Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বৃশ্চিকচক্র – পিয়া সরকার

    পিয়া সরকার এক পাতা গল্প320 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    এতদিন স’য়ে স’য়ে এইবারে মারব

    খবরটা এসেছিল চারটে ছেলের কাছ থেকে। আজ সকালে তারা স্কুল পালিয়ে জলাজঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সামনেই চড়কের মেলা। ওদের ইচ্ছা ছিল একটু বেলার দিকে লহড়িয়া শিব মন্দিরের দিকে যাবে। মেলার জন্য স্টল বাঁধা হচ্ছে, লোকজন এসেছে, নানা কথা বার্তা, নানা গল্প; এসব ওদের আকৃষ্ট করে। পড়ায় মন লাগে না। চারজনেরই সঙ্গে সাইকেল ছিল।

    লহড়িয়া শিব মন্দির যাওয়ার পথে একটা বিরাট কাঁচা মাটির রাস্তা পড়ে; তার দুদিকে লহড়িয়া ড্যামের টলটলে জল। সেই রাস্তার উপর থেকেই দূরে নিচের দিকে তাকালে লহড়িয়া শিবের থান দেখা যায়। ছেলে চারটি আজ সকাল দশটা নাগাদ সেই পথে যাচ্ছিল। লহড়িয়া শিবের রাস্তায় যাওয়ার আগে পথের ধারে ছোটছোট ডুংরি পাহাড় পড়ে। কী মনে হওয়াতে, সাইকেল থামিয়ে তারা ওখানেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। হঠাৎই চোখ পড়ে একটা সরু মত বাইপাস রাস্তার দিকে। ভাঙা-চোরা, খোয়া ফেলা রাস্তা। প্ল্যান বদলিয়ে তারা ঠিক করে ঐ রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে নিচে নামবে, তারপর আবার একইপথে ফিরবে। যে রেসে লাস্ট হবে সে বাকিদের মেলা থেকে কুলফি মালাই কিনে খাওয়াবে।

    পথটায় এগোতে গিয়ে তারা বোঝে যে প্ল্যানিংটা ঠিক হয়নি। রাস্তা শুধু খারাপ তাই না, প্রচণ্ড ঢাল। ডান দিকে খাদ, বাঁদিকে জঙ্গল। সাইকেল চালাতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা। কিন্তু তখন কী আর পিছিয়ে আসলে চলে! চারজনের মধ্যে সবথেকে ভীতু ছেলেটিকে বাকি তিনজন ঠেলে দিয়ে বীরত্বের পরীক্ষা দিতে বলে। সে রাজি না হলে, বাকিরা দুয়ো দুয়ো রব তোলে। তখন সে বাধ্য হয়ে সাইকেল নিয়ে সেই পথে নামে এবং কিছুক্ষণ পরেই আছড়ে পড়ে মাটিতে। সাইকেল সমেত ঘষটাতে ঘষটাতে নেমে আসে নিচের দিকে।

    বাকি বন্ধুরা সাইকেল ফেলে তখন দৌড়ে নেমে এসেছে ওর দিকে সাইকেলটা ছিটকে গিয়ে পড়েছে খাদের দিকে। আর ছেলেটি পড়েছে বিচুটি গাছের ঝোপের উপর। তার হাত পা তো ছড়ে গেছেই, সঙ্গে সারা হাতে, পায়ে, মুখে বিচুটি পাতা লেগে গিয়ে বীভৎস চুলকাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে বন্ধুকে তুলতে গিয়ে ওদের একটু দূরে, পথের বাঁদিকে নজর পড়ে। ধুতরো, বিচুটি, ঘেঁটু, রাঙাচিতের ঝোপে ঢাকা বনের প্রান্ত। খানিকটা ভিতরে সোনাঝুরি গাছের জঙ্গল, আর তারপরেই শালবন শুরু হয়েছে। ঝোপের ধারেই একটা মোটা গাছের পাশ ঘেঁষিয়ে একটা কালো রঙের সিডান গাড়ি দাঁড় করানো। আলো পড়ে চকচক করছে কাচগুলো। এ পথে ট্যুরিস্ট আসে না, এত বড় গাড়ি এল কোথা থেকে! ওরা পায়ে পায়ে এগোয় গাড়িটার দিকে। ভালো করে ভিতরটা দেখার জন্য জানালার কালো কাচে মুখ ঠেকায় ওরা। আর তারপরেই ভয়ে শিউরে ওঠে। সামনের বেইজ কালারের সিটে একজনের শরীর পড়ে আছে। তার কাঁধ আর ঘাড় থেকে রক্তের ধারা বয়ে এসে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শরীর!

    ছেলেগুলো, এর পর একছুটে দৌড়ে উপরের রাস্তায় উঠে আসে। জোরে সাইকেল চালিয়ে শিব মন্দিরের কাছে স্থানীয় লোকেদের খবর দেয়। সেখান থেকে কন্ট্রোল রুমে ফোন আসে।

    খবরটা শোনার পর থেকে আমার প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল। গত চারঘন্টা ধরে আমরা ক্রমাগত পুরুলিয়ার রাস্তা ধরে ছুটে চলেছিলাম। এস.পি রঘুরাম পুরো ঘটনাটা মতিদাকে ফোনে ব্রিফ করছিলেন। পুরুলিয়া থেকে আরও দু গাড়ি ফোর্স আসছে, সঙ্গে নিজেও রওনা হয়েছেন অকুস্থলের দিকে। আজ সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ডি.আই.জি রায় হোটেল সায়নদীপ থেকে বেরোন, সঙ্গে দুজন বন্দুকধারী বডিগার্ডও ছিলেন। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কলকাতা যাওয়ার কথা আজ। কাল রাত সাড়ে আটটা অবধি হোটেলে এক জার্নালিস্টকে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। বাঁকুড়ার সদ্যসমাপ্ত সফল মাওয়িস্ট অপারেশনের অনারে একটা বড়সড় প্রতিবেদন বেরোবে ন্যাশনাল নিউজপেপারে। হোটেলের সামনেই হঠাৎ সেই জার্নালিস্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায়। দুজনে করমর্দন করেন, সিগারেট বিনিময়ের পর খোশগল্প শুরু হয়। বডিগার্ডরাও নিশ্চিন্ত হয়ে নজরদারিতে ঢিলে দেয়। লোকটি পরিচিত, কালকেই উচ্ছ্বসিত হয়ে গল্প করতে দেখেছেন ডি.আই.জি রায়ের সঙ্গে। ইন্টারভিউয়ের পর একসঙ্গে ডিনারও করেছেন দুজনে।

    চটক ভাঙে একটা গাড়ির শব্দে। ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল যেন পাশে। চোখের পলকে জার্নালিস্টের হাতে উঠে আসে রিভলবার, যার নল তাক করা ছিল ডি.আই.জি রায়ের দিকে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে দেরি হয় না দেহরক্ষীদের। বেগড়বাই দেখলেই হাতের রিভলবার থেকে গুলি চালিয়ে দেবেন জার্নালিস্ট। ডি.আই.জি রায়কে এবার গানপয়েন্টে রেখে জোর করে ঠেলে ঢুকানো হয় একটা কালো সিডানে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, সিডানটা ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে যায়। দেহরক্ষীরা সম্বিত ফিরে পেয়ে গাড়ির চাকা লক্ষ করে গুলি চালালেও গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। শেষপর্যন্ত সি.আর.পি.এফের একটা টিম গাড়িটাকে লোকেট করে, আবার ফায়ার করে। অপরপক্ষ থেকেও গুলিবিনিময় হচ্ছিল। সি.আর.পি.এফের গুলিটা নাকি ড্রাইভারকে বিদ্ধ করেছে, সি.আর.পি.এফ জওয়ান কনফার্ম করছেন। তা সত্ত্বেও গত চারপাঁচঘন্টা ধরে পুলিশের সঙ্গে বিড়াল-ইঁদুর খেলে গাড়িটা কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিল খোঁজ পাচ্ছিল না কেউ।

    সি.আর.পি.এফ আর রাজ্য পুলিশের গাড়ি দাঁড় করানো ছিল ঢালু রাস্তার ধারে। সেটা বেয়ে ছুটে নামতেই কালো সিডান গাড়িটা দেখলাম। দু তিনজন কনস্টেবল গাড়ির দরজাটা খুলে একটা বডি বার করছে। পঞ্চাশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আমি সেই মৃত শরীরকে চিহ্নিত করতে পারছিলাম। মতিদা পাশ থেকে দ্রুত হেঁটে গেলেন, সি.আর.পি.এফ টিম জঙ্গলের মধ্যে মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছিল, কনস্টেবলরা লোকের ভিড় সরাতে ঘনঘন হুইশল বাজাচ্ছিল। আমার মাথার উপর বৈশাখের চড়চড়ে রোদটা আরও রুক্ষ, আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। কোনো একজনের চকচকে চোখের ঝকঝকে হাসিটা মনে করে বুক কেঁপে গেল।

    বিধুর নিস্পন্দ বুক জুড়ে নেমে আসা তাজা রক্তপলাশের মত রক্তস্রোত আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, ও আর নেই! গুলিটা বোধহয় ঘাড়ে বা কাঁধে মোক্ষম জায়গায় বিদ্ধ করেছে। মতিদা ওর কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি কাছে গিয়ে বিধুর মুখ দেখব না ঠিক করেছিলাম। এই গল্পের শেষটুকু অন্য কেউ রচনা করবে। সমাপ্তিটা দেখার জন্য আমার মনে অদ্ভুত তাড়না কাজ করছিল। প্রথমবার একটা আদিম দানবীয় স্পর্ধাকে নিজের মধ্যে অনুভব করলাম। জঙ্গলে এক পা দিয়ে মতিদাকে ডাকলাম, “আসুন মতিদা।”

    আমরা দুজনে জঙ্গলে পা রাখলাম। সি.আর.পি.এফ জওয়ানেরা আলাদা আলাদা দলে ভেঙে আমাদের আগে পিছে এগোচ্ছিল। সঙ্গে দুজন বনদপ্তরের লোক। ওদের ধারণা ডি.আই.জিকে এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যেই নিয়ে গেছেন নিরঞ্জন। জঙ্গলটার দৈর্ঘ্য কত সেটা এখান থেকে বোঝা না গেলেও, প্রস্থে যে বিরাট হবে সেটা বোঝা যাচ্ছিল। দূরে সি.আর.পি.এফ জওয়ানরা বাঁশি বাজাচ্ছিল। সি.আর.পি.এফ কমান্ডার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “লগতা হ্যায়, টিলা কে উপর লে কে গয়া।”

    টিলাগুলো এখনও দূরে। সবুজ ঘন অরণ্যে ঢাকা গা, ছায়াঘেরা পরিবেশ, গহীন নিস্তব্ধতা। হয়তো এই পথেই মাদল বাজাতে বাজাতে শিকারির দল এগিয়ে যেত অরণ্যের গভীর থেকে গভীরে। বিধা পরবে ঢাক, ঢোল, রামশিঙা, লাগড়ার শব্দে মুখর হত পৃথিবী। শিকারের গায়ে শেষ আঘাতটা হানার পর মাদল বেজে উঠত।

    …..টা…টা…টাঙিনটা…টা…টা…

    দ্রুত হাঁটার ফলে আমাদের সারা গা বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছিল। পায়ের তলায় শুকনো পাতা আর হলুদ ফুলের মৃতদেহ পেরিয়ে এসেছি কিছুক্ষণ। শাল বনে ঢুকতেই পাতাগুলোয় অদ্ভুত শনশন করে আওয়াজ হল। যেন বল্লম, ভাল্লা, টাঙ্গি আর তীরধনুকে শান পড়েছে বহুদিন পর। চারিদিকে এত ঘন ছমছমে অন্ধকার যে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। মাঝে মাঝে উপরে তাকালে দেখা যায়, বনের চাঁদি ফুঁড়ে সরু সরু আলোর রেখা নিচের দিকে নেমে আসছে। পায়ের তলার জমি ঢেউ খেলানো। কখনও খড়বড়ে অসমান উঁচু নীচু জমি, তার মধ্য দিয়ে কোথাও কোথাও সরু জলের নালা বয়ে চলেছে।

    সি.আর.পি.এফ কমান্ডারটির নাম রবীন্দ্র শুক্লা। কাঁধে সেলফ লোডিং লাইট মেশিনগান। একটা টিলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “উস টিলেকে উপর যানে কে লিয়ে দো রাস্তে হ্যায়। এক সিধা টপ তক যাতা হ্যায়, দুসরা থোড়া টেড়া হ্যায়, পরন্তু এক রক টানেল হোকে যাতা হ্যায়। ছুপনে অউর ছুপানেকে লিয়ে আইডিয়াল জগা হ্যায়। ম্যায় বহতবার দেখা হু উস রস্তে কো। অ্যাবডাক্টর শায়েদ উসি রস্তা লেগা।”

    মতিদা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে সাজেস্ট করলেন, দুটো দলে ভেঙে জওয়ান পাঠাতে। একটা সোজা ডুংরির উপরে ওঠার জন্য, আরেকটা রক টানেল অবধি পৌঁছানোর জন্য। রবীন্দ্র শুক্লা ওয়ারলেসে উর্দ্ধর্তনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি পাথুরে ডুংরিটা ভালো করে খেয়াল করছিলাম। উঁচু ইগনিয়াস পাথরের দেওয়াল খাড়াই উঠে গেছে প্রায় সাত আটশ ফুট। খুব উপরে তাকানো যায় না। বাঁশঝাড়ের উপর দুপুরের তীব্র রোদ পড়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে।

    এ পথে পাহাড়ে ওঠা অসম্ভব। কোনো ঢালু অংশ নেই, যার উপর পা রেখে ওঠা যাবে। জওয়ানেরা বাঁদিকের পথ ধরলো, ওদের দেখাদেখি আমরাও এগিয়ে গেলাম। কিছু দূর সোজা যাওয়ার পর একটা ঢালু পথ পাওয়া গেল। পাথরের স্ল্যাব ঢালু হয়ে উপরের দিকে উঠেছে। পায়ে চলার পথ তৈরি হয়েছে। লোক চলে তবে এ পথে! আমরা পাথুরে পথ ধরে উঠতে শুরু করলাম। চারপাশে গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় গাছের গুঁড়ি ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে গেছে। আমার আর মতিদার ঘন ঘন শ্বাস পড়ছিল। জওয়ানেরা উপরে উঠে ডানদিক বাঁদিকে দেখে আবার এগোচ্ছিলেন।

    কিছুদূর এগোতেই পথটা দুদিকে ভাগ হয়ে গেল। একটা ডানদিকে বেঁকে খাড়াই উঠে গেছে। নিচে থেকে একটা চূড়া দেখা যাচ্ছে। একটা শিলাখণ্ড সামান্য ঝুঁকে তাকিয়ে রয়েছে নিচের উপত্যকায়। আরেকটা শুঁড়ি পথ একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে হারিয়ে গেছে। গুহাটার মুখে ঝুরো ঝুরো পাথর, খসে পড়ে আছে মাটিতে। মাটিও এখানে সামান্য নরম, ভিজে। কিছুদূর এগোতেই দাগটা চোখে পড়ল। প্রায় ছ ইঞ্চি চওড়া একটা দাগ মাটিতে স্পষ্ট। লম্বাটে দাগটা গুহার ভিতরে চলে গেছে। রবীন্দ্র শুক্লা সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন, “লগতা হ্যায় কোই লকড়িকে তক্তেকে সাথ বান্ধকে খিচা গয়া হ্যায়। ইসি রস্তে সে গয়া হ্যায় লগতা হ্যায়।”

    আমি মাটিটা ভালো করে খেয়াল করলাম। পাথরের গুঁড়োগুলো এক এক জায়গায় যেন বেশি গুঁড়িয়ে গেছে। ওজন সমেত তক্তা টানার ফলে হতে পারে। পিছন ফিরে আবার পথটা দেখলাম। যে পথে এসেছি সে পথে তক্তায় বেঁধে টেনে আনার স্কোপ নেই। ডি.আই.জিকে নিশ্চয়ই কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে এ পথে তুলে আনা হয়েছে। তারপর তাকে তক্তায় বেঁধে…কিন্তু একজন পূর্ণবয়স্ক অত্যন্ত ফিট মানুষকে এই ভাবে হ্যান্ডল করা সম্ভব নয়! তাকে নিশ্চয়ই ভালোমত আহত করা হয়েছে। তারপর শরীরটাকে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে টানা হয়েছে। রোমান এক্সিকিউশনের কথা মনে পড়ে গেল। এইভাবে টানার ফলে ভিকটিমের প্রাণ যায় না, শুধু গলায় দড়িটা কেটে কেটে বসে। একবারে ফাঁসিতে মৃত্যুর থেকে যা কয়েকশো গুণ বেশি কষ্টকর।

    “নিশীথ মাহাতোকেও বোধহয় এভাবে তুলেছিল!” মতিদা পাশ থেকে বললেন।

    আমি এই অপারেশনের পরিণতির কথা ভাবছিলাম। নিরঞ্জন বিলক্ষণ জানবেন তাঁর পিছনে পুলিশ আসবে, আর্মড ফোর্স আসবে। সেসব উপেক্ষা করে উনি এই পথে ডি.আই.জি রায়কে নিয়ে এসেছেন! কী পরিকল্পনা আছে ওঁর মাথায়!

    রক টানেলটায় ঢোকার মুখে জওয়ানরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রবীন্দ্র বললেন, টানেলটার দু মুখই খোলা। তবে ভিতরে একটা শার্প বেন্ড আছে বলে আলো ঢুকছে না।

    “পসিবলি ভিকটিম শার্প বেন্ডকে উস পার হোগা, ইয়া ফির টানেল মে হোগা হি নেহি। গেট রেডি বয়েজ।” রবীন্দ্র শুক্লা তার ব্যাটেলিয়নকে অর্ডার দিলেন। আমরা রিভলবার বার করে আনলক করলাম। আর ঠিক তখনই একটা ফায়ারিংয়ের শব্দে গাছে বসা একঝাঁক পাখি প্রচুর শব্দ করে উড়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে টানেলের ভিতরে ঢুকে সবাই দৌঁড়ালাম। ও প্রান্ত থেকে, আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল। আবার একটা ফায়ারিং হল।

    রবীন্দ্র শুক্লা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “মাদারচোদ! মার ডালা হোগা শালেনে।”

    আমি দ্রুত শ্বাস নিচ্ছিলাম।

    রবীন্দ্র শুক্লার কথায় বিশ্বাস হল না। শুধুমাত্র গুলি করে মারার জন্য এত দূর এত ঝুঁকি নিয়ে অভিনন্দনকে নিয়ে আসতেন না নিরঞ্জন। কোনো বীভৎসতম শাস্তি ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ফায়ারিংটা হচ্ছে কেন! টানেলটা থেকে বেরিয়েই চোখ পড়ল দৃশ্যটার দিকে। রাস্তাটা এখান থেকে ঢাল হয়ে নেমে গেছে নিচে। উঁচুতে দাঁড়িয়ে পিছনে দেখলে লহরিয়া ড্যাম দেখা যাচ্ছে। আর সামনে একশ মিটার দূরে ঢাল জমির উপর মাথা তুলেছে একটা ওয়াচ টাওয়ার। লোহার খাঁচা, কাঠের সিঁড়ি। বহু পুরোনো, পরিত্যক্ত। পিছন দিক থেকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সবুজ টিনের ছাদ সামান্য বেঁকে ঝুলছে। নিচ থেকে উপরের কোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। আবার একটা ফায়ারিং হল। কে যেন ধুপধাপ করে টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে নেমে জঙ্গলের দিকে দৌড়ে গেল। এদিক থেকে তাকে চেনা গেল না। সি.আর.পি.এফের টিম দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন, আরেকদল লোকটার খোঁজে জঙ্গলের দিকটায় গেল। আমার মন বলছিল ফায়ারিংটা একটা ফাঁদ।

    সি.আর.পি.এফের দলটা দুরদুর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।

    আমরা পিছন পিছন উঠলাম। সিঁড়ির মাঝ বরাবর যেতে একটা লম্বাটে ছায়া চোখের কোণে ধরা দিল। ওয়াচটাওয়ারের দোতলায় ঠিক মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে আছে ছায়াটা। একদম স্থির।

    আমরা সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রেখেছিলাম। এত পুরোনো এটার কনস্ট্রাকশন যে এতগুলো লোক উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল ধ্বসে পড়ে যাবে। দোতলায় উঠে অদ্ভুত একটা দৃশ্য নজরে পড়ল। টিনের ছাদের মাঝখান থেকে একটা হুকের সঙ্গে একটা শক্তপোক্ত দড়ি ঝুলছে। দড়িটা ফাঁস হয়ে লাগানো যার গলায়, তাকে আর চেনা যায় না। দামী শার্ট প্যান্ট স্থানে স্থানে ফেঁটে ক্ষতবিক্ষত চামড়া দেখা যাচ্ছে। দুই হাত পিছু মোড়া করে বাঁধা। মুখটা শক্ত করে কাপড় দিয়ে বাঁধা। মাথার একটা দিক থেকে অবিরত রক্ত ঝরে পড়ছে। ঘাড় ঝুলে চিবুক ঠেকে গেছে বুকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল দড়িটা। গলায় ফাঁস দেওয়া, কিন্তু ঠিক টান টান নয়। অভিনন্দন রায়ের পাটাও দিব্যি কাঠের মেঝেতে ঠেকে আছে।

    আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। এটা কী নতুন কোনো ট্র্যাপ! একটু পরে রবীন্দ্র শুক্লার মুখ থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোলো। “বহেনচোত কুছ নেহি কর পায়া,” বলে সদলবলে অভিনন্দনের দিকে এগিয়ে যেতে গেলেন। অভিনন্দন মাথাটা তুলে ওদের দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু ঘাড় নাড়িয়ে কী যেন বারণ করতে গেলেন। ওঁর দুই চোখের ভাষা পড়তে পারছিলাম। আর এগোলে ওঁর বিপদ আরও বাড়বে। কিন্তু চেঁচিয়ে বারণ করার আগেই সুবিশাল চেহারার রবীন্দ্র শুক্লা আর দুজন জওয়ান এগিয়ে গেছেন ওর দিকে।

    ওদের পায়ের তলায় কাঠের পাটাতনে একটা বিরাট কড়াত কড়াত শব্দ হল। আর তারপরেই সশব্দে পাটাতন সমেত ভেঙে হা হয়ে গেল মেঝে সি.আর.পি.এফ জওয়ানেরা সেই মেঝের ফাঁক গলে পড়ে গেলেন একশ মিটার নিচে। ছাদের হুক থেকে লাগানো দড়িটা এবার টানটান হয়ে গিয়েছিল। অভিনন্দন রায়ের শরীর সমেত সেটা পেণ্ডুলামের মত দোল খাচ্ছিল এদিক ওদিক।

    নিচে জঙ্গলের মধ্যে আবার একটা ফায়ারিংয়ের শব্দ হল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইলিয়াড – হোমার
    Next Article বিসাশন – পিয়া সরকার

    Related Articles

    পিয়া সরকার

    বিসাশন – পিয়া সরকার

    October 21, 2025
    পিয়া সরকার

    বিসাশন – পিয়া সরকার

    September 12, 2025
    পিয়া সরকার

    বৃশ্চিকচক্র – পিয়া সরকার

    September 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Our Picks

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    October 25, 2025

    থ্রি মাস্কেটিয়ার্স – আলেকজান্ডার দ্যুমা

    October 21, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }