ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, কানপুর তৈরী করে। কিনতে পারেন সিভিলিয়ান। কেনে পুলিশ, এবং সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত অনেক পার্সোনেল। কিন্তু এই বুলেটটায় একটা বিশেষ ব্যাপার ছিল।
বেলগাছিয়ার ফরেনসিক ল্যাবের ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট লিখছেন, “বুলেটের গায়ে শেল কেসিং থেকে বের হওয়ার সময় একটা দাগ ছেড়ে গিয়েছিল। ঐ ব্যাচের অল্প কিছু রিভলবারে এই সমস্যাটা ছিল। যেজন্য সেই রিভলবারগুলি দুহাজার পাঁচে বাজারে ছেড়ে দেওয়ার পর আবার ফেরত নিয়ে রিপ্লেস করে দেওয়া হয়। ঐ ব্যাচের ঐ রিভলবারগুলি কোথায় গিয়েছিল তার একটা ডাটাবেস বেলগাছিয়ায় আছে। তার থেকে জানা যায় …”
মতিদা প্রচণ্ড শকড হয়ে আমার দিকে তাকালেন।
“ঐ রিভলবারগুলো ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশের আই.পি.এস অফিসারদের দেওয়া হয়েছিল মতিদা। কোন রিভলবার তাঁর নামে ইস্যু করা হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই রেকর্ডের্ড আছে। একটা বুলেট কমপ্যারিজন টেস্ট করলেই ব্যাপারটা ধরা পড়ে যাবে।”
“মানে অভিনন্দন রায়!” মতিদা প্রায় চিৎকার করে বললেন।
“দিবাকর বিশ্বাসের রাজা মতিদা। ডক্টর উমানাথন ইজ এ জেম অফ এ হিউম্যান বিয়িং। পার্টির স্বার্থে ঘা লাগছিল বলে ওঁকে জোর করে একটা ঝামেলায় ফাঁসানোর চেষ্টা চলছিল। নরেন্দ্র নামটা পুরোই চান্স ফ্যাক্টর।
মতিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কি এই ব্যালিস্টিক রিপোর্ট থেকেই প্রথম বুঝলি?”
জানালা দিয়ে চড়া রোদ এসে চোখ ঝলসে দিচ্ছিল। দুটো শালিখ জানালার ধারে খুটুর খুটুর করে দানা খাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বললাম, “এই কেসটার তদন্তে নেমে প্রথম থেকেই বারবার একটা কথা মনে হয়েছিল। দিবাকর বিশ্বাসের ডায়েরিটা নিশীথ কেন নিজের কাছে রেখেছেন? যেখানে হেঁয়ালির মাধ্যমে তাঁর নিজের কথাই বলা আছে? যদি ধরেও নিই, নিশীথ এ ছড়ার অর্থ করতে পারেননি, তবুও দিবাকরের ডায়েরি তাঁর কাছে রাখা তো বিপদজনক!”
মতিদা নিশ্চুপ হয়ে আমার কথা শুনছিলেন।
আমি বলে চললাম, “এরকম তখনই মানুষ রাখে, যখন সে কোনো প্ৰমাণ রাখতে চায়। তার নিজের পাপের প্রমাণ সে তখনই রাখবে, যখন সেই কাজে তার একজন সঙ্গী থাকবে, এবং ভবিষ্যতে সেই সঙ্গী বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাকে ফাঁসানোর কিছু একটা তথ্যপ্রমাণ রাখতে হবে। তার থেকেও বড় কথা, সেই সঙ্গীটি বহালতবিয়তে এখনও বেঁচে, নাহলে নিশীথ কবেই ডায়েরিটা নষ্ট করে ফেলতেন।
দিবাকর বিশ্বাসের অ্যাটাচিটায় কোনো নাম ছিল না, ছবি ছিল না। কিন্তু হ্যান্ডরাইটিং ছিল, শিশুদের জন্য করা কাজের খতিয়ান ছিল। কিন্তু আমার প্রশ্ন এখানেই শেষ হল না। আমি ভাবতে শুরু করলাম, এই সঙ্গী লোকটার পরিচয় কী হতে পারে? যদি মাও রেবেলদের মধ্যে কেউ হত, তবে দিবাকর বিশ্বাসকে কেন গুমখুন করতেন নিশীথ? এটা তো ঠিক ওদের পলিসির সঙ্গে যায় না। ভেবে দেখলাম, দিবাকর গুমখুন হয়েছিলেন কারণ নিশীথের সঙ্গী অপ্রকাশ্যে থাকতে চেয়েছিলেন। হয়ত তাঁর হাতেই খুনটা হয়েছিল, যেটা সবার সামনে আসলে ওঁর বিপদ হতে পারত। মাওদের সদস্যদের মধ্যেও খুব গোনাগুনতি লোক ছাড়া এটা কারুর জানার কথা নয়।
ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল, মুম্বাইয়ের জেলে গণেশ হুইয়ের হত্যা হল। নিশীথ মাহাতোর সঙ্গে তার অতীত যোগাযোগের কথা মিডিয়ায় আসল। ততদিনে আর্মস স্মাগলিং মামলার খাতিরে আমরা জেনে গেছি, গণেশ ডাবল এজেন্টের কাজ করত। যদি সেসময়কার ইনটেলিজেন্স ফেলিওরের ঘটনার সঙ্গে হুঁইয়ের উপস্থিতিকে জুড়ি, তবে ব্যাপারটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না। দিবাকর বিশ্বাসের ইনটেলিজেন্স ইনপুট কেন ব্যর্থ হচ্ছিল সেটাও বোঝা যায়।
“মানে তুই বলতে চাইছিস দ্য পিপলের খবরটা সত্যি? গণেশ ডিপার্টমেন্টের ইনফর্মেশন লিক করছিল?”
“গণেশ তো একটা মাধ্যম। সে এই খবর কোথা থেকে পাচ্ছিল সেটা ভাবুন।”
মতিদা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
“গণেশ এই খবর পাচ্ছিল সেই মানুষটির কাছ থেকে যাকে দিবাকর ‘রাজা’ নামে ডাকেন। যিনি অর্থের বিনিময়ে ডিপার্টমেন্টের খবর বাইরে লিক করছিলেন, যার জন্য বারবার ইনটেলিজেন্স ফেলিওর হচ্ছিল। যিনি চেয়েছেন যে পুরুলিয়ায় অস্ত্র ব্যবসা রমরমিয়ে চলুক। সন্ত্রাস চলুক। নিশীথের মত অযোগ্য নেতারা বিপ্লবের নামে দুর্নীতি চালিয়ে যাক। যবে থেকে আমি ডায়েরিটা পেয়েছি তবে থেকে এই লোকটাকে খুঁজে চলছিলাম। লোকটা বাংলার বাইরে মানুষ হয়েছে, সব কিছু জেনেও কর্ণপাত করছে না, ছায়া দেখেও কানা হয়ে থাকছে। এদিকে দিবাকরের ভাষা দেখে মনে হয় রাজার সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক
উপরের সবকটা পয়েন্ট উমানাথনের সঙ্গে হুবহু ম্যাচ করে যাচ্ছিল। কিন্ত উমানাথন একদিন ফোনে একটা খুব প্রচলিত বাংলা প্রবাদ বললেন, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো…আমার ব্যাপারটা কেমন যেন লাগল। উনি বাংলার বাইরের মানুষ অথচ বাংলা এত ভালো জানেন! তিনি কি আবোল তাবোল সম্পর্কে জানবেন না!
ইতিমধ্যে দেবাশিস মাহাতোকে নিয়ে আমি খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। একটা লোক যে কিনা ফেরার হয়ে গেল, মাত্র পনের বছর পরে যখন তাঁকে খুঁজতে বেরোলাম, দেখলাম লোকটার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের রেকর্ড নেই। তার সমস্ত আইডেন্টিটি কে বা কারা যেন অতি যত্নে মুছে দিয়েছে। তাঁর স্টুডেন্ট প্রোফাইল, এমপ্লয়মেন্ট প্রোফাইল, তাঁর ছবি কোথাও কিছু নেই। সি.আই.ডি কিন্তু তাদের ইনভেস্টিগেশনে এই ট্র্যাকিংয়ের সমস্যাটা লিখেছে। সেসময় যেহেতু স্থানীয় লোকজন, বিশেষত ঝালদা বা বাঘমুন্ডি বেল্টে মাওরিস্ট সিমপ্যাথাইজার ছিল, দেবাশিসকে আইডেন্টিফাই করতে কোনো লিড পাওয়া যায়নি। সবাই ভেবেছে সত্যিই দিবাকরকে হত্যা করে গা ঢাকা দিয়েছেন দেবাশিস।
যে কোনো কেসে যখনই আইডেন্টিটি মোছার রেফারেন্স পেয়েছি আমরা, তার পিছনে কিছু কারণ পেয়েছি। তার অন্যতম হল, অন্যের আইডেন্টিটি ফলস পারপাজে ব্যবহার করা। দেবাশিসের ততদিনে মোহভঙ্গ হয়েছে। সে ভিতরের দুর্নীতিগুলো বুঝেছে। দিবাকর বিশ্বাসের মৃত্যুর সঙ্গে ওঁকে রিলেট করতে পারছিলাম না। পরিমল সরকারের কথায় বরং উল্টোটাই মনে হল। মনে হল ওঁর নামটা দিবাকর বিশ্বাস হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং সত্যিটা যাতে প্রকাশ না পায়, ওকে পরে অন্যত্র মেরে দেওয়া হয়েছে। ছবিগুলো থাকলে এদিকের ইনভেস্টিগেশন টিম তদন্ত করবে, তাই আগেই ওঁর সব আইডেন্টিটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
মতিদা আমার মুখের কথা কেড়ে বললেন, “তার মানে বিশ্বাসকে খুনের সঙ্গে আসলে যুক্ত তিনটে লোক, নিশীথ, গণেশ আর ডায়েরির রাজা, যাদের স্বার্থে দিবাকর ঘা দিচ্ছিলেন। তোর কি মনে হয়, শেষ পর্যন্ত দিবাকর রাজাকে চিনতে পেরেছিলেন?”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, “ডায়েরির শেষে অমন একটা কবিতা…মিথ্যে লড়াই, মিথ্যে ফাইট…ভেল্কি, ফাঁকি, অলরাইট সেদিকেই নির্দেশ করছে। একবার ভাবুন, এই ইনফর্মেশন দিবাকরের মাধ্যমে উপরতলায় পৌঁছালে কী হতে পারত! দিবাকরকে সরানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল।”
“কিন্তু রাজাই যে অভিনন্দন, সেটা কীভাবে বুঝলি, বললি না তো?”
“নীলিমা বিশ্বাসকে দিবাকরবাবু ব্যক্তিগত মুহূর্তে একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন। তার চারটে লাইন এমন…
২৭৫
‘জোছনা রাতে সবাই যেথায় আলতা মাখায় চোখে,
যেথায় পথে দমদমাদম পটল তোলে লোকে,
সেই দেশেরই প্যায়দা আমি, পল্টনেতে সেরা
অষ্টপ্রহর লেপমুড়ি দিই, নইলে যাব ধরা…’”
এই কবিতায় দিবাকর তাঁর পেশার ঝুঁকি সম্পর্কে সবটুকু বলে গেছেন। কিন্তু আরও একটা ভয়ানক ইঙ্গিত করে গেছেন। যে দেশে জোছনারাতে সবাই আলতা মাখায় চোখে, তিনি সেই দেশের সেরা পেয়াদা। আবোলতাবোল মনে ছিল। বাঘমুণ্ডির ছদ্মনাম যদি বোম্বাগড় হয়, মনে হল রাজা বোধহয় কোনো ব্যক্তির ছদ্মনাম হতে পারে। একদিন দিব্যজ্যোতির কথায় হঠাৎ এই পেয়াদা শব্দের গুরুত্বটা বুঝলাম।
যে ব্যক্তি নিজেকে বাঘমুণ্ডির পেয়াদা বলছে, সে রাজা কাকে ভাবতে পারে? যার হুকুম সে তামিল করে, যাকে এই বাঘমুণ্ডিতে সে রিপোর্ট করে, যিনি তাঁর আসল আইডেন্টিটি জানেন। কাল সন্ধেবেলা অভিনন্দন নিজে মুখে বললেন, অপারেশন রেড হান্টের ভারপ্রাপ্ত অফিসার উনি ছিলেন, তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে শুরু হল। কনফার্মড হলাম ব্যালিস্টিক রিপোর্ট থেকে। বুঝতে পারলাম দিবাকর এবং তৎকালীন ডি.এস.পির মধ্যে কোড ওয়ার্ডে কথা বিনিময় হত নিশ্চয়ই। যে কোনো আন্ডারকভার এজেন্টের কাজের ধারাটাই তাই। আমার বিশ্বাস এই কোডগুলো আবোলতাবোলের শব্দ ব্যবহার করে তৈরি হয়েছিল।”
মতিদা শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে ভাবছিলেন। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “এত পুলিশের মৃত্যু, এত সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, এতগুলো সাধারণ মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে গেল লোকটা!”
“শুধু তাই নয় মতিদা, রাজ্যের পালাবদলের সময় মহান সিংকে মেরে সে রাজ্যপ্রশাসনে হিরো হয়ে গেল! মারার সময় সাহায্য নিল কার কাছ থেকে? না, নিশীথ মাহাতোর কাছ থেকে, আলট্রাদের মধ্যেই যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।” আমি সামান্য হেসে বললাম।
মতিদা অসম্ভব আশাহত হয়েছিলেন। দুঃখিতস্বরে বললেন, “দেবাশিস কীভাবে এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন সেটা জানা গেল না। শিবাশিস মাহাতো তো দাদার শোচনীয় মৃত্যুর প্রতিশোধ নিল। যদি লোকটাকে ধরা যায় তবে হয়তো বাকিটা…”
মতিদা কথা বলতে বলতে হঠাৎ চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। কী যেন একটা মনে পড়ল ওঁর। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তার মানে শিবাশিস মাহাতো ডি.আই.জি রায়কেও…! ডি.আই.জিকে বোধহয় ইনফর্ম করা হয়নি। নিরঞ্জন সেনের আইডেন্টিটিটা ওঁকে জানাতে হবে…”
মতিদার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল রুম থেকে যে ফোনটা এল, তাতে মতিদার আশঙ্কা সত্যিতে পরিণত হল।
