Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বোবা কাহিনী – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প320 Mins Read0

    ০৬-১০. সা-জী মশায়

    ০৬.

    “বলি, সা-জী মশায়! বাড়ি আছেন নাকি?”

    “এই দুপুর বেলা কে এল? আজাহের নাকি?”

    “স্যালাম কর্তা স্যালাম।”

    “স্যালাম, স্যালাম;–তা কি মনে করে আজাহের?”

    “এই আইলাম কর্তা, আপনার টাহা কয়ডা দিবার জন্যি।”

    “বটে! এরই মধ্যে টাহা জোগাড় করে ফেললি! তুই ত কম পাত্র নস রে!”

    “হে কর্তা! আজই পাট বেচলাম কিনা। তা ভাবলাম আপনার টাহা কয়ডা দিয়া আসি।”

    “তা কত টাকা বেচলি?”

    “এই বেশী নয় সা-জী মশায়। চাইর কুড়ি টাহা।”

    সা-জী মশায় এবারে চেয়ারের উপর একটু ঘুরিয়া বসিলেন। আজাহের মাটির উপর একখানা ছালা টান দিয়া তাহার উপর বসিল।

    বলিল, “কিরে এত টাকায় পাট বেচেছিস? তবে এবার এক কাজ কর। এই টাকা দিয়ে আরো কিছু জমি কিনে ফেল।”

    “জমি আর কি কইরা কিনব কর্তা! আপনার কর্জ টাহা শোধ দিতি অবি। তা ছাড়া। বছরের খোরাকি আছে।”

    “আরে আমার টাকার জন্য তুই ভাবিস নি। পনর টাকার ভারি ত সুদ। মাসে মাত্র দু’আনা কম দুটাকা। এ তুই যখন পারিস দিস। এক কাজ কর গিয়া। পলার চরে আমার দুই বিঘা জমি আছে। তার দাম দুইশ’ টাকা। তা তোকে আমি একশ টাকায় দিতে পারি।”

    “এত টাহা কোথায় পাব কর্তা! মাত্র চার কুড়ি টাহা পাট বেচছি।”

    “তার জন্য ভাবিস না। তুই আশি টাকা এখন দে। তারপর আগাম সন জমিতে ফসল হোলে বাকি টাকাটা দিয়ে দিস!”

    “এত দয়া যদি করেন কর্তা, তা ঐলে ত গরীর মানুষ আমরা বাইচা যাই।”

    “আরে গরীর-গরবা দেখতে হয় বলেই ত মারা গেলাম। এই দেখ, চরের জমিটার জন্য ও পাড়ার কালু সেখ এসে সেদিন একশ’ পঞ্চাশ টাকা নিয়ে কত সাধাসাধি। কিন্তু তোকে দেখে একশ টাকায়ই দিয়ে ফেললাম। আমার গিন্নি ত আমার উপর রেগেই আছে। বলে যত গরীব গরবাকে দয়া করা তোমার কারবার। আরে দয়া কি আমি করি–দয়া উপরওয়ালার।” এই বলিয়া সা-জী মশায় দুই হাত কপালে ঠেকাইলেন।

    কলকেটি আগুনের পাতিলের কাছে পড়িল ছিল। কথা বলিতে বলিতে আজাহের তাহাতে তামাক ভরিয়া নিপুণ হাতে তার উপর আগুন সাজাইয়া সা-জী মশায়ের হাতে দিল। সা-জী মশায়ের সামনের রূপা বাধান হুঁকোটির মাথায় কলকেটি বসাইয়া খানিকক্ষণ টানিয়া আজাহেরের হাতে দিল। দুই হাতের আঙ্গুলের মধ্যে কলকেটি সুন্দর করিয়া জড়াইয়া আজাহের সমস্ত শরীরের দম লইয়া গলগল করিয়া কলকেটিতে টান দিল। টানের চোটে কলকের মাথায় আগুন জ্বলিয়া উঠিল। নাকে মুখে একরাশ খুঁয়ো বাহির করিয়া আজাহের কহিল–”তা বাইবা দেহি সা-জী মশায়। ও বেলা আসপানি।” “অত ভাবিস যদি, কাজ নাই তবে জমি কিনে। আজ বিকালে কালু সেখের আসার কথা আছে। সে যদি আরো কিছু দাম বাড়ায় তবে হয়ত তাকেই দিয়ে ফেলতে হবে। তোর বরাত মন্দ–কি করবো?”

    “না, সা-জী মশায়! আমি এক্কে দৌড়ে যাব আর এক্কে দৌড়ে আসপ। আপনি জমিনটা অন্যেরে দিবেন না।”

    “আরে হাকিম নড়ে ত হুকুম নড়ে না। কথা যখন একবার তোকে দিয়ে ফেলেছি তখন তুই যদি জমি নিস অন্য কাউকে দিব না। তাড়াতাড়ি টাকা নিয়ে আয়।”

    আজাহের সা-জী মশায়কে সালাম করিয়া তাড়াতাড়ি টাকার জন্য বাড়িতে ছুটিল।

    জীবন ভরিয়া আজাহের মানুষের কাছে শুধু ঠকিয়াছে। কতবার সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে–আর সে মানুষকে বিশ্বাস করিবে না। নিজের প্রাপ্য একটি কানাকড়িও সে কাউকে ছাড়িয়া দিবে না। কিন্তু হতভাগ্য আজাহের জানে না, এই পৃথিবীতে যাহারা ঠকাইয়া বেড়ায়, নিত্য নিত্য তাহারা নিজেদের পোশাক বদলাইয়া চলে, ধর্ম নেতার বেশে, সাধু-মহাজনের বেশে, গ্রাম্য মোড়লের বেশে, কত ছদ্মবেশেই যে এই ঠকের দল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, মূর্খ আজাহের কি করিয়া তাহাদের হাত হইতে রক্ষা পাইবে? এ-পথে সাপিনীর ভয় ওপথেতে বাঘে খায়। এই ত জীবনের পথ।

    বাড়ি হইতে টাকা লইয়া আসিতে আসিতে আজাহেরের মনে দু’একবার যে সা-জী মশায়ের সাধুতার প্রতি সন্দেহ না হইল তাহা নহে, কিন্তু এমন ধার্মিক লোক, এমন মিষ্টি যার মুখের কথা, এমন ধোপ-দোরস্ত পোশাক পরিয়া যে সব সময় ফেরে তার প্রতি কি সত্য সত্যই সন্দেহ করা যায়? নিজের মনে মনে সে তাহার সাধুতার প্রতি যে সন্দেহ পোষণ করিয়াছে, সে জন্য সে অনুতাপ করিল। সা-জী মশায়ের বাড়ি যাইয়া, চলার মত। আশিটি টাকা সে গণিয়া দিয়া আসিল। না লইল কোন রসিদ পত্র, না রহিল কোন সাক্ষী-সাবুদ!

    সা-জী মশায় হাসিয়া বলিল, “তাহলে আজাহের আজ হ’তে তুই জমির মালিক হলি।”

    আল্লাদে আজাহেরের বুকখানা দুলিয়া উঠিল। সা-জী মশায়কে সালাম জানাইয়া জোরে জোরে সে পা চালাইয়া বাড়ি চলিল। যাইবার সময় আজাহেরের নাচিতে ইচ্ছা করিতেছিল। সব মিলিয়া এখন তাহার চারি বিঘা পরিমাণ জমি হইল। সেই চারি বিঘা জমিতে আজাহের পাট বুনিবে, ধান বুনিবে, সরষে ফলাইবে, মটরশুটি ফলাইবে। তার বউ সেই খেতে এক মাথা ঘোমটা পরিয়া শাক তুলিতে আসিবে।

    .

    ০৭.

    সত্য সত্যই আজাহেরের জমিতে সোনা ফলিল। চার বিঘা জমির দুই বিঘাতে সে। পাট বুনিয়াছে আর দুই বিঘাতে ধান। পাটের ডগাগুলি যেন ল্যাক ল্যাক করিয়া আকাশ ছুঁইতে চায়। আর তার জমিতে যা ধান হইয়াছে, আকাশের মেঘভরা আসমানখানা কে তাহার জমিতে লেপিয়া দিয়াছে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ চলিয়া গেল। আষাঢ় মাসের শেষের দিকে খেতের শোভা দেখিয়া আজাহেরের আর বাড়িতে আসিতে ইচ্ছা করে না। খেতের মধ্যে একটা ঘাস গজাইলেই সে তাহা নিড়াইয়া ফেলে। তার চার বিঘা জমির উপর দিয়া যখন বাতাস দুলিয়া যায়, তখন তার অন্তরের মধ্যেও ঢেউ খেলিয়া যায়। সমস্ত খেতের শস্যগুলি যেন তার সন্তান। আজাহেরের ইচ্ছা করে, প্রত্যেকটি ধানের গাছ ধরিয়া, প্রত্যেকটি পাটের চারা ধরিয়া সে আদর করিয়া আসে।

    সন্ধ্যা বেলায় আজাহের ঘরে ফিরিয়া যায়। ঘরে ফিরিতে ফিরিতেও আজাহের দুই তিনবার তার খেতের দিকে পিছন ফিরিয়া চায়। খেতের শোভা দেখিয়া তার আশ মেটে না। বাড়ি আসিয়া দেখে, বউ রান্না করিতেছে। তার পাশে একখানা পিড়ি পাতিয়া বসিয়া আজাহের বউ-এর সঙ্গে গল্প করিতে বসে। আর কোন গল্প নয়। ধানক্ষেতের গল্প, পাটক্ষেতের গল্প। ও-পাড়ার বরান খা আজ আজাহেরের খেতের আলি দিয়া যাইতে যাইতে বলিয়া গিয়াছে, তোমার খেতে খুব কামিল-কারী করিয়াছে মিঞা! তোমার ধানখেত না যেন সবুজ টিয়া পাখিগুলি শুইয়া আছে।

    সেই কথা আজাহের আরো বাড়াইয়া বউ-এর কাছে বলে। শুনিতে শুনিতে বউ-এর মুখ খুশীতে ভরিয়া উঠে।

    তারপর গামছার একটি খুঁট খুলিতে খুলিতে আজাহের বলে, “আমার পাটখেতে বউটুবানী ফুল ঐছিল। তোমার জন্যি নিয়া আইলাম।”

    ফুলগুলিকে খোঁপায় জড়াইতে জড়াইতে বউ বলে, “ওবেলা যে পাট শাক তুইলা আনবার কইছিলাম, তা আমাগো বাড়ির উনি আনছে নি?”

    “দ্যাহ, পাট শাক আমার তুলিতি ইচ্ছা করে না। ওরা যখন বাতাসের সঙ্গে হেইলা ল্যাগ ল্যাগ করে আমার মনে অয়, যিনি ওরা আমাগো পোলাপান। ওগো গায় ব্যথা দিতি মনডা যিনি কেমন করে।”

    বউ এবার কতটা লজ্জা লজ্জা ভাব মিশাইয়া বলে, “দেহ, তোমারে একটা কথা কইবার চাই।”

    “আমাগো বাড়ির উনি কি কতা কইবার চায় হুনি?”

    “না কব না।”

    “ক্যান কইবা না! কইতি অবি।”

    আজাহের যাইয়া বউ-এর হাতখানা ধরে।

    “ছাইড়া দাও। খুব লাগতাছে।”

    “না ছাড়ুম না।”

    এবার বউ আজাহেরের হাতখানায় কৃত্রিম কামুড় দিতে গেল।

    আজাহের বলে, “আইচ্ছা কামড়াও, কুত্তা যখন ঐছ, তহন কামড়াও।”

    “কি আমাগো বাড়ির উনি আমারে কুত্তা কইল? আমি কুনু কতা কইব না।”

    “না না কুত্তা ঐবা ক্যান? তুমি ঐলা আমার ধানখেত, তুমি ঐলা আমার পাটখেত। তোমারে আমি নিড়ায়া দিব। তোমার গায়ে আমি পানি ঢালব।”

    “হ হ বুজা গ্যাছে! তুমি খালি কতার নাগর। সারাদিন খেতে বইসা থাহ। আমার কতা একবার মনেও কর না। কও ত! খালি বাড়ি, আমি একলা বউ থাহি কি কইরা? যাও তুমি তোমার পাট লইয়াই থাহ গিয়া। রাত্তিরি আর বাড়ি আইলা ক্যান?” বলিতে বলিতে বউ কাঁদিয়া দিল।

    সত্য সত্যই একথা ত আজাহেরের মনে হয় নাই। গত তিন মাস সে মাঠে মাঠেই কাটাইয়াছে। বাড়ি আসিয়া বউ-এর সঙ্গে খেত-খামারের কথাই আলাপ করিয়াছে। বউ-এর দিন কেমন করিয়া কাটে, সে কেমন আছে তাহার দিকে ত আজাহের একবারও ফিরিয়া তাকায় নাই। কাঁধের গামছার খোটে বউ-এর চোখ মুছিতে মুছিতে আজাহের নিজেই। কাঁদিয়া ফেলিল। সত্য সত্যই ত বউ-এর ঠোঁট দুখানা যেন কেমন নীল হইয়া গিয়াছে, শরীর যেমন ভার ভার। বউ-এর একখানা হাত নিজের বুকের মধ্যে পুরিয়া আজাহের বলে, “মনি! তুমি রাগ কইর না। আমি চাষা মানুষ। তোমারে কি কইরা আদর-যত্তন করতি অবি তা জানি না। আহারে! তোমার সোনার অঙ্গ মইলান অয়া গ্যাছে। আমি কি করবরে আজ?”

    এবার বউ খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, “কেমুন তুমারে জব্দ করলাম কি না?”

    “আচ্ছা আমি পরাস্ত মানলাম। এবার কও ত সোনা! কি কতা কইবার চাইছিলা?”

    “কইলি কি অবি? তুমি বুজবা না।”

    “আচ্ছা কওই না একবার?”

    “আইজ দুই মাস ধইরা আমার কেবলই গা বমি বমি করে, কিছুই খাইবার ইচ্ছা করে না।”

    “তয় এদ্দিন কও নাই ক্যান? আমি এহনি রামে-রাজরে ডাইকা আনবানি, তোমারে ওষুধ করবার জন্যি।”

    আজাহেরের মুখে একটা ঠোকনা দিয়া বউ বলিল, “তুমি কিছুই বোঝ না।”

    “ক্যান বুঝব না? তোমার অসুখ ঐছে। আমি বুঝব না ত কি বুঝবি? তুমি বইস, আমি রামে-রাজরে ডাইকা আনি গিয়া।”

    “আরে শোন? আমার খালি চাড়া চাবাইতে ইচ্ছা করে।”

    “তা ঐলি তুমার অসুখ আরো কঠিন। রামে-রাজরে এহনি ডাকতি অবি।”

    আজাহেরের মুখে আর একটি ঠোকনা মারিয়া বউ বলিল,–”তুমি ছাই বোঝ।”

    এবার বউ হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। আজাহের ব্যস্ত সমস্ত হইয়া গামছাখানা মাথায় জড়াইয়া রামে-রাজের বাড়ি যায়ই আরকি। বউ তাহার হাত দুখানা ধরিয়া বলিল, “শোনই না একবার? আমারে দেইখা ও বাড়ির বু’জী কইছে কি!”

    “কি কইছে? কও–কও।”

    বউ আর একটু লজ্জিত হাসি হাসিয়া বলিল, “আমি কইবার পারব না। আমার সরম লাগে।”

    “আমার সুনা, আমার নককী তুমি আমারে কও। আমার কাছে তুমার সরম কিসির?”

    “তবে তুমি আমার মুহির দিগে চাইবার পারবা না। ওই দিগে চাও, আমি কই।”

    আজাহের পিছন ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, “এই আমি দুই হাতে চোখ বন্ধ করলাম, এবার তুমি কও।”

    “তুমি কইলা না? তুমার খ্যাতের ধানগুলান তুমার কাছে কিসির মত লাগে যিনি?”

    এবার আজাহের বউ-এর দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, “কইলাম ত খ্যাতের ধানগুলা না যেন আমার একখ্যাত ভরা পুলাগুলা নাচত্যাছে।”

    বউ আজাহেরের মুখে আর একটা ঠোকনা দিয়া বলিল, “যাও তুমি আমার দিগে চাইতাছ।”

    “না না এই যে আমি অন্য দিগে চাইলাম।”

    “ও বাড়ির বুজী কইছে কি, আর কয়মাস পরে আমার তাই ঐব।”

    “কি কইলা? পুলা ঐব। আমার পুলা ঐব। ও মাতবরের বেটা, হুইনা যান। হুইনা যান। রবানের বাপরে ডাক দেন।”

    “আরে চুপ চুপ! মানুষ হুনলি কি কইবি।” বউ তার দুখানা সোনার হাত দিয়া আজাহেরের মুখখানা চাপিয়া ধরিল। কিন্তু আজাহেরের মনের তুফানে সেই সুন্দর হাত দু’খানা কোথায় ভাসিয়া গেল। ডাক শুনিয়া মিনাজদ্দী মাতবর আসিয়া উপস্থিত হইল। রবানের বাপ আসিয়া উপস্থিত হইল। বউ ত লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে চায়। সেদিকে আজাহেরের কোন খেয়ালই নাই।

    “কি আজাহের খবর কি?”

    “বসেন মাতবর সাহেব। খবর বড় ভাল খবর। আমাগো ও-পাড়ার বচন মোল্লারে ডাক দিতি অবি। রহিমদ্দী কারিকররেও ডাকতি অবি?”

    “ক্যান মিঞা! লগনডা কি?”

    “লগন আর কি! আমার বাড়িউয়ালী, কইবার ত চায় না। অনেক নিরায়া পিরায়া করতি করতি তয় কইছে, আর একমাস পরে আমার একটা পুলা অবি!”

    বউ রান্নাঘরের ও-পাশ হইতে আজাহেরকে কত রকম ইসারা করিতেছে সেদিকে আজাহেরের খেয়ালই নাই।

    “বুজছেন নি মাতবরের পো? আমার একটা পুলা অবি! খ্যাতে যহন দুইপার বেলা। তিষ্টাতে ছাতি ফাঁইটা যাইতি চাবি তহন আমার পুলা পানির বদনা নিয়া খ্যাতে যাবি। তামুক সাইজা নিয়া হাতে উক্কা দিবি। পুলার হাতে লাঙলের গুটি সইপা দিয়া একপাশে দাঁড়ায়া তামুক খাব আর পুলার হাল বাওয়া দেখপ।”

    “খুব খুশীর কতা আজাহের। তবে আইজ খুশীর দিনি তোমার বাড়ি একটু গান-বাজনা ওক। খাড়াও, আমি গেরামের সগলরে ডাক দিয়া আনি! তুমি পান-তামুক জোগার কর।”

    আধঘণ্টার মধ্যে আজাহেরের সমস্ত বাড়িখানা ভরিয়া গেল। ও-পাড়া হইতে রহিমদ্দী কারিকর আসিল। বচন মোল্লা আসিল। তিলাজুদ্দী, ভুমুরদ্দী কেউ কোথাও বাদ রহিল না। খুঞ্জরীর বাজনায় আর গ্রাম্য-গানের সুরে সমস্ত গ্রামখানা নাচিয়া উঠিল।

    প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত গ্রামবাসীরা আনন্দ কোলাহল করিয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল।

    আজাহেরের মুখে ঠোকনা মারিয়া বউ বলিল, “বলি আমাগো বাড়ির উনির কি লজ্জা সরম একেবারেই নাই? এত লোকের মধ্যে ওই কথা কইল, সরম করল না?”

    “সরম আবার কিসের? আমাগো পুলা অবি। তা সগলরে জানাইয়া দিলাম। আমি এবার পুলার বাপ। ও-পাড়ার ঝড়! এতটুকুন ছাওয়াল, আমারে ডাকে, ও আজাহের! হুইনা যাও। ইচ্ছা করে যে মারি এক থাপর তার মুখ পাইচা। আমি যেন কেউকেডা নয়। এবার মানষি জানুক আমি পুলার বাপ। আমার গুণে যদি আমারে মানতি না চায় আমার পুলার গুণে মানবি।”

    “পুলা হওয়ার আগেই ত তুমি অহঙ্কারে ফাঁইটা পড়লা। আগে পুলা হোক ত।”

    তারপর দুইজনে বিছানায় শুইয়া গলাগলি ধরিয়া কথা আরম্ভ হইল। এবার পাট বেচিয়া আজাহের পুলার পায়ের ঝাজ কিনিয়া আনিবে। নারকেল গাছের পাতা দিয়া ভেপু বাঁশী বানাইবে। বউ পুলার কাথার উপর বিড়াল আঁকিয়া রাখিবে। পুলা দুধের বাটি মুখে দিতে দিতে বলিবে,–”ওমা! বিলাই খেদাইয়া যাও। আমার দুধ খায়া গেল।”

    আজাহের বলে, সে পুলার জন্য শোলা কাটিয়া পাখি বানাইয়া দিবে। পুলা তার মাকে ডাকিয়া বলিবে,–”ওমা! আমারে ত খাইবার দিলা। আমার পাখিরে ত দিলা না?”

    এমনই কত রকমের কথা। পুলা বড় হইয়া খেত হইতে ধান টোকাইয়া আনিবে। মাকে আসিয়া বলিবে, “ওমা! এখুনি আমারে এই ধান দিয়া পিঠা বানায়া দাও।”

    এমনই কথায় কথায় কখন যে রাত কাটিয়া গেল, তাহারা টেরও পাইল না।

    .

    ০৮.

    আষাঢ় মাসের পরে শাওন মাসের মাঝামাঝি ঘন বৃষ্টি পড়িতেছে। চারিদিক অন্ধকার করিয়া আকাশ ভরা মেঘ। বর্ষার জল আসিয়া সমস্ত গ্রামখানাকে ভরিয়া তুলিয়াছে। আউস ধানের খেতগুলিতে কে যেন সোনা ছড়াইয়া দিয়াছে।

    কলার ভেলাখানি লগিতে ঠেলিতে ঠেলিতে আজাহের তাহার খেতে আসিয়া উপস্থিত হইল। মোটা মোটা আউস ধানের ছড়াগুলি এক হাঁটু পানির উপরে মাথা তুলিয়া বাতাসে দুলিয়া সুগন্ধ ছড়াইতেছিল। এদের প্রত্যেকটি ধানের গুচ্ছের সঙ্গে আজাহেরের পরিচয় আছে। ওরা এতটুকু ছিল। নিড়াইয়া কুড়াইয়া সে তাহাদের এতবড় করিয়াছে। আর দুই তিনদিন যদি বর্ষার পানি না বাড়ে তবে আজাহের আঁটি আঁটি ধান কাটিয়া বাড়ি লইয়া যাইবে। খেতের মধ্যে কোথা হইতে কতকগুলি আগাছা পানা আসিয়া জড় হইয়াছে। সে একটি একটি করিয়া পানা তুলিয়া তাহার ভেলায় আনিয়া জড় করিতে লাগিল। সেইগুলি সে অন্যত্র ফেলিয়া দিবে।

    এমন সময় শরৎ সাহা একখানা নৌকায় করিয়া আট দশজন কামলা লইয়া খেতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল।

    “সা-জী মশায় স্যালাম।” আজাহের সেলাম করিয়া জিজ্ঞাসা করে, “তা কি মনে কইরা?”

    “এই এলাম দেখতে খেতের ধানগুলো পেকেছে কিনা। ওরে, তোরা দাঁড়িয়ে রইলি কেন? কেটে ফেল, কেটে ফেল ধানগুলো।”

    আট দশজন কামলা কাস্তে লইয়া ধান কাটিতে আরম্ভ করিল। অনেকক্ষণ আজাহের কোন কথাই বলিতে পারিল না। তাহারই খেতের ধান অপরে কাটিয়া লয়। কিন্তু কি করিয়া প্রতিবাদ করে আজাহের তাহাও জানে না।

    শরৎ সাহা তাহার পুরাতন চশমা জোড়া চাঁদরের খোটে মুছিতে মুছিতে তাহার লোকজনদের বলে, “ওরে তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর। একদিনের মধ্যেই সমস্ত ধান কেটে নিয়ে যেতে হবে। এখন কলিকালের দিন ত। কে কোথা থেকে এসে বাধা দেয় বলা ত যায় না।”

    নিজের খেতের ধানগুলি উহারা লইয়া যাইতেছে। কাস্তের আঘাতে ধানগুলি খসখস করিয়া কাটিতেছে। আজাহেরের বুকের ভিতরে যাইয়া যেন কাস্তের আঘাত লাগিতেছে। সে হঠাৎ খেতের মাঝখানে আসিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। “দোহাই সা-জী মশায়! আমার খেতের ধান কাটপেন না।”

    শরৎ সাহা যেন আকাশ হইতে পড়িয়া গেল, “শুনছ কামলা মিঞারা! কইলাম না? কলিকাল কাকে বলেছে? তোর জমিতে আমি ধান কাটতে এসেছি। তোর জমি? তোর দখলে আছে? পরচা আছে? আরে আজাহের! কলিকাল হ’লেও ধরাটাকে সরা জ্ঞান করা যায় না। আজ আশি বছর ধরে আমার বাবার আমল থেকে এই জমি ভোগ-দখল করছি। আর আজ তুই এসে বলছিস, এ জমি আমার!”

    আজাহের এ কথার আর কি জবাব দিবে? সে শুধু বলিল, “সা-জী মশায়! আপনারা ভদ্দর লোক, মুখি যা বলেন তাই লোকে বিশ্বাস করবি। কিন্তুক আইজও রাইত দিন বইতাছে। কন ত দেহি গত সন ভাদ্র মাসে চার কুড়ি টাহা নিয়া এই জমি আমারে দিছিলেন কিনা? উচা মুখে নিচা কথা কইবেন না।”

    সা-জী মশায় কাষ্ঠ হাসি হাসিয়া বলিলেন, “শোন কামলা মিঞারা। আশি টাকায় দুই বিঘা জমিন ওরে আমি দিয়েছিলাম? দুই বিঘা জমির দাম দু’শ টাকা। ও আমার নাত জামাই কি না, সেই খাতিরে ওকে আশি টাকায় জমি দিয়েছিলাম।”

    “দিছিলেন না সা-জী মশায়? কইছিলেন না? এখন আশি টাকা দে, আগামী সন পাট বেইচা বাকি কুড়ি টাকা দিস। আমি চলার মতন চার কুড়ি টাহা আপনারে গইনা দিয়া আইলাম।”

    এইসব কথা শুনিয়া কামলারা ধান কাটা রাখিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। শরৎ সাহা তাদের তাড়া দিয়া বলিলেন, “আরে মিঞারা! শীগগীর শীগগীর কর। দেখছ না কোথাকার বাতাস কোথায় গিয়ে লাগে?”

    কামলারা আবার কাজ আরম্ভ করিল। আজাহের সা-জী মশায়ের পা দু’টি জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “সা-জী মশায়! আপনারও যদি জমিন অয়, আমি ত ধান বুইনাছি। সারা বছর কি খায়া থাকপ? অর্ধেক আমার জন্য রাইখা যান।”

    সা-জী মহাশয় পা দিয়া আজাহেরকে ঝাড়া দিয়া ফেলিয়া বলিল, “তুমি কি খাবে তার খবর কি আমি রাখব? জমি চাষ করেছ। আমার কাছ থেকে গত বছর পনর টাকা কর্জ নিয়েছিলে। তারই সুদে তুমি আমার জমি চাষ করেছ।”

    কামলারা ধান কাটিতেই ছিল। আজাহের এবার তাহাদের সামনে আসিয়াই দুই হাত উর্দ্ধে তুলিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, “দোহাই দিছি কোম্পানী বাহাদুরের, দোহাই মহারাণী মার। মিঞারা তোমরা আগগাওরে, আমার জমির ধান কাইটা নিয়া গ্যাল। ও মাতবরের পো! ও বরান খাঁ। তোমরা আগগাও–আমার জমির ধান কাইটা লয়া গেল।”

    চীৎকার শুনিয়া মিনাজদ্দী মাতবর নৌকা বাহিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নৌকায় দশ বার জন লোক। বরান খাও কলার ভেলা বাহিয়া আসিল।

    আজাহের এবার আরো জোরে জোরে চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল, “দোহাই দিছি কোম্পানীওয়ালার, দোহাই দিছি ইংরাজ বাহাদুরের, মিঞারা তোমরা দেইখা যাও, আমার জমির ধান কাইটা নিয়া গ্যাল।”

    শরৎ সাহা আস্তে আস্তে তার কামলাদের বলিল, “আরে তোরা এসব কথার মধ্যে থাকবিনে। তাড়াতাড়ি ধান কেটে ফেল। ডবল দাম দিব আজকের রোজের।”

    মিনাজদ্দী মাতবর শরৎ সাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বলি সা-জী মশায়! খবরডা কি?”

    “এই যে মাতবর এসেছে, ভালই হয়েছে। তোমরাই এর বিচার কর। তোমরা ছোটলোক হ’লেও তোমাদের মধ্যে ত ন্যায়-অন্যায় বিচার আছে। তোমাকেই সালিস মানলাম তুমি এর বিচার কর।”

    “ওমন কথা মুহিও আনবেন না কর্তা। আপনারা ঐছেন মানি লোক। আপনাগো বিচার আমরা করতি পারি? কতাডা কি তাই আগে আমাকে বলেন।”

    “শোন তবে বলি মাতবর। জান ত তোমার অনুরোধেই সে বছর আমি ওকে পনর টাকা কর্জ দিলাম। গত ভাদ্র মাসে ও আমাকে যেয়ে ধরল, কর্তা, গরীব মানুষ। এবারকার সুদের টাকা দিতে পারব না। হাতে পায়ে যেয়ে ধরতে লাগল। তখন কি করি! দয়ার শরীর ত। তোমরা আমাকে যাই মনে কর না কেন, কেউ এসে ধরলে আমি আপনা থেকেই গলে যাই। গলে যখন গেলাম তখন আর কি করি? বললাম আমার দুই বিঘা জমি চাষ করে দে, এ বছরে তোর থেকে আর কোন সুদ নিব না। তোমাদের মাতবর! সবাই বলে ছোটজাত। তা ছোটজাত হলেই কি লোকের ধর্ম-জ্ঞান থাকে না। এখন আজাহের বলে যে ওর জমিতে ও ধান বুনেছে। আমি জোর করে সেই ধান কাটতে এসেছি।”

    “দেখেন সা-জী মশায়। বারবার আমাগো ছোটজাত কইছেন। আপনারা ত বড়জাত কিন্তুক বড়জাতের মত ব্যবহারডা ত দেখলাম না।”

    “মিনাজদ্দী! মুখ সামলায়া কথা কইও। মনে রেখ তুমিও আমার কাছে দু’শ টাকা ধার।”

    “মুখ সামলাব কার কাছে মশায়। আপনার ত কুত্তার মুখ। আমি জানি না? গত সন ভাদ্র মাসে এই বেচারী গরীব মানষির কাছ থাইকা আশি টাহা নিছেন জমির দাম। আইজ কইবার আইছেন জমি আপনার। দয়ার শরীর আপনার, জমিটা এরে দয়া কইরাই বুনবার দিছেন! আজ দয়া কইরাই গরীব মানষীর মুখির বাত কাইড়া নিবার আইছেন। এ জমির ধান আপনারে কাটপার দিব না।”

    “দেখ মিনাজদ্দী! সাপ নিয়ে খেলা খেলছ–মনে রেখ। সদর কোর্ট, দেওয়ানী আদালত। মনে যেন থাকে। বড়শি দিয়ে টেনে এনে তবে নাগরদোলায় চড়াব।”

    “আরে মশায়! দেখাওগ্যা তোমার দেওয়ানী আদালত। আমাগো আদালতের বিচারডা আগে কইরা নেই। আজাহের! চহি দেখতাছ না? ধান কাটপার লাইগা যাও।”

    মিনাজদ্দী মাতবরের লোক আজাহেরের সঙ্গে ধান কাটা আরম্ভ করিয়া দিল।

    শরৎ সাহা খানিকক্ষণ চাহিয়া দেখিয়া তাহার লোকজন লইয়া চলিয়া গেল।

    সত্য সত্যই মিনাজদ্দী মাতবরের লোক আজাহেরের খেতের সমস্ত ধান একদিনেই কাটিয়া আনিল। আজাহেরের সমস্ত বাড়িখানা ধানে ভরিয়া গেল। আজাহের উঠানের এক পাশে ধানগুলি পরিপাটি করিয়া সাজাইল! সমস্ত বাড়িখানা নতুন ধানের গন্ধে ভরিয়া গেল। আজাহের একবার ধানের পালার দিকে চাহে আর একবার পাকা ধানেরই মত গায়ের রঙ তার বউয়ের দিকে চাহে। বউ-এর আজ মোটেই অবসর নাই। ধান উড়াইতে, ধান রোদে দিতে, কোন দিক দিয়া যে বেলা কাটিয়া যায় তা বুঝিতেও পারে না। বর্ষার দিনে যখন তখন মেঘ করিয়া বৃষ্টি নামে। তাড়াতাড়ি উঠানের ধানগুলি ঘরে আনিতে হয়। এত যে কাজ তবু তার এতটুকু পরিশ্রম হয় না।

    সময় মত খাওয়া হয় না। সুন্দর করিয়া খোঁপা বাঁধা হয় না। বউ-এর সারা গায়ে ধানের কুটো জড়ানো। মাথার চুলে গুচ্ছ গুচ্ছ ধান ঝুলিতেছে। এগুলিতে আজ তাকে যা মানাইয়াছে! আজাহের ভাবে সোনা-রূপার গহনা পরিয়া সাজিয়া গুঁজিয়া যদি বউ থাকিত তাতেও তাকে অতটা মানাইত না।

    ধান কাটা হইতে না হইতে পাট আনিয়া আজাহের বাড়িতে জড় করিল।

    এই সব কাজকর্মে আজাহের শরৎ সাহার ভয় দেখানোর কথা সমস্তই ভুলিয়া গেল। গত বছর পাট বেচিয়া আজাহের ঠকিয়াছিল। এবার সে কিছুতেই ঠকিবে না। গ্রামের ফড়িয়া, পাটের বেপারীরা–নানা রকম গাল-গল্প করিয়া আজাহেরের প্রশংসা করিয়া বৃথাই ফিরিয়া গেল। আজাহের সমস্ত পাট মাপিয়া পাঁচ সের করিয়া ধড়া বাঁধিয়া মিনাজদ্দী মাতবরের নৌকায় করিয়া ফরিদপুরের হাটে যাইয়া পাট বেচিয়া আসিল। এবার পাট বেচিয়া আজাহের পাঁচশত টাকা পাইল। এই টাকা আনিয়া সে একটা মাটির হাঁড়িতে আবদ্ধ করিয়া হাঁড়িটা ঘরের মেঝেয় গাড়িয়া রাখিল।

    .

    ০৯.

    সেদিন টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছিল। গ্রামের দুই তিনজন লোকের সঙ্গে আজাহের ঘরের বারান্দায় বসিয়া গল্প করিতেছিল আর পাটের দড়ি পাকাইতেছিল। এমন সময় আচকান পায়জামা পরা দুইজন যুবক মৌলবী আসিয়া ডাকিল,–”আজাহের মিঞা! বাড়ি আছেন নাকি?”

    আজাহের তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে যাইয়া পাড়ার একটা ছোকরাকে কি যেন বলিল। সেই ছোকরাটি আওগাইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আজাহের মিঞারে কি জন্যি।”

    মৌলবী দুইজন বলিলেন, “আমরা পীরপুরের মৌলানা সাহেবের তালেব-এলেম। মৌলানা সাহেব এদেশে তছরীফ আনছেন। সেই জন্য আজাহের মিঞারে খবর বলতে আইলাম।“

    আজাহের ঘরের মধ্য হইতে সমস্তই শুনিতেছিল। সে যখন বুঝিতে পারিল উহারা মৌলবী সাহেবের লোক, শহর হইতে পরওয়ানা লইয়া কোন পেয়াদা আসে নাই তখন সে তাড়াতাড়ি আসিয়া তালেব-এলেমদের সামনে দাঁড়াইল। তাঁহারা আচ্ছালামু আলায়কুম বলিয়া আজাহেরের হাত ধরিয়া দরূদ পড়িল। এমন সম্মানের সহিত আজাহেরের সঙ্গে কেহই ব্যবহার করে নাই। আজাহের মৌলবীদের ব্যবহারে একেবারে মোহিত হইয়া গেল। মৌলবীদের মধ্যে যে একটু বড় সে আজাহেরের মুখের কাছে হাত ছোঁয়াইয়া সেই হাত চুম্বন করিয়া কহিলেন, “গ্রামে আসতেই খবর শুনলাম, আজাহের মিঞা, তা নামেও যেমনি কামেও তেমনি। আপনার মতন ভাগ্যবান লোক দুনিয়ায় হয় না।”

    দ্বিতীয় মৌলবী আরবী হইতে সুর করিয়া একটা শ্লোক পড়িলেন, “খোদাওয়ান তায়ালা জাল্লা জালালুহু কোরান শরীফ মে ফরমাইয়াছেন,–”আয়ুর্যেবিল্লাহে মিনাশ শয়তানের রাজিম। অর্থাৎ কিনা যে নাকি পরহেজগার নেকবক্ত আল্লাহ তায়ালা হঠাৎ তার কপালডারে খ্যাডেড় পালাডার মত উচা কইরা দেন।”

    বড় মৌলবী তার সুর আরো একটু চড়া করিয়া পড়িলেন, “আলহামদো লিল্লাহে রাব্বেল আলামিন আর রহমানের রহিম মালেকে ইয়াউমেদ্দিন।”

    অর্থাৎ কিনা, আমার খোদাওয়ান করিম বলেছেন–হে আমার বান্দাগণ, আমার যদি হুকুম না হয় তবে হস্তি দিয়াও তুমি মাকড়ের আঁশ ছিড়বার পারবা না।

    খোদাওয়ান তায়ালা আরো বইলাছেন, আমার যদি হুকুম না হয় তবে বন্দুক দিয়া দ্যাওড় কইরা কাতরা, লাঠি, কুড়াল মাইরা একটা বনের মশারেও তুমি মারবার পারবা না।” এই পর্যন্ত বলিয়া বড় মৌলবী সাহেব হাঁপাইতে লাগিলেন।

    ছোট মৌলবী সাহেব আবার আরম্ভ করিলেন, “আমার খোদা জাল্লা জালালাহু পাক পরওয়ারদেগার আরো ফরমাইয়াছেন, হে আমার বান্দাগণ আমি যদি ইচ্ছা করি, আমার যদি দিলে কয় তবে আকাশের চান্ডার উপরে আমি একজন পথের ফকিরকে বসাইতে পারি।”

    প্রথম মৌলবী এবার তছবীহ জপিতে জপিতে কাঁদিয়াই ফেলিলেন। “দেখ মিঞা আজাহের! খোদা আইজ তোমারে মুক তুইল্যা চাইলেন। আকাশের চান-সুরুজ আইনা তোমার হাতে দিলেন। গ্রামের সকল লোক তোমার নছিবের জন্য হিংসা করবি।” আজাহের সমস্ত শুনিয়া অবাক হইয়া ভাবিতেছিল,–কি সৌভাগ্য আজ তাহার হইল।

    দ্বিতীয় মৌলবী এবার খুব জোরে জোরে খানিক মোনাজাত করিয়া বলিলেন,–”দেখেন মিঞা আজাহের! আজ পিরান পীর ছৈয়দে মক্কা-মদীনা শাহসুফি মোহাম্মদ তজুম্বর আলি খাকসার সাহেব জনাবে নিজামুদ্দীন আলায়হে ছালাম পীরপুরী আপনার বাড়িতে তছরীফ আনত্যাছেন। পীর সাহেবের বজরা শরীফ বাদামতলীর ঘাট হইতে রওয়ানা হইয়া আপনার বাড়ির দিক আসত্যাছেন।”

    দ্বিতীয় মৌলবী আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন, “দেখেন মিঞা আজাহের! খোদার। তারিফের কি খুবী, ঐ গেরামে আরো তো কত আলেম, ফাজেল, জমিদার, জোদ্দার। সাহেবান আছেন। তারা সকলেই পীর সাহেবকে পাইলে তোলা তোলা চান্দি রূপার মত তানারে মাথায় করিয়া নিয়া যাব্যানে।”

    প্রথম মৌলবী হাতের তছবীর মালাটি চুম্বন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ও গিরামের গৈজদ্দী খালাসী কাইল পীর সাহেবের দুই পা জড়ায়া ধইরা কত কানতে লাগলেন। পীর সাহেব! একটু পায়ের ধূলি আমার বাড়িতে দিয়া যান। পীর সাহেব রাজী হইলেন না। কিন্তু আপনার কি ভাগ্য যে বিনি দাওয়াতে পীর সাহেব আজই আপনার বাড়িতে তছরীফ আনত্যাছেন। ওই যে ধলা জল-পিংলাসের নাও সাজায়া পীর সাহেব আসত্যাছেন। জলদী বাড়ির ভিতর যান। পীর সাহেবের জন্য সামিয়ানা তয়ার করেন গ্যা।”

    এই সব শুনিয়া আজাহেরের মন আনন্দে মশগুল হইয়া গেল। সত্যই ত কত বড় সৌভাগ্য তার! সে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর যাইয়া তিনটি মুরগী জবাই করিয়া ফেলিল। বউকে তাড়াতাড়ি ভাত রাধিতে বলিয়া দিল। মিনাজদ্দী মাতবরের বাড়ি হইতে হাতল ভাঙ্গা চেয়ারখানা আনিয়া পীর সাহেবের বসার জায়গা করিল। পীরপুরের মৌলানা সাহেব আজাহেরের বাড়িতে আসিতেছেন। এ খবর শুনিয়া গ্রামের আরো আট দশজন লোক তাহার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। পীর সাহেবের প্রেরিত তালেবে-এলেম দুইজন। তাহাদের সকলেরই হাতে হাত মিলাইয়া দরূদ পড়িলেন এবং তাহাদের দাড়িতে হাত ছুঁয়াইয়া সেই হাত চুম্বন করিলেন। গ্রামের লোকেরা যেন কৃতার্থ হইয়া গেল। তাহারা। সকলেই স্বীকার করিল, এমন বড় মৌলানা তাহাদের দেশে আর কখনও আসে নাই। সুতরাং আজাহের তাহার গরুর ঘরখানা পরিষ্কার করিয়া খড় বিছাইয়া তাহার উপরে খেজুরের পাটির বিছানা পাতিয়া রাখুক।

    শুভক্ষণে মৌলানা সাহেবের বজরা আজাহেরের বাড়ির ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জলপিংলাসের নৌকা কখনও দেখে নাই। তাহারা দৌড়াদৌড়ি করিয়া নৌকা দেখিতে আসিল। আজাহেরের গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল। প্রকাণ্ড বজরার মধ্যে মৌলানা সাহেব বসিয়া তছবীহ জপ করিতেছেন। পৃথিবীর কোন দিকে তাঁহার খেয়াল নাই। মনে হয় যেন শত শত বৎসর ধরিয়া তিনি এইভাবেই তছবীহ জপ করিতেছেন। বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে আজাহের মৌলানা সাহেবের দিকে চাহিয়া রহিল। মৌলানা। সাহেবের গালভরা পাকা দাড়ি, তাহাতে লাল খেজাব মাখা। গায়ে খুব দামী সিল্কের পোশাক। এতবড় লোক আজ তাহার বাড়িতে তছরীফ আনিয়াছেন। তালেব-এলেমরা আজাহেরের কানে কানে আসিয়া কহিল, “আজাহের মিঞা! শিগগীর যায়া থালির উপরে পান আর দশটা টাকা মৌলবী সাহেবের সামনে নজর ধরেন, এতবড় মৌলানা তানার মান। ত রাখতি অবি।”

    সুতরাং পাট বেচা টাকা হইতে দশটি টাকা লইয়া আজাহের তাহার মাটির সানকির। উপরে রাখিল। তার পাশে কয়েকটি পান সাজাইয়া আজাহের মৌলানা সাহেবের সামনে আসিয়া নজর ধরিল। মৌলানা সাহেব একটু মৃদু হাস্যে আজাহেরকে করুণা করিয়া টাকা দশটি জায়নামাজের পাটির একপাশে রাখিয়া দিলেন। তারপর আগেরই মত কোরান পড়ায় মন দিলেন, যেন দুনিয়াদারীর কোন খেয়াল রাখেন না। সাকরেদ দুইজন চোখের ইসারায় আজাহেরকে দেখাইলেন, কত খোদাপরস্ত তাঁহাদের পীর সাহেব।

    মৌলানা সাহেবের সাগরেদদের উপদেশ ও পরামর্শে দুপুরের আহারটা মৌলানা। সাহেবের উত্তম রকমেরই হইল। রাতে মৌলবী সাহেব ওয়াজ করিবেন। মিনাজী মাতবরের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আজাহের দুই গ্রামের সকল লোক দাওয়াৎ করিয়া

    আসিল। রাতে আজাহেরের উঠানের উপর চাদোয়া টাঙান হইল। তাহার তলে পীরান পীর মৌলানা সাহেব মৌলুদ পড়িতে আরম্ভ করিলেন। চারি পাশে গ্রামের লোকেরা বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে মৌলবী সাহেবের ওয়াজ(বক্তৃতা) শুনিতে লাগিল। প্রথমে তিন চারি জন তালেব-এলেম লইয়া মৌলবী সাহেব আরবী এবং ফারসীতে গজল পড়িলেন। তারপর সুদীর্ঘ মোনাজাত করিয়া মৌলবী সাহেব আরম্ভ করিলেন, “খোদা তায়ালা জাল্লা জালালুহু পাক পরওয়ারদেগার কোরান শরিফমে ফরমাইছে,“–এই পর্যন্ত বলিতেই গায়ের একটি বৃদ্ধ লোক আহা-হা করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, মৌলানা সাহেব তাহার প্রতি একটা শুভ দৃষ্টিপাত করিয়াই আবার আরম্ভ করিলেন,– “আমার খোদা কি ফরমাইয়াছেন, হে আমার বান্দাগণ! যদি তোমাদের বাড়িতে কোন মৌলবী আসিয়া উপস্থিত হন, তানি মাথায় করিয়া খোদার রহমত নিয়া আসেন। তখন কি হয়? চারজন। ফেরেস্তা একটা বেহেস্তি চাঁদরের চার কানি ধরিয়া সেই গেরস্তের বাড়ির উপরে আসিয়া দাঁড়ায়। গৃহস্থ যদি মৌলবী সাহেবকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া তাহার সঙ্গে আচ্ছালামু আলায়কুম না করে তবে কি হয়? ওই যে চারজন ফেরেস্তা চাঁদরের চার কানি ধরিয়া রাইখ্যা ছিল, তার একজন চাঁদরের এক কানি ছাইড়া দেয়। তারপর যদি গৃহস্থ ওজুর পানি ও জায়নামাজের পাটি আইনা মৌলবী সাহেবের সামনে না ধরে, তবে দ্বিতীয়। ফেরেস্তা চাঁদরের আর এক কানি ছাইড়া দিয়া যায়। তারপর গৃহস্থ যদি তাজিমের সাথে মৌলবী সাহেবের সামনে খানাপিনা না ধরে অর্থাৎ কিনা মুরগী জবাই কইরা খুব ভালমত তাকে না খাওয়ায়, তখন তৃতীয় ফেরেস্তা চাঁদরের আর এক কানি ছাইড়া দিয়া যায়। শোনেন মিঞা সাহেবরা, আমার কথা নয়, আমার খোদা বইলাছেন, তারপর সেই গৃহস্থ যদি মৌলবী সাহেবের সামনে কিছু নজরানা না দেন তখন সেই চতুর্থ ফেরেস্তা কাতে কাতে বলে, “হারে কমবক্ত! তোর বাড়িতে আমার মৌলবী সাহেব বেহেস্তি নিয়ামত নিয়া আইছিল তুই তারে খালি হাতে বিদায় করলি! যদি তার হাতে এক টাকাও ভইরা দিতি আমার খোদা তোরে রোজহাশরের বিচারের দিন সত্তর টাকা বকশিশ করত। এই বইলা ফেরেস্তা কানতি কানতি চইলা যায়।“ এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলানা সাহেব বাম হস্তের রঙীন গামছা দিয়া চোখ মুছিলেন। সভার মধ্যে বৃদ্ধ দুই একজন লোকও মৌলবী সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছিলেন। মৌলবী সাহেব আবার বলিতে লাগিলেন, “শোনেন মোমিন মুসলমান ভাইরা–শোনেন আমার ঈমানদার ভাইরা! আবার মৌলবী সাহেবকে যদি কেউ একটা ছাতি দান করেন–রোজ কেয়ামতের দিন সেই ছাতি তাহার মাথার উপরে ঝুলতি থাকবি। এখানকার সূর্যের সত্তর গুণ গরম লইয়া সে দিন মাথার উপরে সূর্য উঠপি। এখানকার সূর্য আসমানের উপরে জ্বলে কিন্তু সেদিনকার সূর্য মাথার আধ হাত উপরে জ্বলবি। শোনেন ভাই সাহেবরা, আমার মৌলবী সাহেবরে যিনি আজ ছাতা দান করবেন। সেদিন তাহার মাথায় সেই ছাতা শুধু ঠাণ্ডা হাওয়া ছাড়বি। একটুকও গরম লাগবি না। শোনেন আমার ঈমানদার ভাইরা, মৌলবী সাহেবরে যে একজোড়া জুতা দান করবি, পুলছুরাতের পুলের উপর দিয়া সে যখন চলবি তখন ওই জুতা আইনা ফেরেস্তারা তার পায় পরাইয়া দিবি। সেই জুতা পায় দিয়া সে অনায়াসে পুলছুরাতের চুলের সেতু পার হইয়া যাবি।” এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলবী সাহেব হাঁপাইতে লাগিলেন। তালেম এলেমরা সুর করিয়া গাহিতে লাগিলেন :

    “মৌলবীর মফেলতে মোমবাতি চাহিরে,
    মৌলবীর মফেলতে আতর গোলাপ চাহিরে।
    মৌলবীর মফেলতে ছোরমাদানী চাহিরে,
    মৌলবীর মফেলতে নজরানা চাহিরে।”

    কিছুক্ষণ বাদে হাতের ইশারায় তাহাদিগকে থামাইয়া দিয়া মৌলবী সাহেব আবার ওয়াজ করিতে আরম্ভ করিলেন, “খোদা ওয়াতায়ালা জাল্লা জালালুহু পাক পরওয়ারদেগার কোরান শরিফমে ফরমাইয়াছেন, ”হে আমার বান্দাগণ, তোমরা কখনও আমার মৌলবী সাহেবের কথার অবহেলা করিবে না। যদি মৌলবী সাহেবকে অবহেলা কর তবে আমি তোমাদিগকে কখনও ক্ষমা করিব না। মৌলবী সাহেব হইল আমার নায়েবে-নবী। নায়েবে-নবী কারে কইছে? আমার ভাইরা একটু খেয়াল করিয়া শুনবেন। যেমন আপনারা দেখছেন মহারাণীর চৌকিদার। এই চৌকিদারকে যদি কেহ অমান্য করে, প্রথমে দারগা তাহার বিচার করব, দারগা যদি না করে হাকিম তাহার বিচার করব, হাকিম যদি না করে ছোটলাট তাহার বিচার করব, ছোটলাট যদি বিচার না করে বড়লাট তাহার বিচার করব, বড়লাট যদি না করে মহারাণী নিজে আসিয়া তার বিচার করব। তা হইলে বোঝেন ভাই সাহেবরা, চৌকিদার যদি অপমান হৈল, দারগা অপমান হৈল, ছোটলাট অপমান হৈল, বড়লাট অপমান হৈল, মহারাণী নিজেও অপমান হৈল। এইরূপ নায়েবে-নবী হইলেন মৌলবী সাহেব।”

    এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলবী সাহেব একটা গল্প আরম্ভ করিলেন : একজন চাষী লোকের বাড়ি কবে একজন মৌলবী যাইয়া উপস্থিত। চাষী তাহাকে ভালমত আদর না করাতে মৌলবী সাহেব বেজার হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। তাহাতে সে বছর চাষীর খেতে ফসল হইল না। চাষীর পাঁচটি গরু আছড়াইয়া মরিয়া গেল। তারপর চাষীর বউ কি করিয়া সেই মৌলবী সাহেবকে দাওয়াৎ করিয়া আনাইল, কি করিয়া মৃত বলদগুলির প্রাণ দেওয়াইল এই সকল কথা মৌলবী সাহেব সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন। কখনও কাঁদিয়া কখনও হাসাইয়া সমস্ত আসরকে তিনি যেন নিজের হাতের ক্রীড়নক করিয়া তুলিলেন। প্রায় শেষ রাত্রে আজাহেরের বাড়িতে মৌলুদের বৈঠক ভাঙিল। সমবেত লোকেরা আহার করিয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল। আজাহের তাহাদের খাওয়ার এত যে বন্দোবস্ত করিয়াছিল সে সকলের প্রশংসা তাহারা একবার মুখেও আনিল না। সকলের মুখেই মৌলবী সাহেবের তারিফ। এমন জবরদস্ত মৌলানা তাহারা জীবনে কখনও দেখে নাই। এমন অপূর্ব আওয়াজ তাহারা কখনও শোনে নাই। সুতরাং এ-বাড়িতে সে-বাড়িতে মৌলবী সাহেবকে আরো কয়েকদিন নিমন্ত্রণ রাখিতে হইল। গরীব গাঁয়ের লোকেরা সাধ্যের অতীত অর্থ আনিয়া মৌলবী সাহেবের নজরানা দিয়া সস্তায় বেহেস্তের পথ প্রসার করিয়া লইল। যদিও অপরিচিত জেলার লোকেরা মৌলবী সাহেবের জন্য ঘন ঘন পত্র লিখিতে লাগিলেন তথাপি আশপাশের গ্রামগুলির মুসলমান ভাইদের ঈমানদারীর জন্য মৌলবী সাহেব এখানেই কিছুদিন রহিয়া গেলেন।

    উত্তেজনার প্রথম ঝুঁকিটি কাটিয়া গেলে, আজাহের আর তার বউ রাত্রিকালে অতি গোপনে মাটির তলা হইতে কলসীর টাকাগুলি উঠাইয়া গুণিতে বসিল। হায়! হায়! তাহারা করিয়াছে কি? এই কয়দিনে তাহারা তিনশত টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছে। ওদিকে শরৎ সাহার দেনা পড়িয়া রহিয়াছে। সেদিন কেমন করিয়া শরৎ সাহা শাসাইয়া গিয়াছে, যদি সত্য সত্যই নালিশ করিয়া থাকে তবে উপায় হবে কি? অবশ্য মোড়ল তাহাকে অনেক সাহস দিয়াছে কিন্তু সদরের পিয়ন আসিয়া যদি তাহার গরু বাছুর ক্রোক করিয়া লইয়া যায় তখন মোড়ল তাহাকে কতটুকু সাহায্য করিতে পারিবে?

    আজাহেরের বউ-এর চোখ দুটি জলে ভরিয়া উঠিল। “তুমি এমন নামালের কাজ করলা ক্যান। এতগুলি টাকা এই কয়দিনের মধ্যে খরচ কইরা ফালাইলা।” গামছার খোট দিয়া বউ-এর চোখ মুছাইতে যাইয়া আজাহের নিজেও কাঁদিয়া ফেলে। তবু বউকে সান্তনা দেয়, “পরলোকের কাম ত করছি। এক পয়সা খরচ করলি রোজহাশরের ময়দানের দিন সত্তর পয়সা পাব। বউ তুমি কাইন্দ না।” বউ বলে, “পরলোকের জন্যে ত ছবাব কিনলাম। কিন্তু এখন আমরা খাব কি?” পৃথিবীতে যাহারা কিছুই সঞ্চয় করিতে পারিল না। পরলোকের সঞ্চয়ের স্বপ্ন রচনা করিয়া তাহারা ক্ষণিক সান্তনা লাভ করে। কিন্তু রোজহাশরের ময়দানের সুখ-সুবিধার কথা আজাহের যতই ভাল করিয়া ভাবিতে চায় শরৎ সাহার শাসানির কথা ততই উজ্জ্বল হইয়া তাহার মনে ভাসে।

    .

    ১০.

    সেদিন আজাহের মাঠ হইতে এক আঁটি ঘাস মাথায় করিয়া বাড়ি আসিতেছে, দুর হইতে শুনিতে পাইল তাহার ঘরে ছোট শিশুর ক্রন্দন। এমন সুর যেন আজাহের কোনদিন শোনে নাই। শিশুর মিষ্টি কান্না যেন আজাহেরের সকল অন্তরখানি ধীরে ধীরে দোলা দিতেছিল। আজাহের যা ভাবিতেছে তা যদি সত্য সত্যই সত্য হয় তবে যে আজাহেরের ভারি লজ্জা করে, সে কেমন করিয়া ঘরে যাইবে। আজাহের ঘাসের বোঝাটি মাটিতে নামাইয়া খানিক আওগাইয়া যায়–আবার দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কান পাতিয়া শোনে। আজাহেরের কুঁড়ে ঘরখানি ভরিয়া শিশু-কণ্ঠের কান্নার সুর যেন চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। মনের খুশীতে আজাহের আরো খানিক আওগাইয়া যায়। আবার দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সেই কান্না শোনে। কিন্তু তার যে ভারি লজ্জা করিতেছে। কেমন করিয়া সে ঘরে যাইবে! কিন্তু কি এক অপূর্ব রহস্য যেন তাকে রশি বাধিয়া বাড়ির দিকে লইয়া যাইতে চাহে। দু এক পা যায় আজাহের আবার দাঁড়ায়।

    শিশু-কণ্ঠের মিষ্টি কান্নায় সমস্ত দুনিয়া ভরিয়া গেল। এবার বুঝি সেই সুর খোদার। আরশ পর্যন্ত ধাওয়া করিবে, আর আজাহের স্থির থাকিতে পারে না। আস্তে আস্তে যাইয়া। তার ঘরের পিছনে কচুগাছগুলির মধ্যে লুকাইয়া লুকাইয়া শিশুর কান্না শোনে। ঘরের মধ্যে মিনাজদ্দী মাতব্বরের বউ আসিয়াছে। পাড়া হইতে আরো দুচার জন স্ত্রীলোক আসিয়াছে। উঠানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কৌতূহলী দৃষ্টি লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। এত লোকের মধ্যে আজাহের কেমন করিয়া ঘরে যাইবে? তাহার লজ্জা যেন শতগুণ বাড়িয়াছে। এমন সময় শিশুর নাড়ি কাটার জন্য বাঁশের নেইলের সন্ধানে আসিয়া মিনাজদ্দী মাতবরের বউ আজাহেরকে সেই কচুগাছের জঙলের মধ্যে আবিষ্কার করিল।

    “ওমা, আজাহের! তুমি এহ্যানে পালায়া রইছ, তোমার যে পুলা ঐছে।”

    আজাহের তাড়াতাড়ি কচুগাছের আড়াল হইতে উঠিল–বলিল, “য়্যা–পুলা ঐছে। কিন্তুক আমার যে ভারি সরম লাগে!” বাড়ির ভিতরে মেয়েরা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। ছোট ছোট ছেলের দল আসিয়া আজাহেরকে ঘিরিয়া ফেলিল। “ও আজাহের চাচা! তোমার পুলা ঐছে।”

    “যা! যা! ভারি একটা ইয়া পাইছস তোরা? আমার যে সরম লাগে? তা বুঝতে পারস না।”

    ঘোমটার ভিতর থেকে মিনাজদ্দী মাতবরের বউ বলিল, “তা সরম করলি চলবি না। আমাগো ক্ষীর খাওয়াইতি অবি।”

    “তা ক্ষীর খাইবা বাবি! তাতে ত আমার আপত্তি নাই। আমি এহনই পাঁচ স্যার কুসাইরা মিঠাই আর দশ স্যার আতপ চাইল কিন্যা আনতাছি–কিন্তুক–” আর বলিতে হইল না। একজন বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক পোটলার মত আজাহেরের সেই শিশু পুত্রটিকে আনিয়া তার সামনে ধরিল।

    “দেহ আজাহের! তোমার কি সুন্দর ছাওয়াল হইছে!” খুশীতে আজাহেরের নাচিতে ইচ্ছা করিতেছিল। মুখে শুধু বলিল, “আমার যে সরম লাগে ইয়া তোমরা কেওই বুঝবার পার না।” বাড়ি ভরা মেয়ের দল তখন হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতেছিল! আজাহের তাড়াতাড়ি কোমরে গামছা বাঁধিয়া কুসুরে গুড় কিনিবার জন্য বন্দরে ছুটিল।

    নতুন শিশু পুত্রটি লইয়া আজাহের আর তার বউ বড়ই মুস্কিলে পড়িল। বাড়িতে বর্ষীয়সী কোন স্ত্রীলোক নাই। কেমন করিয়া শিশুকে দুধ খাওয়াইতে হইবে, কেমন করিয়া তাহাকে স্নান করাইতে হইবে, কিভাবে তাহাকে কোলে লইতে হইবে, কোন সময় কিভাবে শিশুকে শোয়াইলে তাহাকে ডাইনীতে পায় না এসব খবর তাহারা কেহই জানে না। আনাড়ী মাতা শিশুকে দুধ খাওয়াইতে যাইয়া তার সমস্ত গায় দুধ জড়াইয়া দেয়, স্নান করাইতে শিশুর নাকে মুখে জল লাগে, সর্দি হয়। বেশী দুধ খাওয়াইয়া শিশুর পেটে অসুখ করে।

    দৌড়াইয়া যায় আজাহের রামে-রাজের বাড়ি। তুক-তাবিজের অলঙ্কারে শিশুর সকল অঙ্গ ভরিয়া যায়। পাড়া-প্রতিবেশীরা শিশুর ভালোর জন্য যে বিধান দেয় দুইজনে অক্ষরে অক্ষরে তাহা পালন করে। এইভাবে শিশু দিনে দিনে বাড়িতে থাকে।

    এখন তাহারা ঠেকিয়া ঠেকিয়া অনেক শিখিয়াছে। রাত্রে বাহির হইতে আসিয়া ‘শিশুর ঘরে প্রবেশ করিলে শিশুকে প্রেতে পায়! নিমা-সামের কালে শিশুকে বাহিরে আনিলে তাহার বাতাস লাগে। বাতাস লাগিয়া পেটে অসুখ করে। ডাইনী আসিয়া শিশুর সঙ্গে কথা কহিতে চেষ্টা করিলে তাহার জ্বর চমকা লাগে। এ জন্য সাবধানও তাহারা কম হয় নাই।

    ঘরের দরজার পাশে একটা মরা-গরুর মাথার হাড় লটকাইয়া রাখিয়াছে। ডাইনীরা তাহা দেখিয়া পালাইয়া যাইবে। কে কখন শিশুকে দেখিয়া নজর দেয়, বলা যায় না ত? সকলের চোখ ভাল না। তাহাতে শিশু রোগা হইয়া যাইতে পারে। উঠানের এক কোণে বাশ পুঁতিয়া তাহার উপরে রান্নাঘরের একটি ভাঙ্গা হাড়ী বসাইয়া রাখিয়াছে। ছেলের দিকে নজর লাগাইলে সেই নজর আবার যদি সেই কালো হাঁড়ীর উপর পড়ে তবে আর তাহাতে ছেলের কোন ক্ষতি হইবে না। ছেলের যাহাতে সর্দি না লাগে সেই জন্য তাহার গলায় একছড়া রসুনের মালা পরাইয়া দেওয়া হইয়াছে।

    শেষ রাত্রে শিশু জাগিয়া উঠিয়া হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতে থাকে। শিশুর খলখলানিতে বাপ মায়ের ঘুম ভাঙিয়া যায়। ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়া শেষ রাত্রের চাঁদ আসিয়া শিশুর মুখের উপর পড়ে। আজাহের আর তার বউ দুইজনে শিশুর দুই পাশে বসিয়া নীরবে চাহিয়া থাকে। কেউ কোন কথা কয় না, তাদের বুকের যত কথা যেন মূর্তি ধরিয়া ওই শিশুর হাসির রঙে ঝলমল করিয়া তাহার নরম ননির মত হাত পাগুলির দোলার সঙ্গে দুলিয়া সেই এতটুকুন দেহখানি ঘিরিয়া যেন টলমল করিতে থাকে।

    দুইজনে দুই পাশে বসিয়া কেবলই চাহিয়া থাকে। নিকটে–দূরে আমবাগান হইতে কোকিলগুলি আড়াআড়ি করিয়া ডাকিতে থাকে। স্কুব স্কুব করিয়া কানাকুয়া ডাকে। আকাশের কিনারায় তারাগুলি সারি বাধিয়া ঝিকমিক করে।

    .

    আজাহের আর তার বউ শিশুর মুখের পানে চাহিয়া নীরবে বসিয়া থাকে। দেখিয়া দেখিয়া আবার দেখিয়া সাধ মেটে না। ।

    আকাশের তারাগুলি ভাঙ্গা ঘরের ফাঁক দিয়া উঁকি মারিয়া চায়। কলা পাতার আড়াল হইতে এক ফালি চাঁদ আসিয়া শেষ রাতের উতল বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুখে নৃত্য করে।

    ওরা কি তাদের শিশুটিকে কাড়িয়া লইয়া যাইবে না কি? না না না। তারার সঙ্গে ‘তারা’ হইয়া কতকাল তাদের এই শিশুটি আকাশ ভরিয়া খেলা করিয়া বেড়াইয়াছে। চাঁদের সঙ্গে চাঁদ হইয়া সারা আকাশ ভরিয়া সে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। বাঁশী বাজাইয়া সেই চাঁদকে আজাহের ঘরে টানিয়া আনিয়াছে। আজ আকাশ ছাড়িয়া তাই তার ঘরের চাঁদকে দেখিতে আসিয়াছে। চাষার ছেলে আজাহের অতশত ভাবিতে পারে কিনা কে জানে!

    কিন্তু এই শিশু পুত্রটির মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া সে যাহা ভাবিতেছে তাহা আকাশের তারার চাইতে ঝলমল করে, আকাশের চাঁদের চাইতে ঝিকমিক করে।

    ছেলের মুখের পানে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে আবার দেখিতে রাত শেষ হইয়া যায়। তাদের ঐ শিশুটির মত আর একটি শিশুরবি পূব আকাশের কিনারায় হাসিয়া হাসিয়া রঙীন হইয়া উঠে।

    প্রভাতের নতুন আলোয় আজাহের বউ-এর মুখের দিকে তাকায়।

    রাঙা প্রভাতের মত লজ্জায় রাঙা হইয়া বউ আজাহেরের দিকে তর্জনী ক্ষেপণ করিয়া বলে, “যাও!”

    আজাহের তাড়াতাড়ি উঠিয়া লাঙল লইয়া খেতে ছোটে। বউ ঘর-গেরস্থালীর কাজে মনোযোগ দেয়।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleষোল-আনি – জলধর সেন
    Next Article ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }