Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বোবা কাহিনী – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প320 Mins Read0

    ১৬-২০. আজাহেরের ছেলে বছির

    ১৬.

    রাত্র শেষ না হইতে আজাহেরের ছেলে বছির জাগিয়া উঠিল। চারিদিকের বনে কত রকমের পাখিই না ডাকিতেছে। মাঝে মাঝে কাঠ-ঠোকরা শব্দ করিতেছে। দল বাধিয়া শিয়ালেরা মাঝে মাঝে চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। আর বনের ভিতর হইতে শো শো শব্দ আসিতেছে। এক রহস্য মিশ্রিত অজানা ভয়ে তাহার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। কখন সকাল হইবে। কখন সে তাহার সদ্য পরিচিত খেলার সাথীদের সঙ্গে এই অজানা। দেশের রহস্য উদঘাটিত করিয়া তুলিতে পারিবে।

    এমন সময় ফুলু আসিয়া ডাক দিল, “বছির-বাই, আইস। আমরা তাল কুড়াইবার যাই।” তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া বছির বাহির হইয়া পড়িল। মোড়লের পুত্র নেহাজদ্দী আর গেদাও উঠানে অপেক্ষা করিতেছিল। তাহারা সকলে মিলিয়া পানা-পুকুরে ডুবান একটা ডোঙ্গা পেঁচিয়া তাহাতে উঠিয়া বসিল। নেহাজী হাতে লগি লইয়া অতি নিপুণভাবে ডোঙ্গাখানিকে ঠেলিয়া আঁকাবাঁকা নাও দাঁড়া বাহিয়া ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়া সেই বেত ঝাড়ের অন্ধকারে তালগাছ তলায় আসিয়া উপস্থিত হইল। পানির উপরে রাশি রাশি তাল ভাসিয়া বেড়াইতেছিল? যেন তাহাদেরই ছোট ছোট খেলার সাথীগুলি। সকলে মিলিয়া কলরব করিয়া তালগুলিকে ধরিয়া ডোঙ্গায় উঠাইতে লাগিল। তারপর তাল টোকান প্রায় শেষ হইয়া আসিল। ঘন জঙ্গলের আড়ালে লতা পাতার আবরণে দু’একটা তাল তখনও লুকাইয়াছিল।

    এবার সেই তালগুলির যেটি যে আগে দেখিতে পাইবে সেটি তাহারই হইবে। দেখা যাক কার ভাগে কয়টি তাল পড়ে। যার ভাগে বেশী তাল পড়িবে সে লগি দিয়া ডোঙা ঠেলিয়া লওয়ার সম্মান পাইবে। তাল খুঁজিতে তখন তাহাদের কি উৎসাহ, “মিয়া-বাই! ওইদিকে লগি ঠ্যাল, ওই যে একটা তাল, ওই যে আর একটা।” ফুলেরই মতন মুখোনি নাচাইয়া ফুলী বলে। এইভাবে তাল টুকাইয়া দেখা গেল, ফুলীর ভাগেই বেশী তাল হইয়াছে। বড় ভাই নেহাজদ্দী বড়ই মনমরা হইয়া তাহার লগি চালানোর সম্মানটি ছোট বোনকে দিতে বাধ্য হইল। কোমরে আঁচল জড়াইয়া ফুলী লগি লইয়া ডোঙা ঠেলিতে। লাগিল। সামনে দিয়া দুই তিনটি সাপ পালাইয়া গেল। একটা সাপ ত ডোঙর মাথায়ই। একেবারে পেচাইয়া গেল। বছির ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল, “আর সাপ–সাপ, কামুড় দিবি!” অতি সন্তর্পণে লগির মাথা দিয়া সাপটিকে ছাড়াইয়া ফুলী খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। তাহার ভাই দুটিও বোনের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিল। ইহারা মানুষ না কি! সাপ দেখিয়া ভয় করে না! বছিরের বড় গোস্বা হইল।

    ফুলী পূর্বেরই মত হাসিতে হাসিতে বলিল, “বছির-বাই! ওগুলো গাইছা সাপ। আমাগো কি করব?”

    “ক্যান কামুড় দ্যায় যদি?” বছির বলিল।

    পূর্ববৎ হাসিতে হাসিতে ফুলী বলিল, “কামুড় কেমন কইরা দিবি, আমার হাতে লগি নাই? এক বাড়িতি মাথা ফাটায়া দিব না?” কিন্তু বছির ইহাতে কোনই ভরসা পাইল না। পথে আসিতে আসিতে পুকুর হইতে তাহারা অনেক ঢ্যাপ-শাপলা তুলিল। বছিরের কিন্তু একাজে মোটেই উৎসাহ লাগিতেছিল না। কোন সময় আর একটা সাপ আসিয়া ডোঙা পেচাইয়া ধরিবে কে জানে। কিন্তু তাহাদের দুই ভাই-বোনের উৎসাহের সীমা নাই। এখানে ওখানে অনেক ঢ্যাপ কুড়াইয়া তাহারা বাড়ির ঘাটে আসিয়া ডোঙা ভিড়াইল। তখন বাড়ির। সকল লোক উঠিয়াছে। মোড়ল ঘাটে মুখ হাত ধুইতে আসিয়াছিল। ছেলে-মেয়েদের এই অভিযানের সাফল্য দেখিয়া তাহাদিগকে তারিফ করিল। ইহাতে তাহাদের সারা সকালের সমস্ত পরিশ্রম যেন সার্থক হইয়া উঠিল। ফুলী তার ফুলের মত মুখোনি দুষ্টামীতে ভরিয়া বলিল, “বাজান! ডোঙার আগায় একটা গাইছা সাপ বায়া উঠছিল। তাই দেইখা বছির-বাই একেবারে বয়ে চিক্কর দিয়া উঠছে।” শুনিয়া মোড়ল একটু হাসিল। ইহার ভিতর। কি তামাসার ব্যাপার আছে বছির তাহা বুঝিতে পারিল না।

    .

    ১৭.

    পাঁচ ছয়দিন কাটিয়া গেল। আজাহের কিছুতেই গরীবুল্লা মাতবরকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিবার অবসর পাইল না। যখনই সে মাতবরকে সমস্ত বলিতে গিয়াছে, মাতবর কৌশলে অন্য কথা পাড়িয়াছে।

    ইতিমধ্যে তাহাদের সম্মানে মাতবর গ্রামের সমস্ত লোককে দাওয়াত দিয়াছে। আজ দুপুরে খাসী জবাই করিয়া বড় রকমের ভোজ হইবে। নিমন্ত্রিত লোকেরা প্রায় সকলেই আসিয়া গিয়াছে। এইসব আত্মীয়তার অতি সমাদর আজাহের কিছুতেই সহ্য করিতে পারিতেছিল না। আজ যেমন করিয়াই হোক সে মাতবরকে সমস্ত খুলিয়া বলিবে। ইতিমধ্যে সে বহুবার মাতবরের বাড়িতে এটা ওটা কাজ করিতে গিয়াছে। হালের লাঙল লইয়া মাঠে যাইতে চাহিয়াছে, মাতবর তার কাধ হইতে লাঙল কাড়িয়া লইয়াছে, হাত হইতে কাস্তে কাড়িয়া লইয়াছে। বলিয়াছে “কুটুমির দ্যাশের মানুষ। মিঞা! তুমি যদি আমার বাড়িতি কাম করবা, তয় আমার মান থাকপ? কুটুম বাড়িতে আইছ। বাল মত খাও দাও, এহানে ওহানে হাইট্যা বেড়াও, দুইডা খোশ গল্প কর।” আজাহের উত্তরে যাহা বলিতে গিয়াছে, মাতবর তাহা কানেও তোলে নাই। অন্দরমহলেও সেই একই ব্যাপার। আজাহেরের বউও এটা ওটা কাজ করিতে গিয়াছে, ধান লইয়া কেঁকিতে পাড় দিতে গিয়াছে, হাঁড়ি-পাতিল লইয়া ধুইতে গিয়াছে, মোড়লের বউ আসিয়া তাহাকে টেকি-ঘর হইতে টানিয়া লইয়া গিয়াছে, হাত হইতে হাঁড়ি-পাতিল কাড়িয়া লইয়াছে; আর অভিযোগের সুরে বলিয়াছে, “বলি বউ! হাঁড়ি দিয়া কি করবার লাগছাস? কুটুমবাড়িতি আয়া তুই যদি কাম করবি, তয় লোকে কইব কি আমারে? কত কাম কাইজির বাড়ির থইন্যা আইছাস, এহানে। দুইদিন জিড়া। হাড় কয়খানা জুড়াক।”

    আজাহের যখন এইসব লইয়া তাহার বউ এর সঙ্গে গভীর পরামর্শ করিতে বসিয়াছে, তখন মোড়লের বউ আসিয়া বেড়ার ফাঁকে উঁকি মারিয়া বলিয়াছে, “বলি বিয়াইর দ্যাশের কুটুমরা কি গহীন কতা কইবার লাগছে। তা ক-লো বউ ক’। এক কালে আমরাও অমনি কত কতা কইতাম। কতা কইতি কইতি রাত কাবার অয়া যাইত, তবু কতা ফুরাইত না।”

    লজ্জায় বউ তাড়াতাড়ি সেখান হইতে পালাইয়া গিয়াছে। মোড়ল-গিনী উচ্চ হাসিয়া। বলিয়াছে, “কি-লো বউ! পালাইলি ক্যান? তোবা, তোবা, কান মলা খাইলাম আজাহের। বাই। আর তোমাগো নিরাল-কতার মদ্দি আমি থাকপ না। না জানি তুমি আমারে মনে। মনে কত গালমন্দ করত্যাছ?”

    কলরব শুনিয়া মোড়ল আসিয়া উপস্থিত হয়। “কি ঐছে? তোমরা এত আসত্যাছ ক্যান?” মোড়লের কানে কানে মোড়ল-গিন্নী কি কয়। মোড়ল আরো হাসিয়া উঠে। আজাহের কয়, “আরে বাবিসাব কি যে কন? আমরা কইত্যাছিলাম …..”

    “তা বুঝছি, বুঝছি আজাহের বাই! কি কইত্যাছিলা তোমরা নিরালে। তবে আজ কান মলা খাইলাম তোমাগো গোপন কতার মদ্দি আড়ি পাতপ না।” লজ্জায় আজাহের ঘর হইতে বাহির হইয়া যায়। মোড়ল আর মোড়ল-গিন্নী হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে। ওদিকে ঘোমটায় সমস্ত মুখ ঢাকিয়া আজাহেরের বউ লজ্জায় মৃত্যু কামনা করে।

    এ কয়দিন সমস্ত গ্রাম ঘুরিয়া এ-বাড়ি ও-বাড়ি বেড়াইয়া আজাহেরের নিকট এই গ্রামটিকে অদ্ভুত বলিয়া মনে হইয়াছে। এ গ্রামে কেহ কাহারও সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করে না। কাহারও বিরুদ্ধে কাহারও কোন অভিযোগ নাই। গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোক ম্যালেরিয়ায় ভুগিতেছে। সন্ধ্যা হইলেই তাহারা কাঁথার তলে যাইয়া জ্বরে কাঁপিতে থাকে। সকাল হইলেই আবার যে যাহার মত উঠিয়া পান্তা-ভাত খাইয়া মাঠের কাজ করিতে বাহির হইয়া যায়। কেউ কোন ডাক্তার ডাকে না। আর ডাক্তার ডাকিবার সঙ্গতিও ইহাদের নাই। গলায় মাদুলী ধারণ করিয়া কিংবা গ্রাম্য-ফকিরের পড়া-পানি খাইয়াই তাহারা চিকিৎসা করার কর্তব্যটুকু সমাধা করে। তারপর রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে করিতে একদিন চিরকালের মত পরাজিত হইয়া মৃত্যুর তুহীন শীতল কোলে নীরবে ঘুমাইয়া পড়ে। কাহারও বিরুদ্ধে তাহাদের কোন অভিযোগ নাই। কাহারও উপরে তাহাদের মনে কোনদিন। কোন ক্ষোভ জাগে না।

    সকলেরই পেট উঁচু, বুকের হাড় কয়খানা বাহির করা, বেশী পরিশ্রমের কাজ কেহ করিতে পারে না। কিন্তু তাহার প্রয়োজনও হয় না। এদেশের মাটিতে সোনা ফলে। কোন রকমে লাঙলের কয়টা আঁচড় দিয়া মাটিতে ধানের বীজ ছড়াইয়া দিলেই আসমানের কালো মেঘের মত ধানের কচি কচি ডগায় সমস্ত মাঠে ছড়াইয়া যায়। আগাছা যাহা ধানখেতে জন্মায় তাহা নিড়াইয়া ফেলার প্রয়োজন হয় না। বর্ষার সময় আগাছাগুলি পানির তলে ডুবিয়া যায়! মোটা মোটা ধানের ডগাগুলি বাতাসের সঙ্গে দুলিয়া লক লক করে। কিন্তু এদেশে শূকরের বড় উৎপাত। রাত্রে শূকর আসিয়া ফসলের খেত নষ্ট করিয়া যায়। বন। হইতে বাঘ আসিয়া গোয়ালের গরু ধরিয়া লইয়া যায়। ম্যালেরিয়ার হাত হইতে রেহাই পাইয়া গ্রামে যাহারা ভাল থাকে তাহারা সারা রাত্র জাগিয়া আগুন জ্বালাইয়া টিন বাজাইয়া শূকর খেদায়, বাঘকে তাড়া করে। তাই পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদের সুযোগ তাহাদের ঘটে না। তাহাদের বিবাদ বুনো শূকরের সঙ্গে, হিংস্র বাঘের সঙ্গে। এইসব শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পাড়ার সকল লোকের সমবেত শক্তির প্রয়োজন। সেই জন্য গ্রামের লোকেরা এক ডাকে উঠে বসে। একের বিপদে অপরে আসিয়া সাহায্য করে। শহরের নিকটের গ্রামগুলির মত এখানে দলাদলি মারামারি নাই; মামলা-মোকদ্দমাও নাই।

    পূর্বে বলিয়াছি নতুন কুটুমের সম্মানে মোড়ল গ্রামের সব লোককে দাওয়াৎ দিয়া আসিয়াছে। নিমন্ত্রিত লোকেরা আসিয়া গিয়াছে। কাছারী-ঘরে সব লোক ধরে না। সেইজন্য উঠানে মাদুর বিছাইয়া সব লোককে খাইতে দেওয়া হইল। আজাহেরকে সকলের মাঝখানে বসান হইল। তার পাশেই গরীবুল্লা মাতবর আসন গ্রহণ করিল। নানা গল্প-গুজবের মধ্যে আহার চলিতে লাগিল। সকলের দৃষ্টি আজ আজাহেরের দিকে। শহরের কাছে তাহার বাড়ি, তাতে সে আবার মোড়লের কুটুম্ব। সে কেমন করিয়া খায়, কেমন করিয়া কথা বলে, কেমন করিয়া হাসে, সকলেই অতি মনোযোগের সহিত সেদিকে দৃষ্টি দিতে লাগিল। তাহারা অনেকেই শহরে যায় নাই। শহরের বহু রোমাঞ্চকর আজগুবি-কাহিনী শুনিয়াছে। আজ শহরের কাছের এই লোকটি তাই তাহাদের নিকট এত আকর্ষণের।

    এত সব যাহাকে লইয়া সেই আজাহের কিন্তু ইহাতে তৃপ্ত হইতে পারিতেছিল না। এই সব জাঁকজমক আজাহেরকে তীব্র কাটার মত বিদ্ধ করিতেছিল। মোড়ল যখন জানিতে পারিবে, সে এখানে আত্মীয় কুটুম্বের মত দুইদিন থাকিতে আসে নাই–সে আসিয়াছে। ভিখারীর মত পেটের তাড়নায় ইহাদের দুয়ারে দয়া প্রার্থনা করিতে; তখন হয়ত কুকুরের মত তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিবে। কিন্তু আজই ইহার একটা হেস্তনেস্ত হইয়া যাওয়া ভাল। আজাহের মরিয়া হইয়া উঠিল। তিন চারবার কাশিবার চেষ্টা করিয়া মোড়লের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া আজাহের বলিল, “মোড়ল সাহেব! আমার একটা কতা।” মোড়ল বলিল, “মিঞারা! তোমরা চুপ কর। আমার বিয়াইর দ্যাশের কুটুম কি জানি কইবার চায়।” একজন বলিয়া উঠিল, “কি আর কইব! কুটুম বুঝি আমাগো চিনি-সন্দেশ খাওয়ানের দাওয়াৎ দিতি চায়!” সকলে হাসিয়া উঠিল। কিন্তু আজাহের আজ মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। তাহার সমস্ত ব্যাপার আজ সকলকে না জানাইয়া দিলে কিছুতেই সে সোয়াস্তি পাইবে না।

    আবার একটু কাশিয়া আজাহের বলিতে আরম্ভ করিল, “মোড়ল সাহেব! সেঁতের শেহলার মত ভাসতি ভাসতি আমি আপনাগো দ্যাশে আইছি। আমি এহানে মেজবান-কুটুমের মত দুইদিন থাকপার আসি নাই। আমি আইছি চিরজনমের মত আপনাগো গোলামতী করতি।” এই পর্যন্ত বলিয়া সভার সব লোকের দিকে সে চাহিয়া দেখিল; তাহারা কেহ টিটকারী দিয়া উঠিল কি না। কিন্তু সে আশ্চর্য হইয়া দেখিল তাহার কথা সব লোক নীরবে শুনিতেছে। তখন সে আবার আরম্ভ করিল, “বাই সব! আমারও বাড়ি-ঘর ছিল, গোয়ালে দুইডা যুয়ান যুয়ান বলদ ছিল, বেড়ী ভরা ধান ছিল; কিন্তু মহাজনে মিথ্যা দিনার দায়ে নালিশ কইর‍্যা আমার সব নিল্যাম কইরা নিয়া গ্যাছে।” এই পর্যন্ত বলিয়া আজাহের গামছার কানি দিয়া চোখ মুছিয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিল, “আধবেলা খায়া উপাস কইরা তবু ভিট্যার মাটি কামড়ায়া ছিলাম। কিন্তুক পুলাপানগুলা

    যহন বাত বাত কইরা কানত, তখন আর জানে সইত না। আমাগো মোড়ল মিনাজদ্দী মাতবর তহন কইল, আজাহের! যা, তাম্বুলখানা আমার বিয়াই গরীবুল্লা মাতবরের দ্যাশে যা। তানি তোর একটা কূল-কিনারা করব।”

    এই বলিয়া আজাহের আবার কঁদিতে লাগিল। তাহার সঙ্গে সমবেত গ্রাম্য লোকদেরও দুই একজনের চোখ অশ্রু সজল হইয়া উঠিল। মোড়ল নিজের গামছার খোট দিয়া আজাহেরের চোখ মুছাইতে মুছাইতে বলিল, “আজাহের বাই! কাইন্দ না। খোদা যহন তোমারে আমার এহানে আইন্যা ফেলাইছে, তহন একটা গতি হবিই।” আজাহের কি বলিতে যাইতেছিল। মোড়ল তাহাকে থামাইয়া বলিল, “আর কইবা কি আজাহের বাই? তুমি যেদিন পরথমে আইছ, সেই দিনই বুঝতি পারছি, শোগা-ভোগা মানুষ তুমি প্যাটের জ্বালায় আইছ আমাগো দ্যাশে। আরে বাই। তাই যদি বুঝতি না পারতাম তয় দশ গিরামে মাতবরী কইরা বেড়াই ক্যান? কিন্তুক তুমি তোমার দুস্কির কতা কইবার চাইছ, আমি হুনি নাই। কেন হুনি নাই জান? তোমার দুস্কির কতা আমি একলা হুনব ক্যান? আমার গিরামের দশ বাইর সঙ্গে একাত্তর বইসা হুনুম। তোমার জন্যি যদি কিছু করনের অয় তবে দশজনে মিল্যা করুম।” এই পর্যন্ত বলিয়া মোড়ল সকলের মুখের দিকে একবার তাকাইয়া লইল। মোড়ল যে এমনি একটা সামান্য ব্যাপারেও তাহাদের দশজনের সঙ্গে পরামর্শ করিতে বসিয়াছে, এজন্য মোড়লের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় তাহাদের মনের ভাব এমনই হইল যে, দরকার হইলে তাহারা মোড়লের জন্য জান পর্যন্ত কোরবানী করিয়া দিতে পারে। তাহাদের মুখের পানে চাহিয়া মোড়ল ইহা বুঝিতে পারে। বহু বৎসর মোড়লী করিয়া তাহার এই অভিজ্ঞতা হইয়াছে। মোড়ল আবার সমবেত লোকদের ডাকিয়া কহিল, “কি বল বাইরা! আজাহের মিঞারে তবে আমাগো গিরামে আশ্রয় দিবা তোমরা?” সকলে এক বাক্যে বলিয়া উঠিল, “তারে আমরা বুকি কইরা রাখপ।”

    “শুধু মুহির কতায় কি চিড়্যা ভেজে মিঞারা? কি ভাবে বুকি কইরা রাখপা সে কতাডা আমারে কও?”

    সম্মুখ হইতে দীনু বুড়ো উঠিয়া বলিল, “মাতবরের পো! আমার ত পুলাপান কিছুই নাই। মইরা গ্যালে জমি-জমা সাতে-পরে খাইব। আমার বাঘার ভিটাডা আমি আজাহের বাইর বাড়ি করবার জন্যি ছাইড়া দিলাম। এতে আমার কুনু দাবি-দাওয়া নাই।”

    দীনু বুড়োর তারিফে সকলের মুখ প্রসন্ন হইয়া উঠিল।

    এ-পাশ হইতে কলিমদ্দী উঠিয়া বলিল, আজাহের-বাইর বাড়ি করতি যত ছোন লাগে সমস্ত আমি দিব।”

    তাহের নেংড়া বহু দূরে বসিয়া ছিল। সে নেংড়াইতে নেংড়াইতে কাছে আসিয়া বলিল, “তোমার বাড়ি করতি যত বাঁশ লাগবি, আমার ছোপের ত্যা তুমি কাইটা নিয়া যাবা আজাহের-বাই।”

    মোড়ল তখন চারিদিক চাহিয়া বলিল, “থাকনের ভিটা পাইলাম, গর তোলনের ছোন পাইলাম। বাশও পাইলাম। কিন্তুক আজাহের বাই ত একলা বাড়ি-গর তুলতি পারবি না?”

    সকলে কলরব করিয়া উঠিল, “আমরা সগ্যলে মিল্যা আজাহের-বাইর নতুন বাড়ি তুল্যা দিব। কাইল-ই কাম আরম্ভ কইরা দিব।”

    “ক্যাবল কাম আরম্ভ করলিই অবি না। কাইলকার দিনির মদ্দি আজাহের-বাইর নতুন বাড়ি গড়ায়া দিতি অবি। বুঝলানি মিঞারা? পারবা ত?” মোড়ল জিজ্ঞাসা করিল।

    সকলে কলরব করিয়া উঠিল, “পারব।”।

    “তা ঐলে এই কতাই ঠিক। কাইল সন্ধ্যার সময় আমি দাওয়াৎ খাইতি যাব। আজাহের-বাইর বাড়িতি। দেখি মিঞারা! তোমাগো কিরামত কতদূর।” এই বলিয়া মোড়ল প্রসন্ন দৃষ্টিতে একবার সকলের মুখের দিকে চাহিল। আজাহেরের জন্য ইতিমধ্যে গ্রামের লোকদের মধ্যে যে যতটা স্বার্থত্যাগ করিতে চাহিয়াছিল, সেই দৃষ্টির বিনিময়ে তাহা যেন স্বার্থক হইয়া গেল।

    সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া আজাহেরের মনে হইতেছিল সে যেন কোন গ্রাম্য-নাটকের অভিনয় দেখিতেছে। মানুষের অভাবে মানুষ এমন করিয়া সাড়া দেয়? আনন্দের অশ্রুতে তার দুইচোখ ভরিয়া আসিল।

    মোড়ল তখন আজাহেরকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “আজাহের-বাই! তোমার দুস্কির কতা তুমি আমারে একলারে হুনাইবার চাইছিলা? কিন্তু সেই হোননের কপাল ত আমার নাই। হেই দিন যদি আমার থাকত তবে গিরামের মানুষ ট্যারও পাইত না, ক্যামুন কইরা তুমি আইল্যা। কাক-কোকিলি জানার আগে তোমার গর-বাড়ি আমি তুল্যা দিতাম। বাগের মত যুয়ান সাতটা ভাজন বেটা ছিল। এক দিনের ভেদ-বমিতে তারা জনমের মত

    আমারে ছাইড়া গেল। তারা যদি আইজ বাইচ্যা থাকত, তবে তুমি যেইদিন আইছিলা,  হেইদিন রাত্তিরেই তোমার নতুন গর-বাড়ি তুল্যা দিতাম। আইজ গিরামের মানুষ ডাইকা তোমার গর-বাড়ি তুলবার কইছি।”

    আজাহের কি যেন বলিতে যাইতেছিল। মোড়ল তাহাকে থামাইয়া দিয়া বলিল, “আরে বাই! তুমি ত পরথমে গিরামের লোকগো কাছে আস নাই। আইছিলা আমার কাছে। আমি তোমার জন্যি কিছুই করবার পারলাম না। আমার পুলারা যদি আইজ বাইচ্যা থাকত?” গামছার খোট দিয়া মোড়ল চোখের পানি মুছিতে লাগিল।

    পাশে বাবরী-চুল মাথায় মোকিম বসিয়াছিল। সে বলিয়া উঠিল, “মোড়ল-ভাই! আপনি কানবেন না। আমরা আপনার পোলা না? আমরা গেরামের সকল পোলাপান মিল্যা আজাহের-বাইর বাড়ি-গর তুল্যা দিব।”

    “আরে মোকিম! তুই কি কস?” গামছার খোটে চোখের পানি মুছিতে মুছিতে মোড়ল বলে, “হেই গিরামের মানুষই কি সব আছে? কি দেখছিলাম, আর কি দেখপার জন্যি বইচ্যা আছি? এই গিরামে ছিল হাসেন নিকারী, কথায় বলে হাসেন নিকারীর খ্যালা, তিনডা ভেঁকি হাতের উপর লয়া শূন্যের উপর খেলা দেখাইত। তারোয়ালখানা ওই নাইরকেল গাছটার উপর ছুঁইড়্যা ফেলাইত, বো বো কইরা তারোয়াল যায়া গাছের নাইরকেল কাইট্যা আইন্যা আবার ফিরা আইস্যা হাসেন নিকারীর পায়ের কাছে সেলাম জানাইত।”

    দীনু বুড়ো বলিয়া উঠিল, “আপনার মনে নাই বড়-মিঞা! ওই জঙ্গলডার মদ্দি ছিল হাকিম চান আর মেহের চান্দের বাড়ি, দুইজনে যহন জারীগান গাইত বনের পশু-পক্ষী গলাগলি ধইরা কানত?”

    “মনে নাই ছোটমিঞা?” মোড়ল বলে, “ফৈরাতপুরির মেলায় যায় গান গায়া রূপার দুইডা ম্যাডাল না কি কয়, তাই লয়া আইল। আমার সামনে তাই দেখায়। কয়, “মোড়ল, এই দুইডা আমাগো বাবির পরন লাগবি। পাগলা কানাইর সঙ্গে গান গায়া তারে হারায়া আইছি। তারই পুরস্কারি পাইছি এই দুইডা, আমাগো বাবি যেন গলায় পরে। অনেক মানা করলাম, অনেক নিয়ারা করলাম, হুনল না। হেই দুইডা মেডিল এহনো আমার বাড়িওয়ালীর গলায় আছে। কিন্তুক হেই মানুষ আইজ কোথায় গেল?”

    “মনে আছে বড়মিঞা?” দীনু বুড়ো আগাইয়া আসিয়া কয়, “দিগনগরের হাটের মদ্দি আমাগো গিরামের হনু গেছিল কুশাইর বেচতি, কি একটা কতায় মুরালদার লোকেরা দিল তারে মাইর। আমাগো গিরামের কমিরদ্দী গেছিল মাছ কিনতি। হুইন্যা, একটা আস্ত জিকা গাছ ভাইঙ্গা সমস্ত মুরালদার মানষিরে আট থইনে বাইর কইর‍্যা দিয়া আইল।”

    “মনে সবই আছে ছোট-মিঞা! সেই কমিরীর ভিটায় আইজ ঘু ঘু চরত্যাছে। সন্ধ্যা-বাত্তি জ্বালনের একজনও বাইচ্যা নাই।” একটা দীর্ঘ নিশ্বাস লইয়া মোড়ল আবার বলিতে আরম্ভ করিল, “আমাগো তাম্বুলখানার গিরামখানা গমগম করত মানষির। কতাবার্তায়। এ যেন কালকার ঘটনা। স্বপনের মতন মনে হইত্যাছে। রাত-দিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি গান, কত আসি, কত তামাসা? এই ম্যালোয়ারী বিমারে সব শেষ কইর‍্যা দিল। আর কি সেই সব দিন ফিরা পাব? গোরস্তানের মদ্দি বুইড়্যা পাহাড়াদার খাড়ায়া আছি। নিজের দুস্কির কতা তোমাগো আর কয়া কি করব? সারা রাইত আমার গুম আসে না। জনমের মত যারা চইল্যা গ্যাছে গিরাম ছাইড়া, নিশির রাত্তিরকালে গোরের থইনে উইঠ্যা তারা আমারে জিগায়, ‘মোড়ল! আমরা ম্যালোয়ারীতে মরলাম, তোমার গিরামের কোন মানুষ এমন হেকমত কি কোন দিন বাইর করতি পারবি, যাতে ম্যালোয়ারী জ্বরের হাত। থইনে আমাগো আওলাদ-বুনিয়াদ যারা বাইচ্যা আছে তাগো বাঁচাইতে পারে? এ কতার আমি কুনু জবাব দিব্যার পারি না। নিজের দুস্কির কাহিনী কইলে ফুরাইবার নয়। আর কত কমু? বাইরা! তোমরা যার যার বাড়ি যাও। আমারও শরীরডা জ্বরায়া আসত্যাছে। এহনই কাঁথার তলে যাইতি অবি। কিন্তুক কাইলকার কতা যেন মনে থাহে। আমি সন্ধ্যা। বেলা যাব নতুন বাড়িতি দাওয়াৎ খায়নের লাগ্যা।”

    গ্রামের লোকেরা যে যার মত বাড়ি চলিল। অনেকেরই শরীরে মৃদু জ্বরের কাঁপন অনুভূত হইয়াছে। কিন্তু সমস্ত ছাপাইয়া কি একটা গভীর বিষাদে যেন সকলের অন্তর ভরা। অতীত দিনের অন্ধকারতল হইতে মোড়ল আজ এই গ্রামের যে বিস্মৃত গৌরব-কথার খানিক প্রকাশ করিল, তাহার মৃদু স্পর্শ সকলকেই অভিভূত করিয়া তুলিতেছে।

    .

    ১৮.

    সন্ধ্যার কিছু আগেই লাঠি ভর দিয়া মোড়ল আজাহেরের নতুন বাড়ি দেখিতে আসিল। আসিয়া যাহা দেখিল, মোড়লও তাহাতে তাজ্জব বনিয়া গেল। বাঘার ভিটার মাঝখানে দু’খানা ঘর উঠিয়াছে। ঘরের পাশে ধরন্ত কলাগাছ। উঠানের একধারে জাঙলায় শ্রীচন্দনের লতা, তাহাতে রাশি রাশি শ্রীচন্দন ঝুলিতেছে। উঠানের অন্য ধারে লাল নটের খেত। কার যেন রাঙা শাড়িখানা রৌদ্রে শুখান হইতেছে।

    “ছ্যামড়ারা তোরা ত যাদু জানস্ দেহি! এত সমস্ত কোন হেকমতে করলিরে তোরা?” কথা শুনিয়া সমস্ত লোক কলরব করিয়া মোড়লকে আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইল। মোড়ল-গিন্নী ঘরের ভিতর হইতে ডাকিল, “আমাগো বাড়ির উনি এদিক আসুক একটু।” ঘরের মধ্যে যাইয়া মোড়ল আরো অবাক হইয়া গেল। ঘরের চালার আটনে একটা ফুলচাঙ পাতা। তাহার সঙ্গে কেলীকদম্ব সিকা, সাগরফানা সিকা, আসমান তারা সিকা, কত রঙ বেরঙের সিকা ঝুলিতেছে। সেই সব সিকায় মাটির বাসন। ছোট ছোট (হড়ি) বাতাসে দুলিতেছে। ঘরের বেড়ায় কাদা লেপিয়া চুন-হলুদ আর আলো-চালের গুঁড়া দিয়া নতুন নকসা আঁকা হইয়াছে। মোড়ল বুঝিতে পারিল তাহার গৃহিণী সমস্ত গায়ের মেয়েদের লইয়া সারা দিনে এইসব কাণ্ড করিয়াছে। সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া মোড়ল খুব তারিফ করিল, “বলি তোমরাও ত হেকমত কম জান না?” শুনিয়া খুশীতে ঘরে উপবিষ্ট সমবেত মেয়েদের মুখ রঙীন হইয়া উঠিল। মোড়লের বউ তখন বলিতে লাগিল, “এই সিকাডা দিছে বরান খার বউ, এইডা দিছে কলিমদ্দীর ম্যায়া, আর এই সিকাডা দিছে মোকিমির পরিবার।”

    মোড়ল বলিল, “বড় সুন্দর ঐছে। আমাগো গিরামে এমন কামিলকার আছে আগে জানতাম না।” বলিতে বলিতে মোড়ল বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল।

    মোকিম বুড়ো তখন আসিয়া বলিল, “মোড়ল-বাই! তুমি না কইছিল্যা আজাহেরের বাড়ি আইজ খাইবা। সামান্য কিছু খিচুড়ী রান্না ঐছে। তুমি না বসলি ত ছ্যামড়ারা উয়া মুহি দিবি না।”

    “তয় তোমরা কোনডাই বাহি রাহ নাই। আইজ বুঝতি পারলাম তোমাগো অসাদ্য কোনু কাম নাই,” বলিয়া মোড়ল আসিয়া খাইতে বসিল। খাওয়া দাওয়া শেষ হইলে যাহাদের ইতিমধ্যেই জ্বর আসিয়াছে তাহারা যাহার যাহার বাড়ি চলিয়া গেল; অবশিষ্ট লোকেরা একতারা দোতারা বাজাইয়া গান গাহিতে আরম্ভ করিল। প্রায় অর্ধেক রাত অবধি গান গাহিয়া যে যাহার বাড়িতে চলিয়া গেল। আজাহের নতুন ঘরে ছেলে-মেয়ে লইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।

    প্রভাত না হইতেই চারিধারের বন হইতে কত রকমের পাখি ডাকিয়া উঠিল। সেই পাখির ডাকে আজাহেরের ছেলে বছিরের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। এখনও ভাল মত সকাল হয় নাই। বছিরের কেমন যেন ভয় ভয় করিতে লাগিল। পাশেই তার ছোট বোন বড় অঘোরে ঘুমাইতেছে। সে বড়কে ডাকিয়া বলিল, “ও বড়ু উঠলি না? চল গুয়া কুড়ায়া আনি।” বড়ু। তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল।

    দুই ভাই-বোনে অতি সন্তর্পণে ঘরের দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিল। মা বাপ জাগিলে হয়ত এত ভোরে তাহাদের বাহিরে যাইতে দিবে না।

    সুপারি গাছের তলায় আসিয়া দেখে, বাদুড়ে কামড়াইয়া কত সুপারি ফেলিয়া গিয়াছে। দুই ভাই-বোনে একটি একটি করিয়া সুপারি কুড়াইয়া এক জায়গায় আনিয়া জড় করিয়া ফেলিল। কড়াইতে কি আনন্দ!

    “ওই একটা–ওই একটা, মিঞা বাই! তুমি ওদিক কুড়াও। এদিকটা আমার,” বলিয়া। বড়ু একটু জঙ্গলের মধ্যে গিয়াছে, অমনি একটা বন-সজারু সামনে দেখিয়া, চীৎকার করিয়া উঠিল, “ও মিঞা বাই! এইডা যেন কি?”

    বছির দৌড়াইয়া আসিয়া বলিল, “বড়ু! ডরাইস না। ওডা সজারু। আয় দেহি, জঙ্গলের মদ্দি সজারুর কাটা আছে কিনা। সজারুর কাঁটা দিয়া বেশ খেলা করা যায়।” দুই ভাই-বোনে তখন জঙ্গলের মধ্যে সজারুর কাটা খুঁজিতে লাগিল।

    এদিকে আজাহের ঘুম হইতে উঠিয়া ভাবিতে বসিল। নতুন বাড়ি ত তাহার হইল। কিন্তু তাহারা খাইবে কি! অবশ্য সাত আট দিনের আন্দাজ চাল ডাল মোড়ল গিন্নী দিয়া গিয়াছে। তাহা ফুরাইতে কয়দিন? পরের কাছে চাহিয়া চিন্তিয়া কয়দিন চালান যাইবে? ভাবিয়া ভাবিয়া আজাহের কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছিল না। আবার কি সে আগের মত জন খাঁটিয়া মানুষের বাড়িতে কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিবে? কিন্তু যেখানে লোকে তাহাকে এত আদর-যত্ন করিয়াছে তাহাদের বাড়িতে জন খাঁটিতে গেলে কি সেই খাতির থাকিবে? আর জন খাঁটিয়া যাহারা খায় গ্রামের লোকেরা তাহাদিগকে সম্মানের চোখে। দেখে না। আজাহের ভাবিল, আজ যদি তাহার গরু দুইটি থাকিত তাহা হইলে সে লাঙ্গল লইয়া খেত চষিতে পারিত। কিন্তু খেত চষিতে গেলেও বীজধান লাগে! আর খেতে ধান ছড়াইয়া দেওয়া মাত্রই তো ফসল ফলে না। বউকে ডাকিয়া জিজ্ঞাস করে, “কও ত এহন কি কাম করি?”

    বউ ভাবিতে বসে। অনেক ভাবিয়া বলে, “আমি একটা কতা কইবার চাই। এহানকার জঙ্গলে কত কাঠ। তুমি কাঠ ফাঁইড়া খড়ি বানায়া ফইরাতপুরির বাজারে নিয়া বিককিরি।

    “ভাল কতা কইছাও বউ। এইডাই কয়দিন কইরা দেহি।” বলিয়া আজাহের মোড়ল-বাড়ি হইতে কুড়াল আনিয়া জঙ্গলের মধ্যে গেল। যাইয়া দেখে তাহার ছেলে-মেয়ে । দুইটি আগেই আসিয়া সেখানে কি কুড়াইতেছে।

    “ও বাজান! দ্যাহ আমরা কত স্যাজারের কাটা কুড়ায়া পাইছি। একরাশ সজারুর কাঁটা আনিয়া ছোট মেয়েটি বাপকে দেখাইল। বছির বলিল, “বাজান! এই দিক একবার চায়াই দেহ না কত গুয়া কুড়াইছি?”

    “বেশতরে, অনেক গুয়া কুড়ায়া ফেলছাস। বাড়ির থইনে ঝকা আইন্যা এগুলা লয়া যা!”

    ছেলে দৌড়াইয়া গেল কঁকা আনিতে। আজাহের কুঠার লইয়া একটি গাছের উপর দুই। তিনটি কোপ দিল। কুঠারের আঘাতে গাছটি কাঁপয়া উঠিল। গাছের ডালে কয়েকটি পাখি বিশ্রাম করিতেছিল, তাহারা করুণ আর্তনাদ করিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল। আজাহেরের কুঠার কাপিয়া উঠিল। কুঠার মাটিতে রাখিয়া আজাহের সমস্ত গাছটির উপর একবার চোখ। বুলাইয়া লইল। কত কালের এই গাছ। বনের লতা জড়াইয়া পাকাইয়া এ-ডালের সঙ্গে ও-ডালে মিল করিয়া দিয়াছে। কত কালের এই মিতালী! শত শত বৎসরের মায়া-মমতা যেন লতা-পাতা শাখার মূক-অক্ষরে লিখিত হইয়াছে। অত শত আজাহের ভাবিতে পারিল কিনা জানি না। কিন্তু সামান্য গাছটির উপর চোখ বুলাইতে কি যেন মমতায় আজাহেরের। অন্তর আকুল হইয়া উঠিল। লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে বাস করিত, তখন এই গাছগুলি ছিল মানুষের দোসর। সেই আদিম প্রীতি তাহার অবচেতন মনে আঘাত করিল কিনা জানি না–গাছের যে স্থানটিতে সে কুঠারের আঘাত করিয়াছিল সে। স্থান হইতে টস্ টস্ করিয়া গাছের কস বাহির হইতেছে। আজাহের তাহা গামছার খেটে মুছিয়া দিয়া বলিল, “গাছ! তুই কান্দিস না। আর আমি তোগো কাটপ না।” এই গাছটির। মত সে নিজেও মূক। নিজের দুঃখ-বেদনা সে ভাষায় প্রকাশ করিয়া বলিতে পারে না। সেই। জন্য এই মূক-বৃক্ষের বেদনা সে বুঝি কিছুটা বুঝিতে পারে। কুঠার কাঁধে লইয়া আজাহের। সমস্ত জঙ্গলটার মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

    কত কালের ভুলিয়া যাওয়া আপনজনের সান্নিধ্যে যেন সে আসিয়াছে। এ-গাছের আড়াল দিয়া ও-গাছের পাশ দিয়া লতাগুল্মের মধ্য দিয়া বনের সরু পথখানি আঁকিয়া বাকিয়া চলিয়া গিয়াছে। এই পথে কাহারা চলে! বন-রহস্যের এই মায়াবি অন্তরখানি যাহাদের কাছে কিঞ্চিৎ উদঘাটিত হয় তাহারাই বুঝি চলিয়া চলিয়া এই পথ করিয়াছে। এক জায়গায় যাইয়া আজাহের দেখিল, একটা গাছের ডালে চার পাঁচ জায়গায় মৌমাছিরা চাক করিয়াছে। কি বড় বড় চাক! চাক হইতে ফোঁটায় ফোঁটায় মধু ঝরিয়া পড়িতেছে। অন্য। জায়গায় আজাহের দেখিল, একটা গাছের খোড়লে কটায় বাসা করিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া কটা পালাইয়া দূরে যাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। বাসায় চার পাঁচটি ছোট ছোট কালো বাচ্চা চিঁ চিঁ করিতেছে। বাচ্চাগুলিকে ধরিয়া আজাহের বুকের কাছে লইয়া একটু আদর করিল, তারপর অদূরবর্তী বাচ্চাদের মায়ের দিকে চাহিয়া অতি সন্তর্পণে সে তাহাদের গর্তের মধ্যে রাখিয়া অন্য পথ ধরিয়া চলিল। বনের পথ দিয়া সে যতদূর যায় তাহার তৃষ্ণা যেন মেটে না। যত সে পথ চলে বন যেন তাহার চোখের সামনে রহস্যের পর রহস্যের আবরণ খুলিয়া দেয়। এমনি করিয়া সারাদিন জঙ্গল ভরিয়া ঘুরিয়া আজাহের সন্ধ্যা বেলা গৃহে ফিরিয়া আসিল। বউ বলিল, “বলি কাঠ না কাটপার গেছিলা? তয় খালি আতে আইল্যা ক্যান?”

    আজাহের তাহার উত্তরে কিছুই বলিল না। কি এক অব্যক্ত আত্মীয়তার মমতায় তাহার সকল অন্তর ভরপুর। তাহার এতটুকু প্রকাশ করিয়া সেই মনোভাবকে সে ম্লান করিতে পারে না।

    সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। আজাহের চাহিয়া দেখে উঠানের এক কোণে একটি ছোট্ট কটার বাচ্চা লইয়া তাহার ছেলে-মেয়েরা খেলা করিতেছে। “বাজান! দেইখ্যা যাও। আমরা জঙ্গল থইনে কটার বাচ্চা ধইর্যা আনছি।” ছোট মেয়ে বড়ু আল্লাদে ডগমগ হইয়া বাপকে আসিয়া বলিল।

    “পোড়ামুখী! এ কি করছস? বুনো জানোয়ার, আহা ওগো মা-বাপ য্যান কতই কানত্যাছে।”

    “বাজান! এডারে আমরা পালব। এরে উড়ুম খাইতে দিছি। একটু বাদে ভাত খাওয়াব।”

    “কিন্তুক ওরা যে মার দুধ খায়। তোর কাছে ত ওরা বাঁচপ না।” আজাহের ভাবিল, কটার বাচ্চাটিকে লইয়া সে তাদের বাসায় দিয়া আসিবে। কিন্তু তখন অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। সেই দুর্ভেদ্য জঙ্গলের পথ সে এখন চিনিবে না। আর চিনিলেও এখন সেখানে যাওয়া অবিবেচনার কাজ হইবে। বুনো শূকর আর বাঘ সেখান দিয়া এখন নির্ভয়ে বিচরণ করিতেছে। মেয়েটিকে সে খুব বকিল। তাহার বকুনীতে মেয়েটি কাঁদিয়া ফেলিল।

    “ও বাজান! আমি ত জানতাম না কটার মা আছে। তারা ওর জন্যি কানব। তুমি বাচ্চাডিরে নিয়া যাও। ওগো বাসায় দিয়া আইস গিয়া।”

    কিন্তু এ অনুরোধ এখন নিরর্থক। আজাহের বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। ছোট কটার বাচ্চাটি চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছে। ও যেন মূক-বনের আপন সন্তান। ওর কান্নায় সমস্ত বন আর্তনাদ করিয়া উঠিতেছে। সারা রাত্র কটার বাচ্চাটির চিন্তায় আজাহেরের ঘুম আসিল না। বারবার উঠিয়া যাইয়া বাচ্চাটিকে দেখিয়া আসে। শেষ রাত্রে উঠিয়া যাইয়া দেখিল বাচ্চাটি শীতে কাঁপিতেছে। আজাহের অতি সন্তর্পণে নিজের গামছাখানি বাচ্চাটির গায়ের উপর জড়াইয়া দিয়া আসিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়িল। প্রভাত না হইতেই আজাহের জাগিয়া দেখিল, তাহার ছেলে-মেয়ে দুইটি বাচ্চাটিকে সামনে করিয়া কাঁদিতেছে। আজাহের আগাইয়া আসিয়া দেখিল সব শেষ হইয়া গিয়াছে। ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের পানিতে আজাহেরের দুই গণ্ড ভিজিয়া গেল। মেয়ে বাপের গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “বাজান! আমরা যদি জানতাম, তা ঐলে বাচ্চাডারে এমন কইরা আনতাম না। আমাগো দোষেই বাচ্চাটা মইরা গ্যাল।”

    উত্তরে আজাহের কোন কথাই বলিতে পারিল না। কিন্তু তাহার মনে হইতে লাগিল আজ যেন তাহার কি এক সর্বনাশ ঘটিল। মহাজনে তাহার যথাসর্বস্ব লইয়া তাহাকে পথের ফকির বানাইয়াছে–কত লোকে তাহাকে ঠকাইয়াছে কিন্তু কোন দিন সে নিজকে এমন অসহায় মনে করে নাই। কটার মায়ের সেই অপেক্ষমান ম্লান মুখোনি বারবার আজাহেরের মনে পড়িতে লাগিল। অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া আজাহের কাল যে গাছটি কাটিতে গিয়াছিল সেই গাছটির তলায় একটি ছোট্ট কবর খুঁড়িয়া যেমন করিয়া মানুষ। মরিলে গোর-দাফন করে তেমনি করিয়া বাচ্চাটিকে মাটি দিল। জানাজার কালাম সে-ই পড়িল। তাহার ছেলে মেয়ে দুটি পিছনে দাঁড়াইয়া মোনাজাত করিল। তারপর সে বলিল, “জঙ্গল! আমার বাচ্চা দুইটা অবুঝ। তুমি ওগো মাপ কইর।”

    ঐ কাজ সারিয়া কুঠার কান্ধে করিয়া আজাহের আবার বনের মধ্যে প্রবেশ করিল। ছেলে বছির সঙ্গে সঙ্গে চলিল। এক জায়গায় যাইয়া তাহারা দেখিল, গাছের তলায় কত টেকিশাক। ডগাগুলো লকলক করিতেছে। গ্রামের লোকেরা টেকিশাক বেশী পছন্দ করে না। কিন্তু শহরে এই শাক বেশী দামে বিক্রি হয়। বাবুরা কাড়াকাড়ি করিয়া এই শাক কিনিয়া লইয়া যায়। বাপ-বেটাতে মিলিয়া তাহারা অনেক ঢেকিশাক তুলিল। তারপর শাকগুলি গামছায় বাঁধিয়া আজাহের আরও গভীর জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হইল। এক জায়গায় যাইয়া দেখিল, একটি কড়াই গাছ। তাহার কয়খানা ডাল শুখাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছে। আজাহের সেই গাছে উঠিয়া ডালগুলি ভাঙ্গিয়া তলায় ফেলিতে লাগিল। কড়াই গাছ। হইতে নামিয়া আজাহের একটি জামগাছে উঠিয়া আরও কতকগুলি শুকনা ডাল ভাঙ্গিল। তারপর নামিয়া ডালগুলি একত্র করিয়া লতা দিয়া বোঝা বাধিয়া মাথায় লইল। চেঁকিশাকগুলি গামছায় বাঁধিয়া গাছতলায় রাখিয়া দিয়াছিল। সেগুলি উঠাইয়া বছিরের মাথায় দিল। বাপ-বেটাতে বাড়ি ফিরিল, তখন বেলা একপ্রহর হইয়াছে। কাঠের বোঝা নামাইয়া আজাহের ছেলে-মেয়ে লইয়া তাড়াতাড়ি খাইতে বসিল। ভাতের হাঁড়ির দিকে চাহিয়া আজাহের দেখিল যে সবগুলি পান্তা-ভাত বউ তাহাদের পাতে ঢালিয়া দিয়াছে। নিজের জন্য কিছুই রাখে নাই। বউ-এর সঙ্গে অনেক ধস্তাধস্তি করিয়া সে নিজের মাটির সানকি হইতে অর্ধেকটা পরিমাণ ভাত তুলিয়া হাঁড়িতে রাখিল। তারপর অবশিষ্ট ভাতগুলিতে সানকি পুরিয়া পানি লইয়া তাহাতে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ ও লবণ মাখাইয়া শব্দ করিয়া গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল। ভাতগুলি সে চিবাইয়া খাইল না। পাছে তাহারা পেটে যাইয়া অল্প সময়ে হজম হইয়া যায়। ভাত খাওয়া শেষ হইতে না হইতেই বউ তাহার হাতে হুঁকা আনিয়া দিল। দুই তিন টানে কার কলিকায় আগুন জ্বালিয়া নাকে মুখে ধুয়া ছাড়িয়া সমস্ত গৃহখানা অন্ধকার করিয়া দিল। লাকড়ির বোঝা মাথায় করিয়া আজাহের ফরিদপুরের বাজারে রওয়ানা হইল।

    এই ভাবে মাসখানেক লাকড়ি বিক্রি করিয়া কোন ক্রমে তাহাদের দিন যাইতে লাগিল।

    .

    ১৯.

    সেদিন আজাহের হাটে যাইবে, ছেলে বছির বায়না ধরিল, “বাজান, আমিও হাটে যাব!”

    –”তুই আটপার পারবি? কত দূরির পথ, আমার সুনা, আমার মানিক, তুমি বাড়ি থাহ।”

    কিন্তু ছেলে কথা শুনে না–”না বাজান, আমি আটপার পারব।”

    অগত্যা ছেলেকে সঙ্গে লইতে হইল। একটি ডালিতে দুই তিনখানা মৌমাছির চাক, সুপারী, কুমড়ার ফুল, কয়েকটা কলার মোচা সাজাইয়া আজাহের ছেলের মাথায় দিল। বাকের দুই ধারে আটকাইয়া সে কাঁধে করিয়া লইয়া চলিল কাঠের বোঝা।

    এত দূরের পথ। মাথার উপর দুপুরের রৌদ্র খা খা করিতেছে। ছোট ছেলে বছির, চলিতে চলিতে পিছনে পড়িয়া থাকে। বাপ পথের মধ্যে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করে। এমনি করিয়া তাহারা বদরপুরের পাকা ইঁদারার কাছে আসিয়া বোঝা নামাইল। কয়া হইতে পানি তুলিয়া আজাহের নিজের চোখে মুখে দিল। ছেলেকে পানি খাওয়াইল। তারপর কিছুক্ষণ ঝাউ গাছের ঠাণ্ডা হাওয়ায় জিড়াইয়া আবার পথ চলিতে আরম্ভ করিল।

    শহরের নিকটে আসিতেই ছোট ছেলে বছির শুনিতে পাইল, কোথায় যেন ঝড় বৃষ্টি হইয়া গর্জন করিতেছে। বছির বাপকে জিজ্ঞাসা করে, “বাজান, এই শব্দ কিসির?”

    বাপ বলে, “আমরা ফরাতপুরির আটের কাছে আইছি।”

    অজানা রহস্যের আবেশে বছিরের বুক দুরু দুরু করিতে থাকে। বছির আরও জোরে জোরে হাঁটে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহারা শহরে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোয়াল চামটের পুল পার হইয়া বামে ঘুরিয়া দুই পাশের মিষ্টির দোকানগুলি ছাড়াইয়া মেছো বাজারের দক্ষিণ দিকের রাস্তায় আজাহের কাঠের বাকটি নামাইল। বছিরের মাথা হইতেও বোঝাটি নামাইয়া দিল। বাপের কাছে কতবার বছির ফরিদপুরের হাটের গল্প শুনিয়াছে। আজ সেই হাটে সে নিজে আসিয়াছে। কত লোক এখানে জড় হইয়াছে। বছির এত লোক একস্থানে কোথাও দেখে নাই। তাহাদের তাম্বুলখানার হাট এতটুকু, এক দৌড়ে ঘুরিয়া আসা যায়। কিন্তু ফরিদপুরের হাটে কত লোক! বছির যে দিকে চাহে শুধু লোক আর লোক। তাহাদের গ্রামের জঙ্গলের মত এও যেন মানুষের জঙ্গল। ইহার যেন কোথাও শেষ নাই।

    সাদা ধবধবে জামা কাপড় পরিয়া ভদ্রলোকেরা আসিয়া আজাহেরের কাঠের দাম জিজ্ঞাসা করে, “কিরে, তোর এই কাঠের দাম কত নিবি?”

    আজাহের বলে, “আজ্ঞা, পাঁচ সিহা।”

    কাঠের বোঝা হইতে কাঠগুলি নাড়িয়া চাড়িয়া বলে, “এযে ভিজে লাকড়ীরে। আখায় দিলে জ্বলবেও না। এর দাম চাস পাঁচ সিকে? পাঁচ আনা পাবি।”

    আজাহের বলে, “এমুন শুকনা খড়ি, আপনি ভিজা দেখলেন? পাঁচ আনায় দিব না কর্তা।”

    “আচ্ছা তবে ছ’আনা নে। চল আমার বাড়িতে দিয়ে আসবি।”

    আজাহের বলে, “আপনারা ঐলেন বড় লোক। আতখান ঝাড়া দিলি আমরা গরীবরা বাঁচতি পারি। হেই তাম্বুলখানা ঐতে আনছি এই খড়ি। কন ত কর্তা, আপনাগো চাকরেও যদি এই খড়ি বিনা পয়সায় আনত তার মায়না কত দিতেন?”

    “তুই ত কথা জানসরে। আচ্ছা তবে সাত আনা নে।”

    কর্তা আপনারা কি আমাগো না খায়া মরবার কন নাকি? আইজকা আধাদিন বইরা খড়ি কুড়াইছি। আধাদিন গ্যাল খড়ি আনতি। তাতে যদি সাত আনা দাম কন, আমরা গরীবরা বাঁচপ কেমন কইরা?”

    আচ্ছা, যা। আট আনা দিব। নিয়ে চল খড়ি।”

    আজাহের হাল ছাড়ে না।”আইচ্ছা বাবু আর একটু দাম বাড়ান।”

    “আর এক পয়সাও দিব না।”

    “তয় পারলাম না কর্তা,” আজাহের বিনীত ভাবে বলে। লোকটি চলিয়া গেল। বছির ভাবে, এমন ধোপদোরস্ত কাপড়-পরা–এরাই ভদ্রলোক। এমন সুন্দর এদের মুখের কথা কিন্তু তার বাবাকে ইনি তুই বলিয়া সম্বোধন করিলেন কেন? তাদের তাম্বুলখানা গ্রামে । সবাই তাহার বাবাকে তুমি বলে। তাহার বাবাও তাহাদের তুমি বলিয়া সম্বোধন করে। কিন্তু এই লেখাপড়া জানা ধোপদোরস্ত কাপড় পরা ভদ্রলোক তার বাবাকে তুই বলিয়া সম্বোধন করিল! সে যদি ভদ্রলোক হইত–সে যদি এমনি বোপদোরস্ত কাপড় পরিয়া তারই মত বই-এর মত করিয়া কথা বলিতে পারিত? কিন্তু সে ভদ্রলোক হইলে তার বাপের বয়সী লোকদের এমনি তুচ্ছ করিয়া তুই বলিয়া সে সম্বোধন করিত না।

    কতক্ষণ পরে আর একজন লাকড়ী কিনিতে আসিল। তাহার সঙ্গে দরাদরি করিতে বাপের উপস্থিত কথাবার্তায় প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পাইয়া মনে মনে বছির বড়ই গৌরব অনুভব করিতে লাগিল।

    “আরে কর্তা! আমার শুকনা খড়ি কিন্যা নিয়া যান। বাড়িতি গেলি মা ঠাকুরনরা তারিফ করব্যানে। আর ওই দোকান ঐতে যদি বিজা খড়ি কিন্যা নেন, ঠাকুরনরা ওই খড়ি চুলায় দিয়া কানতি বসপি।”

    শুনিয়া ভদ্রলোক খুশী হইয়া লাকড়ীর দাম বারো আনা বলিল। আজাহের বলে, “আপনারা বড়লোক মানুষ, আপনাগো কাছে খড়ির দাম কি চাব? মা ঠাকুরনরা খুশী হয়া যা দ্যান তাই নিবানি।”

    “আচ্ছা চল তবে।” আজাহের বছিরকে বসাইয়া রাখিয়া লাকড়ী লইয়া ভদ্রলোকের সঙ্গে চলিল।

    “বছির তুই বয়। আমি এহুনি আসপানি। ডেহিশাগ চাইর আঁটি কইরা পয়সায়। আর এই মধুর চাক সগল যদি কেউ নিবার চায় দ্যাড় টাহা চাবি। এক টাহা কইলি দিয়া দিস।”

    যাইবার সময় আজাহের পাঁচ ছয় আঁটি চেঁকিশাক লইয়া গেল। এই বিরাট হাটের মধ্যে বসিয়া বছিরের যেন কেমন ভয় ভয় করিতে লাগিল। একজন আসিয়া শাকের দাম জিজ্ঞাসা করিল।

    “কিরে ছোকরা! কয় আঁটি করে চেঁকিশাক?”

    প্রায় কাঁদ কাঁদ হইয়া যাত্রাদলের নতুন অভিনেতার মত সে বলিল, “আমার শাকের দাম পয়সায় চাইর আঁটি।”

    “বলিস কি, চার আঁটি পয়সায়? আট আঁটি করে দিবি নাকি?”

    বছির বাপের মত করিয়া বলিতে চেষ্টা করিল, “না কর্তা! আট আঁটি কইরা দিব না।” কিন্তু কথার সুর বাপের মতন মুলাম হইল না।

    লোকটি বলিল, “আচ্ছা, তবে ছয় আঁটি দে এক পয়সায়।” এ কথার জবাবে বছির কি বলিবে তাহা ভাবিয়া পায় না। এমন সময় তাহার বাপ আসিয়া উপস্থিত হইল।

    “আসেন বাবু। এমন চেঁকিশাক বাজারে পাবেন না। দ্যাহেন না, পোলাপানের মতন ল্যাক ল্যাক করত্যাছে ইয়ার ডগাগুলান। পয়সায় চাইর আঁটির বেশী দিব না।”

    লোকটি তখন আঁটিগুলি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিয়া সবগুলি শাক কিনিয়া লইল। লোকটি চলিয়া গেলে আজাহের ছেলেকে বলিল, “খড়ির সঙ্গে পাঁচ আঁটি চেঁকিশাক দিয়া আইলাম মা ঠারহ্যানরে। খুশী অয়া মা ঠারহ্যান আমারে আরো চাইর আনা বকশিস দিছে।”

    বাপের এই সাফল্য দেখিয়া বছির মনে মনে গৌরব বোধ করিল। সুপারি আর কলার মোচা বেচিয়া আজাহের ছেলেকে লইয়া বেনে দোকানে যায়। বেনেরা মৌমাছির চাক কিনিয়া কলিকাতায় চালান দেয়। তাহারা বড়ই চতুর। অনেক ঠকিয়া আজাহের এখন কিছুটা তাহাদের চালাকি ধরিতে পারে। একই ব্যক্তি বিভিন্ন লোক দিয়া পাশাপাশি দুইটি দোকান দিয়া বসে। এক দোকান মৌচাকের দাম যাহা দিতে চাহে, পার্শ্ববর্তী অপর দোকানে গেলে তাহার চাইতে কম দাম বলে। আজাহের তাহা জানে। সেইজন্য সে দূরের দুরের দুই তিন দোকান যাচাই করিয়া তাহার মৌচাক বিক্রি করিল। কিন্তু দোকানদার মৌচাক মাপিতে হাত সাফাই করিয়া বেশী লইতে চাহে। আজাহের বলে, “সা’জী মশায়! রাইতরে দিন করবেন না। আমার চাক আমি মাইপ্যা আনছি।”

    দোকানী বলে, “গো-মাংস খাই, যদি বেশী লয়া থাকি। তোমার ওজনে ভুল ঐছে।”

    আজাহের বড়ই শক্ত ব্যক্তি, “আমি ওজন কইরা আনছি দুই স্যার! যদি তাই স্বীকার কইরা লন তয় নিবার পারেন, তা না ঐলে দেন আমার মধুর চাক। আর এক দোকানে যাই।”

    দোকানী তবু হাল ছাড়ে না, “আরে মিঞা! ওজন ত ঠিক কইরা দিবা। আমার ওজনে ঐল পৌনে দুই স্যার। আচ্ছা ওসব রাইখ্যা দাও। তোমার মৌচাকের দাম চৌদ্দ আনা ন্যাও।”

    “তা অবি না কর্তা।” বলিয়া আজাহের মৌচাকের উপর হাত বাড়ায়।

    “আরে মিঞা! রিয়াইত-মুরিতও তো করতি অয়; আচ্ছা পোনর আনা দাম।” বলিয়া দোকানী আজাহেরের হাতখানা ধরে।

    এ যেন কত কালের ভিখারী!

    চাইরটা পয়সা কম নাও বাই। দোকানী আজাহেরের হাতে একটা বিড়ি খুসিয়া দিল। “আরে বাই, অত নিষ্ঠুর ঐলা ক্যান? তামুক খাও।”

    আজাহেরকে চারটি পয়সা ছাড়িয়া দিতে হয়। বছির ভাবে এরা কত বড় লোক। চারটি পয়সার জন্য এদের কি কাঙালী-পনা! অথচ এই চারটি পয়সা যদি তার বাবা পাইত, তাহা দিয়া মাছ কিনিয়া লইয়া যাইয়া তাহারা কত আনন্দ করিয়া খাইত। তার বাবাকে। মিঠা কথায় ভুলাইয়া এই চারটি পয়সা রিয়াইত লইয়া ইহাদের কি এমন লাভ হইবে? বেনের দোকান হইতে পয়সা গণিতে গণিতে আজাহের একটি অচল সিকি পাইল। তাহা ফিরাইয়া দিতে দোকানী বলিল, “আরে মিঞা! এডা বাল সিকি। যদি কেওই না লয়, ফিরায়া দিয়া যাইও।”

    আজাহের বলিল, “সা’জী মশায়! হেবার একটা অচল টাহা দিছিলেন ফিরায়া নিলেন । আইজ আবার আর একটা নিয়া কি করব? জানেন ত আমরা দিন আনি দিন খাই। এহনি পয়সা দিয়া ত্যাল, নুন কিনতি অবি। আমারে সিহিডা বদলাইয়া দেন।”

    কোনদিক হইতেই আজাহেরকে না ঠকাইতে পারিয়া দোকানী বড়ই নিরাশ হইয়া তাহাকে সিকিটি ফিরাইয়া দিল।

    রাস্তার দুইধারে নুনের দোকানদারেরা ছালার উপর নুন লইয়া বসিয়া আছে; আজাহের জানে একসের নুনে ইহারা পোনর ছটাক মাপিবেই। সেই কমটুকু সে ফাও চাহিয়া পূরণ করিবে। আজাহের নুন লইয়া দোকানীকে বলে, “একটু ফাউ দাও মিঞা বাই!” দোকানী তোলাখানেক নুন ফাউ দেয়।

    আজাহের আবার বলে, “মিঞা বাই! আরও একটু দাও।” বিরক্ত হইয়া দোকানী আরও এক তোলা নুন তাকে দেয়।

    ওধারে গুড়ের হাট। মৌমাছি গুনগুন করিতেছে! গুড়ের বেপারীরা খড়ের বুন্দা জ্বালাইয়া ধূয়া করিয়া মৌমাছিদের তাড়াইতেছে। গুড়ের বাজার বড়ই চড়া। সের প্রতি দুই আনার কমে কেহই গুড় দিতে চাহে না। গুড়ের টিন হইতে কানি আঙ্গুলে গুড় লাগাইয়া আজাহের ছেলের মুখে ধরে, “খায়া দেখ ত গুড় খাটা ঐছে কিনা।”

    ছেলে গুড় মুখে দিয়া বলে, “না বাজান, খাটা না।”

    “তুই কি বোঝোস? আমি একটু মুহি দিয়া দেহি।” বলিয়া আজাহের আঙুলে আর একটু গুড় লইয়া চাখিয়া দেখে। দরে দোকানীর সঙ্গে আজাহেরের বনে না। দোকানী চায় দুই আনা। আজাহের বলে ছয় পয়সা সের। এইরূপে তিন চার দোকানের গুড় পরীক্ষা করে সে। আহা বেচারী ছেলেটা মিষ্টির মুখ দেখে না। চাখিয়া চাখিয়া খাক যতটা খাইতে পারে। এক দোকানী ধমকাইয়া বলে, “আরে মিঞা! গুড় ত নিবা এক সের। বাপ বেটায় চাখিয়াই ত এক তোলা খায়া ফ্যালো।” শুনিয়া বছিরের বড় অপমান বোধ হয়, কিন্তু বাপের মুখের দিকে চাহিয়া দেখে সেখানে কোনই রূপান্তর ঘটে নাই। এইরূপ অনেক যাচাই করিয়া আজাহের এক দোকানের গুড় ছয় পয়সা সের দরে ঠিক করে। এই গুড় সাধারণতঃ লোকে তামাক মাখাইবার জন্য কিনিয়া লয়। বছির চাখিয়া দেখিল, গুড়টি টকটক কিন্তু তার বাপ আঙুলে একটু গুড় মুখে দিয়া বলিল, “নারে বছির! বেশ মিঠা। তাছাড়া দামেও দুই পয়সা কম।” বাড়ি হইতে আজাহের গুড় কিনিবার জন্য খুটি লইয়া আসিয়াছিল। খুব ঠিক মত গুড়ের ওজন করাইয়া আরও কিছু ফাও লইয়া আজাহের কাপড়ের হাটে আসিল। কত রঙ-বেরঙের গামছা, শাড়ি লইয়া তাতিরা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া খদ্দেরদের ডাকিতেছে। অনেক খুঁজিয়া পাতিয়া আজাহের আসিয়া দাঁড়াইল রহিমদ্দী কারিকরের পাশে। “কেমুন আছ আজাহের?” রহিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে।

    “তুমরা যেমুন দোয়া করছ চাচা।”

    “এ কিডা? আমার মিঞা বাই নাহি? আরে আমার মিঞা বাই দেহি ডাঙর ঐছে? এবার তোমার সঙ্গে লড়ন লাগবি? দেখপ কার কত জোর।” বলিয়া দুই হাতের কাপড় এক হাতে লইয়া রহিমদ্দী বছিরের গায়ে মুখে হাত বুলায়।

    “একদিন যাইও চাচা আমাগো তাম্বুলখানার আটে।”

    “কয়াক মাস পরেই যাব।”

    “মাতবর ক্যামুন আছে? ক্যাদাইরার মারে কইও আমাগো কতা।”

    কাপড় দর করিতে খরিদ্দার আসে। রহিমদ্দী বলে, “আরেক আটে আইস আজাহের। অনেক কতা আছে!” বলিয়া রহিমদ্দী খরিদ্দারের সঙ্গে কথাবার্তায় মনোযোগ দেয়।

    আজাহের ছেলেকে লইয়া মেছো হাটে আসে। ইলিশ মাছের দোকানের চারধারে বেশী ভীড়। তাম্বুলখানা যাইয়া অবধি আজাহের ইলিশ মাছ খায় নাই। আলীপুর থাকিতে মাঝে। মাঝে পদ্মা নদীতে যাইয়া সে ইলিশ মাছ মারিয়া আনিত। লোকের ভীড় ঠেলিয়া আজাহের ইলিশ মাছের ডালির কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। বছির তাহার পিছনে। নাড়িয়া চাড়িয়া বড়টা ছোটটা ইলিশ মাছ ধরিয়া দেখিতে আজাহেরের আরাম লাগে। পয়সা দিয়া ত সে কিনিতে পারিবে না।

    “বলি, এই মাছটার দাম কত অলদার মশায়?” যাহারা বাজারে মাছের ব্যবসা করে তাহাদিগকে হাওলাদার বা কৈবর্ত বলে। আজাহেরের হাত হইতে মাছটি লইয়া পরীক্ষা করিয়া কৈবর্ত বলে, “দাম পাঁচ সিহা।”

    আজাহের জানে মাছের বেপারীরা খরিদ্দারের কাছে মাছের ডবল দামের মতন প্রথমে চাহে। অর্ধেক দামের উপরে দুই একআনা বেশী বলিলেই সে মাছটি তাহাকে দিবে। আজাহের বলে, “আট আনা নেন অলদার মশায়।”

    “আরে মিঞা! যে আতে মাছ দরছাও হেই আতখান বাড়ি যায়া ধূইয়া তাই রাইন্দা খাও গিয়া। আট আনায় ইলশা মাছ খাইছ কুনুদিন?”

    আজাহেরের গায়ের শত ছিন্ন মলিন কাপড় দেখিয়া দোকানী তাহাকে গরীব বলিয়া চিনিতে পারিয়াছে।

    “আইচ্ছা নয় আনা লেন।” মাছের বেপারী অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলে। আজাহেরের কথার উত্তর দেয় না। বাপের অপমানে বছিরের কাদিতে ইচ্ছা করে। সে ভীড়ের ভিতর হইতে বাপকে টানিয়া লইয়া আসে। “কাম নাই বাজান, আমাগো ইলিশ মাছ কিনুনের।” আজাহের ওধারের পুঁটি মাছের ডালির কাছে যাইয়া মাছ দর করে। ডালির ঢাকনির উপরে ভাগে ভাগে পুঁটি মাছ সাজানো।

    “কত কইরা বাগ দিছ অলদার মশায়?”

    “চাইর পয়সা কইরা ভাগ।” মাছের উপর পানির ছিটা দিতে দিতে বেপারী বলে।

    “আরে বাই! এক পয়সা বাগ ন্যাও।”

    “তা অবিন্যা মিঞা বাই!”

    পুঁটি মাছের বেপারীর কথায় তেমন ঝাঁজ নাই। বরঞ্চ একটু দরদ মিশানো।

    দুই পক্ষে অনেক কাকুতি-মিনতি কথা বিনিময়ের পরে দুই পয়সা করিয়া পুঁটি মাছের ভাগ ঠিক হয়। ধামার মধ্যে মাছ উঠাইতে উঠাইতে আজাহের অনুনয়-বিনয় করিয়া আরও কয়েকটি মাছ চাহিয়া লয়।

    এইভাবে হাট করা শেষ হইলে আজাহের বাড়ি রওয়ানা হয়। মেছো বাজার পার হইলেই রাস্তার দুই ধারে মেঠায়ের দোকান। বছির বলে, “বাজান! পানি খাব।” ছেলের মুখ শুকনা। সেই সকালে খাইয়া আসিয়াছে। আহা কত যেন ক্ষুধা লাগিয়াছে! পয়সা থাকিলে পেট ভরিয়া সে ছেলেকে মিষ্টি খাওয়াইত। তবু খাক, পানির সঙ্গে কিছু সে খাক। মিষ্টির দোকানে সব চাইতে সস্তা দামে বিক্রি হয় জিলিপি। অনেক দরদস্তুরের পর দোকানী এক পয়সায় দুইখানা জিলিপি বেঁচিতে স্বীকৃত হইল। পাতায় করিয়া দুইখানা জিলিপি শূন্য হইতে দোকানী বছিরের হাতে ঘুড়িয়া দিল। পাছে মুসলমানের ছোঁয়া লাগিয়া। তাহার দোকানের সমস্ত মিষ্টি নষ্ট হইয়া যায়। বছির দুই হাত পাতিয়া সেই মিষ্টি গ্রহণ করিল। দোকানের বাহিরে টুল পাতা। তাহার আশেপাশে গা-ভরা ঘা-ওয়ালা কুকুরগুলি শুইয়া আছে। সেই টুলের উপর বসিয়া মুসলমান খরিদ্দারেরা মিষ্টি খাইয়া থাকে। হিন্দু খরিদ্দারেরা দোকানের মধ্যে যাইয়া চেয়ারে বসিয়া খাবার খায়। সেই কুকুরগুলিরই পাশে পিতলের দুই তিনটি নোংরা গ্রাস মাটিতে গড়াগড়ি যাইতেছে। তাহারই একটিকে বাম পায়ে খাড়া করিয়া দোকানী শূন্য হইতে ঘটিভরা পানি ঢালিয়া দিল। আস্তে আস্তে সেই দুইখানা জিলাপী বছির বহুক্ষণ ধরিয়া খাইল। তারপর সেই গেলাসের পানিটুকু ঢক ঢক করিয়া খাইয়া দোকানীর কাছে আরও পানি চাহিল। দোকানী তাহার গ্লাসে পূর্ববৎ শূন্য হইতে ঘটিভরা জল ঢালিয়া দিল। যতক্ষণ ছেলে খাইতেছিল ততক্ষণ আজাহের মিষ্টির দোকানের কঁচের আবরণীতে রক্ষিত সন্দেশ, রসগোল্লা, পানতোয়া প্রভৃতি স্তরে স্তরে সাজানো নানারকমের মিষ্টিগুলির উপর চোখ বুলাইয়া লইতেছিল। ইহাতে তাহার অন্তরের অন্তঃস্থলে কি যেন আরাম বোধ হইতেছিল।

    তাহাদেরই মত বহুলোক হাট হইতে বদরপুরের রাস্তা বাহিয়া নানা গাল-গল্প করিয়া । বাড়ি ফিরিয়া যাইতেছিল। কে আগে-হাটে দুধ বেচিয়া দুই পয়সা জিতিয়া আসিয়াছে; কে কোন বড়লোক মাড়োয়ারীকে তোষামোদ করিয়া কাপড়ের দাম কম করিয়া লইয়াছে, এই সব গৌরবজনক কথায় সকলেই মশগুল। আজাহেরও সুযোগ বুঝিয়া কি করিয়া পাঁচ আঁটি চেঁকি শাক দিয়া এক ভদ্রলোকের বউ এর কাছ হইতে চার আনা বকশিস্ লইয়া আসিয়াছে। সেই গল্পটি বলিয়া ফেলিল। পার্শ্ববর্তী শ্রোতা শুনিয়া অবাক হইয়া বলিল, “কওকি মিঞা! চাইর আনা বকশিস পাইলা?”

    আজাহের খুশী হইয়া তার হাতে একটা বিড়ি আগাইয়া দেয়। “খাও মিঞা, তামুক খাও।”

    অপর পাশের লোকটি আজাহেরের এই গৌরবের কাহিনী শুনিয়া হিংসায় জ্বলিয়া যাইতেছিল। সে আরও জোরের সঙ্গে বলিতে লাগিল, “এড়া আর কি তাজ্জবের ব্যাপার? হোন মিঞা! আমার একটা গল্প হোন আগে।”

    “আচ্ছা কন বাই কন।” সকলে তাহার কথায় মনোযোগী হইল। লোকটি একটু কাশিয়া আরম্ভ করিল,–

    “আইজকা আটে গেলাম তরমুজ লয়া। এক বাবু আইসা কয়, তরমুজের দাম কত নিবি? আমি জানি তরমুজির দাম চাইর আনায়ও কেও নিবিন্যা, কিন্তু আল্লার নাম কইরা দশ আনা চায়া বসলাম। বাবু কয়, অত দাম কেনরে? আট আনা নে? আমি বাবি আরও একটু বাড়ায় নি। আমি কইলাম, বাবু! এত বড় তরমুজডা দশ আনার কম দিব না। বাবু তহন নয় আনা কইল। আমি অমনি দিয়া ফেলাইলাম। হেই বাবুরে চিনছ তোমরা? গোল তালাপের পূর্ব কোণায় বাড়ি।”

    একজন বলিয়া উঠিল, “চিনব না ক্যান? করিম খার ছাওয়াল। ওর বাবা সুদীর টাহা জমায়া গ্যাছে। কত লোকের বিট্যা-বাড়ি বেইচা খাইছে।”

    আর একজন বলিল, “ওসব তলের কতা দিয়া কি অবি। আরে মিঞা খুব বাল জিতন জিতছাও। বিড়ি দেও দেহি?”

    তলের খবর ইহারা কেহই জানিতে চাহে না। সহজ সরল এই গ্রাম্য লোকগুলি। কত শত শত শতাব্দী ভরিয়াই ইহারা ধনিকদের হাতে বঞ্চিত হইয়া আসিতেছে। কতই অল্পে ইহারা তুষ্ট–কতই সামান্য ইহাদের আকাভক্ষা। শহরের আরাম-মঞ্জিলে বসিয়া যাহারা দিনের পর দিন ইহাদের যথা-ধ্বস্ব লুটিয়া লইতেছে, দিনের পর দিন যাহারা ইহাদিগকে অর্ধাহার অনাহারের পথে ঠেলিয়া দিতেছে তাহাদের প্রতি ইহাদের কোনই অভিযোগ নাই।

    লোকটি গামছার খোঁট হইতে বিড়ি বাহির করিয়া আশেপাশের সকলকেই একটা একটা করিয়া দিল।

    বাড়ি ফিরিতে আজাহেরের প্রায় সন্ধ্যা হইল। সারাদিনের পথ চলায় এবং ক্ষুধায় ছেলেটি বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সামান্য কিছু খায়াই সে ঘুমাইয়া পড়িল। ছোট বোন বড়ু আসিয়া কত ডাকাডাকি করিল। সারাদিনে এ-বনে ও-বনে ঘুরিয়া কত আশ্চর্য জিনিস সে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল। সেগুলি মিয়াবাইকে না দেখাইলে কিছুতেই সে তৃপ্ত হইতে পারিতেছিল না। কিন্তু গভীর ঘুমে বছির অচেতন হইয়া পড়িল। ছোট বোন বড় মুখ ফুলাইয়া অভিমান করিয়া খানিক কাদিল। তারপর বাপকে ডাকিয়া তাহার আশ্চর্য জিনিসগুলি দেখাইতে লাগিল। বয়স্ক পিতা সেগুলি দেখিয়া অভিনয় করিয়া যতই আশ্চর্য হউক তার মিয়া ভাই-এর মত আনন্দে ডগমগ হইতে পারিল না। বারবার অন্যমনস্ক হইয়া পড়িতে লাগিল। ছোট্ট বক্তার কাছে ইহা ধরা পড়িতে বেশী সময় লাগিল না। তখন সে হাল ছাড়িয়া দিয়া নিজের জিনিসগুলি গুছাইয়া রাখিতে প্রবৃত্ত হইল।

    প্রভাত না হইতেই আজ বড়ু আগে উঠিল, “ও মিয়া বাই! শিগগীর উঠ। দেহ আমি জঙ্গলের মদ্দি কি হগল কুড়ায়া পাইছি!”

    চোখ ডলিতে ডলিতে বছির ঘুম হইতে উঠিয়া ছোট বোনের সংগৃহীত জিনিসগুলি দেখিতে লাগিল। লাল টুকটুক করে এত বড় একটা মাকাল ফল। রাশি রাশি লাল কুঁচ, এক বোঝা কানাই লাঠি আরও কত কি।

    “এ হগল কনহানে পাইলিরে?” বড় ভাই বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল। ঘাড় দোলাইয়া দোলাইয়া সুন্দর মুখোনি বাকাইয়া, ঘুরাইয়া ছোট বোন তাহার বিশদ বর্ণনা দিতে লাগিল।

    “ওই জঙ্গলডার মদ্দি আমগাছের উপর বায়া গ্যাছে মাকাল ফলের লতা। কত ফল ঝুলত্যাছে গাছে। এহেবারে হিন্দুরের মত লাল টুকটুক করতাছে। তুমি চল মিয়া বাই, আমারে পাইড়্যা দিব্যানে।”

    “চল,” বলিয়া বছির ছোট বোনটিকে সঙ্গে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল।

    যে আমগাছটিতে মাকাল ফল ঝুলিতেছিল সেই গাছের তলায় আসিয়া তাহারা দেখিল, ফুলু তার বড় বাই নেহাজদ্দী ও গেদাকে সঙ্গে লইয়া পূর্বেই সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এক লাফে বছির গাছে উঠিয়া মাকাল ফল ছিঁড়িয়া তলায় ফেলিতে লাগিল। নেহাজদ্দী ও গেদার কাছে এ কার্যে কোনই উৎসাহ জাগিতেছিল না। নেহাজদ্দী বনের মধ্য হইতে একটা গুইসাপ ধরিয়া লতা দিয়া বাধিয়া সেই গাছের তলায় টানিয়া আনিল। তাহা দেখিয়া বড় চিৎকার করিয়া উঠিল। ফুলু খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। এই সব জন্তু তাহাদের নিত্য খেলার সাথী। তাহাদিগকে দেখিয়া ভয় পাইতে সে কাহাকেও দেখে নাই। গুইসাপ দেখিয়া বছিরও গাছ হইতে নামিয়া আসিল। তখন সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিল–গুইসাপের একটা বিবাহ নিশ্চয় দিতে হইবে। কিন্তু কাহার সঙ্গে ইহার বিবাহ দেওয়া যায়। প্রথমেই নেহাজীর বাড়ির কুকুরটির কথা মনে হইল। কিন্তু এমনতর রাগী বরের সঙ্গে উহার বিবাহ হইলে কনে কিছুতেই সুখী হইতে পারিবে না। দিনরাত বরের। মুখের ঘেউ ঘেউ দাঁত খিচুনী আর কামড় খাইতে হইবে। তখন অনেক যুক্তি করিয়া স্থির। হইল, ফুলুর আদরের বিড়ালটির সঙ্গে ইহার বিবাহ হইবে। দৌড়াইয়া যাইয়া ফুলু বাড়ি হইতে বিড়ালটিকে লইয়া আসিল। বরের মা কিছুতেই ভয়ে মেয়ের কাছে যাইতে পারে না। সে গুই-সাপের দড়িটি ধরিয়া দূরে দাঁড়াইয়া রহিল। অনেক টানাটানিতে গুইসাপটি হয়রান হইয়া স্থির হইয়া পড়িয়াছিল। পূর্ব হইতেই ঠিক হইয়াছিল বছির মোল্লা হইয়া বিবাহ পড়াইবে। বিড়াল ম্যাও ম্যাও করিয়া বিবাহের কলমা পড়িল। কিন্তু গুইসাপটিকে লইয়া বড়ই মুস্কিলে পড়িতে হইল। তাহারা কাঠি লইয়া এত তাহাকে খোঁচাইল-হাতে থাপড় দিয়া শব্দ করিল, কিছুতেই সে কলমা পড়িবে না। তখন বড় যেই হাতের লতাটায় একটু ঢিল দিয়াছে অমনি গুইসাপ দৌড়। তাহারাও কলরব করিয়া তাহার পিছে পিছে চলিল।

    ইতিমধ্যে আজাহের কাঠ কুড়াইতে জঙ্গলে আসিয়াছিল। ছেলেদের কলরব শুনিয়া সে নিকটে আসিয়া সমস্ত ব্যাপার দেখিল। গুইসাপটির মাথায় লতা বাধা ছিল বলিয়া সে বেশী দূর দৌড়াইয়া যাইতে পারে নাই। কাটা গাছের সঙ্গে লতা জড়াইয়া আটকা পড়িয়াছে। সে গুইসাপটি ধরিয়া তাহার মাথা হইতে লতার বাঁধন খুলিয়া দিল। সাপটি দৌড়াইয়া গভীর কাটা বনে প্রবেশ করিল।

    এইবার আজাহের সব ছেলে-মেয়েদের ডাকিয়া বুঝাইয়া বলিল, “গুইসাপ মারিতে নাই। মারিলে জঙ্গলে এত সাপ হইবে যে তাহার ভয়ে কেহই বনে আসিতে পারিবে না।”

    বছির জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বাজান?”

    আজাহের বলিল, “গুইসাপ হগল সাপ ধইরা খায়। যেহানে গুইসাপ আছে আর হগল সাপ সেহান ত্যা পলায়া যায়।”

    তারপর সে সকলকে সঙ্গে লইয়া জঙ্গলে খড়ি টুকাইতে লাগিল।

    আজ আর টেকিশাক পাওয়া গেল না। আজাহের অনেকগুলি বেতের আগা কাটিয়া লইল। শহরের লোকেরা বেতের আগা খাইতে খুব পছন্দ করে। কালকের পরিশ্রমে আজ আর বছির বাপের সঙ্গে শহরে যাইতে চাহিল না। আজাহের একাই লাকড়ীর বোঝার উপর কতকগুলি বেতের আগা লইয়া বাজারে চলিল।

    এইভাবে এক একদিন আজাহের বন হইতে এক একটা জিনিস শহরে লইয়া যায়। বিক্রি করিয়া যাহা পায় তাহাতে তাহার ক্ষুদ্র পরিবারের অন্নসংস্থান হইয়া সামান্য কিছু উদবৃত্ত থাকে। বউও সারাদিন বসিয়া থাকে না। সেই যে বিদায়ের দিন মিনাজদী মাতবরের স্ত্রী তাহাকে ঢাকাই-সীমের বীজ দিয়াছিল, শ্রীচন্দনের বীজ দিয়াছিল তাহা সে ভালমত করিয়া উঠানের এ-পাশে ও-পাশে রোপিয়া দিয়াছে। দীনু মাতবরের বাড়ি হইতে বেগুনের চারা আনিয়া বাড়ির পালানে পুঁতিয়াছে। উঠানের অর্ধেকখানি ভরিয়া লাল নটে। শাকের ক্ষেত আরো রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। লাল টুকটুকে হইয়া ছোট ছোট নটে চারাগুলি উঠান ভরিয়া হাসি ছড়াইতেছে।

    রাতের বেলা ছেলে-মেয়েদের পাশে লইয়া বউ ঘুমাইয়া পড়ে। চারিদিকে নিশুতি স্তব্ধ রাত্রি। আজাহেরের চোখে ঘুম আসে না। তাহার জীবনের ফেলে-আসা অতীত দিনগুলি সাপের মত তাহাকে যেন কামড়াইয়া মোচড়াইয়া দংশন করিতে থাকে। দিনের বেলা নানা। কাজের চাপে সে মনকে শক্ত করিয়া রাখে। কিন্তু রাতের বেলা যখন সকলেরই চোখে ঘুম, চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ, তখন সেই অতীত দিনগুলি একে একে জীবন্ত হইয়া তাহাকে বেষ্টন করিতে থাকে। আজাহের ভুলিয়া যাইতে চায়। আবার নতুন করিয়া ঘর-বাড়ি গড়িবে, নতুন করিয়া সংসার পাতিবে, নতুন দিনের সুখ দিয়া অতীতকে ঢাকিয়া রাখিবে। কিন্তু বালুর উপরে আঁক কাটিলে যেমন ঢেউ আসিয়া তাহা নিমিষে মুছিয়া ফেলে তেমনি তাহার ভবিষ্যতের সকল চিন্তা মুছিয়া ফেলিয়া অতীত আসিয়া সুস্পষ্ট হইয়া কথা কয়। সারাটি জীবন ভরিয়া লোকের কাছে সে শুধু অবিচারই পাইয়াছে। জীবনের সেই। প্রথম-বেলায় কতজন কত আশা দিয়া তাহাকে খাটাইয়া লইয়াছে, তারপর বেতন চাহিলে তাহাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে। সেই শঠ পাটের বেপারী মিষ্টি কথা বলিয়া নানা গাল-গল্প করিয়া তাহাকে কেমন করিয়া ঠকাইয়াছে, সেই ভণ্ড-মওলানা সাহেব তাহার শিষ্য-উপশিষ্য লইয়া কত কৌশল-জাল বিস্তার করিয়া তাহাকে লুটিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই প্রবঞ্চক মহাজন,–তাহার কথা ভাবিতেও গা শিহরিয়া উঠে, কেন–কেন ইহারা এমন করে! আর কেন–কেন এতদিন সে নীরবে ইহাদের অত্যাচার সহ্য করিয়া আসিল? কেন–কেন সে সাপের মতন ইহাদের ঘাড়ে ঝাপাইয়া পড়িল না? সে যে সব কিছু এতদিন নীরবে সহ্য করিয়া আসিয়াছে সে জন্য আজ সে নিজেকেই ক্ষমা করিতে পারিতেছে না। অপমানে ধিককারে আজ তার নিজের দেহের মাংস টানিয়া ছিঁড়িয়া চিবাইয়া খাইতে ইচ্ছা করিতেছে। কোন আদিম কালের হিংস্র রক্ত-ধারা যেন তাহার সকল অঙ্গে নাচিয়া উদ্দাম হইয়া উঠে। তারই সঙ্গে সঙ্গে তার মনের গহন অন্ধকারে অভিনব হিংস্র বৃত্তিগুলির জন্ম হইতে থাকে। আজাহের কিছুতেই স্থির হইয়া থাকিতে পারে না। রাতের অন্ধকারের ফলকে ছবির পর ছবি ফুটিয়া উঠে–এত স্পষ্ট–এত জীবন্ত–এত হিংস্র–এত বিষাক্ত। দেশে দেশে যুগে যুগে এরাই মানুষকে পথে চলিতে দেয় না। মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া যায়–মুখের হাসি-দীপ এক থাপড়ে নিবাইয়া দিয়া যায়–কোলের শিশু-কুসুম ঝরিয়া পড়ে, মায়ের বুক-ফাটা আর্তনাদে খোদার আসমান ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহে, কিন্তু ইহারা তাহাতে ভ্রূক্ষেপও করে না। কেন–কেন এমন হইবে? এমন কি কেহ কোথাও নাই যে ইহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারে? যাহার হুংকারে মুহূর্তে ইহাদের সকল অত্যাচার থামিয়া যায়?

    আজাহের গৃহের মধ্যে চাহিয়া দেখে তাহার ছেলে বছির মায়ের গলা ধরিয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। এই ছেলেকে সে লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষ করিয়া তুলিবে। তিলেতিলে তাহার অন্তর সে এই সব অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে বিষাইয়া তুলিবে। আজাহের বাঁচিয়া থাকিবে। শুধু এই একটি মাত্র আশা বুকে লইয়া সে আবার নূতন করিয়া ঘর গড়িবে। দরকার হইলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করিবে, একবেলা খাইবে–আধ পেটা খাইবে, তবু সে তাহার ছেলেকে লেখাপড়া শিখাইবে। তাহার হাতের লাঠিতে বনের বাঘ পালায়হিংস্র বিষধর সাপ গর্তে লুকায় কিন্তু কলমের লাঠির সঙ্গে সে যুদ্ধ করিতে জানে না। সেই কলমের লাঠি সে তাহার ছেলের হাতে দিবে। ভাবিতে ভাবিতে আজাহেরের চোখ ঘুমে ভাঙ্গিয়া আসে। শেষ রাত্রের শীতল বাতাসে সে ঘুমাইয়া পড়ে।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleষোল-আনি – জলধর সেন
    Next Article ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }