Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বৃষ্টির ঠিকানা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প160 Mins Read0
    ⤶

    ১৩. বৃষ্টি

    বৃষ্টি

    ছোট খালা বললেন, টুম্পা তোর টেলিফোন। তোর আম্মু আমেরিকা থেকে।

    টুম্পা অনেকগুলো খবরের কাগজ নিয়ে বসেছিল, আব্বুর এক্সিবিশান নিয়ে যে খবর বের হয়েছে সেগুলো সে কেটে কেটে রাখছে। কাচিটা রেখে সে টেলিফোন ধরতে গেল, কানে লাগিয়ে বলল, হ্যালো।

    অন্য পাশ থেকে আম্মুর গলা না শুনে সে শুনলো লিটনের গলার স্বর। চিৎকার করে বলছে, আপু! তোমাকে আমরা টেলিভিশনে দেখেছি! টেলিভিশনে দেখেছি!

    তাই নাকি!

    হ্যাঁ আপু! তুমি কথা বলছ! অনেক মানুষ–সেখানে। কী সুন্দর ইশ আপু, তুমি আমাকে নিয়ে গেলে না কেন?

    পরের বার তোকে নিয়ে আসব আমি, দেখবি কী মজা হবে। এখানে যা মজার বৃষ্টি হয় তুই না দেখলে বিশ্বাস করবি না–

    আমাদের এখানেও বৃষ্টি হয়েছে আপু–লিটন এরপর সেখানকার অনেক খুটিনাটি খবর দিতে শুরু করল। লিটনের কথা সহজে শেষ হতো বলে মনে হয় না মাঝখানে আম্মু টেলিফোনটা নিয়ে টুম্পার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন, টুম্পা তোর কী খবর?

    ভালো আম্মু।

    তোকে আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। আমি জানতাম না তুই তোর আব্বুকে খুঁজে পেয়েছিস।

    হ্যাঁ আম্মু।

    আমাকে তো কিছু বলিস নি–

    কীভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক কিছু হয়েছে এখানে, তাই ঠিক করেছিলাম এসে বলব। তোমরা যে টেলিভিশনে দেখে ফেলবে বুঝি নি আম্মু!

    হ্যাঁ। আজকাল সব দেখা যায়। আম্মু একটু অপেক্ষা করে বললেন, কেমন আছে বুলবুল? টেলিভিশনে তো ভালোই দেখলাম–

    এখন ভালোই আছেন। প্রথম যখন খুঁজে পেয়েছিলাম তখন খুব ভয়ংকর অবস্থা ছিল। তুমি চিন্তা করতে পারবে না!

    আম্মু বললেন, আমি জানি। আসলে—

    আসলে কী?

    মানুষটাকে ছেড়ে চলে আসা ঠিক হয় নি। সমস্যা ছিল আমি সেটা ফেস করার সাহস পাই নি। ভয় পেয়েছিলাম–

    তুমি কোনোদিন আমাকে কিছু বল নি।

    বলি নি। কী বলব? বলতে খারাপ লাগতো, লজ্জা লাগতো–তখন বয়স কম ছিল, কী করতে হবে বুঝি নাই– আম্মুর গলা হঠাৎ ভেঙে গেল।

    টুম্পা বলল, আম্মু! তুমি আপসেট হয়ো না। প্লিজ–

    এখন মনে হচ্ছে আমার আরেকটু চেষ্টা করা উচিৎ ছিল। আমি করি নাই। ছেড়ে চলে এসেছি। সেলফিশের মতো কাজ করেছি।

    থাকুক আম্মু। এসব নিয়ে পরে কথা বলব।

    ঠিক আছে। আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর তো চলে আসার সময় হয়ে গেছে!

    হ্যাঁ আম্মু আর দুই দিন।

    তুই চলে এলে বুলবুল একটু মন খারাপ করবে না?

    টুম্পা বলল, আমি সেই কথাটা এখন চিন্তা করতে চাই না আম্মু।

    টুম্পা আরো কিছুক্ষণ তার আম্মুর সাথে কথা বলল, ফোন রেখে দেবার আগে আম্মু বললেন, তোর সেই টিচার সেদিন ফোন করেছিল। মিসেস হেনরিকসন।

    কেন আম্মু?

    জানি না। তোকে খুঁজছে, খুব নাকী দরকার। তোর ছোটখালার নম্বর নিয়েছে–ফোন করবে মনে হয়। তার নাম্বারটাও দিয়েছে। লিখে নিবি?

    আমার কাছে মিসেস হেনরিকসনের নাম্বার আছে।

    ঠিক আছে তাহলে। খোদা হাফেজ।

    খোদা হাফেজ আম্মু।

    পরদিন রাতে মিসেস হেনরিকসন ফোন করলেন। টুম্পা অবাক হয়ে বলল, কী খবর মিসেস হেনরিকসন। তুমি বাংলাদেশে আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছ?

    মিসেস হেনরিকসন বললেন, এখন পৃথিবীটা কতো ছোট হয়ে গেছে! বাংলাদেশ আর আমেরিকা এখন কী দূরে নাকি? পুরো পৃথিবী এখন একটা দেশের মতো। যে কোনো মানুষ যে কোনো দেশে থাকতে পারে।

    টুম্পা ভদ্রতা করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ।

    এখন সব সময় উচিৎ এক দেশের মানুষের অন্য দেশে যাওয়া। অন্য দেশে থাকা। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষ মিলে একটা জাতি হতে পারবে।

    টুম্পা আবার ভদ্রতা করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ মিসেস হেনরিকসন!

    যাই হোক, আমি অবশ্যি তোমার সাথে ফিলোসফি নিয়ে আলাপ করার জন্যে এই দুপুর রাতে ফোন করি নি। অন্য একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্যে ফোন করেছি।

    কী বিষয় মিসেস হেনরিকসন।

    এই এলাকায় সামারে থাকার জন্যে একজন আর্টিস্ট এসেছেন। মিস্টার কিম্বালী। খুব ভালো আর্টিস্ট, বিখ্যাত না কিন্তু ভালো। আমার সাথে কয়দিন আগে দেখা হয়েছিল–যারা ছবি আঁকতে পছন্দ করে তাদেরকে সময় দিতে রাজী হয়েছেন। নানারকম টেকনিক শেখাবেন–সত্যিকার আর্টিস্ট কেমন করে আঁকে, কেমন করে চিন্তা করে এই সব।

    টুম্পা খুকখুক করে হেসে বলল, মিসেস হেনরিকসন! তুমি বিশ্বাস করবে এখানে কী হয়েছে!

    কী হয়েছে?

    আমি একজন বিখ্যাত আর ভালো আর্টিস্টের সাথে সময় কাটাচ্ছি। সে অনেকগুলো ছবি এঁকেছে, আমি দেখেছি। আমাকে একেবারে হাতে ধরে ছবি আঁকা শিখিয়েছে!

    সত্যি?

    তাহলে তো হলোই! তুমি তাহলে শুধু শুধু এখানে ফিরে আসতে চাইছ কেন। থেকে যাও।

    টুম্পা বলল, আমার মাঝে মাঝে তাই ইচ্ছে করে, কিন্তু আসতে তো হবেই।

    মিসেস হেনরিকসন আরো কিছুক্ষণ টেলিফোনে কথা বলে টেলিফোন রেখে দিলেন। সুমি বলল, তোমাদের টিচাররা কী সুইট, একেবারে আমেরিকা থেকে ফোন করে তোমার খোঁজ নেন!

    সবাই না। শুধু মিসেস হেনরিকসন! মিসেস হেনরিকসন অন্যরকম টিচার।

    .

    দেখতে দেখতে টুম্পার ফিরে যাওয়ার দিন চলে এল। বিকেল বেলা ফ্লাইট দুপুরে সবাই একসাথে শেষবারের মতো খেতে বসেছে। ছোটখালা বললেন, আজকে দুপুরে তুই তোর বাবার সাথে থাকলেই পারতি!

    গত কয়েকদিন তো ছিলামই। আজকের দিনটা আমি তোমাদের সাথে কাটাতে চাইছিলাম।

    ছোটখালা বললেন, তুই এসে শুধু কষ্টই করে গেলি! তোকে ভালো মন্দ কিছু খাওয়াতেও পারলাম না।

    কী বল ছোট খালা। আমি এসেছিলাম শুকনো পাতলা, ফিরে যাচ্ছি নাদুসনুদুস গোলগাল! পাশপোর্টের ছবির সাথে মিলবে না, ইমিগ্রেশন না আটকে দেয়!

    সুমি বলল, তাহলে তো ভালোই হয়। তোমাকে আর কোনোদিন যেতে হবে না। তুমি এখানে থেকে যাবে!

    আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না।

    রুমি বলল, তুমি আবার কবে আসবে?

    প্লেনের ভাড়া জোগাড় করলেই চলে আসব।

    ছোট খালা মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ সবাইকে নিয়ে চলে আসবি। অনেকদিন তোর মাকে দেখি না। বাচ্চাটাকে তো দেখিই নাই।

    টুম্পা বলল, আমরা আসলে তো তোমাদের আরও কতো ঝামেলা।

    সুমি বলল, কে বলেছে ঝামেলা, কতো মজা হয়।

    কী মজাটা হয়েছে? সবাই মিলে রাঙ্গামাটি বান্দরবান যাবার কথা ছিল, গিয়েছি? টুম্পা বলল, আমার জন্যে তোদের কোথায় যাওয়া হলো না।

    সুমি বলল, কিন্তু তার বদলে আমরা মেজো খালুর ছবি প্রদর্শনী করেছি। কী মজা হয়েছিল মনে আছে?

    রুমি বলল, হ্যাঁ। মেজো খালু তার একটা ছবি দিয়ে দিলেন আমাদেরকে। সেইটা বিক্রি হলো দেড় লাখ টাকায়! আমাদের তিনজনের একেকজনের পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবার কথা। আম্মুর জন্যে সেটা পেলাম না–একেকজন পেলাম মাত্র পাঁচশো টাকা!

    এই ছোট বাচ্চা এতো টাকা দিয়ে কী করবি?

    ছোট খালু বললেন, বুলবুলের তো কোনো প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান নেই! তাকে দেখে শুনে রাখতে হবে–সে দিলেই তোরা নিবি কেন?

    রুমি চোখ বড় বড় করে বলল, চিন্তা করতে পার? পঞ্চাশ হাজার টাকা! তার বদলে পেলাম মাত্র পাঁচশ টাকা।

    সুমি বলল, ভালো করে ছবি আঁকা শিখে নে, তাহলে তোর ছবিও একদিন লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে।

    টুম্পা বলল, ভ্যানগগের একটা ছবি বিক্রি হয়েছিল পয়ষট্টি মিলিয়ন ডলারে।

    ছোট খালু রুমিকে বললেন, ভ্যানগগ তার কান কেটে বান্ধবীকে উপহার দিয়েছিলেন। তুই পারবি তোর কান কেটে উপহার দিতে? আছে কোনো বান্ধবী?

    তার চাইতে আমি মেজো খালুর এসিস্টেন্ট হয়ে যাব। বাটিতে রং গুলে দেব, তুলি গুলো ধুয়ে রাখব। মেজো খালু খুশি হয়ে মাঝে মধ্যে আমাকে একটা ছবি দিবেন, আমি সেইটা বিক্রি করেই বড় লোক হয়ে যাব।

    সুমি হি হি করে হেসে বলল, এই আইডিয়াটা খারাপ না!

    টুম্পা বলল, রুমি অলরেডি আব্বুর জন্যে অনেক কাজ করেছে। মনে আছে এক্সিবিশনের দিনগুলিতে সে কতো সুন্দর করে সবার কাছে ক্যাটালগ দিয়েছে!

    রুমি বলল, আমি এতো পরিশ্রম করলাম অথচ আমাকে একবারও টেলিভিশনে দেখালো না। দেখালো আম্মুকে! এই পৃথিবীতে কোনো বিচার নাই।

    সুমি বলল, আরে গাধা। সেদিন আম্মু ছিল চিফ গেস্ট। চিফ গেস্টকে দেখাবে না তো কী তোকে দেখাবে?

    ছোট খালু বললেন,  তোদের আম্মু পরিশ্রম করে নাই কে বলেছে? অনেক পরিশ্রম করেছে।

    সুমি আর রুমি এক সাথে প্রতিবাদ করল, কী পরিশ্রম করেছে আম্মু? কতো পরিশ্রম করে সেজেছিল মনে আছে? আমাদের বিয়ের দিনও এরকম সাজ দেয় নাই!

    ছোটখালা প্রতিবাদ করে কিছু বলতে চাইছিলেন, টুম্পা তাকে সুযোগ না দিয়ে বলল,  ছোট খালাকে টেলিভিশনে কী সুন্দর লাগছিল মনে আছে? একেবারে সিনেমার নায়িকার মতো!

    ছোটখালু বললেন, থাক থাক এইভাবে বল না। এমনিতেই বাসায় থাকতে পারি না। এইভাবে বললে আর দেশেই থাকতে পারব না। তোমার সাথে আমাদের আমেরিকা চলে যেতে হবে!

    সুমি হঠাৎ করে বলল, ইশ টুম্পা আপু! তুমি সত্যিই চলে যাবে!

    টুম্পা কিছুক্ষণ সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ সুমি আমি যখন যাব তখন কিন্তু নো কান্নাকাটি। সবাই হাসবে। ঠিক আছে?

    ঠিক আছে।

    তোমাদের কেউ যদি একটুও মন খারাপ করো তাহলে আমি কিন্তু একেবারে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবো–তখন তোমরাই বিপদে পড়ে যাবে! আমি কিন্তু খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলি।

    ছোট খালাও মুখ কালো করে বললেন, আমিও।

    সুমি বলল, আমিও।

    ছোট খালু বললেন, মনে হচ্ছে এটা তোমাদের বংশগত সমস্যা।

    সুমি বলল, আন্তু এটা সমস্যা না, এটা হচ্ছে গুণ। এর অর্থ আমাদের মন খুব নরম। বুঝেছ?

    আব্বু বললেন, বুঝেছি।

    ছোটখালা হঠাৎ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবং তখন একসাথে সবাই চুপ করে গেল। হঠাৎ করে কেউ বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো যে অন্য কেউ একটা কথা বলবে কিন্তু কেউই কিছু বলল না। সবাই চুপ করে বসে রইল।

    .

    এয়ারপোর্টে ছোটখালা, ছোটখালু রুমি সুমির কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় কেউ কাঁদল না। সবাই ভান করতে লাগলো পুরো বিষয়টা একটা মজার বিষয় এবং তারা বিনা কারণে হাসতে লাগলো। ছোটখালা টুম্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেলেন তারপর ফিস ফিস করে বললেন, আমরা এখন যাই। তুই তোর আব্বুর কাছে যা। মানুষটা একা একা দাঁড়িয়ে আছে।

    ।টুম্পা বলল, ঠিক আছে ছোটখালা।

    সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত টুম্পা অপেক্ষা করল তারপর সে তার আব্বুর কাছে গেল। আব্বু এক কোণায় দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে তার গাল ঘষছিলেন। সকালে মনে হয় শেভ করেন নি, সেজন্যে মুখে ছোট ছোট দাড়িতে একটা নীলচে আভা এসেছে। আব্বুর এমনিতেই চুল আচড়াতে মনে থাকে না, চুলগুলো এলোমেলো, একটা আধময়লা ফতুয়া আর রং ওঠা জিনসের প্যান্ট পরে আছেন, তারপরেও তাকে একজন রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে। এতো সুন্দর একটা মানুষকে ছেড়ে তার আম্মু কেমন করে চলে গিয়েছিলেন?

    টুম্পা আব্বুর কাছে গিয়ে ডাকলো, আব্বু।

    আব্বু যেন একটু চমকে উঠে টুম্পার দিকে তাকালেন, টুম্পা!

    হ্যাঁ আব্বু।

    তুই তুই তাহলে সত্যিই চলে যাচ্ছিস।

    হ্যাঁ আব্বু।

    এখন মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে—

    কী মনে হচ্ছে?

    আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, নাহ্! কিছু না।

    বল আব্বু কী বলতে চাচ্ছ।

    মনে হচ্ছে তুই না এলেই ভালো ছিল। তাহলে আমি জানতামই না তুই আছিস! আমি যেরকম ছিলাম সেরকম থাকতাম–

    টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, না আব্বু। তাহলে আমি কোনোদিন তোমাকে দেখতেই পেতাম না।

    কিন্তু এখন যে খুব মন খারাপ লাগছে।

    আমারও খুব মন খারাপ হচ্ছে কিন্তু আব্বু তোমাকে শক্ত হতে হবে।

    আব্বু মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ আমি শক্ত আছি।

    আমি আবার আসব আব্বু। প্লেনের ভাড়া জোগাড় হলেই চলে আসব।

    ও আচ্ছা! আব্বুর হঠাৎ করে কী যেন মনে পড়ল, পকেট থেকে একটা খাম বের করে টুম্পার হাতে দিলেন। বললেন, নে।

    এটা কী?

    এক্সিবিশনের ছবিগুলি থেকে যে টাকাটা এসেছে সেইটা ডলারে করে দিয়েছি। তোর আর প্লেনের টাকার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না।

    এই খানে কতো ডলার আছে?

    গুণি নাই। পাঁচ ছয় হাজার হবে।

    টুম্পা চোখ কপালে তুলে বলল, পাঁচ ছয় হাজার ডলার? সর্বনাশ! এতো টাকা নিয়ে আমাকে যেতে দেবে না।

    দেবে দেবে। আব্বু বললেন, এটা কী তুই চুরি করে নিচ্ছিস যে নিতে দেবে না?

    সবকিছুর একটা নিয়ম আছে–

    আব্বু হাত নেড়ে পুরোটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি কী নিয়ম ভেঙে তোকে টাকা দিচ্ছি? বাবা মেয়েকে টাকা দিতে পারবে না এটা কোন দেশি নিয়ম?

    আব্বু তুমি বুঝতে পারছ না—

    আমি ঠিকই বুঝতে পারছি, তুই বুঝতে পারছিস না।

    টুম্পা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমি এক হাজার ডলার নিয়ে যাই–একটা টিকেটের দাম।

    উহুঁ। আব্বু মাথা নাড়লেন, আমি এখানে টাকা দিয়ে কী করব?

    তোমার একটা টেলিফোন কিনতে হবে। আমি প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলব।

    ঠিক আছে কিনব।

    আর একটা কম্পিউটার কিনবে। তার সাথে ইন্টারনেটের কানেকশান।

    তাহলে আমি তোমাকে দেখতে পাব, তুমি আমাকে দেখতে পাব। ঠিক আছে?

    ঠিক আছে।

    সে জন্যে টাকাগুলো রাখ।

    আব্বু বললেন, আমার সেজন্যে টাকা আছে।

    টুম্পা বলল, কিন্তু আব্বু–

    আব্বু একটু আহত গলায় বললেন, টুম্পা তুই এমন করছিস কেন? এই পৃথিবীতে তুই ছাড়া আমার আর কে আছে? তোকে যদি না দিই তাহলে আমি কাকে দিব? তুই না-না করিস না তো। এমনিতেই আমার মন ভালো নেই, তুই আরো মন খারাপ করে দিচ্ছিস।

    টুম্পা একটু থতমত খেয়ে বলল, ঠিক আছে আব্বু। টুম্পা প্যাকেটটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, থ্যাংকু আব্বু। অনেক থ্যাংকু।

    আব্বু কোনো কথা বললেন না। কেমন যেন আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, টুম্পার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু দেখে মনে হয় আব্বু যেন ঠিক দেখছেন না। টুম্পা ডাকলো, আব্বু।

    হ্যাঁ মা।

    আমি প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলব আর প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখব।

    ঠিক আছে।

    তোমাকে কিন্তু উত্তর দিতে হবে। দিবে তো?

    দিব।

    আর তোমাকে ছবি আঁকতে হবে। বলেছ না যে বিশাল একটা ওয়েল পেইন্টিং করবে–সেটা শুরু করবে।

    শুরু করব।

    ওষুধ খেতে ভুলবে না। ঠিক আছে?

    ঠিক আছে।

    আমি কিন্তু খোঁজ নেব।

    ঠিক আছে।

    টুম্পা তার আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি এখন যাই?

    আব্বু টুম্পাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। টুম্পা বলল, যাই আব্বু?

    আব্বু ভাঙা গলায় বললেন, যা। কিন্তু টুম্পাকে যেতে দিলেন না, তাকে ধরে রাখলেন। টুম্পা খুব সাবধানে আব্বুর হাত সরিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো, সে আব্বুর মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না, তার শুধু মনে হচ্ছিল আব্বুর মুখের দিকে তাকালেই সে বুঝি ঝরঝর করে কেঁদে দেবে। টুম্পা আব্বুর হাত ধরে ফিস ফিস করে বলল, আবার দেখা হবে আব্বু।

    তারপর আবুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনে হেঁটে যেতে থাকে। চেকিং কাউন্টারের সামনে মানুষের লম্বা লাইন, টুম্পা সবার পিছনে দাঁড়িয়ে দেখলো আব্বু তখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে তার চারপাশে কী হচ্ছে আব্বু কিছুই বুঝতে পারছে না।

    মুখ ঘুরিয়ে টুম্পা তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। পিছনে দাঁড়ানো একজন বিদেশি মহিলা সেটা দেখতে পায় নি এরকম ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

    মিনিট দশেক পর টুম্পা ইমিগ্রেশানের লাইনে দাঁড়িয়েছে, বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, মনে হচ্ছে সে যেন একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, স্বপ্নের দৃশ্যগুলো সে দেখছে কিন্তু অনুভব করতে পারছে না। তার ঠিক পিছনে একজন মা তার ছোট ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ছেলেটা একটানা কথা বলে যাচ্ছে, মা ধৈর্য ধরে শুনছে মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে। ছোট ছেলের অর্থহীন কথা ভেবে টুম্পা কান দিচ্ছিল না হঠাৎ করে সে তার কথা শুনে চমকে উঠল। ছেলেটি জিজ্ঞেস করছে, আম্মু, কেন কাঁদছে মানুষটা?

    তার কেউ একজন চলে যাচ্ছে মনে হয় সে জন্যে কাঁদছে।

    তার কে যাচ্ছে?

    ছেলে কিংবা মেয়ে। কিংবা ওয়াইফ।

    কিন্তু আম্মু যারা ছোট তারা কাঁদে। বড় মানুষ কী কাঁদে?

    খুব যখন দুঃখ হয় তখন বড় মানুষেরাও কাঁদে।

    মানুষটাকে পুলিশ কেন ধরে রাখছে আম্মু?

    মানুষটা যে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে সে জন্যে।

    ছোট বাচ্চাটা মায়ের হাত ধরে বলল, মানুষটা কেন ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে আম্মু?

    মনে হয় যে চলে গেছে তাকে আরেকবার দেখতে চাচ্ছে।

    তাহলে পুলিশ কেন তাকে আসতে দিচ্ছে না?

    বাইরের কাউকে ভিতরে আসতে দেয়ার নিয়ম নাই তো, সে জন্যে।

    ছোট ছেলেটা সবকিছু বুঝে ফেলেছে এরকম ভঙ্গি করে গম্ভীর মুখে বলল,

    টুম্পা ফ্যাকাসে মুখে বাচ্চার হাত ধরে রাখা মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষটা কী ফর্সা? নীল রঙের ফতুয়া পরে আছে? জিন্স?

    মহিলাটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই টুম্পা ঘুরে পিছনে তাকালো তারপর একরকম ছুটে বের হয়ে গেল। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ তাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, টুম্পা তাকে কোনো সুযোগ দিল না। ছুটতে ছুটতে সে বের হয়ে আসে–এক কোণায় মানুষের জটলা, দুজন পুলিশকে দেখা যাচ্ছে, টুম্পা ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। হ্যাঁ, তার আব্বু মেঝেতে বসে হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে আকুল হয়ে কাঁদছেন। কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

    টুম্পা ছুটে গিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ডাকলো, আব্বু।

    আব্বু সাথে সাথে মুখ তুলে তাকালেন। টুম্পার দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বললেন, টুম্পা! তুই আমাকে ফেলে রেখে যাস নে মা!

    টুম্পা ফিস ফিস করে বলল, যাব না আবু। আমি তোমাকে ফেলে যাব না।

    সত্যি?

    সত্যি আবু। সত্যি।

    আব্বু তখন টুম্পাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা এখানে ভীড় করেছেন কেন? যান। যান, নিজের কাজে যান। ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তখন সরে যেতে থাকে।

    টুম্পা আব্বুর হাত ধরে যখন এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন কে একজন বলল, আপনি বোর্ডিং কার্ড নিয়েছেন–আপনি তো এভবে চলে যেতে পারেন না–আপনার লাগেজ?

    টুম্পা তার কথা না শোনার ভান করে বাইরে বের হয়ে এল। এয়ারপোর্টের বড় বারান্দায় দাঁড়িয়ে টুম্পা দেখলো আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে। মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে তার নীলাভ আলোতে সবকিছু কেমন যেন ঝলসে উঠচে।

    আব্বু বললেন, বৃষ্টি আসছে।

    টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আব্বু।

    অনেক বৃষ্টি।

    হ্যাঁ আব্বু, অনেক বৃষ্টি। তুমি বৃষ্টিতে ভিজবে আব্বু?

    তুই ভিজবি।

    হ্যাঁ।

    চল তাহলে?

    বড় বড় ফোঁটায় যখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে তখন সবাই অবাক হয়ে দেখলো ফুটফুটে একটা মেয়ে তার বাবার হাত ধরে রাস্তায় নেমে এসেছে। ঝমঝমে বৃষ্টিতে দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার মাঝে দুজন একজনকে আরেকজনকে ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে।

    পাশ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে যাবার সময় একটা ছোট ছেলে বলল, বাবা দেখো দেখো ঐ মানুষটা আর মেয়েটা কী সুন্দর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে।

    বাবা মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন, বললেন, হ্যাঁ বাবা।

    কেন তারা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে?

    মনে হয় তাদের মনে অনেক আনন্দ।

    আমাদের মনে যদি অনেক আনন্দ হয় তাহলে কী আমরাও বৃষ্টিতে ভিজব?

    হ্যাঁ বাবা তাহলে আমরাও বৃষ্টিতে ভিজব।

    ছোট ছেলেটি যতক্ষণ পারল ততক্ষণ টুম্পা আর তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল। আনন্দের কিছু দেখতে তার খুব ভালো লাগে।

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসায়েন্স ফিকশান সমগ্র ৩ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article নিতু আর তার বন্ধুরা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }