আজকে দাদা যাবার আগে বলব যা মোর চিত্তে লাগে
দেবেন মাহাতো হাসপাতালের স্পেশাল ওয়ার্ড এটা। দুঘন্টার নোটিশে তাড়াহুড়ো করে বানানো। একটা বিচ্ছিন্ন ঘর, তাতে একটা বেড়, স্যালাইনের স্ট্যান্ড, পাশে একটা ছোট টেবিল। তাতে বেশ কতকগুলো ওষুধ রাখা। স্যালাইন ড্রিপ ফোঁটা ফোঁটা করে ঢুকছে বেড়ে শায়িত মানুষটার শরীরে। পায়ে একটা বুলেট অপারেট করে বার করা হয়েছে। ঘরের বাইরে তিনজন সশস্ত্র রক্ষী পাহারায়।
আমাকে দেখে তারা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল।
নিরঞ্জন বেডে চোখ বুজে ছিলেন। এতবার কথা হয়েছে, ওঁর মুখের এই অদ্ভুত প্রশান্তিটা আগে কোনোদিন খেয়াল করিনি।
উনি যেন আমারই প্রতীক্ষা করছিলেন। চোখটা খুলে তাকালেন আমার দিকে। একটা উৎফুল্ল হাসির রেখা চোখে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। আমার প্রথম দেখা হওয়ার কথা মনে পড়ছিল। একইভাবে হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কী দর্শনা?”
আমি চেয়ারটা টেনে ওঁর বেডের পাশে বসলাম। নিরঞ্জন বললেন, “আসুন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“কেন!”
“আরে আপনি তো আই.ও, আপনিই তো আগে আসবেন।” নিরঞ্জন হাতের ভারে আধশোওয়া হয়ে বললেন।
“আপনি কেমন আছেন?”
নিরঞ্জন ফিক করে হেসে বললেন, “পা-টার আর দরকার নেই মনে হচ্ছে। হাঁটুর তলা থেকে কিছু ফিল করতে পারছি না।”
“আপনি কোনো স্টেটমেন্ট দেবেন?”
“নিশ্চয়ই, আর আপনাদের সময় নষ্ট করব না।”
আমি মোবাইলে রেকর্ডারটা অন করলাম। নিরঞ্জন মজা করে বললেন, “আরে এবার একটু ভারী গলায়, ফিল্মি কায়দায় বলুন? নিরঞ্জনবাবু, গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। তবে না স্টেটমেন্ট?”
আমার ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে ইচ্ছা করছিল না। আমার মনের মধ্যে একটা দ্বৈরথ চলছিল।
“বলবেন না? আচ্ছা তবে আমিই বলি। কিন্তু আগে কটা কথা আনঅফিসিয়ালি বলতে চাই।”
“বেশ,” আমি রেকর্ডার অফ করে বললাম, “আমারও কিন্তু কটা প্রশ্ন আছে।”
“বলুন।”
“নিশীথ মাহাতো অত রাতে দরজা খুলেছিলেন কেন? আপনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন নাকি?”
নিরঞ্জন একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ। পিছনের দরজায় গিয়ে ঠকঠকালাম। নিশীথ দরজা খোলার আগে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’ বললাম, আমি শিবাশিস গো। দেবুর ভাই। দাদার ব্যাপারে একটু কথা ছিল।
নিশীথ দরজাটা খুলে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘কোন দেবু? এত রাতে কেন? কাল সকালে আসুন।’ আমার মাথার ভিতরটা দপদপ করে উঠল। দাদাকে লোকটা ভুলে গেছে নাকি! জোর করে দরজা ঠেলে ঢুকে….” নিরঞ্জনের মুখটা ঘেন্নায় সামান্য বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।
“বিধু তো বাইরে অপেক্ষা করছিল। ওকে আপনি কতদিন চিনতেন?”
“চিনতাম না। খুঁজে বার করেছিলাম। তা প্রায় বছর পাঁচেক হবে। এই কাজটায় আমার সঙ্গীর দরকার ছিল। এমন কেউ, যে এই কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত আবেগকে বুঝবে, সহমর্মী হবে। বিধুকে পাওয়াটা একটা ম্যাজিকাল ব্যাপার বলতে পারেন। হঠাৎই ডাক্তার উমানাথনের সঙ্গে একদিন হাসপাতালে এসেছি। বিধু তখন অ্যাম্বুলেন্স চালায়। উমানাথন পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিধুর মত করিৎকর্মা ছেলে…” নিরঞ্জনের মুখটা হঠাৎ নিভে গেল।
“বিধুকে খুব চেষ্টা করেছিলাম বাঁচাতে।” কথাটা বলে নিরঞ্জন খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন।
আমি ওঁর অনুভূতিগুলো বুঝতে পারছিলাম। বিধুর জন্য আবার বুকের ভিতর টনটন করে উঠল। সেসব খানিক উপেক্ষা করে বললাম, “উমানাথনকেও তো ছোট থেকে চিনতেন?”
“হ্যাঁ,” কথাটা বলেই নিরঞ্জনের কী যেন মনে পড়ল, বললেন, “স্যারকে যেন এর মধ্যে জড়ানো না হয় দর্শনা, উনি কিন্তু কিছু জানেন না। এটা আপনি দেখবেন একটু। ওঁর মত মানুষ লাখে একজন হয়। উনি না থাকলে কোথায় ভেসে যেতাম।”
নিরঞ্জনের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। যন্ত্রণার রেখা মুখে ফুটে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনার বাকি গল্পটুকু শুনব।”
“শোনাব। শোনানোর জন্যই তো বসে আছি। কেউ শোনেনি তাই এভাবে শোনাতে হল।”
একটু দম নিয়ে নিরঞ্জন বললেন, “দুহাজার পাঁচের পনেরই অগাস্ট। শনিবার ছিল। উইকেন্ড হাতে ধরে গোটা একসপ্তাহের জন্য বাড়ি এসেছিলাম। দিল্লীতে সবে ভর্তি হয়েছি। দাদার ইচ্ছা সাংবাদিক হই। বাবা মারা গিয়েছিলেন আমার পাঁচবছর বয়েসে। দাদাই হাতে ধরে মানুষ করেছিল। ওঁকেই বাবা জানতাম। দাদা কিন্তু আমাকে বন্ধুর মত ভাবত। দায়িত্ব কর্তব্য এমন করত যেন আমাকে জন্ম দিয়েছে, কিন্তু ব্যবহারে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল সে।
মনে আছে সেদিন কুড়ি তারিখ। রাত নটা বাজে। ঝালদায় আমাদের বাড়িতে গ্রামের আরও অনেক বাড়ির মত কারেন্টের কানেকশন আসেনি। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বসে আছি। দিল্লীর আলোকোজ্জ্বল সন্ধের কথা ভাবছি। দাদা ফোনে নানা কথা বলত, সেসবের কথা ভাবছি। আসার ঠিক আগে বলেছিল, সব কিছু ফার্স এখানে। নিশীথ মাহাতো সব থেকে বড় শ্রেণিশত্রুর সঙ্গে মিলে তার থেকে ইনফর্মেশন কিনছে। লোকটা একটা আর্মস স্মাগলারের সঙ্গে নিশীথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, যে কিনা পুলিশের এজেন্ট হিসেবেও কাজ করে। ওর থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় অস্ত্র কেনা হচ্ছে। আলটিমেটলি অস্ত্র খাটিয়ে লোকজনকে ভয় দেখিয়ে রাখা হচ্ছে। গরীবদের উপর চাঁদার নাম করে জোরজুলুম চলছে। বীরেন মাণ্ডি বলে একজন প্রতিবাদ করায় তাঁকে ওরা মেরে ফেলেছে। ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের টাকা কোথায় কী ভাবে ব্যয় হচ্ছে নিশীথ তার কোনো হিসেব চাইলে দিচ্ছে না।
এসব ভাবতে ভাবতে আমার গা গরম হচ্ছিল। দাদাকে চিনতাম। ও এগুলো মেনে নেওয়ার লোক নয়। ও কদিন ধরেই দিবাকর বিশ্বাস বলে একজনের কথা বলছিল। সে নাকি আন্ডারকভার এজেন্ট। বাঘমুণ্ডিতে সমাজকর্মী পরিচয়ে কাজ করছে। লোকটার জন্য অনেক অ্যাটাক আনসাকসেসফুল হয়েছে। লোকটাকে নিশীথ উড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। পুলিশে, দলের যে অ্যালি আছে, সে বলেছে লোকটাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। সরিয়ে তো খুব একটা লাভ নেই, আই.বি দিবাকর বিশ্বাসের বদলে অন্য একজনকে পাঠিয়ে দেবে। তাছাড়া আই.বি অফিসারকে মারলে বিশাল কেসও হবে। সবাই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তার থেকে অনেক সোজা, লোকটাকে কেনার চেষ্টা করা। দাদা এগুলোর প্রতিবাদ করছিল। পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে পুলিশকে মারার যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বলেছিল, সবথেকে বড় কীট তো পুলিশের সেই হোমরাচোমরা, যে টাকার কমিশনের বিনিময়ে নিজের কলিগদের এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দাদা দিবাকর বিশ্বাসকে মারার পক্ষে ছিল না। বরং চাইছিল, লোকটার মারফত যেন পুলিশের সেই হোমরাচোমরার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। আমি বসে বসে দাদার হতাশাটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। একটা দুর্নীতিকে সরাতে নেমে দাদা আরও দুর্নীতির আর্বতে ডুবে যাচ্ছিল। দাদার বিবেক সায় দিচ্ছিল না। আমি জানতাম ও ভিতরে ভিতরে পাল্টে যাচ্ছে। নিশীথের মুখোশ কী করে ফাঁস করা যায় ভাবছে।
ঠিক রাত নটা পঁয়তাল্লিশে পিছনের দরজায় হুড়মুড়িয়ে একটা শব্দ হল। পিছনদিকটা কুয়ো, কলতলা, অন্ধকার। দরজা খুলে দেখি, দাদা! প্ৰচণ্ড ঘামছে, মুখটায় যেন কালিমাখা। দাদা চারিদিক দেখে ঘরে ঢুকে এল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। বললাম, “কী হয়েছে?”
দাদা খুব চিন্তামগ্নভাবে ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “একটা বিরাট সমস্যায় পড়েছি শিবু। দিবাকর বিশ্বাস আজ বাঘমুণ্ডিতে এসেছিল। লোকটা ও যে ধরা পড়ে গেছে, সেটা বুঝে গেছে। কদিন ধরেই ওর বুড়ো বটতলার স্কুলে বাচ্চারা আসছিল না, আজ একেবারেই আসেনি। এদিক ওদিক দেখে, খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ও পরিস্থিতি মাপতে শুরু করে। আর ঠিক করে যে ওখান থেকে বেরিয়ে যাবে।”
“তুমি কী করলে?” আমি উদ্বিগ্ন হয়ে দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি তখন সামনের চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। লোকটা আমাকে চেনে না। এসে বলল, আমাকে একটু বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে দেবেন? আমি রাজি হলাম। নিশীথের চোখ এড়িয়ে লোকটাকে কলকাতায় পাঠাতে পারলে ঠিক সেটাই হবে, যা আমি চেয়েছি। হাইকমান্ড জানতে পারবে আসলে নিশীথ বিপ্লব নয়, ব্যবসা করছে।”
দাদার তখনও সব কিছু পজিটিভ হবে এমন একটা বিশ্বাস ছিল। ও বলল, “কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের পথটা ধরে কিছুদূর এগোতেই ধরা পড়ে গেলাম রে। নিশীথ আর সুশীল একটা বাইকে করে এসে আমার পথ আটকাল। বলল, দিবাকরকে ওর হাতে তুলে দিতে। আমি প্রতিবাদ করলাম। ও আমাকে উল্টে শাসাল, বলল একজন আন্ডারকভার এজেন্টকে পালাতে হেল্প করছি। হাইকমান্ডকে জানাবে। গণসভায় বিচার হবে। আমি কিছু করতে পারলাম না। লোকটাকে ওরা তুলে নিয়ে গেল।”
“ওরা কি ওঁকে মেরে ফেলেছে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“প্রথমে কেনার চেষ্টা করবে, নাহলে মেরে ফেলবে,” দাদার মুখটায় একটা জেদের ছাপ পড়েছিল, ওরকম ভাবেই বলল, “আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। আপাতত কলকাতায় যেতে হবে। ওরা আমাকে গ্রামে টিকতে দেবে না। তোকে আর মাকেও না। আমি আসার পথে উমানাথনের সঙ্গে কথা বলে এসেছি, দরকারে ওঁর কাছে যাস। মায়ের বয়েস হয়েছে। কলকাতায় আমার বন্ধু আছে। অসুবিধা হবে না। আমি কদিন পরে সব সামলে, হাইকমান্ডকে পুরোটা জানানোর চেষ্টা করে ফিরে আসব। ততদিনে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। সামান্য এই কদিন…পারবি তো ভাই আমার?” দাদা আমার চিবুকে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল।”
নিরঞ্জন চোখ বন্ধ করলেন। ওঁর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা গড়াচ্ছিল। ধরা গলায় বললেন, “বহুদিন পর গাল ভিজল। সেই আমার দাদার সঙ্গে শেষ দেখা দর্শনা! আমি পরের দিন সকালে দিল্লী চলে গেলাম। মা গ্রামের বাড়িতে রয়ে গেল। পরে শুনলাম, দলদ্রোহীর মা হিসেবে গণসভায় তাঁর বিচার হয়েছে। দিল্লী থেকে কিছু বুঝতে পারছিলাম না, করতে পারছিলাম না। প্রায় ছমাস পরে কলকাতা ফিরলাম। সর্বত্র দাদাকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। হাসপাতাল, মর্গ, দাদাদের যেসব বন্ধুদের চিনতাম, যেসব হাইড আউট জানতাম…কিচ্ছু বাদ দিইনি। শেষে একজনের সাজেশনে পেপারের অবিচুয়ারি, নিরুদ্দেশ কলাম, আনআইডেন্টিফায়েড মেল বডি বিজ্ঞাপন …” নিরঞ্জন চুপ করে গেলেন।
আমিও চুপ থাকলাম। এসব ক্ষেত্রে কী বা বলা যায়! খানিকক্ষণের অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে বলে উঠলাম,
“আপনার দাদা যাওয়ার আগে অভিনন্দন রায়ের নাম বলে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ। গণেশ হুঁইয়ের নামও।”
আমি মোবাইলটা পকেটে ঢোকালাম। বললাম, “আপনি এতবছর ধরে প্রতিটা লোককে খুঁজে বেরিয়েছেন! এভাবে নিজেই শাস্তির পথ বেছে নিয়েছেন। আইনের পথে একবার চেষ্টা করে দেখলে…”
নিরঞ্জন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “এত কিছুর পরেও আপনার মনে হয় আমার দেশের আইনকানুনে বিশ্বাস রাখা উচিত! আপনার মনে হয়, এই লোকগুলোকে আপনার আইন সাজা দিতে পারত?”
“ব্যালিস্টিক রিপোর্টে অভিনন্দন রায়ের রিভলবার থেকে ফায়ার করা বুলেট প্রমাণ হয়ে যাবে। ওকে একবার প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হতে দিতে হত। ওর যে হিরোইজম নিয়ে ফোর্সে এত গুঞ্জন আছে, তাকে প্রশ্ন করার সুযোগটা আপনি সরিয়ে নিলেন নিরঞ্জন।”
নিরঞ্জন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, “সত্যি করে বলুন তো মিস বোস, আপনার মনে হয় অভিনন্দন রায় শাস্তি পেতেন? ফরেন্সিক এভিডেন্স শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জড হয়। এখানে কাউন্সেল বলত, পুরুলিয়াতে কি একটাই আই.পি.এস অফিসার? গোটা পশ্চিমবঙ্গে ঐ একজনের কাছেই ঐ ব্যাচের রিভলবার আছে? কেস ডিসমিস হয়ে যেত! বেনিফিট অফ ডাউট বোঝেন তো? তাছাড়া এই প্রতিটা লোককে আমি নিজে হাতে মারতে চেয়েছি। একমাত্র গণেশ পুলিশের জালে জড়িয়ে গেল বলে কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হয়েছে। মারার সময় এই প্রতিটা লোকের যন্ত্রণাগুলো আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চেয়েছি, দাদার নাম শুনলে ওঁদের আতঙ্কিত মুখগুলোয় কী প্রভাব পড়ে দেখতে চেয়েছি …” নিরঞ্জন হাঁপাচ্ছিলেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর উপক্রম করলাম। নিরঞ্জন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা দর্শনা! আপনি আমাকে কবে থেকে সন্দেহ করেন?”
আমি মনের দ্বৈরথটাকে আবার টের পাচ্ছিলাম। সেটা চেপে বললাম, “গত দুপুর থেকে। আপনার দাদার বন্ধু পরিমল সরকারের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে।”
নিরঞ্জন একটা চওড়া হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, “তাহলে আপনার কাছে ডি.আই.জিকে সতর্ক করার অ্যাম্পল স্কোপ ছিল। আপনি কেন করেননি?”
আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। আমার ইউনিফর্ম পরা যে ইমেজটাকে আমি সজোরে আঁকড়ে রেখেছি এতদিন, সেটা ভেদ করে একটা ব্যক্তি দর্শনা উঁকি মারছিল। একে আমি ভয় পাচ্ছিলাম। একে আমি চিনি না। ব্যালিস্টিক রিপোর্টের যুক্তি যে কোর্টে ঝড়ের মত উড়ে যাবে তা আমি বুঝতে পারছিলাম। ডি.আই.জির ইনভল্ভমেন্ট শুধু ঐ একটা এভিডেন্সের উপর দাঁড়িয়ে। কোনো সাক্ষী নেই, কোনো স্টেটমেন্ট নেই।
নিরঞ্জন বললেন, “নিজের প্রতি এত হার্ড হবেন না। হামুরাবির কথা মনে রাখুন। অ্যান আই ফর অ্যান আই কোড, এই লোকগুলোর জন্য তৈরি হয়নি?”
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম। নিরঞ্জন আমাকে আটকিয়ে বললেন, “আপনি যে অপুলিশোচিত জেশচারটি রেখেছেন, তার জন্য একটি উপহার আপনার প্রাপ্য হয়েছে।”
“আমার কোনো উপহার দরকার নেই।” আমি ফিকে হেসে বললাম।
“আরে দাঁড়ান। এই উপহার আপনার জীবনের সবথেকে বড় সত্যের সঙ্গে যুক্ত। তাও শুনবেন না?” নিরঞ্জন মিটি মিটি হাসছিলেন। ওর অদ্ভুতদর্শন ইনসাইজর দাঁতটা আমাকে মনে করিয়ে দিল, আমি কোথায় যেন এরকম দাঁত দেখেছি!
নিরঞ্জন হাসিমুখেই বলতে লাগলেন, “আমার দাদার সঙ্গে একটি মেয়ের সম্পর্ক ছিল। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মেয়েটির মামাবাড়ি পুরুলিয়ায় ছিল। জানাজানির পর বাড়ি থেকে মেয়েটিকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়ের পরেও আইডিওলজিকালি দে এক্সচেঞ্জড দেয়ার ভিউজ। ওদের ফোনে যোগাযোগ ছিল। দাদা যখন কলকাতায় যায়, ঐ মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করে। দাদা তখনও দলের কারুর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি। কলকাতাতেও সেফ ফিল করছে না। এই মেয়েটির স্বামী পুলিশে চাকরি করত। মেয়েটি দাদাকে সারেন্ডার করার পরামর্শ দেয়। দাদা তার সঙ্গে দেখা করতে তাদের কোয়ার্টারে যাবে বলে ঠিক করেছিল। কলকাতার পাবলিক বুথ থেকে আমাকে দিল্লীতে এমন কথাই জানিয়েছিল। তারপর থেকেই দাদার সঙ্গে আমার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বহুবছর পরে পেপার হাতড়ে আমি মেয়েটির পরিচয় জানতে পারি, তার পরিবারের সঙ্গে গণেশ হুঁইয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আবিষ্কার করি। আবিষ্কার করি, ঠাকুরপুকুরের ড্রাগ রিকভারির কেসটার পরপরই গণেশের সঙ্গে অভিনন্দন রায়ের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।”
আমি পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। চোখ দিয়ে অজান্তে জলের ধারা গড়াচ্ছিল। নিরঞ্জন যেন বহুদূর থেকে বলে চলছিলেন, “আমার পার্সটা ওরা বাজেয়াপ্ত করেছে। ওটায় আমার দাদার ছবিটা পাবেন। অনেকটা আমার মতই দেখতে ছিল। তবে মনে হয়, আপনার মেমোরিতেও তাঁর মুখখানি গাঁথা আছে।”
আমি দরজা খুলে করিডর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। নিরঞ্জন সেনের পার্স আর খোঁজার দরকার নেই। আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। ঝাঁকড়া মাথা যে লোকটা মায়ের বিছানার পাশে লুটিয়ে পড়েছিল, তার বিকৃত মুখমণ্ডলের দুখানি হাঁ করা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দুটি উঁচু ইনসাইজর উঁকি মারছিল।
সামনের করিডরে একটা ধুলোর ঝড় উঠল। লোকে বলে, ঝড় নাকি বৃষ্টির পূর্বাভাস বয়ে আনে!
***
