জেলনামা – ৪
জেলে হোলি পালনের আয়োজন কিছু দিন ধরেই চলছে। আর্থার রোড জেলের ম্যানুয়াল অনুযায়ী মোট আঠারোটা উৎসব পালন করার জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আসলে পালিত হয় মাত্র সাতটাই। দুটি ইদ, গণপতি উৎসব, দশেরা, দিওয়ালি, ক্রিস্টমাস এবং হোলি। ইদের সময় মুসলিম কয়েদিরা, অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে ইফতার ভাগ করে নেয়। কখনও কখনও এক প্লেট ভর্তি ফল এবং মিষ্টি। সেসময় বেশিরভাগ কয়েদি জেলের রাতের খাবার বয়কট করে। নবরাত্রির সময় নিহাল সিংয়ের ক্যান্টিনে শ্রীখণ্ড বিক্রি হয়। গভীর রাত অবধি আরতি চলে। লোহার খাঁচায় বসে, কয়েদি সেসব খালি তার ইন্দ্রিয়জুড়ে অনুভব করে। সন্ধের পর যতই উৎসব থাকুক না কেন, তাদের লক-আপে ঢুকতেই হয়। সরাসরি উপস্থিত হয়ে সেই লোকাচারের অংশ হওয়া তাদের ভাগ্যে নেই। একমাত্র হোলির সময় একটু ছাড় থাকে।
এই সময়টা জেলে অন্যান্য কাজের চাপ কম থাকে। দুরকম আবির তৈরিতে হাত লাগায় কয়েদিরা; কেমিকাল আবির আর ফুলের পাপড়ি থেকে তৈরি ভেষজ আবির। জেলের পাঁচটা ইউনিটে এই দুই ধরণের আবির বা গুলাল তৈরি করে তাকে প্যাকেটজাত করার কাজ চালায় হাজার হাজার কয়েদি। মার্চ মাসে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজও সেরে ফেলা হয়। জেলের সম্পূর্ণ বন্দীসংখ্যা আরেকবার গুণে ফেলে সারাবছরের সম্ভাব্য খরচের একটা হিসাব করে ফেলা হয়। জেলের ঘানি টানতে টানতে পুরোনো কয়েদিরা কত রোজগার করল তার একটা হিসেব দেওয়া হয়। আন্ডারট্রায়ালদের জন্য দেওয়া হয় নতুন নাম্বারট্যাগ কিন্তু হওলাদি বা কয়েদি নতুন হোক বা পুরোনো, হোলির দিন খাওয়াদাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। নিহাল সিংয়ের ক্যান্টিন থেকে দুপুর থেকে ওর জন্য দু তিনবার ডাক এসেছিল। ঘি দিয়ে তৈরি সুজির হালুয়া আর লুচির জন্য। দোনামনা করেও গণেশ গিয়ে সেসব খেয়ে এসেছে। ঝামেলা শুরু হয়েছে সেলে ঢোকার পর থেকেই।
বেশ কিছু বছর হল, জেলে আমিষ খাবারের উপর, মহারাষ্ট্র সরকার সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কাঠবিড়ালি, ছোটখাটো পাখি, ধেড়ে ইঁদুর ধরা তাই জেলের মধ্যে একটা সিরিয়াস পেশা; পোকামাকড়, এমনকি পঙ্গপালের দল ধরে, রোদে শুকিয়ে, রোস্ট করে, রসিয়ে রসিয়ে খাওয়া হয়। পাখি ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয় যেখানে সেখানে। উড়ন্ত পাখি গুলতি মেরে নামিয়ে আনা হয়। ড্রেন পাইপের মধ্যে ফাঁদ পেতে ধেড়ে ইঁদুর ধরা হয়। কিন্তু সবথেকে জনপ্রিয় পন্থা একদম আদিম। হাতে একটা শিক নিয়ে তক্কে তক্কে থাকে শিকারির দল। একটাও কাঠবিড়ালি বা ইঁদুর দেখলে, কারারক্ষীদের অন্তরালে, তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারি বাহিনী। একটা মোটাসোটা ইঁদুর ধরে রোস্ট করে খেলে মোটামুটি পাঁচ জনের দলের কাজ চলে যায়। ইঁদুরের মাংস সেরকম ঝালমসলা দিয়ে রাঁধলে অবিকল শুয়োরের মাংসের মতনই লাগে। ছাল ছাড়িয়ে, নুন মাখিয়ে রেখে জেলেরই কোন এক কোণে চুপচাপ রেঁধে ফেলা হয়। সাধারণতঃ ল্যাট্রিনের পেছনদিকের কম্পাউন্ডটাতেই এসব কাজকারবার চলে।
হোলি উপলক্ষ্যে জেলে বিরাট মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। লাল নীল সাদা নানা রঙের কাপড়ে বাঁধা মঞ্চ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা আসবে, কয়েদিরা নিজেদের মধ্যে আবির খেলবে। অনুষ্ঠান শেষে, মদ আর মাংসের ফোয়ারা ছুটবে। কর্তাদের জন্য যা বৈধ, কয়েদিদের তা হাসিল করতে গেলে অবৈধ পথেই হাঁটতে হবে। আজ তাই শিকারের দিন। নিহাল বলে গেছে, যারা ল্যাট্রিন পরিষ্কার করে, যাদের জেলের ভাষায় ডাণ্ডা-কামান বলে, তারাই মাংসের ব্যবস্থা করবে। নিহাল সিং আজ বিশেষ যত্ন নিয়ে বাকি কয়েদিদের নন-ভেজ খাওয়াবে। জেলের হোলির প্রোগ্রামে নিহালকে স্টেজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে— বাইরে থেকে যেসব গণ্যমান্য অতিথিরা আসবেন তাদের খাদ্য পানীয় সরবরাহের দায়িত্ব। কাজেই গণেশের ঘাড়ে সে এদিকের রান্নাবান্নার তদারকির দায়িত্ব দিয়ে গেছে। গণেশের একেবারেই মত ছিল না। এসব কাজ সে কোনোদিন করেনি। নিহাল সিংয়ের অনুরোধে উপরোধে রাজি হয়েছে।
বাইরে মাইকের তর্জনগর্জন শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। মঞ্চে বাইরের আর্টিস্ট পারফর্ম করছে। লতাকণ্ঠীরা আর আশাকণ্ঠীরা আসর মাতাচ্ছেন। নাচের পারফরম্যান্সে চটকদার গানের সঙ্গে ঘন ঘন সিটি পড়ছে। কয়েদিদের সঙ্গে কোমর দুলিয়েছেন রক্ষীরাও। আজ ‘বন্দি’ পড়বে একটু দেরিতে।
ডি.আই.জি প্রিজন কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে যাবেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রেখেছেন। হিরণ্যকশিপু আর প্রহ্লাদের গল্প শুনিয়ে, হোলিকাসুর বধের বর্ণনা দিয়ে, অন্যায়ের উপর ন্যায়ের জয় হোক বলে শেষ করেছেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলার ফাঁকে ফাঁকেই নিহাল সিং অতিথিদের খাদ্য পানীয় পরিবেশন করা শুরু করেছে।
রান্নাঘরে গণেশ ব্যস্ত ছিল। রান্নাবান্নার কাজে সে সড়গড় না হলেও, মনটা অনুদ্বিগ্ন ছিল বলে কাজগুলো করতে মন্দ লাগছিল না। আজ সকালে, উকিলের সঙ্গে একপ্রস্থ কথা হয়েছে। এমনিতেই আজ শুক্রবার, মুলাকাতের দিন জেলে। সকাল এগারোটা নাগাদ, এক কনস্টেবল এসে গণেশের নাম ডাকতেই সে চমকে উঠেছিল। তার সঙ্গে কার কিসের প্রয়োজন! কনস্টেবলের পিছু পিছু এগিয়েছিল সে। মনে হাজার শঙ্কা। জেলে যে বড় হলঘরটায় মুলাকাত হয়, সেই ঘরের মাঝবরাবর বিশালাকার নেটের জানালা লাগানো। নেটের জালি এত ঘন, যে তার ওপাশ থেকে কাউকে দেখা যায় না। শুধু মুখের আদলটুকু বোঝা যায়। ঐ একটাই ঘরে অসংখ্য কয়েদি তাদের পরিবার বা উকিলের সঙ্গে দেখা করে। এত লোকের মিলিত কণ্ঠস্বরে কারুর কথাই স্পষ্ট শোনা যায় না। গণেশ হাঁচড় পাঁচড় করে এগিয়ে নেটের জানালার কাছে পৌঁছালেও ওপারে কে আছে তা বুঝতে পারছিল না। একটু পরে পিঠে একটা হাত পড়াতে চমকে উঠেছিল গণেশ। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গণেশের ঘাড়ের কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল অন্য আরেক কনস্টেবল। যে ঘরটায় নিয়ে এসেছিল, সেটা যে জেলেরই একটা ছোট অফিসঘর, তা ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল গণেশ
সামনের রাখা টেবিলটার উপর ফাইল সাজিয়ে যিনি বসেছিলেন, তার পোশাক তার পেশার কথা জানিয়ে দিচ্ছিল। গণেশ সামনের চেয়ারে গিয়ে বসতে, লোকটা নিজের কার্ড বার করে পরিচয় দিয়েছিল। বিশেষ সেটিং না থাকলে উকিলের সঙ্গে এই ঘরে এমন প্রাইভেটলি লম্বা কথা বলা সম্ভব নয়। কাজেই পরিচয় পাওয়ার আগেই, গণেশ জানত যে কোনো হেঁজিপেঁজি উকিলের সঙ্গে সে কথা বলছে না।
উকিলের নাম প্রশান্ত মাতুঙ্গে। কলকাতা ও মুম্বাইয়ের সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট মত আলোচনা হওয়ার পর মাতুঙ্গে গণেশকে নিরাশ করেনি। ইমরান আহমেদ যে গণেশের মত নিজের লোকের মাথার উপর থেকে হাত তুলে নেবে না, অন্তত সেই ভরসাটা গনেশ পেয়েছে। সুমন্তকে খুঁজে বার করতে পুলিশ সেরকম আগ্রহী না হলেও, আহমেদ যে সুমন্তকে খুঁজছে, সে কথাও মাতুঙ্গে গণেশকে জানিয়েছে। আহমেদের কোটি কোটি টাকার অস্ত্র নিয়ে সুমন্ত ফেরার হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা, এই লাইনে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার প্রবণতাকে প্রথম থেকেই ঘেন্নার চোখে দেখা হয়। আহমেদের অস্ত্র লোপাট করে সুমন্ত যে ভুলটা করেছে, তার উপযুক্ত পরিণতিটাও তাকে ভোগ করতে হবে।
মাতুঙ্গে এও জানিয়েছে যে জামিন পাওয়ার জন্য গণেশকে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে সব মিলিয়ে গোটা পঁচিশেক কেস রেজিস্টার করা হয়েছে গণেশ হুঁইয়ের নামে। তার মধ্যে ছোটগুলোয় বেইল পাওয়া গেলেও বড়গুলোয় ভোগান্তি আছে বিস্তর। যখন যেরকম কেস উঠবে সেরকম দৌড়াতে হবে। তবে মহারাষ্ট্র পুলিশ গণেশ এবং আরও বেশ কয়েকজন হ্যান্ডলারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি এনেছে, তার একটার শুনানি খুব শিগগিরি হবে আশা করা যায়। যদি না ডেট পিছায়, তবে পনের দিনের ভেতরেই। আর একবার হিয়ারিং হলে বেইল মুভ করতে সুবিধা হবে। শেষ পর্যন্ত আশার একটা আলো দেখিয়ে মাতুঙ্গে বিদায় নিয়েছে। লকাপে ঢুকতে ঢুকতেই মনের মেঘ অনেকটা কেটে গিয়েছিল গণেশের। তাই নিহালের কাজে হাত লাগাতে পেরেছিল।
হামানদিস্তেতে অনেকক্ষণ ধরে মসলা পিষছিল সে। দুপুরের কথা মনে করতে ওর মনে হল, ও যে নতুন ওয়ার্ডে শিফ্ট হয়েছে এ কথা মাতুঙ্গেকে জানানো হয়নি। উকিলের ব্যবস্থা করার মত, এই রাজকীয় ব্যবস্থাটাও নিশ্চয়ই আহমেদই করেছে। মাতুঙ্গের মাধ্যমে একটা সালাম তো পাঠানোই যেত। ভুল হয়ে গেল বড়! যাই হোক, পরের বার এই ভুলটা আর করা যাবে না। গণেশ হাতের কাজ থামিয়ে চারিদিকে একবার দেখে নিল। এতক্ষণে আমিষ রাঁধার মসলাপাতি সব রেডি হয়েছে। রক্ষীদের নজর এদিকে পড়ার আগেই কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু যা রাঁধা হবে তার প্রধান উপকরণই এসে পৌঁছায়নি। অথচ বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে চলেছে। গণেশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল।
কিচেনের দরজাটায় ঢং করে একটা আওয়াজ হল। লোহার শক্তপোক্ত দরজাটার দিকে তাকিয়ে একবার খেয়াল করল গণেশ। কোথাও কেউ নেই। মাংস দিতে যদি কেউ এসে থাকে তবে এতক্ষণে ঢুকে যাওয়ার কথা। তবে কি রক্ষীরা! ওদের কথা ভেবে একবার তটস্থ হল গণেশ। রিফ্লেক্সে হাত চলে গেল হাতের হামানদিস্তের দিকে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে দেখল। নাহ! কেউ নেই। হামানদিস্তাটাকে সরিয়ে জায়গায় রাখতে যেতেই কিচেনের লাইটটা গেল নিভে। জেলে ঢুকতে কারেন্ট অফ হতে দেখেনি গণেশ। জানালা দিয়ে ঝুঁকে দেখল দূরে কম্পাউন্ডে আলো জ্বলছে। আশ্চর্য তো! বাইরে কেউ কোথাও নেই। দূর থেকে এখনও গানের সুর ভেসে আসছে। গণেশ পিছন ফিরে বাইরে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হল। কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। দরজার দিকে পা বাড়াতেই একটা ছোট্ট শব্দ শুনতে পেল গণেশ। বহুবছরের পরিচিত শব্দ। স্প্রিং দেওয়া ছ ইঞ্চি ফলার ‘রামপুরিয়া’ খোলার শব্দ। ধাতব শব্দ কোথা থেকে এল বোঝার চেষ্টা করার আগেই গাঢ় অন্ধকারে ঝকঝকিয়ে উঠল স্টিলের নতুন পাতের ধারালো ফলা।
মিনিট পাঁচেক পরে বিরাট ভাতের ডেকচির ফ্যান উথলে উঠে ড্রেন বেয়ে গড়াতে শুরু করল। কেউ নেই কিচেনে ডেকচি নামানোর জন্য। ড্রেন বেয়ে ঘোলাটে সাদা জল বইছিল। কিছুক্ষণ পর তার সঙ্গে এসে মিশল লাল রক্ত। গণেশ হুঁইয়ের তরতাজা লাশটা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে ডেকচির উপর। কিচেনের দরজাটা হাওয়ায় কেঁপে উঠে আবার ‘ঢং’ শব্দ করে উঠল।
