Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বোবা কাহিনী – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প320 Mins Read0

    ১১-১৫. খাকি রঙের জামা

    ১১.

    কোথা হইতে খাকি রঙের জামা পরিয়া কোমরে চাপরাশ আঁটিয়া একটি লোক আসিয়া গ্রামে প্রবেশ করিল। গ্রামের কুকুরগুলি তাহাকে ঘিরিয়া ঘেউ ঘেউ করিতে লাগিল।

    কৌতূহলী গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হল্লা করিয়া কলরব করিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। সেই লোকটিকে দেখিয়া গ্রামের সাবধানী লোকেরা ফিস ফিস করিয়া বলাবলি করিতে লাগিল, “আদালতের পিয়ন আসিয়াছে। তোরা পালারে পালা।”

    যে যেখানে পারিল পালাইল কিন্তু সেই লুকান-স্থান হইতে সকলেই তাহার গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিল। লোকটির দাপট পদক্ষেপে সকলেরই বুক দুর দুর করিয়া কাপিতে লাগিল।

    সারাদিন মাঠের কঠোর পরিশ্রম করিয়া দুপুর গড়াইয়া গেল আজাহের ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মত ভাতের থালা সামনে লইয়া কেবল বসিয়াছে, এমন সময় সেই লোকটি তাহার বাড়ির সামনে আসিয়া কর্কশ কণ্ঠে কহিল, “এক নম্বর আসামী আজাহের বাড়িতে আছ? তোমার নামে সমন আছে।”

    অমনি ভাতের থালাখানা সরাইয়া আজাহের মাচার উপর একটা ডোলের মধ্যে যাইয়া পালাইল। ইতিমধ্যে দুই চারজন ছেলে-মেয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। আজাহেরের বউ ফিস্ ফিস্ করিয়া তাহাদিগকে শিখাইয়া দিল, “কয়া দেগা বাড়ি নাই।”

    পিয়নকে আর ছেলেদের বলিতে হইল না। সে বাহির হইতে শুনিয়া আরো জোরের সঙ্গে চেঁচাইয়া কহিল, “আজাহের মিঞা এক নম্বর আসামী বাড়ি নাই বলিয়া তাহার নামের সমন লটকাইয়া জারি করিলাম।”

    এই বলিয়া একখানা কাগজ ঘরের বেড়ার সঙ্গে আটকাইয়া রাখিয়া সে আরো বীরত্বের সঙ্গে পা ফেলিয়া চলিয়া গেল। তাহার দাপটপদক্ষেপে সমস্ত গ্রাম কাপিতে লাগিল। তাহার চলিবার ভঙ্গী এমনই–সে যেন কোথায় একটা কি ভীষণ কাজ করিয়া ফিরিয়া চলিল। গ্রামের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করিয়া তাহার পিছন পিছন ছুটিল। পিয়ন চলিয়া গেলে বহুক্ষণ পরে লুকান-স্থান হইতে কৌতূহলী গ্রামের লোকেরা সকলে মিলিয়া আজাহেরের বাড়ির সামনে আসিয়া উপস্থিত হইল। মিনাজদ্দী মাতবরও আসিল। তাহার গলার আওয়াজ শুনিয়া আজাহেরের ধড়ে প্রাণ আসিল। সে লুকান-স্থান হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সকলের সামনে উপস্থিত হইল। সকলেরই মুখে একই প্রশ্ন ব্যাপার কি?”

    আজাহের আনুপূর্বিক সকল ঘটনা বলিল। ঘরের বেড়ার সঙ্গে লটকান কাগজখানাও দেখাইয়া দিল। মোড়ল অনেক গবেষণা করিয়াও সেই কাগজখানা যে কেন পিয়ন রাখিয়া গেল, তাহার কোন কূল-কিনারা করিতে পারিল না। গ্রামের মধ্যে বচন মোল্লা কিছু লেখাপড়া জানে বলিয়া তাহার কিছু খ্যাতি আছে। ছহি সোনাভান ও জয়গুন বিবির পুঁথি সে সুর করিয়া পড়িয়া গ্রামের লোকদের তাক লাগাইয়া দেয়। সকলে মিলিয়া স্থির করিল বচন মোল্লাকে ডাকাইয়া আনিয়া এই কাগজ পড়াইতে হইবে।

    তিন চারজন লোক বচন মোল্লার কাছে ছুটিল। বচন মোল্লা গিয়াছিল ভাটপাড়ার গায়ে দাওয়াত খাইতে। সেখানে যাইয়া তাহারা শুনিল, সে সেখান হইতে গিয়াছে শোভারামপুর তার শ্বশুর বাড়ি। তখন দে ছুট শোভারামপুর বলিয়া, দুই তিন ঘন্টার মধ্যে কৌতূহলী খবরিয়ারা বচন মোল্লাকে লইয়া আসিল। ইতিমধ্যে আজাহেরের বাড়ির সামনে প্রায় পঁচশত কৌতূহলী লোক জড় হইয়াছে। বচন মোল্লা আসিলে তাহাদের মধ্যে সাড়া পড়িয়া গেল। মিনাজদ্দী মাতবর চারিদিক হইতে ভীড় সরাইয়া দিয়া মাঝখানে বচন মোল্লার জন্য জায়গা করিয়া দিল। সেখানে বসিয়া বচন মোল্লা একবার চারিদিকে তাকাইয়া সমবেত লোকগুলি দেখিয়া লইল, মনে যেন এই ভাব, সকলে মনে করে বচন মোল্লা কেউকেটা নয়; এবার দেখুক একখানা চিঠি পড়িতে প্রায় তিন মাইল দূর হইতে তাহাকে ডাকিয়া আনিতে হইয়াছে। সে ছাড়া আর কাউকে দিয়া এ কাজ হইল না।

    মিনাজদ্দী মাতবর এবার তাড়াতাড়ি আজাহেরের বেড়ায় লটকান কাগজখানা আনিয়া বচন মোল্লার হাতে দিল। “পড়েন ত মোল্লাজী। এতে কি লেইখাছে?” মোল্লাজী কাগজখানা হাতে লইয়া বেশ নাড়িয়া চাড়িয়া খানিকক্ষণ পড়িবার অভিনয় করিয়া তারপর হাতের গামছাখানা দিয়া মুখ মুছিয়া আবার চারিদিকে চাহিয়া বলিল, “একটু তামুক খাওয়াও।”

    অমনি চারি পাঁচজন লোক তামাক সাজিতে ছুটিয়া চলিল। অনেকক্ষণ তামাক টানিয়া কুণ্ডলী করিয়া নাকে মুখে ধূম বাহির করিয়া মোল্লাজী আবার কাগজখানা লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।

    পড়িয়া পড়িয়া মোল্লাজী বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িল। তাহার সমস্ত মুখে ঘাম বাহির হইল। সেই ঘাম গামছা দিয়া মুছিয়া আবার পড়িতে আরম্ভ করিল।

    মিনাজদ্দী মাতবরের আর ধৈর্য থাকে না। সে মোল্লাজীর দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল, “কি পড়লেন মোল্লাজী? কন শীগগীর?”

    মোল্লাজী এবার সুর করিয়া সমবেত লোকদিগকে শুনাইয়া পড়িতে লাগিল, “এতে লেইখাছে, ইবার পিয়াইজির দাম পাঁচসিকা মণ, মুরগীর আণ্ডার দাম দুইআনা করিয়া কুড়ি, তামুক পাতার দাম আধা পয়সা, কাঁচা মরিচের দাম তিন পয়সা সের।”

    আজাহের আগাইয়া আসিয়া বলিল, “আরে মোল্লাজী! আপিনি ত কোন জিনিসের কি। দাম পইড়া যাইতেছেন। কিন্তুক পিয়ন যে কয়া গ্যাল, আজাহের মিঞা এক নম্বর আসামী বাড়িতি নাই বইলা সমন লটকাইয়া জারি করলাম। সেই যে আমি আসামী ওইলাম, কোন মোকদ্দমার? বালা কইরা পড়েন?” মোল্লাজী একটু বিরক্ত হইয়া আজাহেরের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আরে রাখ মিঞা! আমি আসছি তোমার কতায়। ইয়ার আদি-অন্ত সগল কথাইত পড়তি অবি। আর পড়বই বা কি? তোমারে আসামী দিছে, তাতে কি ঐছে? তোমার ত দেখা পায় নাই। ঘরের বেড়ার সাথে কাগজ লটকাইয়া গ্যাছে। ওই বেড়ায়ই এটা লটকাইয়া থোও। যদি আসামী অয় ত ঘরের বেড়াই অবি।”

    মোড়লও এই যুক্তিটি পছন্দ করিল। সরল মনে সকলেই বুঝিল কাগজ যখন পিওন কাহারও হাতে দেয় নাই, ঘরের বেড়ায় লটকাইয়া রাখিয়া গিয়াছে সুতরাং আজাহেরের এ জন্য ভয় করিবার কোনই কারণ নাই। সকলে পরামর্শ করিয়া কাগজখানা বেড়ার যে স্থানে। লটকান ছিল সেই স্থানেই উহা আবার লটকাইয়া রাখিল। বচন মোল্লা সসম্মানে ঘরে ফিরিয়া গেল।

    দিনের পরে দিন চলিয়া যাইতে লাগিল। খেত-খামারের কাজে ঘরের বাহির হইতে বেড়া গোজা সেই কাগজের টুকরাটির দিকে চোখ পড়তেই কি যেন আশঙ্কায় আজাহেরের অন্তরটি দুরু দুরু করিয়া কাপিয়া উঠে। রাত্রে বিছানায় শুইয়া শুইয়া আজাহেরের ঘুম আসে না। সেই কাগজের টুকরাটি হিংস্র অজগর হইয়া যেন তাহাকে কামড়াইতে আসে।

    কোন কোন দিন আজাহের রাত্রে আধ-তন্দ্রায় স্বপ্ন দেখে, তাহার শিশু পুত্রটি কোলের উপর বসিয়া খেলা করিতেছে। হঠাৎ সেই কাগজের টুকরাটি প্রকাণ্ড একটা হা করিয়া আসিয়া তাহার সেই শিশু পুত্রটিকে গ্রাস করিয়া ফেলিল। চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া আজাহের কোলের ছেলেটিকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরে। বউ অবাক হইয়া ভয় পাইয়া জিজ্ঞাসা করে, “কও ত তোমার ওইল কি? এমন কইরা কাইন্দা উঠলা ক্যান?”

    আজাহের বলে, “কিছু না বউ! তুমি ঘুমাও।” কিন্তু উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের ধারায় তাহার সমস্ত বুক ভিজিয়া যায়।

    এই সমস্ত চিন্তার হাত হইতে আজাহের একেবারে রেহাই পায় যখন তাহার শিশু পুত্রটি আধ আধ স্বরে তাহাকে বাজান বলিয়া ডাকে। ছোট ছোট পা ফেলিয়া উঠানের এ-ধারে ওধারে ঘুরিয়া বেড়ায়। আজাহের তাহাকে কাঁধে করিয়া মাঠে লইয়া যায়।

    “এ খেত আমার। ও খেত আমার।” নিজের সবগুলি ফসলের খেত আজাহের ছেলেকে দেখায়। মাঠের ফুল কুড়াইয়া ছেলের হাতে দেয়। আজাহের ছেলের জন্য কি যে করিবে আর কি যে না করিবে!

    কত গ্রাম্য-ছড়াই সে ছেলেকে শিখাইয়াছে। ছেলেকে কোলে করিলে তাহার মুখ যেন ছড়ার ঝুমঝুমি হইয়া বাজিতে থাকে।

    আজাহেরের হালের বলদ দুইটিকে দেখিয়া ভয় না করে এমন লোক পাড়ায় খুব কমই। আছে। কিন্তু আজাহেরের এতটুকুন শিশু পুত্রটির কাছে গরু দুইটি যেন একেবারে নিরীহ। সে তাহাদের শিং ধরিয়া ঝকে, লেজ ধরিয়া যখন তখন টানাটানি করে, গরু দুইটি তাহাকে কিছুই বলে না। প্রতিদানে গরু দুইটি যতক্ষণ বাড়ি থাকে সব সময়ই সে তাহাদিগকে কলার খোসাটি, কচি ঘাসের ছোট গুচ্ছটি, আরো কত কি আনিয়া খাইতে দেয়।

    গরু দুইটি যখন পেট ভরিয়া খাইয়া ঘুমাইতে থাকে সেও তখন তাহাদের গলা জড়াইয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। কতদিন তাহার মা আসিয়া তাহাকে এমন ঘুমন্ত অবস্থা হইতে তুলিয়া লইয়া গিয়াছে। বাড়িতে নূতন কেহ আসিলে সে তাহাকে টানিয়া লইয়া গরু দুটিকে দেখায়। আর সগর্বে ঘোষণা করে, এই গরু দুটি তাহার নিজের।

    ইতিমধ্যে আজাহেরের আরো একটি মেয়ে জন্মিল। সদ্যজাত শিশু বোনটি আজাহেরের ছেলের একটি আশ্চর্য রকমের খেলনা হইয়া দাঁড়াইল।

    সে যখন আধ আধ সুরে তাহাকে ভাই বলিয়া ডাকিতে শিখিল তখন তাহার মনে কি যে খুশী! বোনকে কি খাওয়াইবে, কোথা হইতে কি আনিয়া দিবে, গহন-দুর্গম বনের অন্তরাল হইতে কাউয়ার হুঁটির ফল, কাটা গাছের আগডাল হইতে ডুমকুর, আরো কত কি আনিয়া সে বোনের সামনে জড় করে।

    আজাহের ছেলের নাম রাখিয়াছে বছির’ আর তার মেয়ের নাম রাখিয়াছে বড়। আজাহেরের ছেলে বছির শেষ রাত্রেই জাগিয়া উঠে। বাপ মা দুই পাশে এখনও ঘুমাইয়া।

    ছোট বোন বড়, সেও মায়ের বাহু জড়াইয়া ঘুমাইতেছে–সামনের আমগাছটি হইতে টুপ টুপ করিয়া আম পড়িতেছে। বছিরের বুক তারই তালে তালে নাচিয়া উঠিতেছে, কখন সকাল হইবে–দুইহাতে ধাক্কা দিয়া রাতের আঁধার যদি সরাইয়া দেওয়া যাইত। সামনের কলাগাছের পাতার উপরে শিশির-ফোঁটা পড়ার শব্দ কানে আসিতেছে।

    ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়া চোখ পাতিয়া সে বসিয়া আছে, আর কেহ আসিয়া পাকা আমগুলি কুড়াইয়া লইয়া না যায়।

    .

    ১২.

    ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হইয়া আসিল। আজাহেরের ছেলে বছির আস্তে আস্তে উঠিয়া আম গাছের তলায় যাইয়া আম কুড়াইতে লাগিল। এমন সময় আট দশজন লোক বাড়ির উপর আসিয়া আথাল হইতে গরু দুইটির দড়ি খুলিতে লাগিল। বছির চীৎকার করিয়া তার বাপকে ডাকিতে লাগিল, “ও বাজান! জলদী উইঠা আইস। কারা যিনি আমার গরু দুইডারে লইয়া যাইত্যাছে।”

    ছেলের ডাক শুনিয়া আজাহের হুড়মুড় করিয়া উঠিয়া আসিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে দেখিতে পাইল,শরৎ সাহা লোকজন লইয়া আসিয়াছে। সঙ্গে সেই আদালতের পিয়ন খাকি পিরানের পকেট হইতে এক খণ্ড কাগজ বাহির করিয়া সদম্ভে পড়িতে লাগিল, “আলীপুর গ্রামের মহামহিম শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র সাহা, পিতা মৃত গোলক চন্দ্র সাহার নিকট হইতে গোবিন্দপুর নিবাসী আজাহের মণ্ডল আজ পাঁচ বৎসর পূর্বে পনর টাকা কর্জ করিয়াছিল। তাহার সুদ, সুদের সুদ, চক্রবন্দীতে বৃদ্ধি পাইয়া পঁচ শত টাকায় পরিণত হইয়াছে। এই টাকা মহামহিম আদালত শরৎ সাহার নামে ডিগ্রী দিয়াছেন। আজ আজাহের মণ্ডল যদি সেই টাকা পরিশোধ না করিতে পারে তবে তাহার স্থাবর, অস্থাবর। সমস্ত মাল ক্রোক হইবে।”

    লোকটি প্রতিটি কথা এইরূপ ধমকের সহিত বলিতেছিল, যেন তাহার আঘাতে আজাহেরের বুকের পাজরগুলি ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল।

    আজাহের সেই আদালতের পিয়নের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “দোহাই দিচ্ছি কোম্পানী বাহাদুরের, দোহাই মা মহারাণীর, আমার হালের গরু দুইডা নিবেন না।”

    পিয়ন আজাহেরের হাত হইতে পা ছাড়াইয়া লইয়া বলিল, “রাজার হুকুম, আমার কি সাধ্য আছে মিঞা সাহেব? শরৎ সাহার টাকাটা যদি আপনি পরিশোধ করে দিতে পারেন তবে গরু ছেড়ে যেতে পারি।”

    এত টাকা সে কেমন করিয়া পরিশোধ করিবে। মাত্র পনর টাকা সে কর্জ করিয়া আনিয়াছিল। তাহার পিছনে কত পনর টাকা সে শরৎ সাহার বাড়ি দিয়া আসিয়াছে। তবু তাহার সেই পনর টাকার সুদের সুদ বাড়িয়া আজ পঁচশত টাকায় পরিণত হইয়াছে। আজাহের আছাড় খাইয়া শরৎ সাহার পা জড়াইয়া ধরিল, “সা-জী মশায়! আমারে মাপ করেন।”

    তাহার কান্নাকাটিতে গ্রামের বহু লোকজন আসিয়া উঠানে জড় হইল। মিনাজদ্দী মাতবরও আসিল। কিন্তু আদালতের পিয়ন সামনে দাঁড়াইয়া। তাহার মাজায় আদালতের ছাপ-মারা চাপরাশ ঝকমক করিতেছে। কেহই আজাহেরকে কোন সাহায্য করিতে সাহস পাইল না।

    শরৎ সাহা ঝেংটা দিয়া পা ছাড়াইয়া লইয়া কহিল, “কেন মিঞা? সে দিন যে খুব বাড়াবাড়ি করেছিলে? কই মিনাজদ্দী! কথা কও না কেন? আমার মুখ না কুত্তার মত, এখন আজাহেরকে বাঁচাও।”

    আজাহের জোড় হাত করিয়া শরৎ সাহাকে বলিতে লাগিল, “বাবু! আমারে বাঁচান। আপনি আমার ধর্মের বাপ। আমার ছাওয়াল-ম্যায়াগো মুখির দিক চায়া আমাকে দয়া করেন।”

    “দয়ার কথা আজাহের! শরৎ সাহার জীবনে সব আছে কিন্তু ওই একটা জিনিস কেউ কোন দিন দেখেনি।”

    “কিন্তুক আমাগো সব যদি নিয়া যান আমরা খাব কি? আমার ছাওয়াল-ম্যায়াগুলা যে না খায়া মরবি।”

    “এসব যদি ভাবতাম তবে কি আর টাকা করতে পারতাম। জান মিঞা! টাকা যেমন শক্ত তেমনি শক্ত মন না করতে পারলে টাকা থাকে না। আমার গিন্নীর ছয়মাস যক্ষমা হয়েছে, এখনও টাকা খরচ করে ডাক্তার দেখাইনি।”

    “বাবু! জনম ভইরা আপনার বাড়িতি চাকর খাইটা খাব, যা হুকুম করবেন তাই কইরা দিব।”

    “তোমাকে খাটাব? জান, বাড়িতে গিন্নীর অসুখ, রানতে পারে না। নিজের হাতে এক বেলা বেঁধে তিন বেলা খাই তবু চাকর রাখি না। লোকে বলে, শরৎ সাহার লাখ টাকা আছে। সে কি সহজে হয়? যাক তোমার সঙ্গে কথা বলে কি হবে! আরে মিঞা সাবরা! তোমরা যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে, ঘরের মধ্যে ধান চাউল যা আছে বের কর।”

    শরৎ সাহার লোকেরা ঘরে ঢুকিতেছিল। আজাহেরের বউ দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। “আমার ডোলের ধান আমি কাউরে নিবার দিমু না। আমি কত কষ্টে এই ধান উড়াইছি। কত কইরা বৈদে শুকাইছি। আমার পুলা-ম্যায়ারা বছর ভইরা খাবি। আমি যাবার দিব না কেউরে আমার গরে।”

    শরৎ সাহার লোকেরা আজাহেরের বউ এর গায়ে হাত দিতে যাইতেছিল। মিনাজদ্দী মাতবর আর স্থির থাকিতে পারিল না।

    সে চীৎকার করিয়া উঠিল, “সাবধান! সাবধান মিঞারা! ম্যায়া লোকের গায় হাত দিবেন না। আপনাগো গরেও মা-বোন আছে।”

    এমন সময় পিয়ন সামনে আগাইয়া আসিয়া বলিল, “মাতবর সাহেব! সাপের সঙ্গে খেলা করছেন। রাজার হুকুম। যে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তার যথাসর্বস্ব যাবে। দেখছেন না আমার কোমরে কোম্পানীর চাপরাশ। এই আওরত লোকটিকে দরজা ছেড়ে চলে যেতে বলুন।”

    “হে যদি না যায় তবে কি করতি চান পিয়ন সাহেব?” মাতবর জিজ্ঞাসা করিল।

    “কি করতি পারি শুনতে চান? শোভারামপুরের গনি বেপারী সদর পিয়নকে বে-দখল করেছিল, দেখে আসুন গিয়া আজ গনি বেপারীর বাড়িতে জঙ্গল। উঠানে ঘুঘু চরছে। পীড়নের কথা ছেড়েই দিন। ভাজন ডাঙার বছিরদ্দীন চৌকিদারকে অপমান করেছিল। থানার দারোগা তাকে ডেকে নিয়ে এমন করে মেরেছিল যে সেই মারের চোটেই তিন দিন পরে সে মারা গেল।”

    এ সব কথা ত সবই মিনাজদ্দীর জানা! নইলে কার বাপের সাধ্য ছিল আজ আজাহেরের ঘর হইতে এমন করিয়া সব মাল লইয়া যায়। মিনাজদ্দীকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া পিয়ন আবার আরম্ভ করিল, “আমরা যে গ্রাম-ভরে এত বুকটান করে ঘুরি সে নিজের জোরে নয় মাতবর সাহেব! এই চাপরাশের জোরে। এই আওরত লোকটিকে এখনও চলে যেতে বলুন, নইলে এর মান-সম্মান আর রাখা যাবে না।”

    মিনাজদী আজাহেরকে বলিল, “আজাহের! বউকে ওখান হইতে চইলা যাইতে কও। আমরা বাইচ্যা থাকতি তোমার কুনুই উপকারে আসলাম না।”

    আজাহেরকে আর বলিতে হইল না। বউ আপনা হইতেই দরজা হইতে সরিয়া গেল।

    শরৎ সাহার লোকেরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বেড়ী হইতে ভারে ভারে ধান আনিয়া ছালায় ভরিয়া গরুর গাড়ীতে তুলিতে লাগিল। হড়ী ভরা কলাই, মসুরী, বীজধান যেখানে যাহা পাইল তাহাই আনিয়া গাড়ীতে তুলিল। এই সব কাজ করিতে তাহারা ঘরের বিছানা পত্র, তৈজস, হাড়ী-পাতিল সমস্ত ছড়াইয়া একাকার করিল।

    মোড়ল আজাহেরকে ডাকিয়া কহিল, “আজাহের ভাই! তুই একেবারে ছন্নছাড়া ফকির ছিলি। তোরে আমি নিজের আতে ঘর-গিরস্তালী বানায়া দিছিলাম। ভিন গেরাম হইতে বউ আইন্যা বিয়া দিছিলাম। আইজ তোর সেই যত্তনের বান্দা ঘর-বাড়ি ভাইঙা পড়ত্যাছে। ইয়া আমি আর চক্ষি দেখপার পারি না। পিয়ন সাহেব! যা করবার অয়। করেন, আমি চইল্যা গেলাম।”

    এই বলিয়া চাঁদরের খেটে চোখ মুছিতে মুছিতে মিনাজদ্দী মাতবর চলিয়া গেল। শরৎ সাহার লোকেরা দশ মিনিটের মধ্যে ঘরের সমস্ত জিনিস পত্র আনিয়া গাড়ীতে তুলিল। তারপর তাহারা গাড়ী লইয়া রওয়ানা হইবে এমন সময় শরৎ সাহা বলিল, “আরে মিঞারা! তোমরা কি চোখের মাথা খেয়েছ, দেখছ না ঘরের চালে ক’খানা টিন রয়েছে, টান দিয়ে খুলে নাও।”

    আজাহের শরৎ সাহার পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “বাবু! সব ত নিলেন। আমার মাথা গুজবার জন্যি এই টিন কয়খানা রাইখা যান। ছাওয়াল-ম্যায়া লয়া কোথায় থাকপ?”

    “আরে বাপুরে! তোমার ছেলে-মেয়ের দুঃখই যদি ভাবতে পারতাম, তবে আমি শরৎ সাহা হ’তে পারতাম? পিঁপড়ায় যদি গুড় খেয়ে যায় তার মুখ টিপে সেইটুকু বার করে রাখি। সেইজন্য আমার নাম শরৎ সাহা।”

    একথা মুখে বলিবার প্রয়োজন ছিল না। গ্রামের সকল লোকই তাহা জানিত। সে জন্য। তাহারা নীরব দর্শকের মতই দাঁড়াইয়া রহিল। কোন কথাই বলিতে পারিল না। শরৎ সাহার লোকেরা দেখিতে দেখিতে ঘরের চাল হইতে টিন খুলিয়া লইয়া গাড়ীতে তুলিল। তাহাদের পায়ের ধাক্কা লাগিয়া ভাতের হাঁড়ী তরকারীর পাতিল ভাঙ্গিয়া ছড়াইয়া পড়িল। আজকে। ছেলে-মেয়েগুলো যে পান্তা-ভাত খাইয়া এ-বেলাটা কাটাইয়া দিবে তাহারও উপায় থাকিল না!

    সমস্ত কাজ শেষ করিয়া শরৎ সাহা আজাহেরের বাড়িতে প্রকাণ্ড এক বাঁশ পুঁতিল। তাহার মাথায় এক টুকরা কাপড় বাধা। তখন আদালতের পিয়ন পূর্বের মতই ধমকের সুরে। বলিয়া যাইতে লাগিল, “অদ্য হইতে আজাহের মিঞার বাড়ির স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তিসহ মহামহিম শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র সাহা, পিতা মৃত গোলকচন্দ্র সাহা ডিক্রী করিয়া ক্রোক করিলেন। এই জমিতে বাঁশগাড়ী করিয়া উপযুক্ত সাক্ষীসহ নিজের দখল সাব্যস্ত করিলেন।” সমবেত লোকেরা ভয়ে-বিস্ময়ে সেই ধমকের সুর শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল।

    গাড়ী রওয়ানা হইল। শরৎ সাহার লোকেরা খামারের গরু দুইটিকে যখন লইয়া যাইতেছিল তখন আজাহেরের ছেলে বছির গরু দুইটির গলা জড়াইয়া ধরিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “গরু দুইডা আমার। আমি নিবার দিমু না।”

    শরৎ সাহার লোকেরা বালকের সেই কচি হাত দুইটি ঝেংটা দিয়া ছাড়াইয়া তাহাকে দূরে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দিল। সে চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল, “বাজান! দেহ আমার গরু দুইটা লয়া গেল।”

    আহা! বাজানের আজ কোন সাধ্য নাই এই নরবেশী-দস্যুর হাত হইতে গরু দুইটিকে রক্ষা করে। শরৎ সাহার লোকেরা গরু দুইটির দড়ি ধরিয়া টানে, তাহারা কিছুতেই নড়ে না। মূক-বোবা এই প্রাণী দুইটি হয়ত সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছিল। তাহাদের বড় বড় চোখ দুইটি হইতে ঝর ঝর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। শরৎ সাহার লোকেরা গরু দুইটিকে হেলে-লাঠি দিয়া জোরে জোরে আঘাত করিতে লাগিল। গরু দুইটি তবু নড়িল না।

    তাহাদের পিঠে আঘাতের পর আঘাত চলিতে লাগিল। আজাহের আর সহ্য করিতে পারিল না। হামলাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। তারপর গরু দুইটির গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “বোবাধন! অনেক কাল তোরা আমার কাছে ছিলি। কত ঠাটা-পড়া রৈদী তোগো দিয়া কাম করাইছি। প্যাট বইরা খাবার দিতি পারি নাই। আমারে মাপ করিস। আমার বাড়ি ছাইড়্যা অন্য বাড়িতে গ্যালি হয়ত বাল মত খাইবার পাইবি।” তারপর বউকে ডাকিয়া বলিল, “বউ! জনমের মত ত ওরা চলল। বাল মত পা দুইডা ধুইয়া দাও।”

    বউ আসিয়া কাঁদিতে কাদিতে গরু দুইটার পা ধোয়াইয়া দিল। তারপর গলার কাছে মুখ। লইয়া আরো খানিক কাঁদিয়া আঁচলে বাধা কয়টি ধান-দূর্বা তাদের মাথায় ছড়াইয়া দিল।

    তখন আজাহের নিজেই দড়ি ধরিয়া টানিয়া তাহার এত আদরের গরু দুইটিকে সে বাড়ির বাহির করিয়া দিয়া আসিল। গরু দুইটিকে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ সে তাহাদের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর যখন তাহারা দূরের জঙ্গলের আড়ালে চলিয়া গেল তখন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সে গৃহে ফিরিয়া আসিল। এই গরু দুইটি শুধু মাত্র তার হাল বাহিবার বাহনই নয়; নিজের ছেলে-মেয়েদের মতই সে ইহাদের যত্ন করিয়াছে। তাহার পরিবারে যেমন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে তেমনি এই গরু দুইটি। এদের সঙ্গে সে কথা কহিতে পারিত। এই বোবার ভাষাও সে হয়ত কিছু বুঝিতে পারিত। তার সকল সুখের সঙ্গে সকল দুঃখের সঙ্গে সমসুখী সমদুখী হইয়া ইহারা তাহার স্বল্প পরিসর জীবনটিতে জড়াইয়াছিল।

    উঠানে ফিরিয়া আসিয়া আজাহের মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে বসিল। কিসে কি হইয়া গেল। গাজীর গানের দলের বাদশার কাহিনীর মত নিমিষে সে পথের ভিখারী হইয়া বসিল।

    .

    ১৩.

    দুপুর বেলা মিনাজদ্দী মাতবর নিজের বাড়ি হইতে ভাত পাকাইয়া আনিয়া বলিল, “আজাহের বাই! আর বাইব না। ভাত খাও।”

    আজাহের বলিল, “মোড়ল সা’ব! কয়দিন আপনি এমন কইরা আমাগো খাওয়াইবেন? আমার ত কিছুই রইল না।” আজাহের হামলাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

    মোড়ল তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল, “বাইরে! আল্লা যখন মুখ দিছেন, তিনিই খাওয়াইবেন। কাইন্দা করবি কি?”

    “না মোড়ল সা’ব! আর কাম না।” মোড়লের হাত ধরিয়া আজাহের বলিতে লাগিল, তাহার চোখ দুইটি হইতে যেন আগুন বাহির হইতেছে; “আর কান্দুম না, মোড়ল সাব! আমার ত সবই শ্যাষ। পুলা-ম্যায়ারা না খাইয়া মরবি। কিন্তুক তাগো মরণ আমি খাড়ায়া খাড়ায়া দেখপার পারব না। তাগো মরার আগে ওই শরৎ সার গলাডা আমি টিপা তারে জন্মের শোধ শেষ কইরা দিয়া আসপ।”

    মোড়ল বলিল, “আজাহের! এমন চিন্তা মুখেও আইন না। মানুষরে মানুষ মারলি আল্লার কাছে দায়ী হবা। দোজগে যায়া পুড়বা।”

    “কিন্তুক মোড়ল সাব! আল্লার দোজগের জ্বালা কি দুনিয়ার দোজগের চায়াও বিষম? আমার পুলা-ম্যায়ারা কুনুদিন বাতের দুঃখু পায় নাই। কাইল তারা যখন বাত বাত কইরা কানবি, আমি খাড়ায়া খাড়ায়া তাই হুনব, আল্লার দোজগে কি ইয়ার চায়াও দুস্কু?”

    “হত্যি কথাই কইছসরে বাই আজাহের! মানুষ মানুষির জন্যি যে দোজগ বানাইছে, আল্লার সাধ্যও নাই তেমন দোজগের আগুন বানায়।”

    “তয় মোড়ল সাব। আমারে কি করবার কন আপনি? আগুনে পুইড়া যাইত্যাছে আমার সব্ব শরীল। ওই শরৎ সার মুণ্ডডা কাইটা না আনতি পারলি আমার এই অন্তরডা জুড়াবি না। আমার এই শূন্য বাড়ি-গরের দিগে যখন আমি চাই, ঘরের আসবাব পত্রের কথা যখন বাবি, আমার গরু দুইডার কতা যখন মনে আসে তহন কে যিনি আমার কানের কাছে কেবলই কয়া বেড়ায়, শরৎ সাহার মুণ্ডটা কাইটা আন।”

    “আজাহের বাই! তোমার ত মাথা খারাপ হয়া গ্যাল। একটু ঠিক অও।”

    “ঠিক আর কি মোড়ল বাই! কাইল যখন দেখপ, আমার চাষ দেওয়া খ্যাতে অন্য মানষী হাল জুড়ছে, আমার এত আদরের গরু দুইডি অন্য লোকের খ্যাত চাষ করতাছে, ক্যামন কইরা তা আমি সহ্য করব মোড়ল বাই?”

    “কি করবা আজাহের! রাজার আইন।”

    “আচ্ছা মোড়ল সাব! এ কেমুন আইন? পোনর টাহা কর্জ দিছিল ওই বেটা চামার। তারপর কত পোনর টাহা তারে দিছি, তবু আইজ সেই পোনর টাহা ফুরাইল না। বাইড়্যা পাঁচশ’ টাহা ঐল।”

    “আজাহের! হুনছি এই আইনের বদল অবি। দেশে সুদখোর মহাজন থাকপি না।”

    “কিন্তুক যহন বদল ঐব তহন আমরাও থাকপ না। আমাগো উপর যা ঐল তার কুনু। বিচার অবি না।”

    “আজাহের বাই! সবুর কর। সকল দুরই শেষ আছে। যাই দেখি, ছ্যামড়ারা কি করতাছে। তুমি বইস।”

    মোড়ল চলিয়া গেল। আজাহের বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। দুপুরের দিন গড়াইয়া সন্ধ্যা হইল। রাত্রের পিশাচিনী তার অন্ধকারের কথা বিস্তার করিয়া সমস্ত পৃথিবী ঢাকিয়া ফেলিল। চারিধারের বনে ঝিঁঝিপোকার আর্তনাদ আজাহেরের ব্যথা-বিক্ষিপ্ত অন্তরখানি। যেন ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দিতেছিল।

    দিনের আলোকে মানুষের যে সব অন্যায় অবিচারের আঘাত সে অনুভব করিতে পারে নাই, রাত্রের অন্ধকারে তাহারা সহস্র ক্ষত হইয়া তাহার শরীর-মনকে বিষাইয়া তুলিতেছিল। এই অন্ধকারের আশীতে সে যেন আজ স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছিল, কৌশলের পর কৌশল-জাল বিস্তার করিয়া এই লোভী মহাজন ধীরে ধীরে কেমন করিয়া তাহার সমস্ত ঘর-বাড়ি জমি-জমা দখল করিয়া লইয়াছে। সেই সঙ্গে তার জীবনের সমস্ত আশার প্রদীপ নিষ্ঠুর হাতের থাপড় মারিয়া নিবাইয়া দিয়াছে। তাহার জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া আজাহের শিহরিয়া উঠিল। দিনের পর দিন, ধীরে ধীরে তার এত আদরের ছেলে-মেয়েরা না খাইয়া মরিয়া যাইবে তারপর সে, তার স্ত্রী, তাহারাও ধরাপৃষ্ঠ হইতে একদিন চিরদিনের জন্য মুছিয়া যাইবে। আর এই লোভী শয়তান মহাজন দিনে দিনে তাহার সম্পদ-জাল বিস্তার করিয়া তাহারই মত বহু নির্দোষী লোককে আবার গৃহহীন। সর্বস্বহীন করিবে। ইহার কি কোনই প্রতিকার নাই? আজাহের মরিবে কিন্তু তার আগে সে ইহার কিছুটা প্রতিকার করিয়া যাইবে!

    ঘরের বেড়া হইতে সে তাহার দাখানি বাহির করিয়া বহুক্ষণ বসিয়া তাহাতে ধার দিল। অন্ধকারে বালুর উপর ঘসা পাইয়া ইস্পাতের দা চকমক করিয়া উঠিতেছিল, আর তারই চমকে আজাহেরের অন্তরের কি এক বীভৎস ক্ষুধার যেন তৃপ্তি হইতেছিল। অনেকক্ষণ দাখানি বালুর উপর ঘসিয়া আজাহের তাহাকে মনের মত করিয়া পরীক্ষা করিল। তারপর। মালকোছা দিয়া কাপড় পরিয়া চারিদিকের শুচিভেদ্য অন্ধকার-সাগরের মধ্যে ঝাপাইয়া পড়িল। সারাদিনের কান্নাকাটির পর বউ তাহার ছেলে-মেয়েগুলিকে লইয়া ঘরের মেঝেয় শুইয়া একটু তন্দ্রাতুর হইয়াছিল। সে টের পাইল না।

    সেই ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে চলিতে চলিতে আজাহের নিজেকে যেন দেখিতে পাইতেছিল। তাহার নিজের এই ভীষণতর চেহারা দেখিয়া যেন নিজেই সে শিহরিয়া উঠিতেছিল। কিন্তু ইহা ছাড়া তার আর ত কোন উপায় নাই। ওই শয়তান সুদখোর মহাজনটাকে একটু শিক্ষা না দিয়া গেলে সে কিছুতেই শান্তি পাইবে না।

    দেখিতে দেখিতে আজাহের শরৎ সাহার দরজায় আসিয়া পোছিল। চারিদিকে ভীষণ অন্ধকার। একখানা ঘরে একটি মাটির প্রদীপ টিমটিম করিয়া জ্বলিতেছিল। বেড়ার ফাঁক দিয়া আজাহের দেখিতে পাইল, একটা বিছানার উপর সেই সুদখোর মহাজন পড়িয়া ঘুমাইতেছে। পাশে কতকগুলি মহাজনী খাতা-পত্র ইতস্ততঃ ছড়ান। বোধ হয় সেগুলি পড়িতে পড়িতে, তারই মত কোন সরল-প্রাণ নিরীহ কৃষাণের সর্বনাশের ফন্দী বাহির করিয়া সে শ্রান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হয়ত ঘুমাইয়া ঘুমাইয়াই তাহার বিনাশের নূতন নূতন কৌশল-জালের স্বপ্ন দেখিতেছে। এই উপযুক্ত সময়, আস্তে আস্তে নিশ্বাস বন্ধ করিয়া একটা বাখারীর চাড়া দিয়া আজাহের কপাটের খিল খুলিয়া ফেলিল। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দ-পায়ে যাইয়া বিছানার সামনে হাঁটু-গাড়া দিয়া বসিল। নিজের কোমর হইতে দাখানা খুলিয়া ভালমত আর একবার তাহার ধার পরীক্ষা করিয়া লইল। এইবার মনের মত করিয়া তাহার গলার উপরে একটা কোপ বসাইয়া দিতে পারলেই হয়। কিন্তু একি! ছোট একটি মেয়ের কচি দুখানা হাত ওই সুদখোর মহাজনের গলাটি জড়াইয়া ধরিয়াছে। মাঠের কলমী ফুলের মতই রাঙা টুকটুকে সেই শিশু-মুখোনি। কত

    আদরেই সে তার বাপের গলাটি ধরিয়া রহিয়াছে। দেখিতে দেখিতে আজাহেরের হাতের দাখানি শিথিল হইয়া আসিল। সে এক নিমিষে অনেকক্ষণ সেই সুন্দর শিশু-মুখোনির দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে দাখানি হাতে লইয়া ঘরের দরজা অবধি ফিরিয়া আসিল।

    কিন্তু ফিরিয়া সে যাইবে না। তারও ঘরে ত অমনি ছোট্ট সোনার শিশুকন্যা রহিয়াছে। আজ যখন সে নিলামে তাহার যথাসর্বস্ব লইয়া আসিয়াছে তখন কি একবারও ওই নিষ্ঠুর মহাজন তার ছেলে-মেয়ের কথা ভাবিয়াছে? না! না! কিছুতেই সে ফিরিয়া যাইবে না। এই গোখুরা সাপকে সে চিরকালের মত দুনিয়ার বুক হইতে নিঃশেষ করিয়া যাইবে।

    ধীরে ধীরে আবার আসিয়া আজাহের সেই বিছানার সামনে পূর্বের মতই হাঁটু-গাড়া দিয়া বসিল। মওতের ফেরেস্তা আজরাইল যেন তার সামনে আসিয়া খাড়া হইয়াছে। আস্তে আস্তে অতি সাবধানে শরৎ সাহার গলা হইতে তার ছোট্ট মেয়েটির একখানা হাত খুলিয়া লইল। অপর হাতখানা খুলিতে সেই হাতের তপ্ত স্পর্শ যেন আজাহেরকে মুহূর্তে কি করিয়া দিল।

    সেই হাতখানা মুঠির মধ্যে লইয়া আজাহের ধীরে ধীরে নাড়া চাড়া করিতে লাগিল। তাহার হাতের আদর পাইয়া ছোট মেয়েটি ঘুমের মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে বলিয়া উঠিল, “আমার থেলনা আমি কাউকে নিতে দিব না।” কি মিষ্টি এই কণ্ঠস্বর! খোদার দুনিয়া বুঝি বহুদিন এমন সুর শোনে নাই। সমস্ত আকাশ বাতাস নীরব নিস্তব্ধ হইয়া সেই স্বর যেন বুকের মধ্যে পুরিয়া লইল। এমনি করিয়া বহুক্ষণ কাটিয়া গেল। আজাহেরের মনে ছবির পর ছবি ভাসিয়া উঠিল। ওমনি একটি ছোট খুকী-ফেরেস্তা তাহারও ঘরে আছে। ওমনি করিয়া সারাটি রাত তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া থাকে। আজ ওই নিষ্ঠুর মহাজনটিকে হত্যা করিয়া গেলে তাহারই মেয়ের মত একটি ছোট্ট মেয়ে কাল এবাড়ি ও বাড়ি তাহার আদরের বাপটিকে খুঁজিয়া ফিরিবে। রাতের বেলা ঘুমাইতে যাইয়া ওই ছোট মেয়েটি তার কচি বাহু দুটি জড়াইয়া ধরিবার এমনি আদরের বাপটিকে আর পাইবে না। আজাহেরের উপর যাহা হইয়াছে হউক, ওই কচি মেয়েটিকে কিছুতেই কাঁদাইবে না।

    নিজের হাতের দা-খানিকে অতি সন্তর্পণে কোমরে খুঁজিয়া আজাহের ঘরের দরজা পার হইয়া বাহিরে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন আকাশের চাঁদ পশ্চিমে হেলিয়া পড়িয়াছে। রহিয়া রহিয়া দুই একটি রাতজাগা পাখি নিস্তদ্ধ রাত্রির মৌনতা ভঙ্গ করিতেছিল। মহাজনের উঠানের শেফালি গাছটি হইতে অজস্র ফুল ঝরিয়া পড়িয়া অর্ধেক অঙ্গনখানি ভরিয়া তুলিয়াছে।

    কি জানি কেন আজাহের সেই গাছের তলায় যাইয়া দাঁড়াইল, গামছার খেটে আস্তে আস্তে অনেকগুলি ফুল টুকাইয়া লইল। তারপর ধীরে ধীরে সন্তর্পণে দরজা পার হইয়া সেই সুপ্ত মেয়েটির বিছানার পার্ধে আসিয়া আবার বসিয়া রহিল। রাঙা টুকটুকে আলতা মাখান পা দু’টি। সরু সরু কোমল দুখানি হাত গলায় জড়াইতে ইচ্ছে করে। অতি ধীরে ধীরে আজাহের তার সেই হাত দুখানি লইয়া পূর্ববৎ সেই নিষ্ঠুর মহাজনের গলায় পরাইয়া দিল। মহাজন ঘুমের ঘোরে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়িল। তারপর গামছার খোট হইতে ফুলগুলি লইয়া সেই ছোট্ট খুকী-মেয়েটির সারা গায়ে ছড়াইয়া দিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া আসিল।

    রাত্র তখন শেষ হইয়াছে। মহাজনের সেই খুকী-মেয়েটির মতই আর একটি লাল টুকটুকে মেয়ে ফজরের আসমানের কিনারায় আসিয়া উঁকি দিতেছে।

    .

    ১৪.

    চাহিয়া চিন্তিয়া আর কয় দিন কাটান যায়? তবু যে তিন চার দিন আজাহেরের কি করিয়া কাটিয়া গেল তাহা সে-ই জানে। গ্রামে কাহারও অবস্থা ভাল নয়। ইচ্ছা থাকিলে তাহারা সাহায্য করিতে পারে না। বড় আদর করিয়া আজাহের মেয়েটিকে একগাছি রূপার গোটছড়া কিনিয়া দিয়াছিল। সেইটি কি মেয়ে মাজা হইতে খুলিয়া দিতে চায়? অনেক বলিয়া কহিয়াও যখন কিছু হইল না তখন জোড় করিয়া আজাহের সেই গোটছড়া মেয়ের কোমর হইতে খুলিতে যাইয়া তাহা ছিঁড়িয়া ফেলিল। পীর সাহেবের নিকট হইতে ছেলের ভাল-ভালাইর জন্য আজাহের তাহার হাতে একটি রূপার তাবিজ কিনিয়া দিয়াছিল। সেটিও খুলিয়া লইতে হইল। কিন্তু এইভাবে আর কয়দিন কাটান যায়? নিজেদের কথা না হয় নাই ভাবিল, কিন্তু রাত্র প্রভাত হইলেই যে ছেলে-মেয়ে দুইটি ভাত ভাত করিয়া কান্না। চড়ায়, তারপর কঁদিতে কঁদিতে হয়রান হইয়া দুই ভাই-বোন গলাগলি ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। দুপুরের বেলা জাগিয়া উঠিয়া আবার ভাত ভাত করিয়া কাদিতে থাকে। এইভাবে আর কতদিন চলা যায়?

    আজাহের খবর পাইল, এখান হইতে বিশ মাইল দূরে তাম্বুলখানা গ্রাম। সেখানে অনেক জমি পড়িয়া রহিয়াছে। চাষ করিবার কৃষাণ নাই। সেখানে গেলে জন খাঁটিয়া আজাহের কোন রকমে ছেলে-মেয়ের পেট ভরাইতে পারিবে। প্রথমে সে এ বিষয়ে মিনাজদ্দী মাতবরের সঙ্গে পরামর্শ করিল। মাতবর বলিল, “সেই জঙলা জায়গায়, নদীর দ্যাশের লোক, তোমরা কেমন কইরা থাকপা। হুনছি সেহানে মানষীর জ্বর-জারি লাইগাই আছে।”

    আজাহের বলিল, “এহানে থাইকা ত মরণ। জন-কিষাণি খাটপ, তাও কেউ খাটাইবার চায় না।”

    মোড়ল বলে, “আজাহের! যা করবি কর। জিজ্ঞাস কইরা শুধু আমারে কান্দাইবারই পারবি। আমি যদি পারতাম, তোরে কি এই গিরাম ছাড়বার দিতামরে?”

    আজাহের বলে, “মোড়লসাব! আমাগো জন্যি আপনি বহু কষ্ট করছেন, এইবার গ্রাম ছাইড়া যাওনের দিন-খান ঠিক কইরা দ্যান।”

    মোড়লের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আজাহের যাইবার দিন স্থির করিয়া ফেলিল। মোড়ল বলিল, “আজাহের! হেই দ্যাশে যদি যাবিই, সেহানের গরীবুল্লা মাতবরের বাড়ি যাইস। তানি আমার বিয়াই। আমার কতা কইলি তোরে খাতির করবি।”

    আজাহের খুঁটিয়া খুঁটিয়া গরীবুল্লা মাতবরের সব কিছু জানিয়া লইল। নির্দিষ্ট দিনে কিছু পান্তা-ভাত খাইয়া তাহারা রওয়ানা হইবার জন্য প্রস্তুত হইল। সঙ্গে মোট-বহর কিছুই। নাই। বউ-এর কোলে মেয়েটি, আজাহেরের কোলে ছেলেটি। ছেলেটিকে কোল হইতে নামাইয়া আজাহের উঠানের উপরে কয়টি ধান ছড়াইয়া তাহার উপর একটি সালাম জানাইয়া সে আর একবার ভালমত সমস্ত বাড়িখানি দেখিয়া লইল। আজ বাড়ির প্রতিটি জিনিস যেন তাহার সঙ্গে বিদায় সম্ভাষণ করিতেছে। এখানে বউ লাল-নটে খেত করিয়াছে। রঙের পাতা মেলিয়া যেন খেতখানি নক্সী করা কাঁথার মত ঝলমল করিতেছে। ওইখানে শশার জাঙলা। হলুদ রঙের ফুলে সমস্ত জাঙলা হাসিতেছে। তারই পাশে শ্রীচন্দনের লতা যেন তাহাদের স্বল্প পরিসর ক্ষুদ্র চাষী-জীবনের সমস্ত স্নেহ-মমতা লইয়া জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। এগুলি ছাড়িয়া যাইতে কি মন চায়?

    তাহাদিগকে বিদায় দিতে মোড়ল আসিয়াছে, মোড়লের বউ আসিয়াছে। আজাহেরের বউ মোড়ল-গিন্নীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “বুবুগো! এই সোনার সংসার ছাইড়া আমরা বনবাসে চলোম। আমাগো কতা মনে রাইখ।” মোড়ল-বউ তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া নীরবে কাঁদিতে লাগিল। আজাহেরের বউ বলিল, “বুবুগো! এইখানে কন্যে-সাজানী সীমের গাছ বুনছিলাম। আইজ লালে নীলে রঙীন পাতায় আমার সমস্ত জাঙলা ভইরা গ্যাছে। আর কয়মাস পরেই নীলা রঙের সীমে সমস্ত জাঙলা ছায়া যাবি! তহন আয়া তুমি এই সীম পাইড়া নিও। আর আমার মত মন্দ-ভাগিনীর কতা মনে কইর। আর শোন বুবু! এই যে বরবটির চারা ঐছে না? আমার ম্যায়াড়া বড় যত্তনে উয়ারে বুনছিল, পানি না দিলি ওরা শুহাইয়া যাবি। তুমি আইসা মদ্দি মদ্দি ওগো গোড়ায় একটু। পানি ঢাইলা দিও।”

    মোড়ল-গিন্নী শুধু নীরবে কাঁদিতে লাগিল। বউ আবার তাহাকে বলিতে লাগিল, “বুবুগো। আমার সোনার গরু দুইডারে লইয়া গ্যাছে। ওগো আমি নিজির পুলাপানগো মতই যত্তন করতাম। বাস্যা গণ্ডা দিনে গাস পাত পাওয়া যায় না। তাই সারা বচ্ছর বইরা কুঁড়া পুঁজি কইরা রাকছিলাম। এই কুঁড়ায় আমার কি অবি? তুমি লইয়া যাও, তোমাগো গরুগুলিরে খাওয়াইও।”

    মোড়ল-বউ আজাহেরের স্ত্রীর মাথার চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “বউ! এতটুকু তুই এখানে আইছিলি। তারপর পোলা ঐল-ম্যায়া ঐল। তোর গরের কলরব শুইনা আমার পরাণ জুড়াইত। আইজ যে তুই বনবাসে চললি, তোর এই ভিটা শূন্য পইড়া খা খা করব। আমি রইলাম পোড়া কপালী তাই দেখপার জন্যি।”

    মোড়ল কান্না রাখিতে পারিল না। কাঁধের গামছার খোট দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল। মোড়ল-গিন্নী তার আঁচল হইতে কয়েকটি বীজ বাহির করিয়া আজাহেরের বউকে দিতে দিতে বলিল, “বউ! হুনছি, সেই বন-জঙলের দ্যাশে কিছুই পাওয়া যায় না। এই চালকুমড়ার বীজ কয়টা দিলাম, কোনোখানে বুইনা দিস। সেই গাছে যহন চালকুমড়া ধরবি তখন তোর এই বুবুরে মনে করিস। আর এই সোয়া স্যার কুসুম ফুলের বীজ দিলাম। আজাহেররে কইস মাঠে যেন বুইনা দেয়। চৈত্র মাসে রঙীন অয়া যহন কুসুম ফুল ফুটবি, তহন সেই ফুল দিয়া তোর মায়ার শাড়ী খানা রাঙা কইরা দি।”

    .

    ধীরে ধীরে রোদ হইয়া আসিতে লাগিল। গ্রামের বহুলোক আজাহেরের উঠানে আসিয়া জড় হইল। আজাহের আগে জানিত না, তাহারা তাহাকে এত ভালবাসে। আজ বিদায়ের দিন তাহাদের সকলের গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহারা কাদিতে ইচ্ছা করিতেছে। নিজে কাঁদিয়া সকলকে কাঁদাইয়া আজাহের তার স্ত্রী-পুত্র লইয়া সুদুর তালখানার পথে রওয়ানা হইল। গ্রামের স্ত্রী, পুরুষ, ছোট ছেলে-মেয়ে, প্রায় পঞ্চাশজন বহুদূর পর্যন্ত তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিল। সেই ইদু মল্লিকের তালতলা, সোনাডাঙার বড় বটগাছ, হদু। বেপারীর তালাপ ছাড়িয়া আসিতে আজ কোথাকার কান্নায় আজাহেরের সমস্ত অন্তর ভাঙিয়া যাইতে চাহে। এরাও যে জীবন্ত হইয়া এতদিন তাহার জীবনের সুখের দুঃখের সাথী হইয়াছিল। আজ বিদায়ের বেলা সেই কথাটি আজাহেরের বড় করিয়া মনে পড়িতেছে। কারিকর পাড়ার মোড়ে আসিলে রহিমদ্দী কারিকর আগাইয়া আসিয়া আজাহেরের হাত জড়াইয়া ধরিল, “আজাহের! তুমি তবে চললা?” কারিকরের পায়ে সালাম জানাইয়া আজাহের বলিল, “তোমরা দুয়া কইর চাচা।”– রহিমদ্দী বলে, “আজাহের! বাবছিলাম তোমার যাওনের বেলা আমি দেহা করব না। দুইডা বাতের অভাবেই যে তুমি দ্যাশ ছাইড়া চললা, আমরা তোমারে খাওয়ায়া রাখপার পারলাম না, আল্লা আমাগো এত বদনসীব করছে, সেই জন্যিই আমি পলাইয়াছিলাম। কিন্তু তোমার চাচী হুনল না। এই মশারীখানা নিয়া যাও। হুনছি সেই দ্যাশে ভারী মশার উৎপাত। টানায়া তোমার পুলাপানগো লয়া শুইও। এইডি দিবার জন্যি তোমার চাচী আমারে পাঠাইছে।”

    মশারীখানা গামছায় বাঁধিতে বাঁধিতে আজাহের বলিল, “কারিকর চাচা! আর চিরজনমে তোমার গীদ হুনতি পারব না।”

    রহিমদ্দী বলিল, “তুই ভাবিস না আজাহের! তাম্বুলখানার আটে আমি কাপড় বেচতি যাব। একদিন তোর ওহানে রাত্রির থাইকা গীদ হুনায়া আসপ।”

    গাঁয়ের সব চাইতে বৃদ্ধা কেদারীর মা ভাল করিয়া হাঁটিতে পারে না। তবু আজাহেরকে বিদায় দিতে এত পথ আসিয়াছে। সে আগাইয়া আসিয়া আজাহেরের বউ-এর আঁচলখানি টানিয়া লইয়া বলিল, “বউ! আমি বিধবা মানুষ, আমার ত আর কিছুই নাই। এই মুড়ি চারডা আঁচলে বাইন্দা দিলাম। পথে পুলা-ম্যায়াগো খাইতি দিস।”

    এমন সময় মেয়ে-পুরুষ, সমবেত গাঁয়ের লোকদের মোড়ল বলিল, “তোমরা অনেক দূর পর্যন্ত আইছ, আর যায়া কাম নাই। রইদ উইঠা আইল। ওগো তাড়াতাড়ি যাবার দাও।”

    আজাহের সকলের দিকে আর একবার ভাল মত চাহিয়া বউকে সঙ্গে করিয়া জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল। গ্রামের লোকেরা নীরবে দাঁড়াইয়া যতক্ষণ তাহাদের দেখা যায় ততক্ষণ অগেক্ষা করিয়া ধীরে ধীরে যার যার বাড়িতে চলিয়া গেল।

    আজাহের জোরে জোরে পথ চলিতেছে। একটা ছোট বিড়াল ম্যাঁও ম্যাঁও করিয়া তাহাদের পিছনে পিছনে আসিতে লাগিল। তাহার করুণ কান্না শুনিয়া আজাহেরের মেয়েটি মার কোল হইতে আধ আধ সুরে বলিল, “বাজান! আমার বিলাইডারে লইয়া যাব–ওডারে আমার কোলে দাও।”

    এত দূরের পথ। ছেলে-মেয়ে দুটিকে কোলে লইয়া যাওয়াই অসম্ভব। আবার বিড়ালটিকে কেমন করিয়া তাহারা লইয়া যাইবে। কিন্তু কিছুতেই বিড়ালটি পিছন ছাড়ে না। কোলের মেয়েটিও বিড়ালটির জন্য কাঁদে। আজাহের একটা লাঠি লইয়া বিড়ালটিকে আঘাত করিল। ম্যাঁও ম্যাঁও কান্নায় বিড়ালটি পাশের বনে যাইয়া লুকাইল। তারপর আর তাহার কান্না শোনা গেল না।

    .

    ১৫.

    ঘন জঙ্গলের আড়াল ঘেরা তালখানা গ্রাম। সূর্য এখানে এক ঘন্টা পরে আলোক দেখায়। সূর্য ডোবার এক ঘন্টা আগে এখানে চারিদিকে রাত্র হইয়া যায়। প্রত্যেকটি বাড়িতে আম, কাঁঠাল, সুপারীর বন। তার পাশে বাঁশ ঝাড়, কলার ঝড়, আর নানা আগাছার বন। প্রত্যেকটি গাছের সঙ্গে নাম-না-জানা লতা, এ-গাছের সঙ্গে ও-গাছকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। শেয়াল, খাটাস দিনের বেলায়ই নির্ভয়ে সারা গ্রামে ঘুরিয়া বেড়ায়। বুনো শুয়োরের ঝাক দল বাধিয়া বনের মধ্যে বিচরণ করে। কোন বাড়িতেই বেশী লোকজন নাই। যাহারা আছে তাহাদের পেট উঁচু, বুকের হাড় কয়খানা বাহির করা। এই গ্রামে আসিয়া প্রথমে আজাহের গরীবুল্লা মাতবরের সঙ্গে দেখা করিল।

    গরীবুল্লা মাতবর মিনাজদ্দী মাতবরের সম্পর্কে বৈবাহিক। মিনাজদ্দী মাতবর আগেই আজাহেরকে গরীবুল্লা মাতবরের সঙ্গে দেখা করিতে বলিয়া দিয়াছিল।

    সারাদিন হাঁটিয়া শ্রান্ত-ক্লান্ত হইয়া প্রায় সন্ধ্যা বেলা তাহারা গরীবুল্লা মাতবরের বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। মাতবর বৈঠকখানায় বসিয়া তামাক টানতেছিল। হঠাৎ এই আগন্তুক লোকদের দেখিয়া আশ্চর্য হইল।

    আজাহের মাতবরকে সালাম জানাইয়া কহিল, “আমরা মিনাজদ্দী মাতবরের দ্যাশ অইতে আইছি।”

    মোড়ল খুশী হইয়া বলিল, “আরে কুটুমের দ্যাশ অইতে আইছ! তা বইস বাই! বইস।”

    তারপর অন্দর-বাড়ির দিকে মুখ লইয়া উঁচু গলায় বলিল, “আরে আমাগো বাড়ির উনি কৈ গ্যাল? এদিক আসুক দেহি। কুটুম আইছে। আজ সকাল বেলা থাইকাই কুটুম-পক্ষি ডাকত্যাছে, তখনই মনে করছিলাম, আইজ কুটুম আইব।”

    মোড়লের স্ত্রী হাসি-খুশী মুখে বাড়ির ভিতর হইতে দৌড়াইয়া আসিল। তারপর আজাহেরকে দেখিয়া মুখে লম্বা ঘোমটা টানিয়া দিল। মাতবর কহিল, “আরে শরম কইর না। বেয়াইর দ্যাশের লোক। শীগগীর ওজুর পানি পাঠায়া দাও। আর শোন, এগো বাড়ির মদ্দি নিয়া যাও।”

    মোড়লের স্ত্রী আজাহেরের বউ-এর কোল হইতে মেয়েটিকে টানিয়া বুকে লইল। তারপর আজাহেরের বউকে টানিয়া লইয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। একটু পরেই ছোট মেয়েটি পানির বদনা এবং খড়ম আনিয়া বৈঠকখানায় রাখিল। মোড়ল মেয়েটিকে ডাকিয়া কহিল, “দেখ ফুলু! তোর মাকে ক গিয়া বড় মোরগড়া জবাই কইরা দিতি। আইজ বেয়াই-এর দ্যাশের কুটুমরে বাল কইরা খাওয়াইতি অবি।” মেয়েটি রুমঝুম করিয়া পায়ের খাড়ু বাজাইতে বাজাইতে চলিয়া গেল।

    আজাহের তাহাকে নিষেধ করিবারও সুযোগ পাইল না। এইসব আদর-আপ্যায়নে আজাহের শরমে মরিয়া যাইতেছিল। সে ত কুটুমের মত দু’একদিনের জন্য এদেশে বেড়াইতে আসে নাই। অনাহারী স্ত্রী-পুত্র লইয়া মোড়লের ঘাড়ে একটা ভার হইতে আসিয়াছে। সমস্ত জানিয়া শুনিয়া মোড়ল তাহাকে কি ভাবে গ্রহণ করিবে, কে বলিবে? একটি পয়সা সে সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিতে পারে নাই। সেই জন্য আগেই আজাহের মোড়লকে তাহার সমস্ত অবস্থা জানাইয়া দেওয়ার সুযোগ খুঁজিতে লাগিল।

    একটু কাসিয়া বলিল, “মোড়ল সাহেব! আমাগো জন্যি ব্যস্ত অবেন না। আমাগো সগল হুনলি,”–

    “আরে মিঞা! সগল কতাই হুনবানি। আগে বইস্যা জিরাও, নাস্তা খাও।”

    এমন সময় মোড়লের মেয়ে ফুলু চীনের রেকাবীতে করিয়া মুড়ি, তীলের নাড়, নারকেলের তক্তি–আর একটি বাটিতে করিয়া ঘন আওটা দুধ আজাহেরের সামনে আনিয়া ধরিল। আজাহের কি বলিতে চাহিতেছিল মোড়ল তাহা কানেও তুলিল না, “আরে মিয়া! আগে নাস্তা খায় লও।”

    অগত্যা আজাহের হাত পাও ধুইয়া নাস্তা খাইতে বসিল। মোড়ল তাহার সঙ্গে গল্প করিতে লাগিল।

    “আরে মিঞা! তোমরা ঐলা গাঙের দ্যাশের মানুষ, তাও আবার শহরের কাছে বাড়ি। তোমাগো কি আমরা খাতির করতি পারি? এই গই-গিরামে কিবা আছে আর কিবা খাওয়াব?”

    আজাহের খাইতে খাইতে মুখ উঠাইয়া বলে, “আরে কি যে কন মোড়ল সাব?”

    “কব আর কি আজাহের বাই?” মোড়ল খুশী হইয়া উত্তর করে, “হেবার গেলাম বেয়াইর বাড়িতি! কাছারী গরে কতা কইতাছি, এক দণ্ডও যায় নাই অমনি জিলাপী, হন্দেশ আরও লওয়াজিমা আইন্যা উপস্থিত। কত আর খাব? খাওয়ার পরে বিয়াই কয় চা খাও। চীন্যা-বাটিতে ভইরা চার পানি ত আইন্যা দিল। গরম, মুহি চুমুক দিয়া মুখ পুড়ায়া ফেললাম। তারপর বিয়াইরে কই, ‘বিয়াই! চা ত খাইলাম। এইবার পানি দাও। পানি খাই। বিয়াইন ও-কোণা খাড়ায়া মুহি কাপড় দিয়া আসে। আমি জিজ্ঞাইলাম, আপনার কি অইল বিয়াইন?’ বিয়াই তখন কয়, “তোমার বিয়াইন তোমারে ঠগাইল। চা খায়া পানি খাইতি হয় না। আমি ত এহেবারে নামাকূল আর কি! তোমাগো শহইর্যা দ্যাশের মানষিরী আমরা কি আর খাতির করব? আরে মিয়া! উঠলা যে? ওই উড়মগুলা সবই খাইতি অবি। আর বাটিতে দুধও ত পইড়া রইল?” মোড়ল বাটির সমস্ত দুধ আজাহেরের পাতে ঢালিয়া দিল। নাস্তা খাওয়া শেষ হইলেই মোড়ল নিজের বাশের চোঙ্গা হইতে পান বাহির করিল। পাশের দাখানা লইয়া একটা সুপারি অর্ধেক কাটিয়া আজাহেরের হাতে দিল। “মিঞা! পান-সুপারি খাও।” তারপর খুব গর্বের সঙ্গে বলিতে লাগিল, “পান আমার নিজির বাড়ির, আর সুপারিও নিজির গাছের। চুনডা ক্যাবুল কিনছি।” বলিয়া চুনের পাত্রটি সামনে আগাইয়া দিল। আজাহের পান মুখে দিতে না দিতেই মোড়ল নিজির হাতের হুঁকোটি আনিয়া আজাহেরের হাতে দিল।

    বাড়ির ভিতরেও ওদিকে মোড়লের স্ত্রী আজাহেরের বউকে কম খাতির করিল না। ছেলে-মেয়ে দুটি মোড়লের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে। মুরগীর ঝোল চুলায় উঠাইয়া দিয়া মোড়লের বউ আজাহেরের বউ-এর চুল লইয়া বসিল।

    “পোড়া-কপালী! এমন চুল তোর মাথায়! তাতে ত্যাল নাই।” আঁজলা পুরিয়া তেল লইয়া বউটির মাথায় ঘসিতে বসিল। তারপর বাঁশের চিরুণীখানা লইয়া ভালমত আঁচড়াইয়া সুন্দর করিয়া একটি খোঁপা বাঁধিয়া দিল। “বলি পোড়া-কপালী! দুইদিনের জন্যি ত আইছাস। বালমত আদর কইরা দেই, আমাগো কতা তোর মনে থাকপি।” বউ যেন কি বলিতে যাইতেছিল। মুখে একটা ঠোকনা মারিয়া মোড়ল-গিন্নী বলিল, “বলি আমি তোর বইন অই কিনা? আমার বাড়িতে তুই অযত্তনে থাকপি,–তা দেইখ্যা তোর জামাই। আমারে কি কইব?”

    এত আদর-যত্ন পাইয়া আজাহেরের বউ-এরও বড়ই অসোয়াস্তি বোধ হইতেছিল। ভিখারীর মত তাহারা আশ্রয় লইতে আসিয়াছে। তাহাদের প্রতি তেমনি ভিখারীর আচরণ করিলেই সে খুশী হইতে পারিত। কিন্তু মোড়ল-গিন্নী একি করিতেছে? তাহাদিগকে আত্মীয়-কুটুম্বের মত যত্ন করিতেছে। এটা ওটা আনিয়া খাওয়াইতেছে। কাল যখন টের পাইবে, তাহারা পেটের ভুখের তাড়নায়ই এদের বাড়িতে আশ্রয় লইতে আসিয়াছে, তখন

    জানি ইহারা কি ভাবে তাহাদের গ্রহণ করিবে? কিন্তু মোড়ল-গিন্নীর মুখোনি যেন সকল দুনিয়ার মমতায় ভরা। রোগা একহারা পাতলা গঠন, বয়স পাঁচ চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু মুখের হাসিখানি কি করুণ আর মমতায় ভরা। মা বলিয়া কোলে ঝাপাইয়া পড়িতে ইচ্ছা করে। তাকেও আজাহেরের বউ দুই চার বার তাহাদের সমস্ত দুঃখের কাহিনী বলিবার জন্য চেষ্টা করিল। মোড়ল-গিন্নী সেদিকে কানও দিল না।

    রাত্রের খাওয়া দাওয়া শেষ হইলে একখানা ঘরে মোড়ল আজাহেরদের শুইবার দিল। মোড়ল-গিন্নীর সুবন্দোবস্তে আজাহেরের ছেলে-মেয়ে দুইটি আগেই বিছানার এক পাশে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleষোল-আনি – জলধর সেন
    Next Article ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }