পাতলা ছায়া, ফোকলা ছায়া, ছায়া গভীর কালো
মুখার্জি হোটেলে আজও ভিড় গিজগিজ করছে। গতকাল স্থানীয় উইংস অফ ওয়াইল্ড বলে একটি ট্যুরিজম সংস্থার তরফ থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে পলাশ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরুলিয়ার লোকগীতি, বাউল ঝুমুর গানের আসর বসেছিল। ধামসা মাদলের তালে করম নাচে, নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে পা মিলিয়েছেন অতিথিরাও। থানা থেকে পারমিশন নেওয়ার সময় আমাদের অনেককেই নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল সংস্থাটি। ভিড় পছন্দ করি না বলে যাওয়া হয়নি। তবে, দিব্যজ্যোতি সম্ভবত গিয়েছিল।
আমি একটা চা আর এক প্লেট আলুপকোড়ি অর্ডার দিয়েছিলাম। সকালের দিকটায় খুব বেশি খিদে পায় না কোনোদিন। হঠাৎই একটা তর্কাতর্কির শব্দে মাথা ঘোরালাম। চেনা গলায়, কে একটা ধমকাচ্ছে, “বেশ করেছি ফেলেছি। তোমাদের যত সমস্যা ট্যুরিস্টদের নিয়ে। যাদের টাকায় দিন চলছে, তাদের উপরই খবরদারি করছ।”
উঠে গিয়ে দেখি, ট্রেনের সেই বয়স্ক ভদ্রলোক! গাড়ি থেকে নামেননি। হোটেল থেকে যে কিছু কিনছেন তাও নয়। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে চিপস আর কেকের তিন-চারটে ছেঁড়া প্যাকেট, একটা মিনারেল ওয়াটারের ফাঁকা বোতল গাড়ি থেকেই রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলেছেন। ওঁর ছেলেদের কোথাও দেখলাম না! বোধহয় গাড়ি থামিয়ে কোনো কাজে নেমেছে। ভদ্রলোকের ছোঁড়া প্যাকেটগুলো হোটেলে ঢোকার মুখে এসে পড়েছে। হোটেলের মালিক প্রথমে হালকা গলায় প্যাকেট ডাস্টবিনে ফেলার কথা বলছিলেন, এখন উনিও সুর চড়িয়েছেন। সকাল সকাল ঝামেলা বেঁধে গেছে।
“কী ব্যাপার?”
ট্রেনের ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে একবারেই চিনতে পারলেন। বললেন, “ও আপনি এখনও এখানে? পেপারে লিখবেন, বুঝলেন! যত্তসব ট্যুরিস্ট আনফ্রেন্ডলি জায়গা।”
“প্যাকেটগুলো তুলে ডাস্টবিনে ফেলুন মেসোমশাই। পাবলিক প্লেস এমন নোংরা করলে চলে?” আমি শান্ত গলায় বললাম।
ভদ্রলোক বিকৃত স্বরে বললেন, “পাবলিক প্লেস নোংরা করা চলে না, আর ট্যুরিস্ট প্লেসে যখন তখন লোকাল লোক ঢুকে পড়তে পারে? তার জন্য কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না?
“বুঝলাম না।”
“তা আর বুঝবেন কী করে! যত সব গালভারি নাম দিয়েছে। ইকো রিসোর্ট-গ্রিন হোটেল। এদিকে সিকিউরিটির নাম ঠিকানা নেই, যখন তখন বাইরের লোক ঢুকে…” ভদ্রলোক গজগজ করে আরও অনেক কিছু বলছিলেন। উল্টো দিকের ফুট থেকে ওঁর ছেলে এসে গাড়িতে উঠে বসে বললেন, “আহ বাবা! দেরি হয়ে যাবে। কী হয়েছে ম্যাডাম?”
“এই নোংরাগুলো ডাস্টবিনে…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”
লোকটা একটা শিস দিয়ে দোকানের ছেলেটাকে ডেকে হাতে দশ টাকার নোট ধরিয়ে বলল, “এটা রাখ। আর প্যাকেট-ট্যাকেট কুড়িয়ে ফেলে দিস।”
আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই গাড়িটা এক রাশ কালো ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল। দোকানের ছেলেটা বিনা বাক্যব্যয়ে বোতল আর প্লাস্টিকের গতি করল। এ দেশে সবই ক্রয়যোগ্য। ঘৃণা, চিৎকার, ভালোবাসা আর সিভিক সেন্সও।
আমার আজ দুপুরে ডিউটি। একবার থানার গেটের দিকে নজর বুলিয়ে দেখলাম, শ্যামল ব্যনার্জির জিপ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা কাল রাত আটটা অবধি থানায় ফেরেনি। নিশ্চয়ই ভালো মাপের গণ্ডগোল বেঁধেছে। দুজন কনস্টেবল গিয়েছিলেন সঙ্গে, তাঁদেরও কাল থানাতে আর দেখিনি।
নিশীথ মাহাতোর চরিত্রটা ইন্টারেস্টিং। এত হাই- প্রোফাইল লোক, অথচ দসকার মত অখ্যাত এক গ্রামে পড়ে আছেন। সোশাল ওয়েলফেয়ার, সেল্ফ হেল্প গ্রুপ, আদিবাসী উন্নয়নের একাধিক প্রোজেক্ট হাতে। উদয়স্ত খাটেন। শাসক দলকে পাওয়ারে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের ইনফ্লুয়েন্স ব্যবহার করেছেন এরকম খবরও আছে। থাকেন দসকাতে… দসকা গ্রামের নামটাও পর পর দুটো ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়াটা কেমন যেন অদ্ভুত! হয়তো বা কাকতালীয়ই। ভবেশ বাউরির কেসটা নিয়ে আমি বেশি ভেবেছি বলেই, মাথায় এরকম চিন্তা আসছে।
পুরুলিয়াতে, এমনিতে আপাত শান্তিময় পরিবেশ মনে হলেও, গত দশ বছরে মানুষের মনে ক্ষোভ জমেছে তলে তলে। ট্যুরিজম ছাড়া আর চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়নি। বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির সুযোগ, এই তিনটে প্যারামিটার ভোটের আগে বেশ বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। আর ঠিক দেড় মাস পরে ভোট। জনগণের রায় কোনদিকে যাবে তা বোঝা এখন দায়। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও উত্তপ্ত হবে। ঠিক এই সময়ে নিশীথ মাহাতোর অন্তর্ধান রহস্য আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে।
আমার হাতের ফোনটা বাজছিল। অবাক হয়ে দেখলাম পুরকায়স্থ স্যারের ফোন।
“তুমি কোথায়?”
“বাঘমুণ্ডিতেই স্যার!”
“রিপোর্ট টু এস.পি অফিস। টুডে বাই টেন এ.এম শার্প।”
আর একটাও কথা না বলে ফোনটা কেটে গেল।
****
কনফারেন্স রুম সি, এস.পি অফিসের পিছনদিকের একটা ঘর। ঘরে ঢুকে দেখি, বারোটা মত চেয়ার ইতোমধ্যেই অকুপায়েড। দেওয়ালে একটা বিশাল হোয়াইট বোর্ড ঝুলছে। চারটে কম্পিউটার আর অনেকগুলো ফোন লাইন, ফ্যাক্স মেশিন, স্ক্যানার, প্রিন্টার, এমনকি পাওয়ার পয়েন্ট বা অন্যান্য প্রেজেন্টেশনের চালানোর জন্য একটা প্রোজেক্টর…একটা বড়সড় মাপের ইনভেস্টিগেশনের জন্য যা যা টেকনিকাল হেল্প লাগে সবই আছে।
অন্য অফিসারদের প্রত্যেকেরই মুখ অচেনা। অনেকেই ইউনিফর্মে নেই। ঘরে একটা থমথমে পরিবেশ। সম্ভবত পুলিশের একাধিক দপ্তর মিলে অল হ্যান্ডস ডাউন বৈঠক এটা। সামান্য সৌজন্য বিনিময় করে চেয়ারে বসতে না বসতেই, ঘরের দরজাটা ঠাস করে খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। এস.পি পুরুলিয়া পুলিশের সঙ্গে যে দুজন ঢুকলেন, তাঁদের মধ্যে একজনকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
নিরঞ্জন সেনের দৌলতে এই খবরটা আগে জানলেও, এত তাড়াতাড়ি এঁকে দেখতে পাব বুঝতে পারিনি।
অভিনন্দন রায়! প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স, কিন্তু শরীরে বয়স থাবা বসায়নি। বলিষ্ঠ কাঁধ, চওড়া বুক, নির্মেদ টানটান চেহারা। মাথার উপর পাতলা হয়ে আসা চুলেই যা হেমন্তকাল দেখা দিয়েছে। সমস্ত চোখেমুখে চিন্তাশীলতা, দায়িত্বশীলতা আর নিয়মানুবর্তিতা মিলে মিশে, বিদেশি কপ মুভিগুলো থেকে উঠে আসা কোনো নায়কের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলাম। সামান্য নীলচে চোখ তুলে তিনি ঘরে উপস্থিত সবার উপর একটা কৌতূহলী দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। আমার উপর চোখ দু সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হল না। কেন জানি না, আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত কনফিডেন্স তৈরি হল সঙ্গে সঙ্গে। মহিলা অফিসার হিসেবে, টিম মিটিংয়ে সিনিয়রদের থেকে আলাদা ট্রিটমেন্ট পাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে। হয় তাচ্ছিল্য, না হয় অস্বস্তিকর বিস্ময়। অভিনন্দন রায়, তাঁর ব্যবহারে কয়েক সেকেন্ডেই দ্বিধার গ্লাস সিলিংটা ভেঙে দিলেন।
দরজা খুলে একের পর এক লোক ঢুকছিল। তারা এস.পির কাছে গিয়ে কীসব কাগজপত্র ধরিয়ে ইনফর্মেশন দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর, গলা খাঁকড়ে এস.পি পুরুলিয়া বললেন, “মর্নিং অফিসার্স। যে এমার্জেন্সি সিচুয়েশনে এই বিশেষ টিম মিটিং রাখা হয়েছে, সময় নষ্ট না করে সেটার ব্রিফিং করা যাক। তার আগে লেট আস ওয়েলকাম আওয়ার ডি.আই.জি আই.পি.এস অভিনন্দন রায়। আপনারা অনেকেই জানেন, দশ বছর আগে আমাদের জেলার সাংঘাতিক ক্রাইসিস পিরিয়ডে, উনি অত্যন্ত সুনাম ও পারদর্শিতার সঙ্গে ডি.এস.পির দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন। আমরা খুবই ফরচুনেট, ওঁকে আবার ডি.আই.জি রূপে ফিরে পাওয়ায়। একটা ফর্মাল ওয়েলকাম সেরিমনির ব্যবস্থা…”
অভিনন্দন সামান্য বিরক্ত স্বরে বললেন, “এখন এসব ছাড়ো রঘুরাম। লেটস কাম টু দ্য পয়েন্ট!”
একটা গুজগুজ ফুসফুস তৈরি হয়েছিল। অভিনন্দন স্যার যে ডি.আই.জি হয়ে ফিরেছেন, এ কথা সবারই জানা। কিন্তু সামান্য কোনো কেসের ইনভেস্টিগেটিভ মিটিংয়ে একজন এত হাই র্যাঙ্কের অফিসার মাথা গলাবেন, এটা অবিশ্বাস্য! একটা সূক্ষ্ম কাঁটা মনের মধ্যে খচখচ করে বিঁধে বলল, কোথাও একটা মারাত্মক নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে এবং অভিনন্দন রায় নিজে এই নিম্নচাপ কাটাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
আমার আশঙ্কা সত্যি হল এস.পির বক্তব্যে—
“গতকাল বেলা তিনটে নাগাদ বাঘমুণ্ডি পি.এস-এ একটা ক্রিমিনাল ট্রেসপাসিং আর ক্রিমিনাল ইনটিমিডেশন কেসের এফ.আই.আর রেজিস্টার করা হয়েছে। অ্যাজ অল অফ ইউ অলরেডি নো, যে দোকানে বার্গলারি হয়েছে সেটা পলাশপ্রিয়া বলে এন.জি.ওর। ক্যাশ বা কাইন্ড কতটা কী গেছে না গেছে সেটা ফার্দার ইনভেস্টিগেশনের বিষয়। বাঘমুণ্ডি পি.এসের এস.এইচ.ও সরেজমিন তদন্ত করেছেন। দোকানে ফোর্সফুল এন্ট্রির কোনো এভিডেন্স নেই, কিন্তু ভাঙচুর, ব্লাড স্টেইনস রয়েছে। টাকাও মিসিং। সবথেকে অ্যালার্মিং ব্যাপার হল, পলাশপ্রিয়ার চেয়ারম্যান নিশীথ মাহাতো ইজ অলসো মিসিং ফ্রম দ্য পি.ও হেমন্ত নামের একটি ছেলে প্রতি রাতে দোকানে শোয়। সেদিন রাতে সে ছুটি নেওয়ায় নিশীথ মাহাতো নিজেই দোকানে ছিলেন। নিশীথবাবুর স্ত্রীয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি দোলের পুজোর জন্য তাঁর মেটারনাল হাউজ ভিজিট করেছিলেন। নিশীথবাবু তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে বলেন যে তিনি রাতে দোকানে থেকে যাচ্ছেন, পরেরদিন হেমন্ত কাজে এসে যোগ দিলে তিনি বাড়ি ফিরবেন।”
“দোকানে কি একটিই কর্মচারী?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“দুজন। আপাতত একজন কাজ ছেড়েছে। তাই হেমন্ত আর নিশীথ মাহাতো দুজনে মিলে চালাচ্ছিলেন।”
“নিশীথবাবুর স্ত্রী গতকাল দুপুরে ফেরেন?” সামনের চেয়ারগুলোর থেকে কে যেন জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ। দেড়টা নাগাদ। তিনি বাড়ি এসে তাঁর হাজব্যান্ডকে ফোনে পাননি। ফোন সুইচড অফ ছিল। প্রতিবেশীদের ফোন করে জানেন যে নিশীথ বাবু ফেরেননি। চিন্তিত হয়ে তিনি দোকানে যান। সেসময়ে হেমন্তও দোকানে পৌঁছায়। দোকানে ঢুকে পরিস্থিতি দেখেন এবং সেখান থেকে থানায় আসেন। বাঘমুণ্ডি পি.এসের পক্ষ থেকে, প্রাথমিক খোঁজখবর করা হয়েছে। নিশীথবাবুকে গতকাল সকালে আর কেউ দেখেনি। বাইরে থেকে দেখে ক্রাইম সিনের অ্যাবনর্মালিটি কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ফলে স্থানীয়দের মধ্যেও কোনো অ্যালার্ম রেইজড হয়নি। সো উইথ অল প্রোবেবিলিটি, এটা একটা ফোর্সফুল অ্যাবডাকশনের কেসের দিকে গড়াচ্ছে। এবং বুঝতেই পারছেন, আমরা প্রতি সেকেন্ডে অত্যন্ত ভ্যালুয়েবল টাইম লুজ করছি। কেন এই মিসিং কেসটাকে এত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে, সেটা জেলার বর্তমান পরিস্থিতিতে আশা করি বলে দিতে হবে না। ফাইন্ডিং নিশীথ মাহাতো অ্যালাইভ ইজ ভেরি ভেরি ক্রুশিয়াল ফর আস।” এস.পি একটু দম নিলেন।
“এনি চান্সেস অফ মাওয়িস্ট ইনভল্ভমেন্ট স্যার?” একজন অফিসার প্রশ্ন করলেন।
“হোয়াট ডু ইউ মিন?”
“হোস্টেজ হিসেবে যদি নিয়ে গিয়ে থাকে স্যার?”
এস.পি একটু সতর্কভঙ্গিতে বললেন, “মোডাস অপারেন্ডি দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। কোনো উইটনেস নেই এই ঘটনার। যেটা আলট্রাদের ক্ষেত্রে খুব আনকমন। ওরা হোস্টেজ হিসেবে নিলে এতক্ষণে কোনো টিভি চ্যানেলে চিঠি পাঠিয়ে ক্লেইম করত। তবুও নিশীথ মাহাতোর পাস্টকে চোখে রেখে উই কান্ট রুল আউট দ্য পসিবিলিটি।”
অভিনন্দন রায় চুপচাপ শুনছিলেন। একটা সাদা কাগজে কিসব লিখে নিচ্ছিলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপাতত কিপ অল পসিবল অ্যাঙ্গলস ওপেন। পলিটিকাল, ফিনানসিয়াল, পার্সোনাল, ইভেন মাওয়িস্ট টু।”
“এনি মোর কোয়েশ্চেনস?” এস.পি জিজ্ঞাসা করলেন।
“নিশীথ মাহাতোকে লাস্ট কখন দেখা গিয়েছিল স্যার?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“দোলের দিন রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। হেমন্ত সেইদিনের বিক্রিবাট্টার হিসাব বুঝিয়ে বাড়ি গেছে ওই সময়।” এস.পি বললেন।
“এটা কোনো পরিচিতর কাজ বলেই মনে হচ্ছে স্যার। কারণ ফোর্সফুল এন্ট্রি যখন নয়, তাহলে ধরে নিতে হবে নিশীথ মাহাতো নিজেই দরজা খুলেছিলেন।
অত রাতে অপরিচিত কারুর জন্য দরজা খুলবেন বলে মনে হয় না।” আরেকজন অফিসার মন্তব্য করলেন।
“হতে পারে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টরা অলরেডি ইমপ্রিন্ট নিয়েছেন। দেখা যাক কোনো আই.ডি হয় কিনা। কলকাতা থেকে ফরেনসিক টিম আসছে। আপাতত এটুকু সিওর যে অতর্কিতে হামলা হয়েছে। ভদ্রলোক খাচ্ছিলেন, খাওয়া শেষ করতে পারেননি।”
“মোটিভটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করুন। দ্যাট ইজ মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট।” অভিনন্দন রায় বলে উঠলেন।
“এই কেসটায় পলিটিকাল টারময়েল হওয়ার চান্স রয়েছে কতটা? দুদিন আগেই আমার পি.এসের একটা কেসে পলিটিকাল ইনভল্ভমেন্টে ল অ্যান্ড অর্ডার বিপর্যস্ত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশন হ্যাম্পারড হবে স্যার। ডিটেকশন পিছিয়ে যাবে।” আমি বলে উঠলাম।
এস.পি রঘুরাম জল খাচ্ছিলেন। জলের গ্লাস নামিয়ে রেখে বললেন, “আপাতত নিশীথ মাহাতো যে মিসিং, এটা পুলিশ আর ওঁর বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানে না। পাবলিক এটাকে এখনও ডাকাতি বলেই জানে। দোকানের ছেলেটাকেও এ ব্যাপারে কড়াভাবে বলা রয়েছে। আর জনমোর্চা কংগ্রেসের হাইয়ার লেভেলের সঙ্গে স্বয়ং স্যার কথা বলেছেন। ওঁরা হায়েস্ট লেভেল অফ কো-অপারেশন এনসিওর করেছেন।” এস.পি অভিনন্দন স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“পুরুলিয়া স্টেশন বা বাস আড্ডাগুলোয় একবার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হবে নাকি স্যার?” অন্য একজন বললেন।
“সেসব হয়ে গেছে। কোনো সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। ফুটেজগুলো পেনড্রাইভে তোলা আছে। পেয়ে যাবেন।”
“ক্রাইম সিনের যা ডেসক্রিপশন তাতে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, অ্যাবডাকশনের আগে নিশীথ মাহাতো ইনজিওরড হয়েছিলেন। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে তাকে সরানো হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং মাই অ্যাডভাইজ ইজ, এলাকার গাড়িগুলোর গতিবিধি চেক করুন। ব্যক্তিগত মালিকানা বা রেন্টে খাটানো সব রকম গাড়িই।” অভিনন্দন রায় বললেন।
“আপাতত পরিস্থিতি যা দেখা যাচ্ছে, বাঘমুণ্ডি পি.এসের নানা কাজের সঙ্গে এই তদন্তটা জুড়ে দেওয়া আনজাস্টিফায়েড। এই কেসটার একটা ফাস্ট ট্র্যাক ইনভেস্টিগেশন দরকার। উই নিড ফাস্ট রেজাল্ট। আমরা ঠিক করেছি, আমরা আলাদা করে একটা টিম তৈরী করে এই কেসের তদন্ত চালাবো। টিম লিড করবেন বলরামপুরের সার্কল ইন্সপেক্টর মতিলাল মহান্তি। বাকিরা অ্যাসিস্ট করবেন। ক্রাইম সিনে বাঘমুণ্ডি পি.এসের এস.এইচ.ও আপনাদের ব্রিফ করে দেবেন। ডু কল হিম অ্যান্ড স্টার্ট দ্য ইনভেস্টিগেশন রাইট আফটার দিজ মিটিং। মতিলাল মহান্তির নেক্সট ইন কম্যান্ড থাকবেন বাঘমুণ্ডি পি.এসের এস.আই দর্শনা বোস।”
এস.পি রঘুরাম আমার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তিকর ভাবে কটা মাথা আমার দিকে ঘুরে গেল। সাধারণত এই ধরণের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমে মহিলা অফিসারদের উপস্থিতি এখনও এদেশে রেয়ার ব্যাপার। কৌতূহল স্বাভাবিক।
“দর্শনা বোস ইজ এ হাই ক্যালিবার অফিসার। এর আগে উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ট্র্যাফিকিং, এবং হোমিসাইডে রাজ্য পুলিশের ডিডি ইউনিটে কাজ করেছেন। আমার বিশ্বাস এই কেসে, দর্শনা ওঁর সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবেন। “ আমাকে চমকে দিয়ে অভিনন্দন রায় বলে উঠলেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করে থ্যাঙ্কু স্যার বলার জন্য মুখ খুলতেই আমাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন ডি.আই.জি।
“এসব ইনট্রোডাকশন, স্যালুটেশন ইত্যাদির জন্য পরে অনেক টাইম পাওয়া যাবে অফিসার্স। স্বয়ং সি.এম এই কেসটা নিয়ে চিন্তিত। কাজেই কী লেভেলের আর্জেন্সি, মেটিকিউলাসনেস, ডেডিকেশন আপনাদের কাছ থেকে এক্সপেক্টেড বুঝতে পারছেন। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, মিডিয়াকে যতটা সম্ভব অ্যালুফ রাখতে হবে। এই কেসটায় বি ভেরি ভেরি টাইটলিপড। পুট ইওর বেস্ট ফিট ফরওয়ার্ড। উইশ ইউ অল দ্য ভেরি বেস্ট।”
মিটিং ভেঙে গেল। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে, এস.পি রঘুরাম আমার দিকে তাকিয়ে বলে গেলেন, “মিট মি ইন মাই অফিস।” সার্কল ইন্সপেক্টর মতিলাল মহান্তির সঙ্গে প্রাথমিক বাক্যালাপ সেরে, এস.পির কেবিনে টোকা দিয়ে ঢুকতেই দেখি, ডি.আই.জি অভিনন্দন রায়, এস.পির পাশের চেয়ারে বসে আছেন।
“পি.পি মানে প্রবীর পুরকায়স্থ তোমার নাম রেকমেন্ড করেছে। সেটা মিটিংয়ে বলে তোমাকে আননেসেসারি অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনি।” অভিনন্দন সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন।
“থ্যাঙ্কু স্যার।” ফিকে হেসে বললাম।
“তোমার কোন ব্যাচ? ২০১৮ কি?” ডি আইজি একটা গ্লাস থেকে জল খেতে খেতে বললেন।
“ইয়েস স্যার।”
“হুম। দুর্গাপুর-আসানসোল কমিশনারেটে ছিলে তো? আটজন নেপালি মেয়ে ট্রাফিকিংয়ের কেসটায়?”
“ইয়েস স্যার; আমার প্রথম পোস্টিং।”
“হ্যাঁ দেখলাম। নবগ্রামের হোমিসাইড মামলাটাও দেখলাম। তোমার সাসপেনশনের ব্যাপারটার সম্পর্কে জানলাম। ভেরি আনফরচুনেট। বিশেষত আজকে কেসটা যেদিকে টার্ন নিল!”
“কী হয়েছে স্যার?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
অভিনন্দন আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালেন। ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, “সে কী! ডিন্ট ইউ ওয়াচ টুডেস নিউজ?”
“না। মানে সকাল থেকে…”
জি নিউজ চ্যানেলে ততক্ষণে নিউজ অ্যাংকরের সুন্দর মুখ ভেসে উঠেছে। অভিনন্দন স্যার রিমোট দিয়ে টিভি অন করে দিয়েছেন। স্ক্রিনের নিচে নিউজ টিকার স্ক্রোল হচ্ছে, “গতকাল গভীর রাতে, মুম্বাইয়ের আর্থার রোড জেলে নবগ্রাম অস্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত…”
বাকিটা আর পড়তে পারলাম না। চোখে যেন কেউ এক বোতল অ্যাসিড ঢেলে দিল।
***
“গতকাল সন্ধে ৬.১৫ নাগাদ আর্থার রোড জেলের কয়েদি গণেশ হুঁইয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। গণেশ হুঁই আর্থার রোড জেলের ৬ নম্বর ব্যারাকে বন্দী ছিলেন। আর্থার রোড জেলে গতকাল বিপুল সমারোহে হোলি উৎসব পালন করা হচ্ছিল। রক্ষী এবং কয়েদি দুই তরফেই উৎসাহ উন্মাদনার পরিবেশ ছিল। এমতাবস্থায়, গলা কাটা অবস্থায় গণেশ হুঁইয়ের মৃতদেহ জেলের ক্যান্টিনে পাওয়া যায়। তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় পঁচিশটি ক্রিমিনাল কেস রেজিস্টার্ড হয়েছে। মুম্বাই শহরের মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট সুরতহালের দায়িত্বে রয়েছেন। সুরতহাল এবং পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টের উপর নির্ভর করে খুব শীঘ্রই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ডি.আই.জি প্রিজন অনিমেষ চৌবে। তিনি আজ আরও জানিয়েছেন, জেল কর্তৃপক্ষের তরফে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই মর্মে একটি এফ.আই.আর রেজিস্টার্ড করা হয়েছে এবং পাঁচজন কারারক্ষীকে কাজে গাফিলতির কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে।”
মোবাইলে নিউজ ফিড চেক করে যতটুকু তথ্য পেলাম তার সারমর্ম এটুকুই। হাতের তালু ঘেমে বারবার ফোনটা হাত থেকে স্লিপ করছিল। টেনশনে নিজেও দরদর করে ঘামছিলাম।
“আপনি ঠিক আছেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?” পাশ থেকে মতিলাল মহান্তি জিজ্ঞাসা করলেন। জিপটা চড়িদার দিকে ছুটছিল।
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। সামান্য হেসে বললাম, “হ্যাঁ, ঠিক আছি।”
বাবার কাছে কি আদৌ এই খবরটা পৌঁছেছে? খবরের কাগজ বা টিভি দুটো থেকেই তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। আজ মনে হচ্ছে, হয়তো ঠিকই করেছেন। যে মরীচিকার পিছনে আমি এতদিন ছুটে চলেছি, তাকে আদৌ ছুঁতে পারব না। একটা ক্ষীণ আশা ছিল, কোথাও না কোথাও গণেশদার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবেই। শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই জানতে পারব, কীভাবে ঐ পরিণতি পেয়েছিল আমার মা! এতটা অপেক্ষার পর ভাগ্যের এই বিকট পরিহাস কি সত্যিই আমার প্রাপ্য ছিল! আর হয়তো কোনো পথ বাকি রইল না। আর কে, এত পুরোনো একটা খবরে, চোরাবালির অতলে যে তলিয়ে গেছে, তার খবর রাখবে? হঠাৎই মনে পড়ল নিরঞ্জনের কথা। একবার একটা ফোন করার জন্য হাত নিশপিশ করে উঠল। তারপরেই মনে পড়ল ভদ্রলোকের শর্তের কথা। হতাশায় ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হল।
মতিলাল মহান্তি পাশ থেকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক হাস্যময়, মিশুকে মানুষ। নিজে পুলিশে থেকেও জানি এই গুণ ফোর্সে কতটা বিরল। আমি ডিসটার্বড ছিলাম বলে হু হা দিয়ে কাজ চালাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক তাঁর পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছিলেন।
“আমার সার্ভিস লাইফে মোট ছটা কিডন্যাপিং কেস দেখেছি। চারটেতে জীবিত ফিরেছে, বাকি দুটোয় মৃত। এই বারের কেসটায় কী হবে ঈশ্বর জানেন। কর্তারা তো বলেই খালাস, কী বলেন ম্যাডাম?”
“হ্যাঁ। সে তো বটেই।” আমি হাসার চেষ্টা করলাম।
“তবে আমার কী মনে হয় জানেন, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। মারার হলে, তো দোকানেই মেরে রেখে যেতে পারত, তাই না?”
“হ্যাঁ। এই ধরণের কিডন্যাপিংয়ের তো মোটিভ দুটোই হয়ে জেনারেলি। র্যানসম বা এক্সটর্শন অথবা পুরোনো কোনো শত্রুতা। প্রথমটাতে বেঁচে ফেরার পার্সেন্টেজ বেশি, দ্বিতীয়টায় বলা মুশকিল।” আমি অন্যমনস্কভাবে বললাম।
“ঠিক। সেক্ষেত্রে আমাদের পুরোনো শত্রুতাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হবে, র্যানসম বা এক্সটর্শনের কোনো দাবি যেহেতু এখনও এসে পৌঁছায়নি। নিশীথ মাহাতোর এক নম্বর শত্রু কিন্তু মাওয়িস্টরাই। এ বাদে ব্যক্তিজীবনে ভদ্রলোকের বেশ জনদরদী বলে খ্যাতি আছে, খ্যাতির অন্তরালে কী আছে বলতে পারব না।”
“হুম। আচ্ছা মতিদা, আপনি তো দুহাজার পাঁচ ছয়ের সেই পিরিয়ডটায় চাকরি করেছেন। সেই সময়কার কোনো কেসের সঙ্গে এই কেসটার মোডাস অপারেন্ডি লিঙ্ক করতে পারছেন?”
মতিদা কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, “একটু দেখে বলতে হবে। তখন তো কিডন্যাপিং ব্যাপারটা একদম জলভাত ছিল। আমি নিজেই যেমন ছটা কেস হ্যান্ডল করেছি, অন্যান্য থানায় আরও বেশি এসেছে। পুরোনো কেস ফাইলগুলো নামাতে হবে, বুঝলে।”
“সবই তো পঞ্চায়েত সদস্য, আর সিপিআইআরের লোকজন?”
“হ্যাঁ। সকলেই প্রায় তাই। তবে শিক্ষক, রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এরাও ছিলেন লিস্টে। আর একটা খুব আনফরচুনেট কেস ছিল বুঝলে, যদিও আমি নিজে হ্যান্ডল করিনি” মতিদা কথাটা বলে চুপ করে গেলেন।
“কোন কেস?”
গাড়িটা বাঁক নিয়ে একটা দোকানের সামনে থেমে গেল। মতিলাল মহান্তি আর কথা না বাড়িয়ে বললেন, “চলো এসে গেছি।”
