Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বোবা কাহিনী – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প320 Mins Read0

    ৩১-৩৫. গ্রীষ্মের ছুটি

    ৩১.

    দেখিতে দেখিতে গ্রীষ্মের ছুটি আসিয়া পড়িল। বছির বই-পত্র লুঙ্গীতে বাধিয়া বাড়ি বলিয়া রওয়ানা হইল। পথে চলিতে চলিতে পথ যেন আর ফুরায় না। মায়ের জন্য, পিতার জন্য তাহার মন কাঁদিয়া উঠে। আহা! মা যেন কেমন আছে! যদি তার কোন অসুখ করিয়া থাকে, হয়ত সেই অসুখের মধ্যে মা তার নাম করিয়া প্রলাপ বকিতেছে। যত সব অলক্ষুণে কথা তার মনে আসিয়া উদয় হয়। যতই সে ভাবে এই সব কথা সে মনে আনিবে না, ততই এই সব কথাগুলি কে যেন তার মনের পর্দায় বিদ্ধ করিয়া দিয়া যায়। বছির আরও জোরে জোরে পা ফেলায়।

    সন্ধ্যা হইবার ঘন্টাখানেক আগে সে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। মা রান্না করিতেছিল। তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া তাহার গা মুখ আঁচলে মুছাইয়া দিল। ঘরের বারান্দায় আনিয়া বসাইয়া তালের পাখা লইয়া ছেলেকে বাতাস করিতে লাগিল। আহা! ছেলের শরীর কেমন রোগা হইয়া গিয়াছে। “হারে! সেহানে দুই ব্যালা প্যাট ভইরা খাইবার ত পাস। তোর চেহারা এমুন খারাপ হয়া গ্যাছে ক্যান?”

    ছেলে মিথ্যা করিয়া বলে, “মা! তুমি কও কি? শহরে উকিল সাহেবের বাড়ি, কত সন্দেশ, রসগোল্লা গড়াগড়ি যায়।”

    “তয় তোর চেহারা এমুন খারাব ঐল ক্যান?”

    “মা তুমি কি কও? সেহানে দিন রাইত খালি বই পড়তি অয়। রাইত জাইগা জাইগা পড়ি। তয় চেহারা খারাপ অবি না?”

    এমন সময় আজাহের মাঠ হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। মা স্বামীকে দেখিয়া মাথায় অপরিসর ঘোমটাটি টানিয়া লইতে বৃথা চেষ্টা করিয়া বলিল,”দেহ কিডা আইছে? য়্যাহেবারে শুহায়া কাঠ হয়া আইছে।”

    “তুমি যাও। উয়ার জন্য খাওনের জোগাড় কর।”

    মা তাড়াতাড়ি খাবার বন্দোবস্ত করিতে গেল।

    বহুদিন পরে বছির বাড়ি আসিয়াছে। নারকেল গাছের তলায় নারকেল ফুলের কি এক রকম সুবাস। সেই সুবাসে বছিরের মনে যেন কত কালের কি অনুভূতি জাগে। বনের গাছে। গাছে নানা রকমের পাখি ডাকিতেছে। মূক মাটি তাহাদের কণ্ঠে আপন ভাষা তুলিয়া দিয়া নীরবে শুনিতেছে! সেই গান শুনিতে শুনিতে সারাদিনের পরিশ্রমে শ্রান্ত বছির অল্প সময়েই ঘুমাইয়া পড়িল।

    পরদিন সকালে ফুলী বেড়াইতে আসিল। ফুলী এখন কত সুন্দর হইয়াছে দেখিতে। হলদে রঙের একখানা শাড়ী পরিয়াছে। তাহাতে তাহার গায়ের রঙ যেন আরও খুলিয়াছে!

    “বছির বাই! তুমি আইছ খবর পায়াই তোমারে দেখতি আইলাম।” সুন্দর ভঙ্গীতে বসিয়া ফুলী দুই হাতে বছিরের পা ছুঁইয়া সালাম করিল। যেন কোন পীর সাহেবকে তার একান্ত ভক্ত সালাম জানাইতেছে।

    বছির বলিল “কিরে ফুলী! কেমন আছিস?”

    কোথাকার লজ্জা আসিয়া যেন তাহার সকল কথা কাড়িয়া লইল। বছিরের মায়ের আঁচল মুখে জড়াইয়া ফুলী কেবলই ঘামিতে লাগিল।

    বছির তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিল, “চাচী কেমুন আছে রে? তোরে ত আমি বই দিয়া গেছিলাম পড়বার। পড়ছাস ত?”

    এ কথারও ফুলী কোন উত্তর দিতে পারিল না। বছিরের মা উত্তর করিল, “পড়ছে না? হগল বই পইড়া ফালাইছে।”

    বছির বলিল,”এবার তোর জন্যি আর একখানা বই আনছি। দেখ, কেমন ছবিওয়ালা।”

    এই বলিয়া তার বই-পত্রের বোচকা খুলিয়া একখানা ছোট বই বাহির করিয়া দিল। ফুলী বইখানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে তাহার মুখে মৃদু লজ্জা মিশ্রিত হাসি ফুটিয়া উঠিল। বছিরের মা দুই সাজীতে করিয়া মুড়ী আনিয়া বছির ও ফুলীর হাতে দিয়া বলিল, “তোরা খা। আমি ইন্দারা ত্যা পানি লয়া আসি।”

    এবার ফুলীর মুখ খুলিল, ”বছির বাই! তুমি এবার এত দেরী কইরা আইলা ক্যান? আমি সব সময় তোমার পথের দিকে চায়া থাহি। ওই মাঠ দিয়া জামা কাপড় পরা কেউ। আইলি বাবি, এই বুজি বছির বাই আসত্যাছে।”

    এই বলিয়া ফুলী কান্দিয়া ফেলিল। বছির ফুলীর আঁচল দিয়া তার মুখ মুছাইতে মুছাইতে বলিল, “আমারও বাড়ি আসপার জন্যি মন ছুঁইটা আইত, কিন্তুক পড়াশুনার এত চাপ যে কিছুতেই বাড়ি আসপার পারলাম না। এবার বাড়ি আইসা অনেকদিন থাকপ।”

    ফুলী তখন আঁচলের ভিতর হইতে এক টুকরা কাপড় বাহির করিয়া বলিল, “দেহ বছির বাই! তুমার জন্যি একখানা রুমাল বানাইছি।”

    রুমালখানা মেলিয়া ধরিয়া বছির বলিল, “বারি ত সুন্দর ঐছেরে। কি সুন্দর ফুল বানাইছাস? এ কিরে তুই যে মুড়ি খাইতাছস না? আয় দুই জনের মুড়ি একাত্তর কইরা আমরা খাই।”

    এই বলিয়া নিজের মুড়িগুলি ফুলীর সাজিতে ঢালিয়া দিয়া দুইজনে খাইতে বসিল। খাওয়া শেষ হইলে ফুলী বলিল, “বছির বাই! আমার সঙ্গে আইস।”

    এই বলিয়া বছিরকে টানিতে টানিতে বড়র কবরের পাশে লইয়া আসিল। এখানে আসিলে দুইটি কিশোর হিয়া যেন বড়ুর বিয়োগ ব্যথায় এক হইয়া যায়। বছির চাহিয়া দেখিল, বোনের কবরের উপরে সেই কুল গাছটির প্রায় সবগুলি ডাল বেড়িয়া সোনালতা জড়াইয়া আছে। ফুলীর তাজমহল ধীরে ধীরে প্রসারিত হইতেছে, কিন্তু বছিরের তাজমহল ত শুধু সোনালতার শোভায়ই শেষ হইবে না। সে যে ছেলে। তাকে জীবনের তাজমহল গড়িতে হইবে। আরও বেশী করিয়া পড়াশুনা করিতে হইবে। আরও বহু কষ্ট করিতে হইবে। বহুদিন আধাপেটা খাইয়া থাকিতে হইবে। জীবনের সম্মুখে সুদীর্ঘ কণ্টক পথ লইয়া সে আসিয়াছে। এই পথের মোড়ে মোড়ে অবহেলা-অপমান-অনাহার–বুভুক্ষা–সব তাকে অতিক্রম করিয়া চলিতে হইবে।

    বহুক্ষণ দুইজনে নীরবে সেই কবরের পাশে বসিয়া রহিল। দুইজনের চোখ হইতেই ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ধারা গড়াইয়া পড়িয়া কবরের মাটি সিক্ত করিতে লাগিল।

    এই মূক কবরের তলা হইতে বড় যেন জাগিয়া উঠিয়া বছিরের কানে কানে বলিতেছে, “মিঞা ভাই! পানি পানি করিয়া আমি মরিয়াছি। তুমি এমন কাজ করিও, আমার মত আর কাউকে যেন এমনি পানি পানি কইরা মরতি না হয়।”

    মনে মনে বছির আবার প্রতিজ্ঞা করিল, “সোনা বইন! তুমি ঘুমাও! আমি জাগিয়া রহিব। যতদিন না আমি তোমার মত সকল ভাই-বোনের দুঃখ দূর করিতে পারি ততদিন জাগিয়া থাকিব। দুঃখের অনল দাহনে নিজের সকল শান্তি সকল আরাম-আয়াস তিলে তিলে দান করিব। সোনা বইন! তুমি ঘুমাও–ঘুমাও!”

    ভাবিতে ভাবিতে বছির উঠিয়া দাঁড়াইল। ফুলীও তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিল। ফুলী ভাবিয়াছিল, বছির ভাইকে সে সঙ্গে লইয়া বনের ধারে ডুমকুর ফল টুকাইবে। সে নিজে পাকা ডুমকুরের এক গাছ মালা গাথিয়া তাহার গলায় পরাইয়া দিবে। সেই মালা পাইয়া তাহাকে সুখী করিবার জন্য বছির গাছে উঠিয়া তাহার জন্য কানাই লাঠি পাড়িয়া দিবে। কিন্তু বছিরের মুখের দিকে চাহিয়া সে কোন কথাই বলিতে পারিল না। ধীরে ধীরে বাড়ি পৌঁছিয়া বছির তাহার বই-পুস্তক লইয়া বসিল। ফুলী অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।

    দেখিতে দেখিতে গ্রীষ্মের ছুটি ফুরাইয়া আসিতেছে কিন্তু বছির একদিনও তার বই-পুস্তক ছাড়িয়া ঘরের বাহির হইল না। শহরে থাকিতে সে কত জল্পনা-কল্পনা করিয়াছ! দেশে যাইয়া এবার সে সজারুর কাটা টুকাইতে গভীর জঙ্গলে যাইবে। ঘন বেতের ঝোঁপের ভিতর হইতে বেথুন তুলিয়া আনিবে। তল্লা বাঁশের বাঁশী বানাইয়া পাড়া ভরিয়া বাজাইবে। বাঁশের কচি পাতা দিয়া নথ গড়িয়া ফুলীকে নাকে পরিতে বলিবে, কিন্তু ছুটির কয় দিন সে তার বই-পুস্তক ছাড়িয়া একবারও উঠিল না। সন্ধ্যা হইলে সামনের মাঠে যাইয়া বসে। তখনও পাঠ্যবই তার কোলের উপর।

    ফুলী কতবার আসিয়া ঘুরিয়া যায়। ডুমকুর গাছ ভরিয়া কাটা। সেই কাটায় ক্ষত-বিক্ষত হইয়া ফুলী পাকা ডুমকুর তুলিয়া মালা গাঁথে। তারপর মালা লইয়া বছিরের সামনে আসিয়া অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে। বছির একবারও তাহার দিকে ফিরিয়া চাহে না। বহুক্ষণ এইভাবে থাকিয়া সে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া চলিয়া যায়। যাইবার সময় বছিরের মা ডাকে, “ও ফুলী। এহনি যে চললি? আয়, তোর মাথার চুল বাইন্দা দেই।”

    ফুলী ফিরিয়া চাহিয়া বলে, “না চাচী! আমার চুল বান্ধন লাগবি না। বাড়িতি আমার কত কাম পইড়া আছে। মা যেন আমারে কত গাইল-মন্দ করত্যাছে! আমি এহন যাই।”

    যাইতে যাইতে সেই ডুমকুর গাছটির তলায় যাইয়া ফুলী সদ্য গাথা মালাগাছটিকে ছিঁড়িয়া কুটি কুটি করে। তারপর কোন সাত সাগরের পানি আসিয়া তার দুই চক্ষে ঢলিয়া পড়ে। অতটুকু মেয়ে। কি তার মনের ভাব কে বলিতে পারে!

    .

    ৩২.

    বাড়ি হইতে শহরে আসিয়া বছির অনেক খবর পাইল, কমিরদ্দী সরদারের নামে জমিদার খাজনার নালিশ করিয়াছেন। তা ছাড়া সেদিনের মারামারি উপলক্ষ করিয়া থানার পুলিশ তাহাকে ও তাহার ছেলেকে গ্রেফতার করিয়াছে। এইসব মামলার তদবির-তালাশী করিতে কমিরদ্দী সরদারকে তার এত সখের দৌড়ের নৌকাখানা অতি অল্প টাকায় বিক্রী করিতে হইয়াছে। কারণ আশে পাশের গ্রামগুলিতে উকিল সাহেবের লোকেরা প্রচার করিয়া দিয়াছেন, মুসলমান হইয়া যাহারা নৌকা বাইচ খেলাইবে তাহারা দোজখে যাইয়া জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিবে, আর তাহাদিগকে একঘরে করিয়া রাখা হইবে। সুতরাং মুসলমান হইয়া কে সেই বাইচের নৌকা কিনিবে? সাদীপুরের এছেম বেপারী মাত্র ষাট টাকা দিয়া এত বড় নৌকাখানা কিনিয়া সেই নৌকা লইয়া এখন পাটের ব্যবসা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। গ্রামের লোকেরা এখন আর কমিরদ্দী সরদারের কথায় ওঠে বসে না। তাহারা নানা দলে বিভক্ত হইয়া একে অপরের ক্ষতি করিতে চেষ্টা করিতেছে। গ্রামে ঝগড়া মারামারি লাগিয়াই আছে। আজ উহার পাটের খেত ভাঙিয়া আর একজন ধান বুনিয়া যাইতেছে। কেহ লাঙল বাহিবার সময় পার্শ্ববর্তী লোকের জমির কিছুটা লাঙলের খোঁচায় ভাঙিয়া লইতেছে। এইসব উপলক্ষে বহুলোক রমিজদ্দীন সাহেবের বাসায় যাইয়া মামলা দায়ের করিতেছে। উকিল সাহেবের পশার এত বাড়িয়াছে যে এখন আর তিনি গ্রাম-দেশে নিজে যাইয়া বক্তৃতা করিবার অবসর পান না। আঞ্জুমাননে ইসলামের মৌলবী সাহেবরা এ-গ্রামে সে-গ্রামে যাইয়া যথারীতি বক্তৃতা করেন। মাঝে মাঝে উকিল সাহেব আঞ্জুমানে ইসলামের জমাত আহ্বান করেন। গ্রামের লোকদের নিকট হইতে চাদা তুলিয়া সেই টাকায়। কলিকাতা হইতে বক্তা আনাইয়া বক্তৃতা করান। চারিদিকে উকিল সাহেবের জয় জয়কার পড়িয়া যায়। ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের ইলেকসনে উকিল সাহেব বহু ভোট পাইয়া মনোনীত হইয়াছেন। উকিল সাহেবের বাসায় লোকজনের আরও ভীড়।

    এইসব গণ্ডগোলে বছিরের পড়াশুনার আরও ব্যাঘাত হইতে লাগিল। রাস্তার লাইট পোস্টের সামনে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পড়াশুনা করিতে রাত্র জাগিয়া তাহার শরীর আরও খারাপ হইয়া পড়িল।

    এক শনিবার বছির বাড়ি যাওয়ার নাম করিয়া সন্ধ্যাবেলা আরজান ফকিরের বাড়ি যাইয়া উপস্থিত হইল। ফকির তাহাকে সস্নেহে ধরিয়া একটি মোড়ার উপর আনিয়া বসাইল। ফকিরের বউ আসিয়া আঁচল দিয়া তাহার মুখ মুছাইতে মুছাইতে বলিল, “আমার বাজান বুঝি তার ম্যায়ারে দেখপার আইছে? ও বাজান! এতদিন আস নাই ক্যান?”

    এই মেয়েটির কথায় যেন স্নেহের শতধারা বহিয়া যাইতেছে। তাহার মা বড়ই লাজুক। ছেলেকে আড়াল-আবডাল হইতে ভালবাসে। এই মেয়েটির মত এমন মিষ্টি করিয়া কথা বলিতে পারে না। আজ এমন স্নেহ-মমতার কথা শুনিয়া বছিরের চোখ হইতে পানি গড়াইয়া পড়িতে চাহে।

    ফকির বলিল, “বাজানরে ক্যাবল মিঠা মিঠা কতা শুনাইলিই চলবি না। এত দূরের পথ হাঁইটা আইছে। কিছু খাওনের বন্দোবস্ত কর।”

    “তাই ত! আমার ত মনেই পড়ে নাই। বাজান! তুমি বইয়া ফকিরের লগে কথা কও। আমি আইত্যাছি!”

    তাড়াতাড়ি ফকিরের বউ এক বদনা পানি আনিয়া দিল হাত পা ধুইতে। তারপর সাজিতে করিয়া কিছু মুড়ি আর একটু গুড় আনিয়া বলিল, “বাজান খাও।” যতক্ষণ বছির খাইল ফকিরের বউ এক দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সুন্দর শ্যামল মুখোনি বছিরের। কচি ধানপাতার সমস্ত মমতা কে যেন সেখানে মাখাইয়া দিয়াছে। ফকিরের সন্তান হয় নাই। কিন্তু এই কিশোর বালকটিকে ঘিরিয়া কোন স্নেহের শতধারায় যেন তার সমস্ত অন্তর ভরিয়া যাইতেছে। ঘরে ত বিশেষ কিছু খাবার নাই। সামান্য কিছু আতপ চাউল আর গুড় যদি থাকিত, তবে সে মনের মত করিয়া কত রকমের পিঠা তৈরী করিয়া এই কিশোর-দেবতাটির ভোগ দিত। টাটকা মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে বছিরের মুখে যে শব্দ হইতেছিল; একান্তে বসিয়া ফকির-বউ সেই শব্দ শুনিতে লাগিল। ফকিরের সারিন্দা বাজানও বুঝি কোনদিন তার কাছে এমন মিষ্টি লাগে নাই।

    খাওয়া শেষ হইলে ফকিরের বউ বলিল, “বাজান! তোমারে কিবা খাওয়াইমু। যার লগে আমারে বিয়া দিছিলা হে আমারে বালুর চরায় ঘর বাইন্দ্যা দিছে। একটা ঢেউ আইসাই ঘর ভাইঙ্গা যাবি। কি ঠগের লগেই আমারে জুইড়া দিছিলা, শিশিরের গয়না দিল গায়–না দেখতেই সে গয়না উইবা গেল। কুয়াশার শাড়ী আইন্যা পরাইল, গায়ে না জড়াইতেই তা বাতাসে উড়ায়া নিল। শুধু সিন্তার সিন্দুরখানিই কপাল ভইরা আগুন জ্বাইলা রইল।”

    এই বলিয়া ফকির-বউ গান রিল। ফকিরও সারিন্দা বাজাইয়া তাহার সঙ্গে যোগ দিল।

    কে যাসরে রঙিলা নার মাঝি!
    সামের আকাশরে দিয়া,
    আমার বাজানরে কইও খবর,
    নাইওরের লাগিয়ারে।
    গলুইতে লিখিলাম লিখন সিস্তার সিন্দুর দিয়া,
    আমার বাপের দেশে দিয়া আইস গিয়া

    –রে রঙিলা নার মাঝি!
    আমার বুকের নিশ্বাস পালে নাও ভরিয়া,
    ছয় মাসের পন্থ যাইবা ছয় দণ্ডে চলিয়া,

    –রে রঙিলা নার মাঝি!

    গান গাহিতে গাহিতে ফকির আর ফকিরনী কাঁদিয়া আকুল হইতেছিল। মাঝে মাঝে গান থামাইয়া ফকির সারিন্দা বাজাইতেছিল আর ফকিরনী চোখের পানি ফেলিতেছিল।

    পরের ছেলের সঙ্গে বাজান আমায় দিলা বিয়া,
    একদিনের তরে আমায় না দেখলা আসিয়া।

    এই গান শেষ করিয়া ফকিরনী বলিল, “বাজান! একদিনও ত ম্যায়ারে দেখতি আইলা । আমি যে কত পন্থের দিকে চায়া থাহি।” ফকিরী-কথার যে অন্তনিহিত ভাব বছির তাহা বুঝিতে পারে না কিন্তু গানের সুরের কি এক মাদকতা তাহাকে যেন পাইয়া বসিল।

    বছিরকে কোলের কাছে বসাইয়া ফকিরনী আবার গান ধরিল,

    ও তুমি আমারে বারায়া গেলারে
    কানাই রাখাল ভাবে।
    তোরো মা যে নন্দ রানী,
    আজকে কেন্দে গোপাল পাগলিনীরে;
    –কানাই রাখাল ভাবে।

    এখন ক্ষুধার হয়েছেরে বেলা,
    তুমি ভেঙে আইস গোঠের খেলারে;
    –কানাই রাখাল ভাবে।

    কতদিন যে নাহি শুনি।
    তোরো মুখে মা বোল ধ্বনিরে,
    –কানাই রাখাল ভাবে।

    এই গানের পিছনে হয়ত কত গভীর কথা লুকাইয়া আছে তাহা বছির বুঝিতে পারে না। কিন্তু গানের সুরে সুরে এই পুত্র-হীনা মেয়েটির সমস্ত অন্তর স্নেহের শতধারা হইয়া তাহার দেহে-মনে বর্ষিত হইতেছে তাহা যেন আবছা আবছা সে বুঝিতে পারে।

    গান শেষ করিয়া ফকিরনী বলিল, “বাজান! আইজ তুমি আমাগো এহানে বেড়াও। রাত্তিরে আরও অনেক লোক আসপ্যানে। তোমারে পরান বইরা গান শুনাবানে।”

    ফকিরনীর কথায় এমন মধুঢ়ালা যে বছির না বলিতে পারিল না। ফকির তার সারিন্দায়। নতুন তার লাগাইতে বসিল। বছির উঠানে দাঁড়াইয়া এ-দিক ওদিক দেখিতে লাগিল। ছোট্ট  একখানা বাকা দুইচালা ঘর ফকিরের। তার সঙ্গে একটি বারান্দা। সেখানে সাত আটজন লোক বসিতে পারে। সামনে ছোট্ট উঠানখানা সুনিপূণ করিয়া লেপা-পোছা। তারই পাশে লাউ কুমড়ার জাঙলা। কত লাউ ধরিয়াছে। ওধারে জাঙলা ভরিয়া কনে-সাজানী শিমলতা লালে-নীলে মেশা রঙে যেন সমস্ত উঠানখানি আলো করিয়া আছে। ওধারে শিমূল গাছে কত ফুল ফুটিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। গাছের ডালে ডালে কুটুম পাখি, বউ কথা কও পাখি, ডাকিয়া ডাকিয়া এইসব ফুলের রঙ যেন গানের সুরে ভরিয়া মহাশূন্যের উপর নক্সা আঁকিতেছে। বাড়ির সামনে দিয়া গ্রাম্য-হালটের পথ দূরের মাঠ পার হইয়া আকাশের কোলে কালো কাজল রেখা আঁকা অজানা কোন গ্রামে মিশিয়া কোথায় উধাও হইয়া গিয়াছে। কেউ পথের উপর এখানে সেখানে গরুর পাল লইয়া রাখাল ছেলেরা নানারূপ শব্দ করিয়া ঘরে ফিরিতেছে। কোন কোন রাখাল গ্রাম্য-যাত্রায় গাওয়া কোন বিলম্বিত লয়ের গানের একটি কলি বার বার গাহিয়া গোধূলীর উদাস মেঘেভরা সমস্ত আকাশখানিকে আরও উদাস করিয়া দিতেছে। গরুর পায়ের খুরের শব্দ সেই গানের সঙ্গে যেন তাল মিলাইতেছে। পিছনে যে ধূলী উড়িয়া বাতাসে ভাসিতেছে তাহার উপরে সন্ধ্যার রঙ পড়িয়া কি এক উদাস ভাব মনে জাগাইয়া দিতেছে। বছির মনে মনে ভাবে, ফকিরের এই গ্রামখানার মাঠ, ঘাট, পথে, বাড়ি-ঘর, ফুল-ফলের গাছ সকলে মিলিয়া যেন বৃহত্তর একটি সারিন্দা-যন্ত্র। এই যন্ত্র সকালে বিকালে রাত্রে প্রভাতে এক এক সময় এক এক সুরে বাজিয়া সমস্ত গ্রামের মর্মকথাটি যেন আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দেয়। তারই ক্ষুদ্র প্রতীক করিয়া গ্রাম্য-ফকির তাহার সারিন্দাটি গড়িয়া লইয়াছে। তাহার সুরের মধ্যেও গ্রামের প্রাণ-স্পন্দন শোনা যায়।

    দেখিতে দেখিতে চারিদিক অন্ধকার করিয়া রাত্র আসিল। কোন্ গ্রাম্য-চাষীর মেয়েটি যেন আকাশের নীল কথাখানার উপর একটি একটি করিয়া তারার ফুল বুনট করিয়া তুলিতেছিল। তাহারই নকল করিয়া সমস্ত গ্রামের অন্ধকার কথাখানার উপর একটি একটি করিয়া সান্ধ্য প্রদীপের নক্সা বুনট হইতেছিল। ছোট্ট ছেলে বছির। অত শত ভাবিতে পারিল কিনা জানি না। কিন্তু বাহিরের এই সুন্দর প্রকৃতি তার অবচেতন মনে কি এক প্রভাব বিস্তার করিয়া রাত্রের গানের আসরের জন্য তাহার অন্তরে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করিতেছিল। উদাস নয়নে বছির বাহিরের আকাশের পানে বহুক্ষণ চাহিয়াছিল। ফকিরনীর গান শুনিয়া তাহার চমক ভাঙ্গিল।

    ক্ষুধার হয়েছে বেলা
    এখন ভাইঙ্গা আইস গোঠের খেলারে

    –কানাই রাখাল ভাবে।

    “আমার গোপাল! মুখোনি খিদায় মৈলাম হয়া গ্যাছে। বাজান! চল খাইবার দেই।” আঁচল দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া ফকিরনী বছিরকে ঘরে লইয়া গেল। মাটির সানকীতে করিয়া ভাত আর লাউ শাক। পাতের এক পাশে দুইটা কুমড়াফুল ভাজা। এই সামান্য খাবার। ফকিরনী বলে, “বাজান! আর কি খাইওয়াবো তোমারে। আমাদের গোপালের ভোগে এই। শাক আর ভাত!”

    বছির আস্তে আস্তে খায়। ফকিরনী পুত্র-স্নেহের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি লইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। বছিরের খাওয়া যখন শেষ হইয়াছে, ফকিরনী গান ধরিল–

    কি দিয়ে ভজিব তোর রাঙা পায়,
    আমার মনে বড় ভয় দয়ালরে।

    গানের সুর শুনিয়া ফকির তাহার সারিন্দা বাজাইয়া ফকিরনীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইল। ফকিরনী গাহিতে লাগিল,

    দুগ্ধ দিয়া ভজিব তোরে
    সেও দুধ বাছুরিতি খায়।
    চিনি দিয়া ভজিব তোরে
    সে চিনি পিঁপড়ায় লইয়া যায়।
    কলা দিয়া ভজিব তোরে
    সেও কলা বাদুরিতি খায়।
    মন দিয়া ভজিব তোরে
    সেও মন অন্য পথে ধায়।

    দয়ালরে–
    আমি কি দিয়া ভজিব তোর রাঙা পায়!

    ফকিরনীর এই রকম ভাব-সাব দেখিয়া বছিরের বড়ই লজ্জা করে। সে বুঝিতে পারে না, তাহাকে উপলক্ষ করিয়া তাহারা এরূপ করে কেন? ফকিরনী নিজে বছিরের হাতমুখ ধোয়াইয়া আঁচল দিয়া তাহার মুখ মুছিয়া দিল। তারপর তাহারা দুইজনে খাইতে বসিল।

    ইতিমধ্যে ও-পাড়া হইতে ফকিরের দুই তিনজন শিষ্য আসিল, সে-পাড়া হইতে জয়দেব বৈরাগী তাহার বৈষ্টমীকে সঙ্গে করিয়া আসিল। জয়দেবের কাঁধে একটি দোতারা। সে আসিয়াই দোতারায় তার যোজনা করিতে লাগিল। ফকির হাতমুখ ধুইয়া তাহার সারিন্দা লইয়া বসিল। সারিন্দার তারগুলি টানিয়া ঠিক করিতে করিতে তাহার শিষ্যদিগকে বলিল, “আইজ আমার শ্বশুর আইছে গান হুনবার। তোমরা বাল কইরা গীদ গাইও।”

    জয়দেব বছিরের লাবণ্য ভরা শ্যামল মুখোনির দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “আপনার শ্বশুর কিন্তু আমার কাছে আমার কেষ্ট ঠাকুর। আইজ বৃন্দাবন ছাইড়া আইছে। আমাগো বজ্রবাসীগো অবস্থা দেখপার জন্যি। দেখছেন না, কেমন টানা টানা চোখ ঠাকুরের। আর গায়ের রূপে যেন তমাল লতার বন্নক। এবার হাতে একটা মোহন বাঁশী থাকলেই একেবারে সাক্ষাৎ কেষ্ট ঠাকুর হৈত! মানুষের মধ্যেই ত রূপে রূপে বিরাজ করেন তিনি। যারে দেইখ্যা বাল লাগে তারির মদ্দিই ত আইসা বিরাজ করেন ঠাকুর।”

    ফকির বলিল, “এবার তবে আমার শ্বশুরকে গান শুনাই।” প্রথমে বন্দনা গান গাহিয়া ফকির গান ধরিল,

    কে মারিল ভাবের গুলি
    আমার অন্তর মাঝারে,
    এমন গুলি মাইরা চইলা গ্যাল
    একবার দেখল না নজর করে।
    জগাই বলে ওরে মাধাই ভাই!
    শিকার খেলিতে আইছে গয়ুর নিতাই;
    আমার এত সাধের পোষা পাখি
    নিয়া গ্যাল হরণ করে।

    গান গাহিতে গাহিতে ফকির আর গাহিতে পারে না। হাতের সারিন্দা রাখিয়া অঝোরে কান্না করে। সঙ্গের শিষ্যেরা একই পদ বার বার করিয়া গাহে,

    জগাই বলে ওরে মাধাই ভাই!
    শিকার খেলিতে আইছে গয়ূর নিতাই;
    আমার এত সাধের পোষা পাখি
    নিয়া গ্যাল হরণ করে।

    তারপর ফকির গান ধরিল,

    ও দীন বন্ধুরে
    আমি ভাবছিলাম আনন্দে যাবে দিন।
    বাল্যকাল গ্যাল ধূলায় খেলায়
    আমার যৈবুন গ্যাল হেলায় ফেলায়,
    এই বৃদ্ধকালে ভাঙল দিনের খেলারে।
    জঙ্গলে জঙ্গলে ফিরি,
    আমি আইলা ক্যাশ নাহি বান্দি হে;
    আমি তোরো জন্যে হইলাম পাগলিনীরে।
    শুনেছি তোর মহিমা বড়,
    তুমি পাতকী তরাইতে পার হে;
    আমার মতন পাতক কেবা আছে ভবেরে।

    এই গান শেষ করিয়া ফকির আরও কতকগুলি গান গাহিল।

    আমার ফকিরের বাড়ি নদীর ওপারে। এ-পারে বসিয়া আমি তাহার জন্য কান্দিয়া মরি। হাতে আসা বগলে কোরান সোনার খড়ম পায়ে দিয়া আমার ফকির হাঁটিয়া হাঁটিয়া যায়–তার মুখে মৃদু মৃদু হাসি। সকলে বলে আমার দয়াল কেমন জনা। আন্ধার ঘরে যেমন কাঞ্চা সোনা জ্বলে, কাজলের রেখার উপর যেমন চন্দনের ছটা, কালিয়া মেঘের আড়ে যেমন বিজলির হাসি তেমনি আমার দয়াল চান। তার তালাশে আমি কোন দেশে যাইব?

    চাতক হইয়া আমি মেঘের দিকে চাহিয়া থাকি। মেঘ অন্য দেশে ভাসিয়া যায়। আশা করিয়া আমি বাসা বাধিলাম। আমার আশা বৃক্ষের ডাল ভাঙিয়া গেল।

    গান গাহিতে গাহিতে ফকির আর গাহিতে পারে না। তাহার সমস্ত অঙ্গ কি এক ভাবাবেশে দুলিতে থাকে। জয়দেব বৈরাগী তখন গান ধরিল,–

    আমি বড় আশা কইরা দয়াল ডাকিরে তোরে,
    আমি বড় আফসোস কইরা দয়াল ডাকিরে তোরে।
    হাপন যদি বাপ মা হইতারে দয়াল চান!
    ও লইতা ধূল ঝাইড়া কোলেরে।
    কোলের ছেলে দূরে না ফেইলারে দয়াল চান!
    তুমি রইলা কোন দ্যাশেরে।
    যেনা দেশে যাইবা তুমিরে দয়াল চান!
    আমি সেই দেশে যাবরে।
    চরণের নূপুর হয়ারে দয়াল চান!
    ও তোমার চরণে বাজিবরে।

    গান শেষ হইতে পূর্ব আকাশের কিনারায় শুকতারা দেখা দিল। ফকিরেরা গান থামাইয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল। কেহ কাহারও সঙ্গে একটি কথাও বলিল না। গানের আসরে কি এক মহাবস্তু যেন তাহারা আজ পাইয়াছে। সকলেরই হৃদয় সেই গানের আবেশে ভরপুর।

    ফকিরনী নিজের বিছানার এক পাশ দেখাইয়া বছিরকে বলিল, “বাজান! আইস শুইয়া পড়।” বছির শুইলে ফকিরনী তাহার গায়ে বাতাস করিতে লাগিল। একহাতে মাথার চুলগুলি বিলি দিতে লাগিল। শুইয়া শুইয়া বছিরের কিন্তু ঘুম আসিল না।

    দূরবর্তী চরের কৃষাণ কুটিরগুলি হইতে চেঁকি পারের শব্দ আসিতে লাগিল। চাষী-মেয়েরা শেষ রাত্রিতে উঠিয়া ধান ভানিতেছে। শেষ রাতের শীতল বাতাসে টেকি পারাইতে তত হয়রান হইতে হয় না। কত রকম সুরেই যে মোরগ ডাকিতে লাগিল। চাষীরা এখনই উঠিয়া মাঠে লাঙল দিতে চলিয়াছে! তাহাদের গরু তাড়াইবার শব্দ কানে আসিতেছে। ক্রমে ক্রমে দিনের পাখিগুলি গাছের ডালে জাগিয়া উঠিল। নদী-তীর হইতে চখা-চখী ডাকিতে লাগিল। সে কি মধুর সুর! সমস্ত বালুচরের মনের কথা যেন তাহারা সুরে সুরে ছড়াইয়া দিতেছে।

    মাঝে মাঝে এক ঝাক বেলে হাঁস আকাশে উড়িয়া কখনো অর্ধ গোলাকার হইয়া কখনো লম্বা ফুলের মালার মত হইয়া দূর শূন্য পথে ঘুরিতেছিল। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়া বছির দেখিতেছিল।

    ফর্সা হইয়া যখন সকাল হইল বছির উঠিয়া বসিল। ফকিরনী বছিরের হাতমুখ ধোওয়াইয়া তাহাকে সামান্যকটি ভিজানো ছোলা আনিয়া খাইতে দিল।

    বিদায়ের সময় ফকিরনী বলিল, “বাজান! ম্যায়ারে দেখপার জন্যি কিন্তুক আইস। আমি পথের দিগে চায়া থাকপ।”

    যতক্ষণ বছিরকে দেখা গেল ফকিরনী ঘরের বেড়া ধরিয়া ঠায় দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর সে যখন দূরের ঝাউ গাছটির আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল তখন একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। আহা! এই শ্যামল রঙের ছেলেটিকে সে কোন মায়ার পাশে বাঁধিবে? আর কি সে আসিবে? তারই গায়ের রঙ মাখিয়া দুরের শস্য খেতগুলি যেন মায়ায় দুলিতেছে। আকাশের কিনারায় দূরের মেঘগুলি যেন তারই ছায়া গায়ে মাখিয়া ওমন পেলব হইয়াছে। গোপাল–আমার গোপাল–আমি যে তোর মা যশোদা! গোঠের খেলা ভঙ্গ করিয়া তুই আমার বুকে আয়!

    .

    ৩৩.

    সেদিন বছির টিনের থালায় করিয়া এক গ্লাস ভাত মুখে দিয়া আর এক গ্লাস হাতে লইয়াছে। এমন সময় উকিল সাহেব তাহার সামনে আসিয়া বলিলেন, “খবর পেলাম, তুমি আরজান ফকিরের বাড়ি যেয়ে একরাত কাটিয়ে এসেছ। আমরা তাকে একঘরে করেছি। তার বাড়িতে যেয়ে তুমি ভাত খেয়েছ। আমার এখানে আর তোমার থাকা হবে না। বই-পত্র নিয়ে শিল্পীর সরে পড়। তোমার মুখ দেখলে আমার গা জ্বালা করে।” এই বলিয়া উকিল সাহেব অন্দরে প্রবেশ করিলেন।

    বছিরের হাতের ভাত হাতেই রহিল। হতভম্বের মত সে বসিয়া রহিল। কখন যেন হাতের ভাত থালায় পড়িয়া গেল সে টেরও পাইল না। টিনের থালাখানা হাতে করিয়া বছির বাহিরে আসিয়া ভাতগুলি ফেলিয়া দিল। কতকগুলি কাক আসিয়া সেই ভাত খাইতে খাইতে ছিটাইয়া একাকার করিল। তেমনি করিয়া তাহার বালক-জীবনের স্বপ্নখানিকেও কে। যেন দু’পায়ে দলিয়া-পিষিয়া টুকরো টুকরো করিয়া ইতস্ততঃ ছড়াইয়া দিল।

    এখন বছির কোথায় যাইবে! কোথায় যাইয়া আশ্রয় পাইবে? বই-পুস্তক নিজের লুঙ্গিখানায় বাধিয়া বছির পথে বাহির হইল। আজ আর স্কুলে যাওয়া হইবে না।

    শহরের মসজিদে কয়েকটি মাদ্রাসার ছাত্র থাকিত। সেখানে মজিদ নামে একটি ছেলের সঙ্গে তাহার আলাপ হইয়াছিল। সে মসজিদে থাকিয়া পড়াশুনা করিত। ছুটির সময় গ্রামে গ্রামে লোকজনের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করিত। তাই দিয়া শহরের হোটেলে একপেটা আধপেটা খাইয়া কোন রকমে তাহার পড়াশুনা চালাইত। তাহার সঙ্গে আরও যে চার পাঁচটি ছাত্র থাকিত তাহারাও এইভাবে তাহাদের পড়াশুনার খরচ চালাইত।

    অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া বছির মজিদের আস্তানায় আসিয়া উঠিল। মজিদ অতি সমাদর করিয়া চৌকির উপর তাহার ময়লা লুঙ্গিখানা বিছাইয়া বছিরকে বসিতে দিল। সমস্ত শুনিয়া মজিদ বলিল, “ভাই! আল্লার ওয়াস্তে তুমি আমার মেহমান হয়া আইছ। তোমার কুনু চিন্তা নাই। আমি তোমারে আশ্রয় দিলাম।”

    বছির বলিল, “ভাই! তুমি নিজেই পেট ভরিয়া খাইবার পাও না। তার উপরে আমারে খাওন দিবা কেমন কইরা?”

    মজিদ বলিল, “ভাই! আমার কাছে আট আনার পয়সা আছে, চল এই দিয়া দুইজনে ভাত খায়া আসি। তারপর আর সব কথা শুনবানে।”

    বছির জিজ্ঞাসা করিল, “এই আট আনা দিয়া তুমি আমারে খাওয়াইবা। কালকার খাওন কুথায় থনে অইব?”

    উত্তরে মজিদ বলিল, “ভাইরে! আইজকার কথা বাইবাই বাঁচি না। কালকার কথা বাবলি ত আমরা গরীব আল্লার দইনা হইতে মুইছা যাইতাম। আমাগো কথা ঐল আইজ বাইচা থাহি। কাইলকার কথা কাইল বাবব। চল যাই, হৈটালত্যা খায়া আসি।”

    সামনে হাফেজ মিঞার হোটেল। বাঁশের মাচার উপর হোগলা বিছানো। তার এখানে। সেখানে তরকারি পড়িয়া দাগ হইয়া আছে। রাশি রাশি মাছি ভন ভন করিয়া উড়িতেছে। পিছনের নর্দমার সামনে একরাশ এঁটো থালা-বাসন পড়িয়া আছে। কতকগুলি ঘেয়ো কুকুর। সেখানে কাড়াকাড়ি করিয়া সেই ভুক্তাবশিষ্ট ভাতের উপর পড়িয়া কামড়া-কামড়ি করিতেছে। হোটেলওয়ালা আসিয়া সেই কুকুরগুলিকে নির্দয়ভাবে প্রহার করিয়া তাড়াইয়া দিতেছে; আবার তাহারা আসিয়া যথাস্থান দখল করিতেছে।

    বছিরকে সঙ্গে করিয়া মজিদ সেই মাচার উপর হোগলা বিছানায় আসিয়া বসিল। হোটেলের চাকর সেই এঁটো থালা বাসনগুলি হইতে চল্টা-ওঠা দু’খানা টিনের থালা সামান্য পানিতে ধুইয়া নোংরা একখানা কাপড় দিয়া মুছিয়া তাহাদের সামনে দিল। মজিদ বলে, “দুই থালায় তিন আনার করিয়া ভাত আর এক আনার করিয়া ডাল দাও!” শুনিয়া হোটেলওয়ালা হাফেজ মিঞা বলিল, “মিঞা! রোজই শুধু ডাল ভাত চাও? আমার তরকারি বেচপ কার কাছে! আইজকার মত দিলাম, কিন্তুক আর পাইবা না। ভাত বিক্রী হয়া যায়, তরকারি পইড়া থাহে।”

    মজিদ কথার উত্তর না দিয়া সেই ডাল-ভাত মাখাইয়া দুইজনে খাইতে বসিল। খাইতে খাইতে মজিদ চাকরটাকে বলিল, “বাই ত বাল, দুইডা কাঁচা মরিচ আর দুইডা পেঁয়াজ আইনা দাও।” চাকর তাহাই আনিয়া দিল। হাফেজ মিঞা তাহার দিকে কটমট করিয়া চাহিতে লাগিল। অল্প এতটুকু ডালে অর্ধেক ভাতও খাওয়া হইল না। মজিদ হোটেল-ওয়ালাকে বলিল, “হাফেজসাব! আজই এক ছিপারা কোরান শরীফ পইড়া আপনার মা-বাপের নামে বকশায়া দিবানি। আমাগো একটু মাছের ঝোল দেওনের হুকুম করেন।

    হোটেলওয়ালা বলিল, “অত বকশানের কাম নাই। পয়সা আছে যে মাছের ঝোল দিব?”

    মজিদ বলিল, “আমরা তালেম-এলেম মানুষ। আমাগো দিলি আল্লা আপনাগো বরকত। দিব। না দিলি আল্লা বেজার হবেন।”

    হোটেলওয়ালা মনে মনে ভাবিল, না যদি দেই তবে হয়ত ইহারা অভিসম্পাত দিবে। শত হইলেও তালেম–এলেম! ইহাদের কথা আল্লা শোনে। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে দুই চামচ মাছের ঝোল তাহাদের পাতে ঢালিয়া দিল।

    খাইয়া লইয়া হোটেলওয়ালারে ভাতের দাম দিয়া তাহারা আবার সেই মসজিদের ঘরে আসিয়া বসিল! স্কুলের ঘন্টা কখন পড়িয়া গিয়াছে। তবু বছির বই-পত্র লইয়া স্কুলের পথে রওয়ানা হইল।

    বিকালে স্কুলের ছুটির পর সে মজিদের আস্তানায় ফিরিয়া আসিল। তখন মাদ্রাসার আর আর ছেলেরাও আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। মজিদ তাহাদের কাছে বছিরকে পরিচিত করাইয়া দিল। যাহারা সব সময় অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে তাহারাই অভাবী লোকের দুঃখ সকলের আগে বুঝিতে পারে। মাদ্রাসার ছেলেরা সকলেই বছিরকে আপনজনের মত গ্রহণ করিল।

    কথায় কথায় তাহারা আলাপ করিতে লাগিল, আজ বিকালে তাহারা কোথায় খাওয়ার ব্যবস্থা করিবে? ছাত্রদের মধ্যে করিম একটি রোগা-পটকা ছেলে। পড়াশুনা বিশেষ কিছুই করে না কিন্তু কোথায় কাহার বাড়ি ফাতেহা হইবে, কোথায় বিবাহ উপলক্ষে ভোজের ব্যবস্থা হইবে, তার সমস্ত খবর সে সংগ্রহ করিয়া আনে। সেই জন্য সঙ্গী-সাথীরা তাহাকে বড়ই ভালবাসে। মজিদ করিমকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “করিম ভাই! বল ত আজ তুমি আমাগো জন্যি কুন জায়গায় দাওয়াতের বন্দোবস্ত করছাও?”

    করিম বলিল, “চিন্তা কইর না বাই! আজ খান বাহাদুর সায়েবের মায়ের ফাতেহা। এহনই চল! খতম পড়তি অবি। যার যার ছিপারা লয়া চল।”

    বছির মজিদের কানে কানে বলিল, “আমি যে বাল আরবী পড়তি জানি না।”

    মজিদ বলিল, “আমরাই কি বাল মত জানি বাই? তোমারে একখান ছিপারা দিব। আমাগো মতন দুইলা দুইলা পড়ার অভিনয় করবা। কেউ টের পাবি না।”

    ইতিমধ্যে হোটেলে যাইয়া যে ভাবে মজিদ মাছের ঝোল চাহিয়া লইয়াছে তাহা বছিরের মনঃপুত হয় নাই। এখন আবার আল্লার কোরান শরীফ লইয়া পড়ার অভিনয় করিতে তাহার কিছুতেই মন উঠিতেছিল না।

    সে মজিদকে বলিল, “ভাই! তোমরা সগলে যাও। সকালে আমি এত খাইছি যে আমার মোটেই ক্ষিধা নাই। তাছাড়া আল্লার কালাম লয়া মিথ্যা অভিনয় করবার পারব না।”

    মজিদ বলিল, “ভাই বছির! আল্লার দইনায় কোন সত্য আর কোন মিথ্যা কওন বড় মুস্কিল! আমরা যে এমন কইরা আধ পেটা খায়া আল্লার কালাম পড়তাছি আর খান বাহাদুর সাবরা কতক খায় কতক ফেলায়া দ্যায়। একবারও আল্লার নাম মুহি আনে না! এডাই কি আল্লার হুকুম? আমরা বইসা বইসা কোরান শরীফ পড়ব আর তার ছওয়াব পাইব খান বাহাদুর সাবের মরা মা, এডাই কি সত্য! বাইরে! আমাগো বাইচা থাকার চায়া সত্য আর দুইনায় নাই। অতসব ভাবতি ঐলি আর লেহা পড়া করতি অবি ন্যা। বাড়ি যায় লাঙল ঠেলতি অবি।” এই বলিয়া বছিরকে টানিয়া লইয়াই তাহারা খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি রওয়ানা হইল।

    পরদিন সকালে বছির তার বই-পুস্তক লইয়া পড়িতে বসিল! খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি যাইয়া রাতের খাওয়া ত তাহারা খাইয়াই আসিয়াছে। তাহার উপরে এক একজন পঁচ সিকা করিয়া পাইয়াছে। সুতরাং দুইদিনের জন্য আর তাহাদিগকে ভাবিতে হইবে না।

    পরদিন সকালে মসজিদের বারান্দায় আরও অনেকগুলি নূতন তালেব-এলেম আসিয়া যার যার কেতাব সামনে করিয়া সুর করিয়া পড়িতে লাগিল। বলা বাহুল্য মজিদ ও তার বন্ধুরা আসিয়াও তাহাদের সঙ্গে যোগ দিল। সকলে সুর করিয়া যখন পড়িতেছিল দূর হইতে মনে হইতেছিল, মসজিদে যেন হাট বসিয়াছে। কিছুক্ষণ পরে ইমাম সাহেব। আসিলেন। তাহাকে দেখিয়া সকল ছাত্র দাঁড়াইয়া সিলামালকি দিল। তিনিও যথারীতি উত্তর প্রদান করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। দুইজন ছাত্র তাড়াতাড়ি যাইয়া ইমাম সাহেবকে বাতাস করিতে লাগিল। ইহার পুরস্কার স্বরূপ তিনি তাহাদিগের প্রতি চাহিয়া একটু মৃদু হাসিলেন। তাহাতেই যেন তাহারা কৃতার্থ হইয়া আরও জোরে জোরে পাখা চালাইতে লাগিল।

    বহুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ইমাম সাহেব বয়স্ক তিন চারটি ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাগো পড়া ওইছে?” তাহারা এক বাক্যে বলিল, “ওইছে মাওলানাসাব।”

    তাহারা আসিয়া ইমাম সাহেবের সামনে দাঁড়াইল! তিনি তাহাদের বলিলেন, “পড়।” তোতা পাখির মত তাহারা একে একে যার যার পড়া পড়িয়া যাইতে লাগিল। চারিদিকে আর আর ছাত্রেরা ভীষণ শব্দ করিয়া পড়িতেছিল। তাহাদের গণ্ডগোলে এই ছাত্র কয়টি কি পড়া দিল ইমাম সাহেব তাহা শুনিতেও পাইলেন না। তিনি কেতাব দেখিয়া তাহাদিগকে। নূতন পড়া দেখাইয়া অপর একদল তালেব-এলেমকে ডাক দিলেন। এইভাবে সকল ছাত্রের। পড়া লইতে প্রায় ঘন্টা দুই কাটিয়া গেল। তখন ইমাম সাহেব তাহাদিগকে ছুটি দিলেন। তাহারা কলরব করিয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল। বছির এক কোণে বসিয়া তাহার দিনের পড়া তৈরী করিতে লাগিল।

    মসজিদে আসিয়া বছিরের পাঁচ ছয় দিন কাটিয়া গিয়াছে। এই সময়ের মধ্যে সে মসজিদের ছাত্রদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানিতে পারিল। তাহারা প্রায় সকলেই এই জেলার বিভিন্ন গ্রাম হইতে আসিয়াছে। মাওলানা সাহেবেরা ওয়াজ করিয়া তাহাদের অভিভাবকদের বুঝাইয়াছেন, যে পিতা-মাতা তাহার সন্তানদিগকে ইসলামী শিক্ষার জন্য এই ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় পাঠাইবেন আল্লা রোজ হাশরের আজাবের সময় তাহার মাথায় একটি ছত্র ধরিবেন। যে বাড়িতে একজন মাদ্রাসার ছাত্র পড়ে সে বাড়িতে আল্লার বেহেশত নামিয়া আসে। আলেম লোকদের চৌদ্দ পুরুষ পর্যন্ত বেহেশতে যায়। যখন একটি ছাত্র। প্রথম দিন মাদ্রাসার সিঁড়ির উপর আসিয়া দাঁড়ায় তখন তাহার মৃত মুরুব্বীরা দোয়া দরূদ পড়িতে পড়িতে বলেন, “এই যে আমাগো আওলাদ আইজ মাদ্রাসায় পড়তি আইল, তার যবান হইতে যখন আল্লার কালাম বাহির হইবে তখন আমাগো সকল গোর আজাব কাটিয়া যাইবে।”

    ইত্যাকার বক্তৃতা শুনিয়া সরল-প্রাণ গ্রামবাসীরা সস্তায় পরকালে এই সব সুযোগ-সুবিধা। পাইবার জন্য নিজ নিজ ছেলেদিগকে মসজিদের ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় পাঠাইয়াছে। কোন। কোন ছাত্র সাত আট বৎসর ধরিয়া এই মাদ্রাসায় যাওয়া আসা করিতেছে। এখন পর্যন্তও তাহারা আরবীর প্রথম ভাগ কেতাবখানাই পড়িয়া শেষ করিতে পারে নাই। মসজিদের ইমাম সাহেব হাফেজী পাশ। প্রথম শিক্ষার্থীদের আরবী অক্ষর ও ভাষা শিক্ষা দেওয়ার কোনই পদ্ধতি তিনি জানেন না। জানিলেও তিনি তাহা প্রয়োগ করা প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ মাদ্রাসায় পড়িতে আসিয়া ছাত্রেরা কেহই বেতন দেয় না। দুই ঈদের ফেতরা এবং যাকাত আদায় করিয়া তিনি বৎসরে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা পান। তা ছাড়া নিকটস্থ গ্রামগুলিতে কেহ মারা গেলে তাহার নামে কোরান শরীফ খতম করার জন্য মাঝে মাঝে তিনি দাওয়াত পান। তাহাতে মাসে পাঁচ সাত টাকার বেশী আয় হয় না। সুদূর নোয়াখালী জেলা হইতে তিনি আসিয়াছেন। দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা। তাহারা একবেলা খায় ত আর একবেলা অনাহারে থাকে। কত করুণ করিয়া তাহারা মাঝে মাঝে পত্র লেখে। এই সামান্য আয়ের সবটাই তাহাকে দেশে পাঠাইতে হয়। স্ত্রীর একটি ছোট ছেলে হইয়াছে আজ ছয় মাস। টাকা পয়সার অভাবে এখনও ছেলেকে দেখিতে যাইতে পারেন নাই।

    ছাত্রেরা যখন ইমাম সাহেবকে ঘিরিয়া পড়া জিজ্ঞাসা করিতে থাকে তখন তাহার মন উধাও হইয়া ছুটিয়া যায় সেই নোয়াখালী জেলায় একটি অখ্যাত গ্রামে।

    যে চার পাঁচজন মসজিদে থাকিয়া পড়াশুনা করিত, অল্প সময়ের মধ্যেই তাহাদের সঙ্গে বছিরের বড় ভাব হইয়া গেল। তাহারা প্রত্যেকেই কোরান শরীফে হাফেজ হইবার জন্য তৈরী হইতেছে। সকলেরই অবস্থা বছিরের মত। কিন্তু তাহার মত তাহারা কোন প্রতিকূল অবস্থায় নিরাশ হইয়া পড়ে না। অভাব ত তাহাদের লাগিয়াই আছে। কিন্তু সেই অভাব হইতে মুক্ত হইবার কোন পথ তাহাদের জানা না থাকিলে সেই পথ তাহারা তৈরী। করিয়া লইতে পারে। তাই নিত্য-নূতন ফন্দিতে তাহাদিগকে জীবিকার সংস্থান করিতে হয়।

    যেদিন করিম কোথাও কোন দাওয়াতের খোঁজ পায় না, সেদিন তাহারা দুই তিনটি দলে বিভক্ত হইয়া শহর হইতে দুই তিন মাইল দূরের গ্রামগুলির বাড়ি বাড়ি যাইয়া কবর জেয়ারত করে। সুরেলা কণ্ঠে মোনাজাত করিয়া গৃহকর্তার মঙ্গল কামনা করে। তাহারা খুশী হইয়া সামান্য কিছু দান করে। রাত্র হইলে পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দেয়!

    কোন কোনদিন তাহাদের একজন গ্রামে যাইয়া বলে, “মসজিদে ঘুমাইয়াছিলাম। আমার কোরান শরীফখানা চোরে লইয়া গিয়াছে। আজ কয়দিন কোরান শরীফ পড়িতে পারি নাই। আপনি যদি একখানা কোরান শরীফ কিনিয়া দেন আপনার নামে খতম পড়িয়া সমস্ত ছওয়াব বখশাইয়া দিব।”

    গৃহস্বামী বলে, “আমরা নিজেই খাইতে পাই না। আপনার কোরান শরীফ কেনার পয়সা কোথায় পাইব?”

    ছাত্রটি উত্তরে বলে, “মিঞা সাহেব! আধা পেটা খাইয়া ত প্রায়ই দিন কাটান। না হয় আরও দু’চারদিন কাটাইবেন, কিন্তু পরকালের এই নেকির কাজটি করিয়া রাখেন। রোজ হাশরের বিচারের দিন অনেক কাজ দিবে।” সরল গৃহবাসী তাহার কষ্টের সঞ্চয় হইতে সামান্য কিছু ছাত্রটির কোরান শরীফ কেনার জন্য দান করে।

    এ সব কাজ বছিরের পছন্দ হয় না। সে মজিদের কাছে বার বার এর জন্য প্রতিবাদ করে। কিন্তু মজিদের সেই এক কথা, “আমাগো ত বাই বাচতি অবি। নিজে বাঁচনের জন্যি এই সামান্য মিথ্যা আল্লায় মাফ করবেন। দেখছাও না আল্লার দইনায় কেউ বড়লোক, কেউ গরীব। আল্লা কি আমাগো গরীব কইরা জন্ম দিছিলেন? গরীবগো মুখির বাত কাইড়া নিয়া ওরা বড়লোক ঐছে। দুই চারডা ধর্মের কতা কয়া আমরা যদি ওগো ঠগাইয়া কিছু লই তাতে গুনা অবে না। ওরাও ত আমাগো ঠগাইছে।”

    বছির বলে, “বড়লোকগো ঠগাও সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তুক এইসব গরীব লোকগো ঠগায়া পয়সা আনা ত আমি ভাল বইলা মনে করি না।”

    মজিদ উত্তর করে, “তুমি হাসাইলা বছির আমারে! এইসব লোকগো আমরা যদি না ঠগাই অন্যলোকে আয়া ঠগাবি। দিনে দিনে এরা ঠগতিই থাকপি। আমরা যদি এহন ওগো ঠগায়া লেহা-পড়া শিখতি পারি, আলেম ঐতি পারি, মৌলবী হয়া ওগো কাছে যায়া এমুন ওয়াজ করুম যাতে কেউ আর ওগো ঠগাইবার পারবি না।”

    এ যুক্তিও বছিরের পছন্দ হয় না। এদেরই মত কত ছাত্র ত আলেম হইয়া গ্রাম-দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহারা ত কেহই এইসব গ্রাম্য-লোকদিগকে শোষণের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্য কোন বক্তৃতা করে না। বরঞ্চ আরও অভিনব মিথ্যার জাল পাতিয়া দেশের অজ্ঞ জনসাধারণকে ঠকাইয়া বেড়ায়। কিন্তু যে অসাধারণ অধ্যবসায়ের সহিত এই ছাত্র কয়টি পড়াশুনা করে তাহা দেখিয়া বছির বিস্মিত হয়। ওরা দুই তিনজন প্রায় গোটা কোরান শরীফখানিই মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। তাও কি শুধু মুখস্থই, কেরায়াত করিয়া কোরান শরীফ পড়িতে কোথায় স্বরকে বিলম্বিত লয়ে লম্বা করিতে হইবে, কোথায় খাটো করিতে হইবে, কোথাও থামিতে হইবে, উহার সব কিছু তাহারা মুখস্থ করিয়া আয়ত্ত করিয়া লইয়াছে। দিন নাই-রাত্র নাই–সকাল নাই–বিকাল নাই, অবসর পাইলেই ইহারা কেতাব লইয়া বসে। নিয়মিত খাওয়ার সংস্থান নাই, কতদিন অনাহারে কাটাইতে হয়। শীতে গরম বস্তু নাই। গ্রীষ্মের রৌদ্রে মাথার চান্দি ফাটিয়া যাইতে চাহে। প্রকৃতি ইহাদের কাছে দিনে দিনে নিষ্ঠুর হইতে নিষ্ঠুরতর হয়। তার উপর আছে অনাহারের ক্ষুধা,–সংক্রামক রোগের আক্রমণ! এই নিভকি জীবন যোদ্ধাগুলি দিনের পর দিন সকল রকম প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া চলিতেছে।

    পথ হয়ত ইহাদের ভ্রান্ত হইতে পারে। এই সংগ্রামের শেষ ফসলও হয়তো এই যুগোপযোগী হইয়া তাহাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে ধন-ধান্যে ভরিয়া দিবে না, কিন্তু এই জীবন্ত বিদ্যাসাগরেরা আমাদের পিছাইয়া পড়া মুসলিম সমাজে জ্ঞান-তপস্যার যে কঠোর সাধনা-ধারার আদর্শ রাখিয়া যাইতেছে তাহার প্রভাব কি আমাদের সমাজে পড়িবে না?

    ছোট ছেলে বছির। অত শত ভাবিতে পারে না। কিন্তু মসজিদের এই তালেব-এলেমগুলির প্রতি একান্ত শ্রদ্ধায় তাহার মন ভরিয়া ওঠে। সেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে সে তাহাদের ঘর-সংলগ্ন পায়খানা ও প্রস্রাবখানার উপর বালতি বালতি পানি ঢালিয়া দেয়। দুই বেলা ঝাট দিয়া ঘরখানিকে পরিষ্কার করিয়া রাখে। তাহাদের ময়লা জামা-কাপড়গুলি ভাজ করিয়া সুন্দর করিয়া টাঙাইয়া রাখে। তাহারাও বছিরকে বড়ই স্নেহ করে। সকলেই অভাবী বলিয়া একে অপরের অভাব বুঝিতে পারে। কেহ বাড়ি হইতে সামান্য চিড়া বা মুড়ি লইয়া আসিলে সকলে মিলিয়া তাহা ভাগ করিয়া খায়।

    মসজিদের খাদেম সাহেব এই তালেব-এলেমদিগকে পড়াইতে বিশেষ উৎসাহ দেখান । প্রায়ই নানা ওজর-আপত্তি দিয়া তিনি পড়াইবার সময় অন্য কাজ করেন। এজন্য তাহারা মনঃক্ষুণ্ণ হয় না। আরও মনোযোগের সহিত ওস্তাদের খেদমত করিয়া তাহারা তাহার অনুগ্রহ পাইতে চেষ্টা করে। যেখানে সেখানে ইমাম সাহেবের প্রশংসা করিয়া তাহার জন্য দাওয়াতের বন্দোবস্ত করে। তাহার গোছলের পানি, ওজুর পানি পুকুর হইতে আনিয়া কলসীতে ভরিয়া রাখে। তাহার জামাকাপড় সাবান দিয়া পরিষ্কার করিয়া দেয়। তিনি শুইয়া পড়িলে কেহ পাখার বাতাস করে, কেহ অতি যত্নের সঙ্গে তাহার পা টিপিয়া দেয়। তাহাদের ধারণা, ওস্তাদের সেবা করিয়া তাহার ভিতর হইতে বিদ্যা বাহির করিয়া লইতে হইবে। যখন তিনি তাহাদিগকে পড়াইতে কৃপণতা করেন, তাহারা আরও বেশী করিয়া তাহার খেদমত করে। এইভাবে প্রায় ছয় মাস কাটিয়া গেল। বছির আগের মতই স্কুলে যাইয়া পড়াশুনা করে।

    মাঝে মাঝে আজাহের আসিয়া ছেলের খবর লইয়া যায়। বাড়ি হইতে গামছায় বাঁধিয়া কোনদিন সামান্য চিড়া বা ঢ্যাপের খই লইয়া আসে। মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে বছির সেগুলি কাড়াকাড়ি করিয়া খায়। দেখিয়া আজাহেরের বড়ই ভাল লাগে। আহা! যদি তার সঙ্গতি থাকিত সে আরও বেশী করিয়া চিড়া লইয়া আসিত। যত পারিত ওরা সকলে মিলিয়া খাইত।

    ওদের খাওয়া হইলে আজাহের এক পাশে বসিয়া থাকে। তালেব-এলেমরা যার যার কেতাব লইয়া পড়িতে বসে। বছিরও জোরে জোরে তাহার বই পড়ে। আজাহের বসিয়া বসিয়া শোনে। এই পড়ার সুর যেন তাহার বুকের ভিতর হইতে বাহির হইতেছে। সেই সুরের উপর সোয়ার হইয়া আজাহের ভাসিয়া যায়। ছেলে মস্ত বড় বিদ্বান হইয়া শহরের কাছারিতে হাকিম হইয়া বসিয়াছে! কত উকিল, মোক্তার, আমলা, মুহুরি তাজিমের সঙ্গে তাহার সঙ্গে কথা বলিতেছে। এমন সময় আজাহের সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার পরনে সেই ঘেঁড়া লুঙ্গি। গায়ে কত ধূলাবালি। ছেলে এজলাস হইতে নামিয়া আসিয়া তাহাকে উঠাইয়া লইয়া তাহার আসনের পাশে আনিয়া বসাইল। পায়ের ধূলী মাথায় লইয়া সমবেত উকিল, মোক্তারদিগকে বলিল, “এই যে আমার বাজান। আমার লেখাপড়ার জন্য ইনি কত অভাব-অভিযোগের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছেন। নিজে অনাহারে থাকিয়া আমার পড়ার খরচ চালাইয়াছেন।” ‘না-না’ আজাহের কিছুতেই এইভাবে ছেলের সামনে যাইয়া উপস্থিত হইবে না। তাহা হইলে কি ছেলের মান থাকিবে? সে ছেলের উন্নতির জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে তাহা চিরকালের জন্য যবনিকার অন্তরালে গোপন হইয়া থাকিবে! তাহার ত্যাগের জন্য সে কোনই স্বীকৃতি চাহে না। সকল বাপই ছেলের জন্য এইরূপ করিয়া থাকে। ছেলের উন্নতি হোক–ছেলের সম্মান বাড়ুক, দেশে বিদেশে ছেলের সুখ্যাতি ছড়াইয়া পড়ুক, তাই দেখিয়া আজাহের প্রাণ-ভরা তৃপ্তি লইয়া মাটির গোরে চিরজনমের মত ঘুমাইয়া পড়িবে!

    ছেলের কাছে বিদায় লইয়া আজাহের কত কথা ভাবিতে ভাবিতে গৃহে ফিরিয়া যায়।

    .

    ৩৩.

    সেদিন বছির রহিম মল্লিকের বাড়ি বেড়াইতে গেল। রহিম মল্লিক তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। “ওগো হুনছ নি? আমার মিঞাবাই আইছে। শীগগীর পাও ধুবার পানি দাও! মাথার ক্যাশদা পিড়াহান মুইছা আমার মিঞাবাইরে বসতি দাও।”

    বউ হাসিয়া বারান্দায় একটি খেজুর পাটি বিছাইয়া দিতে দিতে বলিল, “আমার দাদাভাই আইছে। ভাই আমার জন্যি কি লয়া আইছে?”

    বছির বলিল, “হোন দাদী! তোমার জন্যি কুদাল ভাইঙ্গা নথ গড়াইতে দিছি, আর কাঁচি ভাইঙ্গা হাসলি গড়াইতে দিছি সোনারু বাড়িতি। এহন কি খাবার দিবা তাই আন।” বউ বলিল, “তয় আমিও ইন্দুরের মাটি দ্যা তোমার জন্যি পায়েস রাইন্দা রাখছি। ক্যালার। ডাউগ্যার খাসী কইরা রাইন্দা রাখছি তোলই চেরা হাঁড়িতি। বইও কুটুম বইও, আইনা দিত্যাছি।”

    শুনিয়া রহিমদ্দীন হাসিতে হাসিতে বলিল, “তোমরা দাদী নাতি যত খুশী দেওয়া নেওয়া কর। আমি ইয়ার মদ্দি নাই।”

    দাদী তাড়াতাড়ি কোলা হইতে মুড়ি আনিয়া একটি সাজিতে করিয়া বছিরকে খাইতে দিল।

    বছির বলিল, “না দাদী! এত সব বাল বাল খাওয়ার সামগ্রীর নাম করলা, শুইনাই জিহ্বায় পানি আইসা গেছে। তা থুইয়া আমার জন্যি শুধু মুড়ি আইনা দিলা! ওই সব না ঐলে খাব না।”

    দাদী আঁচল দিয়া বছিরের মুখ মুছাইয়া বলিল, “সে সব বানাইতি ত সময় লাগবি। ততক্ষণে এই মুড়িগুলি খাও কুটুম!”

    মুড়ি খাইতে খাইতে বছির রহিমদ্দীর হাল-হকিকত শুনিতে লাগিল। এই অঞ্চলের মধ্যে রহিমদ্দী সব চাইতে ভাল জামদানী শাড়ী বুনাইতে পারিত। লাল, নীল, হলদে সূতা নাইলে পরাইয়া সে শাড়ীর উপর কত রকমের নকসাই না করিত। দেশ-বিদেশ হইতে বেপারীরা আসিত তাহার শাড়ী কিনিতে। শুধু কি জামদানী শাড়ীই সে বুনাইত? মনখুশী, দিলখুশী, কলমীলতা, কাজল লতা, গোলাপ ফুল, রাসমণ্ডল, বালুচর, কত শাড়ীর নাম করিবে সে? কিন্তু এখন দেশে সূতা পাওয়া যায় না। যে সূক্ষ্ম সূতা দিয়া সে আগে শাড়ী বুনাইত তাহা এখন বাজারে পাওয়া যায় না। চোরাবাজারে যা পাওয়া যায় তাহা দিয়া শাড়ী বুনাইলে দাম বেশী পড়ে। লোকসান দিয়া বেচিতে হয়। লোকের রুচিও এখন বদলাইয়া গিয়াছে। শহরের বড়লোকেরা এখন নকসী শাড়ীর পরিবর্তে সাদা থানের উপর নানা রঙের ছাপ দেওয়া শাড়ী পরে।

    “কি কব দাদা বাই! আমাগো এখন মরণ। দেহ আইসা, নকসী শাড়ীর ফর্মাগুলি ইন্দুরে কাটত্যাছে।” এই বলিয়া রহিমদ্দী তাহার ডানা ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া দেখাইল, ঘরের চালের সঙ্গে অনেকগুলি ফর্মা অযত্নে ঝুলিতেছে। তাহার উপর মাকড়সারা স্বেচ্ছায় জাল বুনাইয়া চলিয়াছে।

    বছির বলিল, “আচ্ছা দাদা! সরু সূতা যহন পাওয়া যায় না তহন মোটা সূতার কাপড়ই বানাও না কেন?”

    রহিমদ্দী বলে, “ভাইরে! এই হাতে সরু শাড়ীর নকসাই আসে। তবু অনেক কষ্টে মোটা সূতা কিনা গামছা বুনাই। কিন্তু সে সূতাও চোরাবাজারে কিনতি অয়। তাতে মোটেই লাভ অয় না। একবেলা খাই ত আর একবেলা না খায়া থাহি। গরীবের মরণ আর কি! আমাগো জন্যি কেউ বাবে না।”

    খাইতে খাইতে বছির জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা, দাদা! সগল কারিকরগো অবস্থাই তোমার মত নাকি?”

    রহিমদ্দী বলে, “তাগো অবস্থা আরও খারাপ। কারিকর পাড়ায় হাহাকার পইড়া গ্যাছে।”

    এত সব কথা বছিরকে বলিয়া কি লাভ হইবে? তবু তার কাছেই রহিমদ্দী সকল কথা ইনাইয়া বিনাইয়া বলে। দুঃখের কথা বলিয়াও হয়ত কিছুটা তৃপ্তি পাওয়া যায়।

    রহিমদ্দীর কাছে বছির আরও অনেক খবর পাইল। মেনাজদ্দী মাতবর ভেদবমি হইয়া মারা গিয়াছে। মৃত্যুর পর তার যা কিছু জমি-জমা সাতে ভূতে দখল করিয়া লইয়াছে। সেন। মশায় ডিক্রী জারী করিয়া তাহার বিধবা বউকে পথের ফকির করিয়াছে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি করিয়া এখন তাহার দিনাতিপাত চলে।

    .

    ৩৪.

    ফতেহায়ে দোয়জ দাহম উপলক্ষে ফরিদপুরে বিরাট সভা হইবে। কলিকাতা হইতে ইসলাম প্রচারক মাওলানা আলিম উদ্দীন সাহেব, মাওলানা তোফেল আহমদ সাহেব প্রভৃতিকে দাওয়াত দেওয়া হইয়াছে। এই উপলক্ষে রমিজদ্দীন সাহেব একটি কমিটি গঠন করিয়াছেন। ফোরকানিয়া মাদ্রাসার তালেব-এলেমরা রঙিন ব্যাজ পরিয়া এ-কাজে ছুটাছুটি করিতেছে।

    একদিন রমিজদ্দীন সাহেব মাদ্রাসার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে বছিরকে দেখিতে পাইলেন। তিনি চোখ দুটি লাল করিয়া রাগের সঙ্গে বছিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এখানে এলে কেমন করে?”

    শুনিয়া বছির ভ্যাবাচেকা খাইয়া গেল। সঙ্গের তালেম-এলেমরা বলিল, “বছির ত আমাগো এহানে মসজিদে থাইকা পড়াশুনা করে। ইস্কুলে যায়।”

    শুনিয়া উকিল সাহেবের রাগে যেন আরও ইন্ধন পড়িল। তিনি মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডাকিয়া গোপনে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলিয়া চলিয়া গেলেন।

    ইমাম সাহেব বছিরকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ বছির! তুমি এখনই মসজিদ হইতে চইলা চাও।” বছির তাহার কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করিল। ইমাম সাহেব বলিলেন, “আমি ত তোমারে থাকনের জায়গাই দিছিলাম। কিন্তুক উকিল সাহেব ত মানেন না। তুমি তানার বিপক্ষ লোকের বাড়ি যাও। সমাজে যাগো তিনি বন্ধ থুইছেন, তাগো বাড়ি যায় খাও। সেই জন্যি উকিল সাহেব তোমারে তানার বাসায় ত্যা খ্যাদায়া দিছিলেন। তিনি যহন তোমার উপর বিরূপ, আমি কেমন কইরা জাগা দেই?”

    বছিরের চোখ দুটি হইতে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরিতে লাগিল। ইমাম সাহেব তার গামছা দিয়া বছিরের মুখ মুছাইতে মুছাইতে বলিলেন, “বাবা বছির! আল্লার উপর ভরসা রাইখ। তানি যখন মুখ দিছেন খাওনও তানিই দিবেন। তুমার মনে যদি বড় হবার খাহেছ থাকে কেউ তুমার পথে বাধা ঐতি পারবি না।” মসজিদের তালেব-এলেমরা নিকটে দাঁড়াইয়া সবই শুনিতেছিল। তাহারা বছিরকে কোন সান্ত্বনাই দিতে পারিল না।

    ধীরে ধীরে বছির ইমাম সাহেবের নিকট হইতে বিদায় লইয়া তাহার আধ-ছেঁড়া লুঙ্গিখানার মধ্যে বই-পত্রগুলি বাধিতে লাগিল। সেই বন্ধনের এক একটি মোচড়ে কে যেন তাহার সমস্ত দেহ-মনকে বাঁকাইয়া দুমড়াইয়া দিতেছিল। বই-পত্র বাধিয়া বছির ভাবিতে বসিল, এখন সে কোথায় যাইবে? কোথায় যাইয়া সে আশ্রয় পাইবে? মুর্শীদার ফকির গান গায়–

    আমি আশা কইরা বাঁধলাম বাসা,
    পুরিল মনে আশারে;–
    আমার আশা-বৃক্ষের ডাল ভাঙ্গিয়া গেলরে।

    আজ বছিরের কেবলই মনে হইতেছে, তার মত মন্দভাগ্য বুঝি পৃথিবীতে আর কেহ নাই। সে যেন অচ্যুৎ পারিয়ার চাইতেও অধম। আকাশ, বাতাস, সমস্ত পৃথিবী যেন তাহাকে বেড়িয়া কেবলই বলিতেছে, ধিক্কার, ধিক্কার! কোথায় সে যাইবে! কার কাছে গেলে তার দুঃখ জুড়াইবে!

    মজিদ আর করিম আসিয়া বছিরের পার্শ্বে বসিল। “ভাই বছির! ভাইব না। হাফিজ মিঞার হোটেলে যদি থাকনের জায়গা করতি পারি, এ বাড়ি ও-বাড়ি দাওয়াত খাওয়াইয়াই আমরা তোমারে চালায়া নিব। তুমি আমাগো লগে চল!

    বছির তাহাদের সঙ্গে হাফিজ মিঞার হোটেলে চলিল। সমস্ত শুনিয়া হাফিজ মিঞা বলিল, “আমার হৈটালে উয়ারে আমি জাগা দিতে পারি, যদি নগদ পয়সায় দুই বেলা ও আমার এহানে ভাত খায়।”

    এই অসহায় ছাত্রটিকে আশ্রয় দিলে তাহার কত ছওয়াব হইবে কোরান কেতাবের আয়াত আবৃত্তি করিয়া তাহারা ইহার মনোরম বর্ণনা দিল, কিন্তু হাফিজ মিঞা কিছুতেই টলিল না। বই-পত্রের বোঁচকা কাঁধে লইয়া বছির সেখান হইতে বাহির হইল। মজিদ আর করিম তাহার পাছে পাছে আগাইতে লাগিল।

    ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বছির বলিল, “ভাই! তোমরা আমার জন্যি আর চেষ্টা কইর না। দেখছও না, আমি যে ডাল ধরি সে ডাল ভাইঙ্গা যায়। আমার মত বদ-নছিবের সঙ্গে তোমরা আর জড়াইয়া থাইক না।”

    মজিদ বলিল, “ভাই বছির! আমাগো কোন খ্যামতাই ঐল না যে তুমার কোন উপকার করি। আমরাও তুমার মত নিরাশ্রয়।” বলিয়া মজিদ কাঁদিয়া ফেলিল।

    করিম বলিল, “দেখ ভাই! যখন যেহানে থাহ আমাগো কথা মনে কইর। আমাগো দুস্কের দিন। তবু মনে কইর, আমাগো সেই দুস্কির মদ্দিও তোমার কথা বুলব না।” বছির ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “ভাই! তোমাগো কথা আমি কুনু দিনই বুলব না। তোমরা যে পক্ষি-মার মত ঠোঁটের আধার দিয়া প্রতিদিন আমারে পালন করছ, তাকি বুলবার? যাও ভাই, তোমরা মসজিদে ফিরা যাও। জীবনে যদি কুনু দিন বড় ঐবার পারি তোমাগো পাশে আবার আইসা খাড়াব।” এই বলিয়া বছির পথ চলিতে লাগিল। করিম আর মজিদ সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল।

    চলিতে চলিতে বছির ভাবে, “এখন আমি কোথায় যাই! বাড়ি যদি ফিরিয়া যাই সেখানে আমার পড়াশুনা হইবে না। আমার পিতা আমার মা কত আশা করিয়া আছে, লেখাপড়া শিখিয়া আমি বড় হইব। আমার জন্য তাহারা কত কষ্ট স্বীকার করিতেছে। আজ আমি ফিরিয়া গেলে তাহারা আশা ভঙ্গ হইয়া কত দুঃখ পাইবে। কিন্তু কোথায় আমি যাইব? রহিমদ্দী দাদার ওখানে গেলে আশ্রয় মিলিবে। কিন্তু তাহারা নিজেরাই খাইতে পায় না। আমাকে খাওয়াইবে কেমন করিয়া? এক আছে আরজান ফকির আর তার বউ। তারা কি আমাকে আশ্রয় দিবে?” কিন্তু তাদের অবস্থা এখন কেমন তাও সে জানে না। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া বছির পদ্মানদী পার হইয়া চরের পথ ধরিল। যেখানে একদিন সরষে ফুলের বাহার দেখিয়াছিল আজ সেখানে মাটি ফাটিয়া চৌচির হইয়াছে। এখানে সেখানে কাটা সরিষার গোড়াগুলি দাঁত বাহির করিয়া যেন তাহাকে উপহাস করিতেছে। তাহারই নিরাশ হৃদয়ের হাহাকার যেন দূর্ণী হাওয়ায় ধূলি উরাইয়া মাঠের মধ্যে বৈশাখ-রৌদ্রে দাপাদাপি করিতেছে।

    .

    ৩৫.

    দুপুরের রৌদ্রে ঘামিয়া শ্রান্ত-ক্লান্ত হইয়া বছির আরজান ফকিরের বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। ফকির ভিক্ষা করিতে গাওয়ালে গিয়াছে। ফকিরনী তাহাকে দেখিতে পাইয়া জড়াইয়া ধরিল, “আরে আমার গোপাল আইছে। আমি পথের দিগে চায়া থাহি। এই পথদ্যা নি আমার। গোপাল আসে।” ফকিরনী বছিরকে ধরিয়া লইয়া ঘরের মেঝেয় একটি খেজুরের পাটি। বিছাইয়া বসিতে দিল। তারপর একখানা পাখা লইয়া বাতাস করিতে করিতে লাবণ্যভরা তাহার শ্যামল মুখোনির দিকে চাহিয়া রহিল। আহা! এই ছেলে যদি তাহাকে মা বলিয়া ডাক দিত! কিন্তু ফকিরনীর কি আছে যে এই আসমানের ফেরেস্তা-শিশুকে সে স্নেহের বন্ধনে বাঁধিবে? ঘরে ভাল খাবার নাই যে তাহার হাতে দিবে? সমস্ত বুকভরা তার বাৎসল্য-স্নেহের শূন্যতার হাহাকার। এখানে এই দেব-শিশু কি কাজল মেঘের বারিধারা বহিয়া আনিবে?

    খানিক বাতাস করিয়া ফকিরনী ঘরের মুড়ির কোলা হাতাইতে লাগিল। শূন্য কোলায় ফকিরনীর হাতের রূপা-দস্তার বয়লার লাগিয়া টন টন করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। সেই শব্দ তাহার মাতৃ-হৃদয়কে যেন ভাঙ্গিয়া চুরিয়া দিল। ফকিরনী বলিল, “বাজান! তুমি একটু বইসা জিড়াও। আমি এহনই আত্যাছি।” সামনে আরসাদের বাড়ি। আরসাদের বউকে যাইয়া বলিল, “বউ! ভাত আছে নি?”

    বউ বলিল, “ভাত ত আছে চাচী, কিন্তুক খাইবার ছালুন নাই। আমাগো বাড়ির উনি গ্যাছে মাছ মারতি। ভাত রাইন্দা বইসা আছি। দেহি মাছ যদি মাইরা আনে তয় ছালুন। রানব। না হৈলে কাঁচা মরিচ আর নুন দিয়া আইজ বাত খাইতি অবি। তা বাতের কথা জিজ্ঞাসা করলা ক্যান চাচী?”

    ফকিরনী বলে, “আমার এক ছোট বাজান আইছে শহর থইনে। গরে একটাও চাইল নাই। বাজানের কি খাইতে দিব? তয় দেলো বউ! এই ক্যালা পাতাড়ার উপর চারডা বাত দে। বাজানের সামনে দরবানি।”

    বউ কলাপাতার উপর সামান্য কিছু ভাত দিল। বেশী দিতে পারিল না। তাহাদের ত দুইজনের মাপা ভাত। সেই ভাত লইয়া ফকিরনী আর এক বাড়ি হইতে একটু শাক আর ডাল লইয়া আঁচল আড়াল করিয়া তার ছোট রান্নাঘরে ঢুকিল। তারপর মাটির সানকিতে সেই ভাত বাড়িয়া বছিরের সামনে আনিয়া ধরিল।

    বছির হাত মুখ ধুইয়া খাইতে বসিল। ফকিরনী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

    “বাজান! এবার আর তোমারে যাইবার দিব না। আমার চক্ষের কাজল কোঠার ঘরে। তোমারে বন্দী কইরা রাখপ।”

    খাইতে খাইতে বছির বলিল, “ফকির মা! আমার মতন জনম দুঃখী আর কেউ নাই। আমি তোমাগো বাড়ি আশ্রয় নিবার আইছি।”

    বছিরের মুখে ফকির-মা ডাক শুনিয়া ফকিরনীর বুক যেন জুড়াইয়া গেল। তার বুকের মাতৃস্নেহের সারিন্দাখানি সহস্র তারে বাজিতে লাগিল।

    “বাজান! তুমি যদি দয়া কইরা আমাগো এহানে থাহ তয় যে আমি আসমানের চান আতে পাই। আমি নগরে ভিক্ষা মাইঙ্গা তুমারে খাওয়াব।”

    বিকালে ফকির ভিক্ষা হইতে আসিয়া বছিরকে দেখিয়া বড়ই খুশী হইল। বিশেষ করিয়া বছির যে চিরস্থায়ী ভাবে তাহার বাড়িতে থাকিতে আসিয়াছে ইহাতে যেন সে হাতে স্বর্গ পাইল। নিজের সমস্ত ঘটনা বলিতে বলিতে বছির কাঁদিয়া ফেলিল।

    গামছা দিয়া তাহার মুখ মুছাইতে মুছাইতে ফকির বলিল, “বাজান! আমার সানালের আস্তানায় যখন আইছ, দুঃখ কইর না। দুঃখের অবহেলা করার শিক্ষাই আমার ফকির আমারে দিছে। একদিন আমিও তোমার মত দুঃখ পায়া চোখের পানিতে বুক ভাসাইতাম। সেই দুস্কৃ ভুলবার জন্যি সারিন্দা বাজান ধরলাম। একদিন সেই সারিন্দার সুরির উপর সানাল চান আইসা সোয়ার ঐল। তিনি আমার সগল দুষ্ণু লয়া গ্যালেন।” এই বলিয়া ফকির গান ধরিল–

    “তুমি যে হালে যে ভাবে
    রাখছরে দয়াল চান তুই আমারে?
    ও আমি তাইতে খুশী আছিরে।
    কারে দিছাও দালান কোঠা,
    আরে দয়াল আমার গাছের তলারে।”

    গান শেষ হইলে বছির ফকিরকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা ফকির বাবা! কও ত? তোমার এই সানাল চান কেডা?”

    ফকির হাসিয়া বলিল, “বাজানরে! সে যে কেডা তা আমিও জানতি পারি না। হুনছি নুরুল্লাপুরে এক সানালের বাড়ি ছিল। তা তানার খোঁজ আমি করি না। আমি খুঁজি আমার মনের সানালরে। যে সানাল দুঃখী মানষির দুক্ষু হরণ কইরা লইয়া যায়। যার কেউ নাই। তার সঙ্গে যায়া বসত করে। আমার সানাল চান বাণিজ্যে যায়, জলের কৃম্ভীর বইঠা বায়। দুঃখী তাপিত ব্যথিত-জনের অন্তরে অন্তরে তার আসা যাওয়া। আমার গুরু, তার গুরু, তার গুরু, সয়াল সংসারের যত মানুষ আল্লার আলম ভইরা গানের বাজনায় সুখি-দুঃখী যে দরদের দরদীরে মনে মনে চিন্তা করছে, আমার দয়াল চান সেইজন। তারে মনের চক্ষি দেখা যায়। বাইরের চোহে সে ধরা দ্যায় না। এই বলিয়া ফকির আবার গান ধরিল–

    “মন চল যাইরে,
    আমার দরদীর তালাশেরে;
    মন চল যাইরে।
    হাল বাও হালুয়া ভাইরে হস্তে সোনার নড়ি,
    এই পথদ্যানি যাইতে দেখছাওরে আমার
    সানাল চান বেপারী।
    জাল বাও জালুয়া ভাইরে হস্তে সোনার রশি,
    এই পথদ্যানি যাইতে দেখছাওরে আমার
    সানাল চান সন্ন্যাসী।
    দেইখাছি দেইখাছিরে আমরা সানাল চান সন্ন্যাসী,
    ও তার হাতে আসা বগলে কোরান করে মোহন বাঁশী।
    হাইটা হাইটা যায়রে সানাল দীঘল পন্থরে বায়া,
    আমার মনে বলে তারে আমি কোলে লই যায়।”

    “বাজানরে! এই আমার সানাল চান। যারে দেইখ্যা আমার ভাল লাগে সে-ই আমার সানাল চান। এই যে তুমি আইছ আমার ঘরে তোমারে দেইখা আমার বুকির মায়া উতলায়া। উঠছে। আইজ তুমিই আমার সানাল চান।” ফকিরের কথাগুলি যেন ফকিরনী সারা অন্তর দিয়া অনুভব করিতেছিল। এ যেন তারি মনের কথা ফকিরের মুখে প্রকাশ পাইল। কিন্তু এত সব তত্ত্ব-কথা বছির বুঝিতে পারে না। কেমন যেন লজ্জায় তার শ্যামল, মুখোনি রাঙা হইয়া ওঠে।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleষোল-আনি – জলধর সেন
    Next Article ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }