গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি
বাঘমুণ্ডিতে ব্রেকফাস্ট করার বেশ কটা হোটেল। তার মধ্যে মুখার্জি হোটেল বেশ বিখ্যাত। সারাদিন প্রচুর লোকের পাত পড়ে। একটা শালপাতার প্লেটে চা, ডালের বড়া, আর মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে গেছে দোকানের ছেলেটা। কাল দোল ছিল। আজ হোলি। কাল আমার উইকলি অফও ছিল। জয়েন করে পরদিন ছুটি পেয়ে সুবিধা হয়েছে। বাড়িতে বসেই লোকসমাগম দেখেছি। বিরাট পরিমাণে ট্যুরিস্ট মুখার্জিতে কাল খেয়ে গেছেন। এখনও বেশ কিছু খাচ্ছেন।
“আপনি এই খাবারে অভ্যস্ত?” নিরঞ্জন প্রশ্ন করলেন।
“আমি সবেতেই অভ্যস্ত। আপনার অসুবিধা হচ্ছে নাকি?” আমি ডালের বড়ায় কামড় দিতে দিতে বললাম।
“অসুবিধা ঠিক নয়। আমার তো কলকাতায় কম দিনই হল। আর বাইরে তো ব্রেকফাস্টে আলুপরোটা, আর টক দইটাই বেশি চলে। এই খাবার আমার এক্ষুনি হজম হয়ে যাবে।” নিরঞ্জনকে একটু আনকমফর্টেবল লাগছিল।
“এর আগে কোথায় ছিলেন?”
“আমি দিল্লীর ছেলে। চাকরির পর পর উত্তরভারতের বিভিন্ন জায়গাতেই পোস্টেড ছিলাম। হঠাৎ কোম্পানির মাথায় কী চাপল, দেড় বছর আগে পাঠাল সোজা নর্থ-ইস্ট। মেইনলি ত্রিপুরা। কলকাতায় এসেছি সাত মাস হল। খাওয়াটাই এখনও মানিয়ে উঠতে পারিনি।”
“বেশ তো, লুচিও তো পাওয়া যায় দেখছি। ছেলেটাকে ডেকে বলুন না।”
“হ্যাঁ তাই করব ভাবছি। আপনি নেবেন?”
“না! আমাকে এবার উঠতে হবে। আপনার কী কথা আছে বলছিলেন?” নিরঞ্জন ছেলেটিকে ডেকে এক প্লেট লুচি আলুরদম আনার কথা বলে আমার দিকে তাকালেন। ঝকঝকে চোখে ভরসার হাসি। কিন্তু উনি হাসলেই আমার একটা অস্বস্তি হয়, কোথায় যে ভদ্রলোককে দেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারি না। রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসে ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে বলেছিলেন, জরুরী দরকার ছাড়া ফোন করবেন না। পরশু রাতে ফোন করে বিশেষ কিছু কথা বলার আছে জানিয়ে আজ সকালের দশ মিনিট চেয়ে নিয়েছিলেন আমার কাছ থেকে। পকেট থেকে মোবাইল বার করে একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ আমার দিকে বার করে বললেন, “এই খবরটার ব্যাপারে কিছু মনে আছে আপনার?”
তাকিয়ে দেখলাম, দুহাজার তেরো সালের একটি খবরের অংশবিশেষ রয়েছে অনলাইন আর্কাইভে। “মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পারদর্শিতার স্বীকৃতি স্বরূপ, পুরুলিয়ার ডি.এস.পি অভিনন্দন রায়কে পুরষ্কৃত করবেন মুখ্যমন্ত্রী। পয়লা সেপ্টেম্বর রাজ্য পুলিশ দিবস উপলক্ষ্যে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ সম্বর্ধনা ও মেডেল সহযোগে সম্মানিত হবেন অভিনন্দন রায়। জঙ্গলমহলের বেপরোয়া সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রতিহত করার জন্য ডি.এস.পি রায় সহ আরও কিছু পুলিশকর্মীকে পুরষ্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজ্য সরকার।”
আমি নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে শ্রাগ করে বললাম, “পার্টিকুলারলি কিছু মনে নেই। কেন বলুন তো? ইনি তো এখন আমাদের ওয়েস্টার্ন জোনের ডি.আই.জি?”
নিরঞ্জন চোখটা একটু কুঁচকে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “হ্যাঁ। আপনার জয়েন করার কদিন আগেই জয়েন করেছেন। আগের ডি.আই.জি রিটায়ার করছেন গত মাসে। খুব তাড়াতাড়ি পুরুলিয়া ভিজিটে আসবেন।”
আমি নিরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি দেখে উনি হেসে বললেন, “আরে এই দেখুন, আসল কথা তো বলাই হয়নি। মোতিরা পোয়াম ত্রাস হয়ে ওঠার আগে, জঙ্গলমহলের ত্রাস কে ছিল জানেন তো?”
“সে তো একটা বাচ্চা মেয়েও জানে।” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম। নিরঞ্জন চেয়ারটা টেনে একটু সামনের দিকে এগিয়ে বসে বললেন, “এক্সাক্টলি। কিন্তু এটা জানেন কি, বারো সালে কুশাবনীর জঙ্গলে মহান সিংয়ের উপর এনকাউন্টার করে যে জয়েন্ট ফোর্স, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অভিনন্দন রায়? শোনা যায়, মহান সিংয়ের ঘনিষ্ঠতম সহকারি মীনা মাহাতোর আত্মসমপর্ণেও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন অভিনন্দন।”
“সেলিব্রেটেড অফিসার। হাই ক্যালিবার।”
লুচির টুকরো মুখে পুরে নিরঞ্জন বললেন, “হ্যাঁ। সে আর বলতে।”
“কিন্তু আমি ঠিক কীভাবে এর সঙ্গে জড়িত…মানে আমাকে কেন…”
“দর্শনা, অভিনন্দন রায় ইজ এ মিডিয়া হাইপড স্টার, জানেন তো সেটা? তের সালে মেডেল পাওয়ার পর আমাদের পেপার ওঁর একটা ইন্টারভ্যু ছাপে। অ্যান্ড হি জাস্ট রকড দ্য শো! ওঁর একটা ডায়লগ খুব হাইলাইটেড হয় সেসময়। আপনার মনে আছে কিনা জানি না।”
“হ্যাঁ মনে আছে। বলেছিলেন, ব্রেভারি ইজ নট দ্য অ্যাবসেন্স অফ ফিয়ার, বাট অ্যাকশন ইন দ্য প্রেজেন্স অফ ফিয়ার।”
নিরঞ্জনের চোখ চকচক করে উঠল। বললেন, “কী শার্প মেমোরি আপনার!”
“আরে না না। কথাটাই এমন, রক্ত গরম হয়ে যায়,” আমি হেসে বললাম, “কিন্তু এখনও তো আমার সঙ্গে আপনার দরকারটা বুঝতে পারলাম না।”
“আবার একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভ্যু চাই ওঁর। একান্তে। আপনাকে হেল্প করতে হবে।”
“আমি! আমি কীভাবে?” অসম্ভব অবাক হয়ে বললাম।
“আমি ব্যক্তিগত ভাবে অলরেডি চেষ্টা করেছি দর্শনা। কিন্তু এখন জেলার এই পরিস্থিতিতে মিস্টার রায়ের ইন্টারভ্যু পাওয়া চাপের। একমাত্র আপনি…”
আমি কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম।
“এ.সি.পি. প্রবীর পুরকায়স্থ, অভিনন্দন রায়ের বিশেষ বন্ধু। আপনি পুরকায়স্থকে বললেই ব্যাপারটা ম্যানেজেবল হয়ে যাবে।”
“পুরকায়স্থ স্যারকে আপনি কীভাবে চেনেন!”
নিরঞ্জন উত্তর দিলেন না। বদলে মুচকি মুচকি হাসলেন।
“মাফ করবেন। ব্যক্তিগত কনট্যাক্ট খাটিয়ে এভাবে কাউকে সুযোগ পাইয়ে দেওয়া আমার নীতিবিরুদ্ধ।” আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম। মুডটা উজ্জ্বল ক্যানভাসে এক পোঁচ কালো কালি পড়ে যাওয়ার মত খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
নিরঞ্জন হা হা করে হেসে উঠলেন। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “আরে এটা কোনো ঘুষ বা উপঢৌকনের ব্যাপার নয়, জাস্ট এ স্মল ফেবার। বন্ধু হিসেবে একটা আবদার…”
“বন্ধুত্ব! আপনি আমাকে চেনেন ক’ঘণ্টা?”
“আপনি কিন্তু রেগে যাচ্ছেন। আপনাকে সত্যি কথাটাই বলি। নবগ্রামের কেসটা আমি ইন ডেপথ স্টাডি করেছি। এবং সেই সময় থেকেই কেসটার সঙ্গে চিনে জোঁকের মত লেগে আছি। আপনার ব্যাপারেও প্রচুর খোঁজখবর নিয়েছি সেসময়। দ্য পিপল কিন্তু বিরাটভাবে কভার করেছিল ঘটনাটা। খবরটার যা প্রসপেক্ট ছিল, নেহাত উপরতলা থেকে এখন চেপে দিতে না বললে আমি অনেকদূর যেতাম।” নিরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
“নবগ্রামের কেস এখন ক্লোজড চ্যাপ্টার। অন্ততঃ আমি কোনোভাবে জড়িত নই।” আমি কাটা কাটা গলায় বললাম।
“আপনি ভীষণ ট্যালেন্টেড অফিসার। আপনার সঙ্গে পরিচিতি বা বন্ধুত্ব, দুটোই খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।”
আমি ছেলেটাকে ডেকে বিল আনতে বলে নিরঞ্জন সেনের দিকে তাকালাম। চোখে চোখ রেখে বললাম, “আপনি আমার বন্ধু নন নিরঞ্জন। হলেও উত্তরটা একই হত। মাফ করবেন।”
“বেশ! কিন্তু আপনার ফেবারের বদলে আমি যদি একটা ফেবার ফিরিয়ে দিই?” নিরঞ্জন আমার চোখ থেকে চোখ সরালেন না।
“আমার ফেবারের প্রয়োজন নেই।”
ছেলেটা বিল নিয়ে এসেছিল। ৩৫ টাকা পকেট থেকে বার করে বিলের উপর রেখে নিরঞ্জনকে নমস্কার জানিয়ে বললাম, “আসি।”
“ফেবারটা গণেশ হুঁই সংক্রান্ত হলেও নয়?”
আমি টেবিল থেকে উঠে রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। পিছনে ফিরে না তাকিয়েও বুঝলাম, নিরঞ্জনের একজোড়া চোখ আমার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করছে। মনের মধ্যে ওঠা আকস্মিক ঘূর্ণিটাকে জোর করে চাবুক মেরে থামিয়ে জিপের কাছে পৌঁছে বললাম, “দেবেন মাহাতো হাসপাতাল চলো বিধু।”
***
দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতাল বিরাট আকারের হাসপাতাল নয়। পাঁচশ বেডের হাসপাতালে অন্যসব সরকারি হাসপাতালের মতই মর্গের পরিবেশ গা ঘিনঘিনে। চাকরির প্রথম দিকে সিনিয়রদের দেখতাম, মর্গে ঢোকার আগে নাকের ডগায় মেন্থল জাতীয় মলম লাগিয়ে ঢুকতে বলতেন। প্রথম দু তিনবার আমরা সবাই-ই লাগিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আজকাল আমার উল্টোটাই মনে হয়। অটোপ্সির আগে ডেডবডিগুলোকে যেভাবে অকুস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়, শব ব্যবচ্ছেদের পর সেই বীভৎসতা যেন প্রশমিত হয়ে আসে। সদ্য মৃত শরীরের রক্ত, মজ্জা, পুঁজ কেন এত ভয়াবহ লাগে, বহুবার ভেবেছি আমি! একটা বিরাট, প্রবল, স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের অস্তিত্ব আপাতনির্জীব কিছু দেহতরল, আর দেহকোষ ছেঁতড়িয়ে, ছড়িয়ে নেই হয়ে গেছে, এই সত্যিটা বারবার ধাক্কা দেয়। যারা এতদিন অদৃশ্য ছিল, তারাই নানা ছিদ্রপথে শরীরের বাইরে এসে জানান দেয়, প্রাণের এই বিরাট অহংকার আসলে সমষ্টিগত কিছু জৈবিক ক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়! অটোপ্সির পর ডেডবডি বিয়েবাড়ির উচ্ছিষ্টের মত পড়ে থাকে। তাতে পচনের দুর্বিষহ গন্ধ থাকলেও, আ-জীবন থেকে না-জীবন হয়ে যাওয়ার দৃশ্যগত ধাক্কাটা লাগে না।
উমানাথন তাঁর অফিসে নেই। ডোম অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় সাড়ে বারোটা। মনটা বারবার নিরঞ্জন সেনের দিকে চলে যাচ্ছিল। লোকটা আমার সম্পর্কে ইন ডেপথ খবর নিয়েছে। গণেশদার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাটা শক্ত নয়, সামান্য টাকার বিনিময়ে তথ্য ফাঁস করে এমন ইনসাইডার পুলিশেই প্রচুর আছে। তারপর তথ্যকে রঙিন মোড়ক পরিয়ে পরিবেশনা তো কিছু সাংবাদিকের পেশা। কিন্তু এই ধরণের কোন খবর কোনো সংবাদপত্রে বেরিয়েছে বলে শুনিনি। নিরঞ্জন যে পেপারের সঙ্গে যুক্ত সেখানে তো নয়ই। তা সত্ত্বেও ওর এরকম তৎপরতার কারণ কী! এসিপি পুরকায়স্থ যে আমার পোস্টিংটা দেখেছেন, সেটাও লোকটা জানে। ইনফ্যাক্ট পুরকায়স্থর সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে, সেটাও! প্রশ্ন হচ্ছে কেন? মিডিয়ার লোকজন বিশ্বাসযোগ্য হন না, এরকম একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে। গড়পড়তা ধারণায় পাত্তা না দিয়ে নিরঞ্জন সেনকে বাইরে মিট করে ভুল কাজ করলাম কী!
“আসুন ম্যাডাম। স্যার সই করে দিয়েছেন।”
দরজা ঠেলে যে ঘরটায় ঢুকলাম, সেখানে ইন্ড্রাস্টিয়াল এয়ার কণ্ডিশনিং মেশিনের তাপমাত্রা এতটাই কমানো যে ঠাণ্ডায় হাত পা জমে যায়। লম্বা সার সার দেওয়া পাথরের আটটা স্ল্যাব। তার ছটা অকুপায়েড। এর মধ্যে কোনো একটা ভবেশের ডেডবডি। ফরেন্সিক ল্যাবটাও মর্গ লাগোয়া। ডোম পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গেল, আর লাল একটা ফাইল আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, “নিন, এই কাগজটায় সই করে দিন। ভিসেরার কেমিকাল অ্যানালিসিস রিপোর্ট পেন্ডিং আছে, ওটা পরশু পাবেন।”
“ডাক্তার উমানাথনের সঙ্গে একবার দেখা করা যায়?”
“না। স্যার বেরিয়ে গেছেন। আজ আর আসবেন না। স্যারের আজ ছুটি ছিল। শুধু এই রিপোর্ট কমপ্লিট করে সই করবেন বলে সকালে এসেছিলেন।”
“ডেডবডি একবার দেখা যায়?”
ডোম আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “আবার দেখবেন?”
“আমি নতুন জয়েন করেছি। তখন ছিলাম না।”
ডোম আর কথা না বাড়িয়ে বলল, “আসুন।”
বাঁদিকের সারির একদম শেষ টেবিলের মৃতদেহের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডোম ডেডবডির মাথার উপর পাওয়ারফুল ইয়েলো এল.ই.ডি জ্বালিয়ে দিল। মাঝবয়সী পুরুষ শরীর। মিডিয়াম বিল্ট। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চওড়া ভুরু, চ্যাপ্টা নাক, ভাঙা গাল। মোটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হলদেটে দাঁত দেখা যাচ্ছে। কষের পাশে সাদা ফেনার মত শুকিয়ে জমে আছে। বাম দিকের কাঁধে অগভীর কিছু বাইট মার্কস। অসাধারণত্ব বলতে শুধু সারা শরীরে একটা অদ্ভুত হালকা নীলাভ সবুজ আভা। শেভ করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যেমন হয়। নখগুলোর দিকে তাকালাম। অসীমের কথা মতো সেগুলোও কালচে নীল। বুক থেকে পেট পর্যন্ত বস্তা সেলাইয়ের মত গুণছুঁচে ফোঁড় দিয়ে সেলাই করে রেখেছে ডোম। ভবেশ বাউরির পেশী এখন আবার শিথিল। মৃত্যু হয়ে ছত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেছে।
“হয়ে গেছে?” ডোম লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল। লোকটা বয়স্ক। কম কথা বলে। লাইট নিভিয়ে ল্যাবের দিকে চলে যাওয়ার জন্য এগোল।
“ডক্টর উমানাথনের নাম্বারটা পাওয়া যাবে? একবার কথা বলতাম ওঁর সঙ্গে?” আমি আটকালাম।
“রিপোর্টটা পড়ুন। তাহলেই বুঝবেন। কথা বলে কী হবে? রদ্দি কেস একটা। তাছাড়া থানায় তো নম্বর দেওয়া আছেই।” লোকটা গ্যাঁটগ্যাট করে চলে গেল।
দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ালাম। নম্বরটা সেভ করে আনা হয়নি। যাই হোক, দরকারে জেনে নেওয়া যেতেই পারে। মর্গের বাইরের বেঞ্চে বসে লাল ফাইলটা খুললাম। গোটা গোটা হাতের লেখায় পি.এম রিপোর্টের একগাদা ইনফর্মেশন ফিলাপ করেছেন ভদ্রলোক। “মেল অফ ফর্টি ফাইভ ইয়ার্স অফ এজ, অ্যাভারেজ বিল্ট, নেকেড বডি, অ্যানিম্যাল বাইট মার্কস পারসিস্টিং অন হিজ লেফ্ট শোল্ডার।”
আমার চোখ লাফ দিয়ে দিয়ে প্রতিটা লাইনে নামছিল।
“রটেন এগ স্মেল ওয়জ কামিং আউট ফ্রম হিজ বডি। নেইল বেডস ব্লুয়িশ ইন কালার ইন্ডিকেটিং সায়ানোসিস।”
এর অর্থ কী! সায়ানোসিস যতদূর মনে পড়ছে একধরণের বিষক্রিয়া। পাতা উল্টালাম।
“পোস্ট-মর্টেম হাইপোস্ট্যাসিস প্রেজেন্ট ওভার ব্যাক অ্যান্ড ডিপেন্ডেন্ট পার্টস অফ বডি। রিগর মর্টিং ওয়েল ডেভেলপড।”
“কর্নিয়া, কনজাংটিভা ক্লিয়ার।”
“টিথ, গাম, লিপস ইনক্লুডিং মিউকোসা ইনট্যাক্ট।”
“প্লুরাল ক্যাভিটি, ডায়াফ্রাম, পেরিটোনিয়াল ক্যাভিটি, ইউরিনারি ব্লাডার অ্যান্ড অল ইন্টারনাল অর্গানস ইনট্যাক্ট।”
চোখের দৃষ্টি এরপর তীব্র গতিতে ভিকটিমের হৃদয়সংক্রান্ত তথ্যে চলে গেল। “হার্ট ওয়জ নর্মাল ইন সাইজ অ্যান্ড দেয়ার ভালভ, ওয়াল অ্যান্ড চেম্বারস ওয়র ইনট্যাক্ট।”
আশ্চর্য! ভবেশ বাউরির শরীরের বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজকর্মে কোনো প্রবলেম নেই। পরের পাতা উল্টানোর আগে মনে হঠাৎ একটা টেনশন শুরু হল। আর সামান্যই কটা ইনফর্মেশন, তারপরেই কজ অফ ডেথ। অবশেষে ফুসফুসে পৌঁছে কাঙ্ক্ষিত তথ্য পেলাম। উমানাথন লিখছেন, “ট্রাকিয়া কনজেস্টেড, বাইলেটারাল লাংস কনজেস্টেড, ইডিমেটাস অ্যান্ড হ্যাভিং মাল্টিপল একাইমোসিস ওভার দ্য সারফেস অফ লোয়ার লোব। অল আদার ভিসেরাল অর্গান অ্যান্ড ব্রেইন কনজেস্টেড। স্টমাক কনটেইনস অ্যাবাউট হান্ড্রেড মিলি অফ গ্রিনিশ লিকুইড অ্যান্ড কনজেস্টেড মিউকোসা।”
ফুসফুসে, মস্তিষ্কে, শ্বাসনালীতে অস্বাভাবিক কোনো পদার্থের উপস্থিতির ফলে স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়া রুদ্ধ হয়েছে ভবেশ বাউরির। পদার্থটা কী হতে পারে! পি.এম রিপোর্ট এরপর কজ অফ ডেথ দিয়ে শেষ হয়েছে। ছোট্ট একটা প্যারা, কিন্তু পড়ে আমার যাবতীয় হিসেবনিকেশ ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হল।
“কজ অফ ডেথ, অ্যাসফিক্সিয়া ডিউ টু ইনহেলেশন অফ সিউয়েজ গ্যাস প্রিসাইজলি হাইড্রোজেন সালফাইড।”
সাদা বাংলায় যার মানে করলে দাঁড়ায় ভিকটিমের মৃত্যু হয়েছে হাইড্রোজেন সালফাইড নামক অতি বিষাক্ত এক গ্যাসের দ্বারা ফুসফুস চোকড হয়ে! ছোটবেলায় পচা ডিমের গন্ধযুক্ত গ্যাস জিজ্ঞাসা করলেই যার নাম লিখতাম আমরা। অ্যানালিসিস করে উমানাথন লিখেছেন, ভবেশের নখের নীল রঙ বা শরীরের নীলচে আভা এসবই হাইড্রোজেন সালফাইড পয়জনিংয়ের লক্ষণ। হাইড্রোজেন সালফাইড কোথা থেকে এল, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। ভিসেরা এবং ব্লাড স্যাম্পল কেমিকাল অ্যানালিসিসে পাঠিয়েছেন কনফার্মেশনের জন্য। সেপটিক ট্যাঙ্ক বা সিউয়েজ পাইপ পরিষ্কার করতে গিয়ে টক্সিক গ্যাস পয়জনিংয়ে মারা যাওয়া আমাদের দেশে আনকমন নয়। সিউয়েজ গ্যাসের নব্বই ভাগই হাইড্রোজেন সালফাইড। ভবেশ বাউরি সেভাবেই মারা গেছে। অর্থাৎ এই ঘটনায় কোনো রহস্য নেই, যা আছে তা নেহাতই বেআইনিভাবে লোক লাগিয়ে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের ঔদ্ধত্য। যাকে বলে সেসপুল ক্লিনিং সার্ভিস। বেসরকারি ভাবে তো বটেই, কর্পোরেশন থেকেও বেশ ভালো টাকা চার্জ করা হয় বলে, আর সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার গাড়ির সংখ্যা কম বলে কলকাতা শহরেরও অনেক জায়গায় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং করেই কাজ চালানো হয়। আর গ্রামাঞ্চলে বোধহয় এটাই স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস।
ল্যাবের দরজা বন্ধ করে ডোম বেরিয়ে গেল। এখন লাঞ্চ টাইম। হাসপাতালে বাইরের হাঁক-ডাক বেড়ে গেছে। কেসের কাঁটাও একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেছে। পুলিশ কাস্টডিতে টর্চারে মৃত্যুর তদন্তের তো প্রশ্নই নেই, বরং কার বাড়িতে মেথরগিরি করতে গিয়ে ভবেশ বাউরি প্রাণ খুইয়েছে, আর কে সেই শুয়োরের বাচ্চা যে নিজের গা বাঁচানোর জন্য ওর বডি জঙ্গলে ডাম্প করে গেছে, তদন্ত এখন সেদিকেই এগোবে। ভবেশের মোবাইল লোকেশন চলে আসলে, সেটা বের করা খুব একটা চাপের হবে বলে মনে হয় না। এস.এইচ.ও শ্যামল ব্যানার্জি বলবেন ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। অসীম মনে মনে ভাববে, এত সরেজমিন তদন্তর ফলশ্রুতি একটি পানসে মৃত্যু, যাতে কোনো থ্রিল নেই। ডোম কেন কেসটাকে রদ্দি বলল সেটাও বুঝতে পারলাম। আগে হয়তো এ ধরণের কেস এসেছে মর্গে।
গাড়িটার কাছে গিয়ে দেখলাম বিধু গাড়ির সিটে নেই। ওকে ফোন করার জন্য ফোনটা বার করতেই হোয়াটস অ্যাপে শ্যামল ব্যানার্জির মেসেজটা ঢুকল, “পি.এম রিপোর্ট তো সব ক্লিয়ার? উমানাথনকে ফোন করে জেনে নিয়েছি সব। তুমি কি ওটা ম্যাজিস্ট্রেটকে জমা দিলে?”
তেতো মুখে গাড়িতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে থেমে গেলাম। কী আশ্চর্য! এটা তো মনে পড়েনি আগে? বুক থেকে একটা অস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবলাম, তাহলে, দুইয়ে দুইয়ে চার নয়। অন্তত এক্ষেত্রে নয়!
***
“ভাবরা ভাজা খাবেন?” বিধু জিজ্ঞাসা করল।
“সেটা কী জিনিস?”
“চলুন না। খাওয়াচ্ছি।” বলে গাড়িটাকে রাস্তার বাঁদিকে দাঁড় করিয়ে দিল বিধু। টিনের চাল দেওয়া একটা ছোট্ট দোকান। তাতে মিষ্টি, কচুরি, ঝাল তরকারি সব বিক্রি হচ্ছে। আর কলকাতায় যেমন ভিয়েন বসে জিলিপি ভাজে, ঠিক তেমনই ছাঁকা তেলে ভাবরা ভাজা হচ্ছে। বেসনের সঙ্গে অল্প সোডা, নুন, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজকুচি মিশিয়ে হাত দিয়ে ফেটিয়ে, জিলিপির আকারেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তেলে। সোনালি কলবরে ইঁটে লাল রঙ ধরলেই হাতায় করে ছেঁকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এক একেক বারের লপ্তে সাত-আটটা করে। দেখে মনে পড়ে গেল যে সত্যিই খিদে পেয়েছে। সবুজ রঙের ঝাল একটা চাটনির সঙ্গে গোটা আটপিস উড়ে গেল নিমেষে
“স্যারের সঙ্গে দেখা হল?” বিধু জিজ্ঞাসা করল।
“নাহ! উনি ছিলেন না। কেন বল তো?” আমি ভাবরায় কামড় দিতে দিতে বললাম।
বিধু সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিল না। বলল, “আপনাকে এক-একদিন এক-একটা ইস্পেশাল খাবার খাওয়াবো। আলুপকোড়ি আর গুলগুল্লা তো অবশ্যই।”
“গুলগুল্লাটা কী জিনিস? রসগোল্লার ছোটভাই?” আমি হাসতে হাসতে বললাম।
“মিষ্টি। ছোট মার্বেলের মত দেখতে। খাবেন? আছে এখানে।” বিধু টেবিল ছেড়ে ওঠার উপক্রম করল।
“আরে বস বস। আমি তেলেভাজা খেতে ভালোবাসি। মিষ্টি নয়।”
“সে তো আপনাকে দেখেই বোঝা যায়।” বিধু দাঁত বার করে বলল। “আমি ভালো চোরপুলিশ খেলি, আমি তেলেভাজা খেতে ভালোবাসি, আর কী কী বোঝা যায় রে আমাকে দেখে?”
“এই যে আপনি বেশিদিন এসব থানায়-টানায় থাকবেন না।”
“তো যাব কোথায়?” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম।
বিধু উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। অসীম ফোন করেছে। ফোনটা তুলতেই ভারি গলায় ও বলে উঠল, “ভবেশ বাউরির ফোনটা দুপুর দুটোর পর সুইচড অফ হয়ে গিয়েছিল। ওটা এখনও সুইচড অফ। লাস্ট টাওয়ার লোকেশন বাঘমুণ্ডি পঞ্চায়েত।”
“ওহ! এদিকে পি.এম রিপোর্টের কথা শুনেছ তো?”
“শুনলাম।” অসীমের গলাটা একইরকম আচ্ছন্ন আর ভারি লাগছিল।
“তোমার কী মনে হচ্ছে? আমার কিন্তু কিছু ব্যাপারে খটকা আছে।” আমি পার্স থেকে টাকা বার করতে করতে বললাম।
“ঠিক বুঝছি না। কিন্তু খটকা থাকলেও স্যার যে এটার ব্যাপারে আর মাথা ঘামাবেন না সেটা বোধহয় আপনি বুঝেছেন।”
“হুঁ। কিন্তু আমার খটকাগুলো খুব জেনুইন খটকা। যদি কনভিন্স করানো যায় ডিটেইলে ইনভেস্টিগেট করার।”
“চেষ্টা করে দেখুন।” অসীম ক্লান্ত গলায় বলল।
“তোমার কি শরীর খারাপ?”
“হ্যাঁ। ওই আর কী! কাল রাতে বিশ্রীভাবে হাতটা কেটেছে। কোনো কিছু ধরতে পারছি না। আজ লিভ নিতে বাধ্য হলাম। জ্বর আর ব্যথা।”
অসীম ফোনটা কেটে দিল। কীভাবে হাত কাটল জিজ্ঞাসা করার অবকাশই পেলাম না। বিধু গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছিল।
“তখন উমানাথন স্যারের কথা কী বলছিলি?”
“এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম। স্যারের সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি।”
“তুই চিনিস?”
“চিনব না! স্যারই তো লেখাপড়ার খরচা দিয়েছিলেন। উচ্চমাধ্যমিকটা পড়তে পারলাম স্যারের জন্যই।”
“আচ্ছা!”
“স্যার এখানকার লোকজনের জন্য অনেক কিছু করেন ম্যাডাম। খুব ভালো লোক। কোনো পার্টি পলিটিক্স করেন না, সাতে পাঁচে থাকেন না। রোববার রোববার অন্য ডাক্তারদের পয়সা দিয়ে মেডিকেল ক্যাম্প করান।”
“হুম। আচ্ছা এই ভবেশ বাউরি লোকটাকে তুই চিনতিস বিধু?”
“নাহ ম্যাডাম। এমনি মুখ চেনা হতে পারে। কিন্তু কথাবার্তা হয়নি।”
“আর অসীমকে কতদিন ধরে চিনিস?”
“অসীমদা? ওকে তো ছোট্টবেলা থেকে চিনি ম্যাডাম। আমাদের গ্রামেই তো
বাড়ি ছিল। বাবা মা ভাই সব ওখানেই থাকে এখনও।”
“কোন গ্রাম? এখন অসীম ওখানে থাকে না?”
“না তো। অসীমদা তো এখন বাঘমুণ্ডিতেই থাকে। আগে বড়েরিয়ায় থাকত।”
“বাঘমুণ্ডিতে কোথায়? কোয়ার্টারে?”
“না না। আপনার মতনই ভাড়া থাকে। স্টেট ব্যাঙ্কের পিছন দিকের গলিটায়।”
আমার পুলিশ কোয়ার্টারে না থাকার পিছনে একাধিক কারণ ছিল। তবে প্রধান কারণ ছিল অন্যান্য পুলিশ কর্মচারীদের পরিবার পরিজন, লোক লৌকিকতা থেকে দূরে থাকা। ছোট থেকে একা থেকে থেকে এই বিশ্রী অভ্যেসটা আমার তৈরি হয়েছে। চাকরির সময় বাদে বাকি সময়টুকুতে লোকজন মোটেই ভালো লাগে না। টাকাপয়সার দিক থেকেও বিশেষ লাভ নেই। মাঝখান থেকে হাউজ রেন্ট মারা যায়। কিন্তু অসীমেরও একা থাকার কারণ কি সেটাই…ভাবতে ভাবতেই বিধু সে কথার উত্তর দিল।
“আসলে অসীমদার মাথা গরম। কারুর সঙ্গে মানাতে পারে না। এর আগে তো একবার মাথা গরম করে চাকরি প্রায় যায় যায়।”
“কীরকম?”
“সে তো অনেকদিন আগের কথা। পুরো ডিটেলটা আমি জানি না ঠিক। ওই ভাসা ভাসা শুনেছিলাম।” বিধু এড়িয়ে যেতে চাইছিল।
“না, মানে গণ্ডগোলটা কী নিয়ে হয়েছিল?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম।
“অসীমদা তখন ঝালদাতে পোস্টেড ছিল। ওইদিকটায় হাজারিবাগ থেকে কোটশিলা পেরিয়ে হাতি এসে ঢোকে মাঝে মাঝে। প্রচুর ফসল নষ্ট করেছিল সেবার। লোকে ক্ষতিপূরণের দাবিতে সারা দিন রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিল।”
“তারপর?”
বিধু স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “বন দপ্তরের অফিসারদের সঙ্গে প্রথমে ডি.এস.পি স্যার ওখানে যান। বোঝানোর পর গ্রামের লোকেরা ঘরে ফিরে যায়। তারপর কী হয়েছিল জানি না, সন্ধে বেলা আবার হাইওয়ে অবরোধ করে। তখন অসীমদা ওখানে ডিউটতে ছিল। অবরোধটা থেকে পুলিশকে লক্ষ করে ইঁট ছোড়া হয়। তারপর অসীমদা ফায়ারিং ওপেন করে। একজনের হাঁটুতে বুলেট ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।”
“বলিস কী! টিয়ার গ্যাস ট্যাস বা জলকামান এসব কিছু ছিল না?”
বিধু কান এঁটো করে হাসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে অসীমদা পুরো দাবাং স্টাইল ম্যাডাম। এদিকে রোগাপাতলা চেহারা, কিন্তু একদম শুকনো মরিচের মত ঝাঁঝ।”
“হুঁ। বুঝলাম। কিন্তু এই পদক্ষেপে সাসপেন্ড হয়ে যাওয়া উচিত।”
“সাসপেন্ড হয়নি। তবে এনকোয়ারি বসেছে। স্যালারি কম পাচ্ছে এখন। সে কেস তো এখনও চলছে। সল্ট লেকে স্টেট গভর্মেন্টের ট্রাইব্যুনালে। শুনেছি খুব হাতে পায়ে ধরেছে যাতে শাস্তিটা উঠিয়ে নেওয়া যায়।”
“কার হাতে পায়ে ধরেছে?”
“অত ডিটেল আমি জানি না ম্যাডাম। সব কানাঘুষোয় শুনেছি!” বিধু গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে বলল।
বিধুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ও জানে না, না বলতে চায় না সেটা বুঝতে পারলাম না। অসীমকে চরিত্র হিসেবে খুব আশাবাদী বা খোলামেলা মনে না হলেও, হঠকারি মনে হয়নি একবারও। তবে চাপা স্বভাবের ছেলে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
বিধু আবার গুনগুন করে গান শুরু করেছিল।
“প্রথম দেখায় বাসলি ভালো হাওড়া স্টেশনে, লুটুকটুক মনটা করে থাকব কেমনে…”
বিধুর মুড লুটুকপুটুক হয়ে যাওয়াতে আর কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না, যা বুঝলাম। এই ছেলেটাকেও আমি মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না।
***
“কেসটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা কিন্তু সহজ বলে মনে হয় না স্যার।” শ্যামল ব্যানার্জী কান চুলকাচ্ছিলেন। এটা এঁর ইউনিক একটা স্বভাব। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোকে চা কফি পান করে, ইনি কান খোঁচান। আজ হোলি বলে কপালে একটা বিরাট সবুজ রঙের টীকা লাগিয়ে এসেছেন।
“কেন কিসে তোমার অসহজ মনে হচ্ছে?” কান খুঁচিয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ব্যানার্জি স্যার জিজ্ঞাসা করলেন।
“দুটো খটকা। এক, সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজে একের বেশি লোক থাকে। তাহলে বাকিরা কোথায় গেল? তারা কি অসুস্থ হয়েছিল? দুই, ভবেশ বাউরির টাইম অফ ডেথ ভোর তিনটে থেকে তিনটে পঁয়তাল্লিশ। এই সময়টা কেন কেউ সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজে লাগবে?” আমি কাগজে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বললাম।
ব্যানার্জী ভুরু কুঁচকে বললেন, “ধুস! বেকার জল ঘোলা করো না তো। লোক নামিয়ে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করাটা বেআইনি, সেই জন্য রাতে লোক নামিয়ে কাজ হচ্ছিল।”
“কিন্তু স্যার…”
ব্যানার্জী স্যার হাত তুলে আমায় থামালেন। বললেন, “দেখ দর্শনা; কিছু মানুষের জীবন কীটপতঙ্গের মতো হয়। হাজারে হাজারে জন্মায়, আবার হাজারে হাজারে মরে। আর তারা মরলে পৃথিবীর বুকে একটা পাতাও তার স্থান থেকে নড়ে না। এসব বাউরিরা এই শ্রেণীর লোক। যাও যাও, মেলা কাজ পড়ে আছে।”
“অ্যাটলিস্ট ভবেশের বাড়ির লোককে ডেকে একটা জিজ্ঞাসাবাদ করা…মানে কে ওকে কাজে লাগিয়েছিল…” আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখলাম।
“দেখ দর্শনা, এই মুহূর্তে তোমাকে আমি অন্য কাজে অ্যালোকেট করব। এই কেসটা পেটি, এটা অসীম দেখে নিতে পারবে। ক্লিয়ার?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই স্যার। আমি জাস্ট আমার ডাউটগুলো আপনাকে বলছিলাম। মানে যেমন ধরুন, ভবেশ বাউরির মোবাইল ফোন। পঞ্চায়েত থেকে বেরোনোর পর পরই বন্ধ। কেন?”
স্যার একটা হাই তুলতে তুলতে বললেন, “চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে আমার কোনো ডাউট নেই। নেক্সট?”
“ভবেশের সঙ্গী সাথীরা? একজনের মৃত্যু হল, বাকিরা চুপ করে মেনে নিল? যে ওদের কাজে লাগিয়েছে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এল না কেন? একদম নিঃসাড়ে ভবেশের বডিটা জঙ্গলে ফেলে রেখে দিল খুনী?”
“খুনী! এটা জাস্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট। এরকম ঘটনা তো আনকমন নয়। এটায় ম্যাক্সিমাম 304 এর A লাগাতে পারো।”
“আমি এটা খুনের পর্যায়েই ফেলছি স্যার। আইন হয়তো বলবে কজিং ডেথ বাই নেগলিজেন্স লিডিং টু কালপেবল হোমিসাইড, কিন্তু জেনেশুনে যে লোক আরেকটা লোককে…” আমি পুরোটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।
“তুমি কি নিজেকে আইনের থেকে বড় ভাবছ নাকি!” স্যারের চোখমুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গিয়েছিল।
“না স্যার! কিন্তু বাকি সঙ্গীরা কোথায় গেল এই পয়েন্টটায় আমি কনভিন্স হচ্ছি না। এটা নিছকই সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কেস বলে আমার মনে হচ্ছে না।”
“হয়তো ও একাই কাজ করছিল?” স্যার বিরক্তিভাবটা কাটিয়ে বললেন।
“মিনিমাম দুজন থাকে স্যার। একজন নামে, অন্যজন ময়লা মাথায় নিয়ে গাড়িতে ডাম্প করে। কোমরে দড়ি বেঁধে নামলে দড়ির আরেক প্রান্ত ধরে থাকে। সেই দ্বিতীয়জন কোথায়?” আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম।
ব্যানার্জী স্যার সামনে ঝুঁকে এসে টেবিলের উপর থেকে জলের গ্লাস তুলে ঢকঢক করে জল খেলেন। তারপর বললেন, “তাকে এক বোতল তাড়ি ধরিয়ে দিয়েছে, সে সেটা টেনে সব ভুলে গেছে। এমনিতেই হোলির সময়। আর এসব শ্রেণীর লোকজন এমনই হয়। তুমি নতুন এখানে, দুদিন থাকো। সব বুঝে যাবে। এসব আদিবাসিদের তোমার আমার মত হাই মরাল গ্রাউন্ড আছে নাকি! ছোট জাত সব।”
আমার গা রি-রি করে জ্বলছিল। শ্যামল ব্যানার্জি গলাটা নামিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, “থানাতেও তো তাই। এই অসীম, বিধু, ওদিকে কনস্টেবল দুটো, সব ছোট জাত। বুঝলে কিনা? সব গভমেন্টের দয়ায় জাতে উঠেছে।”
আমার মাথাটা দপদপ করছিল। রাগ চেপে বললাম, “ভবেশ যেখান থেকে নিখোঁজ হয়েছে, তার কাছেই দসকা গ্রাম। আমার ধারণা ভবেশ ওখানেই কারুর বাড়িতে কাজ করছিল। একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে।”
“হ্যাঁ…হ্যাঁ…সেসব অসীম…”
স্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা মহিলা কণ্ঠস্বর অফিসরুমের দরজার সামনে থেকে বলে উঠল, “আসতে পারি?” আমি দরজার দিক থেকে পিছন ফিরে বসেছিলাম। দেখলাম, ভোজবাজির মত ব্যানার্জী স্যারের মুড পাল্টে গেল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আরে এসো…মানে আসুন, আসুন।
কী ব্যাপার হঠাৎ থানায়?”
পিছন ফিরে যাকে দেখলাম তার জন্য একটাই বাক্য প্রযুক্ত হয়,
“সে যেন মদিরার সমুদ্রে সদ্য স্নান করিয়া উঠিল;
মাদকতা তাহার সর্বাঙ্গ বাহিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে।”
মেয়েটি ব্যস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকল। বেশ লম্বা, একহারা চেহারায় গতি, বুদ্ধি আর যৌন আবেদন মাখামাখি হয়ে অসামান্য রূপ নিয়েছে। ছোট কপাল, কুঁচকানো চুলের মধ্য দিয়ে পাতলা সিঁথি, সিঁথিতে চিকনসুতোর মত সিঁদুর, ধনুকের ছিলার মত ভুরু, আবেদনময় ডাগর দুটো চোখ, চাপা নাক, সামান্য স্ফীত ঠোঁট। পাড়াগাঁয়ের শ্যামলাসবুজ দীঘির মত টলটলে যৌবনের দীপ্তি ফুটে বেরোচ্ছে সমস্ত শরীর থেকে। ছকভাঙা সৌন্দর্য। বেশ কিছু সেকেন্ড এই নারীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজের দিকে চোখ পড়ল। মেয়েটি কোনো কারণে ডিসটার্বড। আঙুলে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
কপালে, ঘাড়ে ঘাম জমেছে।
“ইয়ে দর্শনা, একটু কোল্ড ড্রিংকস-ড্রিংকসের ব্যবস্থা করো।” শ্যামল ব্যানার্জি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“তার দরকার নেই। আমার আসলে…আসলে…” মেয়েটি নার্ভাসভাবে বলল।
“বলো…বলুন না বৌদি।” ব্যানার্জী স্যার প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বললেন। “মানে…একটা সমস্যায় পড়ে…দোকানে মনে হয় ডাকাতি হয়েছে…আর ওঁকে…ওঁকে ফোনে পাচ্ছি না।
“কাকে ফোনে পাচ্ছেন না? নিশীথদাকে!”
“হ্যাঁ। আমাকে গতকাল ফোনে বললেন, দোকানে কিসব হিসাব পত্র বুঝে নেওয়া বাকি। হেমন্ত ছুটি নেবে। রাতে দোকানেই থাকবেন। দুপুরে হেমন্ত আসলে বাড়ি আসবেন। আমি ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসেছি কিনা জিজ্ঞাসা করছিলেন।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান। হেমন্ত কে?”
“দোকানের কর্মচারী।”
“আচ্ছা। ডুপ্লিকেট চাবি কেন? আপনি বাড়ি ছিলেন না?”
“না বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য। দোলযাত্রার পুজো ছিল। আজ দুপুরে ফিরেছি।”
“দোকানের খবরটা কীভাবে পেলেন?”
“সকালে ওকে ফোনে না পেয়ে চিন্তা হচ্ছিল। আমি তাই ফেরার সময় সোজা দোকানে যাই। তখন হেমন্ত সবে এসে পৌঁছেছে। দুজনে মিলে ঢুকে দেখি … “ মেয়েটির গলায় শঙ্কার ছাপ পড়ল।
“কী দেখলেন?” এস. এইচ. ও সামনের দিকে ঝুঁকে বসলেন।
“দোকানে…” মেয়েটা কথা শেষ করতে পারল না। ঠোঁট কামড়ে একটা উদগত আবেগ থামালো।
শ্যামল ব্যানার্জি ব্যস্ত হয়ে বললেন, “কী দেখলেন দোকানে? খুলে বলুন।”
মেয়েটির রুক্ষ চুল হাওয়ায় উড়ছিল। কয়েকটা গুছি ঘর্মাক্ত কপালে লেপটে ছিল। ইতস্ততঃ করে সে বলতে লাগল, “একটা কাচের আলমারিতে জিনিস সাজানো থাকত। সেটা দেখলাম ভাঙা। কাচ চারিদিকে ছিটিয়ে রয়েছে। শোকেসের ভিতরে…মাটিতে…আর…আর দেওয়ালে, দরজার চৌকাঠের কাছে অনেকটা রক্ত…আর উনি…ওঁর খাওয়ার থালাটা খোলা…টেবিলের উপর পড়ে আছে। খাবার যে কে সেই পড়ে আছে।” মেয়েটি আর সামলাতে পারল না। তার দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে এল।
“আহা! আহা! কাঁদবেন না। নিশীথদার কিছু হবে না। আমি দেখছি।”
“কিন্তু ফোনটা…! ওঁর ফোন এতক্ষণ বন্ধ থাকে না। আর দোকানে অত রক্ত!” মেয়েটি ত্রাস-বিস্ফারিত চোখে এস.এইচ.ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।
শ্যামল ব্যানার্জি নিজের ফোনটা তুলে ফোন করলেন। কানে লাগিয়ে বললেন, “এখনও সুইচড অফ। আচ্ছা, আর কোনো নম্বর আছে?”
“না। এই একটাই আমি জানি।” মেয়েটি ইতস্তত করে বলল।
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি। দোকানে কিরকম টাকাপয়সা ছিল জানেন?”
মেয়েটি ঠোঁট টিপে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, “নাহ! তবে দোলের সময় ভালো বিক্রি হয় জানি।”
“ক্যাশবাক্সটা দেখেছেন?” আমি এতক্ষণ পর মুখ খুললাম।
মেয়েটি ঘুরে আমার দিকে তাকাল। সামান্য ভাঙা গলার আওয়াজ ওর। চোখ না সরিয়েই বলল, “নাহ! খেয়াল হয়নি।”
“আপনি আজ দুপুরে বাপের বাড়ি থেকে সোজা দোকানে গেছেন? কীভাবে পৌঁছালেন?”
“বাসে এসেছি।”
“আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে শেষ কখন কথা হয়েছিল?”
“বললাম তো, গতকাল রাতে।” মেয়েটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
“আজ বাপের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফোন করেননি?”
আমার প্রশ্নে মেয়েটি সামান্য বিরক্ত হচ্ছিল। একটু ক্লান্ত স্বরে বলল, “হ্যাঁ করেছিলাম অনেকবার। তখনও ফোন বন্ধ ছিল। চিন্তা হচ্ছিল শরীর খারাপ কিনা…”
“আজ সকালে নিশীথবাবুর কটার সময় বাড়ি ফেরার কথা ছিল?” শ্যামল ব্যানার্জি জিজ্ঞাসা করলেন।
“ঐ দেড়টা নাগাদই। হেমন্ত ফিরলে।” মেয়েটার মুখে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ঘনিয়ে এল।
“দোকানে জিনিসপত্র বা ক্যাশ কিছু খোয়া গেছে নাকি খেয়াল করেছেন?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ। ক্যাশবাক্সে ক্যাশ থাকত। দোকানে গিয়ে দেখি খোলা পড়ে আছে।”
“কত ক্যাশ ছিল?”
“তিরিশ হাজার।”
“কীভাবে জানলেন? আপনি যে আগে বললেন ক্যাশবাক্স দেখেননি?”
মেয়েটির মুখ সাদা হয়ে গেল। ওর উত্তর দেওয়ার আগেই শ্যামল ব্যানার্জি ওকে থামতে বললেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আহ! দর্শনা! তুমি একটু বাইরে যাও। আমি কথা বলে নিচ্ছি বৌদির সঙ্গে। এই কেসটা আমি পার্সোনালি দেখব।
স্যালুট ঠুকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনলাম, “হ্যাঁ পুরো ব্যাপারটা আমাকে ভালো করে গুছিয়ে বলুন তো।” সেমি ট্রান্সপারেন্ট দরজার বাইরে থেকে শ্যামল ব্যানার্জির স্ফীত অবয়বটাকে চেয়ার ছেড়ে উঠে মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। সম্ভবতঃ আরও খুঁটিয়ে তদন্ত করার জন্যই!
***
“নিশীথ মাহাতো এই অঞ্চলের সবথেকে প্রভাবশালীদের একজন। মহান সিংয়ের এনকাউন্টারের ব্যাপারটা জানেন তো? যেটা কোবরা আর আমাদের পুলিশফোর্সের জয়েন্ট অ্যাকশন ছিল?”
এ.এস.আই দিব্যজ্যোতি মণ্ডল চা খেতে খেতে গলা নীচু করে বলল। আমি একটু চমকে ওর দিকে তাকালাম। আজকে সকাল থেকে মাত্র ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে মহান সিংয়ের এনকাউন্টারের কথা দ্বিতীয়বার উঠে এল। দিব্যজ্যোতি সুডুক করে চা টেনে বলল, “ক্যান্টিনে চায়ের কোয়ালিটি দিনদিন খারাপ হচ্ছে।” দিব্যজ্যোতি বিল মেটাতে মেটাতে বলল।
“নিশীথ মাহাতোর ব্যাপারটা কী বলছিলে?”
“হ্যাঁ তো যেটা বলছিলাম, মহান সিংকে ধরিয়ে দেওয়ার পিছনে ইনসাইডাররা ছিল সেটা জানেন তো?”
“হ্যাঁ। পেপারে পড়েছি।”
“তখন মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে একের পর এক মাওয়িস্ট কমান্ডার আত্মসমপর্ণ করছে। স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের হাতে ধরাও পড়ছে অনেকে। নিশীথ মাহাতো প্রথমে এরিয়া কমান্ডার ছিল। তারপর লালগড় মুভমেন্টের সময় সেকেন্ড ইন কমান্ড। শুনেছি মহান সিংয়ের সঙ্গে স্টেট সেক্রেটারি কে হবে সেই নিয়ে নিশীথ মাহাতোর একটা দূরত্ব তৈরী হয়। নবীন বলে ঝাড়খণ্ডের একটা ছেলেকে মহান সিং স্টেট সেক্রেটারি আর পিপল লিবারেশন গেরিলা আর্মির পশ্চিমবঙ্গ শাখার চিফ কমান্ডেন্ট করে দেওয়ায় তীব্র বাদানুবাদ হয়। এবং এর পরপরই নিশীথ মাহাতো ধীরে ধীরে নিজেকে গেরিলা অ্যাক্টিভিটি থেকে সরিয়ে আনেন।”
“ওয়েট এ মিনিট। তুমি মিন করছ, মহান সিংকে ধরিয়ে দেওয়ার পিছনে নিশীথ মাহাতোর হাত ছিল?” আমি চায়ের কাপ নামিয়ে ওর দিকে তাকালাম।
দিব্যজ্যোতি কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসল। বলল, “এসবই অফ দ্য রেকর্ড। কোনো প্রমাণ নেই কিন্তু। শুনেছিলাম কুড়ি লাখ টাকা নগদ পুরস্কার পেয়েছিলেন।”
“মাই গড়! এখন কী করেন?”
“মেইনলি সোশাল ওয়ার্ক। রঘুনাথপুরে, বলরামপুরে ঝালদায়, বাঘমুণ্ডিতে আদিবাসী কল্যাণের কিছু ইউনিট আছে। বিপণন কেন্দ্র আছে। ওঁর এন.জি.ও পলাশপ্রিয়া লোকালি বিভিন্ন ক্রাফ্ট বানায় আর বিক্রি করে। এখানে যে বিপণন কেন্দ্রটি আছে, সেটায় একই ছাদের তলায় সারা জেলার হস্তশিল্প বিক্রি হয়। ট্যুরিস্ট সিজনে ভালো রোজগার হয়। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য পান। তার চেয়েও বড় কথা, উনি জেলার জনমোর্চা সভাপতির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মেন্টর বলা যেতে পারে।”
“সক্রিয় রাজনীতি করেন না?”
“ভীষণভাবে করেন। মেম্বারশিপ আছে। মিটিং মিছিলে যান। এবছর ভোটে দাঁড়াবেন ঠিক হয়েছিল। কিন্তু এবারের সমীকরণটা একটু আলাদা। জনহিত পার্টি ওঁত পেতে আছে। মাওবাদী অতীতের জন্য এবারের টিকিটটা পাননি বোধহয়। পরেরবারেরটা তো সিওর।”
“হুঁ।”
“সেই লোকের দোকানে হামলা আর লোকটাকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে বুঝতে পারছেন তো? স্যার ব্যাপারটা লাইটলি নিলে কেস খাবেন। কী বললেন
আপনাকে? সঙ্গে থাকতে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, “নাহ! বললেন তো নিজেই ম্যানেজ করবেন।” দিব্যজ্যোতি মিচকি হেসে বলল, “দেখুন, মোতিরা পোয়াম তুলে নিয়ে গেল কিনা! মহান সিংয়ের এনকাউন্টারের তথাকথিত বদলা। খবরের ভাষায় যাকে বলে মাওয়িস্টস ব্যাক উইথ এ ব্যাং।”
আমি হেসে ঘাড় নাড়ালাম। মনে মনে ভাবলাম, এত তাড়াতাড়ি উপসংহারে পৌঁছানোর মত কিছু ঘটেনি। নিশীথ মাহাতো কোথায় গেলেন সেটা অবশ্য বেশ সন্দেহজনক। তার থেকেও বেশি বিভ্রান্তিকর মেয়েটার বয়ান। দোকানে হামলা হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে। কিন্তু ক্যাশবাক্সে এক্সাক্ট কত টাকা ছিল সেটা তো মালিক বাদে কারুর সেভাবে জানার কথা নয়!
“নিশীথ মাহাতোর বয়স কত?” জিজ্ঞাসা করলাম।
“কত হবে? পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ।”
“ওঁর ওয়াইফ তাহলে ওঁর থেকে অনেক ছোট।”
“কে? সোনালি মাহাতো? অনেক কম বয়স, এখনও তিরিশ পেরোয়নি। তবে এ তো আপনাদের কলকাতা নয়, এখানে স্বামী স্ত্রীর বয়সের ওরকম গ্যাপ থাকা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।” দিব্যজ্যোতি হেসে বলল।
“মানে গ্রামে জেনারেশন গ্যাপটা ম্যাটার করে না বলছ? ‘না উমরো কি সীমা হো, না জন্মকা হো বন্ধন’ টাইপের প্রেম হয়?”
দিব্যজ্যোতি আমার খোঁচাটা বুঝতে পারল না। বলল, “ধুর! সোনালি মাহাতোর সঙ্গে নিশীথ মাহাতো! কোনো ম্যাচ নাকি! অমন সেক্সি মেয়ে চাইলে যে কোনো লোকের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে।”
“তাহলে নিশীথ মাহাতোর মাথাটাকেই বেছে নিল কেন? কোনো কারণ আছে? নাকি নিশীথবাবু নিজেই মাথা এগিয়ে দিয়েছিলেন?”
দিব্যজ্যোতি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “বলতে পারব না। চারবছর আগে বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে নেমতন্ন খেয়েছি। হেবি খাইয়েছিল।”
“বাচ্চাকাচ্চা আছে?” আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“নাহ।”
দিব্যজ্যোতির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ক্যান্টিনে বিধু ঢুকল। কপালে ভর্তি আবির। হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেট থেকে আলুপকোড়ির সুবাস আসছিল। আমার হাতে দিয়েই একটা স্যালুট ঠুকে দাঁত বার করে হাসল। বলল, “দুটো খবর আছে।”
“বলে ফেল।”
“এক— ভবেশ বাউরির বাড়ির লোক মর্গ থেকে বডি নিয়ে গেছে। দুই— বিকেলে ভেবেছিলাম আপনাকে বামনি ফলস দেখাতে নিয়ে যাব। সেটা আর হবে না। আমাকে এখনই শ্যামল স্যারের সাথে চড়িদার দিকে যেতে হবে।”
“চড়িদায় কী?” জিজ্ঞাসা করলাম।
আমার কথার উত্তরটা দিব্যজ্যোতি দিল। “নিশীথ মাহাতোর দোকান।”
“আচ্ছা। আর ওঁর বাড়ি কোথায়?” চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম।
“দসকাতে।”
“কোথায়!” ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
“দসকায়…নিশীথদার বাড়ি।”
“ওহ!”
