জেলনামা – ২
মদন একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, “জিরো ডায়াল হোনে কা লফড়া মেরে কো মালুম হ্যায় গণেশ। শালা, আপনা ভি ওয়সেহি এন্ট্রি হুয়া থা না।”
মদন তালপাড়ের হাইট মেরে কেটে পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হবে। পরনের সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট আর বাহুতে ওং লেখা বিশাল ট্যাটু না থাকলে তালপাড়ে আর মুম্বাইয়ের সবজি বিক্রেতার মধ্যে চেহারার বিশেষ পার্থক্য থাকত না।
গণেশ ভাবলেশহীন মুখে প্রিজন-সেলের গেটের দিকে তাকিয়েছিল। এখনও মাঝে মাঝে অভ্যাসের বশে হাত দুটো পকেটের দিকে চলে যায়। মাথার মধ্যে মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে যখন তখন। তিনটে মোবাইল ফোনে অহরহ ফোন আসত গণেশের। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিরাট ইনফর্মার নেটওয়ার্ক ওকে অহরহ আপডেট দিয়ে যেত। এই তো, মনে হয় সেদিনের কথা! রাতে আজকাল ঘুম আসে না গণেশের। অথবা আসলেও দুঃস্বপ্নের ভিড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে যায় ঘুম। পায়ের পাতাদুটোয় অসহ্য যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে যায়। কলকাতার জেলে রডের সঙ্গে দুটো হাত বেঁধে দিয়ে, গণেশের শায়িত শরীরের ছড়ানো থাইদুটোর উপর পা দিয়ে দাঁড়াত দুই পুলিশকর্মী। আরও একজন পায়ের পাতার উপর দম্মাদম রুলের বাড়ি চালাত। পুলিশি ভাষায় একে বলে ফালাঙ্গা টর্চার। এই ধরণের মারের সুবিধাটা হচ্ছে, বাইরে থেকে কোনো ইনজ্যুরি মার্ক বোঝা যায় না। এত সতর্কতা সত্ত্বেও গণেশের নাক, কান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসত, চোয়াল ফুলে ঢোল হয়ে যেত।
বিকেলে চলত মেঝেতে স্কোয়াট করে বসে, একদল পুলিশ অফিসারের সঙ্গে প্রেস ফোটোগ্রাফের পালা। দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করে, একের পর এক গোপন ডেরার তথ্য ফাঁস করেছে গণেশ; আর পুলিশ প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছে সেসব অস্ত্রোদ্ধারে। তাদের পৌঁছানোর অনেক আগেই ডেরা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অস্ত্র। উধাও হয়েছে কোটি কোটি টাকার শটগান, পাম্পগান, সেমি-অটো পিস্তল, সাব-মেশিন গান, রিভলভার ছাড়াও নানা ধরণের বিস্ফোরক।
“জিরো কিসকো বোলতে মালুম হ্যায় না?” তালপাড়ে গণেশের দিকে বিড়ি বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল।
গণেশ অন্যমনস্কভাবেই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। কলকাতায় যাদের খবরি বলে, বম্বেতে তাদের আরেকটা পরিচয় জিরো বা জিরো ডায়াল রূপে। শব্দটার উৎপত্তি নব্বইয়ের দশকে। বম্বের গলিঘুঁজিতে যখন গ্যাংস্টারদের দাপট। একজন গ্যাংস্টার তার বুড়ো আঙুল আর তর্জনী বেঁকিয়ে ‘শূন্য’ সংখ্যার চিহ্ন আঁকার অর্থ, সে তার দলবলকে সতর্ক থাকতে বলছে, কাছাকাছিই কোনো এক ইনফর্মার রয়েছে, সে পুলিশকে যখন-তখন টিপ-অফ করতে পারে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অধিকাংশ ভাষার মত এ শব্দেরও দুরকমের অর্থ দাঁড়ায়। একটা আপাতভাবে সরল, আরেকটা জটিল এবং অশুভ। গ্যাং-ওয়ারের দিন গেছে, এখন মুম্বাই এবং গোটা দেশ জুড়ে সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত। তবু, জিরো ডায়াল শব্দটার অস্তিত্ব মুম্বাইয়ের ক্রাইম-ডিকশনারি থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি।
মুলাইজা ওয়ার্ডের কয়েদিরা গণেশকে আর ঘাঁটায়নি। সকাল থেকে অন্যান্য কয়েদিদের মধ্যে কয়েকজন গণেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেও, গণেশ কথা না বলায় সরে গেছে। দুপুরে লাঞ্চের পর, ওয়ার্ডগুলোতে তালা চাবি পড়ে যায়। কারা রক্ষীরাও সেসময়ে বিশ্রাম করে, ফলে খুব প্রভাবশালী কয়েদিরা ছাড়া অন্য ওয়ার্ডে আসা যাওয়া করার অনুমতি কারুর নেই। তালপাড়ে সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে।
“বহত সারে ক্রাইম ব্রাঞ্চকে অফসরকে সাথ কাম কিয়া। শেট্টি মালুম? আই.বি কা অফসর? জিসকো বাদমে নানা কোম্পানিনে ঠোক ঢালা? উসকা খাস আদমি থা ম্যায়। যব বম্বে আয়াথা, এক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ভি নেহি থা, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স তো বহত দূর কী বাত হ্যায়। শেট্টি দেতা থা, কভি কভি পানশ, কভি হাজার। বাদমে কভি পাঁচ হাজার, দশ হাজার! শেট্টি গয়া, অপনা কিসমত পলট গয়া।” মদন তালপাড়ে একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল, “পর যো হুয়া, হুয়া। শেট্টি গয়া, ভাই আয়া। তব হজারো মে খেলতা থা, আজকাল লাখো মে খেলতা হু। তুম অপনা বতাও।”
গণেশ কোনো উত্তর দিল না। কালকের অভিজ্ঞতার পর সারারাত ছটফট করেছে ও। ভোরবেলার দিকে সামান্য চোখ লেগে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু ছটা নাগাদ জেলের অ্যালার্ম বেল বাজাতে বাকি কয়েদিদের সঙ্গে গণেশকেও লাইন করে দাঁড়াতে হয়েছিল চাতালে। প্রাত্যহিক রোল কলের পর চারটি লাইন বানিয়ে স্কোয়াট এক্সারসাইজ। সারা রাত মশার কামড়ে গা হাতপায়ের প্রতি ইঞ্চি চামড়া ফুলে গেছে। পা কুঁকড়ে শুয়ে সারা শরীরে ব্যথা। তারপর সকালে টয়লেট করার সময় চূড়ান্ত দুর্ভোগ যে হবে, তা জানাই ছিল। পেটের মল বার করার জন্য হয় কোনো ফাঁকা জায়গা খুঁজতে হবে বা অন্য কারুর হেগে যাওয়া পুতিগন্ধময় মলের স্তূপের উপরেই প্রাতঃকৃত্য সারতে হবে। কলকাতায় থাকতে প্ৰথম কদিন যে লক-আপে সে ছিল, বা পরে জেলের যে হাই-সিকিউরিটি ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছিল, আর্থার রোড জেলের টয়লেটের তুলনায় সেখানকার টয়লেট স্বর্গ। সেখানে অন্তত স্যানিটারি প্যানের ফ্যাকাশে সাদা রঙ কোণাযুঁজি দিয়ে উঁকি মারত, এখানে পরিত্যক্ত মল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না গণেশ।
বাইরে তখন, কিছু বাছাই করা কয়েদিদের সঙ্গে গণেশেরও নাম ডাকা হয়েছে। স্টোর রুমের দেওয়াল সারাই হচ্ছে। গণেশকে কনক্রিট ব্লক বয়ে নিয়ে যেতে হবে। ঝুড়ির উপর পাথরগুলো চাপিয়ে গণেশের একবার মনে হয়েছিল, এটাই বোধহয় শেষ। বাকি জীবনটা এভাবেই কাটাতে হবে। মদন তালপাড়ে ঠিক তখনই পিছন থেকে ওর নাম ধরে ডেকেছিল। যার হুমকির জোরে গতকালের অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিল গণেশ, তাকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হল প্রায় দশ ঘণ্টা পর। তালপাড়ে ভারপ্রাপ্ত কনস্টেবলের কানে কানে ফিসফিস করাতে কংক্রিট ব্লক বওয়ার কাজ করতে হয়নি গণেশকে, কিন্তু ওর সঙ্গে কথাবার্তাও বিশেষ এগোয়নি তালপাড়ে। এক কোনায় দাঁড়িয়ে ওকে এক নজর মেপে চলে গিয়েছিল। তারপর আবার এসেছে দুপুরে খাওয়ার পর।
মদন তালপাড়ে ইমরান আহমেদের বিশ্বস্ত সেনাপতিদের অন্যতম। দুহাজার তিন সালে গুজরাতে মুসলিম জেনোসাইডের পর ইমরান আহমেদের টেরর আউটফিটগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। শোনা যায়, মদন সেসময় আহমেদের হয়ে প্রচুর হেট-স্পিচ ছড়ায় সারা দেশে। সন্ত্রাসবাদের ব্যবসায় ইমরান আহমেদের সেই যে উত্থান হয়েছিল, তারপর থেকে তাকে আর থামানো যায়নি। এখন ভারতে বেআইনি অস্ত্র ব্যবসার অন্যতম কিংপিন ইমরান আহমেদ। দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া আর্মস স্মাগলিং র্যাকেটের কলকাঠিটি তিনিই নাড়ছেন। আহমেদের উন্নতিতে তালপাড়ের অবদান কিছু কম নয়। ওর অন্যতম গুণ হল, ওর রিফ্লেক্স র্যাটেলস্নেকের মতই ধারালো। অথচ চেহারা, কথাবার্তাতে সে একেবারে আম আদমি। মুম্বাই শুধু নয়, সমস্ত মহারাষ্ট্রে তালপাড়ের নেটওয়ার্ক এতটাই শক্তপোক্ত যে এক-আধটা ক্রাইম করে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাওয়াটা ওর কাছে জলভাত। ইমরান আহমেদের হয়ে প্রচুর খুন জখম করিয়েছে তালপাড়ে। মাঝে মাঝে দু একটা মামলায় ফেঁসে গিয়ে জেলে এলেও, এখানে সে বিশেষ খাতির পায়। কোর্টে শুনানি থাকলে পুলিশের লোকে ওকে ঠেলাঠেলি তো দূরের কথা, গায়েও হাত দিতে সাহস পায় না। তালপাড়ের জন্য আহমেদের আলাদাই বাজেট আছে। প্রত্যেক মাসে কোর্টে শুনানির সময়, আহমেদের তরফ থেকে পুলিশের পকেট গরম করতে মোটাসোটা হপ্তা ঢুকে যায় নিয়ম করে। এই জেলে আপাতত তালপাড়েই শেষ কথা।
কলকাতায় থাকতে এটুকু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে গণেশ হুঁইয়ের পরবর্তী গন্তব্য মুম্বাই হবে। নেপাল আর বাংলাদেশের বর্ডার পেরিয়ে যেসব অস্ত্র ভারতে ঢুকছে, তার উৎস যে পাকিস্তান এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লস্কর-এ-তইবার ফান্ডিংয়েই এই জাতীয় কনসাইনমেন্টগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোর সুভেদ্য বর্ডার পেরিয়ে পাঠানো হয়, তা ইনটেলিজেন্সের কাছে অজানা নয়। এই দীর্ঘ ছ-মাস ধরে নানা জেরায়, গণেশ যে নাম্বারগুলো এ.টি.এসকে জানিয়েছে, তা সবই বাংলাদেশের মিলিট্যান্ট সংগঠন হরকত-উল-জিহাদি-ইসলামির চট্টগ্রামের অপারেটর জিয়াউল করিমের। বর্ডারে লজিসটিকাল সাপোর্ট বা অস্ত্র কেনার জন্য হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা পাঠানো এসবই জিয়াউল কন্ট্রোল করে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের এনট্রি পয়েন্ট কন্ট্রোল করত সে নিজে।
তবে এই বিরাট রাঘব বোয়ালসমৃদ্ধ পুকুরে গণেশ যে সামান্য চুনোপুঁটি হ্যান্ডলার, এ.টি.এসের অফিসাররা তা বিলক্ষণ জানেন। যে কিংপিনের হয়ে গণেশ এবং গণেশের মত আরও কিছু হ্যান্ডলার সারা দেশে কাজ করছে, এ.টি.এস এখনও অবধি সেই কিংপিনের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। ইমরান আহমেদ যে দেশের তাবড় তাবড় মন্ত্রী, আমলাদের ছত্রছায়ায়, চাটার্ড বিমানে উড়ে গিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোনো বিলাসবহুল শহরে, লক্ষ লোকের ভিড়ে মিশে গিয়েছে নিঃশব্দে, তা কি এ.টি.এসের অজানা! গণেশের ঠোঁটের কোণে একচিলতে ব্যাঙ্গের হাসি দেখা দিয়েও মিলিয়ে যায়। জেলে ঢোকার আগে একটা কভার চেয়েছিল গণেশ। আহমেদের সঙ্গে তার কাজের সূত্রে যোগাযোগ প্রায় পাঁচ বছরের। নিখুঁত প্ল্যানিং আর জবরদস্ত লোকাল নেটওয়ার্কের দৌলতে একের পর এক কনসাইনমেন্ট পার করেছে গণেশ। কখনও নিজে এসে লেনদেনের কাজ সেরেছে, কখনও কখনও সাগরেদ পাঠিয়ে। আহমেদ ওর কাজে খুশি ছিলেন। তাই ধরা পড়ার পর, ফোনে আশ্বাস এসেছিল, কলকাতায় নয়, মুম্বাইতে পৌঁছালে ব্যবস্থা হবে সবকিছুর। কভার, জেলে থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা, এমনকি মামলা একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে উকিল লাগিয়ে জামিন। জেলে ঢুকে মদন তালপাড়ের কভার পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল গণেশ, বুঝেছিল ইমরান আহমেদ আর যাই হোক বেইমান নয়। সে নিজে না থাকলেও তার নেটওয়ার্ক এখনও সবকিছু কড়া নজরে দেখে চলেছে। ইমরান আহমেদ নিজের হ্যান্ডলারদের অনাথ করে ছেড়ে দেয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি ততটাও সহজ নয়, যতটা গণেশ ভেবেছিল।
“কিতনে কি লগি?” মদন তালপাড়ে পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল।
“মালুম নেহি। অভি তো ট্রায়াল শুরু নেহি হুয়া। ভাই কে তরফ সে অওর কোই মেসেজ আয়া?”
তালপাড়ে নেতিবাচক ঘাড় নাড়াল। গণেশের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর চাহিদা বিশাল কিছু নয়। জেলে ‘গেস্ট-হাউজ ট্রিটমেন্ট’ বলে একটা বিশেষ ব্যবস্থা হয়। প্রভাবশালী নেতা-নেত্রী, ক্ষমতাবান রাজনৈতিক গুন্ডারা প্রায়শই সেই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ফাইভস্টার লাক্সারিতে দিন কাটান, ভালো খাওয়াপরা তো বটেই, সামান্য অঙ্গুলিনির্দেশে বডিম্যাসেজ থেকে শুরু করে, সিগারেট এমনকি ড্রাগ পর্যন্ত সহজলভ্য হয়ে যায়। ইমরান আহমেদ চাইলেই আর্থার রোড জেলে গণেশের জন্য সেটুকু ব্যবস্থা করতে পারেন। যতদিন না জামিন হয়, শুধু এটুকুই গণেশের দাবি।
“আরে সুমড়িমে বৈঠ বৈঠকে পগলা যাওগে ভাউ, যাও যাকে খালো। খানা অচ্ছা নেহি লগা?” তালপাড়ে নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞাসা করে।
“আচ্ছা থা। পর ভুখ নহি লগি।” গণেশ বিরক্তি চেপে বলে। মদন তালপাড়ে একই রকম নির্বিকারে, পাশে বসে কান খুঁচাচ্ছিল। দেখতে গেলে সেই আর্থার রোড জেলের ডি-ফ্যাক্টো চিফ। গণেশ হুঁইয়ের পরনের জামাটুকু ছাড়া তার যে আর কোনো সম্বল নেই, এ কথা মদনের অজানা থাকার কথা নয়। যেমন সে কেন খেতে পারেনি, তাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মুলাইজা ওয়ার্ডে প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার আগে-পরে যে চৌবাচ্চার জলে হাত ধুতে হয়, তাতে থিকথিক করে শেওলা। লাঞ্চে প্রতিদিন সোয়া চাঙ্কের যে অপাচ্য ঘ্যাঁটটা খাওয়ানো হয়, বা আধসিদ্ধ চালের ভাতের সঙ্গে দুর্গন্ধযুক্ত যে ডালটা পাতে পড়ে, তার স্বাদ কেমন তাও মদন তালপাড়ে বিলক্ষণ জানে। গণেশের মনে হল, মদন ইচ্ছা করে এরকম ব্যবহার করছে। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা না রেখে উপায় নেই। ইমরান আহমেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ একমাত্র মদনই করে দিতে পারে। আর এই মুহূর্তে, গণেশের কাছে সেটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।
পাশের দুচারজন কয়েদি তালপাড়েকে এতক্ষণ সেলে দেখে তাদের প্রয়োজনের কথা বলতে এসেছিল। মুলাইজা ওয়ার্ডের কয়েদিদের মধ্যে ফার্স্ট টাইম অফেন্ডারের সংখ্যা বেশ বেশি। স্বভাবতই তারা বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতে উৎসুক হয়ে থাকে। জেলে একটা হাই টেক ফোন বুথ ও আছে, প্রত্যেক কয়েদির বায়োমেট্রিক ডাটা তাতে ফিট করা। চাইলে, কয়েদি তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে লগ ইন করতে পারে, সেক্ষেত্রে কয়েদির দেওয়া দুটো পূর্বনির্দিষ্ট নাম্বার স্ক্রিনে দেখা যাবে। সেসব ভেরিফায়েড নাম্বারে প্রত্যেক কয়েদি দিনে পাঁচমিনিট বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে সপ্তাহে দুদিন বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ।
এই নিয়মের বাইরে অন্য ব্যবস্থা করতে গেলে মদন তালপাড়ের কাছে আসে মানুষ।
রোগা পাতলা সদ্য গোঁফ গজানো একটা ছেলে বহুবার তালপাড়ের কাছে কথা তোলার চেষ্টা করছিল। গণেশকে ছেড়ে তালপাড়ে এবার সেদিকে মন দিল।
“হো যায়েগা বাবুয়া। জেলকে ডক্টরকে সাথ সেটিং করনা পড়েগা। উও তুমহে স্পেশালিস্ট রেফার করেগা। ফির, পুলিশ এসকর্টকে সাথ সুবহে সুবহে নিকলো, দিনভর হোটেল বোটেল মে ফ্যামিলি ইয়া গার্লফ্রেন্ডকে সাথ বিতাও, শাম শাম অপনা খোলি ওয়াপস আ যাও। সমঝে না?” মদন ছেলেটির দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপল।
ছেলেটা জুলজুল চোখে মদনের দিকেই তাকিয়ে ছিল। ওর কথা শুনে ঘাড় নাড়াল।
“ত্রিশ হজার লগেঙ্গে বারা ঘন্টে কি আজাদিকা। রূপেয়া ফেকো। অওর মজা লো।”
“ত্রিশ হজার!” ছেলেটা খাবি খেয়ে বলল।
“জাদা হ্যায়? ফির মত যাও বাহার!”
তালপাড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ছেলেটাকে তাড়িয়ে গণেশের দিকে তাকিয়ে হাসল।
“আপকো বাহার যানা হ্যায় ভাউ? বোলো তো ম্যায় সেটিং করতা হু। আপ হামহারে খাস হ্যায়, ইতনা তো হাম কর সকতে হ্যায় আপকে লিয়ে। পয়সা-ওয়সা কুছ নেহি লগেগা। বস আপ বতাও।”
গণেশ মাথা নাড়াল। এই শহর তার পরিচিত সাম্রাজ্য নয়। এখানে তার সঙ্গে কারুর খাতির নেই। বহুবার কাজের সূত্রে এলেও, এখানে আলাদা করে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার কথা সে কোনোদিন ভাবেনি। পরিচিতি বাড়িয়ে তুলছিল সুমন্ত। সে বহুবার বলতো, “গ্রাম থেকে গঞ্জ, আর গঞ্জ থেকে শহর কলকাতা, তুমি এর মধ্যেই আটকে রইলে গণেশদা। একটু চেষ্টা করলেই আজকাল গোটা দেশে এমনকি পুরো দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়া কোনো ব্যাপার না। জাল ছড়াতে শেখো গণেশদা। কতদিন আহমেদের আন্ডারে কাজ করবে? নিজের একটা আলাদা
সাম্রাজ্য ভালো লাগে না তোমার?”
সুমন্তর কথা মনে পড়তেই গণেশের চোখটা ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। তালপাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “মুঝে আহমেদ ভাই সে বাত করনা হ্যায়। বেল চাহিয়ে মুঝহে। কুছ হিসাব নিপটানা হ্যায়।”
“ভাইসে বাত করনা অভি মুশকিল হ্যায়। মেরাইচ ফোন নেহি উঠাতে কভি কভি। ফির ভি ম্যায় টেরাই করতা হু। খুশখবরি ইয়ে হ্যায় কী, মেরা ববুয়াকা শাদি হ্যায়, কাল সুবহে ম্যায় প্যারোল পে নিকল রহা হু। আপকে লিয়ে ভাইসে বাত করতা হু। কালা কোট লগা দেঙ্গে কোই তগড়াসা, বেল মিল যায়েগি।” তালপাড়ে পাশ থেকে উঠে পড়তে পড়তে বলে। কালা কোট অর্থাৎ উকিল। এখনও পর্যন্ত লিগাল হেল্প সেভাবে পায়নি গণেশ। কানাঘুষোতে শুনেছে এত সহজে এই কেসে বেল পাওয়া যাবে না। তবে ইমরান ভাই চাইলে কী না হতে পারে! কিন্তু তালপাড়ের ইচ্ছা নয়, গণেশ তাকে ডিঙিয়ে সোজা ভাই অবধি পৌঁছায়।
“ভাইসে বাত করকে আচ্ছাসা কোই ওয়ার্ডমে শিফ্ট হো সক্তা হ্যায় কেয়া?” গণেশ পিছন থেকেই বলল।
মদন কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ‘দেখতা হু’ বলে আবার এগিয়ে গেল সামনে।
কাল যদি তালপাড়ে প্যারোলে জেলের বাইরে বেরিয়ে যায়, তবে গণেশের ব্যাপারটা সে কতটা দেখবে তা বলা শক্ত। গণেশ মদন তালপাড়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল। তালপাড়ে চিতাবাঘের মত ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলছে বাইরের গ্রাউন্ডের দিকে। বিকেল পাঁচটা বাজে। এইসময় আর্থার রোড জেলে প্রিজন সেলের তালা খুলে দেওয়া হয়। এখানকার ভাষায় একে বলে ‘বন্দি’ উঠে যাওয়া। এসময় কয়েদিরা আবার লকাপের বাইরে বেরোতে পারে। গণেশের এখন কোনো কাজ নেই। চাইলে সে এইসময়টা সেলের বাইরে বেরোতেই পারে। কিন্তু গণেশের ইচ্ছা করছিল না। জেলের অভিজ্ঞতা তার এই দ্বিতীয়বার। প্রথমবার জেল যেতে হয়েছিল বছর কুড়ি আগে। আলিপুর জেলের সেই এপিসোডটা গণেশ হুঁইয়ের জীবনে না ঘটলে আজ ওর জীবন অন্যখাতে বইত। ‘হাজার’ ছেড়ে ‘লাখ’ টাকার ধান্ধার মুখ দেখার সেই শুরু। তখন বয়স অল্প ছিল। ঘ্রাণশক্তি তীব্র ছিল। রক্ত, অস্ত্র, মাদক, টাকা, প্রতিপত্তি…এসবের গন্ধ যে সমজাতীয় তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ওর। বুঝতে যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে, তবে তা অতি ঘনিষ্ঠ সুমন্তকে। সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে গেছে সে। আস্তিনের সাপটাকে হাতে পেলে বিষদাঁত একেবারে উপড়ে ফেলবে গণেশ। অন্ধবিশ্বাসের অনেক বড় দাম দিয়েছে ও। ঠিক যেমনটা কুড়ি বছর আগেও একবার দিয়েছিল। সন্ধে নেমে আসছিল দ্রুত। নানা চিন্তার ভিড়ে গণেশের মাথা আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। বসে বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। পাশের লোক, রাতের বেলা খাবারের সময়ে ডেকে না দিলে গণেশ হয়তো ওভাবেই ঝিমোতো।
খাবার খেয়ে লক-আপের ভিতরে ঢুকতেই ইন্টারকমের স্পিকারটা হঠাৎ বেজে উঠল
“গণেশ হুঁই, পিতা দেওগোপাল হুঁই, চক্করমে আকে রিপোর্ট করো।” স্পিকারে দুবার ঘোষণাটা হয়েই থেমে গেল। চক্কর জায়গাটা গণেশ কাল দেখেছে। জেলের সুপারিনটেন্ডেন্টের ঘর ছাড়িয়ে বেশ দূরে গ্রাউন্ডের মধ্যে এই একতলা বিল্ডিংটা। এখানে ডেপুটি সুপার আর অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপাররা তাদের আর্দালিদের নিয়ে বসে। এই আর্দালিরা অফিসার আর কয়েদিদের মিডলম্যান। তালপাড়ের মত লোকেরা আর্দালিদের হাত দিয়ে সব কাজ সারে। ঘুষের টাকাও এদের হাত দিয়েই লেনদেন হয়।
চক্কর থেকে ডাক আসা বেশ চাপের ব্যাপার। এর দুরকম ফলাফল হতে পারে। হয় কয়েদির জামিন হয়ে সে মুক্তি পাবে, অথবা কোনো কারারক্ষীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে তার হাত পায়ের চামড়া তুলে নেওয়া হবে। অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য কোনো রাইভ্যাল গ্যাংয়ের মাথা, জেলে বন্দী তার পুরোনো শত্রুর উপর থার্ড ডিগ্রির ব্যবস্থা করায় এ ভাবে। চক্করের বিল্ডিংয়ের সামনের দিকটায় সিসিটিভি আছে। পিছন দিকে নেই। থার্ড ডিগ্রীর ব্যবস্থা সেখানেই হয়। ঘরের মধ্যিখানে একটা লোহার রডের সঙ্গে কয়েদিকে উল্টো করে টাঙিয়ে আগাপাশতলা মেরে মুরগির মত ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। মার খেয়ে আধমরা হয়ে গেলে তুলে জেলের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আজ সকালে কোনো এক কয়েদিকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক ঠাঙানো হয়েছে। তার চিৎকারের শব্দ মুলাইজা ওয়ার্ড অবধি আসছিল।
চক্করের বিল্ডিংটার কাছে গিয়ে গণেশ একবার জোরে শ্বাস নিল। তারপর অফিসের গেটটা দিয়ে সোজা ঢুকে চেয়ারে বসা অফিসারের দিকে সেলাম করে বলল, “আপ বুলায়েথে স্যার?”
